কড়িখেলা – ১৪

॥ ১৪ ॥

যেদিন সে ঘোষণা করেছিল চলে যাবে এবং ডিভোর্স ফাইল করবে সেদিনই রাতে কমল তার সঙ্গে জোর-জবরদস্তি সহবাস করে! সোহিনী বাধা দিলে কমল একদম শোনেনি। কমলকে এই ভূমিকায় কোনওদিন দেখেনি সোহিনী! সত্যি বলতে, তার উপর জোর খাটানো হচ্ছে জেনেও সে পুরোপুরি এনজয় করেছিল ব্যাপারটা। তারপর রোজই নিজের পৌরুষ জাহির করতে শুরু করে কমল। এর মধ্যে তার জন্মদিনে কমলই তাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায় মুদিয়ালি। তারপর সেখান থেকে সিনেমা এবং ডিনারে। এসব দেখে সোহিনীর থেকেও বেশি বিস্মিত কমলের মা, কান্তা বাই! আজকাল কমল চেম্বারে বেরোনোর আগে তার কোমর জড়িয়ে চুমু খায়। সঙ্গম নয়, এই চুমুটাই আপ্লুত করে তোলে সোহিনীকে। কমল তাকে এরপর আর একবারও বলেনি, ‘তুমি যাবে না তো?’ ইত্যাদি। সে একদিন বলে ফেলল, ‘চলে যাব, তাই শরীরটাকে ভাল করে ভোগ করে নিচ্ছ?’ কমল কোনও উত্তর দেয়নি।

সোহিনী বুঝতে পারে না কী করবে? তার মনে প্রশ্ন, এসব কমল করছে কেন? শুধু ডিভোর্সটা আটকাতে? ডিভোর্সি তকমার হাত থেকে বাঁচতে?

এর মধ্যে একদিন একটা ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল ভরদুপুরে, অনু-রুণু দুই বোন ডাকল ফেরিওয়ালাটাকে। সাইকেলের উপর কাচের বাক্স। তাতে তুলোর বিছানা, ঝুটো দুল, পাথরবসানো আংটি, টিপের পাতা, সেফটিপিন, মাথার ক্লিপ, সুচ, সুতো রং-বেরঙের। তার কী হল, সে-ও ওড়না গায়ে জড়িয়ে নেমে এল নীচে। অনু-রুণুদের রকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে কিছু কিনল না। অনু-রুণু কিনল দুল, ক্লিপ এসব। তারপর অনু-রুণুর সঙ্গে গল্প করতে লাগল সে। ওরা দুই বোন সারাক্ষণ কিশোরকুমারের ক্যাসেট বাজায়। সেই গান, ‘জানি যেখানেই থাকো/ এখনও যে তুমি/মোর গান ভালবাসো’, নির্জন হয়ে আসা পাড়া, শাঁটুলের মোটরবাইক ছুটিয়ে চলে যাওয়া, বদ্যিবাড়ির বউয়ের ছেলেকে পড়তে বসিয়ে, ‘বল, বল, কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি, বল, বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি,’ ফাঁকা অ্যাকোয়ারিয়ামটা, কর্পোরেশন কল থেকে সরু করে পড়ে যাওয়া জল — সব কিছু, সব কিছু কেমন মোহিত করে তুলল তাকে! মনে হল, সে এই পাড়ার একজন হয়ে গেছে!

তখনই অনু আর রুণু দু’জনে দু’জনের গায়ে হেসে ঢলাঢলি করে বলে উঠল, “অ্যাই সোহিনী, তোমরা এখন বাচ্চা নেবে না?”

“কবে নেবে বাচ্চা?” রুণু বলল।

“এখন চাও না, না?” অনু বলল।

“না, না, এখন না,” রুণু বলল।

“হ্যাঁ, ফ্রি-লি ঘুরে-বেড়িয়ে নাও।”

“বাচ্চা নিলেই তো হয়ে গেল।”

“হ্যাঁ, হয়ে গেল! পায়ে বেড়ি।”

সোহিনী বাড়ি ফিরতে লাগল পায়ে পায়ে। একটা ম্যাটাডোর দাঁড়িয়ে আছে কল্লোলিনী লাইব্রেরির সামনে। দুটো কুলি নিঃশব্দে বই কার্টেনে প্যাক করে তুলছে ম্যাটাডোরে। এত সব বই কোথায় যাবে? প্রশ্ন উঠল সোহিনীর মনে। সে শুনেছে কমলের কাছের বাড়িটা এবার ভাঙা হবে। মকাইরা সব যে যার মতো চলে গেছে কোথায় কোথায়। ক’দিন ধরে লরিতে লরিতে দিনরাত মালপত্র গেছে ঘোষালবাড়ি থেকে। শুধু জ্যোতিষ্মান ঘোষালের খাট, টেবিল, টেবিল ফ্যানের কোনও দাবিদার ছিল না। অভীক লালুকে দিয়ে সেসব পোলের তলার লোকদের দিয়ে দিয়েছে। সোহিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! একশো বছরের পুরনো বাড়ি, ভাঙা হয়ে যাবে। ফোনে ছবি তুলে রাখবে সে, ফেসবুকে আপলোড করবে।

সেপ্টেম্বরেই কান্তা বাই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। আপনা- আপনিই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল সোহিনীর কাঁধে। দোতলা, তিনতলা করে সে সামলাতে চেষ্টা করল সব দিক। রান্নাঘরেও ঢুকতে হল তাকে। কান্তা বাইকেও কিছু-কিছু সেবা করতে হল তাকে। কান্তা বাই খেতে চায় না। আর সে জোর করে খাওয়ায়। এই দৃশ্যটা তার নিজেরই বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *