অলিভার টুইস্ট – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ

একশো বছর আগের ইংলন্ড। এক নিশুতি রাতে লন্ডন শহরের প্রায় সত্তর মাইল দূরে জনমানবহীন সড়কের ওপর দিয়ে চলেছে এক তরুণী। সঙ্গীসাথী তার কেউ নেই। যাবে সে কাছাকাছি কোনো একটা বড়ো শহরে। অনেক দূর থেকে আসছে সে শরীরে একটা ভারী বোঝা নিয়ে। 

ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। তাই পথের নিশানা মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলছে সে। তবুও তার পথ চলার বিরাম নেই। দেহ তার ক্রমেই অবশ হয়ে পড়ছে। জুতো কেটে পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে হাঁটতে আর পারে না সে, কিন্তু তবু তাকে এগিয়ে যেতেই হবে—বেহুঁশ হয়ে পড়ার আগে তাকে শহরে পৌঁছোতেই হবে। তাই কোনোরকমে সে. দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যায় শহরের দিকে বাঁচার তাগিদে। 

কুয়াশার আবরণ ভেদ করে একটা চলমান লণ্ঠনের ফিকে আলো নজরে পড়ে তরুণীর। এবারে সে পা চালায় তাড়াতাড়ি। মনে তার আশার আলো জেগে উঠেছে। নিজের কথা সে আর ভাবে না। এখন সে বাঁচাতে চায় তার ভাবী সন্তানকে মানুষের সাহায্য নিয়ে। 

কিন্তু সে আর হাঁটতে পারে না। ‘উঃ মাগো’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। দেহের অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে সে। মাটি হাতড়ে হাতড়ে কিছুটা পথ এগোবার সে চেষ্টা করে। কিন্তু শেষে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে পথের মাঝে। ধুলো আর রক্তে মাখামাখি হয় তার সারা দেহ। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই লণ্ঠনের আলো এগিয়ে এসে তরুণীর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়লো। চকিতে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লণ্ঠনের মালিক তখনি তরুণীকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে পাড়ি দিলো শহরের দিকে। 

শহরের এক ধারে অন্ধকার এক গলির ভেতর একটা ভাঙা পোড়ো বাড়ি। দরজায় কাঠের ওপর লেখা ‘অনাথ-আশ্রম’। মৃতপ্রায় তরুণীকে নিয়ে আসা হলো সেখানে। আশ্রমের বারান্দায় তাকে ফেলে রেখে লোকটি ছুটে গেলো আশ্রমের ডাক্তারকে ডাকতে। তার হাঁকডাকে আশ্রমের বাসিন্দা অনাথা স্যালী বুড়ি ছুটে এলো। প্রয়োজনের তাগিদে স্যালী বুড়ি কখনো কখনো ধাইয়ের কাজও করে থাকে। 

স্যালী বুড়ির ছোট্ট ঘরেই মূর্ছিতা তরুণীটি শেষে আশ্রয় পেলো। হাতে-পায়ে গরম সেঁক দেবার পরে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এলো তার। স্যালী বুড়ির হেফাজতে তাকে রেখে ডাক্তার চলে গেলেন অন্য ঘরে। 

কিছুক্ষণ বাদেই জন্ম হলো একটি শিশুর। তার মা সেই তরুণীর রক্তহীন পাণ্ডুর ঠোঁট দুখানি নড়ে উঠলো। অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে সে : “আমার কাছে ওকে নিয়ে এসো। মরার আগে আমার সন্তানকে দেখতে দাও একবার।” এই বলে সে অতিকষ্টে বালিশ থেকে ঘাড় তুলে পাশেই তার নবজাত শিশুর কপালের ওপর নিজের মুখটা চেপে ধরেই এলিয়ে পড়লো। ডাক্তার এসে নাড়ী টিপে বললেন : “সব শেষ!” 

মৃতার জন্যে শোক করার কেউ নেই। তাই অবহেলাভরে লাশ ঢেকে দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন। যাবার আগে ডাক্তার একবার জিজ্ঞাসা করলেন স্যালী বুড়িকে : “বেশ দেখতে ছিলো মেয়েটি—কোথা থেকে এসেছিলো?” 

বুড়ি উত্তর দিলো : “রাতেই কুড়িয়ে আনা হয়েছে ওকে। পথে পড়ে ছিলো। জুতোর হাল দেখে মনে হয়, অনেকখানি পথ সে হেঁটে এসেছে, কিন্তু কোথা থেকে সে এসেছিলো, আর যাচ্ছিলোই বা কোথায়, তা জানে না কেউ।” 

ডাক্তার বললেন : “ওঃ! সেই একই পুরোনো জবাব!” 

ডাক্তার চলে যেতেই স্যালী বুড়ি এবার শিশুকে বাঁচাবার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো। অনেকক্ষণ ধরে জীবন-মরণের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে হাঁপাতে লাগলো শিশুটি। তার খোঁজ-খবর নেবার জন্যে কোনো মাসি, পিসি বা খুড়ী- জেঠী সেখানে ছিলো না। এমনকি তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্যে কোনো ভালো ডাক্তারও মাথা ঘামালো না। তবুও এতো অনাদরে অযত্নে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলো সে। তাকে দেখাশুনো করার জন্যে ছিলো কেবল অনাথ-আশ্রমের সেই অনাথা স্যালী বুড়ি আর দায়ে-ঠেকা সেই হাতুড়ে ডাক্তার। 

শত অবহেলাতেও শিশুটি যখন দুনিয়ার আলো-বাতাসকে আঁকড়ে রইলো, মরণের নামটিও করলো না, তখন আশ্রমের কর্মকর্তারা তার একটা নাম রাখতে বাধ্য হলেন। আশ্রমের রেকর্ডে শিশুটির নাম লেখা হলো অলিভার টুইস্ট। বাপ- মায়ের পরিচয় নেই বলেই শিশু অলিভারকে রেখে দেওয়া হলো অনাথ-আশ্রমের একটা অবাঞ্ছিত বোঝা হিসেবে। 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশু অলিভারের গায়ে উঠলো অনাথ-আশ্রমের আাখা। সে হয়ে গেলো তাদেরই একজন—আধপেটা খাওয়া হীন কেনা গোলাম যারা, কিলচড় আর গালমন্দ সয়ে যারা বেঁচে থাকে দুনিয়ায়, যাদের ঘেন্না করে সবাই, কিন্তু দয়া করে না কেউ, অনাথ-আশ্রমের সেই অসহায় শিশুদের একজন। 

দশ মাস পরে শিশু অলিভারকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তিন মাইল দূরে অনাথ-আশ্রমের অন্য এক কর্মকেন্দ্রে। যেসব ছোটো ছোটো ছেলে আইন ভেঙে পুলিশের হাতে ধরা পড়তো, তাদের ওই কর্মকেন্দ্রে আটকে রাখা হতো। সেখানে থাকতো ওইরকম বিশ-তিরিশ জন কিশোর অপরাধী। নিষ্পাপ শিশু অলিভারের সঙ্গী হতো তারা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *