॥ ৩ ॥
একটা বাসন্তী রঙা কমদামি সুতির সালোয়ার-কামিজের উপর নীল ওড়না জড়িয়ে যে কুড়ি-একুশ বছরের মেয়েটা দরজা খুলে দিল শর্মিলাকে, তার বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল তাকে চিনে নিতে! জামাটা কমদামি হলে কী হবে, খুব যত্ন করে কেচে পরা। বোওয়া চুল পিঠের উপর ছড়ানো। পিছনে ক্লিপ আটকানো। এই ক্লিপগুলো হাতিবাগান মার্কেটের ফুটপাতে থরে থরে বিক্রি হয়, এইটুকু লক্ষ করতে না-করতেই মেয়েটা বলে উঠল, “ভানুদি? তুমি? কতদিন পর এলে! ভানুদি এসেছে মা!”
দোতলার টানা বারান্দায় গায়ত্রীকে দেখা গেল, “কে? ও মা, ভানু তুই? আমি ভাবছি, এই ভরদুপুরে কে এল?”
সানগ্লাস ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে শর্মিলা ঢুকে এল সদর পার করে বাড়ির মধ্যবর্তী চাতালে। দুপুরের এই সময় চাতালের উপর এসে পড়া রোদের রং আর রেখা অপরিবর্তিত। একতলাটা নতুন চুনকাম করা হয়েছে। জানলা দরজাতেও লাগানো হয়েছে বটল-গ্রিন তেলরং। অবশ্য একতলার সব ঘরের দরজায় ঝুলছে তালা। ঢুকে এসে শর্মিলা বলল, “আমি তো ডালিয়াকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি মামি! ভেবেছি, নতুন ভাড়াটে টাড়াটে এসেছে হয়তো!” যতটা উচ্ছ্বাস সে ফোটাতে চাইল গলায়, ততটা ফুটল না। সে নিজেও ঠিক জানে না, আজ অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটে ছ’বছর পর সে কেন এসেছে!
গায়ত্রী উপর থেকে বলল, “আয়, আয় ভানু, তা তোর মুখটা এমন লাগছে কেন রে? রোদ লাগল কী করে? গাড়ি চড়ে আসিসনি? তোর বর তোকে ছাড়ল? বাবাঃ! এলি তা হলে? মনে পড়ল আমাদের?”
সে বুঝতে পারল, সিঁড়ি দিয়ে তার পিছন পিছন উঠে আসতে আসতে ডালিয়া তাকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে। তার হাইট বেশ ভাল, পাঁচ পাঁচ। তার উপর পেনসিল হিল পরেছে। ছ’ বছর পর এই বাড়িতে ঢুকে তার মনে হচ্ছে, বাড়িটা কী ছোট, ঠাসা ঠাসা ঘর, মাত্র এক কাঠা ছ’ ছটাক জমির উপর কী করে এতগুলো ঘর, রোয়াক, চাতাল, কলতলা, রান্নাঘর, সিঁড়ি সব বেরোল? আগে যখন এবাড়িতে সে থাকত, তখন এই প্রশ্ন তার কখনও মনে আসেনি। এখন আসাটা স্বাভাবিক। কারণ, এখন সে সারাক্ষণ জমি, বাড়ি, প্রপার্টি সংক্রান্ত নানা আলোচনা শুনছে। আদিত্যকে এটা কিনতে, ওটা বিক্রি করতে দেখছে। তা ছাড়া ‘ইস্ট সিটি’তে তাদের বাসস্থানই তো প্রায় তিন হাজার স্কোয়্যার ফুটের। আঠাশ তলার উপর একটা খোলা ছাদও আছে, যেখানে অনায়াসে কুড়ি-পঁচিশ জনের জন্য একটা পার্টি থ্রো করা যায়! সত্যি, এত বড় বাড়িতে সে এখন থাকে, কিন্তু বাড়িটার একটা ছোট্ট কোণও কখনও তার একাকিত্বের আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে না! এত বড় বাড়ি, অথচ লুকোনোর একটা অন্ধকার স্থান নেই। আর এবাড়িতে কত যে গোপন জায়গা ছিল! চোখের জল ফেলার, রাগ করে সকলের চোখের আড়ালে থাকার, চুপচাপ বসে মোটা মোটা বই সারা বেলা ধরে পড়ে ফেলার কত ছোট ছোট অমোঘ সব ঠাঁই, যেখানে আত্মলীন হয়ে যাওয়া যেত! শর্মিলা ভাবল, তখন তো অনেক কিছুই মনে হত বড় কষ্টের, বড় দুর্ভোগের। আজ এত বছর পর একটা কমফর্টেবল লাইফে থেকেও, এত আরাম-ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও তার কেন যে অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটের স্মৃতিকে, সমস্ত স্মৃতিকে বড় প্রিয়, বড় মধুর লাগে, কে জানে!
এত কাল পরে আসা হল, প্রথম মিনিটপনেরো কে কী বলছে, কোনও ঠিক রইল না। গায়ত্রী গায়ত্রীর মতো বলে যাচ্ছে, শর্মিলা শর্মিলার মতো বলে যাচ্ছে, ডালিয়াও প্রশ্ন করছে! তিনজনই একটু হাঁপিয়ে গিয়ে বসল দোতলার ডালিয়ার ঘরে। ছোটমামা অফিসে, ফিরতে বিকেল।
গায়ত্রী বলল, “ও ভানু, তুই দুটো ভাত খা? দুপুরে এলি যখন? গরিব মামার বাড়িতে শুধু ভাত, ডাল চচ্চড়ি, খাবি?”
শর্মিলা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “মামি, তুমি আর গরিব সেজো না। আজকাল সরকারি চাকরির মাইনে অনেক। তার উপর মামা তো কত বছর চাকরি করছে!”
গায়ত্রী ফিক করে হেসে বলল, “তোর মামাকে বুড়ো বললে রেগে যায়! তা ও বুড়ো নয়, বল?”
সে বলল, “তুমি কিন্তু একদম ইয়ং আছ। ফিগার সেই আগের মতো, পান খাওয়াটা ছাড়োনি এখনও মামি?”
ডালিয়া বলল, “ভানুদি, তুমি এখন আরও সুন্দরী হয়েছ। কী দারুণ দেখাচ্ছে তোমায়!”
শর্মিলা ঘুরে বসল ডালিয়ার দিকে, “দাঁড়া, দাঁড়া, তোকে আগে দেখি! বাবা, এ তো বিউটি কুইন! পাড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে নাকি? মামার চোখে ঘুম নেই?”
মামি বলল, “ও ভানু শোন, এবার দুর্গাপুজোয় ডালিয়া তো লাল পাড় শাড়ি টাড়ি পরে অঞ্জলি দিতে গেছে। আর কারা সব এসেছিল টুরিস্ট, তারা ডালিয়াকে দাঁড় করিয়ে একের পর এক ছবি তুলছে! আয়েষার বড় মেয়েটাকে সবাই বলে অপূর্ব সুন্দরী। তার ছবি কেউ তোলেনি। তাই আয়েষা তো রেগে কাঁই! তুই তো জানিস, আয়েষার কী অহংকার! তা তুমি বিশ্বম্ভর ঘোষের ছেলের বউ সে পাড়ায়, বেপাড়ার লোক তোমায় পাত্তা দেবে কেন, তারা জাপানি টুরিস্ট বুঝলি…”
“আঃ মা, চুপ করো তো!” বলে উঠল ডালিয়া।
“তুই থাম, বলতে দে।”
শর্মিলা দেখল, তার শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠছে। চনমন চনমন করে উঠছে মনটা। আঃ, পাড়াটা ছ’বছরে কিছুই বদলায়নি। বদলালে সে বেশ দুঃখ পেত। এসব কাসুন্দির স্বাদ সে কত দিন পায়নি! তার মনে হচ্ছে, মামি আরও বলুক এসব, এপাড়ার হাল হকিকত। তার কথা কেউ বলে? বলে না?
সে বলল, “ও, আয়েষার বড় মেয়েটা বুঝি খুব সুন্দরী? কত বয়স হল গো?”
মামি বলল, “ডালিয়ার চেয়ে ছোট, আঠারো-উনিশ হবে। সুন্দরী ঠিকই, কিন্তু স্কিনটা ভাল না। মুখে ব্রণ হয় খুব, আয়েষার মতো রূপ পায়নি। আয়েষা তো রূপের জোরে তরে গেল বল?”
ডালিয়া বলল, “আয়েষাদিকে দেখলে তুমি চিনতেই পারবে না। মাড়োয়ারি বউদের মতো মোটা। থপথপ করে হাঁটে!”
“তুই কিন্তু একদম মোটা হোসনি ভানু!”
সে বলল, “আয়েষা তো আমার চেয়ে অনেক বড় মামি। সাত-আট বছরের বড়।”
“হ্যাঁ, অভীক আর আয়েষা তো একই বয়সি, না? তোর আর অভীকের ম্যাচটাই বেশি ভাল ছিল। বাবা, আয়েষা কী বউই না হয়েছে, সারাদিন পাড়া বেড়াচ্ছে, বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সকলের সঙ্গে গল্প করছে। অত বড় বাড়ির বউ, ম্যাক্সি পরে রাস্তায় বেরোয়। সে বেলা কিন্তু কেউ কিছু বলে না। অন্য বউরা কেউ কিছু করুক, সকলে অমনই সমালোচনা করা শুরু করে দেবে! হ্যাঁরে ভানু, তোর বরের তো কতগুলো গাড়ি, একটা বেশ বড় গাড়ি চড়ে এসেছিস তো?”
সে বলল, “না মামি। আদিত্যকে না বলে এসেছি, মনটা খুব টানছিল। পাড়ার মোড়ে এসে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলাম। আজ ভোরে স্বপ্ন দেখলাম, তুমি নিম-বেগুন ভাজা করেছ আর আমাকে কুণ্ডুদের পাঁচিলের এপাশ থেকে ডাকছ ভাত খাওয়ার জন্য!”
“মাছ না, মাংস না, নিম-বেগুন ভাজা? আশ্চর্য! আজ নিম-বেগুন তো ভেজেছি। চল, খাবি চল।”
“তোমরা এখনও খাওনি?”
“না, এবার বসব। ‘ভাইবোন’ সিরিয়ালটা দেখেই বসতাম, আয়।”
“না, না, মামি, আমি খাব না। আমি লাঞ্চ করে বেরিয়েছি।”
“আবার কথা বলে!”
“ভানুদি, তুমি না খেলে আমি খাবই না!”
ডালিয়ার মধ্যে সেই নেতিপেতি ভাবটা এখনও রয়ে গেছে। এই বোনটাকে সে খুবই ভালবাসত। শর্মিলা ভাবল, এত বছর ধরে আদিত্যর বাধাদানের ফলে এবাড়িতে যাতায়াতটা বন্ধ করে সে অন্যায়ই করেছে, ভুলই করেছে। কই আদিত্য তো নিজের কোনও কিছু বন্ধ করেনি? বাড়ি, বাবা-মা, আত্মীয়পরিজন, মায় প্রাক্তন স্ত্রী, সকলের সঙ্গেই লোকটার অবারিত যোগাযোগ। আর তার বেলা যত শাসন! হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ছোটমামা আদিত্যর সঙ্গে তার বিয়েটা মেনে নেয়নি। সে প্রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েই বিয়েটা করেছিল এবং বিয়ে করে আদিত্যকে নিয়ে সে প্রণাম করতে এলে ছোটমামা প্রণাম গ্রহণ করেনি, তেমন কথাও বলেনি। তাই আদিত্যর রাগ থাকতেই পারে। কিন্তু সে তো আদিত্যর বাবা-মাও তাকে সেভাবে মেনে নেননি। তা বলে কি সে আদিত্যকে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বাধা দিচ্ছে? আর নর্থ ক্যালকাটার সব কিছু যদি অতই খারাপ, আদিত্যর ভাষায়, ‘ঝুরঝুরে ড্যাম্প লাগা তোশকের মতোই হয়ে থাকে, তা হলে সে-ও তো নর্থের মেয়ে, তাকে আদিত্যর এত পছন্দ হল কেন?
ডালিয়া যে ছোটবেলায় তার খুব হাতধরা ছিল, তা নয়। পনেরো বছরের ছোট বোন, কলেজে পড়া দিদির সঙ্গে একটা দূরত্ব তো থাকেই। তারপর চাকরিতে ঢোকার পর শর্মিলা তো বাড়ির বাইরেই থাকত গোটা দিন। আদিত্যর সঙ্গে প্রেম পর্বে তো রাতে এসে শোওয়াটুকু এবং বাইরেই খেয়ে আসত। ফলে ডালিয়ার ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা তার নজর একরকম এড়িয়েই গেছে। তবে ডালিয়া খুব শান্তশিষ্ট ছিল, মনে পড়ে শর্মিলার। আজ ডালিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তার নতুন করে মায়া জন্মাল যেন। শর্মিলার তো কোনও বন্ধু নেই। ডালিয়া হোক ছোট, তবু বোন তো। তাই ডালিয়া তার বন্ধুও তো হতে পারে, সে ভাবল। এবার আদিত্য টুরে গেলে সে ডালিয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, শপিং করবে, বড় রেস্তরাঁয় খাবে। এই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তাকে আনন্দ দিল এখনই। এমন স্পষ্ট আনন্দ সে অনেক দিন অনুভব করেনি! সে সেই আতিশয্যে বোনকে তিরস্কারও করল একটু, “ওঃ, এখন দরদ উথলে পড়ছে দিদির উপরে? কই একবার তো একটা ফোনও করিস না দিদিকে?”
ডালিয়া বলল, “বাবা তো দেয় না করতে! জানোই তো বাবা কেমন!”
“তুই পার্ক স্ট্রিটের দিকে যাস না কখনও? আমার অফিসে আসতে পারিস তো?”
“পার্ক স্ট্রিট! আমি জীবনে দু’বার গেছি! বাবা নিয়ে গেছিল, পঁচিশে ডিসেম্বর।”
“পঁচিশে ডিসেম্বর যাবি না। যাবি ক্রিসমাস ইভে, চব্বিশের সন্ধেবেলা, তা হলে অনেক কিছু দেখতে পাবি।”
“তাই?”
গায়ত্রী বলল, “তুই কেন এখনও তেতেপুড়ে চাকরিটা করছিস ভানু? তোর কি টাকার অভাব? কোথায় পায়ের উপর পা তুলে খাবি আর দামি দামি শাড়ি-গয়না কিনবি, তা না, রোজ অফিসে যাওয়ার ঝঞ্ঝাট পোহাচ্ছিস!”
সে বলল, “বাড়িতে বসে থাকার কথা আমি তো ভাবতেই পারি না মামি! সে এক যদি খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেত, সংসারে ঢুকে যেতাম, তা হলে হত। একবার বাইরের জগৎটা দেখে নিয়ে আর সম্ভব নয়।”
মনে মনে একথা বলে শর্মিলা হাসল। হাঃ! কী বাইরের জগৎই না দেখছে। ওই অফিসে আসে-যায় সেজেগুজে, ওই পর্যন্তই। সবটাই তো আদিত্যর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। চাকরি তো আদিত্যই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বন্ধুর কোম্পানিতে। কারণ, বিয়ের পর তাকে আর নিজের কোম্পানিতে রাখতে চায়নি।
হঠাৎ মামি বলল, “তা তুই একটা বাচ্চা টাচ্চা নিলি না? তোর তো সন্তান-সুখ হল না, ওঁর না হয় ছেলে আছে।”
সে বলল, “ছাড়ো, চলো, দুটো ভাত খাই তোমার সঙ্গে।”
দোতলার রান্নাঘরটা খুব বড়। রান্নাঘরেরই এক কোণে খাবার টেবিল পাতা আছে। টেবিলও সেরকমই টেবিল! অ্যালুমিনিয়াম পাত দিয়ে উপরটা মোড়া।
গায়ত্রী বলল, “এখানে তোর খুব গরম লাগবে ভানু। বরং আমার ঘরের মেঝেতে বসে খাবি? আমার ঘরে নতুন ফ্যান লাগানো হয়েছে। হাওয়াটাও বড় মিষ্টি!”
মেঝেতে বসে খাওয়া অসম্ভব! পেট চেপে বসতে হলে সে মরে যাবে। আবার এখানে রান্নাঘরের গরম, শর্মিলা দু’ সেকেন্ডের জন্য মহা ধন্দে পড়ল। আর সত্যি নর্থের লোকেরা বড় কিপটে হয়! জীবনযাপনের ধরনধারণের মধ্যে কোনও শ্রী নেই। আরামপ্রদ জীবনের কী অনুষঙ্গ, তা নিয়ে উত্তরের লোকেরা আজও বড় উদাসীন। নইলে ছোটমামা এই রান্নাঘরটা একটু সারাতে পারে না? একটা ডাইনিং টেবিল কিনতে পারে না, একটা ফ্যান সেখানে দিতে পারে না? বাড়িঘর করতে হয়নি। ছেলে নেই যে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার করতে খরচ হয়েছে। মেয়ের এখনও বিয়ে হয়নি, টাকা নিয়ে মামা করছেটা কী?
শেষ পর্যন্ত শর্মিলা গায়ত্রীর ঘরের মেঝেতেই আসন পেতে বসল খেতে। তিনজনের কথাবার্তার কোনও বিরতি নেই। মোটা ভারী স্টিলের থালায়, স্টিলের গ্লাসে খেতে দিয়েছে গায়ত্রী তাকে। শর্মিলার সংসারে ছুরি, কাঁটা-চামচ ছাড়া স্টিলের কোনও বাসন নেই। অবশ্য আদপেই যদি ওটাকে কোনও সংসার বলা চলে।
নিম-বেগুন পাতে পড়তেই শর্মিলার মনটা ভারী হয়ে গেল খুব। সে বলল, “আমার কি কানাই জেঠার বাড়ি একবার যাওয়া উচিত জেঠিমার সঙ্গে দেখা করতে? এসেই পড়েছি যখন?”
হাতা রয়েছে ডালে, মাছের ঝোলের বাটিতে। গায়ত্রী ভাত তুলে দিচ্ছে হাতে করে, লাউ-চিংড়ি দিল হাতে করে! শর্মিলার একটু ঘেন্না ঘেন্না করল, মেঝেতে বসে খাওয়া, খাটের তলায় ঝুল রয়েছে দেখা যাচ্ছে, একটা-দুটো চুল উড়ছে মাটিতে, সে চোখ সরিয়ে নিতে নিতে ভাবল, নর্থের লোকেরা কখনও বদলায় না। গায়ত্রী তাকে যা ভাত দিয়েছে, সে সারা সপ্তাহে অত ভাত খায় না। সে বারবার অনুনয় করল ভাত তুলে নিতে, লাগলে পরে নেবে। গায়ত্রী আর ডালিয়ার থালাতেও পাহাড়প্রমাণ ভাত, এত ভাত খেয়েও গায়ত্রী বা ডালিয়ার শরীরে কোনও মেদ নেই। আর সে তিনটে দিন যদি একটু রুটিনের বাইরে গিয়ে খায়, তার গাল নাকি টোপা টোপা হয়ে যায়, তলপেট ঝুলে আসে, অবশ্য আদিত্যর উক্তি অনুযায়ী! গায়ত্রীকে ভীষণ হিংসে হল শর্মিলার এই একটা ব্যাপারে। কত ভাত খাচ্ছে গায়ত্রী সপসপ করে গ্রাস তুলে। গায়ত্রীর রান্না বরাবরই খুব ভাল। কিন্তু সেই সকালে রান্না হয়েছে, খেতে বসার আগে সেগুলো নতুন করে গরমও করেনি। শর্মিলার মনে পড়ল, এসব আগে তার কাছে অতি স্বাভাবিক ছিল। নিম-বেগুন খেতে তার বেশ লাগল। কিন্তু কাঁসার পাত্রে রাখা মুগের ডালে সে যেন কেমন ধাতু ধাতু গন্ধ পেল। তবু তার সম্যক টান কম হল না। সে গল্প করতে করতে খেতে লাগল, “ঠিক সাড়ে চারটের সময় বেরিয়ে যাব মামি, গাড়ি আসবে অফিসে ছ’টার মধ্যে।”
গায়ত্রী বলল, “মাঝে মাঝে এরকম চলে আসিস। আর যাওয়ার সময় চাইলে যেতে পারিস কানাইদার বাড়িতে।”
এই সময় ডালিয়ার ফোন বেজে উঠল। ফোন ধরে ডালিয়া বলল, “হ্যাঁ খাচ্ছি। খেয়ে যাচ্ছি। আসলে ভানুদি এসেছে তো, খুব গল্প হচ্ছে?”
সে বলল, “কে রে? কোথায় যাবি?”
ডালিয়া বলল, “আয়েষাদির বাড়ি। আয়েষাদির বড় মেয়ের পরীক্ষা হয়ে গেছে বলে এখন করার কিছু নেই। আমরা দু’জনে দুপুরে বসে গল্প করি, ফেসবুক করি, সিনেমা দেখি, গান শুনি…ছোট মেয়েটাও আসে মাঝে মাঝে। আর্যদার মেয়ে রুমনিও আসে। খুব মজা হয়। আমি একটু বড় ওদের চেয়ে, কিন্তু আমার ভালই লাগে। আমিই বা আর কী করব বলো ভানুদি? কলেজের বান্ধবীরা কেউ কাছে থাকে না। হয় সিঁথির মোড় না হয় হেদুয়া। বাবা কোথাও যেতে দেবে না। এপাড়ায় এখন আমার বয়সি মেয়ে প্রায় নেই বললেই চলে।”
“তুই এম এ-টা করলি না কেন?” বলল শর্মিলা।
“বাবা তো গত বছর থেকেই বিয়ে দেবে বলে উঠেপড়ে লেগেছে! বলে দিয়েছে, এখন আর বাড়ির বাইরে যেতে হবে না। বিয়ে করে মাস্টার ডিগ্রি কোরো, যা খুশি কোরো! কী পাগল, বলো?”
“ওমা, তোর মতো অপ্সরা, তোর তো পাত্রের লাইন পড়ে যাওয়ার কথা!” গত বছর থেকে পাত্র খোঁজা চলছে আর এখনও পাত্র জোটেনি শুনে সত্যিই অবাক হল শর্মিলা। ডালিয়াকে সত্যিই বড় সুন্দর দেখতে, শুধু ভুরু জোড়া একটু বেশি ঘন। আর ঠোঁটের উপর হালকা একটু রোমের আভাস আছে। আর এই দুটো ফিচারই ডালিয়াকে র্যাম্প সুন্দরী, বিজ্ঞাপনের সুন্দরীদের চেয়ে একেবারে আলাদা একটা মাধুর্য দিয়েছে। একেবারে পুরনো ধাঁচের, একালে অমিল, একটা কমনীয়তা, এত রোগা অথচ হাত-পায়ের কী সুন্দর গড়ন! নিটোল, যেন হেমেন মজুমদারের নারী। এ মেয়ে দৌড়ঝাঁপ করে চাকরিবাকরি করবে বলে মনে হয় না। বিয়ে করবে, মেনেই নিয়েছে। তা হলে ডালিয়ার উচিত খুব বড় বনেদি বাড়িতে বিয়ে হওয়া। কেজো বাড়িতে ওকে মোটেও মানাবে না।
খাওয়াদাওয়ার পর শর্মিলা একতলার কলতলায় গেল আঁচাতে। গায়ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ছোটমামা এখন একতলাটা সারিয়ে-সুরিয়ে রেখেছে ভাড়া দেবে বলে। কিন্তু মনমতো ভাড়াটে পাচ্ছে না। ডালিয়া বড় হওয়ার পর মামা আর অল্পবয়সি ছেলে আছে, এরকম পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দেবে না ঠিক করেছে। মামির ধারণা, ডালিয়ার বিয়ে না মিটলে একতলাটা খালিই থাকবে।
“তোর মামার যত্তসব!” বলে গায়ত্রী মুখ মটকে হাসল, এই বয়সেও গায়ত্রী চোখে কাজল দেয়। পান খেয়ে তাকে বেশ লাস্যময়ী লাগে।
একতলার বড় ঘরে থাকত দাদু, আমৃত্যু। আর তার পাশের খুব ছোট ঘরটা ছিল শর্মিলার, বাবা-মা’র খাট, একটা আলমারি রাখার পর পড়ার টেবিল ঢুকত না। সারা জীবন সে দাদুর ঘরেই বসে পড়াশোনা করেছে। বুড়ো হতে হতে দাদুর বড় বকবকানি ধরেছিল। খুব মুশকিল হত তখন শর্মিলার। অথচ চামড়া দিয়ে বাঁধানো দাদুর টেবিল ছাড়া পড়ায় মনও বসত না তার। একটা সময় দাদু যখন আর বাইরে বেরোতে পারত না, তখন কেউ বাইরে থেকে ঘুরে বেড়িয়ে এলে, বিয়ে, পইতে বাড়ি থেকে ফিরলে, ঠাকুর দেখে কিংবা ফাংশন শুনে এলে দাদু তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিত! দাদুর প্রশ্ন করার ধরনটা ছিল ভারী অদ্ভুত।
‘হ্যাঁ, তারপর তোমরা তো গেলে, যেতেই বেয়াইমশাই দরজা খুলে দিলেন?’
‘না দাদু, গোপামাসি দরজা খুলে দিল।’
‘ও, তা গোপা তো তোমাদের দেখে খুব খুশি হল? হয়ে বলল, তোমরা এত দেরি করে এলে কেন?’
“হ্যাঁ দাদু, তাই বলল।’
‘ওদের কুকুরটা তো নিশ্চয়ই লাফালাফি শুরু করে দিল।’
‘হ্যাঁ দাদু, খুব লাফাচ্ছিল।’
‘বেশ! বসতে বলল কি একতলায়, নাকি উপরে নিয়ে গেল?’
‘না, না, উপরেই নিয়ে গেল সোজা।’
‘ও, তখন ওদের পুজো শুরু হয়ে গেছে? নাকি ঠাকুরমশাই এসেই পৌঁছোয়নি?’
‘দিব্যি ঠাকুরমশাই এসে গেছেন!’
‘বেয়াইমশাই তো আবার শার্ট-প্যান্ট পরা সাহেব মানুষ, চুরুট খান, উনি নিশ্চয়ই পুজো দেখতে এলেন না, বসে বসে টেলিভিশন দেখতে লাগলেন?’
‘না, দাদুকে তো দেখলাম না একবার!’
‘একবারও দেখলে না? সে কী? ছোট বউমাকে ডাক ভানু। তা হলে কি বেয়াইমশাই রাগ করে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে বসে রইলেন?’
এইরকম আর কী! একবার বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় নতুন ধরনের আলোর কারসাজি করেছিল। ঠাকুর দেখে ফিরে দাদুকে সেই আলোর খেলার বর্ণনা দিতে গিয়ে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল শর্মিলার! আহা রে! ভাবল শর্মিলা, দাদুকে সে বড় ভালবাসত। যখন এবাড়িতে পা দিয়েছিল ঘণ্টাদেড়েক আগে, তখন একটা কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল তার মধ্যে। এখন সেটা চলে গেছে। মনটা অনেক দ্রব হয়ে এসেছে। সে গায়ত্রীকে বলল, “দাদুর ঘরটা একবার দেখব মামি?”
“দ্যাখ না, কিন্তু বাবার পালঙ্ক টালঙ্ক সব তত তিনতলায় তুলে দেওয়া হয়েছে।”
“ওঃ!” বলল সে।
আবার দোতলায় উঠতে হল তাকে। ব্যাগ থেকে ছোট আয়না আর লিপস্টিকটা বের করে মুখটা একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে শর্মিলা গায়ত্রীকে বলল, “এবার উঠি মামি,” বলেই সে বলতে যাচ্ছিল ‘তোমরা একদিন এসো,’ কিন্তু কথাটা গিলে নিয়ে সে বলল, “ডালিয়া চল, একদিন তুই আর আমি কোথাও একটু ঘুরে আসব।”
ডালিয়া খুব মিষ্টি করে মাথা নাড়ল।
গায়ত্রী বলল, “আবার আসিস ভানু। তুই হয়তো ভাবিস, মামি ভুলেই গেছে, ডাকে না, পুজো টুজো চলে যায়, একটা শাড়ি টাড়িও দিই না তোকে। আসলে তোর বর আর তোর মামার মধ্যে আমরা পড়ে গেছি রে, দুঃখ হয়!”
সদর দরজা অবধি এসে মামি বলল, “ও ভানু! ভদ্রলোকের আগের স্ত্রী কি এখনও শ্বশুরবাড়িতেই থাকে?’
“হুঁ!”
“ভাল কথা নয় ভানু, ভাল কথা নয়। সাবধানে থাকিস, কবে আবার আমে-দুধে মিলে যাবে, আঁটি হয়ে গড়াগড়ি খাবি!”
ডালিয়া কিছুটা এল তার সঙ্গে। তারপর চলে গেল আয়েষাদের বাড়িতে। সে বিশ্বম্ভর ঘোষের বাড়ির পাশ দিয়ে কোনওমতেই যাবে না। সে আবার অনাদি ঘোষাল স্ট্রিট দিয়ে বটতলায় এসে ট্যাক্সি ধরল।
ট্যাক্সিতে বসে তার প্রথম যে কথাটা মনে হল, সেটা বড়ই অদ্ভুত! সে ভাবল, আচ্ছা, ডালিয়ার সঙ্গে যদি মহুলের বিয়ে দেওয়া যায় কেমন হয়? ধুস, কোনওদিন সম্ভব নয়। আদিত্যরা অসম্ভব নাক উঁচু, অহংকারী, আর ওরা খুঁজছে বড় বাড়ির কনভেন্ট এডুকেটেড, চূড়ান্ত স্মার্ট মেয়ে। মহুল আবার তিন বছর লন্ডনে থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। এদিক থেকেও সম্ভব নয়। ছোটমামা কোনওদিন ডালিয়ার বিয়ে সেই পরিবারে দেবে? মহুলের বাবা ছোটমামাকে কি কম অপমান করেছিল ফোনে সেই একদিন? যেদিন তাকে একবার আসতে বলেছিল ছোটমামা?