অলিভার টুইস্ট – ৭

সপ্তম পরিচ্ছেদ

অলিভারকে জনতার হাতে ছেড়ে দিয়ে চার্লি ও ধুরন্ধর ফিরে এলো ফ্যাগিনের আস্তানায়। 

—“অলিভার কোথায়?” চোখ লাল করে প্রশ্ন করলো ফ্যাগিন্ 

ফ্যাগিনের চেলা খুদে চোরেরা ওস্তাদের রাগ দেখে ভয় পেলো, কোনো জবাব দিলো না তারা। 

ধুরন্ধরের জামার কলার চেপে ধরে ফ্যাগিন্ বললো : “কি করেছিস তোরা ও ছোকরার? এখনি বল, নইলে তোকে গলা টিপে মেরে ফেলবো।” 

সে যা বলছে, তা যে সে সত্যিই করবে, এমনি একটা ভাব ফ্যাগিনের চোখে-মুখে ফুটে উঠতে দেখে ভয়ে শিউরে আর্তনাদ করে উঠলো চার্লি বেস। “বল্ শীগগির!” আবার গর্জন করে উঠলো ফ্যাগিন্। মুখ গোমড়া করে ধুরন্ধর বললো : “পুলিশের ফাঁদে সে ধরা পড়েছে। ছাড়ো—আমাকে ছেড়ে দাও।” এই বলে সে এক ঝটকায় তার ঢিলে জামাটার ভেতর দিয়ে গলে বেরিয়ে গেল। জামাটা ফ্যাগিনের হাতেই রয়ে গেল। তারপর সে একটা খুক্তি তুলে ছুঁড়ে মারলো ফ্যাগিনের দিকে। 

চকিতে সরে দাঁড়ালো ফ্যাগিন্। সঙ্গে-সঙ্গে একটা লম্বা ডিগবাজি খেয়ে মদের বোতল তুলে নিয়ে ধুরন্ধরের দিকে তাক্ করলো, কিন্তু সেই সময়ে চার্লির গলা- ফাটানো চিৎকারে বিরক্ত হয়ে তার দিকেই ছুঁড়ে মারলো সেটা 

বোতলটা লুফে নিয়ে কে যেন মোটা-গলায় বলে উঠলো : “কে ছুঁড়লো রে এটা? এতে নেহাতই মদ আছে তাই, নইলে একজনকে আজ খুন করতুম নিশ্চয়ই।” বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো বছর-পঁয়ত্রিশের গুণ্ডার মতো চেহারার একটা লোক। তার পেছনে-পেছনে এলো সাদা রঙের একটা লোমশ কুকুর। 

ঘরে ঢুকেই ফ্যাগিকে বললো সে : “আরে বেহায়া অর্থপিশাচ! ছেলেগুলোর ওপর আবার জুলুম করছিস? এরা যে কেন তোকে এখনও খুন করেনি, তা ভেবে আমি অবাক হই।” 

আগন্তুক বিল সাইকে দেখে ফ্যাগিনের গরম মেজাজ উবে গেল একেবারে। সাইকে দু-তিন গেলাস মদ খাইয়ে তখনই শান্ত করলো ফ্যাগিন্। সাইকস্‌ এবার ধুরন্ধরের কাছ থেকে অলিভারের ব্যাপারটা সব জেনে নিলো। 

ফ্যাগিন্ বললো : “আমার ভয় হয়, সে হয়তো এখানকার কথা পুলিশের কাছে ফাঁস করে দিয়ে বিপদে ফেলবে আমাদের!” 

সাইক্‌স্ পরামর্শ দিলো : “পুলিশ-অফিসে কি ঘটেছে, কেউ গিয়ে সে খবরটা জেনে আসুক এখনি!”

কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় পুলিশের আওতায় যেতে কেউই রাজী নয়। এমন সময় ঘরে ঢুকলো দুটো মেয়ে—ন্যানসি আর বেট্। শেষে ফ্যাগিনের অনুরোধে ন্যানসি অলিভারের খবর নিয়ে আসতে রাজী হলো। 

এক হাতে একটা ঝুড়ি আর অপর হাতে একটা বড়ো চাবি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পথে বেরিয়ে ন্যান্‌স ইনিয়ে-বিনিয়ে চেঁচাতে লাগলো : “ওগো, তার কি হলো গো? তাকে কোথায় কে ধরে নিয়ে গেলো গো? দয়া করে বলুন হুজুরেরা, আমার ভাইটা কোথায় আছে গো!” 

এভাবে চেঁচাতে চেঁচাতে ন্যানসি কোর্টে গিয়ে দারোগাবাবুর কাছে আছড়ে পড়লো। দারোগাবাবু বললেন যে, অলিভারকে যে-ভদ্রলোক নিয়ে গেছেন, তিনি তাঁর সঠিক ঠিকানা জানেন না, তবে তিনি বোধহয় পেন্টন্‌ভিলে থাকেন, কেননা সেদিকেই তিনি গাড়ি হাঁকাতে হুকুম দিয়েছিলেন কোচোয়ানকে। 

ন্যানসি ফিরে এসে ফ্যাগিকে সেই খবরটা জানালো। ফ্যাগিন্ অলিভারের খোঁজ করার জন্যে কড়া হুকুম দিল সাগরেদদের। যেমন করে হোক, জীবন্ত বা মৃত, অলিভারকে নিয়ে আসা চাই-ই! 

পুলিশের কাছে কতটা কি ফাঁস করে দিয়েছে অলিভার তার আস্তানার বিষয়ে, তা জানা না পর্যন্ত ফ্যাগিন্ বা তার দলের কেউই নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত পুলিশের ভয়ে পুরোনো আস্তানা ছেড়ে ফ্যাগিন্ কিছুদিনের মতো গা ঢাকা দিলো অন্য জায়গায়। সঙ্গে নিয়ে গেল তার লুকোনো বাক্সটা, যার মধ্যে দামী দামী চোরাই মাল রেখে দিয়েছে সে সাগরেদদের নজর এড়িয়ে। 

***

বেশ কয়েকদিন পরের কথা। 

লিট্ল স্যাফ্রন্-হিলের সবচেয়ে নোংরা অঞ্চলের একটা শুঁড়িখানার বাইরের ঘরে বসে ছিল বিল সাইক্‌স্। চিন্তায় ডুবে আছে সে। তার পায়ের কাছে বসে একটা সাদা-লোমওলা কুকুর জিভ দিয়ে নিজের মুখের ঘা চাটছিলো, আর মাঝে মাঝে মনিবের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে তার মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করছিলো। 

হঠাৎ সাইক্‌স্ কুকুরটাকে ধমক দিয়ে গর্জে উঠলো : “চুপ রও, হারামজাদা, চুপ!” কুকুরটার পিটপিটে চাউনির ফলে হয়তো তার গভীর চিন্তায় বাধা পড়ছিলো। 

বারবার সাইকসের লাথি খেয়ে কুকুরটা এধার-ওধার ছুটোছুটি করতে করতে একসময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এমন সময় ঘরে ঢুকলো ফ্যাগিন্। 

তাকে দেখে সাইক্‌স্ রেগে বলে উঠলো : “আরে বেটা হা-ভাতে চোর! তুই আবার আমার কুকুরের ব্যাপারে নাক গলাতে এলি কেন?” 

মুখ কাঁচুমাচু করে ফ্যাগিন্ বললো : “বিল্, তোমার হয়েছে কি বলো তো? মেয়েটাকে কি বাগে আনতে পারোনি এখনো?” 

ফ্যাগিনের মুখে মেয়েটা অর্থাৎ ন্যানসির নাম শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলো সাইক্‌স্। লাফিয়ে উঠে ফ্যাগিনের ঘাড় ধরে বললো : “ফের ওর নাম মুখে এনেছিস তো খুনখারাপি হয়ে যাবে শয়তান!” 

ফ্যাগিন্ ভেবে পায় না সাইকসের মনের কথা। তার দলের মধ্যে সাইক্‌স্ হচ্ছে সবচেয়ে সেরা চৌখশ মাথা, কিন্তু বড়োই একরোখা সে। যা বলবে, তা সে করবেই, আর যেটা না করতে চাইবে, সেটা তাকে দিয়ে কিছুতেই করানো যাবে না। এ হেন দুর্দান্ত লোককে দিয়ে কত কি বেপরোয়া চুরি-ডাকাতির কাজ করিয়েছে ফ্যাগিন্ তার ঠিক-ঠিকানা নেই। মানুষ খুন করা তো অতি মামুলি ধরনের কাজ বলে সে মনে করে। তাই কথায় কথায় ছুরি-পিস্তল চালাতে সে ওস্তাদ। দলের সেরা মেয়ে ন্যানসিকে সাইকসের হাতেই তুলে দিয়েছে ফ্যাগিন্ কাজের পুরস্কার হিসেবে। ফ্যাগিন্ ভেবেছিল এতে সাইকসের মেজাজ খুশি হবে। কিন্তু সাইক্‌স্ বদলালো না একটুও। 

সাইকসের শাসানি শুনে ফ্যাগিন্ সরে পড়বার তাল করছে, এমন সময়ে বাইরে হৈ-হট্টগোল শোনা গেল। সাইক্‌স্ বললো : “বলি, ব্যাপার কি ফ্যাগিন্! বাইরে চেঁচামেচিটা কিসের?” 

ফ্যাগিও বুঝতে পারে না ব্যাপারটা। এমন সময়ে বার্নি নামে এক ছোকরা ইহুদী ঘরে ঢুকলো। ফ্যাগিন্ তাকে জিজ্ঞাসা করলো : “এখানে আর কেউ আছে নাকি?” 

বার্নি নাকি-সুরে বললেন : “কৈঁ, নাঁ-তোঁ।” 

সাইক্‌স্ বললে : “বাইরে এতো গোলমাল কিসের? যা তো এখনি দেখে আয় ব্যাপারটা কি?” 

.

ঠিক এই সময় ওই পথ দিয়ে অলিভার যাচ্ছিলো মিঃ ব্রাউন্‌লোর বইগুলো দোকানদারকে ফেরত দিতে। সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে, সে ফ্যাগিনের আস্তানার এত কাছ দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা মেয়ে—“ভাইটা আমার” বলে গলা-ফাটানো কান্নার সুরে চেঁচাতে চেঁচাতে এসে, সোহাগ করে অলিভারের গলা জড়িয়ে ধরলো। 

চমকে উঠে অলিভার বললো : “এই, ছাড়ো, ছাড়ো—আমাকে ছেড়ে দাও।” কিন্তু কে কার কথা শোনে? মেয়েটার এক হাতে একটা ঝুড়ি, আর অপর হাতে একটা বড়ো চাবি। সে আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো : “আমার ভাই! ওরে আমার ভাই রে! ভগবান তোকে মিলিয়ে দিয়েছে রে অলিভার! কত যে ভুগেছি তোর জন্যে! কত যে খুঁজেছি তোকে! চল্ চল্ ভাই—বাড়ি চল্।” 

চেঁচামেচি শুনে রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে গেল। সবাই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো : “কি ব্যাপার?” 

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বললো : “এ হচ্ছে আমার ভাই অলিভার— মাসখানেক আগে ও বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে চোর-বদমাশের দলে মিশেছে। অনেক কষ্টে ওকে খুঁজে পেয়েছি।” 

এই বলে আবার অলিভারের হাত ধরে টানাটানি করে মেয়েটা বললো : “ওরে অলিভার, এখনি বাড়ি চল্। মা যে তোর জন্যে ছটফট করে মরতে বসেছে।” 

মেয়েটার কান্না দেখে আর কথা শুনে রাস্তার লোকেরা অলিভারের ওপরেই চটে গেল। একজন এগিয়ে এসে বললো : “এই জানোয়ার, বাড়ি ফিরে যা!” কেউ-বা বললো : “হতভাগা।” 

অলিভার তাদের বললো : “আমি একে চিনি না। আমার কোনো বোন বা বাপ-মা নেই। আমি পেন্টন্‌ভিলে থাকি।” 

মেয়েটা কান্না-ভরা গলায় বললো : “শুনুন মশাইরা, কেমন বেপরোয়াভাবে মিথ্যে কথা বলছে শুনুন।” 

এতক্ষণ পরে অলিভার মেয়েটার মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে চমকে উঠে বললো : “আরে, এ যে–ন্যানসি!”  

ন্যানসি সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠলো : “দেখলেন তো আপনারা, এ আমাকে বেশ চেনে। এখন দয়া করে আপনারা একে ধরে বাড়িতে দিয়ে যান, নইলে বাবা আর মা এর শোকে মারা যাবেন।” 

এই সময়ে পাশের একটা শুঁড়িখানা থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো বিল্‌ সাইক্‌স্‌ আর তার পেছনে সেই সাদা কুকুর। সে এসেই বললো : “এই অলিভার, শীগগির বাড়ি চল্ তোর মায়ের কাছে।” 

অলিভার আপত্তি করতেই সাইক্‌স্ তার হাত থেকে বইয়ের বান্ডিলটা কেড়ে নিয়ে, তাই দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড এক ঘা বসিয়ে দিলো। দুর্বল অলিভার সেই মার খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লো। আর সেই মুহূর্তে ন্যানসি ও সাইক্‌স্‌ তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল এক নোংরা গলিতে ভাঙাচোরা একখানা বাড়ির মধ্যে। ঢুকেই সদর দরজায় খিল এঁটে দিলো ন্যানসি ও সাইক্‌স্। কুয়াশায় ঢাকা আঁধার রাত তখন নেমে এসেছে শহরের বুকে। 

অলিভারকে দেখে ধুরন্ধর মুখ ভেঙচে ব্যঙ্গ করে বললো : “আরে আরে, এই যে—এই যে বাছাধন! ও ফ্যাগিন্! এ-দিকে চেয়ে দেখ—চেয়ে দেখ!” 

চার্লি বেটস্ হো হো করে হাসতে-হাসতে বললো : “ওরে, তোরা আমায় ধর্ ধর্, আমি একটু হাসি!” 

ধুরন্ধর অলিভারের পকেটগুলো হাতড়াতে লাগলো। চার্লি তার সামনে একটা বাতি ধরে বললো : “দেখ, দেখ, কি দামী পোশাক পরেছে! সঙ্গে আবার বই! একেবারে বাবু বনে গেছে দেখছি!” 

ফ্যাগিন্ কপট বিনয়ের সঙ্গে অলিভারকে বারকয়েক সেলাম করে বললো : “তোমার উন্নতি দেখে ভারি খুশি হয়েছি, বাবাজী! তোমার এ পোশাকী জামা- কাপড় যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্যে ধুরন্ধর তোমাকে আরেক সেট জামা-কাপড় দেবে’খন। তা, তুমি চিঠি লিখে আগে আমায় জানালে না কেন যে, তুমি আজ ফিরে আসছো? তাহলে তো তোমার খাবারটা গরম করে রাখা যেতো।” 

এই সময়ে ধুরন্ধর অলিভারের পকেট থেকে পাঁচ পাউন্ডের নোটখানা বের করতেই ফ্যাগিন্ সেখানা ছিনিয়ে নিলো। তাই দেখে সাইক্‌স্‌ এগিয়ে এসে বললো : “এ টাকা আমার ফ্যাগিন্।” 

ফ্যাগিন্ বললো : “না—না, বিল, এ টাকা আমার…বইগুলো তুমি বরং নাও।” 

কিন্তু সাইক্‌স্ তাতে রাজী হলো না। সে স্পষ্টই বললো : “টাকা আমাকে না দিলে অলিভারকে ফেরত নিয়ে যাবো।” কথা বলতে-বলতে ফ্যাগিনের হাত থেকে নোটখানা সে ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো। 

অলিভার মিনতি করে বললো : “ও-টাকা আর ও-বইগুলো আমার নয়, ওগুলো সব আমার আশ্রয়দাতার। আমি যখন জ্বরে মরতে বসেছিলাম, তখন তিনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমাকে এখানে রাখতে চাও রাখো, কিন্তু দোহাই তোমাদের, ও-টাকা আর ও-বইগুলো তাঁকে পাঠিয়ে দাও। নইলে তিনি আমাকে চোর ভাববেন।” 

এই বলে অলিভার উঠে দাঁড়িয়েই পাগলের মতো ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাগিন্ আর তার সাগরেদরা অলিভারকে ধরার জন্যে ছুটে পিছু ধাওয়া করলো। 

এ অবস্থায় সাইক্‌স্ কি করবে তা ভেবে পেলো না। হঠাৎ কুকুরটার দিকে তার নজর পড়লো। কুকুরটা তখন বাইরে বেরুবার জন্যে ছটফট করছে। মনিবের হুকুম পেলেই ছুটে বেরিয়ে গিয়ে অলিভারের টুটি চেপে ধরবে, এমনি একটা ভাব তার। 

কুকুরটার হাবভাব দেখে চকিতে সাইকসের মাথায় মতলবটা এলো। সে তখনি কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে অলিভারের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে ঠিক করলো। সাইকসের ভাবগতিক বুঝতে পেরে ন্যানসি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো : “কুকুরটাকে আকে রাখো বিল, নইলে ছেলেটাকে টুকরো- টুকরো করে ফেলবে।” 

সাইক্‌স্ বললো : “সেটাই ওর উচিত সাজা হবে। সরে যাও আমার পথ থেকে, নইলে দেয়ালে ঠুকে তোমার মাথা গুঁড়ো করে দেব।” 

—“তা দেবে দাও, বিল্, কিন্তু আমাকে না মেরে ফেলে তুমি কুকুরটাকে ছেড়ে দিতে পারবে না।” 

সাইক্‌স্ ধাক্কা দিয়ে ন্যানসিকে ঘরের মেঝেয় ফেলে দিলো। 

এমন সময় অলিভারকে পাকড়াও করে তার কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ফ্যাগিনের দল ফিরে এলো। 

অলিভারকে ঘরে নিয়ে এসে ফ্যাগিন তার ঘাড়ে কয়েকটা রদ্দা দিয়ে পাছায় লাথি মেরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। তারপর সে ঘরের কোণ থেকে একটা ভারী লাঠি নিয়ে তেড়ে গেল অলিভারকে মারতে। ন্যানসির কাছ থেকে বাধা পেলো ফ্যাগিন্। 

ন্যানসি স্পষ্টই বললো ফ্যাগিকে : “আমি অলিভারকে ধরে তোমাদের কাছে এনে দিয়েছি, কিন্তু তা বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে তার ওপর তোমাদের জুলুম দেখতে পারবো না বলে রাখছি।” 

ফ্যাগিন্ বলে উঠলো : “বাঃ বাঃ ন্যানসি! বেশ অভিনয় তুমি করতে পারো।” 

ন্যানসি বললো : “তোমার যা ইচ্ছা তা করতে পারো! মনে রেখো, বাচ্চা ছেলেটার ওপর বেশি জুলুম করলে তোমার শেষ পর্যন্ত ভালো হবে না কিন্তু!” সাইক্‌স্ এতক্ষণ চুপচাপ ছিলো, কিন্তু ন্যানসির কথার ধরন দেখে চোখ রাঙিয়ে বললো : “এসব কথার মানে কি ন্যানসি?” 

ন্যানসি জবাব দেয় ঝাঁঝালো গলায় : “ছেলেটাকে নিয়ে যা-ইচ্ছে তাই সকলে মিলে করবে তা সইবো না আমি কিছুতেই। ওর ওপর মারধোর করতে দেবো না আমি।” 

একথা শুনেই সাইকসের মাথা গরম হয়ে উঠলো। সে চেঁচিয়ে বললো : “চুপ কর, ন্যান্‌স, নইলে তোর মুখ ভোঁতা করে দেবো।” 

সাইকসের শাসানিতে ন্যানসি ভয় পেলো না একটুও। সে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলো : “ওঃ! মুরোদ তো তোমার কতো তা জানতে আর বাকি নেই আমার। অপদার্থ কুত্তা কোথাকার।” 

সাইকসের রাগ চড়ে উঠলো সপ্তমে। ঘুষি বাগিয়ে ন্যানসির দিকে তেড়ে গিয়ে সে বললো : “মুখ সামলে কথা ক ন্যানসি, নইলে আজ তোর শেষ দিন জেনে রাখিস্!” 

ন্যানসি নিজের মাথাটা এগিয়ে দিয়ে চেঁচাতে লাগলো : “মারো আমাকে, খুন করো আমাকে। তোরা সব দাঁড়িয়ে দেখ শয়তানের দল।” 

সাইক্‌স্ ভেবে পেলো না সে কি করবে এবার বিদ্রোহী ন্যানসিকে নিয়ে ফ্যাগিন্ এসে ওদের ঝগড়া থামিয়ে দেবার চেষ্টা করলো। সে বার বার বললো : “ভদ্রভাবে কথা কও তোমরা—ভদ্রভাবে কথা কও!” 

ন্যানসি এবার আরো রেগে গেল। সে ফ্যাগিনের দিকে তেড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো : “ভদ্রভাবে! শয়তান কোথাকার! ভদ্র কথা শেখাচ্ছো এখন আমাকে? বাচ্চা বয়সে আমাকে চুরি করে এই জঘন্য আস্তাকুঁড়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলি কেন? উঃ মরণ না হওয়া পর্যন্ত এখানে আমাকে থাকতে হবে তোমার মতো শয়তানের জন্যে!”

বাধা দিয়ে ফ্যাগিও চেঁচিয়ে ন্যানসিকে বললো : “আর যদি এ ধরনের কথা বলো তো আরও জঘন্য ক্ষতি করবো তোমার।” 

ন্যানসি এবার রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে-ছিঁড়তে ফ্যাগিনের দিকে তেড়ে গিয়ে দু’চার ঘা বসিয়ে দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সাইক্‌স্ তার কবজি ধরে এমন একটা মোচড় দিলো যে ন্যানসি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। 

এভাবে সেদিনের ঝগড়াটা মিটে গেল। 

অলিভারের জীবনে নেমে এলো আবার অন্ধকার। 

***

পরদিন দুপুর-নাগাদ অন্য সবাই বেরিয়ে গেলে, ফ্যাগিন্ অলিভারকে ভালো কথায় বোঝাতে লাগলো যে বেইমানীর মতো পাপ আর নেই, তাই অলিভার যদি আবার আগের মতো দলের কাজ-কর্ম ঠিকমতো করে, তাহলে ফ্যাগিন্ আর তার সাগরেদরা সবাই তাকে বন্ধুর মতো ভালোবাসবে। আর যদি অলিভার এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করে কিংবা গোলমাল শুরু করে, তাহলে সে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে পাতকোর ভেতর ফেলে দেবে। এ-রকম অনেক ছেলেকেই সে এর আগে খুন করেছে, একথা যেন অলিভার মনে রাখে। এভাবে অলিভারকে শাসিয়ে ঘরে তালাচাবি দিয়ে ফ্যাগিন্ বেরিয়ে গেল। 

প্রথম হপ্তাটা অলিভারকে একটা ঘরে আটকে রেখে তালা বন্ধ করে দেওয়া হলো। তারপর একদিন আর সে-ঘরে তালা দেওয়া হলো না। অলিভার তার ইচ্ছামতো বাড়ির ভেতর ঘুরে ফিরে বেড়াবার অধিকার ফিরে পেলো। ঘরের বাইরে বেরিয়ে চারদিকে ঘুরে সে দেখলো, বাড়িখানা অত্যন্ত পুরোনো, এবং জানলা-দরজা সব সময়েই বন্ধ থাকে। 

এই বাড়িতেই অলিভার দেখতে পেলো, সদ্য জেল-ফেরত আঠারো বছরের ছোকরা চিটলিংকে। চিটলিং আসার পর থেকেই সে অলিভারকে দিন-রাত বেপরোয়া চুরি-ডাকাতির গল্প শোনাতে লাগলো। 

***

কয়েকদিন পর ফ্যাগিন্ বিল সাইকসের আস্তানায় গিয়ে হাজির হলো একটা বিশেষ জরুরি কাজে। অলিভারের ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হওয়ার ফলে ন্যানসি আগের মতো আর তাকে খাতির-যত্ন করলো না। অন্য সময় হলে ন্যানসির এ বেয়াদপির জন্যে ফ্যাগিন্ তাকে বিলক্ষণ ধমকাতো, কিন্তু আজ তার মনের অবস্থা অন্যরকম। যে করেই হোক, এক বস্তা মোহরের জন্যে তাকে কাজটা হাতে নিতেই হবে, আর সে কাজটা ভালোভাবে করতে গেলে যে ন্যানসির সাহায্য দরকার সে বিষয়ে ফ্যাগিনের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 

ফ্যাগিন্ বললো : “টবি বলছিল একটা ছোটো ছেলে পেলে নাকি কাজটা সারতে পারো তুমি? কথাটা কি সত্যি?” 

সাইকস্‌ জবাব দিলো : “কাজটা হাতে নেওয়া ঠিক হবে না। টবি আর আমি দু’জনেই কাল বাড়িটাকে মোটামুটি দেখে এসেছি। সদর দরজা বেশ মজবুত, আর দেওয়াল খুব পাকা, তাই কোনো দিক্‌ দিয়েই সুবিধে করা যাবে না।” 

ফ্যাগিন্ বললো : “কাজটা কিন্তু তোমাকে করতেই হবে বিল্! এতে মোটামুটি লাভ হবার আশা আছে!” 

সাইক্‌স্ বললো : “চেষ্টার ত্রুটি তো হয়নি। টবিকে নিয়ে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নিয়েছি কাজটা করার জন্যে। বাড়ির চাকরবাকররা কুড়ি বছর ধরে ও-বাড়িতে কাজ করছে—তাদের কাউকে দলে ভেড়ানো যাবে না লোভ দেখিয়ে। শুধু একটা উপায় ঠাওরেছি। সেটা করতে হলে একটা ছোটো ছেলের দরকার হবে।” 

ফ্যাগিন্ বললো : “আজকাল ছোটো ছেলের বড়োই অভাব। যে কটাকে আমার দলে ভিড়িয়েছিলাম, সবাই তো পুলিশের খপ্পরে পড়ে তাদের পেশা পালটেছে—তারা নাকি এখন লেখাপড়া শিখছে সরকারের অতিথিশালায়।” 

সাইক্‌স্ বললো : “তাহলে উপায়?” 

দুজনকেই বেশ চিন্তিত দেখা গেল। 

ন্যানসি এতক্ষণ কান খাড়া করে দুজনের কথা শুনছিল। সে হঠাৎ এগিয়ে এসে ফ্যাগিকে বলল : “অলিভারের কথাটা বলেই ফেলো ফ্যাগিন্। আমাকে সমীহ করার দরকার নেই।” 

একথা শুনে ফ্যাগিন্ হেসে ফেলে বললো : “দেখলে হে বিল্ আমাদের সমস্যাটা কতো সহজে সমাধান করে দিলো ন্যানসি। একেই বলে—স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম্’। তাহলে কালই অলিভারকে পাঠিয়ে দেব তোমার এখানে।” 

সাইক্‌স্ খানিকটা ভেবে বললো : “সবচেয়ে ভালো হয় যদি ন্যানসি তোমার ওখানে গিয়ে অলিভারকে নিয়ে আসে। তাহলে হয়তো ছেলেটাকে বাগে আনতে সুবিধে হবে।” 

সাইকসের একথা যুক্তিসংগত বলে মনে হলো ফ্যাগিনের। ঠিক হলো আগামীকাল রাতে ন্যানসি ফ্যাগিনের আস্তানায় ফিরে অলিভারকে নিয়ে আসবে। বিদায় নিয়ে ফ্যাগিন্ চলে গেল ঘুরপথে আর একটা গোপন আস্তানায়, যেখান থেকে এক বস্তা মোহরের বদলে একটা কাজের বরাত পেয়েছে সে। 

***

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে অলিভার সবিস্ময়ে দেখলো যে, তার পুরোনো জুতোজোড়া নেই, তার বদলে আছে পুরু সোওয়ালা একজোড়া নতুন জুতো। 

সেদিন অলিভারের সাথে সকালের জলখাবার খেতে বসে ফ্যাগিন্ বললো : “অলিভার, আজ রাতে তোমাকে সাইকসের আস্তানায় যেতে হবে। ন্যানসি তোমাকে নিতে আসবে।” 

অলিভার প্রশ্ন করলো : “সেখানেই কি আমি বরাবর থাকবো?” 

ফ্যাগিন্ জবাব দেয় : “আরে না-না। একটা কাজের জন্যে তোমাকে সাইকসের দরকার। কাজটা হয়ে গেলে আমার এখানে আবার তুমি ফিরে আসবে।” 

অলিভার শঙ্কিত হয়ে উঠলো, কিন্তু তার এতে করারই বা কি আছে। অলিভার নিজের মনকে তৈরি করে নিলো সারাদিন ধরে। 

সন্ধ্যার পরে ফ্যাগিন্ বাইরে বেরুবার আগে অলিভারকে সতর্ক করে দিয়ে বললো : “সাবধান অলিভার, খুব সাবধান। সাইকসের রক্ত গরম হয়ে উঠলে খুন করা ছাড়া ও আর কিছুই ভাবতে পারে না। যাই বলুক না কেন, মুখ বুজে ওর সব কথা শুনে যেও।” 

ফ্যাগিন্ চলে যাবার পর অলিভার গালে হাত দিয়ে ভাবছে এমন সময়ে তাকে সাইকসের কাছে নিয়ে যাবার জন্যে ন্যানসি এসে হাজির হলো। এ ক’দিনেই তার চেহারা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। সে অলিভারকে আশ্বাস দিলো যে, যেমন করেই হোক সে তাকে শয়তানদের হাত থেকে বাঁচাবে। সে আরও জানালো যে, অলিভারের হয়ে সে কথা বলেছিলো বলে তাকে খুব মার খেতে হয়েছে সেদিন। তারপর তার হাতে আর ঘাড়ে মারের চিহ্ন দেখালো। 

সাইক্‌সের কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সাইক্‌স্ কোনো কথা না বলে একটা রিভলবার বের করলো। অলিভারের সামনে সেটাকে ধরে সে শান্তকণ্ঠে বললো : “যদি কথা না শুনিস তো এক গুলিতে মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো।” 

অলিভার ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। 

এর পরেই রাতের খাবার খেয়ে সাইক্‌স্ শুয়ে পড়লো। শোবার আগে সে ন্যানসিকে হুকুম করলো, ঠিক ভোর পাঁচটায় তাকে জাগিয়ে দিতে। অলিভার তার নির্দেশমতো ঘরের মেঝেয় শুয়ে অনেকক্ষণ জেগে রইলো। সে আশা করেছিলো, ন্যানসি হয়তো সুযোগমতো তাকে কোনো উপদেশ দেবে। কিন্তু ন্যানসি তখনও আগুনের কাছে বসে বসে অনেক কিছু ভাবছে। সাইকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেবার জন্যে সে বোধহয় সারা রাতই জেগে থাকবে। 

ভোর পাঁচটার আগেই সাইক্‌স্ উঠে পড়লো। চোখ-মুখ তাড়াতাড়ি ধুয়ে অলিভারের সামনে একটা বড় আলখাল্লা এনে বললো : “এটা গায়ের ওপর জড়িয়ে নে!” তারপর রিভলবারটা পকেটে পুরে অলিভারের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো সে। কোথায় যাচ্ছে, কি করতে হবে অলিভার কিছুই বুঝতে পারে না। ভয়ে কোনো কথাও বলতে পারে না সে। যেতে যেতে পেছন ফিরে চায়, যদি ন্যানসির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। কিন্তু দেখলো, ন্যানসি তখনও আগুনের দিকে এক নজরে চেয়ে একমনে যেন কি ভাবছে…আর কোনো দিকেই হুঁশ নেই। 

সাইক্‌স্ অলিভারকে টানতে-টানতে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লো। 

***

বাদল-দিনের ঘোলাটে সকাল। গত রাতের বৃষ্টির জল জমে রয়েছে রাস্তায়। এখনও জোর বৃষ্টি হচ্ছে—সোঁ সোঁ করে বাতাস বইছে। আজ আবার হাটবার। ক্রমে ক্রমে রাস্তায় নানা ধরনের লোকের ভিড় বাড়ছে। 

অলিভারকে কেবল গালাগাল আর তাড়া দিতে দিতে সাইক্‌স্ হাইডপার্ক পেরিয়ে কেনসিংটনের পথ ধরলো। তারপর একখানা চলন্ত গাড়ির মালিককে রাজী করিয়ে অলিভারকে নিয়ে তাতে চেপে বসলো। কিছুক্ষণ পরে নামলো এসে ‘গাড়িঘোড়া’ নামে এক সরাইখানার সামনে। তারপর অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে পৌঁছালো হ্যাম্পটন শহরে। সেখানে থেকে কিছু দূরে শহরের বাইরে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আবার শহরে ফিরে এসে এক সরাইখানায় গিয়ে রাতের খাবারের আয়োজন করতে হুকুম করলো। 

খাওয়া-দাওয়ার পর সাইক্‌স্ হ্যালিফোর্ডগামী এক শ্রমিকের গাড়িতে চেপে শোপারটাউনে এসে নামলো অলিভারকে নিয়ে। তারপর জলকাদা ভেঙে, অন্ধকার গলিঘুঁজি আর চষা-ক্ষেতের ওপর দিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে থামলো একখানা পোড়ো বাড়ির সামনে। অন্ধকার নির্জন বাড়ি। মনে হয় প্রাণের কোনো সাড়া নেই তার ভেতর-আশেপাশেও আর কোনো বাড়ি নেই। অলিভারের হাত ধরে সাইক্‌স্ ভেজানো দরজা ঠেলে সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। 

বাড়িতে কিন্তু মানুষ ছিলো। এই বাড়িতে সাইক্‌সকে সাদরে অভ্যর্থনা করলো টোবি ক্র্যাকিট্ আর বার্নি। সাইক্‌স্ তাদের কাছে অলিভারের পরিচয় দিলো। 

কিছুক্ষণ পরে খেতে বসলো তারা। মদের গেলাস মুখের কাছে তুলে তিনজনে বলে উঠলো : “আজকের অভিযান সফল হোক।” বলেই তারা গেলাসের পর গেলাস ভরে মদ খেতে লাগলো। অলিভারের আপত্তি সত্ত্বেও তারা তাকে জোর করে খানিকটা মদ খাইয়ে দিলো। খাওয়ার পরে সবাই শুয়ে পড়লো। 

মদের নেশায় অলিভারের সারা দেহ ভারী হয়ে এলো। সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছিলো, সে যেন তার ছেলেবেলার জীবনে ফিরে গেছে। হঠাৎ সে চমকে উঠলো টোবির গলা শুনে। টোবি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে ঘোষণা করল : “দেড়টা বাজে।” 

মুহূর্তমধ্যে অপর দুজনও উঠে দাঁড়ালো। সাইক্‌স্ আর টোবি দুখানা শালে নিজেদের মুখ আর গলা ঢেকে নিলো, তারপর বার্নির কাছ থেকে কয়েকটা যন্ত্রপাতি নিয়ে পকেটে পুরলো। বার্নি তাদের দু’জনকে দুটো পিস্তল দিলো আর একটা লম্বা আলখাল্লা পরিয়ে দিলো অলিভারকে। 

তারপর অলিভারের হাত দু’টো ধরে সেই কুয়াশায় ঢাকা রাতে বেরিয়ে পড়লো তারা। 

সাইক্‌স্ ফিস্‌ফিস্ করে বললো : “আজ রাতে সারা শহর ছুঁড়লেও আমরা কারও চোখে পড়বো না।” 

রাত দুটো নাগাদ তারা শহর পেরিয়ে, পাঁচিল-ঘেরা একটা বাড়ির সামনে এসে থামলো। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়ির ভেতরেও সব চুপচাপ। চোখের নিমেষে টোবি ক্র্যাকিট্ পাঁচিলের ওপরে উঠে পড়লো। তারপর অলিভারকে নিয়ে সাইও উঠলো এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা পাঁচিলের অপরদিকে বাগানের মধ্যে নেমে পড়লো। 

অলিভার ভয়ে মাটির ওপর বসে পড়লো। সাইক্‌স্ রেগে বলে উঠলো : “শীগির ওঠ, শুয়োর! নইলে তোর মাথা গুঁড়িয়ে এই ঘাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেবো।” 

অলিভার কাঁপতে কাঁপতে বললো : “তোমাদের পায়ে পড়ি, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও।” 

সাইক্‌স্ পিস্তল বের করে অলিভারকে গুলি করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু টোবি সেটা ছিনিয়ে নিলো, আর অলিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে বাড়ির দিকে এগুতে- এগুতে বললো : “আর একটা আওয়াজ করেছিস কি, একটা বাড়ি দিয়ে তোর মাথা একেবারে গুঁড়ো করে দেবো। বিল্ তুমি গিয়ে জানালাটা খুলে ফেল, আমি এটাকে সামলাচ্ছি। এসব ছেলেকে ঠাণ্ডা করার কায়দা আমার দস্তুরমতো জানা আছে।” 

অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যাজিকের মতো সাইক্‌স্ বাড়ির পেছন দিকের একটা ছোটো জানালা খুলে ফেললো। সে-জানালা দিয়ে অলিভারের মতো ছোটো ছেলে সহজেই গলে যেতে পারে। তারপর অলিভারের হাত একটা লণ্ঠন দিয়ে কানে কানে বলে দিল : “বাড়ির ভেতর ঢুকে তুই চুপি চুপি দরজার খিলটা খুলে দে।” 

জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর লাফিয়ে পড়েই অলিভারের ইচ্ছে হলো, সে চেঁচিয়ে বাড়ির লোকজনদের জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু হঠাৎ কানে এলো, জানালার ওপার থেকে সাইক্‌স্ চাপা গলায় বলছে : “ফিরে আয় হারামজাদা! ফিরে আয় জানালায়।” 

ভয়ে অলিভারের হাত থেকে লণ্ঠনটা খসে পড়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির মাথায় দু’টো মূর্তির আবির্ভাব হলো আর আলোর একটা ঝল্কানির সঙ্গে কিছু ধোঁয়া দেখা গেল। গুলির আঘাত সইতে না পেরে অলিভার মুখ থুবড়ে পড়ে গেল জানালার কাছে। সাইক্‌স্ তখন সেই লোক দু’টোকে তাক্ করে রিভালবার ছুঁড়তেই লোক দু’টো ভয়ে পালিয়ে গেল। সাইক্‌স্ আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে, জামার কলার ধরে অলিভারকে টেনে জানালার বাইরে নিয়ে এলো। 

সঙ্গে সঙ্গে অলিভারকে কাঁধে তুলে নিয়ে সাইক্‌স্ ছুটতে লাগলো। অলিভারের পায়ে একটা গুলি এসে লেগেছিলো, সেজন্য প্রচুর রক্ত ঝরতে লাগলো। অলিভারকে কাঁধে নিয়ে ছুটতে অসুবিধে হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সাইক্‌স্ আধা-বেহুঁশ অলিভারকে একটা নরদমার ভেতর ফেলে রেখে পালালো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *