॥ ১৩ ॥
জ্যোতিষ্মানের কোনও উত্তরাধিকারী নেই। ফলে জ্যোতিষ্মান মারা যাওয়ার পর মকাইদের বাড়ি বিক্রিতে আর কোনও বাধা থাকল না। বাকি শরিকরা সব অনেক আগেই একমত হয়ে গিয়েছিল। এবার সকলে মিলে উঠে পড়ে লাগল ক্রেতা জোগাড় করতে। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। কোনও অংশীদারই অন্য জনকে বিশ্বাস করতে পারছিল না! এত বড় সম্পত্তি, দশ কাঠার উপর জমি। ছ’টা-সাতটা ভাগ, যে-সে প্রোমোটার নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। যে তরফ প্রোমোটার আনে, সেই তরফকে তার প্রোমোটার নানা প্রলোভন দেয়। দামে কম্প্রোমাইজ় করতে বলে, শরিকদের রাজি করাতে বলে, বদলে একটা পার্সেন্টেজ দেবে বলে কথা দেয়। ফলে সব শরিকই দাবি করতে থাকে, তার আনা ক্রেতাই বাড়ি নিক। এবং বাড়ির দরও ওঠানামা করতে থাকে। এই ক্রেতাদের মধ্যে অভীকও পড়ে। মকাইয়ের সঙ্গে অভীকের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। মকাইকে অভীক দশ লাখ বেশি দেবে কথা দিয়েছে। দাম দেবে তিন। কিন্তু অভীক কাউকে ফ্ল্যাট ট্যাট দেবে না। যে যার টাকা নেবে, বাড়ি খালি করে দেবে। এদিকে শাঁটুলও ঢুকে পড়েছে এর মধ্যে। তার পার্টি ফ্ল্যাটও দেবে, টাকাও দেবে। বাকি শরিকরা এরকমটাই চায়। এত বছরের পাড়া ছেড়ে আর যেতে হয় না তা হলে। শরিকরা কেউই খুব একটা প্রতিষ্ঠিত নয়। থোক টাকা আর ফ্ল্যাট, এটাই তাদের কাম্য। শাঁটুলের পার্টিই ঘনঘন মিটিং করতে লাগল ঘোষালবাড়িতে।
ব্যাপার অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর অভীক একদিন শাঁটুলকে বলল, “তুই সরে দাঁড়া শাঁটুল”
শাঁটুলের ভুরু উঠে গেল, বলে কী অভীকদা? সরে দাঁড়াবে? ডিলটা হয়ে গেলে দু’ তরফ থেকে সে প্রায় ছ’- সাত লক্ষ টাকা কামাবে। এত দিনে সে যা জমিয়েছে, সব দিয়ে টিয়ে গম গুদামের ওখানে একটা ছোট ফ্ল্যাট হয়ে যাবে তার। তারপর সে বিয়ে করবে। বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি করতে চায় শাঁটুল। দোলনকে সে হাতছাড়া করতে চায় না। সাউথের মেয়েদের প্রতি আর কোনও মোহ নেই শাঁটুলের। দোলন দমদম ক্যান্টনমেন্টের মেয়ে, বাঙাল। ওর মা আগে একটা স্কুলের সামনে বসে কাচের বাক্সে করে ঘুগনি, পরোটা, মাংসের কিমা এসব বিক্রি করত। এভাবে দুই ছেলে আর এক মেয়েকে মানুষ করেছেন ভদ্রমহিলা। এখন দিন এত খারাপ নেই। এক দাদার একটা রমরম করে চলা রোল কাউন্টার আছে দমদম মেট্রো স্টেশনের গায়ে। আর এক দাদা শাঁটুলের মতোই বাড়ি, ফ্ল্যাটের ব্রোকার। সেই দাদার নাম বিশ্বনাথ। বিশ্বনাথদা খুব মাই ডিয়ার হচ্ছে। দোলনের সঙ্গে সে মিশছে, ঘুরছে, বেড়াচ্ছে, মলে যাচ্ছে, মাল্টিপ্লেক্সে যাচ্ছে, সব ঠিক আছে। কিন্তু সামনের বছরের মধ্যে বিয়ে কিন্তু করতে হবে, এক কথা বিশ্বনাথের। এসব মিলিয়ে শাঁটুলের চোখে এখন অনেক স্বপ্ন, অনেক চিন্তা। দোলনের মুখের মধ্যে একটা পবিত্রতা আছে। সেই পবিত্রতাটাই শাঁটুলের সবচেয়ে ভাল লাগে। সে নিজেকে বলে, বউ হবে দোলনের মতো। জ্বালা ধরিয়ে কেটে পড়বে না। দোলন থেকে যাবে তার পাশে সারা জীবন।
তার ভুরু উঠেই ছিল, অভীকদা বলল, “তুই আমার থেকে টু পার্সেন্ট নিয়ে নিস৷”
“আর ওদের টু পার্সেন্টটা? সেটা তো মার যাবে!”
“আরে, ভাবছিস কেন? সেটা তোকে পুষিয়ে দেব। এখনই তো হবে না, পরে পরে।”
শাঁটুল বলল, “সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু পার্টির সঙ্গে তো এদের ভাল যোগাযোগ হয়ে গেছে। আমি সরে গেলেই বা কী? পার্টি কেন ব্যাক করবে?”
“করবে। এদের বোঝাতে হবে, পার্টি মালকড়ি দেবে না ঠিকমতো।”
“কেন? সব তো ব্যাঙ্ক ড্রাফট দেবে কথা হয়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া করে থাকার খরচও দেবে!”
“কিছু একটা কর, তারপর আমি দেখছি।”
“উলটোপালটা করা যাবে না। আমাকে এই লাইনে করে খেতে হবে। শাঁটুল দাসের একটা রেপুটেশন আছে।”
“বেশ। তুই শুধু একটা কাজ কর শাঁটুল। পার্টির সঙ্গে আমার একটা মিটিং করিয়ে দে। ব্যস!”
শাঁটুল ভাবল অনেকক্ষণ, “তোমার এত কী দরকার ওই বাড়িটা?”
“ভাল প্রপার্টি, আবার কী? তা ছাড়া আমার একটা কফি শপ খোলার খুব শখ বলতে পারিস। এরকম প্রাইম পজ়িশন না হলে চলবে না। পিছনটা হবে পার্কিং। দোতলাটা দুটো বিয়েবাড়ি ভাড়া দেওয়ার মতো করে দেব। একদম ফাইভ স্টার বিয়েবাড়ি। পাড়া জমজমাট হয়ে যাবে। বিয়েবাড়িতে আলো জ্বলবে, ফুল দিয়ে সাজানো হবে, মিউজ়িক বাজবে, বাজি ফাটবে আর তিনতলা চারতলায় ছ’টা করে বারোটা ফ্ল্যাট! তুই আমার হয়ে কাজ কর। যা, তোকে সবসুদ্ধ আট দেব। ঠিক আছে?”
আট লক্ষ টাকা! শাঁটুল থুতনির ঘাম মুছে বলল, “সই হলেই দিয়ে দেবে তো?”
“হ্যাঁ রে, এসব নিয়ে ভাবিসই না।”
শাঁটুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে লেগে পড়ল। জুন মাসে একদিন অভীক বসে গেল অন্য পার্টির সঙ্গে। কী ইকোয়েশন হল কে জানে, পার্টি এক মাসের মধ্যে জানিয়ে দিল, তারা আর ইন্টারেস্টেড নয়। এবার ঘোষালবাড়ির সিনে ঢুকল অভীক। ওই পার্টি সরে যাওয়ায় ঘোষাল শরিকরা একটু দুশ্চিন্তায় ছিল। এবার ওরা চট করে রাজি হয়ে গেল প্রোপোজ়ালে। অগস্টের শেষে ঘোষালবাড়িতে রেজিস্ট্রার বসিয়ে সই-সাবুদ করে ফেলল অভীক। আর সেদিনই আয়েষাদি তাকে হাত ধরে বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে মুখে মিষ্টি গুঁজে দিল।
এরপর থেকে আয়েষাদি সব সময় তাকে ডেকে কথা বলে। একদিন দোলনকে নিয়ে এসেছিল শাঁটুল ঘোষবাড়িতে। আয়েষাদি একটা দামি শাড়ি দিল। দোলনের তো বাড়ির ভিতরটা দেখে চক্ষুস্থির! একটা ঘর তো মাল্টিপ্লেক্সের গোল্ড ক্লাসের মতো। জাম্বো টিভি আর গদি আঁটা সোফা পাতা। কিন্তু সেদিন হুট করে একটা কথা বলে দিল আয়েষাদি, ‘দোলনকে আমার খুব ভাল লেগেছে রে শাঁটুল। মুখটা দুর্গা প্রতিমার মতো। সোহিনীর চেয়ে দোলনকেই ভাল দেখতে। সোহিনীর মুখটা তো অতটা ভাল নয়, স্টাইলেই বেরিয়ে যাচ্ছিল!’
ব্যস! সেই থেকে বেবাক মুশকিলে আছে শাঁটুল! দোলনের সেই এক কথা, ‘কে সোহিনী বলো? আমার সঙ্গে সোহিনীর তুলনা করা হল কেন বলো? কেউ ফোন করলেই, সোহিনী ফোন করেছে? সোহিনীর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?’
মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা শাঁটুলের! আরে, সোহিনী সাউথের সঙ্গে দোলন তোর তুলনা হয় না! ওটা আয়েষাদির চুকলিবাজি। দিল সারা জীবনের মতো জল ঘোলা করে, এ জল আর থিতোবে কখনও? দোলন এমনি ভাল, কিন্তু টেরাও আছে খুব। অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। কী বলবে শাঁটুল? যে সে বউদিবাজি করেছে? পাড়ার বউয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে? আর সেই মেয়েটা তাকে দু’দিন নাচিয়ে ছেড়ে দিয়েছে? দোলনের বিশ্বাসটা একদম নষ্ট হয়ে যাবে না? এদিকে অভীকদা তাকে অর্ধেক পেমেন্ট করে বাকিটা ঝুলিয়ে দিল। আয়েষাদির সঙ্গে পঙ্গাও নেওয়া যাচ্ছে না। আয়েষাদি সেদিন বলল, ‘দোলনকে আর একদিন আনিস।’ আর আনে? খতরনাক জিনিস! লালু ভাল বুদ্ধি দিল, ‘বলে দে না, বাগবাজারের একটা মেয়ে, কয়েক দিন ঘুরেছিল ওর সঙ্গে। বিয়ে হয়ে গেছে!’