ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার মুখে একখানা গাড়ি করে নিজের বাড়ির দরজায় এসে নামলেন মিঃ ব্রাউন্লো সঙ্গে দু’জন লোক নিয়ে। মিঃ ব্রাউন্লোর হুকুমে লোক দু’জন গাড়ির ভেতর থেকে নামিয়ে আনলো মকে।
তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে, বাড়ির পেছনের দিকে একখানা ঘরের সামনে তারা মঙ্কসকে নিয়ে হাজির হলো। তাদের পেছন পেছন এলেন মিঃ ব্ৰাউন্লো।
মঙ্কসকে ঘরে ঢুকতে নারাজ দেখে মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “ঘরে না গেলে তোমাকে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবো।” সে কথা শুনে ভয় পেয়ে মঙ্কস ঘরে ঢুকলো। মিঃ ব্রাউন্লো তাঁর সঙ্গীদের বললেন : “তোমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে যাও—আমি ডাকলে তবে এসো।”
লোক দু’জন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর মঙ্কস মিঃ ব্রাউন্লোকে বললো : “বাবার বন্ধু হয়ে চমৎকার ব্যবহার করছেন আমার সঙ্গে!”
মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “তোমার বাবার বন্ধু বলেই তো এরকম ব্যবহার করতে হচ্ছে আমাকে, নইলে এতক্ষণ জেলে পচে মরতে। তোমার বাবার সঙ্গেই শুধু আমার গভীর বন্ধুত্ব ছিলো না, তোমাদের পরিবারের আরও একজনের সঙ্গে আমার ভালোবাসা ছিলো। বহুকাল আগে তোমার পিসিমার সঙ্গে আমার বিয়ের ঠিক হয়েছিলো, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছে ছিলো অন্যরকম, তাই বিয়ের আগেই তোমার পিসিমা মারা যান। তাঁরই স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি আমি, তাই তোমার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করছি, এডওয়ার্ড ল্যাফোর্ড।”
মঙ্কস্ বললো : “ও-নামের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?”
—“কিছু না! আমি খুব খুশি যে, তুমি ও-পদবী পাল্টে ফেলেছো।”
মঙ্কস বললো : “আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছেন কেন, তা কি জানতে পারি?”
মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “তোমার ভাইয়ের জন্যেই তোমাকে এখানে ধরে এনেছি তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে।”
—“আমার কোনো ভাই নেই!”
মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “ধাপ্পা দিও না আমাকে। আমি তোমাদের পরিবারের সব খবর রাখি। তোমার বাবা বিয়ে করার কিছুকাল পরেই তোমার জন্ম হয়। তোমার বাবার পারিবারিক জীবন খুবই অশান্তিময় ছিলো, বিশেষত তোমার মা তোমার বাবার চেয়ে দশ বছরের বড়ো হওয়ার জন্যে। তারপর তোমার মায়ের চাল-চলনের ফলে তোমার বাবার জীবন নষ্ট হয়ে যেতে বসে। সে সময় তোমার মা তোমাকে নিয়ে বিদেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান, আর তোমার বাবা নিজের দেশেই পড়ে থাকেন একলা দীর্ঘদিন ধরে।”
মঙ্কস বললো : “আমি এসব কিছুই জানি নে।”
মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “মিথ্যে কথা, তুমি সবই জানো। এসময় তোমার বাবার সঙ্গে নৌবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী এবং তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের আলাপ হয়। তখন বড় মেয়েটার বয়স উনিশ, ছোটোটা বছর ছয়েকের। সেই বড় মেয়েটাকে তোমার বাবা বিয়ে করবেন বলে পাকা কথা দেন। এমন সময় এক মুমূর্ষু ধনী আত্মীয়কে দেখতে তোমার বাবা রোমে চলে যান, কেননা তিনি ওই আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী ছিলেন। রোমে গিয়েই তোমার বাবা কঠিন রোগে পড়ে কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যান। তিনি কোনো উইল করে যেতে পারেননি, তাই তাঁর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হলে তুমি আর তোমার মা।”
বাবা কোনো উইল করে যাননি, এ কথা মিঃ ব্রাউন্লোর মুখ থেকে শুনে মঙ্কস্ এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
মিঃ ব্রাউন্লো আবার বলতে লাগলেন : “রোমে যাবার আগে তোমার বাবা আমার কাছে কয়েকটা জিনিস রেখে যান। তার মধ্যে তাঁর নিজের হাতে আঁকা একখানা ছবি ছিলো—সেখানা তাঁর বাগদত্তা বউয়ের। সেই আমাদের দুজনের শেষ দেখা। তাঁর মৃত্যুর পরে বাগদত্তা বউটার খোঁজ নিতে গিয়ে জানলুম যে, তাদের পরিবার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে কেউ তা জানে না।” মিঃ ব্রাউন্লো আরও বললেন : “কিছুদিন আগে তোমার ভাইকে আমি বদমাইশদের দল থেকে উদ্ধার করি। তখন তাকে আমি তোমার ভাই বলে চিনতাম না। সে যখন অসুস্থ হয়ে আমার বাড়িতে ছিলো, তখন তার চেহারার সঙ্গে তোমার বাবার হাতে আঁকা বাগদত্তা বউটার ছবিখানার মিল দেখে অবাক হয়ে যাই। তাছাড়া, তোমার ভাইয়ের চোখে-মুখে তোমার বাবার আদলও দেখতে পেয়ে আমার সন্দেহ বেড়ে যায়। কিন্তু তোমার ভাইয়ের ইতিহাস জানার আগেই তাকে রাস্তা থেকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল ওরা। তারপর অনেক খোঁজ করেও তার আর খবর পাই না। এদিকে তোমার মাও মারা গেছেন, আর তুমিও ওয়েস্ট ইন্ডিজে আছো বলে আমার তখন জানা ছিলো। তাই মনে হলো, তোমার ভাইয়ের ইতিহাস হয়তো তুমিই একমাত্র জানতে পারো। তাই তোমার খোঁজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাই। তারপর কতদিন কত জায়গায় খুঁজেছি তোমাকে, কিন্তু তোমার দেখা পেলাম আজ মাত্র দু’ঘণ্টা আগে।”
সদর্পে দাঁড়িয়ে মঙ্কস বললো : “এতেই আমাকে চোর আর জালিয়াৎ বলে ঠাওরালেন? আপনি এও নিশ্চিত জানেন না যে, আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের কোনো ছেলে ছিলো কি না!”
মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “আগে তা জানতুম না বটে, কিন্তু গত পনেরো দিনের মধ্যে সব-কিছুই জেনে ফেলেছি। জেনেছি যে, ভাই তোমার হয়েছিলো, আর তুমিও তাকে ভালো করেই চেনো। উইলও ছিলো তোমার বাবার, কিন্তু তোমার মা নষ্ট করে ফেলেছেন সেখানা। সেই উইলে তোমার ভাইয়ের সম্বন্ধে কিছু বলা ছিলো, আর তোমার মার কাছ থেকে সে খবরটাও তুমি পেয়েছো। তারপর রাস্তায় নিজের ভাইকে চুরির দায়ে পুলিশ ধরেছে দেখে খুশিতে তুমি ডগমগ হয়ে উঠলে, আর তার বাবার পরিচয়ের প্রমাণ সম্বন্ধে তো তুমি নিজেই বলেছো, ছোঁড়াটার পরিচয়ের একমাত্র চিহ্ন এখন নদীর তলায়। আর যে-বুড়ি ওর মায়ের কাছ থেকে সেটা নিয়েছিলো, সেও আজ কবরে শুয়ে। এখনো কি তুমি আমার এসব কথার প্রতিবাদ করতে সাহস পাও, এডওয়ার্ড লীফোর্ড?”
এ কথার প্রতিবাদ করার মতো কোনো উচিত জবাব সহসা খুঁজে না পেয়ে মঙ্কস মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলো।
দারুণ ক্রোধে মিঃ ব্রাউন্লো বলে চললেন : “ওই ঘৃণ্য শয়তান ফ্যাগিনের কাছে তুমি যা বলেছো, তার প্রতিটি কথাই আমি জানি। নির্যাতিত অলিভারের দুঃখে ন্যানসির মতো মেয়েরও প্রাণ কেঁদে ওঠে…অলিভারকে বাঁচাতে গিয়ে ন্যানসি নিজের প্রাণ খোয়াতে বাধ্য হয়েছে…তাকে যারা খুন করেছে তার মধ্যে তুমিও আছো।”
—“না-না, ন্যানসির খুনের সাথে আমি জড়িয়ে নেই…তাকে খুন করার কারণও আমি কিছুই জানিনে।” ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মঙ্কস্।
মিঃ ব্রাউন্লো বললেন : “তোমার গোপন কথা ন্যানসি ফাঁস করে দিয়েছে বলেই তাকে খুন করা হয়েছে।”
একথা শুনে মঙ্কস খুব ভয় পেলো। সে মিস্টার ব্রাউনলোর দাবি মেনে নিয়ে তাঁর কথামতো সাক্ষীর সামনে সব কথা খুলে বলে অলিভারকে নিজের ভাই বলে স্বীকৃতি-পত্র লিখে দিতে এবং বাবার উইলমতো অলিভারকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে আপত্তি করলো না।
মিঃ ব্রাউন্ंলো যখন মঙ্কসকে নিজের কবজায় নিয়ে এসে তার সাথে একটা বোঝাপড়া করে ফেললেন অলিভারের বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে, সেই সময় ডাক্তার লস্বার্ন সে ঘরে ঢুকে জানালেন যে, সাইকে গ্রেপ্তার করার জন্যে চারিদিকে লোক পাঠানো হয়েছে, আর তার গ্রেপ্তারের জন্যে সরকার একশো পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছে। একথা শুনে মিঃ ব্রাউন্লো নিজে আরও পঞ্চাশ পাউন্ড পুরস্কার দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
—“বেচারা মেয়েটার খুনের প্রতিশোধ নেবার জন্যে আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে।” একথা বলে ডাক্তার লসবার্ন চলে গেলেন।