॥ ৪ ॥
সোহিনীর আজ সকাল থেকে মাথা গরম! তিনতলায় যে ঘরে সে থাকে, অর্থাৎ যে ঘরটা তার বেডরুম, তার পাশের ঘরটা বহুকাল ধরে গুদোম হয়ে ছিল। সংসারের যাবতীয় অকাজের জিনিস কান্তা সেখানে জমা করেছিলেন এত বছর ধরে। কান্তা সম্পর্কে তার শাশুড়ি। তিনি থাকেন দোতলায়। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া সব দোতলায় হয়। তিনতলার ওই গুদোম ঘরটাকে বউ হয়ে আসার পর থেকেই সোহিনী নিজস্ব একটা বসার ঘরের চেহারা দেওয়ার চেষ্টায় ছিল। প্রকৃতপক্ষে এত বড় বাড়ি হলে কী হবে, এবাড়িতে সে অর্থে কোনও ড্রইংরুম নেই। সোহিনীর বরাবরের শখ একটা সুন্দর করে সাজানো- গোছানো ড্রইংরুমের। একতলায় যারা ভাড়া থাকে, তারাই এবাড়ির বৈঠকখানার দখল নিয়ে রেখেছে।
নতুন বউ হয়ে আসার পরই সোহিনী বুঝেছিল, কমল সম্পূর্ণ মায়ের আঁচলের তলায় থাকা একটা গোবরগণেশ টাইপের ছেলে। এবাড়িতে সবই ঘটে কান্তা বাই-এর কথায়! আড়ালে সোহিনী শাশুড়িকে ‘কান্তা বাই’ বলে ডাকে। ফলে প্রথম থেকেই সে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটু জেদি হয়ে উঠেছিল। তার জন্য তাকে কান্তা বাই-এর সঙ্গে কম লড়াই লড়তে হয়নি। একথা ঠিক যে, তাদের চারজনের সংসারে সে রীতিমতো একঘরে। তার শ্বশুর ভবেশ মিত্তির লোকটাও কান্তা বাই-এর বশংবদ! তবু এরই মধ্যে সে অনেক দিন লেগে থেকে তিনতলার এই ঘরটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে হাবিজাবি জিনিস সব দূর করে বেশ পরিপাটি একটা ড্রইংরুম করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। বরফি বরফি পুরনো মোজাইকের ফ্লোর তুলে লাগিয়েছিল ফ্লোর টাইলস। খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলো আগের মতো রেখে দিয়ে রং করিয়ে ভারী ভারী পর্দা ঝুলিয়েছিল। কমলের কাছ থেকে লুটপাট করে টাকাপয়সা নিয়ে একটা নরম, গদিওয়ালা সোফা পেতেছিল। দেওয়ালে একটা কাচের শোকেস করেছিল। এসব করার পর, একটু শান্ত হওয়ার পর সে দেখল, ঘরে তখনও যা জায়গা আছে, তার নাচ প্র্যাকটিস করার পক্ষে যথেষ্ট। তখন সে একটা ইয়া ব্বড় আয়না লাগিয়ে ফেলল দেওয়ালে।
গতকাল বাবার শরীরটা একটু খারাপ হওয়ার জন্য বাবাকে দেখতে গিয়ে সোহিনী রাতটা বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে আজ সকালে এখানে ফেরে। ফিরে সে দেখে যে, তার সাধের ড্রইংরুমখানা একেবারে ধূলি-ধূসরিত অবস্থায় লন্ডভন্ড হয়ে আছে! সম্ভবত কাল এদিকে কালবৈশাখী হয়েছিল। খোলা জানলা দিয়ে ঝড় ঢুকে এসে ধুলো, বৃষ্টির জলে ঘরটাকে একেবারে কাদাকাদা করে রেখে গেছে। একখণ্ড গালচেতে কাদা, সোফায় কাদা, মেঝেতে জল থইথই! ঈর্ষাকাতর কান্তা বাই ঝড় ওঠার সময় একবার চেকও করেননি যে, তিনতলার সব বন্ধ আছে কি না। কে জানে, সে ছিল না বলে কান্তা বাই-এর সুপুত্তুরটি রাতে বাড়ি ফিরে আর তেতলায় উঠেছিল কিনা! হয়তো মায়ের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছিল আহাম্মকটা! ব্যাপার দেখে সোহিনীর চোখ থেকে উপচে পড়ল জল। বাছাই করা কিছু ইংরেজি গালাগালি সে দিয়েছিল মা এবং ছেলের উদ্দেশে। তারপর কাজের লোকদেরও সে বিস্তর বকাঝকা করেছে। এরপর আর কিছু করার নেই। সে গুম হয়ে শুয়ে আছে সেই থেকে। মায়ের খোকন তো সকালবেলাই চলে গেছে চেম্বারে। সোহিনী কমলের সঙ্গে ঝগড়া করার অপেক্ষায় রয়েছে এখন।
এসব করতে করতে বেলা দেড়টা বাজে যখন নীচ থেকে চিৎকার ভেসে এল, ‘কমল আছে? কমল?’ কমলকে কেউ ডাকাডাকি করলে কান্তা বাই-ই সাড়া দেন বেশি, তাই সে চুপ করেই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন, ‘অ্যাই কমল? কমল?’ শুনল সোহিনী, তখন বেরিয়ে এল বারান্দায়। দেড়টা বেজে গেছে, এতক্ষণে কমলের ফেরারই কথা। বারান্দা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সোহিনী বলল, “ফেরেনি তো!”
নীচে রাস্তায় দুটো কমলের বয়সি ছেলে মুখ উঁচু করে ‘কমল, কমল’ করে চেঁচাচ্ছে। ছেলে দুটো এপাড়ার কি? রায়বাগানের? মনে হল না সোহিনীর। দু’বছরে সে এপাড়ার ছেলেদের চিনে গেছে। বেশিরভাগই মুখ চেনা অবশ্য। কমলের পাড়াতুতো বন্ধুদের মাত্র দু’-একজনের সঙ্গেই সোহিনী কথা বলে। বাকি ওই শাঁটুল ফাটুলদের সঙ্গে কথা বলতে রুচিতে বাধে তার। বিশেষত ওই শাঁটুল আর লালু। শাঁটুলের চোখটা ভীষণ খারাপ। আর লালু ওর স্যাঙাত। দেখলেই মনে হয়, কানের গোড়ায় দুটো দেয়!
“ফেরেনি? সে কী? এইমাত্র বাড়িতে ঢুকল দেখলাম!” বলল একটা ছেলে।
সোহিনী অবাক হল, বাড়িতে ঢুকে একবারও উপরে আসেনি? সে বলল, “দাঁড়ান, দেখছি।” তিনতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে সে মুখ বাড়িয়ে ডাকল, “বদ্রিদা? বদ্রিদা? দাদা বাড়ি ঢুকেছে?” দোতলার সিঁড়ির কাছে কমলকেই দেখতে পেল সোহিনী। গামছা পরে দাঁড়িয়ে আছে, উফ, জঘন্য!
“তোমাকে লোক খুঁজছে।”
“ও।”
কমল চলে গেল। সে-ও ফিরে এল টানা বারান্দায়। ছেলে দুটো কথা বলছে কমলের সঙ্গে, কমল দোতলায়, “বন্ধুর অবস্থা খুব খারাপ। খিঁচ হচ্ছে, মুখ থেকে গ্যাঁজা বেরচ্ছে, তোকে যেতে হবে কমল।”
“দাঁড়া দু’ মিনিট,” বলল কমল।
সোহিনী দাঁত কিড়মিড় করল, আহা, বিরাট বড় ডাক্তার তো, ব্যস্ততার শেষ নেই। দম ফেলার ফুরসত মিলছে না! কমলের সঙ্গে ঝগড়াটা স্থগিত করে বসে থাকতে হচ্ছে বলে সোহিনীর পাগল পাগল লাগছে আসলে। কমলের সঙ্গে তো ঝগড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই তার!
দু’ মিনিট বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেই সে দেখল, কমল শার্ট- প্যান্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছে ব্রিফকেস হাতে। তীব্র মানসিক একটা অভিঘাত তৈরি হল তার কমলকে দেখে। মনে হল, এখনই তিনতলার বারান্দা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কমলের টুঁটি চেপে ধরে এবং তখনই তার মনে হল কমলের প্রতি ধীরে ধীরে তার মনে একটা ঘৃণা তৈরি হয়েছে। এই ঘৃণাটাকে একটু যত্ন করতে পারলেই সে কমলের সঙ্গে তার বিয়েটা ভেঙে দিতে পারবে। এই বিয়েটার তার কাছে আর কোনও মূল্যই নেই। সুশিক্ষায়তনের চাকরিটা হয়ে গেলেই সে এই বিয়েটা ভাঙার উদ্যোগ নেবে।
তার সঙ্গে কমলের বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে। সম্বন্ধটা যখন এসেছিল, তখন তার বয়স তেইশ আর সবে ইন্দ্রর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে! সোহিনী অ্যাকচুয়ালি সব ভুলে বিয়ে করে সুখী হতে চেয়েছিল। বরকে ভালবাসতে চেয়েছিল। আর সেটা করতে গিয়েই বিয়ের পরপর সে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল বরকে। অন্তত বলা যায় সে চেষ্টা করেছিল আপ্রাণ। তখন সে সবকিছুর মধ্যে দিয়ে কমলকে বোঝাতে চাইত, একটা মেয়ের সর্বস্ব পণ করা ভালবাসা কত মহার্ঘ। সত্যি বলতে, ইন্দ্রের সঙ্গে একটা কদর্য প্রেমের অভিজ্ঞতার কারণেই সোহিনী বিয়েটাকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করতে চায়নি। কিন্তু শুরু থেকেই সে বুঝেছিল, কমল একটা বর্ম পরে তার কাছে এসেছে। বিয়ের ঠিক এক-দেড় মাসের মাথায় একটা অবোধ ঝগড়াঝাঁটির পর সোহিনী যখন হু-হু কান্নায় ভেঙে পড়ে কমলকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করছে, বুকে মাথা রাখতে চেষ্টা করছে, তখন হঠাৎ কমল তার বাহু ধরে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, “সোহিনী শোনো, কাঁদছ কেন? আমি জানি, আমি তোমার জীবনে প্রথম পুরুষ নই। তোমার জীবনে আগে কেউ ছিল!”
সে কান্না থামিয়ে আকাশ থেকে পড়েছিল, “এর মানে কী? আমার জীবনে আগে কেউ থেকে থাকলে এখন আমি তোমার জন্য কাঁদব না কেন? আশ্চর্য? তোমার সঙ্গে বিয়ে হল, তোমাকে ভালবাসার চেষ্টা করছি, এগুলোকে তুমি মিথ্যে ভাবো? আর আমার জীবনে আগে কেউ ছিল তুমি বুঝলে কীসে? প্রেমপত্র দেখেছ? ফোন চেক করেছ?” হাস্যকর ঠেকেছিল সোহিনীর।
“আমি একজন ডাক্তার তুমি এটা ভুলে যাচ্ছ!” বোকার মতো বলেছিল কমল।
“ডাক্তার বলে? ও তুমি এই মিন করতে চাইছ?” সোহিনী দক্ষিণ কলকাতার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে, কো-এড স্কুলে ছোটবেলা থেকে ছেলেদের গোপন অঙ্গে ডেস্কের তলা দিয়ে হাত দিয়েছে! শরীর নিয়ে তার কোনও শুচিবাই নেই। ষোলো বছর বয়সেই সে এক কাকার সঙ্গে চুমোচুমিতে অভ্যস্ত ছিল। আঠারো-উনিশ বছরে তার একসঙ্গে দুটো বয়ফ্রেন্ড ছিল! এবেলা একটা, ওবেলা একটা মতো…তা ছাড়াও একজন বয়স্ক অদেখা ব্যক্তির সঙ্গে ফোন-প্রেম চালাত সে রাত জেগে! সারা রাত ধরে লোকটা তার সঙ্গে তীব্র কাম-বিহ্বল কথোপথন চালাত। সেই কথাবার্তায় নারী-পুরুষের মিলনের, বলা ভাল, উত্তুঙ্গ রমণ প্রক্রিয়ার কোনও অংশের ধারাভাষ্য অস্পৃষ্ট ছিল না। সোহিনীও বিছানায় কাতরাত, রাত জাগা লোকটাও বিছানায় কাতরাত। যৌনতার পাঠ তো লোকটাই তাকে দিয়েছে একেবারে সর্বতোভাবে। তারপর তার সঙ্গে প্রেম হল ইন্দ্রের। বলা বাহুল্য, সেই প্রথম সে প্রেমে পড়ল, উন্মাদের মতো প্রেম। অবধারিতভাবে শরীর এল তাতে। দুটো ছেলেমেয়ের প্রেমে শরীর আসবে না, এ তো ভাবাই যায় না। সে ভাবেওনি, কখনও এতে সে কিছু হারিয়েছে। বিশেষত ভার্জিনিটি তো আইডিয়া মাত্র! সোহিনীর একবার খুব বিশ্রী ধরনের ইউরিন ইনফেকশন হয়েছিল। তখন লেডি ডাক্তার তার যোনির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। তখনও তার প্রথম সঙ্গম অভিজ্ঞতা হয়নি। সেই পরীক্ষায় তার ব্যথা লেগেছিল, ডাক্তার বলেছিলেন, তার ইউটেরাসে ছোট ছোট সিস্ট আছে, কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট নয়। ব্যথা লাগলেও তার রক্তপাত হয়নি। যোনির মেমব্রেন টেমব্রেন মেয়েদের কবেই ছিড়ে যায় তার কি কোনও ঠিক আছে? কমলের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে সে বলেছিল, “তুমি তা হলে বিয়ের আগে পরিষ্কার করে জানতে চাওনি কেন? আমি বলে দিতাম যে, আগেই আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। লুকোতাম নাকি? আমার পরিস্থিতি এমন ছিল না যে, মরিয়া হয়ে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করে একটা মেয়ের সঙ্গে সেক্স করে তারপর সে ভার্জিন কি না বোঝার প্রক্রিয়াটা তো অসৎ প্রক্রিয়া কমল?”
“জিজ্ঞেস করলে তুমি সত্যি বলতে?” বলেছিল কমল, “কেউ বলে?”
“বাঃ!” তখন সোহিনী বলেছিল, “এটা তোমাদের নর্থ ক্যালকাটার মানসিকতা!”
তার এই কথাগুলো শুনে কমল বলেছিল, “দোষটা আমারই। আমার আগেই জানতে চাওয়া উচিত ছিল।”
“তা হলে এবার কী হবে? ইউ ওয়ান্ট ডিভোর্স?” সোহিনী টু দ্য পয়েন্ট কথা বলেছিল, “বাবা-মাকে জানাই তা হলে?”
“সেটা আমি পারি না। বিয়ে যখন করেছি, তখন তোমার দায়িত্ব নিয়েছি। আমার দিক থেকে ডিভোর্সের কথা উঠবে না। এটাও নর্থ ক্যালকাটার মানসিকতা বলতে পারো।”
“ডিভোর্স করবে না, গ্রহণও করবে না, এরকমই চলবে?” চিৎকার করে উঠেছিল সে।
কমল আর একটা কথাও বলেনি। একটা ভাঙাচোরা বিপজ্জনক সেতুর উপর তারপর থেকে দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে দুটো বছর কেটে গেছে।
সত্যি কথা বলতে, ওই ঘটনার পর সোহিনী দেন অ্যান্ড দেয়ার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথাই ভেবেছিল। দেড় মাসের বিয়ে, নাথিং। এই যুগে এরকম একটা বিয়ে মানুষের জীবনে কোনও দাগই রাখে না, কেউ গুরুত্ব দেয় না। এই তো তার পিসতুতো দিদি তৃণারই তো বিয়ের চার মাসের মাথায় ডিভোর্স ফাইল হয়। দশ মাসের মধ্যে ডিভোর্স। মানুষের যেমন চিকেন পক্স হয় বা টাইফয়েড কিংবা ম্যালেরিয়া, ভুগে উঠে একটু দুর্বল লাগে, তারপর আবার সুস্থতায় ফিরে আসে, মুখের স্বাদ ফিরে আসে, চামড়ার দাগ সেরে যায়, নতুন চুল গজায়, সেরকমই এমন বিয়ে থেকে লোকে মুক্তি পেয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়! তার পরিবারে এসব নিয়ে কানাকানি নেই, জল্পনাকল্পনা নেই, হইচই হয় না। তৃণাদি তো আবার বিয়ে করে সুখে আছে, বেঙ্গালুরু চলে গেছে। যাকে বিয়ে করেছে, তারও ওরকম একটা খুচরো বিয়ে ছিল। সোহিনীর ক্ষেত্রেও সেটাই হত, কিন্তু সমস্যাটা তৈরি করল সোহিনী নিজেই। একদিন দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কান্তা বাইকে সোহিনী গুছিয়ে তার নিন্দে করতে শুনল এপাড়ার দত্ত জেঠিমার কাছে। সোহিনী মেয়ে মোটেই ভাল না, কমলের সঙ্গে কোনও বনিবনা নেই, তিনতলায় বসে থাকে, কোনও কাজ করে না, বহির্মুখী মন, ইংরেজি গান চালিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে, ডাকলে সাড়া দেয় না — অভিযোগের পর অভিযোগ! সোহিনী শুনল সব, তারপর ঠিক করল, এই কান্তা বাইকে টাইট না দিয়ে সে নড়বেই না এবাড়ি থেকে। শাশুড়ি বলেছিল, কমল বউকে সহ্যই করতে পারে না। সোহিনী জেদ ধরল, কমলকে তাকে সহ্য করতেই হবে। এদের মাথায় বসে তাণ্ডব নৃত্য করবে সে। ভীষণ দুঃখও হয়েছিল তার। নীলচে অভিমান। তার তো কোনও দোষই নেই। কমলের যদি অতই চরিত্রবান মেয়ে দরকার ছিল, তা হলে উচিত ছিল কুমারীত্বের পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে বিয়ে করা! তার প্রতি কমল যে অন্যায় আচরণ করছে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না তার।
এক ধরনের র্যাডিকাল ইমপ্যাক্ট হয়েছিল সোহিনীর উপর এই ঘটনার। তার মতো অল্পবয়সি স্বাধীন চিন্তাভাবনার একটা মেয়ে কোনও নৰ্মস মেনে বা স্বার্থ চিন্তা করে এই অবস্থার প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ছেলেমানুষিই ছিল তার আচরণে। সেই থেকে একটা ঠান্ডা যুদ্ধের বাতাবরণে বসবাস করছে সোহিনী, এই অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটের বাড়িতে। কমলের সঙ্গে তার কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই বললেই চলে। পুরোটাই একটা সামাজিক আদানপ্রদান। এই করতে করতে দু’ বছরে কান্তা বাই আর কমল যথেষ্ট কোণঠাসা তার দ্বারা। সে জড়ভরত হয়ে তো থাকে না। রীতিমত প্রতাপ আছে তার। মাঝে মাঝেই নিজের তেজ বিকিরণ করে এদের নাস্তানাবুদ করে সোহিনী! টানা ইংরেজিতে সে যখন চিৎকার করতে থাকে, কমল আর কমলের মা পালানোর পথ পায় না।
একদিন কমলের মা তাকে বলতে এসেছিলেন, “দ্যাখো, অত ইংরেজি কপচিয়ো না! আমার দাদামশাই বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার ছিলেন। উনিও অত ইংরেজি বুলি ঝাড়তেন না। বাড়িতে খেটো ধুতি আর খড়ম পরতেন, দু’ দিনের যোগী, ভাতকে বলে প্রসাদ!”
সেদিন মোক্ষম উত্তরটা দিয়েছিল সোহিনী, “আপনার দাদামশাই বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার, আপনার বাবা ডাক্তার, আপনার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, ছেলে ডাক্তার, কিন্তু আপনি নিজে কী? বলুন, আপনি কী?”
ওমা! এই একটা প্রশ্নে কান্তা বাই খেই হারিয়ে অগাধ জলে, “আমি কী? আমি? আমি?” এমন একটা প্রশ্ন বছর পঞ্চান্নর মহিলাটিকে কেউ কখনও করেনি।
কমল ছিল সেখানে, মায়ের পিছন থেকে বলল, “মা আবার কী হবে? মা, মা!”
“এটা একটা পরিচয় হল? সে তো সকলেই কিছু না-কিছু — মা, বাবা, ভাই, বোন, মামা, মাসি!”
কান্তা বাই অশ্রুপাত করতে লাগলেন, “এম এ পাশ বলে এত অহংকার?”
সেদিনই সোহিনী বুঝেছিল এটাই তাকে চালিয়ে যেতে হবে। পুরনো ধ্যান-ধারণা আর বিশ্বাসের মুলে প্রতিদিন আঘাত করতে হবে। নইলে ইংরেজি টিংরেজি সে খুব একটা বলতে চায় না। কিন্তু যারা তার বিপক্ষে, তাদের তো ধরাশায়ী করতে গেলে তাদের দুর্বলতাটাই এনক্যাশ করতে হবে। তবে আর বেশিদিন এদের সঙ্গে এই ইঁদুর-বিড়াল খেলবে না সোহিনী। সুশিক্ষায়তনের চাকরিটা হয়ে গেলেই, ব্যস! কিন্তু যদি না হয়? ইস, এই চিপ খেয়োখেয়ির মধ্যে না থেকে পোস্ট ডক্টরেটটা করে নিলেই ভাল করত।
কমল দুপুরে আজকাল আর প্রায় তিনতলায় আসেই না। রাতেই বা কেন এসে শোয় তার পাশে, কে জানে? নিজে থেকে কমল কখনও এগোয় না তার দিকে। শরীরের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে সে নিজেই টানাটানি করে কমলকে সময় অন্তর। করে, বেশ করে! বিয়ে করেছ কেন? করতেই হবে, বিয়েও করবে, অধিকারও করবে না। ডিভোর্স দেবে না যখন, তখন চড়-থাপ্পড় খাও, তখন চুলের মুঠো ধরে তোমায় নামিয়ে নিয়ে যাই নীচে, আমাকে রমণ করো, যদিও অনিচ্ছুক মানুষের সঙ্গে শোওয়া জঘন্য অপরাধ — তবু আমি কী করব? দোষ তো আমার নয়। দোষ আমার কখনওই নয়।
প্রতিবারই মিলনের পর সে অতৃপ্ত অবস্থায় ঘুমোতে যায়। প্রতিবারই তার মনে হয়, কমলকে যদি একটা বারও জাগাতে পারত! একটা বারও যদি শিকারি নেকড়ের মতো তার টুঁটি টিপে ধরত কমল, সে ওকে তা হলে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিত। এ এক অদ্ভুত অভিশপ্ত আবর্ত! যত বার কমলকে সে এই অবস্থায় চুমু খেতে চায়, কমল মাথাটা সরিয়ে নেয়, ঘাড় শক্ত করে রাখে। সোহিনীর মনে হয়, ঘুষি মেরে ওর চোয়াল খুলে দেয় তখন! মায়ের ভেড়ুয়া ছেলের আবার এত শক্ত ঘাড় কী? হাঃ, ভারী তো মূল্যবোধ, ভারী নীতিবাগীশ! মূর্খ! আমার জীবনটা নষ্ট করল কাপুরুষটা! তার দাম কে দেবে?
তিনতলার বারান্দায় ঝুঁকে থাকা রেনপাইপ বেয়ে উঠে আসা মাধবীলতার ঝাকড়া ডালপালা সরিয়ে সোহিনী দেখল, কমল তিন মাথার মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরে গেল। একটা বুক খালি করা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহিনী ঘরে ফিরছিল স্নান করে নেবে ভেবে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল নিমাই খুড়োদের রকের দিকে। দালালটা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা পড়ছে না, ঠোঁট কামড়ে আছে দাঁতে। ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারতে হয়! শাঁটুলের এই তাকিয়ে থাকাটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। সেদিন তো একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে ফেলেছিল ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে। একদম নির্লজ্জ বেহায়া। আজকাল রাতেও অনেক সময় বসে থাকে ওই রকে। মাথাটা গরমই ছিল সোহিনীর ভীষণ, সে আর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করল না। হাত তুলে একটা চড় দেখাল শাঁটুলকে। আর দু’চোখ থেকে ঝরিয়ে দিল বিতৃষ্ণা, ঘৃণা! সে ক্লাসিকাল ডান্সের মেয়ে। সহজেই চোখ এবং হাতের মুদ্রা দিয়ে যে-কোনও রসের সঞ্চার ঘটাতে পারে।
চড়টা দেখিয়েই সোহিনী কেউ দেখল কি না বোঝার জন্য এদিকে তাকাতেই দেখল, কালো বিদেশি গাড়ির জানলা থেকে প্যাট প্যাট করে তাকে একবার আর শাঁটুলকে একবার দেখছে আয়েষাদি! তার চোখেই পড়েনি, সত্যর দোকান থেকে গাড়ি থামিয়ে পান কিনছে আয়েষাদি। রোজই এই সময় আয়েষাদি মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে ফেরে।
এই আয়েষা নামক পৃথুলা ধনী গৃহিণীকে সোহিনী ভীষণ ভয় পায়। আয়েষাকে এপাড়ার অনেকেই পছন্দ করে না। কিন্তু কমল আবার আয়েষার অতিরিক্ত অনুরাগী। আয়েষার বাড়ির তিনতলায় মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা মদ্যপানের আসর বসে। সেখানে মধ্যমণি আয়েষা স্বয়ং! কমল সেখানে নিয়মিত যায়। আগেও কী একটা কারণে আয়েষা তার আর কমলের মধ্যে বেশ উচ্চ পর্যায়ের গন্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছিল। এসবই আয়েষার টাইমপাস। এর বিরুদ্ধে ওকে খেপিয়ে তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার। এই মুহূর্তে আয়েষার চোখে অন্য একটা রং খেলা করছে, ‘ধরা পড়েছ চাঁদু, আহা!’ ঠোঁটের প্রান্তে শিরা- উপশিরার মতো হাসির রেখা। আয়েষা হাসলে ওর পাতলা ঠোঁট আরও সরু হয়ে যায়, তখন ওকে আরও কুচক্রী দেখায়! সোহিনী আয়েষার ওই চেরা হাসির দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল আর তখন সে লক্ষও করল না শাঁটুল বিশ্রীভাবে হাসছে আর আড়মোড়া কাটছে। আর গুনগুন করে গাইছে, ‘লীলাবালি, লীলাবালি, ভর যুবতী, আহা ভর যুবতী, হুঁ-হুঁ ভর যুবতী, হ্যাঁ ভর যুবতী..’
যত বার ‘ভর যুবতী’ বলছে শাঁটুল তত বার সে ভাবছে, ক্যারমের টেবিলের উপর চিত করে ফেলা একটা মেয়ে। মেয়েটা সোহিনী, মেয়েটা ছটফট করছে, তাতে শাড়ি উঠে যাচ্ছে উপরে, আরও উপরে উঠতে উঠতে ঠাসানো ময়দার মতো সাদা দুটো মাংসল থাই, একদম নির্লোম! শাঁটুল মন থেকে জানে, কমলের বউটার উরু, উরুসন্ধিস্থল একেবারে ডাকাতে হবে! পুরুষের যা আছে, সব নিংড়ে, শুষে, টেনে নেবে, ছিবড়ে করে নেবে! শাঁটুল গান গাইতে গাইতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতেই এগোতে থাকে বাড়ির দিকে। তার চোখ ঝুলে থাকে ভবেশ মিত্তিরের তিনতলার বারান্দায়, আয়েষা যে তাকেও দেখছে, সেটা শাঁটুল লক্ষও করে না।