কড়িখেলা – ২

॥ ২ ॥

খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শর্মিলার। ঘোরের মধ্যে উঠে বসে সে জোরে জোরে নাক টানতে লাগল, আঃ, আঃ! চারিদিকে একটা ম, ম, গন্ধ! নিম-বেগুন ভাজার গন্ধ। গন্ধটা যে নিম-বেগুন ভাজার সেটা অনুধাবন করতেই ঘুমের ঘোরটা সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছিল শর্মিলার। এই আঠাশ তলার বিল্ডিং-এ কার ফ্ল্যাট থেকে নিম-বেগুন ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে? এখানে তো বাঙালি প্রায় নেই বললেই চলে। হাতে গোনা! আশেপাশে একটাও বাঙালি নেই। আর থাকলেও এত ভোরে ওট-মিল্ক, কর্নফ্লেক্স দিয়ে ব্রেকফাস্ট করার বদলে কে নিম- বেগুন খাবে? এই কমপ্লেক্সের বাঙালিদের লাইফস্টাইল তো আন্তর্জাতিক মানের। গন্ধটা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল! ইচ্ছে করছিল, গরম ভাত নিয়ে তাতে নিম-বেগুন ভাজা মেখে খায়। হালকা সবুজ তেল গড়িয়ে আসবে মাখার সময়। মামি কী মুচমুচে করে ভাজত নিমপাতাগুলো, তেতোর আস্বাদও যে অমৃতর মতো হতে পারে, তা মামির নিম-বেগুন খেলে বোঝা যায়।

গায়ত্রীর কথা মাথায় আসতেই মেরুদণ্ডে একটা টক্কা লাগল শর্মিলার। ও হো, সে তো গায়ত্রীরই স্বপ্ন দেখছিল এখন! ঠিক গায়ত্রী নয়, মামাবাড়ির পাড়ার স্বপ্ন, অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটের বাড়ি, শিবমন্দির, চিলড্রেন্স পার্ক, পোলের তলা, রেলমাঠ, রায়বাগান, সরকার বাগান — সব মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা বড়সড় পটভূমি। স্বপ্নের মধ্যে সে দেখছিল, রাধাদিদের বাড়ির সামনের রকে বসে সে বেলা পার করে আড্ডা দিচ্ছে তো দিচ্ছে আর গায়ত্রী কুণ্ডুবাড়ির পাঁচিলের ওপাশ থেকে ডাকছে তাকে, ‘ভানু ভাত খাবি আয়। নিম-বেগুন ভেজেছি ভানু, খাবি আয়।”

শর্মিলা অবাক হয়ে বসে রইল, স্বপ্নের নিম-বেগুনের গন্ধ এত তীব্র হয়ে নাসারন্ধ্রকে উত্তেজিত করে? সে আবার শুঁকল বাতাস, হ্যাঁ, এখনও স্পষ্ট গন্ধটা পাচ্ছে সে! তখনই তার মনে হল, হয়তো গন্ধটা শুধুমাত্র তার কল্পনা নয়, কোথাও সত্যিই ভাজা হচ্ছে নিম-বেগুন! শর্মিলা আদিত্যর দিকে তাকাল এবার। আদিত্য এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না। ছ’টায় উঠে পড়ে মুখটুখ ধুয়ে পরিপাটি হয়ে প্রপার ট্র্যাক প্যান্ট ট্যান্ট পরে গেস্টরুমে রাখা ট্রেড মিলে দৌড়োবে আধঘণ্টা। তারপর কিছু যোগাসন করবে। তারপর নিজেই জল গরম করে গার্গল করবে এবং এসব সেরে চায়ের জল বসিয়ে তাকে ডাকবে। কিছু না ভেবেই শর্মিলা আদিত্যকে ঠেলা দিল, “অ্যাই শুনছ? শোনো না?”

এক ডাকাতেই চোখ মেলল আদিত্য, “কী?”

“আচ্ছা, তুমি কি নিম-বেগুন ভাজার গন্ধ পাচ্ছ?”

বুকের উপর দুটো হাত জড়ো করে শুয়েছিল আদিত্য, এটাই তার শোওয়ার ভঙ্গিমা। সেই অবস্থাতেই চোখ বড় বড় করে পলক ফেলল, “কী বলছ? নিম-বেগুন?”

“হ্যাঁ? গন্ধ পাচ্ছ?”

সোজা উঠে বসল আদিত্য, “শর্মিলা, তুমি না প্লিজ ন্যাকামি করাটা বন্ধ করো।”

আহত দৃষ্টি মেলে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রইল শর্মিলা, “বিশ্বাস করো, আমি একদমই ন্যাকামি করিনি। ঘুম ভেঙে গেল একটা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নে দেখলাম ছোটমামি আমাকে নিম-বেগুন ভাজা দিয়ে ভাত খেতে ডাকছে। তারপর এখনও আমি স্পষ্ট এখানে ওই নিম-বেগুন ভাজার গন্ধ পাচ্ছি। এটা কী করে সম্ভব? ভীষণ অবাক হলাম বলেই তোমাকে ডাকলাম।”

আদিত্য একটু নরম হল, “না, আমি কোনও গন্ধ টন্ধ পাচ্ছি না। আর শর্মিলা, ঘুম ভাঙিয়ে তুমি একথা জিজ্ঞেস করছ? আচ্ছা, তোমার বয়স না হয় বাড়েনি, তুমি কচি খুকিটি হচ্ছ। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে, সারাদিন এত পরিশ্রম করতে হয়, আমার ঘুমে থাবা না বসালেই আর চলছিল না?”

শর্মিলা চুপ করে গেল। আজকাল আদিত্য তাকে সামান্য সামান্য কারণেই খুব বকাবকি করে। শর্মিলা বুঝতে পারল না, একদিন আধঘণ্টা আগে ঘুম থেকে ডেকে তুললে কী এমন অন্যায় করা হয়! সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আদিত্য আর শুল না, নেমে গেল বিছানা থেকে। অতঃপর প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মে নিযুক্ত হল।

শুয়ে শুয়ে শর্মিলা ভাবতে চেষ্টা করল, স্বপ্নটা ঠিক কী ছিল? কোথা থেকে কোথায় ঘুরছিল স্বপ্নটা। ভাবতে ভাবতে মৃদু হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে। স্বপ্নে সে যখন রাধাদিদের রকে বসে গল্প করছে তখন জানলা দিয়ে দু’-দু’বার রাধাদির মা পানের পিক ফেলেছে। রাধাদির মা কি এখনও বেঁচে আছে?

ছ’ বছর আগে যখন শর্মিলা অনাদি ঘোষাল স্ট্রিট ছেড়ে চলে আসছে তখন তো রাধাদির মা বেঁচেই। এই ছ’ বছরে তার সঙ্গে গায়ত্রীর ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু সেরকম খোশগল্প তো হয়নি কখনও যে, পাড়া-প্রতিবেশীর খবর নেবে। আর শুধু রাধাদির মা-ই কেন, ও পাড়ার বুড়োবুড়িদের কত জনই যে এই ছ’ বছরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, তাই বা কে জানে?

শর্মিলা এমনই এমনই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ভাবল, আজ অফিসে পৌঁছে গায়ত্রীকে একটা ফোন করবে। অনেক দিন তো কথাই হয়নি। তখন জিজ্ঞেস করবে রাধাদির মা’র কথা। কানাই জেঠাও তাকে বড় স্নেহ করতেন। বাপ-মা মরা মেয়ে, একটু খোঁজখবর নিতেন। কানাই জেঠার কথাও একবার জানতে চাইবে শর্মিলা। কবে যেন একদিন নিউ মার্কেটে দেখা হয়েছিল সরসীদির সঙ্গে। চাম্বা-লামা থেকে রুপোর গয়না কিনছিল শর্মিলা। আদিত্য খুব পছন্দ করে এসব সাজ। সরসীদি খুব তাড়াহুড়ো করে দু’-একটা কথা বলেই চলে গেল। কানাই জেঠার কথা জিজ্ঞেসই করা হল না তার। তবু মনে আছে, তারই মধ্যে সরসীদি তার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘দেখে তো মনে হয় ভালই আছিস?’ সে হাসতে চেয়েছিল, পারেনি। কেন কে জানে? তার ভাল থাকার মধ্যে একটা হুল ফুটে আছে প্রথম থেকেই।

আদিত্য গার্গল করছে, তার মানে যোগ টোগ হয়ে গেছে। শর্মিলা ভাবল, মাঝে মাঝেই বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে তার গাড়িতে গিয়ে উঠতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয়, কিছু একটা তাকে পিছন দিকে টানছে। পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছে করে ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় চড়ে বসে, শ্যামবাজার স্টেশনে গিয়ে নামে। সে মনশ্চক্ষে দেখতে পায়, শ্যামবাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে সে পোলের দিকে যাচ্ছে, তারপর ব্রিজ থেকে নেমে গেল। তখন পোস্ট অফিসের জরাজীর্ণ বাড়িটার দরজা বন্ধ হচ্ছে, জগুর চায়ের দোকানের সামনে ভীষণ ভিড়, ভীমের দোকানে চুবড়িতে পড়তে না-পড়তেই উড়ে যাচ্ছে সোনালি গরম গরম চপগুলো, তখন জ্যোতিষ্মানদা লাইব্রেরির দরজা খুলে জলের ছিটে দিচ্ছে, তখন সে-ও পৌঁছে গেছে পাড়ায়!

এই ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে যায়! ছ’ বছরে টান যত বেড়েছে, যাওয়া কিছুতেই হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া আদিত্যকে জানিয়ে তো যাওয়া যায় না। আদিত্য মত দেবে না। তার জীবনের সব বিষয়ে আদিত্যর মতামতের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আদিত্যর জীবনের অনেক ব্যাপারেই তার মতামতটা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না! আর তাকে ওপাড়ায় কেউ ডাকেও না। গায়ত্রী কি কখনও জোর দিয়ে বলেছে, ‘আসবি না কেন, আয়! কত দিন দেখিনি তোকে!’

শর্মিলার চোখে জল চলে এল! জলে চোখ ভরে উঠল, কিন্তু গড়িয়ে বালিশে পড়ে গেল না। উপরন্তু সুড়সুড়ি দিতে লাগল চোখে। সে ভাবল, আর একটু জল এলেই জলটা উপচে পড়তে পারত চোখ থেকে। কিন্তু আজকাল কী হয়েছে, চোখে জল এসেই তারপর অশ্রু শুকিয়ে যায়। পরিপূর্ণ একটা কান্না সে অনেক দিন কাঁদেনি। আসেই না! তার দুঃখের কি গভীরতা নেই কোনও? নাকি আদিত্যর সঙ্গে থেকে থেকে সে ভিতরে ভিতরে সত্যিই এতটা বদলে গেছে যে, চোখে জল আসামাত্রই যুক্তির ব্লটিং পেপার ফেলে সেই জলকে অসংকোচে শুষে যেতে বাধ্য করে। যুক্তি? আদিত্য খুব যুক্তিবাদী। শর্মিলা পড়াশোনায় খারাপ ছিল না। ভাল রেজাল্টই করত। কিন্তু সে তো বই মুখস্থ করে থরে থরে উত্তর লিখে আসা। তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার জগৎ বলে কিছু ছিল না কখনও। নিজস্ব যুক্তিবৃত্তি বলেও তার কখনও কিছু গড়ে ওঠেনি। আদিত্য যা বলে, এতদিন সে শুধু সেটাই বিশ্বাস করে এসেছে। ভেবেছে, সেটাই সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ।

ইদানীং অবশ্য সে আদিত্যর সব যুক্তি মেনে নিতে পারছে না। যেমন তাকে না বলে আদিত্যর সিঙ্গাপুর যাওয়ার যুক্তিটা। আসলে তাকে না বলে আদিত্য কেন সিঙ্গাপুর গেল, সেটা তো মনে মনে সে নিশ্চিতভাবে জানে! জানে না? তা-ও না বলে যাওয়ার ব্যাখ্যা শুনতে চায় কেন? এটুকুও না জিজ্ঞেস করলে, এই সামান্য চাপটুকুও না রাখলে শেষ অবধি তার পরিণতি কী হবে, এই ভেবেই তো? কী অদ্ভুতভাবেই না আদিত্যর সিঙ্গাপুর যাওয়ার খবরটা পৌছোল তার কাছে! অথচ তার জানার কথাই নয়।

কিচেনের আওয়াজে শর্মিলা বুঝল, আদিত্য চায়ের ট্রে গোছাচ্ছে। উঠে চোখ-মুখ ধোওয়ার বদলে শর্মিলা ঘুমের মধ্যে আর একবার তলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। আদিত্য তাকে তুলে দিল এসে। এখন সবই একটু বদলে বদলে গেছে। কিন্তু এই সেদিনও আদিত্য ঘুম থেকে তুলে তার হাতে চায়ের কাপ দিলে, সে তার কাঁধ পর্যন্ত স্টেপ কাট চুলের গুছি দু’হাতে জড়িয়ে দু’কানে গুঁজে, বেশ নড়েচড়ে বাবু হয়ে বসে কাপ নিত হাতে। খুব আদুরে ভাব করত এই সময় শর্মিলা। আদিত্যর ব্যবহারটাই ছিল এরকম তার সঙ্গে। প্রায়শই স্নেহপ্রবণ! শাসনপ্রবণ! দু’জনের বয়সের প্রচুর পার্থক্যটাই তার কারণ, স্বাভাবিকভাবেই! আদিত্য আর সে প্রায় আঠারো বছরের ছোট বড়। আজ বেমক্কা অকারণে ঘুম থেকে তুলে দেওয়ার জন্য শর্মিলা ভেবেছিল তাকে দ্বিতীয় আর এক দফা বকাঝকা শুনতে হবে আদিত্যর কাছে। কিন্তু চায়ের ট্রে বিছানায় নামিয়ে রুমের পর্দা টর্দা সরিয়ে জানলাগুলো সব খুলে দিতে দিতে আদিত্য রোদ পড়া চোখ কুঁচকে আপনমনে হাসল একবার, লক্ষ করল শর্মিলা।

আদিত্য বলল, “সকালে কী স্বপ্ন দেখছিলে? নিম-বেগুন ভাজা খেতে ইচ্ছে হয়েছে?”

সে একটু মিটিমিটি করে তাকাল আদিত্যর দিকে। একটু অভিমান গলায় এনে বলল, “ইচ্ছে হলেই বা! তোমার তো আবার ওসব পছন্দই নয়। আমি তো বাজারে যাই না। তুমি যাও, তোমাকে বললে তুমি আনবে?”

একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বিছানায় এসে বসল আদিত্য। প্রায় তিপান্ন বছর বয়স হল আদিত্যর। কিন্তু যোগ টোগ করে চেহারাটা একদম তকতকে রেখেছে, নির্মেদ টানটান শরীর। বড় বড় চোখগুলোয় একটা বুদ্ধির তরলতা। যেটাকে চালাকের লক্ষণ বলতে পারে অনেকে। অন্তত ছোটমামা তো আদিত্যকে দেখে তাই বলেছিল, ‘ভীষণ চালাক লোকটা। এ তোকে এক হাটে কিনে দশ হাটে বেচে দেবে ভানু!’ মামি বলেছিল, ‘তা চালাক হবে না? এত বড় ব্যাবসা করে, কত লোক চরিয়ে খায়। তা ভানুই কি কম চালাক নাকি? এত বড় একটা লোককে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে কি এমনি এমনি?’ গায়ত্রী পানের রসে ভেজা ঠোঁট টিপে হেসেছিল, ‘ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোচ্ছে বিদ্যেধরী ভাগনি তোমার!’ আসলে পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল শর্মিলা। অনেক নম্বর পেত। তাই সকলেই ভাবত, তার মাথায় গজগজ করছে বুদ্ধি। কিন্তু বইয়ে পড়া বিদ্যে জীবনের অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত সংসারের বিষাক্ত পরিবেশে যে কোনও কাজেই লাগে না, তা শর্মিলা খুব ভাল করে জানে এখন।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আদিত্য খুব খেলিয়ে খেলিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে বলল, “আনব না কেন? বললেই আনব! দুপুরবেলা গরম গরম এক থালা ভাতে নিম-বেগুন ভাজা মেখে খাবে। তারপর মাছের কাঁটার চচ্চড়ি খাবে। তারপর আর কী যেন খেতে তোমার মামাবাড়িতে? মাছের ডিমের টক! আঙুল চাটবে, তারপর টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখবে ‘সাত পাকে বাঁধা।’ বিকেলে দেড়শো টাকা কেজির চা খাবে চিনি গুলে, আর কী কী? বাসে করে সতেরোটা লোকের কনুইয়ের গুঁতো খেতে খেতে অফিস যাবে, বসন্ত কেবিন না কোথায় পর্দা টানা কেবিনে বসে কাটলেট খাবে! শুধু নিম- বেগুন খেলে কি সাধ মিটবে তোমার শর্মিলা?”

দামি পোর্সেলিনের সুগার পটের ঢাকনা সরিয়ে চায়ে আর এক চামচ চিনি মেশাতে যাচ্ছিল শর্মিলা। আদিত্যর টীকা- টিপ্পনীতে সে হতবাক হয়ে হাত সরিয়ে নিল! ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আদিত্যর মুখের দিকে। সকাল সকালই তাকে ভাষণ দিতে পেরে আদিত্যর লালচে ত্বক যেন আরও চকচক করে উঠছে। অন্যকে বাক্যবাণে জর্জরিত করতে পারলে আদিত্য আর কিছু চায় না। এটাই আদিত্য রায়ের প্রিয় খেলা। যত বয়স বাড়ছে, এটা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদিত্যর মধ্যে কি কোনও চোরাগোপ্তা ফ্রাস্ট্রেশন আছে? আদিত্য কি দিন দিন স্যাডিস্ট হয়ে উঠছে? আজকাল নিজের মতো করে শর্মিলা কিছুই ভেবে উঠতে পারে না। সারাক্ষণ আদিত্যর ডিরেকশনে চলতে চলতে সে কেমন জবুথবু হয়ে গেছে।

শর্মিলার চোখে আবার জল চলে এল। এসেই সোঁ করে শুষে গেল কোথায়! সে বলল, “আজকাল না আপনাকে আমার ভীষণ রুড় লাগে অ্যাট টাইমস। একটা সামান্য ইচ্ছেকে আপনি কত ব্যঙ্গ করে দেখলেন।”

বিয়ে এবং প্রেমপর্ব মিলিয়ে-মিশিয়ে আদিত্যকে শর্মিলা প্রায় দশ বছর চেনে। প্রথম প্রথম আদিত্যকে সে ‘আপনি’ই বলত, ফর্মালি! কারণ, আদিত্য ছিল তার এমপ্লয়ার, কোম্পানির মালিক। আর সে ছিল এমপ্লয়ি। প্রেমের পরও বহু দিন ‘আপনি’ বলে এসেছে। তারপর বিয়ে হল। কিন্তু ‘আপনি’ বলাটা শর্মিলা পুরোপুরি ছাড়তে পারল না। যখনই আদিত্যকে তার একটু দূরের লোক মনে হয়, সে অমনই ‘আপনি’ বলে ফেলে! আসলে শর্মিলা নিজেও হয়তো জানে না, তার মধ্যে ‘আদিত্যর এমপ্লয়ি’ এই ব্যাপারটা কোথাও রয়ে গেছে এখনও! আর আদিত্যও সাম হাউ এই ‘আপনি’ বলাটাকে বরাবরই খুব এনজয় করে এসেছে। তাকে শুধরে দেয়নি কখনও! আদিত্য তো সকলের উপর প্রভুত্ব করতেই চায়। বস্তুত আদিত্যর সঙ্গে সকলের সম্পর্কই ওই গোছের। এমনকী, ওর বন্ধুদের সঙ্গেও একটা প্রভু টাইপের আচরণ করে থাকে ও! সেইজন্য আজকাল আদিত্যকে অনেকে অপছন্দ করছে। বিশেষত দেবোত্তম। সেই অপছন্দের জন্যই কি তলে তলে দু’জনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে কোনও শত্রুতা? নইলে দেবোত্তমের বউ পরিজা কেন আদিত্যর সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথাটা তার কানে তুলবে? চায়ের কাপে মুখ ডুবিয়ে শর্মিলা গোপনে একটু দেখল আদিত্যকে। শত্রুতার কথা, বন্ধুত্বর কথা তুললে আদিত্য বাঁকা হেসে বললে, ‘আমার কোনওদিনও কেউ বন্ধু ছিল না। আমিও কোনওদিন কাউকে বন্ধু বলে ভাবিনি। আমি মনে করি যে, কেউ যখন-তখন আমার সঙ্গে শত্রুতা করতে পারবে! আর আমি তার জন্য তৈরি। যতক্ষণ তুমি তোমার নিজের প্রয়োজনের সব কিছুকে কন্ট্রোল করতে পারছ, ততক্ষণ তুমি সেফ। ছেড়েছ কি মরেছ!”

মনে মনে শর্মিলা ভাবল, ভুবনেশ্বর যাচ্ছি বলে আপনি সিঙ্গাপুর কী করে চলে গেলেন আদিত্য? আমাকে মিথ্যে বললেন? আপনি কি একাই গিয়েছিলেন? আপনি কি তা হলে পরমাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুর ঘুরে এলেন? এটা কী করে জানা যায়? কী করে? কিছু একটা করে? কিন্তু শর্মিলা দেখল, সে আর তেমন মাথা খাটাতে পারে না আজকাল। হঠাৎ শর্মিলার মনে হল, সে আসলে কোনওদিনই খুব বুদ্ধিদীপ্ত, চৌখস মেয়ে ছিল না। অঙ্কও সে প্রাণভরে মুখস্থ করত। ব্রেন ব্যাপারটা তেমন ছিল কি না সন্দেহ। এত ভাল রেজাল্ট বলে সকলেই ভাবল, সে দুর্দান্ত ছাত্রী। সে নিজেও তাই ভাবল। একটা দারুণ সরকারি চাকরি পেয়েছিল সে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে। নিল না, কারণ, আদিত্যর অফিস ছেড়ে যাওয়ার কথা তখন আর শর্মিলা ভাবতেই পারছে না। সেই বোকামিটার কোনও তুলনা হয়?

তার অভিযোগটাকে পাত্তাই দিল না আদিত্য, “নাও, নাও, অনেক ঠোঁট ফুলিয়েছ। এবার ওঠো, বিছানা ছাড়ো, ব্রেকফাস্টটা বানাও, চা তো বানিয়েই যাচ্ছি রোজ, এরপর কি ব্রেকফাস্টও বানিয়ে যেতে হবে?”

শর্মিলা বিছানা থেকে নেমে হাউজকোটটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল, “ভোরে চা তুমি নিজেই বানিয়ে খাবে বলেছিলে। এতে আমার দোষ কী হল?”

আদিত্য বলল, “লোকে ভাবে, এই আধবুড়ো লোকটা এমন একটা তরতরে যুবতী মেয়ের কতই না সেবা পাচ্ছে! লোকে তো জানে না, আমার বউ কোনও কাজই করতে পারে না। উলটে আমাকেই তার সেবা করতে হয়।”

এই ‘আমার বউ’ কথাটা আদিত্য আজকাল খুব বেশি বলে তার সামনে। তাকেই যেন শোনায়। তার ছ’বছরের বিবাহিত জীবনটা কি আস্তে আস্তে ডুবন্ত জাহাজের মতো এক পাশে কাত হয়ে তলিয়ে যাচ্ছে জলে? শর্মিলার হঠাৎ ভয় করে! বেডরুম থেকে বেরিয়ে প্যাসেজে পা দিতে দিতে শর্মিলা আদিত্যর উদ্দেশে বলে ওঠে, “মুনশিদের কোম্পানি আমি এবার ছেড়ে দেব আদিত্য। অনেকদিন পর আমার সঙ্গে কেটিদির দেখা হল সেদিন, একটা এয়ারলাইন্সের পার্টিতে। কেটিদি বলল, ‘মুনশিরা লালবাতি জ্বালল বলে, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো মুভ করো। ‘ক্যাটাউন’ জয়েন করছ না কেন? আমার মনে হয়, কেটিদির অফারটা আমার ভেবে দেখা দরকার।”

আদিত্য কী বলছে শোনার জন্য সে আর দাঁড়াল না। নিজের পার্সোনাল ব্যবহারের টয়লেটে ঢুকে গেল।

আদিত্যর অনেক ব্যাপার আছে। সকালে উঠে স্নান করে ধৌত, শুদ্ধ হয়ে তবে শর্মিলাকে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হয়। ফলে উইক ডে-তে সে কোনওদিনই খুব সময় নিয়ে স্নান করতে পারে না। তারই মধ্যে আজ খুব দামি একটা শাওয়ার জেল দিয়ে শরীর পরিষ্কার আর পেলব করে তুলতে তুলতে হঠাৎ শর্মিলা ভাবল, যে জীবনযাপনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেটা তার নিজের পক্ষে কোনওদিন অ্যাফোর্ড করা সম্ভব নয়। কোনও কারণে তাকে যদি আবার অনাদি ঘোষাল স্ট্রিট বা সমতুল্য জীবনে ফিরতে হয়, তা হলে সে মরে যাবে। একথা ভেবেই কেমন শিউরে উঠল শর্মিলা! পরেশ বলছিল, আগামী রবিবার মহুলের জন্য মেয়ে দেখতে গাড়ি নিয়ে সিউড়ি যাবে আদিত্য। পরেশের ধারণা, বউদিও সঙ্গে যাবে দাদাবাবুর। পরেশ আদিত্যর খাস ড্রাইভার। মাসে মাসে তারও ডিউটি করে পরেশ। পরেশের সঙ্গে এমনিতে দিব্যি খোলামেলা কথাবার্তা হয় শর্মিলার। গাড়িতে যেতে-আসতে সে পরেশের সঙ্গে আন্তরিক কথাবার্তা বলে বলে অনেক ভাব জমিয়ে ফেলেছে। পরেশ এখন তাকে অনেক গোপন কথাও বলে! কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও পরমাকেই ‘বউদি’ বলে ডাকে পরেশ! আর তাকে বলে ‘ম্যাডাম’, স্রেফ ‘ম্যাডাম!’ অথচ পরেশের কাছেই শুনেছে যে, ছোট থেকে ড্রাইভারি করতে এবাড়িতে ঢুকে পরমার কাছ থেকে কোনওদিন স্নেহপূর্ণ আচরণ পায়নি ছেলেটা। আর শর্মিলা? পরেশকে কত না আপনার জন ভাবে। হয়তো সেটা তার অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটের ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্যই হবে। তবু পরেশ কিন্তু তাকে কখনও বউদি বলে ডাকল না! কত যে ছোট ছোট আক্ষেপ শর্মিলার! ছোট? নাকি জমিয়ে রেখেছে বলে? নইলে কীসের ‘বউদি’ পরমা এখনও? বউ তো সে! সে! পরমা তো প্রাক্তন!

ধুস! এই নাকি প্রাক্তন? নাকের ডগায় বসে আছে আদিত্যর! আহা, কী ভাল ডিভোর্সই না হয়েছে আদিত্য আর পরমার! ডিভোর্স হয়ে গেছে, কিন্তু পরমা শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ছেলে নিয়ে থেকে গেছে আদিত্যর সল্টলেকের পৈতৃক বাড়িতেই! শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে সে যেমন পুত্রবধূ, তেমনই রয়ে গেছে, পরম আদরণীয়। আর আদিত্য বেরিয়ে এসে বিয়ে করে ফ্ল্যাট কিনে তাকে নিয়ে থাকছে। অথচ সকাল-বিকেল তার সল্টলেকের বাড়িতে যাওয়া চাই। দুপুরবেলা সেক্টর ফাইভের অফিস থেকে আদিত্য মা’র হাতে তৈরি লাঞ্চ খেতে সল্টলেক যায়। ওখানেই এক ঘণ্টার একটা ঘুম লাগায়। সন্ধেবেলাও আত্মীয়পরিজন, ছেলে ইত্যাদি কারণে সল্টলেকের বাড়িতেই যায় চা খেতে। শর্মিলা অফিস থেকে ফেরে প্রায় সাড়ে ছ’টা-সাতটা। আদিত্য ফেরে আটটা। তাও মাঝেমধ্যে ছেলেকে সঙ্গ দিতে বাইরে কোথাও ডিনারে যায় আদিত্য ছেলেকে নিয়ে। পরেশের ইঙ্গিতটা ধরলে তখন পরমাও যায় না যে, তা নয়!

যতক্ষণ না আদিত্য বাড়ি ফেরে, বাইপাসের এই হাই রাইজ়ের আঠাশ তলায় প্রায়ান্ধকারে শর্মিলা চুপ করে বসে থাকে। আগে যখন সে এসব নিয়ে আপত্তি করেছে, কান্নাকাটি করেছে, ঝগড়া করেছে, তখন আদিত্যর আচরণের মধ্যে থেকে একটা বার্তাই বেরিয়ে এসেছে শুধু, ‘সয়ে যাবে! সময়ে সয়ে যাবে!’ এখন আর দুপুরবেলা অফিসে বসে কাজ করতে করতে তার শরীর জ্বালা করে ওঠে না এই ভেবে যে, এই দুপুরে আদিত্য বাবা, মা, বউ, ছেলে নিয়ে এক টেবিলে বসে লাঞ্চ খেতে খেতে হাসিঠাট্টা করছে। কিংবা রেস্ট নিতে যে ঘরে ঢুকছে সেখানে পরমা! নাঃ, সে আর এসব ভাবে না। এটা একটা ব্যবস্থা, যা সে মেনেই নিয়েছে বলতে গেলে। তাই বলে আদিত্য পরমাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুর বেড়াতে যাবে তাকে লুকিয়ে? উফ! সেদিন পরিজা কীরকম ফিচেল হেসে বলল, ‘আদিত্যদার তো প্রেমিকা হল বউ আর বউ হল প্রেমিকা!’ বলেই চোখ মেরেছিল তাকে। আর সে যেন কিছুই বুঝতে পারেনি, এমনভাবে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল ওয়াইন ধরা গ্লাস হাতে। আর তার মনে হয়েছিল, আমার কী? পরিজা তো আমাকে কিছু বলছে না, বলছে আদিত্যকে। বলছে, বেশ করছে!

ব্রেকফাস্ট টেবিলে দ্রুত খাবার খেতে খেতে আদিত্য বলল, “আমি সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে যাব, তারপর মহেন্দ্র মোটর্সের একটা পার্টিতে যেতে হবে। তুমি রেডি হয়ে থেকো!”

শর্মিলা ভাবল, এখন থেকে সাড়ে আটটা অবধি তা হলে আমি বুঝি স্বাধীন? হঠাৎ সে ঠিক করল, আজ দুপুর দুপুর অফিস থেকে বেরিয়ে সে যদি একবার অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটে যায়, কেমন হয়? আদিত্যকে না জানিয়ে? ভাবতেই গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল তার। যেন একটা অ্যাডভেঞ্চার!

ঠিক দুটোর সময় শর্মিলা মুনশিজির ছোট্ট চেম্বারে ঢুকে বলল, “মুনশিজি, আমি একটু বাপের বাড়ি যাব আজ। আজ আর অফিসে ফিরতে পারব না। কেয়াকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি, ও সামলে নেবে।”

মুনশিজি মাথা নাড়তে সে আর দাঁড়াল না। রাসেল স্ট্রিটের ছোট্ট অফিসটা থেকে বেরিয়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে এগোতে এগোতে সে ভাবল, মেট্রো নেবে। মার্চ মাস অথচ রোদের তেমন তেজ নেই। হাঁটতে তার খারাপ লাগছিল না। ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নিল শর্মিলা। কিন্তু কিছুটা যেতে না-যেতেই আপন মনেই একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে সে বলল ‘শ্যামবাজারে হেমন্ত সেতু!’ গাঁক গাঁক করে ছুটল ট্যাক্সি। তিন মাথার মোড়ে সে নেমে পড়ল ট্যাক্সি থেকে। এক পা-এক পা করে খুব যত্ন সহকারে এগোল শর্মিলা। আর ঠিক তখনই তাকে পাশ কাটিয়ে একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর এসে দাঁড়াল কানাই জেঠার বাড়ির সামনে। এখনও কিছু খই রাস্তায় ওড়াউড়ি করছে। শর্মিলা দেখল, গাড়ি থেকে খুব বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে নেমে আসছে সরসীদি, নীলাদি। সে থমকে দাঁড়াল, কে? কানাই জেঠা? না জেঠিমা? নিজেকেই প্রশ্ন করল শর্মিলা!

সে দেখল ধীমানদাকে। ফোনে কাকে বলছে, “হ্যাঁ, বিরাট লাইন ছিল আজ, কাশীমিত্তির ঘাটে। আমরা এই পাড়ায় ফিরলাম!”

কানাই জেঠার রকের উপর একটা পিতলের রেকাবি হাতে দাঁড়িয়ে হৈমন্তী কাকিমা। পরনে একটা ন্যাতানো হলুদমাখা শাড়ি। ভাঙা ভাঙা গলায় হৈমন্তী কাকিমা বলল, “সরসী, তোরা নিমপাতা মুখে ছুঁইয়ে ঘরে ঢোক। ও ধীমান, টেবিলে রসগোল্লার হাঁড়ি রাখা আছে, ছেলেগুলোকে বলো, মিষ্টি জল খেয়ে বাড়ি যেতে! আমাকেও এবার বাড়ি যেতে হবে।”

শর্মিলা ভাবল, সকালেই তার একবার কানাই জেঠার কথা মনে হয়েছিল না?

আগে বাড়ির সদর দরজা সব সময় হাট করে খোলা থাকত। তখন বাড়িভর্তি লোক ছিল। অবিরত ঢোকা বেরোনো। এখন ছ’বছর পর বাইলেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শর্মিলা দেখল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। এবং দরজার পাশে তিনটে বেল। তিনটে বেল কেন?

কোনটা টেপে, কোনটা টেপে করে, যেটা একদম হাতের ময়লায় কালো হয়ে আছে সেটাতেই আঙুল ছোঁয়াল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *