অলিভার টুইস্ট – ৮

অষ্টম পরিচ্ছেদ

অলিভার ফিরে এলো না দেখে মিঃ ব্রাউন্‌লো তার পরের দিনই খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন ছাপাবার ব্যবস্থা করলেন। বিজ্ঞাপনটা ছিলো এরকম : 

পুরস্কার ঘোষণা 

গত বৃহস্পতিবার রাতে অলিভার টুইস্ট নামে একটি ছেলে তার পেন্টভিলের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, অথবা কেউ তাকে চুরি করে ধরে নিয়ে গেছে। যিনি তার খোঁজ দেবেন অথবা তার পুরোনো ইতিহাস জানাবেন, তাঁকে পাঁচ গিনি পুরস্কার দেওয়া হবে। 

যেদিন বিজ্ঞাপনটা খবরের কাগজে বেরুলো, সেদিনই সন্ধ্যায় অনাথ-আশ্রমের কাজে মিস্টার বাম্বল এসে পৌঁছোলেন লন্ডনে। সরাইখানায় ঢুকে এক গেলাস কড়া মদ সামনে রেখে হাতের খবরের কাগজখানা খুলে ধরলেন তিনি। 

বিজ্ঞাপনটা নজরে পড়তেই সেটা তিন-তিনবার পড়লেন মিস্টার বাম্বল। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পেন্টন্‌ভিলের পথ ধরলেন—মদের গেলাসটা যেমন ছিলো তেমনি অবস্থায় পড়ে রইলো টেবিলের ওপর। 

মিঃ বাম্বলের মুখে অলিভারের নাম শোনা মাত্র মিসেস্ বেডুইন্‌ তাঁকে মিস্টার ব্রাউন্‌লোর কাছে নিয়ে গেলেন। মিস্টার গ্রিউইও সেখানে হাজির ছিলেন। 

অলিভারের পুরোনো ইতিহাস বলতে গিয়ে সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে মিঃ বাম্বল যেসব কুৎসা রটালেন, তা শুনে মিঃ ব্রাউন্‌লো ও মিঃ গ্রীম্‌উইগ্ দু’জনেই খুব হতাশ হলেন। তাঁরা জানলেন যে, অলিভার জাত-না-জানা কুড়িয়ে পাওয়া একটা ছেলে,—বেইমানী আর নীচতাই তার স্বভাব। 

মিঃ বাম্বল্ বিদায় নেবার পর মিঃ ব্রাউন্‌লো কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বললেন : “বেডুইন্‌! অলিভার সত্যি একটা জোচ্চর।” 

কিন্তু মিসেস্ বেডুইন্‌ কিছুতেই একথা মানতে চাইলেন না। এর জন্যে মিঃ গ্রীম্‌উইগ্ তাঁকে বেশ একচোট ঠাট্টা করলেন। 

***

যে অনাথ-আশ্রমে অলিভারের জন্ম হয়েছিলো, সেখানকার ধাইমা মিসেস্ কর্নি একলা তাঁর ঘরে বসেছিলেন। বাইরে তখন তুমুল ঝড়-বৃষ্টি চলছে। ঘরের ভেতর দরজা-জানালা বন্ধ করে এক কাপ গরম চা নিয়ে তিনি আরাম করে খেতে বসেছেন। 

চা খেতে খেতে মৃত স্বামীর কথা তাঁর মনে পড়লো। মনে পড়তেই টি-পট- টার দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠলেন : “অমনটা আর আমি পাবো না!” কার উদ্দেশ্যে যে তিনি এ-কথা বললেন—মৃত স্বামী, না সামনের টি-পট্, তা বোঝা গেল না। এমন সময়ে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার বাম্বল। 

কিছুক্ষণ তাঁরা দু’জনে অনাথদের সম্বন্ধে আলোচনা করলেন। দেখা গেল, একটা ব্যাপারে দু’জনেই একমত— দু’জনেরই লক্ষ্য হলো, অনাথদের শোষণ করে তাদের পাওনা টাকা হাতিয়ে নিজেদের তহবিল বাড়ানো। কিছুক্ষণ এসব আলোচনার পরেই মিঃ বাম্বল বিদায় নিচ্ছিলেন, কিন্তু বাইরে ঝড়-জলের জন্যে মিসেস্ কর্নি তাঁকে খানিকটা অপেক্ষা করে, চা খেয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ জানালেন। 

অগত্যা মিঃ বাম্বল আবার চেপে বসলেন চেয়ারে। 

চা খেতে বসে এ-কথা সে-কথার পর মিস্টার বাম্বল মিসেস্ কর্নিকে বিয়ে করার কথাটা পাড়লেন। এমন সময়ে একটা বুড়ি এসে মিসেস্ কর্নিকে জানালো যে, স্যালী বুড়ি মারা যেতে বসেছে—সে মরার আগে মিসেস্ কর্নিকে বিশেষ জরুরি কোনো কথা বলে যেতে চায়। 

একথা শুনেই মিস্টার বাম্বলকে ঘরে অপেক্ষা করতে বলে, মিসেস্ কনি কর্তব্যের দায়ে সেই বুড়ির সাথে বেরিয়ে গিয়ে হাজির হলেন খুপরির মতো একখানা ছোটো ঘরে। সেখানে তখন একজন ছোকরা ছাত্র-ডাক্তার স্যালী বুড়ির কাছে বসে কি যে ওষুধ তৈরি করছে, আর স্যালী বুড়ি বেহুঁশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। কাছে আরও একজন বুড়ি বসে হা-হুতাশ করছিলো। 

ছাত্র-ডাক্তারটির কাছে মিসেস্ কর্নি জানতে পারলেন যে, আর ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যেই স্যালী বুড়ি মারা যাবে এবং মরার আগে তার হুঁশ ফিরে পাবার আশা খুবই কম। 

ছাত্র-ডাক্তারটি চলে গেলে, মিসেস্ কর্নি মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন : “স্যালী বুড়ি মরবে কখন তার জন্যে আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করবো?” 

ঘরে যে আর দু’জন বুড়ি বসেছিলো, তাদের একজন বলে উঠলো : “আর বেশিক্ষণ নয়, ঠাকরুন! আমাদের মরণের জন্যে কাউকেই আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না!” 

মিসেস্ কর্নি ধমকে উঠলেন : “চুপ কর, বুড়ি!” তারপর প্রশ্ন করে জানতে পারলেন যে, স্যালী বুড়ি এর আগেও বহুবার এমনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতো। একথা শুনে মিসেস্ কর্নি চলে যাবার জন্যে উঠছিলেন, এমন সময় স্যালী বুড়ি হঠাৎ বিছানার ওপর উঠে বসলো এবং মিসেস্ কর্নির একখানা হাত ধরে টেনে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে বললো : “আপনার সঙ্গে আমার কিছু গোপন-কথা আছে—ওদের বের করে দিন ঘর থেকে……তাড়াতাড়ি করুন…..তাড়াতাড়ি!” 

ইচ্ছে না থাকলেও দু’জন বুড়ি মিসেস্ কর্ণির ধাক্কা খেতে-খেতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

মুমূর্ষু স্যালী বুড়ি তখন সাধ্যমতো গলা উঁচু করে বলতে লাগলো : “এবার মন দিয়ে শুনুন আমার কথা। এই ঘরে, ঠিক এই বিছানায়, কত বছর আগে মনে নেই, কুড়িয়ে-পাওয়া একটি মেয়েকে এনে শোয়ানো হয়। তারপর তার একটি ছেলে হলো। আমি তার একটা জিনিস চুরি করেছি”–বলতে বলতে উত্তেজনায় স্যালী বুড়ি ধপাস্ করে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ বাদে আর্তনাদ করে আবার বিছানার ওপরে উঠে বসে সে বললো : “সেটা ছিলো তার একমাত্র সম্পদ। তার পরনে গরম পোশাক ছিলো না বটে— পেটেও অন্ন ছিলো না, কিন্তু সেটা সে সযত্নে রেখেছিলো তার বুকের মধ্যে। খুব দামী সোনার জিনিস সেটা।” 

—“সোনা!” মিসেস্ কর্নি আগ্রহের সঙ্গে বললেন : “বলো বলো! তারপর সেটার কী হলো?” 

স্যালী বুড়ি বললো : “সেটা সে আমার কাছে বিশ্বাস করে গচ্ছিত রেখেছিলো, আর শেষে মরার সময়ে হাত-জোড় করে বলেছিলো, ছেলেটা যদি বাঁচে তো তাকে এটা দিতে—তাহলে সে অন্তত নেহাৎ অনাথ হবে না। ছেলেটার নাম রাখা হয়েছিল অলিভার। আর আমি যে-সোনা চুরি করেছিলাম—”

–“হ্যাঁ, হ্যাঁ—বলো বলো” বলতে বলতে মিসেস্ কর্নি একেবারে স্যালী বুড়ির মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। 

স্যালী বুড়ি শেষে আর একবার উঠে বসে বিড়বিড় করে কি-যেন বললো, তারপর তার প্রাণহীন দেহটা বিছানার ওপরে ঢলে পড়লো। তার হাত দুটো তখনও মিসেস্ কর্নির স্কার্টের প্রান্তদেশ জড়িয়ে ধরে আছে। 

***

মিসেস্ কর্নির ঘরে একা বসে মিস্টার বাম্বল যখন বারবার ঘরের আসবাব আর তৈজসপত্র নেড়েচেড়ে দেখে মনে মনে সেগুলোর দাম কষে হিসেব শেষ করছিলেন, সেসময় ঘরে ঢুকলেন মিসেস্ কর্নি 

কথায় কথায় মিঃ বাম্বল জানতে পারলেন যে, মিসেস্ কর্নি তাঁর চাকরির দৌলতে বিনামূল্যে কয়লা ও মোমবাতি পান, এবং তাঁকে বাড়িভাড়া দিতে হয় না। তখন মিঃ বাম্বল আবার সেই বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। একটুখানি ইতস্তত করার পরে মিসেস্ কর্নি বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। 

কিছুক্ষণ পরেই মিসেস্ কর্নির অনুরোধে সেই ঝড়-জল মাথায় করে মিঃ বাম্বল ছুটলেন মিঃ সোয়াবেরীর বাড়ির দিকে, মৃতা স্যালী বুড়ির জন্যে কফিনের ফরমাস দিতে। 

সোয়াবেরী দম্পতি তখন বাড়ি ছিলেন না। নোয়া ক্লেপোল্ সেই অবকাশে শার্লটির কাছে বিয়ের প্রস্তাব করছিলো। এমন সময় মিস্টার বাম্বল সেখানে হাজির হলেন। বিয়ের কথা শুনতে পেয়ে তিনি কষে ধমকে নোয়াকে বললেন : “অ্যাঁ! এখানেও বিয়ে! সাবধান! ফের বিয়ের কথা বললে তোর মুণ্ডপাত করবো। যাক্ শোন্! তোর মনিব এলে বলিস, আশ্রমের এক বুড়ীর জন্য কাল সকালেই সে যেন একটা কফিন পাঠিয়ে দেয়। …দেশটা গোল্লায় গেল একেবারে—খালি বিয়ে আর বিয়ে।” 

কথাগুলো বলতে বলতে মিঃ বাম্বল বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *