॥ ১১ ॥
দু’দিন যমে-মানুষে টানাটানি চলল। একবারই জ্ঞান ফিরেছিল জ্যোতিষ্মানের। তারপর সেই যে আধবুড়ো লোকটা কোন অন্ধকারে তলিয়ে গেল আর চেতনা ফেরত এল না। তৃতীয় দিন যদিও ডাক্তার বলল, ‘অবস্থা একটু স্টেবল।’ চতুর্থ দিন শহরের এক বিখ্যাত দৈনিকের পঞ্চম পাতায় ছোট করে খবর বেরোল একটা, ‘নকশালপন্থী জ্যোতিষ্মান ঘোষাল গুরুতর অসুস্থ।’ আত্মহত্যার চেষ্টাটা লেখা হল না, অভীক প্রভাব খাটিয়ে খবরটা ধামাচাপা দিয়েছিল। ভিতরের খবরে যা-যা লেখা হল, তাতে বোঝাই গেল, নাম বিভ্রাটের জের এখনও পিছু ছাড়েনি জ্যোতিষ্মানের। মাঝখানে চল্লিশটা বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। পুলিশ অফিসার হত্যা, প্রমাণাভাবে ’৭৪-এ ছাড়া পাওয়া, দমদমে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি, ভাঙচুর…সবই ছুঁয়ে গেল খবরটা, সপ্তম দিনে ভোরবেলা রাস্তায় বেরিয়ে পাড়ার লোকেরা দেখল লাইব্রেরির দরজার গায়ে সাঁটা একটা লাল পোস্টার। পোস্টারের উপরে একটা মালা, পোস্টারে লেখা, ‘কমরেড আমরা তোমাকে ভুলছি না, ভুলব না।’ বেলা বাড়ার আগেই এই খবর ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়। পাড়ার ভিতর নকশালদের পোস্টার? যুবক ও মধ্যবয়সিরা যে যার কাজে চলে গেল সেদিন তাড়াতাড়ি। কিছু বুড়ো-হাবড়া বসে বসে রোমন্থন করতে লাগল জ্যোতিষ্মানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দিনটা। দু’-একজন বলল, ‘কেউ বলতে পারে না, হয়তো জ্যোতিষ্মান সত্যিই জড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনে!’
আয়েষা লালুকে সঙ্গে নিয়ে নার্সিংহোম যাচ্ছিল জ্যোতিষ্মানকে দেখতে রোজকার মতো। অভীক বাধা দিল, “তুমি যাবে না। অন্য কেউ যাক। লালু যাক।”
“কেন?”
“আমরা কংগ্রেসি। এসবের মধ্যে আমাদের না থাকাই ভাল। ডিসট্যান্স তৈরি করো আয়েষা। আমার একটা পলিটিক্যাল ফিউচার আছে।”
“তোমার পলিটিক্যাল ফিউচার? ও, তুমি ভোটে দাঁড়াবে?”
“হয়তো।”
“মদের পিপে থেকে মুখ তুলবে, তবে তো?” আয়েষা চায় যে, অভীক ভোটে দাঁড়াক। যদি জিতে যায়, অভীকের বউ হিসেবে তার ভাগ্যে আরও অনেক কিছু জুটবে। পলিটিক্যাল লিডারদের বউদের প্রবল সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি! কিন্তু তা বলে জ্যোতিষ্মানদার দেখাশোনা করতে পারবে না সে? মানুষের কি মাথা খারাপ হয়েছে যে, জ্যোতিষ্মানের ক্লোজ় বলে তাদেরও নকশালপন্থী ভাববে? তাদেরও, যারা টাকার গদিতে বসে আছে আজ অর্ধ শতাব্দী? যারা বিদেশি গাড়ি চড়ে উচ্ছে কিনতে যায়? আয়েষা বলল, “আমি যাবই!”
অভীক বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়ে সোজা আয়েষার ফোলা গালে এক থাপ্পড় মেরে বলল, “তুই হারামজাদি বাড়ির বাইরে এক পা রাখবি তো…”
চড় খেয়ে আয়েষা অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ তার সমস্ত শরীর জুড়ে কাঁপন দেখা দিল! সে বলল, “আমি আজই এবাড়ি ছেড়ে চলে যাব?”
“যাবে যাও। তোমার মেয়েদের নিয়ে যাবে!” বলল অভীক। সে মূলত ঠান্ডা মাথায় বউকে শাসন করল, এই প্রথম।
“কেন, মেয়েদের কি আমি গোলক মাঝি লেন থেকে এনেছিলাম। মেয়েরা দু’ চক্ষের বিষ? সেই বিষ কে ঢেলেছে আমার পেটে?”
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌনতার চোরাস্রোত সব সময় প্রবহমান। শরীরের লেনদেন ফুরিয়ে গেলেও যৌন আকর্ষণ মরে গেলেও যৌন ধৃষ্টতা, যৌন বিতৃষ্ণা, যৌন কারুণ্য, যৌন বিদ্রোহটা থেকে যায়! এ একই মুদ্রার ওপিঠ মাত্র। আয়েষার এই বাক্যবাণে হঠাৎ অভীকের চোখের সামনে ভেসে উঠল রোগা রোগা একটা মেয়ে, গোলক মাঝি লেনে থাকে। ভোরে উঠে দুধের বোতল হাতে ফেরে, হরিণঘাটার দুধ! রেশন তোলে, বাজার করে, একই সালোয়ার-কামিজ পরে রোজ কলেজে যায়। ভাল কিছু খেতে পারে না বলে রোজ ফুচকাই খায় গপ গপ করে, তেঁতুল জল খায় চেয়ে চেয়ে! অথচ দুর্গাপুজোর সময় লাল পাড় শাড়ি পরলে সেই মেয়েটাই হয়ে ওঠে অনবদ্য রূপসি! অভীকের মনে পড়ে যায় সব! এই মেয়েটাকেই একদিন গাড়ির মধ্যে চুমু খেতে গেলে মেয়েটা তাকে আঙুল তুলে বলেছিল, ‘আগে বিয়ে করবে, তারপর গায়ে হাত দেবে! আমি গরিবের মেয়ে। আমার মা টাকা দিতে পারবে না, গয়না দিতে পারবে না। আমি আমার বরকে এই একটাই জিনিস দিতে পারব আর আমার কিচ্ছু নেই।’ তারপর এই মেয়েটার শরীরের উপর সে কত দৌরাত্ম করেছে। সেই মেয়েটা এরকম হয়ে গেল কী করে? থরে থরে মেদ শরীরে। এত এত খায়। মদ খেয়ে হুলস্থুলু বাধায়। মুখে সারাক্ষণ চ্যাটাং চ্যাটাং কথা, হাই প্রেশারের রোগী!
অভীক বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “এখনও তো বিষ ঢালতে ইচ্ছে করে! কিন্তু যা চেহারা বাগিয়েছ! বাঘের জন্য ঠিক আছে, পুরুষমানুষ ছোঁবে না।”
আয়েষা চোখের জল মুছে বলল, “তাও আমি এখনও সবার চেয়ে সুন্দরী!” সত্যিই আয়েষার মধ্যে কোনও বিনয় নেই!
“ওই আনন্দেই থাকো! তুমি পুরনোদের দলে চলে গেছ আয়েষা। পাড়ায় নতুন নতুন বউরা এসেছে। পাড়ার ছোট ছোট মেয়েগুলো হঠাৎ বড় হয়ে যাচ্ছে। তোমার মেয়েই তোমাকে সাত গোল দিতে পারে! তুমি লিস্ট থেকে বাদ পড়ে গেছ। তোমার জন্য শুধু আমিই আছি, এখনও।”
“তুমি একটা মিথ্যেবাদী, একটা মদ্যপ।”
“আর তুমিও আমার মদখোর, মাতাল বউ!”
কোথা থেকে কী হয়ে গেল! সারা সকাল আয়েষা আর অভীক বসে বসে এরকম কথা চালাচালি করতে লাগল! কথার ফলাগুলোর ধার বসে গেল ক্রমশ। অভীক দু’-একবার ভাবল, উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। তারপর ভাবল, পরে হবে।
সেদিনই দুপুরবেলা মারা গেল জ্যোতিষ্মান। তখন নার্সিংহোমে পাড়ার কেউই ছিল না।