অলিভার টুইস্ট – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

অলিভার যখন মিঃ সোয়ারবেরীর বাড়ি থেকে পালালো, তখনো ভালো করে দিনের আলো ফুটে ওঠেনি। অলিভার কয়েক পা এগোয়, আর পিছু ফিরে দেখে, কেউ তাড়া করে আসছে কিনা। এভাবে ভয়ে ভয়ে পথ চলতে চলতে বেলা আটটার সময় পাঁচ-মাইল পথ পেরিয়ে গেল সে। দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে হাঁটার পর পথের পাশের মাইল-স্টোনের পাশে সে বসে পড়লো। এতক্ষণে সে ওদের নাগাল থেকে পালিয়ে আর যাতে ধরা না পড়তে হয়, সেকথাই ভাবছিলো, কিন্তু এবার প্রথম ভাবতে শুরু করলো তার ভবিষ্যতের কথা—কোথায় গেলে ভালো হয়, আর কিভাবে বাঁচার চেষ্টা করবে। 

যে মাইল-স্টোনের পাশে সে বসেছিলো, তাতে লেখা ছিলো : “লন্ডন শহর এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে।” 

লন্ডন শহরের নাম শুনেই বালক অলিভারের মনে নতুন সাড়া জাগলো। মস্ত বড়ো শহর সেটা—সেখানে গেলেই সে হারিয়ে যাবে বিশাল জনস্রোতে—কেউ, এমনকি মিঃ বাম্বলও তাকে খুঁজে পাবে না কখনো। তাছাড়া সে শুনেছে যে সেখানে নানা ধরনের কাজ পাবার উপায় আছে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে সে আবার হাঁটা শুরু করলো। 

সে মনে মনে ঠিক করলো : হোক্ সত্তর মাইল দূরে, সে পায়ে হেঁটেই লন্ডনে যাবে। 

পাঁচ মাইল হাঁটার পরে সে আবার বসে পড়লো। তার ছোটো পুঁটলির মধ্যে একটুকরো রুটি, একটা কোরা জামা আর দু’জোড়া মোজা ছিলো। তাছাড়া তার কাছে একটা পেনীও ছিলো—ওটা সে কাউকে কবর দেবার পর দান হিসাবে পেয়েছিলো। কিন্তু এই শীতের দিনে আরও প্রায় পঁয়ষট্টি মাইল হাঁটবে কিভাবে তা ভেবেই সে শিউরে উঠতে লাগলো। 

সেদিন অলিভার মোট কুড়ি মাইল পথ হাঁটলো। নিছক মনের জোরে। খেতে পেয়েছিলো শুধু সেই রুটিখানা, আর রাস্তার পাশের কুয়োর জল। রাতের আঁধার নেমে এলে সে খোলা মাঠের মাঝে একটা খড়ের গাদায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরের দিন সকালে খিদেয় তার নাড়ী জ্বলতে লাগলো। বাধ্য হয়ে পেনীর বদলে একটা ছোটো পাঁউরুটি যোগাড় করে কোনোরকমে পেটের জ্বালা খানিকটা কমালো। 

তারপর আবার হাঁটা শুরু করলো। সেদিন সে মোট বারো মাইল পথ হাঁটলো। তার পা দুটো ভীষণ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে কাঁপতে লাগলো। তবুও তার পথ চলার বিরাম নেই। পরের দিন হাঁটা শুরু করার সময় তার পা ফেলার ক্ষমতা ছিলো না বললেই হয়। 

একটা ছোটো পাহাড়ের তলায় সে একটা গাড়িকে আসতে দেখলো। তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পাহাড়ের চড়াইটা পার করে দেবার জন্যে সে অনেক অনুরোধ করলো, কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিলো না। গাঁয়ের মাঝ দিয়ে চলার সময় অলিভারের সবচেয়ে মুশকিল হলো কুকুরগুলোর জন্যে। তাদের তাড়ায় কোনো গাঁয়ে বসার উপায় ছিলো না তার। একে সে অপরিচিত, তার ওপর দীনহীন ছেঁড়া পোশাকে তাকে দেখে গাঁয়ের ছেলেরা তাকে চোর মনে করে কুকুর লেলিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে তাড়া করলো। 

তাছাড়া বড়ো বড়ো সাইনবোর্ডে লেখা ছিলো যে, যদি কেউ ভিক্ষা করে তবে তাকে জেলে পাঠানো হবে। এর ফলে না খেয়ে মরলেও সে হাত পাততে সাহস করলো না। 

একটা দয়ালু বুড়ি এবং একজন গেট-কীপারের অযাচিত সাহায্যের জন্যে অলিভার সে-যাত্রা বেঁচে গেল, নইলে তাকে রাজপথেই প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে হতো। এভাবে সাতদিন পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে ভোরবেলায় অলিভার এসে ঢুকলো বার্নে শহরে। তখন তার পায়ে এমন ব্যথা যে, সে পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলো না—তাকে খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছিলো। একটা বাড়ির দরজায় চুপ করে বসে পড়লো সে—কারো কাছে ভিক্ষা চাইবার প্রবৃত্তিও তার হলো না। 

এমন সময় অদ্ভুত চেহারার একটা ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ছেলেটার পরনে ঢিলেঢালা ছোঁড়া-ময়লা পোশাক আর তার মুখটা কেমন যেন তুবড়ে গেছে। অলিভারকে পা থেকে মাথা অবধি খুঁটিয়ে ভালো করে দেখে নিয়ে সে বলে উঠলো : “ওরে ছোঁড়া, তোর বাড়ি কোথা রে?” 

অলিভার বললো : “বাড়ি নেই!” 

ছেলেটা দরদ দেখিয়ে বললো : “বুঝেছি…পেটে দানাপানিও কিছু জোটেনি তো?” 

অলিভারের চোখ ছল্‌ল্ করে উঠলো। বললো : “না…খিদেয় আর দাঁড়াতে পারছি নে।” 

—“আয় আমার সঙ্গে…দুঃখ সঙ্গে…দুঃখ করিস নে…আমি তোর সব ভার নিচ্ছি…আয়”—এই বলে ছেলেটা অলিভারের হাত ধরে নিয়ে চললো। যেতে- যেতে সে একটা সরাইখানায় ঢুকে কিছু রুটি-মাংস কিনে অলিভারকে খাওয়ালো। খাওয়া শেষ হলে কথায়-কথায় ছেলেটা জানতে পারলো যে, অলিভার একজন সর্বহারা—শূন্য পকেটে চলেছে লন্ডনে—সেখানে তার থাকা-খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 

অলিভারের পিঠ চাপড়ে মুরুব্বীর মতো বললো ছেলেটা : “ভয় নেই রে… আমি তোকে লন্ডনে বিনি পয়সায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো।” 

কৃতজ্ঞতায় অলিভারের মন ভরে উঠলো। 

***

সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে অলিভার তার সেই নতুন-চেনা বন্ধু জ্যাক্‌ ডকিন্স ওরফে “ধুরন্ধর”-এর সঙ্গে লন্ডনে প্রবেশ করলো। অতি সরু নোংরা গলিপথ দিয়ে চলতে চলতে ফিল্ড লেনের কাছাকাছি একটা ভাঙা বাড়িতে অলিভারকে নিয়ে ঢুকে পড়লো ধুরন্ধর। ঢুকেই বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে খুব জোরে শিস্ দিলো। বাড়ির ভেতর থেকে সাড়া এলো : “কে?” 

জবাব দিলো ধুরন্ধর : “কুমড়োপটাস্।” 

এটা একটা সংকেত বাক্য বলে মনে হলো অলিভারের। কেননা সঙ্গে সঙ্গে গলির অপর দিকে মোমবাতির একটা ফিকে আলো জ্বলে উঠলো, আর সঙ্গে সঙ্গে একজন পুরুষের মুখ উঁকি মারলো। পুরুষটা জিজ্ঞাসা করলো : “সঙ্গে কে?” 

ধুরন্ধর অলিভারকে সামনে ঠেলে দিয়ে বললো : “নতুন বন্ধু…গ্রীনল্যান্ড থেকে আসছে। ফ্যাগিন্ ওপরে আছে কি?”

—“আছে।” জবাব এলো ওধার থেকে। 

ধুরন্ধরের হাত ধরে ভাঙা নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো অলিভার। নিচু ছাদওলা অতি পুরোনো নোংরা একখানা ঘর। বাজে কাঠের টেবিলের ওপর বোতলের মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বলছে। টেবিলের ওপরে গোটাকয়েক মশলার পাত্র, একটুকরো পাঁউরুটি, কিছু মাখন আর একখানা ছুরি। জ্বলন্ত উনুনের ওপরে সস্প্যানে কি যেন ছেঁচকি ভাজা হচ্ছে, তার কাছে খুক্তি-হাতে চামড়া ঝুলে-পড়া একজন বুড়ো ইহুদী দাঁড়িয়ে আছে। একটা আলনায় একরাশ রেশমের রুমাল ঝুলছে। পুরোনো চট দিয়ে ঘরের মধ্যে কয়েকটা বিছানা পাতা। টেবিলের চারপাশে বসে কতকগুলো ছেলে পাইপ টানছে আর মদ খাচ্ছে—তাদের কারুর বয়সই ধুরন্ধরের চেয়ে বেশি নয়। 

ধুরন্ধর বুড়ো ইহুদীকে ফিসফিস করে কি যেন বললো। তারপর অলিভারকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে বললো : “ফ্যাগিন্, এ আমার বন্ধু— অলিভার টুইস্ট।” 

ফ্যাগিন্ আর তার দলের ছেলেরা অলিভারকে সাদরে বরণ করলো। কিছু খাবার খেয়ে চটের বিছানায় শুতে-না-শুতেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লো অলিভার। 

অলিভারের ঘুম ভাঙলো অনেক বেলায়। ঘুম ভাঙার পরও সে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলো চোখ বুজে। মাঝে-মাঝে চোখ পিট্ পিট্ করে ঘরের চারদিকে নজর দিয়ে দেখলো, ঘরে ফ্যাগিন্ ছাড়া আর কেউ নেই। ফ্যাগিন্ তখন একলা বসে কফি তৈরি করার জন্য উনুনে সস্প্যান বসাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পরে অলিভারের নাম করে কয়েকবার ডাকলো তাকে ফ্যাগি, কিন্তু সে সাড়াশব্দ না দিয়ে মড়ার মতো পড়ে রইলো। ফ্যাগিন্ ভাবলো—অলিভার নিশ্চয়ই এখনো অকাতরে ঘুমিয়ে আছে, তাই এই অবসরে তার অলক্ষ্যে নিজের জরুরি কাজটা সেরে ফেলবে সে। 

ভোরে দলের ছেলেরা বাইরে বেরিয়ে গেলে রোজই ফ্যাগিন্ ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপিচুপি একলা বসে তার এই জরুরি কাজটা সেরে ফেলে কেউ ঘরে ফিরে আসার আগে। আজ অলিভার ঘরের মধ্যে আছে বলে তার অসুবিধা হচ্ছে ও-কাজটা সেরে ফেলতে কিন্তু অলিভার এখনও ঘুমোচ্ছে মনে করে সে নিশ্চিন্ত মনে ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঠের মেঝে সরিয়ে একটা ছোটো খুপরির ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করলো নানা চোরাই মাল। হিসেব করে সে দেখলো—সেগুলো সব ঠিক ঠিক আছে কি না। যেসব ছেলেদের সে আশ্রয় দিয়েছে নিজের ঘরে, তাদের তো পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। কখন কে হাত সাফাই করবে তার ঠিক কি? 

অলিভার পাশ ফিরে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো —ফ্যাগিন্ কতকগুলো সোনার ঘড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তাছাড়া আরও কতো রকমের নাম-না- জানা গয়না ছড়িয়ে রয়েছে তার চারপাশে। সেগুলো সে একটার পর একটা দেখছে আর বিড়বিড় করে কি বলছে, আর বাইরের সামান্য শব্দ শুনেই তার কান খাড়া হয়ে উঠছে। হিসেব শেষ করে ফ্যাগিন্ চোরাই মালগুলো আবার যথাস্থানে রেখে দিলো। এবার সে রুটিকাটা বড়ো ছুরিটা হাতে তুলে নিতেই অলিভার ভয়ে আঁতকে উঠলো। ফ্যাগিনের নজর এড়াতে পারলো না সে। ছুটে গিয়ে ফ্যাগিন্ ঘাড় ধরে অলিভারকে বিছানা থেকে তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ঠিক করে বল—কতক্ষণ ঘুম থেকে উঠেছিস?” ঘুমজড়ানো সুরের ভান করে অলিভার বললো : “এই মাত্র।” 

ফ্যাগিন্ আবার মেজাজ দেখিয়ে বলে : “ঠিক বলেছিস তো? আমার সাথে ধোঁকাবাজি করলে কিন্তু তোর ভালো হবে না বল্‌ছি!” 

অলিভার উদাসভাবে জবাব দেয় : “মিছে কথা কখনো বলিনে আমি।” ফ্যাগিন্ এবার একটু নরম হয়ে বললো : “আচ্ছা, তোর কথা বিশ্বাস করছি। এবার উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নে।” 

সেদিন নেহাত বুদ্ধির জোরে অলিভার বেঁচে গেলো ফ্যাগিনের হাত থেকে— নইলে হয়তো লাশ ভেসে উঠতো নদীর বুকে। 

অলিভার হাত-মুখ ধুয়ে ফ্যাগিনের কথামতো ঘর সাফ করছে, এমন সময় সেখানে এলো ধুরন্ধর—সঙ্গে আছে চার্লি বেট্স। গত রাতে চার্লিকে এই ঘরে পাইপ টানতে দেখেছে অলিভার। 

মাংস, মাখন আর কফি নিয়ে চারজনে খেতে বসলো। খেতে-খেতে অলিভারের দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে ধুরন্ধরকে প্রশ্ন করলো ফ্যাগিন্ “সকালে কাজে বেরিয়ে কিছু পেয়েছো কি সোনার চাঁদেরা?” 

ধুরন্ধর বললো : “দু’খানা পকেট-বই।” এই বলে সে দু’খানা পকেট-বই বের করলো—একখানা লাল, অপরখানা সবুজ। 

ফ্যাগিন্ সেগুলো খুলে ভালো করে পরীক্ষা করে বললো : “এগুলো তেমন ভারী নয়, তবে খুব চমৎকার বাঁধাই—কি বলো অলিভার?” 

অলিভার সায় দিলো : “সত্যি, ভারি চমৎকার!” একথা শুনে চার্লি হো-হো করে হেসে উঠলো—অলিভার তো অবাক। 

চার্লি জানালো যে, সে পেয়েছে খানকয়েক রুমাল শুধু! এই বলে সে চারখানা রুমাল বের করে দিলো। ফ্যাগিন্ সেগুলো পরীক্ষা করে বললো— “জিনিসগুলো মন্দ নয়। তবে মার্কা দেওয়া দেখছি। মার্কাগুলো তুলে ফেলতে হবে। ছুঁচ দিয়ে কেমন করে মার্কা তুলতে হয়, তা আমরা অলিভারকে শিখিয়ে দেবো। কি বলো অলিভার, য়্যা?—হাঃ হাঃ হাঃ!” 

এমন সময় সেখানে এলো ন্যানসি আর বেট্ নামে দু’জন তরুণী। তাদের মাথায় একগাদা এলোমেলো চুল। মুখে তারা রঙ মেখেছে প্রচুর। তেমন সুন্দরী না হলেও দু’জনেই বেশ মোটাসোটা আর হাসিখুশি তাদের চেহারা। 

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তাদের মদ খেতে দেওয়া হলো। তারপর চার্লি যেই জানালো যে, ক্ষুরে ‘প্যাড’ লাগাবার সময় হয়েছে, অমনি চার্লি, ধুরন্ধর ও মেয়ে দু’জন ফ্যাগিনের কাছ থেকে খরচের টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। 

অলিভার তার নতুন আস্তানার ভাব-গতিক কিছুই বুঝতে পারে না। তাকে রেশমের রুমাল থেকে মার্কা তুলে ফেলার কায়দা শেখানো হয়েছে। ঘরে বসে সে সে কাজ করে। আর মনে মনে ভাবে, কোথা থেকেই বা রোজ এত রেশমের রুমাল আসে। কেনই বা তার মার্কাগুলো তুলে ফেলা হয়! কাজের ফাঁকে নিরালা অবসরে বাইরের ফাঁকা বাতাস আর বাঁধনখোলা জীবনের জন্যে মন তার হাঁপিয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বুড়ো ফ্যাগিন্ তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না। 

***

অবশেষে একদিন অনুমতি পেয়ে সে চার্লি ও ধুরন্ধরের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। বেরুবার সময় তার সঙ্গীরা তাকে খোলাখুলি জানিয়ে দিলো, যা চোখে দেখবে, তা নিয়ে কোনো কথা যেন সে না বলে! অলিভার অবাক্ হয়ে দেখলো, পথের ধারে দোকানগুলো থেকে বহু আপেল আর পেঁয়াজ চুরি করে পকেট বোঝাই করলো চার্লি। তার পকেটগুলোতে এত জিনিস ধরে যে, মনে হচ্ছিলো তার সারা জামাটাই যেন পকেট! 

একটা সরু গলির মুখে ধুরন্ধরকে হঠাৎ থেমে পড়তে দেখে অলিভার জিজ্ঞাসা করলো : “কি হলো?” 

ধুরন্ধর বললো : “চুপ! ওই লোকটাকে দেখতে পাচ্ছো? ওই যে বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে!” 

—“রাস্তার ওপারে ওই বুড়ো ভদ্রলোক তো? হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি ওঁকে।” অলিভার বললো। 

–“বেশ মোটা মাল!” মন্তব্য করলো চার্লি বেস্‌। 

চার্লি ও ধুরন্ধর রাস্তা পার হয়ে ভদ্রলোকের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। অলিভার এখন কি করবে তা বুঝতে না পেরে তাদের পেছনে-পেছনে কয়েক পা এগিয়ে গেল। 

বুড়ো ভদ্রলোক একখানা বই নিয়ে একমনে পড়ছিলেন। অলিভার দেখলো, হঠাৎ ধুরন্ধর একটা হাত ঢুকিয়ে দিলো বুড়ো ভদ্রলোকের পকেট—তারপর একখানা রেশমের রুমাল হাতিয়ে নিয়ে চালান করে দিল চার্লির কাছে। তারপর দু’জনে মিলে ছুটে পালাতে লাগলো প্রাণপণে। এতদিন পরে অলিভার বুঝতে পারলো, কোথা থেকে কিভাবে ফ্যাগিনের ঘরে রোজ এত রেশমের রুমাল আসে। এরা তাহলে চোর পকেটমার! ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল অলিভার। সেও প্রাণপণে ছুটে পালাতে লাগলো। 

ঠিক এমনি সময়ে পকেটে হাত দিতেই বুড়ো ভদ্রলোক টের পেলেন যে, তাঁর রেশমের রুমাল খোয়া গেছে। পেছনে ফিরে তাকাতেই তিনি দেখলেন, একটা ছোটো ছেলে ছুটে পালাচ্ছে। বুড়ো ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন—“চোর! চোর! ধর! ধর!” 

অমনি সারা রাস্তার লোক “চোর চোর—ধর ধর” বলে চেঁচাতে লাগলো। ধুরন্ধর ও চার্লি পাকা চোর। তারা জানতো যে এ-সময়ে ছুটলে লোকে তাদেরই চোর বলে ভাববে। তাই তারা দু’খানা বাড়ি পেরিয়ে গিয়েই থেমে পড়লো। কিন্তু অলিভার তখনও সমানে ছুটে চলেছে। এর জন্যই সবাই তাকে চোর মনে করে তার পেছনে ধাওয়া করলো। 

খানিকটা দূরে যেতে না যেতেই ধরা পড়লো অলিভার। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো সে রাস্তার ওপর। সবাই তাকে দেখার জন্যে ঘিরে দাঁড়ালো। চারদিকে রব উঠলো—সরে দাঁড়াও, বাতাস ছেড়ে দাও’, ‘হ্যাঁঃ, ওর আবার বাতাস’, ‘কই সে ভদ্রলোক কই’, ‘ওই যে আসছেন উনি—ভদ্রলোককে পথ ছেড়ে দাও’ ইত্যাদি। 

বুড়ো ভদ্রলোক ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে অলিভারকে দেখে বললেন : “হ্যাঁ, মনে হচ্ছে এই ছেলেটিই। ইস—পড়ে গিয়ে ভারী আঘাত পেয়েছে তো!” 

—“পড়ে যায়নি….আমি মেরেছি…এই দেখুন, কবজিটা আমার ছড়ে গেছে মারতে গিয়ে—” বলতে বলতে একটা চোয়াড়ে ধরনের লোক এগিয়ে এসে বুড়ো ভদ্রলোককে সেলাম ঠুকে দাঁড়ালো কিছু পুরস্কার পাবার আশায়। 

ব্যাপারগতিক দেখে বুড়ো ভদ্রলোক তখন পালাতে পারলে বাঁচেন। কিন্তু গোলমাল দেখে পুলিশের লোক তখন এসে পড়েছে….বুড়ো ভদ্রলোকের আর সরে পড়া হলো না। পুলিশ অলিভারকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে বুটের ঠোক্কর মেরে বলে উঠলো—“পাজী শয়তান!” তারপর অর্ধ-অচেতন অলিভারকে নির্মমভাবে টেনে নিয়ে চললো তারা। বুড়ো ভদ্রলোককেও বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে যেতে হলো। 

অলিভার আর বুড়ো ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ মার্টন্‌ হিল’ আদালতে গিয়ে হাজির হলো। একজন গাঁট্টাগোট্টা গুঁফো দারোগা জানালেন যে, বুড়ো ভদ্রলোককেও এক মিনিটের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে হবে। তারপর দারোগাসাহেব অলিভারকে হাজতে পুরে তার দেহতল্লাশি করলেন, কিন্তু কিছু না পেয়ে তাকে আটকে রেখে দিলেন। 

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে বুড়ো ভদ্রলোক তাঁর নামের কার্ড টেবিলের ওপর রেখে বললেন : “এতে আমার নাম-ঠিকানা আছে, হুজুর।” 

ম্যাজিস্ট্রেট ফ্যাঙ্গের মেজাজ সেদিন খুব বিগড়ে ছিলো! কিছুদিন আগে একটা মোকদ্দমায় তিনি যে রায় দিয়েছিলেন, সে নিয়ে একটা প্রবন্ধে স্থানীয় দৈনিক কাগজে জোরালো সমালোচনা বেরিয়েছে। ওই প্রবন্ধে লেখা হয়েছে : “এই নিয়ে তিনশো বার স্বরাষ্ট্রসচিবের নজরে আনা হলো ম্যাজিস্ট্রেট ফ্যাঙ্গের বিরুদ্ধে।” বুড়ো ভদ্রলোককে যখন তাঁর সামনে হাজির করা হলো, তখন ফ্যাঙ্গ সেই প্রবন্ধটাই পড়ছিলেন চোখমুখ লাল করে। রেগে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : “বে তুমি?” 

বুড়ো ভদ্রলোক টেবিলের ওপর রাখা তাঁর নাম-ঠিকানা লেখা কার্ডটা এগিয়ে দিতেই ম্যাজিস্ট্রেট খবরের কাগজ দিয়ে সেটা মেঝেতে ঠেলে ফেলে দিয়ে বললেন : “ইনস্পেক্টর, লোকটা কে?” 

বুড়ো ভদ্রলোক গম্ভীর-কণ্ঠে বললেন : “আমার নাম, হুজুর, ব্রাউন্‌লো! কিন্তু যে ম্যাজিস্ট্রেট একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোককে এমন অপমান করেন, তাঁর নাম জানতে পারি কি?” 

হাতের কাগজখানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দারোগাকে জিজ্ঞাসা করলেন ফ্যাঙ্গ : “এ লোকটার বিরুদ্ধে নালিশ কিসের?” 

দারোগা জানালেন যে, নালিশ মিঃ ব্রাউন্‌লোর বিরুদ্ধে নয়—তিনিই নালিশ করতে এসেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট তখন মিঃ ব্রাউন্‌লোকে হলফ করার জন্যে হুকুম দিলেন দারোগাকে। 

বিচার শুরু হলো। মিঃ ব্রাউন্‌লো অনেক করে বললেন যে এই ছেলেটি তাঁর রেশমের রুমাল নিয়েছে কিনা, সে-কথা তিনি জোর দিয়ে বলতে পারেন না এবং ইতিমধ্যে সে যা সাজা পেয়েছে, তা যথেষ্ট হয়েছে। অলিভার তো কাঠগড়ায় উঠেই বেহুঁশ হয়ে পড়লো। তখন দারোগার জবানবন্দী নেওয়া হলো। তিনি অলিভারের নাম পর্যন্ত জানেন না—নিজের মন-গড়া নাম দিলেন, টম হোয়াইট’। মাত্র এটুকু শুনেই ম্যাজিস্ট্রেট অলিভারকে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ডের হুকুম দিলেন। 

পুলিশ বেহুঁশ অলিভারকে জেলে নিয়ে যাচ্ছিলো, এমন সময় আদালতে ঢুকলো সেই বইয়ের দোকানদার, যার দোকান থেকে মিঃ ব্রাউন্‌লো বই কিনেছিলেন। সে ম্যাজিস্ট্রেটকে বললো : “ওই ছেলেটা রেশমের রুমাল চুরি করেনি, আর ও সবসময় মিঃ ব্রাউন্‌লো থেকে বেশ খানিকটা তফাতে ছিলো— চুরি করেছে অপর একটা ছেলে। চুরি করতে দেখে ওই ছেলেটা হতবাক্ হয়ে খানিকটা দাঁড়িয়ে থেকে পরে ভয়ে ছুটে পালালো।” 

ফ্যাঙ্গের মেজাজ আগে থেকেই বিগড়ে ছিলো। বইয়ের দোকানদারের এ কথায় বেশ চটে গিয়ে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলেন তিনি : “এতক্ষণ একথা আমাকে বলোনি কেন?” 

বইয়ের দোকানদার জবাব দিলো : “হুজুর আগেই আসতাম আমি আপনার কাছে, কিন্তু নিজের দোকান ছেড়ে চট করে আসতে পারিনি।” 

ফ্যাঙ্গের জেরার চোটে এও জানা গেলো যে, মিঃ ব্রাউন্‌লো একখানা বই নিয়ে এসেছেন তার দোকান থেকে, কিন্তু এ ঘটনার জন্যে তাড়াহুড়োয় বইখানার দাম দিয়ে আসেননি। একথা শুনে ফ্যাঙ্গ কড়া ভাষায় ব্যঙ্গ করলেন মিঃ ব্রাউন্‌লোকে। তাতে মিঃ ব্রাউন্‌লো ভারি লজ্জিত হয়ে পড়লেন। 

বইয়ের দোকানদারের সাক্ষ্যের ফলে রেহাই পেলো অলিভার জেল খাটার দায় থাকে। 

মিঃ ব্রাউন্‌লো এবং বইয়ের দোকানদার একসঙ্গে আদালত থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন, অলিভার পড়ে আছে রাস্তার ওপর বেহুঁশ হয়ে। তার জামাটা ছিঁড়ে খানখান হয়ে গেছে। কে যেন তার মাথায় প্রচুর জল ঢেলে দিয়েছিলো। মৃতপ্রায় বালক অলিভারের সাদা মুখ দেখ মিঃ ব্রাউন্‌লো আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি তখনি গাড়ি ডেকে অলিভারকে তুলে নিয়ে নিজের বাড়িতে চললেন। বইয়ের দোকানদারও তাঁর সাথে চললো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *