কড়িখেলা – ১২

॥ ১২ ॥

সকাল, দুপুর, সন্ধে, কোনও সময়ই সোহিনীর কোনও কাজ থাকে না। তার কাজ মানে, নিজস্ব কাজ। নিজের জামাকাপড় গোছানো। ইস্ত্রি করা, আলমারি গোছানো। ওয়াক্সিং করা। চুলে প্যাক লাগানো। হয়তো বসে বসে টাকা পয়সার হিসেব করল। ইস, এমাসে আট হাজার টাকা অলরেডি নেওয়া হয়ে গেছে কমলের কাছ থেকে। হাতে এখন পাঁচশো পড়ে। কমল কি আর দেবে? একটা নাইট ক্রিম না কিনলেই নয়। খুড়তুতো বোন বনির বার্থ ডে, কিছু দিতে হবে। কয়েকটা ব্লাউজ় তৈরি করতে দেওয়া আছে রাসবিহারীর ‘লেডি ডায়না’য়, সে-ও প্রায় সাত আটশো টাকার ব্যাপার। সব মিলিয়ে এমাসে আরও হাজারপাঁচেক চাইই চাই! এসবই তার কাজ! তাও সেই কাজ সোহিনী কমল বাড়ি থেকে না বেরোনো অবধি করে না। কারণ, ন’টা অবধি এই ঘর কমলের দখলে। কাগজপত্র গোছাচ্ছে। এটা ঘাঁটছে, ওটা নাড়ছে। স্নান করে, জামা-প্যান্ট পরছে। তারপর চুল আঁচড়াতে লাগল। ওরে বাবা, কমলের চুল আঁচড়ানো, সে এক ব্যাপার। এদিক নেই, সেদিক আছে। হুঁ, হুঁ! এই বয়সেই কমলের চাঁদিটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে বেশ। সেই ফাঁকা ফাঁকা চাঁদিটা ঢাকার কী আপ্রাণ চেষ্টা কমলের! এদিকের চুল ওদিকে টেনে সাজাচ্ছে। পছন্দ হল না, আবার ঘেঁটে দিচ্ছে। জলের ছিটে দিয়ে আসছে, আবার এদিকের চুল ওদিকে টেনে সাজাচ্ছে। এক-একদিন হয় আর না। চিরুনিই ছুড়ে ফেলে দিল। দুম দুম করে দু’ঘা লাথি মেরে দিল খাটের পায়ায়। উফ বাবা, কী ক্যাবলা! পুরুষমানুষের আবার অত চুল আঁচড়ানো কী?

আজকাল সোহিনী শুধু ভাবে, এই কমলকেই সে মনেপ্রাণে ভালবাসার চেষ্টা করেছিল। যা তা! যাক গে বাবা, তার চাকরিটা শেষ অবধি হয়ে গেছে সুশিক্ষায়তনে। পুজোর পর এক টিচার রিটায়ার করে যাচ্ছেন। তিনি যাবেন ২১ তারিখে। সোহিনী ঢুকবে ২২-শে। আর মাত্র চার মাস। তারপর সে চলে যাবে এই বাড়িটা থেকে। বাঁচা যাবে। তবে এই পাড়াটাকে সে মিস করবে খুব। যাওয়ার আগে শাঁটুলের সঙ্গে যে করেই হোক, একবার কথা বলতে হবে। মিট করতে হবে। শাঁটুল না, গৌরচাঁদ।

গৌরচাঁদকে একদিন সোহিনী হেসে হেসে বলেছিল কমলের চুল আঁচড়ানোর গল্প। তখন গৌরচাঁদ বলল, ও-ও অনেক সময় নিয়ে চুল আঁচড়ায়। আগে ও যখন আঁচড়াত, তখন ওর দাদাও চুল আঁচড়াতে আসত। একটাই আয়না তখন। ওর দাদার তখন ড্রেসিংটেবিল সুদ্ধু বউ আসেনি। আর তখন ওরা দুই ভাই পরস্পরকে কনুইয়ের গুঁতো মারত চুল আঁচড়াতে গিয়ে! আর মা বাজারের থলে হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। যার আগে চুল আঁচড়ানো শেষ হবে সেই তো বাজারে যাবে।

গৌরচাঁদ বলেছিল, ‘নর্থের ছেলেরা যে খুব চুল আঁচড়ায় নো ডাউট। এক-একজনের পকেটে তিন-চার রকম চিরুনি।’ সে বলেছিল, আমার কোনও বন্ধুবান্ধবকে পকেটে চিরুনি রাখতে দেখিনি তো?’ শাঁটুল বলেছিল, ‘সাউথে চুলে হাত চালিয়ে দিল, হয়ে গেল। ওরা কেয়ার ফ্রি। নর্থের ছেলেরা ওদের চুল, ওদের ড্রেসিং একটু পরিপাটি!’ এই যে শাঁটুল ড্রেসিং বলল, এটাও নৰ্থিশ! তার শাশুড়িও বলে, ‘খুব ড্রেস দিয়ে বেরোচ্ছে!’ আরও কত কী বলে এরা। সোহিনী নোট করে রাখবে। নইলে ভুলে যাবে! সে চট করে পুরনো কথা ভুলে যেতে পারে। নইলে সে প্রথম প্রেমিককে ভুলে কমলকে ভালবাসার চেষ্টা করল কী করে?

আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে দেখেছে সোহিনী। আজ তার ঘুম ভেঙে যায় যখন সূর্যের আলো প্রায় ফোটেইনি। সে ভাল করে চোখ না খুলেই বুঝতে পারে, পাশে শোওয়া কমলের নড়াচড়াটা একটু অন্য রকম। আধো চোখ খুলে সোহিনী দ্যাখে, কমল মাস্টারবেট করছে। সে চুপচাপ পড়ে থাকে। ঘুমের ভান করে। কমল একবার তাকায় তার দিকে, আলতো একটা ঠেলা দেয় তাকে বিন্দুমাত্র সাড়া দেয় না। তখন কমল আস্তে করে তার হাঁটুর উপর উঠে যাওয়া নাইটি দু’আঙুলে ধরে আরও উপরে তুলে দেয়! সোহিনীর ত্রিকোণ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যেন আকাশের নীচে দখলদারহীন পড়ে থাকে একটা বদ্বীপ। সে বুঝতে পারে, কমল সেটার দিকে তাকিয়ে মাস্টারবেট করছে। এক সময় ‘আঃ, আঃ’ শুনতে পায় সোহিনী। কমল তারপর তার নাইটিটা নামিয়ে দেয় আবার।

সোহিনী আশ্চর্য হয়ে যায়! কী যে কমলের যৌন দর্শন, সে মাথা খাটিয়ে বের করতে পারে না! কিন্তু তার মনে হয়, কমল তাকে ব্যবহার করেছে। হয়তো দিনের পর দিন। সে টের পায়নি। চোখে জল চলে আসে তার। হাসিও আসে। দু’- আড়াই বছরের বিবাহে, পাশাপাশি শোওয়ায় সে প্রতিনিয়ত কমলকে জোর করেছে মিলিত হতে। সে ভেবেছে, সে-ই চেয়েছে। কমল চায়নি। কমল চায়নি। কিন্তু যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। এটাই সত্যি। আজ মাসদুয়েক সোহিনী আর কমলকে জোর করেনি। তাই কি কমল এভাবে মাস্টারবেট করছে? তার অজ্ঞাতসারে তারই শরীর থেকে প্ররোচনা সংগ্রহ করছে? নিজের খিদে মেটাচ্ছে? কী গর্দভ! কিছু যায় আসে না। করুক যত খুশি মাস্টারবেট, করুক!

কমল যতক্ষণে না বেরোচ্ছে, সোহিনী নিজের হাতে সাজানো পাশের ঘরে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ে, বই পড়ে। আজ তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ মহুলের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সোহিনী এগারোটা নাগাদ বেরোবে। মিন্টো পার্ক যাবে, সুশিক্ষায়তনে। স্কুল বোর্ড কিছু কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে। অরিজিনালগুলো শো করে অ্যাটেস্টেড জেরক্স দিয়ে আসতে হবে। হঠাৎ সোহিনীর মনে পড়ল, কোনও কাগজই অ্যাটেস্ট করানো হয়নি। কমলকে দিয়ে সই করাতে হবে। সে তাড়াতাড়ি শোওয়ার ঘরে এসে আলমারি থেকে কাগজ বের করল। কমল তখন ব্রিফকেস গোছাচ্ছে। সে কোনও গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই বলল, “এগুলো সই করে স্ট্যাম্প মেরে দাও।”

কমল দেখল কাগজগুলো, বলল, “কী হবে এগুলো?”

“সুশিক্ষায়তনে আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।”

“তুমি চাকরি করবে? বাবা-মা’র পারমিশন নিয়েছ?”

“কোনও প্রয়োজন নেই।”

“তা ঠিক, চাকরি না করেই তো সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরছ। আমার মনে হয় না, মা তোমাকে চাকরির অনুমতি দেবে।”

“ডু আই কেয়ার?”

“তুমি এবাড়ির বউ, আমি বাবা-মা’র সঙ্গে থাকি। বাবা- মা’র বাড়িতে। আমি বা তুমি, যা খুশি করতে পারি না।”

“তুমি তোমার মা’র বাধ্য থাকো। তাতেই উনি খুশি থাকবেন। ওঁর আমাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই,” তারপর সে থামল একটু, “তা ছাড়া চাকরিটা আমি এবাড়িতে থেকে করব না। আই অ্যাম লিভিং দিস হাউস বাই সেপ্টেম্বর। তারপর মাসছয়েক পরে ডিভোর্স ফাইল করব। তুমি নিশ্চয়ই ডিভোর্সটা দিয়ে দেবে! আর না যদি দাও, তো আমি কোর্টে গিয়ে লড়ব। আমার বাবা-মা’র আমার বিয়ে দেওয়ার টাকা ছিল। ডিভোর্স দেওয়ার টাকা নেই। ডিভোর্সের খরচ আমি চাকরি করে দেব।”

কমল বসে পড়ল খাটে, “আমি একটা ডিভোর্সি ছেলে হয়ে ঘুরব? লোকে বলবে, কমলের বউ ছেড়ে চলে গেছে?”

“এই জন্য তুমি বিয়েটা টিকিয়ে রেখেছ? মা গো! কেন? তুমি আবার বিয়ে করবে। কোনও আনটাচ্ডকে। তবে তোমার বিদ্যে দিয়ে পরীক্ষা করে নিয়ো। নইলে ঠকতে পারো! তা ছাড়া তুমিও তো এখন সেকেন্ড হ্যান্ড হয়ে গেছ।”

“এদেশে মেয়ের অভাব নেই।”

“মেয়ের অভাব নেই। কিন্তু কুমারী মেয়ের অভাব আছে। তোমার তো আবার কুমারী না হলে চলবে না।”

কমলের পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল আপনাআপনিই কেমন উসকোখুসকো হয়ে গেল। তার জেরক্সগুলো নিয়ে ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলল কমল, “তুমি একটা কালনাগিনী!”

“আর তুমি একটা ভণ্ড, হিপোক্রিট। আমার ম্যাক্সি তুলে মাস্টারবেট করতে লজ্জা করে না?”

“ইস, চিৎকার করছ? সবাই শুনবে!”

সোহিনী একটা ঠাস করে চড় মারল কমলের গালে, “খুব না? সাধু পুরুষ!”

কমল তার হাত ধরে টানল, “তুমি যাবে না। তুমি যাবে না। তুমি এখানে থেকে চাকরি করো। আই উইল ম্যানেজ।”

“না।”

‘আমি তোমায় গোয়া নিয়ে যাব।’

“ইস, কমল এখনও হামাগুড়ি দিচ্ছ মনে হচ্ছে।”

“আমি ডিভোর্সি তকমা গায়ে লাগাব না। সকলে হাসবে।”

“কোন যুগে পড়ে আছ? মেয়েরাই ডিভোর্স দিতে দু’বার ভাবে না।”

“এপাড়ায় একটাও ডিভোর্স হয়েছে? আমার ফ্যামিলিতে হয়েছে? আমার হবে না।”

‘মামাবাড়ির আবদার, ডিভোর্সি হব না!” সোহিনী কমলকে ভেঙাল, “আমি আর থাকব না তোমার সঙ্গে। আমার একটা ফিলিং তৈরি হয়েছিল তোমার প্রতি, সেটা আর নেই। ওয়াশড আউট। ফ্রম মাই সিস্টেম।”

“মিথ্যে বোলো না। তুমি আমায় কখনও ভালবাসোনি!” বলল কমল।

“এতদিন পর ভালবাসার খেয়াল পড়ল? তুমি তো একটা কমপ্লিট মেল শভেনিস্ট। তুমি তো একটা ‘হোল’ ছাড়া কিছুই বোঝো না। বাকি মানুষটা, তার মনটা?” সোহিনী আবার এনে দিল এক্সট্রা জেরক্স।

কমল আর কিছু বলল না। সই করে স্ট্যাম্প মেরে দিল। তারপর বেরিয়ে গেল চেম্বারে।

মহুলের সঙ্গে দেখা হল সোহিনীর নির্দিষ্ট সময়ে। সে বেকবাগানের মুখটায় দাঁড়াল গিয়ে, মহুল এসে গাড়িতে তুলে নিল তাকে। যেতে যেতে মহুলকে সোহিনী সকালের ঘটনাটা বলল সব। অবশ্য ভোরের ব্যাপারটা বলল না। যতই ফ্র্যাঙ্ক হোক, ভোরের কথাটা বলতে তার লজ্জাই লাগল।

সব শুনে মহুল বলল, “তা হলে তুই ফাইনালি ডিভোর্স নিবি ঘোষণা করলি? এবার যদি তোকে কমল বলে, এখনই চলে যাও?”

“চলে যাব।”

“তোরা মেয়েরা কিন্তু সাংঘাতিক। ভীষণ ডিফিকাল্ট! কলকাতায় এসে যত মেয়েকে দেখলাম, প্রত্যেকে কিন্তু নিজের জীবনটাকে কমপ্লিকেটেড বানিয়ে রেখেছে। তোর ইন্দ্রাণীকে মনে আছে? ওর প্রবলেমটা শুনবি? তোর চেয়ে ডিফারেন্ট। হাজব্যান্ডের সঙ্গে পটে না। তার অন্য গার্লফ্রেন্ড আছে। ও জানে সেটা। ওর অফিস কোলিগের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার চলছে। সেই ছেলেটা আনম্যারেড। ওকে বিয়ে করতেও রাজি। তবু ইন্দ্রাণী নিজের বিয়েটায় ইতি টানছে না। কেন? না শ্বশুর-শাশুড়ি ভীষণ ভালবাসে আর বাবা-মা প্রচণ্ড হার্ট হবে। আর এভাবে শি ইজ় স্পয়েলিং হার লাইফ। এসব অহেতুক টানাপোড়েনে তো নিজের কাজকর্মও নষ্ট হয়। স্পিরিটটাও নষ্ট হয়। কোনও সাদা মেয়ে এসব করবে না। যাকে ভালবাসে না তার সঙ্গে থাকবে না। আর বাঙালি মেয়েরা তো আরও ন্যাকা! এসব দেখে টেখে আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি ক’দিনেই!”

“লিচ্ছবীর কী খবর?”

মহুল হঠাৎ বোম ফাটানোর মতো বলল তাকে, “লিচ্ছবীকে আমি বিয়ে করছি না!”

“কেন?” অবাক হল সোহিনী, “সব তো ঠিক?”

“বানচাল করতে হবে! ওর একটা বয়ফ্রেন্ড আছে। এখনও তার সঙ্গে ঘোরে ফেরে। ছেলেটা এখনও ওর বাড়িতে গিয়ে রাত কাটায়। আরে, আমার কিচ্ছু যায় আসে না। ওর দশটা প্রেমিক থাকতে পারে। তাই বলে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও তাদের সঙ্গে রাত কাটাবে? গত উইকেও লিচ্ছবী একটা ছেলের সঙ্গে কোলাঘাট গিয়েছিল! যে মেয়ের লিবিডো এত হাই, তাকে আমি ট্যাকল করতে পারব না সোহিনী। আমার এত ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া এ মেয়ে উইকএন্ড হলেই পাগলের মতো পার্টি করে, ড্রিঙ্ক করে। ভোর না হলে বাড়ি ফেরে না। তুই বিশ্বাস করবি না, প্রথম দিন আমার সঙ্গে বেরিয়ে কী পরিমাণ ড্রিঙ্ক করেছিল। কোনও কন্ট্রোল নেই। এসব খবর যখন থেকে পেতে শুরু করি, তখন থেকেই বেঁকে বসেছি। আমি আমার জীবনটা মেস করতে চাই না সোহিনী। সে যা ইচ্ছে করুক, আমার তাতে অসুবিধে নেই, কিন্তু তা বলে আমি তাকে বিয়ে করতে যাব না।”

“তোকে জোর করছে কে?”

“কে আর? বাবা!”

“কেন?”

“বাবার লিচ্ছবীকে দারুণ লেগেছে! ও নাকি পরে দুর্দান্ত ব্যাবসা সামলাবে। বাবা আসলে ঘুরিয়ে বলতে চায়, আমি ব্যাবসা সামলাতে পারব না। বাবার ধারণা, আমার অত অ্যাম্বিশন নেই। এত বছর বিদেশে থেকেও আমি নাকি ভেতো বাঙালি টাইপ রয়ে গেছি!”

“তোর বাবাকে আমি কখনও দেখিনি!” বলল সোহিনী।

“আমি বাবাকে বলে দিয়েছি, ওই মেয়ের সঙ্গে যদি বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো, খুব বাজে হবে। আমার জব অফার আছে হার্কলে-তে, সোজা চলে যাব! চাই না তোমাদের সম্পত্তি। তা সত্ত্বেও বাবা ওদের বাড়ির সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে! আমি বাবাকে কাল রাতে একটা এসএমএস করেছি, ‘তোমার যখন এতই ভাল লেগেছে লিচ্ছবীকে, হোয়াই ডোন্ট টু গো অ্যাহেড অ্যান্ড ম্যারি হার? আমার মাকে তো তুমি একবার ডিভোর্স দিয়েইছ, সেকেন্ড টাইম তো দিতে হবে না। অ্যান্ড দ্যাট আদার উওম্যান ইন ইয়োর লাইফ, শর্মিলা, আমাদের সকলের করুণার পাত্রী, শি ওন্ট কাম ইন ইয়োর ওয়ে।”’

“তুই এরকম এসএমএস করেছিস? তোর বাবা কিছু বলেননি?”

“না, এখনও না!”

“শর্মিলা করুণার পাত্রী কেন?”

মহুল গাড়ি চালাতে চালাতে হাসল, রাসেল স্ট্রিট দিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকল সেডানটা, “বাবা আদৌ মাকে ডিভোর্স দেয়নি! অন্তত আমার তাই ধারণা। বাবা-মা’র ইকোয়েশনটা আমি ঠিক জানি না। তবে প্ৰব্যাবলি শর্মিলার সঙ্গে বাবার বিয়েটা আইনসিদ্ধ নয়!”

সোহিনী চুপ করে রইল।

মহুলই বলল আবার, “আই হেট মাই ফাদার।”

ঠিক সাড়ে চারটের সময় চাঁদনি আর আহেলির ফ্লুরিজে পৌঁছে যাওয়ার কথা। মহুল আজ বান্ধবীদের ট্রিট দেবে। গাড়ি পার্ক করল মহুল পার্ক স্ট্রিটে।

সে হঠাৎ মহুলকে বলল, “তুই এত ভাল কেন রে?”

একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল মহুল তার দিকে। পিক পিক আওয়াজ করে গাড়িটা লক হয়ে গেল।

সোহিনী বলল, “দাঁড়া, তোর জন্য আমিই একটা মেয়ে দেখব। একটা শান্তশিষ্ট, ঘরোয়া, সুন্দর দেখতে মেয়ে, যার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই, সে নেশা করে না!”

“আর হাঁটুর নীচ অবধি পোশাক পরে না?” বলল মহুল।

“আর?”

“আর খুব হাসে।”

“আর?”

“আর রাগ করে না, কিন্তু অভিমান করে!”

“বাব্বা! আর কী?”

“আর? যার জীবনে আমিই প্রথম পুরুষ।”

সোহিনীর মুখটা সঙ্গে সঙ্গে কালো হয়ে যায়।

“তুই আমাকে শোনালি?”

“বিন্দুমাত্র না! আচ্ছা শোন, শোন সোহিনী, তোর জীবনেও তো কেউ একজন প্রথম পুরুষ ছিল? ছিল না?”

“হুঁ।”

“প্রতিটা মেয়ে, সে যতই স্বাধীনচেতা হোক না কেন, যতই পুরুষসঙ্গ করুক না কেন, কেউ একজন তো তারও প্রথম পুরুষ হবে?”

সোহিনী মাথা নাড়ল।

“আমার প্রথম যাকে দিয়েছিলাম, তার আমি কত নম্বর ছিলাম, সে নিজেই জানত না। ফলে আমার প্রথমটা একদম মাঠে মারা গেল!”

সোহিনী ফুসে উঠল, “তোরা সব ক’টা এক, হিপোক্রিট। যা না, যা, তোর তো অনেক টাকা, যা দিয়ে সোনাগাছির কোনও পিম্পকে ধর। ধরে একটা নথ ভাঙা বুক করে আয়।”

মহুল বলল, “সর্বনাশ করেছে। তোর উন্ডে হাত পড়ে গেছে! তুই নর্থ ক্যালকাটার মেয়েদের মতো শাড়ির কুঁচি ধরে চেঁচাচ্ছিস কেন?”

সোহিনী বলল, “আমি তোর পয়সায় খাব না। আই উইল পে মাই বিল। রাসকেল!”

“কেন, তোর বরও তো আমার মতোই রাসকেল! তুই তোর বরের পয়সা নিস কেন?”

“আমার বর তো আমার বর!” সোহিনী চোখ বড় বড় করে বলল কথাটা।

মহুল বলল, “তোর সব গুলিয়ে গেছে।”

এসবের পরে হঠাৎই সোহিনী বলে উঠল, “শোন, শোন মহুল, আমাদের পাড়ার না একটা মেয়ে আছে, ডালিয়া। ঠিক তোর যেমন মেয়ে চাই, সেরকম মেয়ে। তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারি।”

“তোদের পাড়া মানে? মুদিয়ালি?”

“শ্বশুরবাড়ির পাড়া। যেখানে আই রিসাইড।”

“একটু ডেসক্রিপশন দে।”

“দাঁড়া, হয়তো আমার ফোনে ছবি থাকলেও থাকতে পারে। পুজোর সময় তুলেছিলাম। সিঁদুরখেলার দিন।”

“তুই সিঁদুরও খেলেছিলি?”

“অফকোর্স। হোয়াই নট।”

“তোর বিয়েটাই তো জমল না! তাতেও পাড়ায় সিঁদুর খেলছিস?”

“তো কী করব? বঙ্কিমচন্দ্রের আর শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মতো ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে থাকব? কপালে করাঘাত করব?” সোহিনী বলল, “উফ, সত্যি তো এবার সিঁদুর খেলাটা মিস করব! আরে, ওদিনই তো আয়েষা ঘোষের সঙ্গে আমার ফাটাফাটি কম্পিটিশন হয়।”

মহুল বলল, “ধুনুচি নাচের?”

সোহিনী একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল, “না, সাজের!” দু’- দু’বার সে দেখেছিল, আয়েষা লাল বেনারসি পরে, মাথা থেকে পা অবধি সোনার গয়না পরে, বাঁধনকেও ওরকম সাজিয়ে, লোকলশকর পরিবৃত হয়ে সিঁদুর খেলতে হাজির হয়, যেন নবযুগের জমিদার গিন্নি! কী যে ভাবে নিজেকে! তাই সোহিনী এবার তিনশো টাকা দামের সস্তা পাড় শাড়ি পরে, হাতে শুধু শাঁখা পরে ঠাকুর বরণ করতে গেছিল। আর সবাই আয়েষা ঘোষকে ছেড়ে তাকেই দেখছিল অবাক হয়ে! ফোনে ছবি পাওয়া গেল ডালিয়ার দু’-তিনটে।

মহুল খুব খুঁটিয়ে দেখল সেগুলো এনলার্জ করে, “তুই শিয়োর, ওর কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?”

“বিয়ের চেষ্টা চলছে জানি।”

“কী করে আলাপ করাবি?”

“প্ল্যান করতে হবে। আমি ওর বাড়িতে যাব একদিন। বলব, আমার এক বন্ধুর জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। বলব, ডালিয়ার ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে।”

“মেয়েটা ফেসবুকে নেই?”

“আই ডোন্ট নো।”

“এটাই ভাল, আই ওয়ান্ট টু ফাইন্ড আ গার্ল মাইসেল্ফ।” বলল মহুল, “আই ডোন্ট ওয়ান্ট মাই ফাদার টু ইন্টারফেয়ার।”

ঠিক এই সময় চাঁদনি আর আহেলি হইহই করে ঢুকে এল ফ্লুরিজ়ে। কত দিন পর দেখা! কথাবার্তা সব অন্যদিকে ঘুরে গেল। সোহিনীর মনে হল, সে স্কুল লাইফে ফিরে গেছে! তার জীবনে কোথাও কোনও সমস্যা নেই। এক ফাঁকে অবশ্য মহুল নিজের নোটপ্যাড থেকে ফেসবুকে গিয়ে ডালিয়া মুখার্জিকে খুঁজে বের করে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল। মেসেজে লিখল, “তোমার ছবি দেখলাম এক জায়গায়। তোমার সম্পর্কে আমি একটু জানি। ক্যান উই বিকাম ফ্রেন্ডস? অবশ্য ওটা একটা কথার কথা। তুমি বুঝতে পারবে।’ মহুল নিজের ফোন নম্বরটা দিয়ে দিল মেসেজের সঙ্গে। আহেলি আর চাঁদনি ছ্যা- ছ্যা করল সব শুনে।

ওরা যখন মশগুল হয়ে গল্প করছে, তখন বাড়ি ফেরার পথে শর্মিলা একবার ফ্লুরিজ ঘুরে যাচ্ছিল। ফ্রাস্ট্রেশন থেকেই হোক আর যাই হোক, আজকাল সে খুব নিজেকে ইনডালজ করছে। গোপনে রোজই এটা-সেটা খেয়ে ফেলছে সে। ওয়েট বাড়ছে তাতে। আদিত্য জিজ্ঞেস করলে শর্মিলা খুব আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে, ‘তুমি শুধু আমাকে মোটাই দ্যাখো।’ আজ তার ইচ্ছে করল, চিজ কেক খেতে। ফ্লুরিজে ঢুকতে গিয়ে সে দেখতে পেল মহুলকে।

মহুলকে সে বরাবর অন্যরকম ভাবত। কিন্তু আদিত্যর ছেলে হলে কী হবে, মহুল বোধহয় একদম অন্য রকম। লিচ্ছবী নামের মেয়েটা, যাকে আদিত্য অলরেডি ‘মিমি’ না কী বলে আদর করে ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল, যে মেয়ে নাকি আদিত্যকে বলেছে, ‘আঙ্কল, আমি বিয়ের শপিং সব দুবাই থেকে করব’ আর আদিত্য বলেছে, অ্যাকর্ডিং টু পরেশ, ‘নো বিগ ডিল। আমরা সবাই যাব’, সেই লিচ্ছবীকে মহুল বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে! লিচ্ছবীর মতো জংলি বিল্লি ওর পছন্দ নয়। ওর নাকি একটা সাধারণ মেয়ে চাই! শর্মিলা আর ভিতরে ঢুকল না। মহুল মেয়েগুলোর সঙ্গে বসে খুব হাসছে। তবে দেখলেই বোঝা যায়, ওরা পরস্পরের বন্ধু।

সে খুব স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাল কয়েক পলক মহুলের দিকে। মহুলের বয়সি ছেলে হয় না তার। তবু মহুল সম্পর্কে তো ছেলেই। সে হাঁটতে লাগল গাড়ির দিকে। ওই লিচ্ছবী বলে মেয়েটা নাকি একদিন সল্টলেকের বাড়িতে এসে আদিত্যকে গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে। গুড বাই কিস। ইস! শ্বশুরকে কেউ চুমু খায়?

হাঁটতে হাঁটতে শর্মিলা ভাবল, তার কখনও শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হল না। সে কেমন বিচ্ছিন্ন আর একা হয়ে রয়ে গেল। পার্ক স্ট্রিটের জমজমাট সন্ধেবেলায় তার বুকটা খাঁ-খাঁ করে। উঠল একথা ভেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *