॥ ৭ ॥
বছরের এই সময়টায় শর্মিলাদের অফিসে নিশ্বাস নেওয়ার ফুরসত থাকে না। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে সে দেখছে, সামার টাইমে তুলনামূলক ঠান্ডার জায়গায় যাওয়াটা কলকাতার উচ্চবিত্তদের মধ্যে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে স্বদেশ হোক বা বিদেশ। গরম পড়লে লোকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ছে। মে-জুন মাসে চাপ সবচেয়ে বেশি। আগে যেমন অবাঙালি ব্যাবসাদাররাই অধিক সংখ্যায় বিদেশভ্রমণ করত, পছন্দের জায়গা ছিল ইউরোপ। এখন বাঙালি চাকুরিজীবীরাও দিব্যি তিন-চার লক্ষ টাকা খরচ করে ঘুরতে চলে যাচ্ছে এসব জায়গায়। আজই যেমন, সে গুনে দেখল, বাইশটা ভিসা অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে তাদের, যারা বাঙালি এবং চাকরি করে। লাঞ্চ ব্রেক নেওয়ার আগেই শর্মিলা নবারুণকে বুঝিয়ে দিল কাল ভোর ভোর ওকে ইউ কে-র ভিসা অফিসে পৌঁছে যেতে হবে। জনা সাতের তো কালই ভিসা ইন্টারভিউ। নবারুণ ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে, কিন্তু বেশ করিতকর্মা। রেবাদি প্লেট টেট ধুয়ে রেখে গেছে। শর্মিলা ওয়াশরুম থেকে মুখ টুখ ধুয়ে এসে সবে লাঞ্চ বক্স খুলবে, আদিত্যর ফোন।
“শর্মিলা, কথা বলা যাবে?”
সে বলল, “হ্যাঁ বলো।”
“আজ মিমির বাড়ি থেকে সবাই সল্টলেকে আসছে।”
“মিমি কে?”
“সিউড়ির ওই মেয়েটি, ওর ডাকনাম মিমি।”
মেয়েটার ভাল নাম লিচ্ছবী। কী নামের ঘটা! কিন্তু শর্মিলা অবাক হল এই ভেবে যে, আদিত্য হবু ছেলের বউকে ডাকনামে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে? শর্মিলা যতদূর জানে, এই লিচ্ছবী মেয়েটা কলকাতায় থেকে পড়াশোনো করে এবং মেয়েটি যথেষ্ট স্বাধীনচেতা! সিউড়িতে পরিবারের বিরাট ব্যাবসা। ওখানে পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্সও খুব ভাল। একটা-দুটো নয়, কলকাতায় অনেকগুলো বাড়ি টাড়ি আছে মেয়ের বাবার, তারই একটায় মেয়েটি একা একা থাকে। ও লেডি ব্রেবোর্নে পড়ে। আদিত্যর এইরকম মেয়েই পছন্দ ছেলের জন্য। যতই লন্ডনে পড়াশোনা করে আসুক না কেন, মহুল বেশ ইন্ট্রোভার্ট। বেশি কথা বলে না, খুব একটা বন্ধুবান্ধব নেই, আদিত্য তো রাজারহাটে একটা বড় ফ্ল্যাট এই জন্যই কিনে দিল ছেলেকে যে মহুল বন্ধুবান্ধব নিয়ে পার্টি করবে, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ফুর্তি করবে। কিন্তু মহুলের দুটো-একটা ছাড়া বন্ধু নেই, লন্ডনে ওর সঙ্গে একটা চাইনিজ় মেয়ের প্রেম হয়েছিল, ইন্ডিয়াতে ফিরে আসার পর সেটা কেটে যায়। এখন মহুলের কোনও বান্ধবী আছে কি না সন্দেহ আদিত্যর। সে বলেছিল, “এ কী ছেলে হল রে বাবা! পঁচিশ বছর বয়স অথচ একটা মেয়েবন্ধু নেই?” শর্মিলা শুনে বলেছিল, “আচ্ছা, তুমি ওকে পুশ করছ কেন? যখন হওয়ার হবে, ছোট থেকে লন্ডনে থেকেছে। এখানকার মেয়েদের ওর অতটা ভাল না-ও লাগতে পারে।” আদিত্য বলেছিল, “ওর বয়সে আমার বাইশটা গার্লফ্রেন্ড ছিল! আর তারা সব কী জিনিস ছিল! এক সে বড় কর এক! অন্নপূর্ণা বলে একটা পঞ্জাবি মেয়ে ছিল, তাকে সামলাতে দশটা মিলিটারি কম পড়বে, সেই মেয়ে আমার পিছনে ঘুরত! সেই আমার ছেলের এই অবস্থা? রাত আটটায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বাংলা নিউজ শুনছে? ছোঃ! এ জিনিসকে ঠিক করতে হবে। যে বয়সের যা, সেটা যদি না করে, পরে উলটোপালটা করে বেড়াবে! লাইফ নষ্ট করবে। মেয়েফেয়ে এখনই এন্তার ঘেঁটে নেওয়া উচিত। নইলে পরে কাজের মেয়ে ঘর মুছলেও তার পাছার দিকে তাকিয়ে থাকবে, বুঝেছ?” শর্মিলা হেসে ফেলত। তার রাগও হত এসব শুনে। অন্নপূর্ণার গল্প শুনে শুনে তো কান পচে গেছে। কে যে কার পিছনে ঘুরত! তারপরই সে সিরিয়াস হয়ে যায়, “এত মেয়েদের সঙ্গে মিশে, এত লীলাখেলা করে তারপর তুমি পরমাদিকে বিয়ে করেছিলে। আর সেই বিয়েটা ওয়র্ক করল না?” এসব কথা হাজার বার হয়ে গেছে। তবু বারবার হতে থাকে। আদিত্যর সঙ্গে প্রেম পর্বেও সে এই প্রশ্ন করত। আগে এই প্রশ্নের জবাবে আদিত্য খুব উদার ভাবে বলত, “দোষও তো তোমার! তুমি আমার মাথা ঘোরানোর জন্য এলে কেন?” এখন আদিত্য এই প্রশ্নের জবাবে চুপ করে থাকে কিংবা বলে, “ছাড়ো তো, তোমাদের মেয়েদের শুধু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা!” তা ছাড়া এই সময়ের মধ্যে আদিত্যর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন যেটা দেখা দিয়েছে সেটা হল, ছেলে ছেলে করে চিন্তা করা। আর শর্মিলার মনে হয়, ছেলে ছেলে করেই আদিত্য তার কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আবার ফিরে যাচ্ছে পরিবারের মধ্যে, যেখানে পরমাও আছে!
ফোনে আদিত্যর কথা শুনে শর্মিলা হেসে ফেলে বলল, “বাবা, হবু পুত্রবধূকে একদম ‘মিমি’ বলে ডাকতে শুরু করে দিলেন?” সে ‘আপনি’তে ফিরে গেল। চেতনার মধ্যে সামান্য দ্বিধা এলেই সে ‘আপনি’তে সরে যায়।
“তোমার ভ্যানতারা রাখো তো। যেটা বলছি সেটা শোনো, আজ মিমির বাড়ির লোকেরা আসবে, আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে যাব সল্টলেক। আমার ফিরতে রাত হবে, কত রাত জানি না। তুমি খেয়ে নিয়ো। আমি খেয়ে আসব। হল?”
“ব্যস, আর কী?” বলল সে, “তা আজই কি আশীর্বাদ?”
“এত তাড়াতাড়ি আশীর্বাদ? আমার ছেলের আশীর্বাদ হলে সারা শহর জানতে পারবে। সেটা একটা বড় প্রিপারেশন, আমার সঙ্গে এত বছর থেকেও তুমি কিছুই বুঝলে না। মনটা সেই অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটের মতোই রেখে দিয়েছ!” করুণার সঙ্গে হাসল আদিত্য।
তার রাগ চরমে উঠছিল। আজ তার মানে পরমা আর আদিত্য মহুলের দায়িত্বশীল বাবা-মা’র ভূমিকা পালন করবে কতগুলো লোকের সামনে। আর তারা নিশ্চয়ই ওদের স্বামী- স্ত্রীর মতোই ট্রিট করবে। এই সামাজিকতার নামে ওরা বেশ গ্রহণযোগ্য স্বামী-স্ত্রীই হয়ে উঠতে চাইবে নিশ্চয়ই। ভাঙন, বিচ্ছেদ, টেনশন, এসব কিছুই উঠে আসবে না! বাবা, কী ভাল নাটক! সমাজ আর সামাজিকতার খাতিরে, ছেলের ভালর জন্য যদি এসবই চলবে, ডিভোর্সড হাজব্যান্ড-ওয়াইফ এত সময় পরস্পরের সঙ্গই করবে যদি, তা হলে কী দরকার ছিল বিয়েটা ভাঙার এবং তাকে বিয়ে করার? শর্মিলা তো ওখানে আনওয়ান্টেড। আজকের সন্ধ্যায় যদি শর্মিলা উপস্থিত হয়, তা হলেই তো চিত্তির! সব স্বাভাবিকতা মার খেয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে তো অচিরেই আদিত্যর জীবনে সে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। সে কী এমন ট্রয়ের হেলেন যে, এত ঝকমারি করে শুধু রাতটুকু একসঙ্গে ঘুমোনোর জন্য আদিত্য বাইপাসের ফ্ল্যাটে ফিরবে? একসঙ্গে ছ’ বছর থাকার পর শরীরের উন্মাদনা তো অনেকটাই কেটে গেছে আদিত্যর। শর্মিলা আজকাল ভীষণভাবে ফিল করে ধর্মসম্মত স্ত্রী সে নয়, আজও পরমাই রয়ে গেছে। যখন সে ভাবে, আদিত্য পরমাকে ডিভোর্সের কাগজে সই করতে বলেছিল আর পরমা সই করে দিয়েছিল নির্বিকারভাবে, তখন তার আরও রাগ হয়! পরমা যেন করুণাই করেছিল তাকে! তখন তার মনে হয়। ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কী ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং! হায়, সে নিজেই ওদের স্বামী-স্ত্রী ভাবে। আজও রাগটা উঠে এলেও সে গিলে ফেলল। বলল, “ঠিক আছে, খেয়ে নেব!”
“দরকার পড়লে ফোন কোরো!” বলল আদিত্য।
তার মানে অদরকারে ফোন কোরো না! ফোন ছেড়ে দু’- একবার বড় বড় করে নিশ্বাস নিল সে। আদিত্য এটা ঠিক করছে না। আদিত্য নিজের সুবিধেমতো জীবনটাকে দুটো ভাগে ভাগ করে নিয়ে বাঁচছে! এই দুটো জীবন আলাদা, এই দুটো জীবনে আদিত্যর দুটো মুখ, দুটো পার্সোনালিটি। আর সে এখানে প্রায়…শর্মিলা চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল চেয়ারে, প্রায়…তার চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল, উলটো মুখো শুষে গেল না। নিজেকে প্রায় ‘রক্ষিতা’র মতো ভেবে ফেলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সে!
তারপর সে হঠাৎ আবিষ্কার করল, সে ভাবতে পারছে! ক্রমশ সে আবার নিজের মতো করে অনেক কিছু ভাবতে পারছে। বোধহয় আদিত্যর ছায়া থেকে একটু সরে দাঁড়িয়েছে বলেই। আর খুব দ্রুত ভেবেও ফেলল শর্মিলা, আজ সে কিছু না হোক রাত আটটা-ন’টা অবধি ফ্রি। চাইলে রাত দশটা অবধি বাইরে থাকতে পারে। তখনই সে ঠিক করল, আজ একবার অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটে গেলে হয় না? সেদিন গায়ত্রী-ডালিয়া, দু’জনেই বলছিল, জ্যোতিষ্মানদার ক্যান্সার ধরা পড়েছে গলায়। একটা সময় সে রোজ স্কুল থেকে ফিরে লাইব্রেরিতে যেত, গিয়ে একটা টেবিল দখল করে বসে বই পড়ত। আর জ্যোতিষ্মানদা, আধ-খেপাটে জ্যোতিষ্মান দত্ত একমাত্র তার সঙ্গেই বসে বসে গল্প করত। কত গল্প যে হত তাদের!
তার বই পড়ার অভ্যেসটা একদম চলে গেল কী করে? মনটা ভীষণ আর্দ্র হয়ে উঠল তার। তাড়াতাড়ি যদি বেরোতে পারে, তা হলে পৌঁছে দেখবে লাইব্রেরির ঘরে নীল নীল টিউব জ্বলছে। বিরাট বিরাট সব স্টিলের বুক র্যাক। অলিভ গ্রিন রং করা। তার কাচের ভিতর থরে থরে বই। বইগুলো ভীষণ পুরনো। অধিকাংশই খুব ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। ওই বইগুলো এখন আর কেউ-ই খুব একটা পড়ে না। কিন্তু ওই বইগুলোর গায়ে গায়ে তাদের ওই পাড়া, আশেপাশের পাড়ার কত মানুষের হাতের স্পর্শ। যদি কোনওদিন কোনও ফরেনসিক অনুসন্ধান হয়, হাজার হাজার মানুষের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে বইগুলোতে। আর জ্যোতিষ্মানদাই ওই বইগুলোর প্রহরী! জ্যোতিষ্মানদাই ওই বইগুলো সকলের হাতে হাতে তুলে দেয়। দুটো মুখোমুখি র্যাকের মাঝখানে দেড় ফুটের চওড়া সুড়ঙ্গ। রংচটা পাঞ্জাবি পরা লোকটা ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে থেকে চোখ বন্ধ করেও যে- কোনও বই এনে দিতে পারে। আজ সে জ্যোতিষ্মানদাকে গিয়ে বলবে, ‘আমাকে নতুন করে মেম্বারশিপ দাও।’
ডালিয়া সেদিন বলছিল, ক্যান্সার তো কী? ঠিক সাড়ে চারটের সময় লাইব্রেরির দরজা খোলে জ্যোতিষ্মানদা। ঝাঁট দেয়, জল ছেটায়। রাত দশটা অবধি বসে থাকে। ফাঁকা লাইব্রেরি, এখন তো কেউই সেভাবে বই পড়ে না। আর সবচেয়ে বড় কথা মকাইদারা বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চায় প্রোমোটারকে।