অলিভার টুইস্ট – ১৪

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

সে রাতে রোজ ঘুমোতে পারলো না। ভোরবেলা সে হ্যারীকে চিঠি লিখে সব ব্যাপারটা জানিয়ে পরামর্শ নেবে বলে ঠিক করলো। 

পরদিন সকালে চিঠি লিখতে শুরু করে কি লিখবে ভাবছে, এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকলো অলিভার। সে জানালো যে, এই মাত্র সে মিস্টার ব্রাউন্‌লোকে একটা বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে এবং একটুকরো কাগজে সেই বাড়ির ঠিকানা লিখে এনেছে। রোজ কাগজখানা নিয়ে দেখলো, ক্র্যাডেন স্ট্রীটের একটা বাড়ির ঠিকানা। তখনি সে অলিভারকে সঙ্গে নিয়ে একখানা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লো। মিসেস্ মেইলীকে শুধু জানিয়ে গেল যে, তারা ঘণ্টাখানেকের জন্যে একবার বেরোচ্ছে। 

অলিভারকে বাইরে গাড়িতে বসিয়ে রেখে রোজ ভেতরে গিয়ে মিস্টার ব্রাউন্‌লোর সঙ্গে দেখা করলো। তিনি তখন মিস্টার গ্রীমউইগের সঙ্গে কি একটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। 

মিঃ ব্রাউন্‌লো রোজকে সাদরে গ্রহণ করে বললেন : “এসো, মা, এসো! ইনি আমার বন্ধু মিস্টার গ্রীমউইগ্…গ্রীমউইগ্, তুমি একটু বাইরে যাও।” 

রোজ বাধা দিয়ে বললো : “না-না, উনিও বসুন এখানে। আমি যে ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি তা উনিও জানেন।”

মিঃ ব্রাউন্‌লোর কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠেছিলেন মিঃ গ্রীমউইগ্, কিন্তু রোজের কথায় আবার ধপ্ করে বসে পড়লেন। 

মিঃ ব্রাউন্‌লোকে রোজ বললো : “এক সময়ে আপনি আমার এক বালক বন্ধুকে দয়া করেছিলেন। তাকে আপনারা ‘অলিভার টুইস্ট’ নামে জানেন।” 

মিঃ গ্রীমউইগ্ একখানা মোটা বই খুলে পড়ার ভান করছিলেন, রোজের মুখে অলিভারের নাম শুনে তাঁর হাত থেকে বইখানা সশব্দে পড়ে গেল—হাঁ করে রোজের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। 

মিঃ ব্রাউন্‌লোও রোজের কথায় কম বিস্মিত হননি। তিনি বললেন : “দয়ার কথা বাদ দাও, মা! তুমি যার নাম করলে, তার বিষয়ে আমি বড়ই হতাশ হয়ে গেছি।” 

মিঃ গ্রীমউইগ্ বলে উঠলেন : “ছোঁড়া যদি বদ না হয় তো আমি আমার মাথা খাবো।” 

রোজ় বললো : “আপনার মাথা আপনারই থাক…তবে আমার কাছ থেকে শুনুন, আপনারা যাকে বদ ছেলে বলছেন, তার মতো ভালো ছেলে বড় একটা দেখা যায় না।” 

মুখ ভার করে মিঃ গ্রীমউইগ্ বললেন : “আমার বয়স একষট্টি, এর মধ্যে অনেক কিছুই ভালো-মন্দ দেখলাম…ওই অলিভার ছোঁড়াটা যে একটা আস্ত শয়তান এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “ওঁর কথায় কিছু মনে করো না, মা! উনি যা বলেন, তা অন্তর দিয়ে বলেন না।” 

মিঃ গ্রীমউইগ্ গর্জে উঠলেন : “আলবাৎ বলি।” 

রেগেমেগে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “কখনই নয়।” 

মিঃ গ্রীমউইগ্ বললেন : “যে একথা মানে না তার মাথায় ছাই পোরা।”

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “যে এত জেদ করে কথা বলে তার মাথাটা ভেঙে দেওয়া উচিত।” 

মিঃ গ্রীমউইগ্ তাঁর লাঠিটা মেঝেয় ঠুকে বললেন : “সেও দেখতে চায়, তার মাথা ভাঙার সাহসটা কার।” 

রোজ অবাক হয়ে দেখে, এতখানি রাগারাগির পরও দু’জন বুড়ো আগের মতোই আবার হাসাহাসি করে প্রত্যেকে একই নস্যির দানি থেকে এক-এক টিপ নস্য নাকে গুঁজে একে অপরের হাতে হাত মেলালেন। বিচিত্র এ তাঁদের বন্ধুত্ব। 

তারপর মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : ‘নাও, মা, এখন তোমার আসল কথাটা বলো। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম, যাতে ছেলেটার ভালো হয়, কিন্তু বড় দুঃখেই তার বিষয়ে খারাপ ধারণা পোষণ করতে হলো আমাকে।” 

রোজ এবার অলিভারের বিষয়ে যতটুকু জানতো তা অল্প কথায় দু’জনকেই জানালো, কেবল ন্যানসির কথাটা গোপন রাখলো। ন্যানসির কথাটা মিস্টার ব্রাউন্‌লোকে গোপনে বলবে বলে রোজ সংকল্প করলো। 

রোজের কথা শুনে আনন্দে মিঃ ব্রাউন্‌লোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন : “বড়ো আনন্দ দিলে মা, বড়ো আনন্দ দিলে! আমি কিন্তু তোমাকে একটু বকবো—তুমি অলিভারকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে না কেন?”

রোজ বললো : “অলিভার আমার সঙ্গেই এসেছে…বাইরের গাড়িতে বসে সে অপেক্ষা কছে।” 

এ-কথা শুনে মিঃ ব্রাউন্‌লো ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ গ্রীমউইগ্ আসন ছেড়ে উঠে অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ রোজের কানে চুপিচুপি বললেন : “আমার অনুমান যে মিথ্যে হয়েছে, তার জন্যে আমিও খুব খুশি হয়েছি!” 

এমন সময় অলিভারকে নিয়ে মিঃ ব্রাউন্‌লো ঘরে ঢুকলেন। মিঃ গ্রীমউইগ্ উঠে অলিভারকে আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “ভালো কথা, আর একজনের কথা ভুললে চলবে না আমাদের।” এই বলে তিনি মিসেস্ বেডুইনকে ডেকে পাঠালেন। 

মিসেস্ বেডুইন্‌ ঘরে ঢুকে হুকুমের অপেক্ষায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাই দেখে মিঃ ব্রাউন্‌লো চেঁচিয়ে উঠলেন : “আঃ, বেডুইন্‌! দিন দিন কি চোখ তোমার খারাপ হয়ে যাচ্ছে?” 

মিসেস বেডুইন্ উত্তর দিলেন : “তা কর্তা, আমার মতো বয়সে আর চোখ ভালো হয় না।” 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “তা আমারও জানা আছে। এখন একবার তোমার চশমাটা চোখে দিয়ে দেখো দেখি, এখানে তোমার কোনো হারানিধির খোঁজ পাও কিনা?”

মিসেস্ বেডুইন্ তাঁর জামার পকেটে চশমা হাতড়াতে লাগলেন। কিন্তু অলিভার আর চুপ করে থাকতে পারলো না—ছুটে গিয়ে মিসেস্ বেডুইন্‌কে জড়িয়ে ধরে ডাকলো : “ধাই-মা!” 

—“অলিভার না? জয় ভগবান! ওরে, তুই এখানে আবার ফিরে আসবি, এ আমি জানতুম। কোথায় ছিলি রে বাছা এতদিন?…ঠিক সেই মুখ, সেই চোখ! এ- মুখ, এ-চোখ, এ-হাসি যে বরাবর আমার মনে গেঁথে আছে!” 

বলতে বলতে হাসি-কান্নায় অধীর হয়ে উঠলেন মিসেস্ বেডুইন্। 

সুযোগ বুঝে রোজ গোপনে মিস্টার ব্রাউন্‌লোকে ন্যানসির কথা জানালো।

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “আমি রাত আটটার সময় হোটেলে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করবো, মা! এর মধ্যে তুমি মিসেস্ মেইলীকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে রেখো।” 

কতকটা নিশ্চিত হয়ে রোজ অলিভারকে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলো। 

রাতে মিঃ ব্রাউন্‌লো হোটেলে এলেন। ডাক্তার লসবার্নও সেখানে হাজির ছিলেন। মিসেস্ মেইলী তাঁকে আগেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন অলিভারের ব্যাপারটা তাঁকে জানাবার জন্যে। ডাক্তার লসবার্ন সমস্ত শুনে তো রেগেই আগুন! তখনই সমস্ত দলটাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। মিস্টার ব্রাউন্‌লো তাঁকে বেশ কয়েকবার ধমক দিয়ে অতি কষ্টে থামালেন। 

ডাক্তার লসবার্ন তবুও বললেন : “আমি তাদের সব কটাকে পাঠিয়ে দেবো—”  

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “তাদের কোথায় পাঠাবেন, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো, অলিভারের বাপ-মায়ের পরিচয় খুঁজে বের করা এবং তার বাপের সম্পত্তির ওপর তার দাবিদাওয়ার বিষয়ে ব্যাপারটা কি তার জানা।” 

ডাক্তার লসবার্ন শান্ত হয়ে বললেন : “তা তো বটে! তবে তাদের কয়েকটাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো চাই-ই, আর বাকিগুলোকে পাঠাতে হবে দ্বীপান্তরে।” 

হেসে মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁসি আর দ্বীপান্তরের পথ খোলসা করে নেবে। কিন্তু রোজ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ন্যানসিকে, তা একটুও না ভেঙে আমাদের কাজে এগোতে হবে। ন্যানসির সাহায্যে মকে চিনে নিয়ে, তাকে একলা পাকড়াও করে আজ আনতে হবে। কিন্তু রবিবারের আগে তো ও মেয়েটার দেখা পাচ্ছি নে—আজ তো সবে মঙ্গলবার। এ-ক’টা দিন আমাদের চুপচাপ থাকতে হবে—অলিভারকে পর্যন্ত কিছু জানতে দেওয়া হবে না। আর, আমি আমার বন্ধু মিঃ গ্রীমউইকে দলে নিতে চাই। লোকটা অদ্ভুত প্রকৃতির হলেও খুবই চতুর—বিশেষ সাহায্য করতে পারবে আমাদের। সে ওকালতি করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পেশা ছেড়ে দিয়েছে, কেননা বিশ বছরের মধ্যে একটার বেশি মোকদ্দমা আসেনি তার হাতে।” 

ডাক্তার লসবার্ন এ-প্রস্তাব মেনে নিয়ে বললেন : “তা-হলে আমিও কিন্তু আমার একজন বন্ধুকে দলে নেবো। সে ওই বৃদ্ধা মহিলার পুত্র এবং এই তরুণীর অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু।” এই বলে তিনি মিসেস্ মেইলী ও রোজকে দেখিয়ে দিলেন।

মিসেস্ মেইলী জানালেন যে, এ তদন্ত যাতে সফল হয় তার জন্যে তিনি টাকাপয়সা খরচ করতে কসুর করবেন না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *