কড়িখেলা – ৬

॥ ৬ ॥

পা মচকে পড়ে গিয়ে ব্যথায় জ্বর এসে গেছে, এর জন্য একেবারে মাথায় বাজ পড়ার মতো কিছু হয়নি। তবু মায়ের প্রাণ তো, ছোটদের জন্য কাতর হতেই হয়। তা ছাড়া মেয়েদের ব্যাপারে আয়েষা যথেষ্ট স্পর্শকাতর। কারণ, ছোটবেলাটা তার শুধু অনাদরেই কেটেছে। জ্বর হোক, জারি হোক, ডাক্তার- বদ্যির ব্যাপার ছিল না, খুব কিছু হলে দু’ টাকা দিয়ে নাম লিখিয়ে কয়লার গলির হোমিওপ্যাথির বড়ি, নিজের এই অতীতকে সারাক্ষণ অস্বীকার করতেই আয়েষা যা করে, সব বেশি বেশি করে। কমলকে নিজেই ফোন করল সে।

কমল বাঁধুলিকে দেখে টেখে ওষুধ লিখে দিল। ফলককে পাঠাল আয়েষা ওষুধ আনাতে। তারপরও কমল যেমন পাড়ার পেশেন্ট দেখতে গিয়ে বসে চা-টা খায়, গল্প টল্প করে, অন্য কোথাও থেকে ডাকাডাকি করলে তবে ওঠে, নইলে আড্ডাই মারে, তেমনই বাঁধুলির ঘর থেকে কমল যখন বেরোচ্ছে অভীক ঢুকল, বলল, “কী রে, তুই?”

“বাঁধুলির জ্বর।”

“ও, চলে যাচ্ছিস?”

“এই যাচ্ছিলাম।”

“চল, উপরে চল।”

অভীকের সঙ্গে আজ এসেছে পূর্ণেন্দু আর সজল। চারজনে উপরে চলে গেল।

সেদিন কমলকে কিছু বলার কথাটা মনেই থাকল না আয়েষার। পরের দিন তার ভীষণ ঝামেলা গেল পার্বতীকে নিয়ে। পার্বতী সেন্টারের আয়া হিসেবে ঢুকেছিল বাঁধুলি হওয়ার সময় থেকে। এত বছর টিকে গেছে। সকালে আসে, রাতে যায়।

পরের দিন পার্বতী এসে দুম করে বলল, “তারকেশ্বর যাব। চারদিন ছুটি দাও।”

টাকাপয়সা চাও, আয়েষা উদার হস্ত। কিন্তু ছুটি চাও, আয়েষা দেবে না! সে মনে করে, তার চাকরবাকর চব্বিশ ঘণ্টা, তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই তার চাকরবাকর। সে বলল, “বাঁধুলির জ্বর, কে দেখবে। ছুটি ফুটি হবে না!”

পার্বতী বলল, “ওরকম বোলো না বউমণি। ছেলের নামে মানত আছে। যেতে হবেই। না যদি ছুটি দাও, তা হলে আমাকে কাজ ছাড়তে হবে!” পার্বতী এতটা বলত না। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, আয়েষা ছুটি দেবে না। বিস্তর ঝামেলা করবে।

এদিকে ‘মানত’ শুনেই আয়েষা ভাবল, তা হলে দু’দিনে ছুটি মঞ্জুর করবে। ধমকে বলবে, দু’দিনের মধ্যে ফিরতে হবে। কিন্তু পার্বতী এতটা বলে ফেলল বলে সে বেঁকে বসল। সে বলল, “তুমি টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে বিদেয় হও! আয়েষা ঘোষকে চাপ দিয়ে কাজ আদায় করবে? কেউ পারল না, আর তুমি! টাকা ফেললে লোকের অভাব? ওসব ভয় তুমি অন্য জায়গায় দেখিয়ো পার্বতী!”

পার্বতীর সঙ্গে আয়েষার বারো বছরের আন্ডারস্ট্যান্ডিং। দু’-দুটো সিজারিয়ান সেকশন হয়েছিল তার। বাঁধুলি হওয়ার পরপর সে শুয়ে থেকেছে বহু দিন। পার্বতীই প্রকৃতপক্ষে বড় করেছে মেয়েকে। কিন্তু এই কথোপকথনে এক নিমেষে সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং ধসে পড়ল। পার্বতী চোখের জল চেপে নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করে তরতরিয়ে নেমে গেল নীচে।

লালু সেই সময় উপরে আসছিল। আয়েশাকে এসে লালু বলল, “কী হয়েছে গো আয়েষাদি? পার্বতীদি ‘টাকার গরম, টাকার গরম!’ করতে করতে চলে গেল, মনে হল, খুব খচে আছে!”

আয়েষা নিজের ঘরের সোফার উপর কোমরে হাত দিয়ে বসে রইল স্তম্ভিত হয়ে! পার্বতী যে পার্বতী তার জুতোর তলায় থাকে, পিঁপড়ের মতো টিপে মারতে পারে যাকে সে, তার এত চোপা? এই তো দু’দিন আগে অবধি একটু স্থির হয়ে সে বসলেই পার্বতী হার্বাল ম্যাসাজ তেলটা এনে তার পায়ে মালিশ করে দিত। সারাক্ষণ সেবা করার জন্য ছটফট করত যেন, আর সেই পার্বতী…হঠাৎ আয়েষা এত রেগে উঠল যে, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তার মাথা ঘুরে গেল। তার ধবধবে ফর্সা মুখ একরকম লাল হয়ে ফুলে উঠল অপমানে। ভাগ্যিস লালু দাঁড়িয়ে ছিল সামনে, সে টলে যেতে লালু ধরে ফেলল তাকে।

আয়েষাকে যেভাবে ধরল লালু, তাতে তার মনে হল, নিজের হাতখানা তার দু’ থাক নরম গদির মধ্যে ঢুকে গেছে! আয়েষাদি দুর্দান্ত সুন্দরী ছিল। একদম শ্রীদেবী কিংবা দিব্যা ভারতী স্টাইলের। কিন্তু এখন পুরো জয়ললিতা হয়ে গেছে! আয়েষাদিকে দেখে আর কারও কোনও কামভাব জাগার কথা নয়। তবু মেয়েমানুষ তো, আর ছোটবেলায় আয়েষাদির ট্যাসেল ঝুলিয়ে নিতম্ব দুলিয়ে হেঁটে যাওয়াটা এখনও মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি বলে আয়েষাদির শরীরের ভাঁজে খাঁজে হাত দেওয়া অবস্থায় মাথায় পাপ চিন্তা যেন না আসে ভেবে জিভ কাটল লালু মনে মনে। তবু পাপচিন্তা এলই তার মনে! টিভিতে একটা কী যেন চ্যানেলে দেখায় না বিরাট ফোলানো, হাওয়া ভরা গদির উপর দিয়ে লোকে হাঁটার চেষ্টা করছে, তারপর টুপ করে জলে পড়ে যাচ্ছে — লালুর হঠাৎ মনে হল, আয়েষাদির উপর চড়ার চেষ্টা করলে প্যাঁকাটির মতো রোগা লালু সমাদ্দার ওইরকম টুপ করে খসে পড়ে যাবে! লালু মনে মনে গালে চড় কষাল নিজের, পাঁক, পাঁক! মানে একদম খালের জলের পাঁক!

আয়েষার অবস্থাও তথৈবচ! সে দামি দামি শাড়ি পরে, গয়না পরে, খুব সাজগোজ করে, মেয়েলি কতগুলো ব্যাপারে সে ভয়ানক পারদর্শী। যেমন পরচর্চা, পরনিন্দা, লাগানো ভেজানো, পরশ্রীকাতরতা, আবার সে হইহইও করে খুব। পাড়া মাতিয়ে রাখে, এই পাড়ায় মাদার্স ডে পালন করল, এই পাড়ায় ফাংশন করাল মেয়ে বউদের দিয়ে, এই বিসর্জনের দিন নাচতে নাচতে বাগবাজার ঘাটে চলল, কখনও ঝাঁপিয়ে পড়ে কাউকে হাসপাতালে পাঠাল, কারও মেয়ের বিয়ের জন্য কোমর বেঁধে লেগে পড়ে ব্যবস্থা করল। কিন্তু এই এতসব কিছুর মধ্যে তার নারী হিসেবে অস্তিত্বটা কোথায় যেন শরীর এবং মন দুটোর কাছেই পরাজিত হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে! গহিন, অন্তলীন নারীত্ব তার জীবনের কোথাও আর কোনও পদধ্বনি তোলে না। তার জীবনে না আছে কোনও প্রেমের ভূমিকা, না আছে শরীরের ভূমিকা। সে প্যাট প্যাট করে তাকায় লোজনদের দিকে, কুটিল চাউনি দেয়, অবজ্ঞার চোখে তাকায়, ঠাট্টার, ব্যঙ্গের চোখে তাকায়, ভর্ৎসনার কিংবা রাগের চোখে তাকায়। কিন্তু প্রেমের দৃষ্টি সে কারও দিকে নিক্ষেপ করেনি বহু বছর। সে বিশাল বপুখানা নিয়ে হেঁটে চলে বেড়ায়। কিন্তু সেই সঞ্চরণের মধ্যে কোনও তরঙ্গ নেই, উতরোল নেই, ঢেউ নেই। সেই চলাচল অনেকটা জাহাজের কন্টেনারের ক্রেনে করে ওঠানামার মতো। একটু বেসামাল হওয়ার জো নেই। এপাড়ায় দুটো লালু আছে, একটা ঢ্যাঙা লালু, একটা রোগা লালু। রোগা লালু আয়েষাকে ধরতে আয়েষার কোনও হেলদোল হল না। সে বলল, “ও লালু, কমলকে ডাক। আমার মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে হট করে।” আয়েষা আবার ধপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

বাঁধুলির জ্বর ছাড়তে ছাড়তে, আয়েষার শরীরে বল ফিরে আসতে আসতে মাঝে তিন-চারদিন কেটে গেল। কমল রোজই এল গেল, আড্ডা দিল। কিন্তু আয়েষার আর কমলকে সোহিনী-শাঁটুলের কথাটা বলে ওঠা হল না।

পয়লা বৈশাখের দিন আয়েষা বাড়িতে একটা গেট টুগেদার করে। যাকে পারে, যাকে রাস্তায় দেখে মনে হয় ডাকি, তাকেই ডাকে, আহ্বান জানায় ছাদের সেই গেট টুগেদারে আসতে। তা ছাড়া এপাড়ার অনেকেই আছে ডাকলেই আসে। এমনকী, না ডাকলেও চলে আসে এবাড়ির উৎসব অনুষ্ঠানে।

কমল আর সোহিনীর তো এমনিই নেমন্তন্ন। এবার কমল আর সোহিনী ঢুকতেই আয়েষার জিভ সুলুক সুলুক করতে লাগল। সে অমনই টের পেল, কীসের একটা খুঁতখুঁতুনি চলছিল মনের মধ্যে ক’দিন ধরেই।

সে খুব ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেল সোহিনীর দিকে। এতদিন সে সোহিনীকে ‘তুমি তুমি’ করে কথা বলত, আজ একরকম ‘আয়, আয়, সোহিনী, কী সুন্দর দেখাচ্ছে রে তোকে,’ বলে খুব প্রগল্ভ হয়ে পড়ল আয়েষা। শাঁটুল এসেছে কী না চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল সে। নাঃ, এখনও আসেনি। এলে এমন কিছু করতে হবে যে, রগড় হবে খুব! মনে মনে ভাবল সে। কী করা যায়? কী করা যায়? এমন কিছু করতে হবে যে, কমলের বউ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যাবে। আয়েষা কখনও চায় না কমল বউকে ত্যাগ করুক। সে ডিভোর্স টিভোর্সের পক্ষপাতী নয়। আরে, ডির্ভোস হয়ে গেলে তো হয়েই গেল। ভাঙাভাঙির মধ্যে কোনও রস নেই। আকচাআকচিতে রস, গোপন কর্ম তো রসে থইথই! কেচ্ছা কেলেঙ্কারি ছাড়া জীবনে উপভোগ করার মতো আর আছেটা কী? উফ, পাড়ার অন্যতম বর্ধিষ্ণু পরিবারের ইংলিশে এম এ বউ, পাড়ার হায়ার সেকেন্ডারি পাশ বাড়ির দালালের সঙ্গে প্রেম করছে!

ঠিক এই সময় ছাদে উঠে এল শাঁটুল। শাঁটুলকে দেখে আয়েষার কটা কটা চোখ দুটো রহস্যের সন্ধানে গনগনে হয়ে উঠল যেন! ফুলো ফুলো হাতের গোল গোল আঙুল পট পট করে মটকে ফেলল উৎসাহে। শাঁটুলটা এমনি আর যাই হোক, চেহারাটা বেশ হিরো হিরো! আজকাল জামাকাপড়ও বেশ বেছে বেছে পরছে। হাতে সোনার চেন পরেছে। চুল টুল সব সময় শ্যাম্পু করা। ফ্ল্যাট, বাড়ির দালালি করে বেশ ভালই ইনকাম করছে শাঁটুল এখন। সেদিনই তো অভীক তার সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে মোবাইলে বলছিল শাঁটুলকে, ‘তুই বিশ্বাসদের বাড়িটা আমাকে করিয়ে দে। দেড় কোটির মধ্যে টু পার্সেন্টের জায়গায় থ্রি পার্সেন্ট আমি তোকে দেব। আর যাই করিস শাঁটুল, মেড়োগুলোকে নর্থে আর ঢুকতে দিস না। ওরা এখন কলেজ স্ট্রিট অবধি চলে এসেছে। এবার শ্যামবাজার, বাগবাজারও ওদের গ্রাসে চলে যাবে। বাঙালির সঙ্গে ব্যাবসা কর শাঁটুল, বাঙালির সঙ্গে।’

দেড় কোটির থ্রি পার্সেন্ট প্রায় চার সাড়ে চার লাখ টাকা! আয়েষার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে, অন্য কেউ অনেক টাকা রোজগার করছে শুনলেই সে কেমন আঁতকে ওঠে! নিজেদের ক্ষেত্রে হলে এই টাকাটাই তার মনে হত খোলামকুচি! আসলে আয়েষার জগৎটা খুব বড় নয়, এই বি টি রোডের হেমন্ত সেতুর ডান হাতে পড়ে থাকা বেশ একটা বড়সড় সাইজের ভূখণ্ডের মধ্যেই তার জগৎটা আটকে। এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে সে খুব একটা স্বচ্ছন্দ নয়। আর এইটুকুর মধ্যেই প্রভাব-প্রতিপত্তির যে আস্বাদ পেয়েছে, তা ধরে রাখতে সে সদা সতর্ক।

ফোনের কথোপকথন শুনে সে অবাক হয়ে অভীককে জিজ্ঞেস করেছিল, “শাঁটুল আজকাল এত বড় বড় ডিল করছে?” অভীক সেদিন বাধ্য হয়ে তার সহ-সওয়ারি হয়েছিল গাড়িতে। তার প্রশ্নের কোনও উত্তরই দিল না অভীক! সে যদি আবার প্রশ্ন করত তা হলে অবধারিতভাবে শুনতে হত, ‘নিজের চরকায় তেল দাও!’ অভীক তার প্রতি আজকাল নির্দয় হয়ে উঠেছে এবং তাতে বয়েই গেছে আয়েষার!

শাঁটুলকে তার ছোট মেয়ে বাঁধুলি খুব পছন্দ করে। শাঁটুলকে দেখেই বাঁধুলি ছুটে এল, শাঁটুল খুব ভাল মিমিক্রি করে বম্বের সিনেমা আর্টিস্টদের। সেগুলো বারবার দেখতে চায় বাঁধুলি। কিন্তু বাঁধুলি শাঁটুলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার আগেই আয়েষা শাঁটুলকে বলল, “অ্যাই শাঁটুল শোন এদিকে, কথা আছে!”

শাঁটুল আয়েষার এমন ঘনিষ্ঠ আহ্বানে অবাক হল কিঞ্চিৎ! বাবা, আয়েষাদির তো আজ অন্য মুড। প্রথমে আয়েষা একটা কাজের কথা সেরে নিল শাঁটুলের সঙ্গে।

“শোন, লাইব্রেরিটা কিন্তু উঠে যেতে দেওয়া চলবে না শাঁটুল। মকাইদারা যদি বাড়িটা প্রোমোটারকে দিয়ে দেয়, তা হলে জ্যোতিষ্মানদারই বা কী হবে? কোথায় যাবে মানুষটা?”

সকলেই জানে, শাঁটুল জ্যোতিষ্মানদাকে ভীষণ ভালবাসে। এদিকে এ পাড়ায় কোনও বাড়ি বিক্রি হলে বা প্রোমোটারি হলেও শাঁটুলের লাভের ব্যাপার থাকে। পার্টি আনতে পারলে সে ভাগ পায়।

শাঁটুল খুব দমে যাওয়া গলায় বলল, “জ্যোতিষ্মানদার তো গলায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে, জানো তো?”

“আমি জানব না?” বলল আয়েষা।

একথা-সেকথা বলে আয়েষা একদম সোজাসুজি আক্রমণ করল শাঁটুলকে, “সোহিনীর সঙ্গে তো খুব ইশারায় প্রেম চলছে? বলিস তো আমি তোকে সাহায্য করতে পারি!”

শাঁটুল ঘাবড়াল না। এক মুখ হাসল, “প্রেম কেন হতে যাবে?”

“তা হলে?”

“ধুস! কী যে বলো না?”

“আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয় রে শাঁটুল!”

“তুমি তো সকলের সঙ্গেই প্রেম দ্যাখো! তোমার মেয়েরা বড় হচ্ছে, তুমি এখন ওদের দিকে খেয়াল রাখলে কাজে দেবে,” শাটুল ভীষণ বুদ্ধিমান। সে আয়েষার ফাঁদে পা দিল না।

আয়েষার ভুরু কুঁচকে গেল। তার চোখ ঘুরতে লাগল শাঁটুলের মুখের উপর, “সোজা কথা সোজা করে বল শাঁটুল! আমি যা বলি, সোজা বলি!”

“আমার বলার কী আছে? তোমার চোখ তো সব দিকে! তা বাঁধনের দিকেও মাঝেসাঝে খেয়াল কোরো!” শাঁটুল খেলে দিল।

কত কী ভাবছিল আয়েষা শাঁটুল-সোহিনীকে নিয়ে! হঠাৎ বাঁধনের কথা ওঠায় চিন্তাভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে গেল তার। বাঁধন ছাদে নেই। সে ধুপধাপ করে নামল দোতলায়। বাঁধন সাজছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। একটা লাল ঢাকাই পরেছে, সঙ্গে লাল ঘটি হাতা ব্লাউজ়। ডালিয়াও খুব সেজেগুজে এসে বসে আছে, বাঁধনের মেক-আপ বক্স ঘাঁটছে। আয়েষা বাঁধনকে বেশ ধমক দিয়ে বলল, “উপরে চল। এত দেরি হচ্ছে কেন?”

বাঁধন বলল, “মা, আমি আর ডালিয়ামাসি একটু বাগবাজারে যাচ্ছি। ওপাড়ায় ফাংশন হচ্ছে। সোনু নিগম আসছে, বিশাল-শেখর আসবে, বিশালকে আমার অসাধারণ লাগে…আর দেব-ও আসছে। মাইকে অ্যানাউন্স করেছে!”

বাঁধন একদম তার মতোই হয়েছে। তার তো সারা জীবন কেটেছে জিতেন্দ্র-জয়াপ্রদা, মিঠুন-মাধুরী করে তারা কী খায়, কী মাখে, কে কার সঙ্গে প্রেম করছে, সে অতি অধ্যবসায়ের সঙ্গে এর পাঠ নিয়েছে বাঁধনের চেয়ে ছোট বয়স থেকে। এমনকী, মেয়েদেরও সে কখনও কোনও কবিতা মুখস্থ করে শোনাতে বলেনি, বলেছে, “ওই গানটা গা তো, ‘দিল তো পাগল হ্যায়, দিল দিওয়ানা হ্যায়!” বলেছে, “ধুম মচা দে, ‘ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর’ নাচটা নাচতে। সে কত বার ভেবেছে, চ্যানেলে চ্যানেলে ডান্স কম্পিটিশনে নাম দিলে মেয়ে তার নেচে ফাটিয়ে দিত! তারই উদ্যোগে পাড়ার বাৎসরিক ফাংশনে বম্বের স্টার কেউ না-কেউ আসেই। ক্লাবের টাকায় না কুলোলে সে নিজেই ভর্তুকি দেয়। পাড়ার বয়স্কদের অনেকেই অভিযোগ করে, অভীকের হাতে পড়ে পাড়ার সংস্কৃতির অনেক অবনতি হয়েছে! তা হয়েছে, হয়েছে। আয়েষা এসব গায়েই মাখেনি। অভীক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, অভীকের বউ হিসেবে তার কথাই খাটে। সে কোমর বেঁধে মাঠে নামে বলেই তো ক্লাবের পুজো প্রতি বছর পুরস্কার পায়, রত্তন্দান শিবির এত সফল হয়, কাঙালি ভোজন, কম্বল দান, দুঃস্থ শিশুদের পাঠ্য বই বিতরণ— এরকম নানা জনহিতকর কার্যকলাপ চলতেই থাকে। চ্যানেলে চ্যানেলে নাম ওঠে পাড়ার। এসব সত্ত্বেও, তার এই ওরিয়েন্টেশন সত্ত্বেও আজ বাঁধনের কথায় গায়ে জ্বালা ধরে গেল আয়েষার। বলল, “টিভিতে দিন রাত এত সিনেমা আর্টিস্টদের দেখেও মন ভরছে না? কথায় কথায় রাস্তায় বেরোনো, কথায় কথায় বাগবাজার যাওয়া! কেন, কী আছে বাগবাজারে? আর ডালিয়া ই কী রে? তোর না হয় পড়াশোনার পাট চুকে গেছে, ওর তো তা নয়। বল?”

এমনিতেই আয়েষার গোপন রাগ ছিল ডালিয়ার প্রতি ক’দিন যাবৎ, একদিন ভানু এসেছে আর ডালিয়া রোজ ভানুদির গল্প করছে, ভানুদির নাকি ফিগারটা দারুণ আছে, ভানুদির বর নাকি ভানুদিকে ভাত টাত খেতেই দেয় না, বউয়ের দিকে ভীষণ নজর…আয়েষার আবার ফিগার ভাল মেয়েদের প্রতি ঘোর বিদ্বেষ। আজ এই সুযোগে সে ডালিয়ার প্রতিও বিশেষ কঠোর হয়ে উঠল। সে বলল, “ডালিয়া তোর উচিত তোর বয়সি মেয়েদের সঙ্গে মেশা।”

বাঁধন খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠল, “মা এটা ঠিক নয়, তুমি ডালিয়া মাসিকে এরকম করে কথা বলবে না খবরদার! তুমি পাড়ায় যাদের সঙ্গে মেশো, রকে বসে আড্ডা দাও, তারা সব তোমার বয়সি?”

ডালিয়া বোকার মতো হাসল। মেয়েটা অতিরিক্ত নিরীহ। এই আক্রমণের মানেই বুঝল না। উলটে বলল, “আমি যাই, মা-ও ফোন করছে।”

কিঞ্চিৎ হুঁশ হল আয়েষার, “না, না, উপরে যা, খেয়ে যাবি। তোদের আজ আর বাগবাজার যাওয়ার দরকার নেই।”

“আমি পরে এসে খাব!” ততক্ষণে দু’চোখে জল চলে এসেছে ডালিয়ার। কাউকে কিচ্ছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল সে।

বাঁধন কিছুক্ষণ মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে একে একে খুলে ফেলতে লাগল সাজসজ্জা। তারপর চুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

“তুই উপরে যাবি না?”

“না, তুমি চলে যাও এখান থেকে!”

“কী দোষের কথা বললাম শুনি?”

বাঁধন ষোলো বছরের মেয়ে, মোটেই আর ছোট নেই। বাঁধন বলল, “মা, এখনও তুমি যদি নিজেকে না সংশোধন করো, মানুষকে যখন তখন অপমান করা বন্ধ না করো, একদিন তোমাকে সবাই ছেড়ে চলে যাবে। কেউ তোমার পাশে থাকবে না। দাদু না, ঠাম্মি না, বাবা না, বোন না — কেউ তোমাকে ভালবাসবে না। একমাত্র আমিই তোমাকে ইগনোর করিনি। ‘মা’ বলে সব সময় মান্য করেছি, আজ তুমি ডালিয়াদির সঙ্গে যা করলে, তোমাকে আমি….তোমাকে আমিও আর ভালবাসব না।”

আয়েষা বলল, “খুব হয়েছে, খুব ভায়লগ দিচ্ছিস!”

বাঁধন বলল, “মা, প্লিজ লিভ মি অ্যালোন। উইল ইউ?”

আয়েষা বুঝল, মেয়ে যথার্থই রেগে গেছে। সে আর ঘাঁটাল না বাঁধনকে। আপাতত মেয়ের বেরোনো আটকানো গিয়েছে এতেই ভীষণ খুশি হল সে। সে আবার থপ থপ করে উঠতে লাগল ছাদে।

শাঁটুল লক্ষ করেছে, তার কথা শুনেই আয়েষাদি তরতর করে নীচে নেমে গেল। আর এখানে থাকবে না মনস্থির করে ফেলল সে। থাকলে ভালই হত! সোহিনী সাউথকে কাছ থেকে দেখা যেত ভাল করে। চন্দন রঙের একটা তাঁতের শাড়িতে যা দেখাচ্ছে! ব্লাউজের পিঠটা গভীর করে কাটা। সাদা পিঠটা তোলপাড় তুলবে যে-কোনও পুরুষের মনে। পিঠে লম্বালম্বি একটা খাঁজ। সেই খাঁজে শাঁটুল নাক ঘষল মনে মনে। তারপর চোঁ চোঁ করে দুটো হুইস্কি মেরে দিয়ে সে সোজা গিয়ে দাঁড়াল সোহিনীর সামনে। মেয়েটা তখন দলছুটের মতো ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে অদূরের ব্রিজের দিকে তাকিয়ে আছে উদাস চোখে। আশেপাশে কেউ নেই। শাঁটুল সামনে দাঁড়িয়ে বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে বলল, “শোনো, আয়েষাদির সম্পর্কে একটু সাবধানে থেকো।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *