দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অনাথ-আশ্রমের যে কর্মকেন্দ্রে শিশু অলিভারকে পাঠানো হলো দশ মাস বয়সে, মিসেস্ ভ্যান ছিলেন তার পরিচালিকা। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের দেহ ও মন কতো সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে নাকি মিসেস্ ম্যান বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই অনাথ-আশ্রমের প্রধান কর্মকর্তারা তাঁকে কিশোর অপরাধীদের অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করে নিশ্চিন্ত ছিলেন। মিসেস্ ম্যান ওইসব কিশোরদের নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন, বিশেষ করে সবচেয়ে কম খাবার আর সবচেয়ে কম পোশাক দিয়ে কি করে ছেলেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারা যায়, সেদিকে তাঁর নজর ছিলো প্রখর। ছেলেদের কোনো অনিয়মই তিনি সইতে পারতেন না। তাঁর আশ্রমের কোনো ছেলে হলফ করে বলতে পারবে না যে, বেনিয়ম করে সে বরাদ্দ খাবারের একটা কণাও কোনো দিন বেশি খেতে পেয়েছে। প্রত্যেক ছেলে-পিছু খরচ করার জন্যে তিনি প্রতি সপ্তাহে সরকার থেকে পেতেন সাড়ে সাত পেনী। পাছে বেশি খেয়ে পরে ছেলেদের মেজাজ বিগড়ে যায়, সেজন্যে তিনি সরকারের দেওয়া ওই সামান্য অর্থের বেশ মোটা একটা অংশ নিজের তহবিলে জমাতেন। অবশ্য ছেলেগুলো ছিলো বড্ড পাজী, তাই মিসেস্ ম্যানকে সকলের চোখে হেয় করার জন্যে তারা বেশির ভাগ বড় হবার আগেই মারা যেতো অসুখে ও অনাহারে। যদি কোনোরকমে তাদের কেউ বেঁচে থাকতো, তাহলে কতো কম খাবারে মানুষ জান বাঁচিয়ে থাকতে পারে তার একটা নমুনা হিসেবে দুনিয়ার সামনে তাকে তুলে ধরা যেতে পারতো।
মিসেস্ ম্যানের দেওয়া আদর্শ খাবার নিয়মিত খেয়ে অলিভারের বয়স যখন ন’বছর হলো, তখন তার রোগা লিকলিকে ছোটোখাটো চেহারা আর সাদা চামড়ার দিকে চেয়ে কেউ অনুমানই করতে পারতো না যে, তার দেহে কোথাও একফোঁটা রক্ত আছে। কিন্তু বাপ-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া বা প্রকৃতির দেওয়া এমন একটা জিনিস সে পেয়েছিলো তার দেহে ও মনে, যা মিসেস্ ম্যানের শত চেষ্টাতেও খোয়া গেলো না। তার সরল, সুন্দর, নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে সকলেরই তাকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করতো।
সেদিনটা ছিলো অলিভারের নবম জন্মতিথি। অলিভার সারাটা দিন দুজন কিশোর ছেলের সাথে তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করা কয়লা মজুত রাখার ছোটো কুঠুরীতে আটকে রইলো মিসেস্ ম্যানের হুকুমে। ওদের অপরাধ, ওরা নাকি বড্ড বেশি খাই খাই করেছে সেদিন। এহেন দিনে হঠাৎ সেখানে হাজির হলেন অনাথ- আশ্রমের প্রধান পরিচালক মিস্টার বাম্বল। ঘরের জানালা দিয়ে কুটীরের দরজার সামনে তাঁকে দেখেই মিসেস্ ম্যান বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি তখনি অলিভার ও তার সঙ্গী দুজনকে অবিলম্বে কয়লা-কুঠুরী থেকে বের করে দোতলায় নিয়ে গিয়ে ভালো করে গা রগড়ে ধুয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন পরিচারিকাকে। তাঁর ভয় হলো, মিস্টার বাম্বল যদি ওদের কয়লা-মাখা অবস্থায় দেখতে পান, তবে তাঁর বদনাম দিতে কসুর করবেন না তিনি।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মিসেস্ ম্যান খাতির-যত্ন করলেন মিঃ বাম্বলকে। ভালো ভালো পানীয় খেতে দিলেন তাঁকে। খেতে খেতে মিঃ বাম্বল জানালেন যে, কুড়ি পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেও অলিভারের বাপ-মায়ের কোনো পরিচয় বা খোঁজ পাওয়া যায়নি, আর ওর এখন বয়স বেড়েছে বলে ওকে এবার অনাথ- আশ্রমের কর্মকর্তারা তাঁদের প্রধান কর্মকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে কাজের লায়েক করে তুলতে চান। তাই অলিভারকে সেখানে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি।
একথা শুনে মিসেস্ ম্যান অলিভারকে নিয়ে এসে হাজির করলেন মিঃ বাম্বলের সামনে, মিসেস্ ম্যানের কথামতো অলিভার মিঃ বাম্বলকে নমস্কার জানালো।
মিঃ বাম্বল জিজ্ঞাসা করলেন : “কি হে অলিভার, তুমি কি আমার সাথে যাবে?”
মিসেস্ ম্যানের খপ্পর থেকে তাড়াতাড়ি রেহাই পেতে চায় অলিভার, তাই সে জবাব দিতে যাচ্ছিলো যে সে মিঃ বাম্বলের সাথে যেতে খুবই আগ্রহী, কিন্তু জবাবটা তার মুখে আটকে গেলো মিসেস্ ম্যানের দিকে তাকিয়ে। অলিভার দেখলো—মিসেস্ ম্যান মিঃ বালের চেয়ারের পেছনে সরে গিয়ে চোখ রাঙিয়ে হাতের ঘুষি দেখাচ্ছেন তাকে লক্ষ্য করে। ভয় পেলো বেচারা অলিভার। আমতা আমতা করে সে মিঃ বাম্বলকে জিজ্ঞাসা করলো মিসেস্ ম্যানের দিকে আঙুল দেখিয়ে : “উনিও কি আমার সাথে যাবেন?”
মিঃ বাম্বল বললেন : “আরে না-না। উনি কেন যাবেন তোমার সাথে? তোমাকে একলাই যেতে হবে আমার সাথে।”
পরিস্থিতি বোঝার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি ছিলো অলিভারের, তাই সে কেঁদে ভাসিয়ে দিলো মিসেস্ ম্যানকে ছেড়ে যেতে হবে বলে। মিসেস ম্যানও কিছুমাত্র দেরি না করে অলিভারকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, আর সাথে সাথে বিদায় সম্ভাষণও জানালেন। এভাবে দুজনের মধ্যে নিষ্প্রাণ ভালোবাসার অভিনয় হবার পর অলিভার তার বিগত ন’ বছরের আশ্রয় ছেড়ে রওনা হলো মিঃ বাম্বলের সাথে অনাথ-আশ্রমের প্রধান কর্মকেন্দ্রে যাবার জন্যে। তার ডান হাতে মিসেস্ ম্যানের দেওয়া এক টুকরো পাঁউরুটি, আর মাথায় অনাথ-আশ্রমের মার্কামারা ছোট্ট বাদামী টুপি।
মিসেস্ ম্যানের কুটীরের দরজা পেরিয়ে অলিভার রাস্তায় নামার সাথে সাথে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে তা দেখতে পেয়েই অলিভারের চোখে জল এলো। যে কুটীরের ভেতরে অলিভার কোনোদিন একটা দরদভরা কথা কারও মুখ থেকে শোনেনি, যেখানে সে কেবল পেয়েছে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা, যেখানে খিদের সময় খাবারের বদলে সে পেয়েছে তাড়না, সেই মিসেস্ ম্যানের কুটীর ছেড়ে চলে আসার সময় তার মুখে নেমে এলো শোকের ছায়া। যেসব বন্ধুদের সে রেখে এলো ওই কুটীরে, তাদের দুঃখময় জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে সে পথ চলতে লাগলো। এই বিশাল দুনিয়ায় অচেনা পথে এবার থেকে তাকে একা চলতে হবে, তাই তার মন অজানা আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে উঠলো।