অলিভার টুইস্ট – ১৫

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

যে-রাতে সাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ন্যানসি রোজের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো, সে-রাতে লন্ডনের পথে হেঁটে আসছিলো একটা পুরুষ ও একটা স্ত্রীলোক। 

পুরুষটা রোগাটে, হাত-পাগুলো ল্যাং-ল্যাং করছে, গাঁটগুলো বার-করা। তার কাঁধে একটা লাঠির ডগায় একটা বোঁচকা বাঁধা। তার বয়স ঠাওর করা কঠিন। স্ত্রীলোকটার চেহারা মোটাসোটা…তার পিঠের ভারী বোঝাটা বয়ে নিয়ে যেতে তার কষ্ট হচ্ছে না মোটেই 

লম্বা-লম্বা পা ফেলে অনেকটা এগিয়ে এসেছিলো পুরুষটা। এবারে বোঝার ভারে নুয়ে পড়া স্ত্রীলোকটার উদ্দেশে পেছন ফিরে বললো : “চটপট চলে আয় শার্লটি। তুই দেখছি কুড়ের বেহদ্দ।” 

মেয়েটা বললো : “বোঝাটা বড় ভারী, নোয়া।” 

—“ভারী! কি বলছিস তুই? ভারী বোঝা বইবার জন্যেই তো মেয়েদের জন্ম।…আবার থামল কেন? আচ্ছা, থাম! মিঃ সোয়ারবেরী ধাওয়া করে এসে, হাতকড়া দিয়ে নিয়ে যাবে তোকে।” 

শার্লটি বললো : “কিন্তু শুধু আমাকে কেন বলছো? তোমাকেও তো নিয়ে যাবে।” 

—“তুই হাতবাক্সো থেকে টাকা চুরি করেছিস যে!”

—“আমি চুরি করেছি তো তোমার জন্যে।” 

—“কিন্তু সে টাকা কি আমি নিজের কাছে রেখেছি?” 

না, নোয়া ক্লেপোল্ সে টাকা নিজে রাখেনি—শার্লটির কাছে সে রেখে দিয়েছে। অবশ্য তার কারণ এ নয় যে, সে শার্লটিকে বিশ্বাস করে। আসল কথা হলো, একান্তই যদি ধরা পড়ে, তাহলে সে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করে বলতে পারবে যে, সে টাকা নেয়নি, নিয়েছে শার্লটি। 

খুব সাবধানে সদর-রাস্তা পার হয়ে গলি-ঘুঁজি দিয়ে তারা সেন্ট জন রোডে পড়লো। একটার পর একটা সরাইখানার মধ্যে উঁকি মেরে দেখলো নোয়া, কিন্তু সবগুলোতে ভিড়। কোনোটাই পছন্দ হলো না তার। শেষ পর্যন্ত সে ঢুকলো ‘ত্রিভঙ্গ’ নামে একটা অতি নোংরা সরাইখানায়। 

সরাইখানায় একটা ইহুদী ছোকরা ছাড়া তখন আর কেউ ছিলো না। তার কাছে নোয়া রাত কাটাবার জায়গা চাইতে সে বললো : “কইতে নারলাম থাকতে পারবেন কিনা—খুঁজ নিয়ে দেখচি।” 

 —“আগে আমাদের হাত-মুখ ধোবার জল, কিছু মাংস আর মদ তো দিয়ে যাও।”

ইহুদী ছোকরার নাম বার্নি। নোয়ার হুকুম তামিল করে তাদের খেতে বসিয়ে দিয়ে ওপরে গেল! ওপরে যে-ঘরে যাবে, সেখান থেকে নিচের ঘরের অতিথিদের দেখা যেতো এবং তাদের কথাবার্তা পর্যন্ত শোনা যেতো। বার্নি সে-ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময়ে ফ্যাগিন্ সেখানে এসে হাজির হতেই বার্নি ফ্যাগিকে বললো : “আঁস্তে! লিঁচের ঘরে নতুন মনীষ্যি এঁইচে। পালিয়ে এইচে উঁআরা- তুমার পথের পথিক।” 

একথা শুনে ফ্যাগিন্ ওপরের সেই ঘরে ঢুকে নোয়া ও শার্লটির কথাবার্তা 

শুনতে লাগলো। 

নোয়া ক্লেপোল্ তখন শার্লটিকে বলছিলো : “আমি ভদ্দর নোক হতে চাই।”

শার্লটি বললো : “আমিও তো তাই চাই, কিন্তু রোজ-রোজ তো আর হাত- বাক্সো ভাঙা যাবে না।” 

নোয়া বললো : “চুলোয় যাক হাতবাক্সো! ও ছাড়াও অনেক কিছু আছে ভাঙবার—পকেট, ছেলেমেয়েদের হাতব্যাগ, বাড়ি, ডাকগাড়ি, ব্যাঙ্ক, আরো কত- কি! একটা লুঠেরার দলে মেশাই আমার ইচ্ছে। তারপর তুই একাই তো পঞ্চাশটা মেয়ের সমান—তোর মতো চালাক আর ধড়িবাজ মেয়ে আমি আর কখনও দেখিনি।” 

নোয়ার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠলো শালটি। নোয়া আবার বললো : “তা বলে লাফিয়ে উঠিস নে যেন। আমি চাই একটা লুটেরা দলের সর্দার হতে।” 

এমন সময় ফ্যাগিন্ সে-ঘরে ঢুকে কিছু মদ আনার হুকুম দিয়ে নোয়াকে জিজ্ঞেস করলো : “মশায়ের বুঝি পাড়া-গাঁ থেকে আসা হচ্ছে?” 

উলটে নোয়া জিজ্ঞাসা করলো : “বুঝলেন কি করে?” 

নোয়ার জুতোর দিকে আঙুল দেখিয়ে ফ্যাগিন্ বললো : “এ শহরে তো এত ধুলো নেই, ভায়া?” 

—“আপনার নজর তো খুব। হাঃ-হাঃ-হাঃ। দেখেছিস শার্লটি?” 

ফ্যাগিন্ বললো : “শহরে থাকতে গেলে নজর থাকা চাই বই কি! এখানে পুরুষকে যে সবসময় হাতবাক্সো, মেয়েদের হাতব্যাগ, বাড়ি, ডাকগাড়ি, আর ব্যাঙ্ক লুঠ করতে হয়।” 

একথা শুনেই ভয়ে আঁতকে উঠলো নোয়া। মুখখানা তার ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। 

ফ্যাগিন্ তার কাছে এগিয়ে এসে বললো : “তোমার কপাল ভালো ভায়া যে, কথাটা শুধু আমিই শুনেছি।” 

নোয়া শার্লটিকে দেখিয়ে আমতা-আমতা করে বললো : “আমি কিছু নেইনি—এসব ওর কাজ।” 

ফ্যাগিন্ বললো : “যেই নিয়ে থাক, তাতে ক্ষতি কোনো নেই। ‘ত্রিভঙ্গের’ চেয়ে নিরাপদ জায়গা সারা লন্ডনে আর নেই। আর আমিও তো ও-পথেরই পথিক। এ সরাইখানার লোকেরাও তাই। তুমি ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছো ভায়া। আমার একজন বন্ধু আছে, যে তোমার মনের ইচ্ছে সফল করতে পারে।” 

এ কথার পরে ফ্যাগিনের অনুরোধে শার্লটিকে মালপত্তর ওপরে রেখে আসতে হুকুম করলো নোয়া। শার্লটি চলে গেলে ফ্যাগিন্ জানতে চাইলো, নোয়া তার বন্ধুর দলে যোগ দিতে রাজী আছে কিনা। 

নোয়া জিজ্ঞাসা করলো : “বন্ধুটি কি-দরের ব্যাপারী?” 

ফ্যাগিন্ জানালো যে, সে ব্যবসাদারদের শিরোমণি এবং পাক্কা শহুরে–তার দলে কোনো গেঁয়ো লোক নেই। অবশ্য, তার দলে মিশতে হলে নোয়া মিঃ সোয়ারবেরীর হাতবাক্সো ভেঙে যে কুড়ি পাউন্ডের নোটগুলো চুরি করেছে, তার সব কটাই প্রবেশমূল্য হিসেবে দিতে হবে। ফ্যাগিন্ নোয়াকে বোঝালো যে, এ নোটগুলোর কোনো দাম নেই নোয়ার কাছে, কেননা সে এ নোটগুলো ভাঙাতে পারবে না কিছুতেই। নোটের নম্বরগুলো নিশ্চয়ই মিঃ সোয়ারবেরীর কাছে আছে, তাই সেগুলো ভাঙাতে গেলেই ধরা পড়তে হবে তাকে। 

নোয়া জিজ্ঞাসা করলো : “আচ্ছা! তাহলে মাইনে কত করে পাবো আমি?”

ফ্যাগিন্ বললো : “মাইনে! মাইনে আবার কি? বিনিপয়সায় থাকতে পাবে, খেতে পাবে, তামাক-মদও পাবে, তাছাড়া তুমি আর তোমার বান্ধবী যা রোজগার করবে তারও অর্ধেক পাবে।” 

অন্য সময় হলে অর্থপিশাচ নোয়া এত কমে রাজী হতো না, কিন্তু এখন প্যাঁচে পড়ে আমৃতা-আমতা করে বললো : “কিন্তু আমি হাল্কা কাজ নিতে চাই।” 

ফ্যাগিন্ বললো : “বেশ তো! তুমি তো তোমার বান্ধবীর কাছে গল্প করছিলে যে, গোয়েন্দাগিরি ধরনের কাজ পেলে তোমার ভালো লাগবে। আমার বন্ধুরও একজন গোয়েন্দা দরকার।” 

নোয়া বললো : ‘কিন্তু তাতে তো কিছু আয় হবে না।” 

ফ্যাগিন্ বললো : “তা বটে! আচ্ছা, বুড়িদের হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার কাজটা কেমন লাগে তোমার?” 

—“উঁহু, ওরা যে বড্ড বেশি চেঁচামেচি করে থাকে। ওটা বাদ দিয়ে অন্য কোনো কাজ বাতলাও।” 

—“বেশ, তাহলে ছোকরা-ছিনতাই করো।” 

—“সে আবার কি ধরনের কাজ?” 

—“ছোটো ছেলেরা অনেক সময়ে তাদের মায়েদের কাছ থেকে টাকাটা সিকিটা নিয়ে দোকান-বাজারে যায়। সে সময়ে তাদের হাত থেকে সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে আসা, এই কাজ আর কি! পয়সাকড়ি ছোঁড়ারা হাতে রেখেই পথ চলে ঢিমেটালে, সে সময় স্রেফ একটা ধাক্কা দিয়ে তাদের মাটিতে ফেলে দেওয়া, আর হাতের পয়সাকড়িগুলো ছিনিয়ে নিয়ে সরে পড়া, বুঝলে কিনা—হা-হা-হা-হা-হা।” 

নোয়াও হো-হো করে হেসে উঠলো। সে বললো : “ঠিক-ঠিক, এ কাজটাই ঠিক জুতসই হবে আমার।” 

এমন সময় শার্লটি ফিরে এলো। ঠিক হলো, কাল বেলা দশটার সময়ে ফ্যাগিন্ আসবে তার বন্ধুর সঙ্গে নোয়াকে আলাপ করিয়ে দিতে। ফ্যাগিনের কাছে নোয়া নিজের পরিচয় দিলো মিস্টার বোল্টার নামে, আর শালটিকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিলো। এরপর ফ্যাগিন্ বিদায় নিলো। 

***

এ ক’দিনের মধ্যেই খুব রোগা হয়ে গেছে ন্যানসি। বেশির ভাগ সময়েই সে ঘরে বসে থাকে, আর কি যেন ভাবে—কখনও বা অকারণে হেসে ওঠে। নিজের মনে সে চমকে ওঠে, সে কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে? 

ফ্যাগিনের মনেও সন্দেহ জেগেছে ন্যানসির আচরণে। দলের কোনো কাজেই আজ আর ন্যানসির উৎসাহ নেই, অথচ ফ্যাগিন্ তো ভালো করেই জানে—তার দলের সেরা মেয়ে ছিলো ন্যানসি—আরও মেয়েটার কড়া নজর ছিলো কি করে দলের কাজগুলো আরও ভালোভাবে চালানো যায়। ন্যানসির এসব গুণের জন্যেই তো দলের অতি গোপন খবরও তাকে সে জানাতো—এককথায় ন্যানসিকে সে বিশ্বাস করতো সব ব্যাপারে। তাছাড়া, ন্যানসিকে সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছে সাইস্তার সবচেয়ে বড়ো সাগরেদ! সে-হিসেবে ন্যানসির স্থানও অনেক উঁচুতে তার দলের মধ্যে। 

সেই ন্যানসি আজ একরকম দলছাড়া—সাইকসের নোংরা ঘরের এক কোণে বন্দী বললেই হয়। 

যতোই এসব ভাবে ফ্যাগিন্ ততোই অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে তার মন।

রবিবার রাতে সাইকসের আস্তানায় বসে ফ্যাগিন্ পরামর্শ করছে সাইকসের সাথে, এমন সময় গির্জার ঘড়িতে ঢং-ঢং করে এগারোটা বাজলো। 

সাইক্‌স্ বললো : “কাজকর্মের পক্ষে আজকের রাতটা খুবই চমৎকার।”

ফ্যাগিন্ কোনো জবাব না দিয়ে ন্যানসির দিকে নীরবে ইশারা করলো। সাইক্‌স্ দেখলো ন্যানসি বাইরে যাবার পোশাক পরছে। সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো : “বলি, এত রাতে চললে কোথায়?” 

—“বেশি দূরে দয়।” 

–“যা জিজ্ঞেস করলাম তার জবাব দাও। কোথায় যাচ্ছো?” 

—“জানি নে কোথায় যাচ্ছি।” 

সাইক্‌স্ চাপা-রাগে বললো : “কোথায় যাচ্ছো, তা না বললে তোমাকে যেতে দেওয়া হবে না।” 

আসল ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার জন্যে ন্যানসি বললো : “শরীরটা ভালো নেই, তাই একটু খোলা বাতাসে বেড়িয়ে আসতে চাই।” 

সাইক্‌স্ গম্ভীরভাবে জানালো : “তা যদি হয়, তাহলে জানলা খুলে দিয়ে জানলার সামনে বসো, যথেষ্ট হাওয়া পাবে।” 

ন্যানসি তবু বাইরে যাবার জন্যে জেদ ধরলো। 

সাইক্‌স্ তখন ঘরের দরজায় কুলুপ এঁটে দিয়ে বললো : “যেখানে আছো, সেখানেই বসে থাকো চুপটি করে…হাওয়া খেয়ে আর কাজ নেই তোমার।” 

ঘরের ভেতর থেকে কাঁদকাঁদ গলায় ন্যানসি চেঁচিয়ে উঠলো : “জানো, বিল, তুমি আমার কি ক্ষতি করছো?” 

“কি! কি করছি আমি!”—ফ্যাগিনের দিকে তাকিয়ে সাইক্‌স্ বললো : “ছুঁড়িটা আজ ক্ষেপে গেছে, নইলে আমার সঙ্গে এমন বেয়াড়া ভাবে কথা বলতে সাহস করতো না।” 

একথা শুনে ন্যানসি দু’হাতে নিজের বুক চেপে ধরে আপন মনে বলে উঠলো : “তোমরা দু’জনে আমাকে পাগল না করে ছাড়বে না? দরজা খুলে দাও এখনি, আমাকে যেতে দাও এই মুহূর্তে।” 

সাইক্‌স্ বললো : “না। 

মাটিতে পা ঠুকে ন্যানসি চেঁচিয়ে ফ্যাগিকে বললো : “সাইকে বলো আমাকে ছেড়ে দিতে। এতে ওর ভালো হবে।” 

সাইক্‌স্ ধমক দিয়ে উঠলো : “ফের বেয়াড়াপনা করছো? আর একটুও গলার আওয়াজ শুনি তো কুকুরটা তোমার চুঁটি টিপে একেবারে চুপ করিয়ে দেবে।” 

দরজার সামনে মেঝের উপর বসে পড়ে ন্যানসি আবার অনুনয়ের সুরে বললো : “আমাকে যেতে দাও বিল্। তুমি জানো না, আমার কি ক্ষতি তুমি করছো—মাত্র এক ঘণ্টার জন্যে আমাকে ছেড়ে দাও।” 

সজোরে ন্যানসির হাত টেনে ধরে সাইক্‌স্ চোখ রাঙিয়ে বললো : “চোপরাও হারামজাদি। মেঝে থেকে ওঠ।” 

—“উঠবো না—যেতে না দিলে এখান থেকে উঠবো না!” 

ন্যানসি চেঁচাতে লাগলো। তখন সাইক্‌স্ তাকে টেনে হিঁচড়ে পাশের একটা ছোটো কুঠুরির মধ্যে আটকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো। 

গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ন্যান্‌স কিছুটা শান্ত হলো—বাইরে যাবার আশা ছেড়ে দিলো সে। 

রাতে আর বাইরে যাবার চেষ্টা করবে না—সাইকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ন্যানসি ছাড়া পেলো সেই ছোটো কুঠুরি থেকে। 

সাইক্‌স্ বললো ফ্যাগিকে : ‘ভেবেছিলাম, ওকে পোষ মানিয়েছ, কিন্তু না, এখনও ঠিক আগের মতোই ও বেয়াড়া আছে।” 

এ-কথা শুনে ন্যানসি খিল্‌-খিল্‌ করে হেসে উঠলো। 

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ফ্যাগিন্ সাইকসের কাছ থেকে বিদায় নিলো। চলে যাবার সময় ফ্যাগিকে নিচে পর্যন্ত এগিয়ে দিলো ন্যানসি হাতে বাতি ধরে।

ন্যানসিকে একা পেয়ে ফ্যাগিন্ বললো : “ন্যানসি, তোমার কষ্ট দেখে আমার কান্না পাচ্ছে। সাইক্‌স্ একটা বাঁদর। তোমার কদর বোঝে না সে। সাইকসের হাত থেকে যাতে রেহাই পাও তার ব্যবস্থা করবো শীগগির।” 

ন্যানসি চুপ করে শুনে গেল ফ্যাগিনের কথা। কোনো জবাব না পেয়ে ফ্যাগিন্ বুঝলো—তার কথাটা ন্যানসির মনে ধরেনি। 

—“আচ্ছা, এ নিয়ে পরে কথা হবে।” এই বলে দরজার বাইরে পা দিলো ফ্যাগিন্। 

রাস্তায় বেরিয়ে ফ্যাগিন্ ন্যানসির আজকের আচরণটা আর একবার তলিয়ে দেখলো। ন্যানসি কেন এত রাতে এক ঘণ্টার জন্যে বাইরে বের হবার জেদ ধরলো, বেরোতে না দিলে ভালো হবে না বলে সাইকে শাসালো। ফ্যাগিনের সন্দেহ হলো, ন্যানসি নিশ্চয়ই গোপনে গোপনে কোনো কাজকারবার করছে, অথচ দলের কেউই এসব জানে না—এমনকি সাইও তা জানে না। 

ব্যাপারটা ভালো ঠেকলো না ফ্যাগিনের। যতোই সে এসব ভাবে ততোই তার সন্দেহ বেড়ে যায় ন্যানসির ওপর। শেষে ন্যানসির ওপর গোপনে নজর রাখার ব্যবস্থা করবে বলে সে ঠিক করলো। 

***

ভোরবেলা ফ্যাগিন্ তার নতুন সহচরের দেখা পেলো। সেই এসেই কাঁড়ি কাঁড়ি খাবার গিলতে লাগলো। 

ফ্যাগিন্ এগিয়ে এসে ডাকতেই নোয়া বললো : “খাওয়া শেষ হওয়ার আগে যেন কোনো কাজ করতে বলো না আমাকে।” 

মনে মনে নোয়ার মুণ্ডপাত করতে করতে ফ্যাগিন্ বললো : “তা, খেতে খেতে তুমি নিশ্চয়ই কথা বলতে পারো?” 

—“হ্যা তা পারি। কথা বলতে বলতে খেলে বেশি খাওয়া হয়ে যায়।” এই বলে নোয়া বেশি করে খানিকটা রুটি কেটে নিয়ে বললো : “শার্লটি গেল কোথায়?”

—“তাকে আমি বাইরে পাঠিয়েছি, তোমার সঙ্গে এখানে বসে গোপনে আমার আলোচনা করার জন্যে।” 

নোয়া বললো : “তা, যাবার আগে শার্লটি আমার জন্যে মাখন মাখিয়ে খানকয়েক টোস্ট করে দিয়ে গেলে তো পারতো।” 

ফ্যাগিন্ তোষামোদের সুরে বললো : “কাল কিন্তু তোমার কাজ খুব চমৎকার হয়েছে—প্রথম দিনেই ছ’ শিলিং সাড়ে ন’ পেন্স। এরকম ছোকরা-ছেনতাই করেই তোমার বরাত ফিরে যাবে।” 

এভাবে নানা মিষ্টি কথায় নোয়াকে খুশি করে ফ্যাগিন্ শেষে নিজের একটা কাজ করে দেবার জন্যে অনুরোধ করলো তাকে। কাজটায় কোনো বিপদের ভয় নেই—কেবল দলের একটা মেয়ের পেছন পেছন গিয়ে গোয়েন্দাগিরি করা। নোয়াকে জানতে হবে—সেই মেয়েটা লুকিয়ে কোন জায়গায় কাদের সাথে দেখা করে—কি ধরনের কথাবার্তা বলে বা কাদের কাছ থেকে কিরকম পরামর্শ শোনে। এসব খবর যোগাড় করে ফ্যাগিকে গোপনে জানাতে হবে, আর এই সামান্য কাজের জন্যে ফ্যাগিন্ পুরস্কার হিসেবে নোয়াকে এক পাউন্ড বখশিস্ দেবে— একেবারে এক পাউন্ড! টাকার অঙ্কটা ফ্যাগিন্ বেশ একটু জোর দিয়ে বললো, যাতে নোয়ার মন ভেজে। 

নোয়া রাজী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো : “তা, আমাকে কোথায় যেতে হবে?”

ফ্যাগিন্ বললো : “আমি সময়মতো তোমাকে তা জানাব। তুমি মোটের ওপর তৈরি থেকো।” 

***

নোয়া রোজই সেজেগুজে বসে থাকে——ফ্যাগিন্ রোজই হতাশ-মুখে এসে জানায় যে, এখনও সে-সময় আসেনি। 

এরপর থেকে ফ্যাগিন্ রোজ ন্যানসির খোঁজখবর নেয়, আর ন্যানসির ওপর তার সন্দেহ যে মিথ্যে তা প্রমাণ হয়ে যায়। সাইকসের কাছ থেকে ফ্যাগিন্ জানতে পারে যে আজকাল ন্যানসি কি রকম যেন হয়ে গেছে—কিছুতেই ঘর থেকে বেরোতে চায় না। 

সাইক্‌স্ বলে যে, সেদিনের রাতের ঘটনার পর থেকে ন্যানসির অভিমান হয়েছে, যার জন্যে সে এরকম উদাস হয়ে থাকে। 

ফ্যাগিন্ ন্যানসির ওপর তার সন্দেহের কথা সাইকে বলে। কথাটা শুনেই সাইক্‌স্ হেসে গড়াগড়ি যায় ফ্যাগিনের ভোঁতা মগজ দেখে। 

সাইক্‌স্ বলে : “ন্যানসি খুব জেদী মেয়ে—সে ইচ্ছে করলে সব কিছুই করতে পারে, কিন্তু বেইমানী সে কখনো করবে না। তাছাড়া আমাকে—” কথাটা আর শেষ না করে হেসে উঠলো সাইক্‌স্। 

ফ্যাগিন বলে : কিন্তু যদি সে বেইমানী করে তাহলে তুমি কি করবে?”

সাইক্‌স্ বললো : “সকলের যা করা হয় ওরও তাই করবো। যেদিন শুনবো ও বেইমানী করেছে, সেদিনই ওকে গলা টিপে মারবো।” 

—“কথাটা খেয়াল থাকে যেন। এর খেলাপ করো না কিন্তু।” ফ্যাগিন্ বলে ওঠে গম্ভীরভাবে। 

সাইকসের মতো অতোটা ন্যানসিকে বিশ্বাস করতে পারে না ফ্যাগিন্‌, তাই ন্যানসির ওপর কড়া নজর রাখে দিনের পর দিন। 

ফ্যাগিন্ ভাবে যে সাইক্‌স্ আজকাল শরীর খারাপের জন্যে বাড়ি থেকে বেরোয় না, তাই ন্যানসিও বেরোবার সুযোগ পাচ্ছে না বলে তার সন্দেহের কুয়াশা পরিষ্কার হচ্ছে না। এরকম সাত-পাঁচ ভেবে সাইকে বাইরের একটা কাজে পাঠাবার চেষ্টা করলো ফ্যাগিন্। লোভে পড়ে সাইও কাজটা হাতে নিলো এবং ঠিক করলো, আগামী রবিবারের রাতে যখন সকলে আমোদ-আহ্লাদে ডুবে থাকবে তখন সে ফ্যাগিনের দেওয়া কাজটা হাসিল করবে। 

রবিবার সন্ধ্যার কিছু আগে ফ্যাগিন্ হাসতে হাসতে এসে নোয়াকে বললো : “আজ মনে হচ্ছে, সে-মেয়েটা বাড়ি থেকে রাতে বেরোবে। যে-লোকটাকে সে ভয় করে, সেও আজ রাতে বাড়িতে থাকবে না—ভোরের আগে সে ফিরবে না। নাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।” 

জানা-পথের গোলকধাঁধা পেরিয়ে ফ্যাগিন্ আর নোয়া এসে হাজির হলো সাইকসের আস্তানায়। নোয়া যে ইহুদি ছোকরাকে সরাইখানায় দেখেছিলো, সে-ই দরজা খুলে দিলো এবং তার সাহায্যে নোয়া নিজে গা-ঢাকা দিয়ে ন্যানসিকে ভালো করে দেখে নিলো। 

রাত এগারোটায় ন্যানসি বাড়ি থেকে বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গে নোয়া দূর থেকে তার পেছন পেছন যেতে লাগলো। 

রাত সওয়া এগারোটার সময়ে লন্ডন-ব্রিজের ওপর দুটো মানুষকে দেখা গেল আগে-পিছে—নোয়া খানিকটা তফাতে থেকে অতি সাবধানে পিছু নিয়ে চলেছে ন্যানসির 

ঘন আঁধারে-ভরা রাত। যে-সব গৃহহারার দল ব্রিজের ওপরে রাতের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলো, তারা আঁধারের দরুন ন্যানসি ও নোয়াকে তেমন ঠাহর করতে পারলো না। 

নদীর ওপরে কুয়াশার ঢল নেমেছে। দু’একখানা নৌকোর আলো কুয়াশা ভেদ করে ফুটে উঠেছে আবছাভাবে। 

মিনিট-দুয়েক পরে সেখানে এসে একটা ভাড়াটে-গাড়ি থামলো। সেই গাড়িটা থেকে এক বুড়ো ভদ্রলোক নামলেন একটা তরুণীকে নিয়ে। বুড়ো ভদ্রলোক হলেন মিঃ ব্রাউন্‌লো, আর তরুণী হচ্ছে রোজ। 

ন্যানসি তাড়াতাড়ি তাঁদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো : “এখানে নয়— এখানে এই সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় করছে…চলুন ওই পোলের সিঁড়ির ওপর।”—এই বলে সে সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে দিলো। দূর থেকে ন্যানসির আঙুল-দেখানো দেখে, নোয়া আগে থাকতেই পা টিপে টিপে সিঁড়ির নিচে গিয়ে লুকিয়ে রইলো। 

ন্যানসির পেছন-পেছন মিঃ ব্রাউন্‌লো এবং রোজ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। কিছুদূর যাবার পরে মিঃ ব্রাউন্‌লো ন্যানসিকে বললেন : “আমি আর এগোতে দেবো না আমার সঙ্গিনীকে…অনেক দূর এগিয়েছি তোমাকে খুশি করার জন্যে।” 

“আমাকে খুশি করার জন্যে!”—জোরালো গলায় বললো ন্যানসি : “বলুন! বলুন! আমি তো আগেই বলেছি, আপনাদের সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমার ভয় করছে। কি যে হয়েছে আমার আজ, জানি নে হয়তো বা মরণের ভয়! রক্তমাখা লাশের চেহারা যেন সারাদিন আমার চোখে ভাসছে। সন্ধ্যের পর একখানা বই পড়ছিলাম—মনে হলো, ছাপার অক্ষরগুলোও যেন রক্তমাখা রয়েছে।” 

রোজ মিঃ ব্রাউন্‌লোকে ন্যানসির সাথে সদয় ব্যবহার করার জন্যে অনুরোধ করলো। 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “গত রবিবার তো তুমি আসোনি এখানে?”

ন্যানসি বললো : “আমাকে ওরা জোর করে আটকে রেখেছিলো।”

মিঃ ব্রাউন্‌লো জিজ্ঞাসা করলেন : “আজ এখানে আসার জন্যে তোমায় কেউ সন্দেহ করবে না তো?” 

ন্যানসি জবাব দিলো : “না, তা করবে না কেউ।” 

মিঃ ব্রাউন্‌লোর আরও প্রশ্নের জবাবে ন্যানসি জানালো যে, সে ফ্যাগিকে ধরিয়ে দিতে রাজী নয়। সে যুক্তি দেখিয়ে বললো : “সত্যি বটে সে বদ্ লোক, কিন্তু আমিও তো ভালো মেয়ে নই। একসঙ্গে বাস করি আমরা—ইচ্ছে করলে আমারও ক্ষতি করতে পারতো সে, কিন্তু তা তো সে করেনি।” 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “তাহলে মকে তুলে দাও আমার হাতে। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না এবং তোমার মত না নিয়ে ফ্যাগিকে আদালতে হাজির করাবো না।” 

ন্যানসি রোজকে জিজ্ঞাসা করলো : “আপনিও কি এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?”

রোজ বললো : “হ্যাঁ, আমিও এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।” 

তখন ন্যানসি এত নিচু গলায় কথা বলতে লাগলো যে, নোয়া তার গোপন স্থান থেকে কিছু কিছু শুনতে পেলো। মসের গতিবিধি সম্বন্ধে ন্যানসি যা জানতো, তা সে রোজ এবং মিঃ ব্রাউন্‌লোকে জানিয়ে বললো : “মঙ্কস্ দেখতে লম্বা…দুলে-দুলে চলে—চলার সময় মাঝে মাঝে বাঁদিকে ঘাড় ফিরিয়ে সাথে-সাথে ডানদিকে ঘাড় ফেরায়…মুখখানা তামাটে রঙের…আর সব সময় একটা লম্বা কোট পরে তার কলারটা উঁচু করে দিয়ে গলা ঢেকে রাখে। তার গলায়—”

“একটা লাল দাগ আছে।”—বললেন মিঃ ব্ৰাউন্‌লো। 

“সে কি! আপনি চেনেন কি তাকে?”

—“বোধহয় চিনি। যাক তুমি বড় উপকার করলে আমাদের। এখন বলো, আমরা কি করতে পারি তোমার জন্যে 

ন্যানসি বললো : “কিছু না—কিছু না।” 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : তুমি একজন মহীয়সী রমণী। একটা অসহায় অনাথ ছেলেকে বাঁচাবার জন্যে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছো। তোমাকে পুরোনো সাথীদের কাছে ফিরে যেতে দিতে চাই নে আমি। তুমি যদি চাও তো কাল ভোরের আগেই এদেশ থেকে বহুদূরে বিদেশের কোনো ভালো জায়গায় তোমাকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারি। সেখানে তুমি পাবে ভালো পরিবেশ, নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তাছাড়া অর্থের ভাবনা তোমার থাকবে না। তুমি শুধু রাজী হও—তারপর যা করার আমি করবো।” 

ন্যানসি বললো :”না-না, আমি আমার পুরোনো জীবন থেকে দূরে সরে যেতে পারি নে—এখন অনেকদূরে এগিয়ে গেছি—আর সেখান থেকে ফিরে যেতে পারি নে।” 

মিঃ ব্রাউন্‌লো বললেন : “তা হলে আর কি করা যাবে। যাক, চলি আমরা— তোমাকে বোধহয় কিছু বেশি সময় আটকে রেখেছি।” 

ন্যানসি নিচু গলায় বললো : “হ্যাঁ।” 

রোজ ও মিঃ ব্রাউন্‌লো চলে গেলেন। ন্যানসি সিঁড়ির ওপর প্রায় উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে তার মনের ব্যথা দূর করলো কিছুক্ষণ ধরে। তারপর দুর্বল শরীরে কাঁপতে কাঁপতে চলে গেল সেখান থেকে। 

নোয়া যখন উঁকি মেরে দেখে বুঝলো যে সবাই চলে গেছে, তখন সে তার লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্যাগিনের আড্ডার দিকে এগিয়ে চললো। 

***

ভোর হতে তখনো ঘণ্টা দুয়েক বাকি। শরৎকালে এ সময়টা মাঝরাত বলেই মনে করা হয়। চারদিক চুপচাপ—কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও। ফ্যাগিন্ তার আস্তানায় বসে আছে—তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ দুটো লাল। মেঝের ওপর একখানা জাজিমে গভীর ঘুমে এলিয়ে আছে নোয়া। 

ন্যানসির ওপর ঘেন্নায় রাগে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ফ্যাগিনের মন। সে নোয়ার এ কথায় বিশ্বাস করেনি যে, ন্যানসি তাকে ধরিয়ে দিতে রাজী হয়নি। 

এমন সময়ে একটা বান্ডিল হাতে সাইক্‌স্ সেখানে হাজির হলো। বান্ডিলটা ফ্যাগিকে দিয়ে সে বললো : “তুলে রাখো এটা…ভারী কষ্ট হয়েছে এটা যোগাড় করতে…নইলে দু-ঘণ্টা আগেই এখানে এসে পৌঁছোতাম।” 

বান্ডিলটা তুলে রেখে ফ্যাগিন্ একনজরে সাইকসের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রতিহিংসার ছায়া। 

সাইক্‌স্ জিজ্ঞাসা করলো : “কি ব্যাপার, ফ্যাগিন্? অমন হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?” 

ফ্যাগিন রাগে এমন তেতে গিয়েছিলো যে, চেষ্টা করেও সে কথা বলতে পারলো না। 

সাইকস্‌ বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো : “কি হলো ফ্যাগিন্? ক্ষেপে গেলে নাকি আমার ওপর? মারবে নাকি আমাকে?” 

ফ্যাগিন্ কোনোমতে বললো : “না-না, তোমার ওপর কোনো রাগ নেই আমার।” 

সাইক্‌স্ এবার নিজের পকেটে লুকোনো পিস্তলটায় হাত রেখে মৃদু হেসে বললো : “না থাকলেই ভালো, নইলে আমাদের মধ্যে খুনোখুনি হয়ে একজন হয়তো ফেঁসে যেতো। কার কপালে মরণ ঘটতো, তা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামিয়ে আমাদের কাজ নেই।” 

সাইকসের কথায় কান না দিয়ে ফ্যাগিন্ বললো : “তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ একটা কথা আছে, বিল্‌।” 

সাইক্‌স্ বললো : “বলে ফ্যালো তাড়াতাড়ি, নইলে আর দেরি করলে ন্যানসি হয়তো ভাববে যে, আমি মারা গেছি।” 

—“তা, সে তোমাকে মেরে ফেলার পথ তৈরি করেই এসেছে। আচ্ছা, মনে করো, ওই ছেলেটা যে ওখানে পড়ে ঘুমোচ্ছে”, বলেই ঘুমন্ত নোয়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলো ফ্যাগিন্ : “ও যদি আমাদের দুশমনদের কাছে গিয়ে আমাদের গোপন কথা ফাঁস করে দেয়—যদি আমাদের আস্তানার খোঁজ আর আমাদের কারুর কারুর চেহারার বিবরণ দিয়ে আসে, তাহলে—তাহলে তুমি ওকে কি করবে?” 

—“তাহলে আমি জুতোর তলার কাঁটা দিয়ে মাড়িয়ে ওর মাথাটা ঝাঁঝরা করে দেবো।” 

—“ঠিক তো?” 

–“এখনই পরখ করে দেখতে পারো আমাকে।” 

—“যদি চার্লি বা ধুরন্ধর এমন জঘন্য কাজ করে? কিংবা—”

—“যে কেউই হোক না কেন, বাছবিচার করবো না আমি…তাকে ওরকম সাজা দেবোই।” 

সাইকসের এ-কথা শুনে নোয়াকে ডেকে তুলে ফ্যাগিন্ তাকে ন্যানসির গত রাতের গোপন অভিযানের কথা বলতে বললো। 

নোয়া তখন খোলাখুলি বলে যেতে লাগলো, কিভাবে সে ন্যানসির পিছু পিছু ধাওয়া করে লন্ডন ব্রিজ পর্যন্ত গিয়েছিলো, আর কিভাবে ন্যানসি সেই বুড়ো ভদ্রলোক এবং তরুণীর সঙ্গে দেখা করে মসের কথা তাদের বলে দিয়েছিলো।

–“শয়তানী! শয়তানী!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সাইক্‌স্ লাফ দিয়ে দরজার দিকে মাতালের মতো ভীষণ হুঙ্কার ছড়িয়ে ছুটে গেল। ব্যাপারটার সাংঘাতিক পরিণতি হবে বুঝতে পেরে ফ্যাগিন্ দৌড়ে পেছন থেকে সাইকসের হাত পাকড়ে ধরলো, কিন্তু ফ্যাগিনের হাত ছাড়িয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সাইক্‌স্। 

ফ্যাগিন্ সাইকসের পেছন পেছন দৌড়োতে দৌড়োতে তাকে অনুরোধ জানালো : “ন্যানসির ওপর খুব বেশি অত্যাচার করো না, বিল্! তাহলে আমাদের দলের সকলেরই বিপদ ঘটবে।” 

কোনো জবাব না দিয়ে সাইক্‌স্ ছুটতে লাগলো। তারপর কোথাও না থেমে এবং কোনোদিকে না চেয়ে সোজা এসে সে হাজির হলো নিজের আস্তানায়। তারপর চুপচাপ ঘরে ঢুকেই দরজায় চাবি দিয়ে ন্যানসিকে ঘুম থেকে জাগালো সে। 

ন্যানসি চমকে জেগে উঠেই বলে উঠলো : “বিল, তুমি!” 

ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছিলো। সাইক্‌স্ বাতি নিবিয়ে দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ঘরের কানাচে। 

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে দেখে ন্যানসি বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পরদা সরিয়ে দিতে গেল। 

সাইক্‌স্ বাধা দিয়ে বললো : “পরদা যেমন আছে তেমনি থাক, আমার কাজের জন্যে দরকারী আলো ঘরে আছে।” 

ন্যানসি সভয়ে বললো : “তুমি অমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?”

হিংস্র আক্রোশে সাইক্‌স্ দু-এক মুহূর্ত ন্যানসির দিকে তাকিয়ে থেকে তার চুঁটি টিপে তাকে ঘরের এককোণে টেনে আনলো এবং হাত দিয়ে সজোরে তার মুখ চেপে ধরলো। 

ন্যানসি নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বললো : “বিল্, বিল্‌, চেঁচাবো না আমি একটুও…কাঁদবো না এক ফোঁটা…শুধু আমাকে খুন করার আগে বলো, আমি তোমার কি করেছি।” 

সাইক্‌স্ দাঁতে দাঁত চেপে বললো : “শয়তানী, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস? জানিস কাল রাতে তোর পেছনে চর লেগেছিলো। তুই লুকিয়ে যেখানে গিয়েছিলি আমাদের সর্বনাশ করার জন্যে, তাদের যা বলে এসেছিস সেখানে, তা সবই জানি! বেইমান কোথাকার!” 

ন্যানসি আর্তনাদ করে বলে উঠলো : “বিশ্বাস করো বিল্, আমি তোমাকে বাঁচাবারই চেষ্টা করেছি…তোমার সঙ্গে কোনো বেইমানী আমি করিনি! আমাকে খুন করার আগে আমার কথা শোনো…শুধু আমার জন্যে নয়, তোমার ভালোর জন্যেও বলেছি, বিল্, আমায় খুন করার আগে আমাকে বলতে দাও সব কথা। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো, বেইমানী আমি করিনি।” 

ন্যানসির চুলের মুঠি ধরে তাকে মাটিতে ফেলে হিড়হিড় করে টানতে টানতে সাইক্‌স্ বললো : “মিছে কথা বলিস্ নে শয়তানী! কাল রাতে ওদের চর তোকে নজর করেছে, আর কি কি কথা বলেছিস তাও সে শুনেছে। এর পরেও কি তুই বলবি, বেইমানী করিসনি। বল্ হারামজাদি, আর কি বলবি তাই বল।” 

সাইকসের পা দুটো জড়িয়ে ধরে ন্যানসি বলে ওঠে : “তোমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করেছি আমি, তার বদলে তোমার কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষে চাইছি। ছেড়ে দাও আমাকে বিল্, ওরা আমাকে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয় দিতে চেয়েছিলো। আমি…আমি তোমার মুখের দিকে চেয়ে তা নেইনি। তুমি চাও তো আমাদের দুজনের জন্যেই বহুদূরে বিদেশে নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের জন্যে বলবো ওদের—ওরা তা নিশ্চয়ই দেবে আমাদের। আমাকে ছাড়ো—আমার গলা ছাড়ো। উঃ বড্ডো লাগছে—মরে গেলুম বিল্‌… বিল্‌…” 

এতক্ষণে সাইক্‌স্ ন্যানসির গলা টিপে ধরেছে এক হাতে, আর অন্য হাতে নিজের পিস্তলটা বাগিয়ে ধরেছে। কিন্তু প্রচণ্ড রাগের মাথায়ও তার খেয়াল হলো যে, পিস্তল ছুঁড়লে লোক জানাজানি হয়ে যাবে, আর তাতে হয়তো তাকে খুনের দায়ে হাতেনাতে ধরা পড়তে হবে। তাই সে পিস্তলের উল্টো দিকটা দিয়ে ন্যানসির কপালে ও মুখে বারবার সজোরে ঘা মরতে লাগলো। 

ন্যানসি মেঝের ওপর পড়ে গেল…তার কপালে ও মুখের ক্ষত থেকে ফিকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। সাইক্‌স্ তবুও থামলো না…ন্যানসির রক্তমাখা মুখের ওপর একনাগাড়ে প্রচণ্ড আঘাত হানতে লাগলো সে। ন্যানসি আর সইতে পারলো না। তবুও বহু কষ্টে সে শেষবারের মতো হাঁটু গেড়ে উঠে এবার বসলো, তারপর বুকের ভেতর থেকে রোজের দেওয়া রুমালখানা বের করে আকাশের দিকে মুখ তুলে হাত জোড় করে প্রার্থনা জানালো ভগবানের কাছে। মুখের ভাষা তার বেরুলো না…বিড়বিড় করে কি যেন বলতে গিয়ে তাঁর ঠোঁট দুটো কেবল সামান্য নড়ে উঠলো, তারপর ধীরে ধীরে স্থির হয়ে গেল…সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুটো গেল বুজে চিরদিনের মতো। 

সাইক্‌স্ তাতেও খুশি হলো না। ন্যানসির দেহে প্রাণের বিন্দুমাত্র স্পন্দন থাকতে সে তাকে ছাড়বে না। তাই একগাছা ভারী লাঠি দিয়ে বার বার আঘাত করতে লাগলো মৃত ন্যানসিকে। তারপর সে একখানা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলো ন্যানসিকে। পড়ে রইলো শুধু রক্ত আর মাংস…নরম তুলতুলে মাংস আর গাঢ় অঢেল রক্ত। 

সাইক্‌স্ তখন আগুন জ্বেলে লাঠিগাছা পুড়িয়ে ছাই করে ফেললো, হাতমুখ ধুয়ে পোশাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে লাগলো রক্তের দাগ। পোশাকের কোনো কোনো জায়গা থেকে জলে ধুয়েও রক্তের দাগ উঠছে না দেখে, সাইক্‌ সে সব জায়গা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেললো। তারপর কুকুরটাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো সে। পথ দিয়ে যেতে যেতে একবার সে তার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো,—পরদাটা ঠিক তেমনি করে ঝুলছে। ন্যানসি যে আলোর জন্যে পরদাটা সরাতে গিয়েছিলো, সে আলো আর সে দেখবে না কোনোদিন। 

সূর্য তখনও ওই জানালার ধারে-কাছে সকালের সোনালী কিরণ ছড়াচ্ছে। 

শিস্ দিয়ে কুকুরটাকে ডেকে খুব জোরে পা চালিয়ে দিলো সাইক্‌স্ নতুন আস্তানার খোঁজে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *