॥ ১ ॥
সাড়ে এগারোটার সময় ধীমানদা একটা হাঁক দিয়ে বলল, “জেঠাইমা, এবার আপনি উঠুন, জেঠাকে নিয়ে আমরা রওনা দিই। অ্যাই, কে আছিস, জেঠাইমাকে ধরে ভিতরে নিয়ে যা। সরসী, নীলা, তোরা আমার গাড়িতে উঠে পড়। ছাড়, জেঠাকে ছাড়। শনিবারের বারবেলা পড়ে যাবে এর পর, আর দেরি করা যাবে না!”
ধীমানদা এপাড়ার একজন নেতৃস্থানীয় লোক, কংগ্রেস করে। তা ছাড়া পাড়ার ফাংশন থেকে শুরু করে রক্তদান শিবির— সবেতেই ধীমানদার ভূমিকা সঞ্চালকের। জীবনের সব পরিস্থিতির সমস্ত কথাই ধীমানদা বেশ উচ্চৈঃস্বরে কেটে কেটে বলে থাকে। তবু এই সময় এতটা জোরালো কথাবার্তা শাঁটুলের মতো বেপরোয়া, চোখ-কানকাটা ছেলের কানেও কেমন বিশ্রী শোনাল!
ধীমানদার কথায় কানাই জেঠার বৈঠকখানা ঘরে আরও একবার আছড়ে পড়ল কান্নার ঢেউ। কানাই জেঠার দুই মেয়ে, নীলাদি আর সরসীদি। দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দু’জনেই কানাই জেঠার মৃতদেহ দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। জেঠাইমা বসে আছেন একটা চেয়ারে, জেঠার পা দুটোকে ছুঁয়ে। জেঠাইমা বেশি কাঁদেননি। লক্ষ করেছে শাঁটুল। বয়সের ভারে বৃদ্ধা নিজেও যথেষ্ট জবুথবু। একটু হতভম্ব চোখমুখ। ঘরের মধ্যে বেশ বড় একটা জটলা। পাড়ার কে নেই সেখানে। বেশিরভাগই কানাই জেঠার সমসাময়িক লোকজন। সতু কাকাও রয়েছেন। লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা সতুকাকা নিশ্চয়ই শ্মশানে যাবেন না। তা ছাড়া সতুকাকার হাতে মাছের রক্তের দাগ লাগা থলে। বোঝাই যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছিলেন।
ধীমানদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সতুকাকা বলে উঠলেন, “ওরে, আর কেঁদে কী হবে? যে গেছে, সে আর ফিরবে না। তোরা ওঠ, ওঠ, আর দেরি করিসনে, এবার আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।”
শ্মশানে যাবেন না, অথচ ‘আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে’ বলছেন! শুনে শাঁটুল হাসল মনে মনে। এই বুড়ো হল সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। কথাটা বলেই সতুকাকা হাঁপাতে শুরু করেছেন। তাঁর প্রচণ্ড হাঁপানি, বুকটা সব সময় হাপরের মতো উঠছে, নামছে। আজন্মকাল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বুকের খাঁচা কেমন যেন ঠেলে উঠেছে উপরের দিকে। শাঁটুল লক্ষ করেছে, আম আদমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিলে কপালে, নাকে বিজবিজে ঘাম দেখা দেয়। কিন্তু সতুকাকার মতো হেঁপো রোগীরা অষ্টপ্রহর হাঁপালেও তাঁদের শরীরের উপর চেপে বসে থাকা চামড়ার জিনিসটার কোনও ঘামটাম নেই! যেন কেমন ম্যাদা মেরে যাওয়া ঠান্ডা, নির্জীব আর ফ্যাকাশে। হাঁপানির রোগীদের বোধহয় ঘাম হয়ই না। কে জানে? ভুলও হতে পারে।
সতুকাকার হাঁপানো দেখে কানাই জেঠাদের ভাড়াটে স্নেহাশিসদার বউ ঘোমটা টানতে টানতে বলে উঠল, “কাকা, আপনি খুব হাঁপাচ্ছেন। একটু শান্ত হন।”
এই কথায় সতুকাকা হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, “ওরে, কানাইদা আমাকে হাত ধরে ইস্কুলে নিয়ে যেত। কানাইদা আমাকে রাস্তা পার হওয়া শিখিয়েছিল। কানাইদা আমাকে কত ঘটিগরম খাইয়েছে। সেই কানাইদা চলে গেল?”
এসব কথা শুনলে শাঁটুলের মনে বরাবরই হাসির ঢেউ ওঠে। চলে গেল মানে? যাবে না? আর কদ্দিন পড়ে থাকবে? ছিয়াশি তো হয়েছিল। বাব্বাঃ, শাঁটুল কখনও এতদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবে না! শাঁটুল চায় বেশ তরতরে থাকতে থাকতে দুনিয়া থেকে কেটে পড়তে। পাড়ায় এত বুড়ো হাবড়া দেখতে দেখতে বৃদ্ধাবস্থাকে সে প্রায় ঘৃণার চোখেই দেখে! কানাই জেঠা মারা গেছে শুনে তো প্রথম যে কথাটা ভেবেছিল সেটা হল, ‘যথেষ্ট!’ বেফালতু একটা লোক আর ক’দিন বাঁচবে? বেঁচে থেকে পৃথিবীর ভার বাড়ানো বই তো নয়? টানাটানির অন্ন ধ্বংস করা। এই বয়সে একটা লোক আর পৃথিবীর কোন কাজে লাগবে? তখনই কাউন্টার চিন্তাটা মাথায় এসেছিল তার, কানাই জেঠার ক্ষেত্রে এটা ঠিক। জেঠা সকাল থেকে বেলা বারোটা অবধি রকে ইজ়িচেয়ার পেতে বসে থাকত, হাতে ধরা থাকত একটা খবরের কাগজ, যে যেত, তাকে ডেকে ডেকে কথা বলাটা ছিল একমাত্র কাজের মধ্যে কাজ! আবার বিকেল পাঁচটা থেকে ঠিক ওই একই জায়গায় বসে থাকত রাত ন’টা পর্যন্ত। শীত, গ্রীষ্ম কুড়ি বছর ধরে ওই একই রুটিন! কিন্তু কানাই জেঠার পাশের বাড়ির পশুপতি জেঠার ক্ষেত্রে কেসটা ঠিক উলটো। পশুপতি জেঠারও বয়সও আশি হবে। পশুপতি জেঠা পেশাসূত্রে হলেন ঐতিহাসিক, হিস্টোরিয়ান। পাড়ার গর্ব। ইতিহাসের অনেকগুলো মোটা মোটা বই আছে, জেঠার নিজের লেখা। বাড়ি তো নয়, একটা লাইব্রেরি! এখনও সকাল-সন্ধে জানলা থেকে দেখা যায় জেঠা টেবিলে বসে পড়াশোনা, লেখালিখি চালিয়ে যাচ্ছেন। নিরলস সংগ্রাম! এই তো সেদিন টিভিতে ইন্টারভিউ হচ্ছিল জেঠার। বলছিলেন, ‘ইতিহাসের কোলেই মাথা দিয়ে শুয়ে আছি, আর ইতিহাস আমার কানে মৃদু মৃদু কথা কইছে! বড় রহস্যময় সেই ফিসফাস, খুবই সাংকেতিক এক ভাষা!’ এইটুকুই শুনেছিল শাঁটুল, তার বেশি শোনার ধৈর্য ছিল না তার, সে নিজে তো ইতিহাসে পাতি হাঁস!
পশুপতি জেঠার এখনও কত ছাত্র-ছাত্রী, অনেকেই সকাল- সন্ধে আসছে। এই একটা ব্যাপার শাঁটুল ও তার বন্ধুবান্ধবদের কাছে একসময় খুব উপভোগ্য ছিল। পশুপতি জেঠার কাছে ভাল ভাল বাড়ির সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আসত পড়াশোনা সংক্রান্ত সহায়তার জন্য। পি এইচ ডি-র স্টুডেন্ট ফুডেন্ট আর কী! নিমাই খুড়োর রকে বসে সেসব সুন্দরী মেয়েদের দেখতে কী ভালই না লাগত শাঁটুলদের! একটা চার চোখো মেয়ের তো প্রেমেই পড়ে গিয়েছিল সে! তখন শাঁটুলের নিজস্ব বাহন ছিল না। তবু বাসে-ট্রামে করেই মেয়েটাকে ফলো করেছিল একদিন। মেয়েটা থাকত দক্ষিণ কলকাতার বর্ধিষ্ণু পাড়া ল্যান্সডাউন রোডে। বরাবরই শাঁটুলের দক্ষিণ কলকাতার মেয়েদের উপর দুর্বলতা আছে। এপাড়ায় তো কিছু কম মেয়ে নেই। গিজগিজ করছে। কিন্তু শাঁটুলের চোখে দক্ষিণ কলকাতার মেয়েরাই অসামান্য। টক ঝাল মিষ্টি লজেন্সের মতো। সে তুলনায় এখানকার মেয়েরা তাকে তেমন টানে না, যেন বড্ড বেশি জানা। তো সেই পশুপতি জেঠা এখনও, এই বয়সেও মাঝেমধ্যে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নানা সভা-সমিতিতে যাচ্ছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। এই যে মেদিনীপুরে জমি খুঁড়তে গিয়ে তিন ফুট লম্বা কষ্টিপাথরের বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া গেল, তাই নিয়ে টিভিতে কত আলাপ আলোচনা, জেঠাকে তো স্টুডিয়োয় যেতেই হল না। বিরাট একটা ও বি ভ্যান দাঁড়িয়ে পড়ল ঠিক এখানে, যেখানে শাঁটুল এখন দাঁড়িয়ে আছে। পশুপতি জেঠার এখনও বেশ ব্যস্ততাময় জীবন। সুতরাং এর মানে দাঁড়াল, কারও কারও বয়স হলেও সংসারে একটা দাম থাকে। যাকে বলে, একটা উপযোগিতা থাকে। সেদিক থেকে ভেবে দেখলে, শাঁটুলের নিজের জেঠারও বয়স আশি ছাড়াল এবং মা যে সারাক্ষণ বলে, ‘বটঠাকুর না থাকলে কি এ সংসারে দু’বেলা হাঁড়ি চড়বে? সাধে কি আমি বুড়োকে এত তোয়াজ করি? দুধটা, ডিমটা ওর পাতে দিই?’ সে তো শাঁটুল বিলক্ষণ জানে কেন দেয়! জেঠা ছিল রেলের কেরানি। পেনশন হোল্ডার, বিয়ে-থা করেনি। এখনও অবধি জেঠার পেনশনটাই শাটুলদের সাত-আটজনের ফ্যামিলির মেন ইনকাম। বুড়ো মরলেই ইনকাম বন্ধ! ভাগ্যিস নন্দলাল দাস বিয়ে-থা করেনি, এই কথাটা শাঁটুলদের সংসারে সারাক্ষণ অনুচ্চারিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। জেঠার কাছ থেকে শেষ যা শাঁটুল হস্তগত করেছে, তা এই লাল ঘোড়া মোটরবাইকটা। এটায় চেপেই শাঁটুল ইদানীং এই চত্বর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কাজকর্ম এখন বেশ ভালই হচ্ছে তার। এ মাসে সে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা পকেটে পুরেছে। আজও রোজকার মতো শাঁটুল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পাঁউরুটি চায়ে ভিজিয়ে খেয়ে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল শ্যামবাজারে এক ক্লায়েন্টকে বাড়ি দেখাতে। অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটে ঢুকেই সে জানতে পারল, কানাই জেঠা দেহ রেখেছেন! জেঠা দশ দিন ভর্তি ছিল হসপিটালে। মৃত্যুর কারণ, বয়সজনিত। এখন সাতটা, সাড়ে সাতটা বাজে। ধীমানদা বলল, ‘শাঁটুল তোকে দরকার লাগবে। ব্যস, তার আর কাজে যাওয়া হল না। লালুকে পিছনে বসিয়ে শাঁটুল চলে গেল বাগবাজার ঘাটে, খাট আর ফুল কিনে আনতে। ক্লায়েন্টকে ফোন করে বলে দিল সন্ধেবেলা নিয়ে যাবে বাড়ি দেখাতে। তারপর সে একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করল খাল পাড় থেকে, সেখান থেকে গেল আর জি কর। বডি নিয়ে ফেরত আসা ইস্তক সে এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এপাড়ায় যত বিপদ আপদ, দুর্ঘটনা, মৃত্যু, ঝগড়া কাজিয়া, লাফড়া, কিচাইন সব কিছুর উপরই শাঁটুলদের একটা ওনারশিপ আছে! স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এখন তারাই পাড়ার সবেধন নীলমণি। সেই ক্লাস নাইন-টেন থেকে শাঁটুল যে কত বার হসপিটাল, নার্সিংহোম থেকে বডি এনেছে, কত বার শ্মশানে গেছে, তার হিসেব নেই। সে তাই দাঁড়িয়ে আছে কানাই জেঠার বাড়ির সামনে। কখন কী কাজের আহ্বান আসে…মাঝখানে দু’বার সে শুধু জগুর চায়ের দোকান থেকে চা খেয়ে এসেছে। সিগারেটে টান মেরে এসেছে। একটু আগে মা আর বউদি এসেছিল জেঠাকে শেষ দেখা দেখতে। মা তাকে দেখতে পেয়ে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “ও, তুই এখানেই তাঁবু গেড়ে বসে আছিস? সকালে বললাম একটু বাজার এনে দে, তখন তো খুব কাজ দেখালি?’ মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই শাঁটুল গঙ্গাধরের লন্ড্রির ভিতর গিয়ে সেঁধিয়েছিল। মা-বউদি চলে যাওয়ার পর আবার ফিরে এসেছে। তখন একটা অদ্ভুত কথা মনে হয়েছিল শাঁটুলের, মা কস্মিনকালেও বাড়ির বাইরে বেরোয় না। মাকে রাস্তাঘাটে হঠাৎ দেখলে শাঁটুল আগেও দু’-একবার চিনতে পারেনি। আজ বউদিকে দেখেই সে মাকে চিনে নেয়। তা-ও মুহূর্ত সময় লেগেছিল!
সতুকাকার আবেগমথিত কথা শেষ না হতেই ‘বলো হরি, হরি বোল’ ধ্বনি একটা অতীব ভারী কণ্ঠস্বর থেকে ছিটকে উঠল ঘরের মধ্যে। যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এমনকী শাঁটুল নিজেও চমকে উঠল সেটা শুনে! বাড়ির সামনে ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো ভিড়টা নতুন করে একবার গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল কানাই জেঠার বাড়ির গোল রকটার কাছে। আবার একটা ক্রন্দনরোল উঠল। শাঁটুল দেখল, মিন্তিপিসি জেঠাইমাকে ধরে ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে চলে যাচ্ছে। নীলাদি, সরসীদি আবার একবার জাপটে ধরেছে বাবার মৃতদেহ। ধীমানদা কাঁধ দিল জেঠাকে। শাঁটুল গিয়ে ম্যাটাডোরের ড্রাইভারকে বলল গাড়িটা এনে ঠিক নিমাইখুড়োদের রকের সামনে রাখতে। পাড়ার ভিড়টা বাড়ছে। ম্যাটাডোরের ড্রাইভার গাড়িটা পজ়িশনে রেখে এবার আর স্টার্ট বন্ধ করল না। এক হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে অন্য হাতে ধরা মোবাইলে লোকটা কথা বলতে বলতে হাসছে।
ঠিক এই সময় মোহিনীমোহন লাট লেন দিয়ে এসে অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটে এন্ট্রি নিল আয়েষাদি। কানাই জেঠার মরদেহ নিয়ে তৈরি হওয়া ছোটখাটো প্রসেশনটাকে ঠেলে ঠুলে কানাই জেঠার মৃতদেহের পায়ে আলতো হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে দুদ্দাড় করে মোটা মোটা আহ্লাদী শরীরটাকে নিয়ে ঢুকে গেল কানাই জেঠার বাড়ির ভিতর, যেতে যেতে তার দিকে তাকিয়ে আয়েষাদি বলল, “অভীকদাকে দেখেছিস শাঁটুল?”
ঠিক ক’দিন পর আয়েষাদি কথা বলল তার সঙ্গে? এটা মার্চ মাস, পুজোর পর আর সরাসরি তার সঙ্গে আয়েষাদির কথা হয়নি। সামনে পড়ে গেলেও আয়েষাদি এমন ভান করে আজকাল, যেন সে পোকামাকড়! দেখতেই পাচ্ছে না, এত তুচ্ছ! আজ শাঁটুল সেটাই করল, যেটা সে কখনও করেনি আয়েষাদির সঙ্গে! এত বছর, এত অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও, সে জাস্ট মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে হেঁটে গেল নিমাই খুড়োদের রকের দিকে। সে ভাবল, আজকাল আয়েষাদির খুব এসব কাণ্ডজ্ঞান হয়েছে। পাড়ার কেউ মারা গেলে সাদা সালোয়ার- কামিজ পরে শোকজ্ঞাপন করতে আসে।
ভীষণ নেকা নেকা লাগে শাঁটুলের এসব। আয়েষা ঘোষ কি হিন্দি সিনেমার নায়িকা যে, কেউ মারা গেলে সাদা কলিদার পরে, চোখে সানগ্লাস দিয়ে দেখা করতে আসতে হবে? এপাড়ায় বহুত আলতু ফালতু জিনিস আমদানি করেছে আয়েষাদি। পারলে আয়েষাদি শ্বশুর বিশ্বম্ভর ঘোষের টাকায় এই গোটা তল্লাটটাই কিনে নেয়। ‘বলো হরি, হরি বোল’ বলতে বলতে বড়কাকা, ছোটকাকা, ধীমানদা, শৈলেন চৌধুরি, সকলে মিলে কানাই চাটুজ্যেকে ম্যাটাডোরে তুলে দিল, সবসুদ্ধ জনাদশেক ছেলে জুটে গেছে। একে-একে তারা সব লাফ মেরে উঠে পড়ছে ম্যাটাডোরে। সবচেয়ে শেষে উঠল ধীমানদা। নিজের মোটরবাইকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শাঁটুল লালুকে জিজ্ঞেস করল, “অ্যাই? তুই যাবি তো আমার সঙ্গে?”
অন্য দিন হলে লালু ওর সেই নিজস্ব ভঙ্গিতে আধশোওয়া হয়ে থাকত নিমাই খুড়োদের রকের উপর। লাল তেলচুকচুকে সিমেন্টের বেদিতে পিঠ ঠেস দিয়ে হাঁটু জোড়া নাক বরাবর তুলে এনে লালু প্রায় শুয়ে পড়ে। দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয় একটা হাত, অন্য হাতটা সিগারেট ধরা অবস্থায় ঝুলে থাকে বাইরে, লালু চোখ বুজে ঝিমোয়। আজ নেহাত একটা শোকের ব্যাপার ঘটে গেছে বলে লালু পা ঝুলিয়ে বসে আছে রকে। তার কথায় লালু সিগারেটের টুকরোটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “চল।”
শাঁটুলের বাইকটা অ্যাকোয়ারিয়ামের গায়ে দাঁড় করানো আছে। এই অ্যাকোয়ারিয়ামটা লালুর খুব মায়ার জিনিস। পনেরো-কুড়ি বছর আগে ‘সৌহার্দ্য সঙ্ঘ’ থেকে গঙ্গাধরের লন্ড্রির সামনে এক চিলতে বেওয়ারিশ জায়গায় এই অ্যাকোয়ারিয়ামটা তৈরি করে দিয়েছিল। তখন লালু ক্লাস থ্রি- ফোরে পড়ে। লাল-নীল মাছগুলো দেখতে গিয়ে যাতায়াতের পথে রোজই দাঁড়িয়ে পড়ত অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে। তখন এই নিমাই খুড়োদের রকটা দখলে ছিল বটুকদাদের। আর যখন সে অবাক হয়ে জলের মধ্যে খেলে বেড়ানো মাছগুলো দেখতে ব্যস্ত, বটুকদা হঠাৎ করে এসে প্যান্ট খুলে দিত তার! তখন সে খুব বদলা নেওয়ার কথা ভাবত এসবের। সমস্ত অপমানের, অবজ্ঞার, তাচ্ছিল্যের। এদিকে খার থাকলে কী হবে, সে বটুকদাকে ভয়ও পেত খুব। সে জানত, গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে বটুকদা গুলি বানায়। গালে গালপাট্টা, বড় বড় চুল, বটুকদার চেহারাটাও ছিল বাজখাঁই। তা ছাড়া ছোটবেলায় লালুরা বাড়িতে ঠিকমতো খেতে পেত না। না খেয়ে খেয়ে সে কেমন একটা ক্যাবলা ক্যাবলা হয়ে গেছিল। কবে যে অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছগুলো মরে গিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামটা ফাঁকা হয়ে গেল, মনে নেই লালুর। এখন অ্যাকোয়ারিয়ামের ভিতরটা শেওলায় কালো হয়ে আছে। কাচের গায়ে মোটা মোটা শুঁড়ের মতো বেয়ে বেয়ে উঠেছে শেওলা। বটুকদা লোকটাও হেমন্ত সেতুর উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসতে গিয়ে একদিন বাস চাপা পড়ে মরেছে। প্রকৃতপক্ষে এখন লালু নিজেও ছোট ছোট বাচ্চাদের খচানোর জন্য অনেক সময় প্যান্ট খুলে দেয়। এটা একটা পুরনো খেলা, যা বড়রা ছোটদের সঙ্গে খেলেই থাকে! কিন্তু এখনও সে প্রায়ই ভাবে, অ্যাকোয়ারিয়ামটা পরিষ্কার করবে একদিন। ক’টা রঙিন মাছ ছাড়বে। কিন্তু হয়ে আর ওঠে না।
লালু ভাবছিল, এই একটা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাড়ায় বেশ নাটক হচ্ছে। কানাই চাটুজ্যের মড়ার গলাতে সাত-আটটা মালা? ভাবা যায় না! কুঁড়ে আর কেপ্পন, ‘কানাই চাটুজ্জ্যে’ বলতে এই তো বোঝায়! কোনওদিন ভিখিরিকে একটা পয়সা দিয়ে দেখেছে বুড়োটা? ম্যাটাডোরটা চলতে শুরু করেছে। সরসীদির বর ‘বলো হরি, হরি বোল’ বলতে বলতে ঝনাত শব্দে কিছু খুচরো পয়সা ছড়িয়ে দিল রাস্তার উপর।
লালু সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “যাঃ শালা, সব পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা! সব অচল পয়সা রে শাঁটুল! জমিয়ে রেখেছিল।”
শাঁটুল বলল, “যাবি তো চল রে লালু!”
শাঁটুলের মুখে অন্য উদ্দীপনা। শ্মশানে যাওয়ার একটু নেশা আছে ওর।
লালু বলল, “আজ আমার সকাল থেকে পেটটা বসে গেছে। যাওয়ার পথে ‘পপুলার’ থেকে কিছু একটা ওষুধ নিতে হবে।”
ম্যাটাডোরটা তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। লালু চড়ে বসল শাঁটুলের ঘোড়ার পিছনে। বাম্ শব্দে স্টার্ট দিল শাঁটুল বাইকটা। এখন রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোর বারান্দায়-রকে নানা মুখ। সকলেই কানাই জেঠার শেষযাত্রার সাক্ষী হচ্ছে। প্রদীপদার দু’বছরের ছেলেটা খুব নমো নমো করছে। ঠিক তখনই ভবেশ মিত্তিরের বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এল কমলের বউ। কমলের বউকে অচানক দেখতে পেয়ে শাঁটুলের বাইক প্রায় অ্যাক্সিডেন্টই করছিল শনি মন্দিরের গায়ে গিয়ে! খুবজোর বেঁচে গেল। কমলের বউয়ের নাম সোহিনী। আর শাঁটুল তার নাম দিয়েছে সোহিনী সাউথ। সাউথ থেকে বিয়ে হয়ে নর্থে এসেছে মেয়েটা। শাঁটুলের ধারণা, সাউথের মেয়েরা অন্যরকম হয়। সবাই জানে, বিয়ে করলে শাঁটুল সাউথের মেয়েকেই করবে। রায়বাগানের এই ইট বের করা বাড়ি, এঁদো গলির চেয়ে সাউথ ক্যালকাটা কত আলাদা! সোহিনী সাউথের যেখানে থাকে, সেটা মুদিয়ালি। মুদিয়ালি জায়গাটা দারুণ। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, বড় বড় গাছ, চওড়া বুলেভার্ড। সোহিনী ওই মুদিয়ালির মতো, এপাড়ার তুলনায় চোখটাটানো গ্ল্যামার, হাঁটাচলা, আদবকায়দা, পোশাকআশাক, কথা বলা, সবই আলাদা। এমনকী, ওর বিয়ের দিন শাঁটুল ফুলের স্তবক দিতে গেলে সোহিনী সাউথ যে হাসিটা হেসেছিল, সেটাও মারাত্মক ছিল! হেভি পার্সোনালিটি। এককথায় বলতে গেলে শাঁটুল-লালুরা এত স্মার্ট মেয়ে আগে কখনও দেখেনি। তাদের কাছে এই স্মার্টনেস, এই ঝাঁ চকচকে উপস্থিতি রোমহর্ষক, উত্তেজক! লালু জানে, হঠাৎ করে সোহিনীকে দেখলে শাঁটুল সেই চাপা উত্তেজনায় চিতাবাঘের মতো হয়ে যায়। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে চায় কমলের বউটার একদম ঘাড়ের কাছে। চোখ টানটান করে থমথমে মুখে তাকিয়ে থাকে। কৌতূহল জলের মীনের মতো সুরুত সুরুত করে আনাগোনা করে ওর চোখে। কমলের বউয়ের প্রতি শাঁটুলের এই বেপরোয়া আচরণ খুব এনজয় করে লালু। শাঁটুল ছটফট করলে তার খুব মস্তি হয়। আর যেহেতু সে শাঁটুলের সত্যিকারের বন্ধু, তাই সে সাবধানও করে শাঁটুলকে বাড়াবাড়ি না করতে। এপাড়ায় সকলেই সকলের দিকে নজর রাখে। কমলটা যতই ম্যাদামার্কা হোক, সোহিনী তো কমলের বউ। আর ‘বউ’ মানেই তো সম্পত্তি। ভোগ-দখলের সম্পত্তি! লালু দেখল, ফাটাফাটি ড্রেস করেছে সোহিনী আজ। সোহিনীর টকটকে ফর্সা গায়ের চামড়ায় যেন কেটে কেটে বসে গেছে কালো ব্লাউজটা। একটা সাদা-কালো চেক চেক শাড়ি পরেছে। শ্যাম্পু করা একটু বাদামি রঙের চুল খোলা অবস্থায় যেন লকলকিয়ে উঠছে কাঁধের উপর। চোখে সানগ্লাস। পায়ে পেনসিল হিল, হাতে একটা চমৎকার হ্যান্ডব্যাগ। ঠোঁটে কী একটা লিপস্টিক লাগিয়েছে, রোদে ঝলসে উঠছে পাকা পাকা টসটসে দুটো ঠোঁট। সেই ঠোঁটে সামান্য ঢেউ তুলে, হিলে শব্দ তুলে সে হেঁটে যাচ্ছে তিন মাথার মোড়ের উদ্দেশে। আর শাঁটুল এলোমেলো বাইক চালাচ্ছে। হঠাৎ গতিটা বাড়িয়ে দিয়ে শাঁটুল সোজা বটতলার ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। লালু দেখল, শাঁটুলের চিবুক শক্ত, মাথার দু’পাশের রগ ফুলে উঠছে। সে নেমে দাঁড়াতে যাচ্ছিল বাইক থেকে। শাঁটুল তার পায়ে চাপড় মারল, “বসে থাক।”
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল লালু, “শ্মশানে যাবি না?”
“নাঃ!” বলল শাঁটুল।
“দ্যাখ শাঁটুল, বাড়াবাড়ি করিস না। পাড়ার বউ, বন্ধুর বউ পরস্ত্রী, সমঝে চল। কমলের বউকে দেখলে তুই যে এরকম করিস, তা কিন্তু অনেকেরই নজরে পড়েছে। সেদিন রকে বসে তুই কমলের বউকে নিয়ে যেসব মন্তব্য করছিলি, সকলেই বুঝতে পারছিল, তোর একটা অন্যরকম ইন্টারেস্ট আছে!” নাকের কাছে উড়ে আসা একটা মাছি তাড়াতে তাড়াতে বলল লালু। সে দেখল, ওই তিন মাথার মোড় থেকে বাঁ হাতে ঘুরল সোহিনী সাউথ। এদিকেই আসছে। ট্যাক্সিতে উঠবে, জানা কথা।
শাঁটুল তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব বিদ্বেষপূর্ণ স্বরে বলল, “উলটো দিকের বাড়িতে একজন মারা গেছে, তার বডি এখনও পাড়া থেকে বেরোতে পারল না। কমলের বউ তারই মধ্যে এত মাঞ্জা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল? মেয়েটার কি কোনও চক্ষুলজ্জা নেই? এইজন্য কমলের মা বউকে দেখতে পারে না! আরে, এটা তো সাউথ ক্যালকাটা নয়, এখানে পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে লোকের জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক, এই বউটা সেসব তো মানতেই চায় না!”
“এসব মেয়ে এরকমই! কোনও নিয়মকানুন মানলেওয়ালি থোড়ি! অহংকারে মটমট করছে?” লালু সত্যি ভেবেই বলল কথাটা।
শাঁটুল চোখটা সরু করে তাকাল, “তাই না? আমার বউ হলে দেখিয়ে দিতাম! এত ছটফটানি বের করে দিতাম। কমলটা তো একটা ছাগল। এসব জ্যান্ত রাক্ষুসিকে কি কমলটমল হ্যান্ডল করতে পারে?”
‘আমার বউ হলে’ কথাটার মধ্যে অসম্ভব একটা কাম ভাব রয়েছে, বুঝল লালু। অবদমিত কাম। সে আত্মসংবরণ না করে বলল, “তোর বউ হলে আর কী করতি? বল শালা?”
শাঁটুল খুব শান্তভাবে বলল, “প্রথমেই থাই দুটো দেখতাম একটু। দু’হাতে দলাইমলাই করতাম!”
শাঁটুলের মধ্যে তৈরি হওয়া অমানুষিক ইচ্ছেটা পড়তে পারল লালু। সে বলল, “শালা তোকে পুয়েরা হড়কে দিয়েছে। তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে?” বলে গলাটা বিকৃত করে হাসল একটু।
শাঁটুল বলল, “দাঁড়া তো! আজ কমলের বউটাকে ফলো করতে হবে। প্রায় দিন এরকম ভরদুপুরে সেজেগুজে কোথায় যায় জানতে হবে!”
লালু বলল, “দ্যাখ শাঁটুল, আমি এই ফলো করাকরিতে নেই। যদি শ্মশানে যেতে হয় চল, যাচ্ছি। নইলে আমার বিস্তর কাজ আছে। একটু পরেই অভীকদা আমাকে খুঁজবে।”
“ভাগ শালা অভীকের পেয়াদা! আমাকে দ্যাখ। নিজের মর্জির চাকর, অন্যের নই! তোকে কত দিন ধরে বলছি, অভীকদাকে ছাড়, আমার লাইনটা ধর। আমারও চাপ বাড়ছে। একটা হেল্প হলে ভাল হয়, শেয়ার থার্টি, সেভেন্টি। তুই শুধু পার্টিকে বাড়িগুলো দেখিয়ে দিবি, ব্যস!”
দুপুর তিনটে নাগাদ অভীকদা লালুকে ট্রাভেল এজেন্সিতে যেতে বলেছে। অভীকদার বাবা-মা দিল্লিতে কোনও আত্মীয়ের বিয়েতে যাবে, টিকিট কালেক্ট করে টাকাপয়সা মিটিয়ে আসতে হবে। লালুর কোনও চাকরিবাকরি নেই। অভীকদা, আয়েষাদির ফাইফরমাশ খেটেই দিন চলছে তার। আয়েষাদির আজকাল হেভি মেজাজ হয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই ডাঁটো ডাঁটো বাক্যি ঝাড়ে। লালু বলল, “অভীকদাকে আমি চটাতে চাই না। মাস গেলে চার-পাঁচ হাজার এসে যাচ্ছে, আমার এতেই যথেষ্ট!”
শাঁটুল বলল, “তোর শাঁটুল দাসের মতো এলেম নেই। তোর বুকটা চড়াই পাখির বুক হয়ে গেছে লালু! তুই অভীকদার পুরো চাকর বনে গেছিস। তোর লজ্জা করে না? সেদিন দোলের আগের দিন রাতে সজলদাদের ছাদে মাল খেতে খেতে অভীকদা বলল, ‘লালু একটু পিঠটা ম্যাসাজ করে দে তো!’ তুই অমনই অভীক ঘোষের গাত্র মর্দনে লেগে গেলি! ছিঃ লালু, ছিঃ, ছিঃ! রোজ তোকে দিয়ে অভীকদা গা হাত-পা টেপায়!”
সত্যি একদম কাছে চলে এসেছে সোহিনী সাউথ! হাঁটার ছন্দে দুটো ভরাট সুডৌল ঊরু ফুটে ফুটে উঠছে, দুটো সাদা নিটোল লম্বা লম্বা হাতে ঝিকিয়ে উঠছে সোনার অলংকার। বালা না বাউটি, কী যেন বলে। লালুর কোনও জ্ঞান নেই এসব বিষয়ে। তার মায়ের হাতে তো আজীবন শুধু খয়ে যাওয়া ব্রোঞ্জের চুড়ি! ‘গয়না’ বললে লালুর বরং আয়েষাদির কথা মনে পড়ে। গয়নার বিজ্ঞাপনের চেয়েও বেশি গয়না পরে আয়েষাদি। আচ্ছা, সোহিনী সাউথকে কি আয়েষাদির চেয়ে বেশি ভাল দেখতে? তবে এটা এখন সকলেই জানে, বিশ্বম্ভর ঘোষের একমাত্র ছেলের বউ আয়েষা ঘোষ সোহিনী সাউথকে বেশ ঈর্ষার চোখে দেখে। এপাড়ায় আয়েষাদির প্রবল প্রতাপ- প্রতিপত্তি। যেমনটা একসময় ছিল আয়েষাদির শ্বশুর বিশ্বম্ভর ঘোষের। আয়েষাদি যেন শ্বশুরের জায়গাটাই নিয়েছে। সেই আয়েষাদি একমাত্র সোহিনী মিত্রের কাছে কোনও পাত্তা পায় না। বছরদুয়েক আগে তখন সোহিনী সবে বিয়ে হয়ে এপাড়ায় এসেছে, আয়েষাদি সোহিনীকে দলে টানতে চেয়েছিল। পুজোর ফাংশনে নাচতে বলেছিল সোহিনীকে। তাতে সোহিনী খুব বিরক্ত হয়ে ভ্রূ তুলে বলেছিল, ‘আমার গুরুর নাম বিজেশ মহারাজ, তুমি ভাবলে কী করে আমি এসব পাড়ার ফাংশনে নাচব?’ আরও একটা জায়গায় আয়েষাদিকে পুরো নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে সোহিনী সাউথ। সোহিনী সাউথ তুখোড় ইংরেজি বলে। আর আয়েষাদি যতই বড়লোকের বউ হোক, আসলে তো তাদের মতোই গরিব বাড়ির মেয়ে। গোলক মাঝি লেনে থাকত, পড়েছে মনোমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ে, বাংলা মিডিয়ামে। সোহিনী তরতর করে ইংরেজি বললে আয়েষাদি বাক্যিহারা হয়ে যায়। যারা সামনাসামনি আয়েষাদিকে সবচেয়ে বেশি তোল্লাই দেয়, তারাই এই নিয়ে পিছনে হাসাহাসি করে।
বটতলায় এই সময় ট্যাক্সির সংখ্যা হাতে গোনা। সর্বসাকুল্যে দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। একটা এইমাত্র প্যাসেঞ্জার তুলে চলে গেল। শাঁটুল এমনভাবে বটগাছের আড়ালে ‘সারদেশ্বরী’ প্রিন্টিং প্রেসের চাতালে ঢুকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তারা সোহিনীকে দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সোহিনীর পক্ষে তাদের দেখা সম্ভব হচ্ছে না। ট্যাক্সির দরজা খুলে ভিতরে উঠে বসল সোহিনী, অমনই স্টার্ট দিল শাঁটুল বাইকে। লালু একশো আশি ডিগ্রি চোখ ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা কে-কে লক্ষ করছে! ‘সারদেশ্বরীর’ বুড়ো ম্যানেজারটা চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা পরে হাতের কাজ থামিয়ে তাকিয়ে আছে এদিকে। কিন্তু সোহিনী ট্যাক্সিতে উঠে বসলেও ট্যাক্সি তো এগোচ্ছে না। লালু ভাবল, ট্যাক্সিটা কি যেতে চাইছে না? সোহিনী কী একটা বোঝাচ্ছে ড্রাইভারকে।
শাঁটুল বলল, “কেসটা কী? হারামিটা কি সোহিনী সাউথকে রিফিউজ করছে? লোকটা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল?”
লালু বুঝে গেল, এর পর কী হতে চলেছে, স্টার্ট বন্ধ করে মোটরবাইকটা তাকে ধরিয়ে দিয়ে শাঁটুল হেভি রেলা নিয়ে হেঁটে গেল ট্যাক্সিটা অবধি। জানলায় হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে বলল, “কী ব্যাপার? কোনও প্রবলেম?”
সোহিনী সানগ্লাস পরা চোখমুখ তুলল শাঁটুলের দিকে, এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর কোনও উত্তর না দিয়ে সটান নেমে এল ট্যাক্সি থেকে। আর হনহন করে হাঁটতে লাগল ব্রিজের দিকে। ব্যস, হেভি বোকা বনে গেল শাঁটুল! সোহিনীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কী করবে ভেবে না পেয়ে সে আচমকাই মাথা গরম করে ফেলে দুম করে একটা ঘুষি মেরে বসল ড্রাইভারটাকে!
মোটরবাইকটা ঠিক করে রেখে লালু ছুটে গেল ঝামেলা সামলাতে। ড্রাইভারটাও হাতা ফাতা গুটিয়ে নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। ব্যাপার অনেক দূর গড়াল, লোকজন জমে গেল। পাড়া, তাই দু’-চারটে চড়-থাপ্পড় খেয়ে ট্যাক্সিওয়ালা পালাল ব্যাপারটা ছেড়ে। ততক্ষণে আধঘণ্টা সময় বয়ে গেছে বি টি রোডের সামনে দিয়ে। অতঃপর কিংকর্তব্য? নাকের পাটা ফুলিয়ে শাঁটুল রাস্তার দু’পাশে। তারপর শ্যামবাজারের জনারণ্যে সোহিনীকে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেল কাশী মিত্তির ঘাটে।