অলিভার টুইস্ট – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বালক অলিভারকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন মিঃ বাম্বল। এর আগে অলিভার একনাগাড়ে এতটা পথ হাঁটার সুযোগ পায়নি কখনো। তাই একদিকে যেমন পথ চলতে অসুবিধে হওয়ায় সে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো, তেমনি আশেপাশে নানা অপরিচিত দৃশ্য দেখে কখনো কখনো হতবাক্ হচ্ছিলো। পথ চলায় অলিভারের এই ধরনের গাফিলতি মিঃ বাম্বল সইতে পারলেন না। তিনি ধমক দিলেন কয়েকবার তাকে, শেষে কানমলা ও কোঁৎকা দিয়ে তার পথ চলার গতি বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই বালক অলিভার তাঁর মতো একটা ধুম্‌সো লোকের সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে পারলো না। একে তার খিদেয় পেট জ্বলছে, তার ওপর পথ চলার অভ্যাস নেই তার। তাই মিঃ বাম্বলের হুমকি কোনো কাজেই লাগলো না। অবশ্য মিঃ বাম্বলকে খুশি করার জন্যে অলিভারের চেষ্টার কসুর ছিলো না একটুও। সত্যি কথা বলতে কি, রোগা লিক্‌লিকে ফ্যাকাসে ছোটোখাটো চেহারা নিয়ে অলিভারকে দৌড়োতে হয়েছিলো মিঃ বালের পেছনে পেছনে। 

এভাবে অলিভারকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মিঃ বাম্বল যখন অনাথ- আশ্রমের প্রধান কর্মকেন্দ্রে হাজির হলেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এসেই শুনলেন যে আশ্রমের কর্মকর্তাদের সভা শুরু হয়ে গেছে, আর অলিভারকে নিয়ে সভায় হাজির হবার জন্যে তাঁর ঘন ঘন ডাক এসেছে সভাপতি মিঃ লিকিনের কাছ থেকে। একথা শোনামাত্র মিঃ বাম্বল অলিভারকে দু’চার মিনিট বিশ্রাম করার সুযোগ না দিয়েই তাকে বগলদাবা করে টানতে টানতে হন্তদন্ত হয়ে সভায় হাজির হলেন। 

কর্মকর্তাদের সভায় হাজির হয়ে অলিভার দেখলো, আট-দশজন ভদ্রলোক একটা মস্ত বড়ো টেবিলকে ঘিরে চেয়ারে বসে কথাবার্তা কইছেন আর মাঝে মাঝে কতকগুলো লেখা কাগজ পড়ছেন। তাঁদের মধ্যে একজন একটু উঁচু চেয়ারে বসে আছেন। 

অলিভারকে টেবিলের দিকে এগিয়ে দিয়ে মিঃ বাম্বল বললেন : “অলিভার, ওঁদের নমস্কার জানাও—ওঁরাই তোমাকে এতদিন খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছেন।” 

খিদের জ্বালায় আর পথশ্রমে অলিভারের চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমেছিলো। চোখের জল মুছে সে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালো কর্মকর্তাদের। যিনি উঁচু চেয়ারে বসে ছিলেন, তিনি হলেন সভাপতি মিঃ লিম্বকিন। একটিপ নস্যি নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন : “খোকা, তোমার নাম কি?” 

প্রশ্নের সাথে সাথে এতগুলো লোককে তার মুখের দিকে এক নজরে তাকাতে দেখেই অলিভার ঘাবড়ে গেলো। ভয়ে ঠক্‌ঠক্‌ করে তার পা কাঁপছিলো, গলা তার শুকিয়ে গিয়েছিলো। তাই বিড়বিড় করে সে যা জবাব দিলো তা সকলে শুনতে পেলেন না। 

কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মন্তব্য করলেন : “ছেলেটা একটা আস্ত গাধা।” কেউ কেউ বললেন : “পেট ভরে খাওয়ানোর ফলে ছেলেটার মাথার ঘিলু মোটা হয়ে গেছে।” 

মিঃ বাম্বল এবার অলিভারের পেছনে দাঁড়িয়ে দু’একটা কোঁৎকা দিলেন। ফলে অলিভার তার নুয়ে পড়া পা দুটো খাড়া করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো পরবর্তী প্রশ্নের জন্যে। 

মিঃ লিম্বকিন আবার প্রশ্ন করলেন : “খোকা, তুমি বোধ হয় জানো যে তুমি একজন অনাথ?” 

“তাতে হয়েছে কি?” অলিভার জবাব দিয়ে বসলো। 

এবার হাসির রোল উঠলো সভার মাঝে। অলিভার যে নিরেট গাধা সে বিষয়ে কর্মকর্তাদের আর কোনো সন্দেহ রইলো না। 

মিঃ লিকিন অলিভারের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন : “তুমি নিশ্চয়ই জানো যে তোমার বাপ-মা নেই বলে আমরা তোমাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছি, তাই না?” 

কাঁদ-কাঁদ গলায় অলিভারের ছোট্ট জবাব শোনা গেল : “হ্যাঁ।” 

মিঃ লিকিন বললেন : “তোমাকে এবার শিখিয়ে পড়িয়ে কোনো কাজের লায়েক করে তোলার জন্যে এখানে আনা হয়েছে। কাল ভোর ছটা থেকে দড়ি পাকানোর কাজে লেগে যাবে, বুঝেচো?” 

অলিভারের মুখ দিয়ে আর কোনো জবাব বেরুলো না। মিঃ বাম্বল অবশ্য আর দেরি না করে অলিভারকে টানতে টানতে একটা বড়ো হলঘরে নিয়ে এসে তারই এককোণে একটা ময়লা বিছানায় শুইয়ে দিলেন। অলিভার ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো কেউ আর খোঁজ রাখলো না। খাবার জন্যে কেউ তাকে ডাকতেও এলো না। 

ওদিকে কর্মকর্তারা সভা শেষ করার আগে অনাথ-আশ্রম পরিচালনার ব্যাপারে কতকগুলো নিয়মকানুনের গুরুতর রদবদল করলেন। তার মধ্যে একটা হলো অনাথ ছেলেদের খাওয়ার পরিমাণ বিষয়ে। কর্মকর্তারা সবাই জ্ঞানী-গুণী দার্শনিক লোক। তাঁরা অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন যে অনাথ ছেলেদের বেশি পরিমাণে খাবার দেওয়া হচ্ছে বলে তারা দিন দিন গাধা হয়ে যাচ্ছে, আর অকর্মার ঢেঁকি হয়ে নিশ্চিন্ত আরামে দিন কাটাচ্ছে, তাই এবার থেকে খাওয়ার পরিমাণ এমনভাবে কমাতে হবে যাতে অনাথ ছেলেরা আশ্রমকে তাদের আড্ডাখানা করে তুলতে না পারে, আর খিদের জ্বালায় কাজকর্মের দিকে মন দিতে পারে। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা আশ্রমের খাবার জলের সরবরাহ বাড়িয়ে দিলেন, আর ছেলেদের মাথাপিছু রোজ তিনবারে তিন হাতা যবের ছাতুর তৈরি পাতলা লসি, সপ্তাহে দুবার একটি করে পিঁয়াজ এবং প্রতি রবিবারে আধখানা রুটি বরাদ্দ করলেন। 

নতুন ব্যবস্থামতো খাবার দেবার ফলে অনাথ-আশ্রমের প্রথম প্রথম খরচ বেড়ে গেল, কেননা অনাথ ছেলেরা না খেতে পেয়ে ধীরে ধীরে আরও লিকলিকে হওয়ার ফলে তাদের জামাগুলো বড্ড বেশি ঢিলে হয়ে গেল আর তাদের জামা পালটাতে বাড়তি খরচের ধাক্কা সইতে হলো। তাছাড়া অনাথ ছেলেরা বেশি সংখ্যায় মরতে লাগলো বলে অনেক খরচ হলো, কেননা একজনের কয়েক বছরের খাবার খরচের চেয়ে তাকে কবর দেওয়ার খরচ ছিলো বেশি। কর্মকর্তারা ছিলেন সবাই খাঁটি খ্রিশ্চান, তাই কবর দেওয়ার বদলে লাশগুলো তাঁরা জলে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেন না ধর্মনষ্ট হবার ভয়ে। 

***

প্রথম তিনমাস অলিভার ও তার সঙ্গীরা মুখ বুজে সয়েছিলো অনাহারের জ্বালা। সকলেই খাবার সময়ে এক হাতা লসি খেয়ে আঙুল চুষতো অনেকক্ষণ ধরে, আর ক্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকতো লসির হাতার দিকে, কিন্তু কারও সাহস হতো না আর-এক হাতা লসি চাইতে। তারা ভালো করেই জানতো বাড়তি এক হাতা লপ্‌সি চাইলে তারা তো তা পাবেই না, উলটে পাবে কঠোর সাজা। তাই খিদের জ্বালায় তারা খাবারের থালা চেটে চেটে চকচকে করে তুলতো। এর ফলে থালা ধোয়া-মোছার পাট ছিলো না তাদের। 

ক্রমাগত না খেয়ে খেয়ে অনাথ ছেলেরা শেষে মাথা ঠিক রাখতে পারলো না। একদিন একটা ছেলে বললো—রোজ বাড়তি আর এক হাতা লপ্‌সি না পেলে সে হয়তো কোনোদিন মাঝ রাতে তার পাশে শোওয়া ঘুমন্ত ছেলেটাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে। একথায় অন্য ছেলেরা সবাই ভয় পেয়ে গেলো। তারা তখন পরামর্শ করলো নিজেদের মধ্যে। শেষে ঠিক হলো তারা এবার এক হাতা বাড়তি লসির জন্যে দাবি পেশ করবে। এ ব্যাপারে অলিভারকেই তারা বেছে নিলো তাদের নেতা হিসেবে। অলিভারই সর্বপ্রথম এক হাতা বাড়তি লসি চাইবে তারপর ধীরে ধীরে বাকি সবাই এই দাবি নিয়ে এগিয়ে যাবে। 

সেদিন সন্ধ্যাবেলা এক হাতা লসি খেয়ে ছেলেরা নিয়মমতো আঙুল চোষার পরে থালা চাটতে লাগলো। অলিভার কিন্তু তা করলো না। সে এগিয়ে গিয়ে বাড়তি আর এক হাতা লসি চেয়ে বসলো। 

অনাথ-আশ্রমের দীর্ঘ জীবনে কখনো কোনো ছেলে এরকম বেআইনী দাবি করেনি। পরিবেশক চমকে উঠলো। তখনি সে হাতার বাঁট দিয়ে অলিভারের মাথায় দু-চার ঘা বসিয়ে দিলো এবং তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গিয়ে মিঃ বাম্বলকে জানালো : “সর্বনাশ হয়েছে! অলিভার এক হাতা লসি বেশি চেয়েছে!” 

মিঃ বাম্বল চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন : “য়্যা! ছোঁড়াটা এক হাতা লসি বেশি চেয়েছে! এতবড়ো আস্পর্ধা খুদে শয়তানটার! অকৃতজ্ঞ বেইমান কোথাকার।” 

রাগে কাঁপতে থাকেন মিঃ বাম্বল। বেতটা কাছে খুঁজে না পেয়ে অলিভারের দিকে তেড়ে গেলেন তিনি। 

অলিভার কিন্তু ভয়ে পিছু হটলো না। বাড়তি এক হাতা লসির দাবিতে সে অবিচল রইলো! তা দেখে মিঃ বাম্বলের মাথা আরও গরম হয়ে উঠলো। চোখ পাকিয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন : “বড়ো বাড় বেড়েছিস দেখছি! ফের যদি এ ধরনের কথা বলিস তো চাবকে সোজা করে দেবো।” 

অলিভার তবুও ভয়ে কুঁকড়ে গেলো না বা মাথা নোয়ালো না দেখে মিঃ বাম্বল এবার তার কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন আশ্রমের সভাপতি মিঃ লিকিনের কাছে। 

নিজের ঘরে ইজিচেয়ারে বসে লিম্বকিন তখন আধা-ঘুমের আমেজে ছিলেন।

“স্যার! এই ছোঁড়াটা এক হাতা লপ্‌সি বেশি চেয়েছে।” সখেদে বলে ওঠেন মিঃ বাম্বল। 

কথাটা কানে আসামাত্রই মিঃ লিকিনের ঘুমের নেশা ছুটে গেলো। চোখ কপালে তুলে তিনি ফ্যালফ্যাল্ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অলিভারের মুখের দিকে। প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে অলিভারের বিদ্রোহের মাত্রাটা কতখানি তা বোধ হয় প্রথমে যাচাই করে দেখলেন তিনি। তারপর কিছুই যেন শোনেননি বা বুঝতে পারেননি এরকম একটা ভাব দেখিয়ে এক টিপ্ নস্যি নিয়ে লিম্‌কিন জিজ্ঞাসা করলেন : “কি বলছেন আপনি, মিঃ বাম্বল?” 

মিঃ বাম্বল জবাব দেন : “স্যার! এই পুঁচকে ছোঁড়াটা আশ্রমের নিয়মকানুন মানবে না বলছে—রোজ এক হাতা লসি বেশি চাইছে।” 

এ ধরনের জঘন্য অভিযোগ আজ পর্যন্ত পাননি মিঃ লিম্বকিন তাঁর সুদীর্ঘ আশ্রম-জীবনের কাজে, তাই নিজের কানকে যেন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। কথাটা সত্যি কিনা তা ভালো করে যাচাই করার জন্যে তিনি আবার মিঃ বাম্বলকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি বলতে চাইছেন যে ওই ছেলেটা সত্যি সত্যি পুরো এক হাতা বাড়তি লসি চেয়েছে?” 

—“তাইতো চেয়েছে ছোঁড়াটা।” জবাব দেন মিঃ বাম্বল। 

—“পুরো এক হাতা—” কথাটা শেষ করতে পারেন না মিঃ লিকিন। বিস্ময়ের রেশ ফুটে ওঠে তাঁর সুরে। 

—“হ্যাঁ স্যার! সিকি বা আধ হাতা নয়, পুরো এক হাতা লসিই বেশি চেয়েছে।” কথাটা জোর দিয়ে বলেন মিঃ বাম্বল। 

—“ঠিক বলছেন তো?” আবার জিজ্ঞেস করেন মিঃ লিকিন। 

—“হ্যাঁ স্যার।”—এবার ছোট্ট জবাব আসে মিঃ বাম্বলের কণ্ঠে। 

একথা শুনে মিঃ লিম্বকিন সোজা হয়ে চেয়ারে বসলেন। মনে মনে বোধ হয় এতক্ষণ হিসেব করছিলেন রোজ পুরো এক হাতা বাড়তি লসি দিলে আশ্রমের খরচের খাতে কত টাকা বাড়বে। হিসেব গুলিয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ মেজাজে তিনি মিঃ বাম্বলকে আবার জিজ্ঞাসা করেন : “কেন? ওদের কি আমরা কম খেতে দিচ্ছি?” 

এ প্রশ্নের জবাব দিতে যাচ্ছিলো অলিভার, কিন্তু তার কোঁকে কোৎকা মেরে মিঃ বাম্বল থামিয়ে দিলেন তার ভাষা! সাফাইয়ের সুরে নিজেই বলে ওঠেন : “মোটেই তা নয়, স্যার। আপনারা সকলে এতো মাথা ঘামিয়ে অনাথ ছেলেদের জন্যে যা বরাদ্দ ঠিক করেছেন তা কখনো কম হতে পারে না। কোনোমতেই তাকে কম বলা যায় না—অন্তত আমি তা স্বীকার করি না। বরং আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে ওদের খাবার বেশি দেওয়া হচ্ছে।” 

—“খাবার বেশি দেওয়া হচ্ছে!’ আর একটা অভিযোগ পেলেন বলে মনে হলো মিঃ লিকিনের। 

মিঃ বাম্বলের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন মিঃ লিকিন বাহবার ভঙ্গিমা নিয়ে। মুখে তাঁর মৃদু হাসি ফুটে ওঠে এবার। সমস্যার সমাধান হয়তো খুঁজে পেয়েছেন তিনি এতক্ষণে। 

এদিকে শীর্ণ ক্ষুধার্ত অলিভার ভয়ে কাঁপতে থাকে সভাপতির জাঁদরেল চেহারা ও তাঁর ভারিক্কি চাল দেখে। তার মুখে কোনো ভাষা বেরুলো না মিঃ বাম্বলের মারের ভয়ে, তবে তার অন্তর বলতে থাকলো :”আপনাদের দয়ায় যেটুকু খেয়ে বেঁচে এখনও আছি তার জন্যে কৃতজ্ঞ, শুধু বাড়তি এক হাতা লসি পেলে আরও কিছুদিন বাঁচবো।” 

মিঃ বাম্বুলের জবাবের জের তুলে মিঃ লিম্বুকিন আবার জিজ্ঞাসা করেন : “তাহলে, মিঃ বাম্বল, আপনি কি বলতে চান যে ছেলেটা আশ্রমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাইছে?” 

মিঃ বাম্বল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন : “হ্যাঁ স্যার, এটা একটা ঘোরতর বিদ্রোহ। এর একটা হেস্তনেস্ত করা এখনি দরকার, নইলে শেষে আমরা কিছুতেই সামাল দিতে পারবো না।” 

মিঃ লিম্বকিন বললেন : “তাহলে তো বিদ্রোহীকে কড়া সাজা দিতে হয়?”

মিঃ বাম্বল জবাব দেন “হ্যাঁ স্যার, এ ছোঁড়াটা হলো নাটের গুরু। একে সাজা না দিলে এর দেখাদেখি বাকি সকলে বিগড়ে যাবে, আর পরিণামে অনাথ ছেলেদের জন্যে আশ্রমের এতদিনের সৎ প্রচেষ্টা একেবারে বানচাল হয়ে যাবে।” 

মিঃ বাম্বলের শেষ কথাটা শুনে মিঃ লিম্বকিন ঘাবড়ে যান। অনাথ দরিদ্রদের সেবক তিনি। আজীবন সেবার আদর্শ ঘাড়ে নিয়ে আশ্রমের কঠোর কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। একটা ছেলের জন্যে অনাথ-আশ্রমের এতবড়ো ক্ষতি হবে তিনি জেনেশুনে সইবেন কি করে? তা ছাড়া ছেলেদের বেশি খাবার দেওয়ার অভিযোগ পেয়েছেন মিঃ বাম্বলের কাছ থেকে 

অগত্যা কর্মকর্তাদের সভা ডেকে বসলেন মিঃ লিকিন সে-রাতেই। সভার বিচার্য বিষয় হলো : “বাড়তি এক হাতা লসি চেয়ে অলিভার টুইস্ট নামে এক বালকের বিদ্রোহ ঘোষণা আশ্রমের বিরুদ্ধে।” 

মিঃ লিকিনের হুকুমে সেদিন থেকে অলিভারকে অন্ধকার সেল্-এ আটক রাখা হলো। অনেক ভেবেচিন্তে অনাথ-আশ্রমের কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন, অলিভারকে আশ্রম থেকে বিদায় করতেই হবে। 

পরের দিন আশ্রমের সদর দরজায় একটা বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিলো : “কেউ যদি অলিভারকে নিজের কাজে লাগাবার জন্যে নিয়ে যায়, তবে তাকে পাঁচ পাউন্ড দেওয়া হবে।”

এক সপ্তাহের মধ্যে কেউ এলো না এই জঘন্য অপরাধী-বালকের প্রার্থী হয়ে। নির্জন অন্ধকারে বন্দী-দশায় কেঁদে-কেঁদে আকুল হলো অলিভার। 

সেদিন সকালবেলা চিনি-পরিষ্কারক গ্যামফিল্ড যাচ্ছিলো আশ্রমের সামনে দিয়ে। তাকে তার বাড়িওলা ক’দিন ধরে বাকি ভাড়ার জন্যে ভারি তাগাদা দিচ্ছিলো। গাম্‌ফিল্ড ভাড়ার টাকা যোগাড় করতে না পেরে খুব ভাবনায় পড়েছিলো। হঠাৎ আশ্রমের ওই বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ায় সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। তখনি অনাথ-আশ্রমের কর্মকর্তাদের কাছে অলিভারকে নিজের সহকারী হিসেবে পাবার জন্যে আবেদন জানালো। অনেক দর-কষাকষির পরে কর্মকর্তারা তাকে পাঁচ পাউন্ডের জায়গায় সাড়ে তিন পাউন্ড দিয়ে তার হাতে অলিভারকে সঁপে দিতে রাজী হলেন। 

তারপর অলিভার আর গ্যাম্‌ফিল্ডকে নিয়ে মিঃ বাম্বল্ গেলেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে—তাঁর অনুমতি ছাড়া অলিভারকে লাগানো যাবে না চিমনি পরিষ্কার করার কাজে। কেননা, এর আগে এ-কাজ করতে গিয়ে কয়েকজন বালক দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। 

ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু সব-কিছু বিগড়ে দিলো অলিভার। সে গ্যাম্‌ফিল্ডের চ্যাপটা-মুখে কি যেন দেখে এমন ভয় পেলো যে, কিছুতেই তার সঙ্গে সে যেতে চাইলো না। ম্যাজিস্ট্রেটও তাই মত দিলেন না। 

অলিভারকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে আবার অন্ধকার সেল্-এ আটকে রেখে দেওয়া হলো এবং পরদিন অনাথ-আশ্রমের সদর দরজায় আবার একটা বিজ্ঞাপন টাঙানো হলো : “অলিভারকে ভাড়া দেওয়া হবে এবং যে ভাড়া নেবে, তাকে পাঁচ পাউন্ড দেওয়া হবে।” 

অলিভারকে ভাড়া নেবার জন্যে কেউ এগিয়ে এলো না দেখে কর্মকর্তারা তাকে বিদেশে কোথাও ছোকরা চাকর হিসেবে পাঠিয়ে দেবার চেষ্টা করতে বললেন মিঃ বাম্বলকে। মিঃ বাম্বল চলে গেলেন লন্ডনে জাহাজী-ব্যাপারীদের কাছে, কিন্তু তাতে সফল হলেন না তিনি। আশ্রমে ফিরে আসার পথে তাঁর দেখা হলো মিস্টার সোয়ারবেরীর সাথে। মিঃ সোয়ারবেরীর পেশা হলো—কফিন তৈরি করা ও লাশ কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা। 

কথায় কথায় মিঃ বাম্বল অলিভারের ব্যাপারে নিজের হয়রানির কথা মিঃ সোয়ারবেরীকে বললেন। নানা কারণে মিঃ বাম্বুলের সাথে মিঃ সোয়ারবেরীর স্বার্থ জড়িত ছিল, কেননা মিঃ বাম্বল ছিলেন একজন পাদরী। পাদরীর সাহায্য পেলে কফিনের ব্যবসায় ভালোরকম পশার বাড়িয়ে তোলা যায়, তাই মিঃ বাম্বলকে খুশি করার জন্যে অলিভারকে নিতে মিঃ সোয়ারবেরী রাজী হয়ে গেলেন তখনি। 

মিঃ বাম্বল ছুটে গেলেন মিঃ লিকিনের কাছে খবরটা দিতে। ঠিক হলো সেদিন সন্ধ্যার পর অলিভারকে পাচার করে দেওয়া হবে মিঃ সোয়ারবেরীর বাড়িতে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *