দশম পরিচ্ছেদ
ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস লেগে খানার মধ্যে অচেতন অলিভারের জ্ঞান ফিরে এলো। কোথায় আছে, কেনই বা সেখানে এসেছে, প্রথমে কিছুই মনে করতে পারলো না সে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই দারণ যন্ত্রণায় ‘মা-গো’ বলে আবার সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার জ্ঞান ফিরে এলো তার। সে বুঝতে পারলো, এই খানার মধ্যে এভাবে পড়ে থাকলে তাকে এখানেই মরে পড়ে থাকতে হবে। তাই বহু চেষ্টা করে কোনোমতে খানা থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করে দিল সে! তার মাথা ঘুরছে, পা কাঁপছে, তবু সে হেঁটে চললো।
কিছুক্ষণ চলার পরে সামনেই দেখলো সে একটা বড়ো বাড়ি। সেখানে গিয়ে সাহায্য চাইবে ঠিক করলো, কিন্তু বাড়ির গেট পেরিয়ে বাগানের মধ্যে পা দিতেই চমকে উঠলো সে—এই বাড়িতেই তো কাল রাতে তারা ডাকাতি করতে এসেছিলো। প্রথমে সে ভাবলো, পালিয়ে যাবে, কিন্তু পালিয়ে যাবেই-বা কোথায়? শেষ পর্যন্ত সে এগিয়ে গিয়ে দরজার কড়া নাড়লো, কিন্তু শরীরের দারুণ দুর্বলতার জন্যে আবার বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল।
***
সাইক্স্ যে-বাড়িতে অভিযান করেছিলো, গাইলস্ সে-বাড়ির খানসামা এবং ব্রিটলস্ হলো ‘বয়’ বা বালক-ভৃত্য। বালক-বয়সেই ওই বাড়িতে কাজে লেগেছিলো ব্রিটলস্, কিন্তু এখন তার বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেলেও তার ‘বয়’ নাম ঘোচেনি। এরা দুজন পুরুষ ছাড়া বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই স্ত্রীলোক, তবে আর একজন বাইরের লোক দুটো কুকুর নিয়ে রাত কাটাতো ওই বাড়ির রোয়াকে শুয়ে। সে হলো একজন ঝালাইওলা।
সাইক্স্ ও তার সঙ্গীদের পেছন রাতে ধাওয়া করেছিলো ওই তিনজন লোক, সঙ্গে দুটো কুকুর নিয়ে! অনেকটা দূর ধাওয়া করে এসে কি ভেবে তারা পরামর্শ করার জন্য থামলো।
দলের সবচেয়ে মোটা লোকটা বললো : “আমার মতে এখন বাড়ি ফিরে যাওয়া ভালো। চলো, আমরা বাড়ি ফিরে যাই।”
একথা শুনে দ্বিতীয় লোকটার মুখে আতঙ্কের ছায়া ফুটে ওঠে। সে কাঁপা গলায় বললো : “মিস্টার গাইসের মতই আমার মত।”
তৃতীয় লোকটা বললো : “মিস্টার গাইসের কথার প্রতিবাদ করার কোনো অধিকার নেই আমার।” কথা বলার সময়ে তার দাঁতগুলো ঠকঠক করে কাঁপছিলো।
—“তুমি ভয় পেয়েছো, ব্রি” গাইলস্ বললো।
ব্রিটলস্ বললো : “ভয় পেয়েছি! কৈ, না তো।”
—“তুমি মিথ্যুক।”
ব্রিটলস্ বললো : “আপনি মিথ্যাবাদী, মিস্টার গাইলস্!”
তর্কাতর্কির অবসান করে দিল ঝালাইওলা। সে বললো : “সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সবাই ভয় পেয়েছি।”
তারপর তিনজনে পরস্পরের গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে ভয়ে ভয়ে ফিরে চললো বাড়ির দিকে। তখন ভোর হয়ে গেছে। ফিরে এসে তারা রান্নাঘরে বসে চা খেতে খেতে গত রাতের ঘটনা আলোচনা করছিলো। গাইলস্ বাড়ির প্রধান পরিচারক, তাই সে নিজের মর্যাদা বজায় রাখার জন্যে সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে, আর অন্য সব চাকর-বাকরদের এড়িয়ে চলে। কিন্তু রাতের রোমাঞ্চকর ডাকাত ধরার অভিযানের নেতৃত্ব করেছে বলে সে আজ তার গাম্ভীর্যের মুখোশ খসিয়ে সবার সাথে একসঙ্গে বসেছে। বাড়ির ঝি আর রাঁধুনী হাঁ করে গিলছিলো তার কথাগুলো।
গাইলস্ বলছিলো : “রাত তখন বোধহয় দুটো হবে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে জেগে উঠলুম। প্রথমে ভাবলুম, স্বপ্ন দেখেছি। এমন সময় আবার শব্দ হলো। তখন বিছানার ওপরে উঠে বসলুম।”
“কী সব্বোনাশ!” রাঁধুনী আর ঝি একসঙ্গে একথা বলে আর একটু কাছ- ঘেঁষে বসলো গাইল্সের।
ভারিক্কী চালে গাইস্ আবার বলতে লাগলো : “ঠিক করলুম, ব্রিটলস্ বেচারাকে ডেকে তুলতে হবে, নইলে ওকে ডাকাতরা হয়তো ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করে রেখে যাবে—ও হয়তো টেরও পাবে না। তাই চুপিচুপি উঠে গিয়ে ওকে ডেকে তুলে বলুম, ভয় পানে।”
রাঁধুনী জিজ্ঞাসা করল : “তা, ও কি ভয় পেলো?”
গাইলস্ বললো : “মোটেই না। ও প্রায় আমারই মতো সাহসী কিনা!”
ঝি বললো : “আমি হলে কিন্তু তখনি ভয়ে মরে যেতুম।”
ব্রিটলস্ বললো : “তুমি যে মেয়েছেলে।”
গাইলস্ সায় দিয়ে বললো : “ঠিকই বলেছ ব্রিটলস্! মেয়েমানুষের কাছে ভয় ছাড়া আর কিই-বা আশা করা যায়!”
ঠিক এ সময় বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই গাইলস্ এবং অন্য সবাই উঠলো। ঝি আর রাঁধুনী ভয়ে আঁতকে উঠলো।
গাইলস্ বললো : “দরজাটা খুলে দাও কেউ!”
কিন্তু ভয়ে কেউ নড়লো না। গাইলস্ সবার ভয়ার্ত মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে আবার বললো : “এত ভোরে কড়া নাড়ছে কে? ভারী সন্দেহের কথা। যাক্, দরজাটা খুলে দাও কেউ।”
এই বলে গাইলস্ ব্রিক্সের দিকে তাকালো, কিন্তু ব্রিটলস্
তার মুখচোখে এমন ভাব দেখালো যে গাইলস্ যেন কখনও তাকে এত বড়ো কাজের ভার দিতে পারে না। ঝালাইওলাকে দেখা গেল, সে যেন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। আর মেয়েরা তো ভয়ে জড়সড়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে গাইলস্ বললো : “ব্রিটলস্ যখন ভয় পাচ্ছে তখন আমি বলি কি, তার সঙ্গে আমরাও সকলে একসাথে যাই…কি বল হে তোমরা?”
হঠাৎ ঘুমিয়ে-পড়া ঝালাইওলা জেগে উঠে বললো : “আমি এতে রাজী আছি।”
শেষপর্যন্ত সবাই একসাথে জড়াজড়ি করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো।
অলিভারকে দেখে গাইলস্ সবিস্ময়ে বলে উঠলো : “আরে, এ যে সেই বিচ্ছু ডাকাতটা; একে চিনতে পারছো না, ব্রিটলস্?”
“তাইতো! তাইতো!” বলে সকলে ভয়ে পিছিয়ে গেল, কিন্তু গাইলস্ অলিভারকে চ্যাংদোলা করে বাড়ির ভেতর এনে মেঝের ওপরে শুইয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো : “মা-ঠাকরুন! দিদিমণি! ডাকাত ধরেছি। কাল এটাকেই গুলি করেছিলুম।”
একজন তরুণী এসে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ালো এবং অলিভারকে না দেখেই ব্রিকে পাঠিয়ে দিলো ডাক্তার আর পুলিশ ডেকে নিয়ে আসার জন্যে।
সকালের জলখাবার খেতে বসলেন দু’জন মহিলা—একজন বৃদ্ধা, অপরজনের বয়স সতেরো বছরেরও কম। তরুণীটি ভারী সুন্দরী। তাদের পরিবেশন করতে লাগলো গাইলস্।
বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন : “ব্রিটলস্ কতক্ষণ হলো গেছে?”
গাইলস্ ঘড়ি দেখে বললো : “এক ঘণ্টা বারো মিনিট হলো, মা।”
বৃদ্ধা বললো : “ভারী কুঁড়ে ও।”
গাইলস্ বললো : “ব্রিটলস্ ছেলেটা চিরকালই ওরকম।”
মৃদু হেসে তরুণীটি বললো : “ছেলেটা রাস্তায় আবার অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে শুরু করে দেয়।”
তরুণীটির তামাশা বুঝতে পেরে গাইও হেসে ফেললো। এমন সময়ে একজন মোটা ভদ্রলোক বড় বড় পা ফেলে সোজা ঘরের মধ্যে ঢুকে বলে উঠলেন : “আঃ! মিসেস্ মেইলী! শুনলুম কাল রাত্তিরে আপনার বাড়িতে নাকি ডাকাত পড়েছিলো? আমাকে খবর দিলেন না কেন? কী সাংঘাতিক রাত্তিরবেলা বাড়ি চড়াও! আঃ মিস্ রোজ!”
যিনি একথা বললেন, তিনি হলেন ডাক্তার লসবার্ন।
তরুণী মিস্ রোজ তখনি ডাক্তারকে অলিভারের কাছে পাঠিয়ে দিলো। রোগী দেখতে অনেকক্ষণ সময় লাগলো ডাক্তারের। তারপর তিনি নিচে নেমে এসে মিসেস্ মেইলী ও মিস্ রোজকে নিয়ে গেলেন ওপরে অলিভারকে দেখাবার জন্যে।
মৃদু পায়ে তাঁরা ঢুকলেন অলিভারের ঘরে। রোজ অলিভারের কাছে গিয়ে তার চুলগুলো গুছিয়ে দিতেই সে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো।
মিসেস্ মেইলী বললেন : “বেচারা এমন ছেলে কখনোই ডাকাত দলের লোক হতে পারে না।”
ডাক্তার বললেন : “যে যতই বেচারা হোক, বাইরের চেহারা দেখে বলা যায় না, কার মনে কি আছে!”
রোজ বললো : “তা বলে এত কম বয়সে?”
ডাক্তার বললেন : “কম বয়সেই তো ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে সহজে পাপের খপ্পরে পড়ে।”
রোজ বললো : “হয়তো মায়ের ভালোবাসা বা বাড়ির সুন্দর পরিবেশ এর কপালে কোনোদিন জোটেনি। হয়তো অনাদর, অত্যাচার আর পেটের জ্বালাতেই ও খারাপ লোকেদের সঙ্গে মিশেছে। যাই হোক্, ওকে জেলে পাঠিয়ো না পিসিমা দয়া করো ওকে।”
কিশোর অলিভারকে দেখেই রোজের মতো মিসেস্ মেইলীর অন্তরও গলে গিয়েছিল। তাই রোজ অনুরোধ করার সঙ্গে-সঙ্গেই অলিভারকে জেলের দায় থেকে কি উপায়ে বাঁচানো যায়, সে বিষয়ে ডাক্তার লসবার্নের কাছে পরামর্শ চাইলেন।
বেশ খানিকক্ষণ ভেবে-চিন্তে ডাক্তার লসবার্ন জানালেন যে, তিনি ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবেন, তবে গাইস্কে আর ব্রিকে ধমকাবার অধিকার দিতে হবে তাঁকে। অবশ্য, সেই অযথা ধমকানির মূল্য হিসেবে মিসেস্ মেইলী তাদের না হয় কিছু বকশিস দেবেন। ডাক্তার আরও জানালেন যে, তিনি আগে থেকে কিছুটা কাজ এগিয়ে রেখেছেন—অলিভারের অবস্থা সংকটজনক বলে কনস্টেবলকে ঠেকিয়ে রেখেছেন—অলিভারের সঙ্গে তাকে দেখা করতে দেননি।
মিসেস্ মেইলী ও রোজ ডাক্তারের শর্ত মেনে নিলেন।
গাইলস্ নিচে রান্নাঘরে মজলিস জাঁকিয়ে বসেছিলো। ব্রিটলস্, ঝালাইওলা, রাঁধুনী আর ঝিয়ের কাছে তার অসীম সাহসের কাহিনী বলছিলো সে। কনস্টেবলও ছিলো সেখানে। এমন সময়ে ডাক্তার লসবার্ন গিয়ে সেখানে হাজির হলেন।
দু’একটা মামুলী কথার পরে ডাক্তার বললেন : “আমার ভয় হচ্ছে, গাইলস্ তুমি ভুল করছো। আচ্ছা, তুমি শাস্ত্র মানো তো?”
—“মানি বৈকি!” গাইলস্ বললো।
—“আর তুমি ব্রিটলস্?”
—“নিশ্চয়ই। মিস্টার গাইলস্ যা মানেন, আমিও তাই মানি”, জানালো ব্রিটলস্
ডাক্তার তখন বেশ ঝাঁজের সুরেই বললেন, “ভালো! আচ্ছা, তোমরা কি হলফ করে বলতে পারো যে, ওপরের ঘরে যে-ছেলেটা আছে, সেই-ই কাল রাতে এ বাড়িতে ঢুকছিলো? মনে রেখো, তোমাদের অনুমান যদি ভুল হয়, তাহলে ভগবান যমদূত পাঠিয়ে তোমাদের শায়েস্তা করবেন। কনস্টেবল, এদের জবাবটা শুনে রাখো।”
গাইলস্ আর ব্রিটলস্ দু’জনে দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। এমন সময়ে সদর দরজায় কড়া নড়ে উঠলো…দারোগাবাবু এসেছেন
দারোগা ব্ল্যাদার্স আর তাঁর সহকারী ডাফের কাছে বেশ ধীরে-সুস্থে ডাক্তার লসবার্ন গতরাতের সব কাহিনী বললেন।
দারোগা বললেন : “এ নিশ্চয়ই লাঙলের কাজ নয়, কি বলো, ডাক্?”
—“নিশ্চয়ই না।” সহকারী ডাফ্ দারোগার মত মেনে নিলেন।
ডাক্তার বললেন, “লাঙল” বলতে আপনারা যদি গেঁয়ো লোক বোঝাতে চান তো বলবো ঠিকই অনুমান করেছেন আপনারা—এটা গেঁয়ো লোকের কাজ নয় মোটেই।”
তারপর ব্ল্যাদার্স জিজ্ঞাসা করলেন : “আচ্ছা, যে ছোঁড়াটাকে চাকরেরা ধরেছে বলেছিলো—”
লবার্ন বললেন : “বাজে কথা। ভয় পেয়ে তারা যা-তা বলেছে। সে- ছেলেটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এ-ডাকাতির।”
লসবার্নের কথা মেনে নিলেও দারোগা কিন্তু অলিভারকে জেরা করে তার পরিচয় জানার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন : “ছোঁড়াটা কে? এলো কোত্থেকে? সে তো আর আকাশ থেকে খসে পড়েনি!”
ডাক্তার লসবার্ন দারোগাকে বললেন : “ছেলেটা এমন মারাত্মকভাবে অসুস্থ যে, ডাক্তার হিসেবে আমি এখন কিছুতেই তাকে উত্ত্যক্ত করার অনুমতি দিতে পারি না। তার সঙ্গে দেখা করতে হলে আপনাকে দু’চারদিন অপেক্ষা করতে হবে।”
একথা শুনে দারোগা ঠিক করলেন যে, আগে তিনি বাড়ির চাকরবাকরদের জেরা করবেন এবং ডাকাতরা কোন্ পথে এসেছিলো তা পরীক্ষা করে দেখবেন। ডাক্তার লস্বার্নের কাছে ধমক খেয়ে গাইলস্ আর ব্রিটলস্ এমন ঘাবড়ে গিয়েছিলো যে, তারা দারোগার জেরার উত্তরে উলটোপালটা এজাহার দিলো। ফলে অলিভারের ওপর পুলিশ-কর্মচারীদের সন্দেহ একেবারে পাতলা হয়ে গেল।
চাকর-বাকরদের জেরা শেষ হয়ে গেলে, দারোগা ব্ল্যাদা আর তাঁর সহকারীকে পেট ভরে মদ খাইয়ে দিলেন ডাক্তার। তাঁদের মন থেকে অলিভারের ওপর সন্দেহ তখন মুছে গেছে। তাঁরা তখন এ-ডাকাতি কোন্ দলের কাজ তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন।
দারোগা বললেন : “এটা সেই শাঁখারী-ব্যাটার কাজ।”
সহকারী ডাফ্ বললেন : “না, এ-কাজ সেই ঘরামী ব্যাটার।”
চলে যাবার আগে পুলিশ-কর্মচারীরা অলিভারকে দেখলেন বটে, কিন্তু ডাক্তারের কথামতো তাকে কোনো জেরা করলেন না। তাঁরা শুধু এই শর্ত করলেন যে, একান্ত এড়ানো না গেলে অলিভারকে আদালতে হাজির হতে বে এবং সে যাতে হাজির হয়, তার জন্যে মিসেস্ মেইলী ও ডাক্তার লম্ববান জমিন থাকবেন। ডাক্তার আর মিসেস্ মেইলী এ-শর্ত মেনে নিলেন। তারপর পুলিশ- কর্মচারী দু’জনে চলে যাওয়ার সময়ে তাঁদের হাতে একটা করে গিনি গুজে দিলেন ডাক্তার লসবার্ন।
***
অলিভারের অসুখটা সহজ ছিলো না, তাই সারতেও বেশ সময় লাগলো। কয়েক সপ্তাহ পরে সে একটু সুস্থ হবার পর যাঁরা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের দয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের দুঃখময় জীবনের করুণ কাহিনী তাঁদের কাছে জানালো। তারপর দুটো ছোটো হাত জোড় করে সে তাঁদের কাছে কাতর আবেদন জানালো, যেন তাঁরা আর তাকে ফেলে না দেন। সে বারবার বলতে লাগলো যে তাঁরা তাকে যে কাজ করতে দেবেন, হাসিমুখে সেই কাজ করতে সে রাজী আছে।
অলিভারের কাহিনী শুনে রোজের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আর তার মন সহানুভূতিতে ভরে গেল। অলিভারকে আশ্বাস দিয়ে সে বললো : “আমাদের খুশি করার জন্যে তোমার ব্যস্ত হবার দরকার নেই। যে-শোচনীয় অবস্থায় তোমার জীবন কেটেছে বলে আমাদের জানিয়েছো, তা থেকে পিসিমা যে তোমাকে উদ্ধার করতে পেরেছেন, তাতেই আমি খুশি হয়েছি। যদি দেখতে পাই যে, তিনি অপাত্রে করুণা করেননি, তাহলে আমার যে কী আনন্দ হবে তা তুমি ধারণাও করতে পারো না।”
কথায় কথায় অলিভার জানালো যে, মিস্টার ব্রাউন্লোর সঙ্গে দেখা করার জন্যে সে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক হয়তো তাকে বেইমান জোচ্চোর ভাবছেন।
রোজ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো যে, আর একটু ভালো হয়ে উঠলেই সে নিজে গিয়ে মিস্টার ব্রাউনলোর সঙ্গে দেখা করতে পারবে।
কিছুদিনের মধ্যেই অলিভার বেশ সেরে উঠলো। তখন একদিন মিসেস্ মেইলীর ঘোড়ার গাড়িতে চেপে সে ডাক্তার লসবার্নকে নিয়ে মিস্টার ব্রাউন্লোর সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়লো।
সেখানে পৌঁছে প্রথমেই সে বাড়ি ভুল করে বসলো। তারপর বহুকষ্টে যদিই- বা খুঁজে পেল মিঃ ব্রাউন্লোর বাড়ি, কিন্তু হায়! সে বাড়ির বারান্দায় সাইনবোর্ড ঝুলছে : “বাড়িটা ভাড়া দেওয়া হবে।”
তখন ডাক্তার লসবার্নের পরামর্শে পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, মিঃ ব্রাউন্লো তাঁর সব জিনিসপত্র বেচে দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে চলে গেছেন। তাঁর পরিচারিকা এবং তাঁর নিত্যসঙ্গী এক বন্ধুও তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন।
হতাশায় ভেঙে পড়লো অলিভার। রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে সে কল্পনার জাল বুনেছিলো। তাকে দেখতে পেলে মিঃ ব্রাউন্লো এবং মিসেস্ বেডুইনের কী আনন্দই-না হবে। শেষ পর্যন্ত সে বইওলার কাছে গিয়ে খবর নেওয়ার কথা বলতেই, ডাক্তার লম্ববার্ন বললেন : “এত আশা করে যখন বিফল হওয়া গেল, তখন আর চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। বইওলার খোঁজে গিয়ে দেখবে হয়তো সে মারা গেছে, নয়তো সে নিজের ঘরে আগুন দিয়ে পালিয়ে গেছে। নাঃ আর নয়! এবার সিধে বাড়ি ফিরে চলো।”
নিরুপায় অলিভার অগত্যা বাড়ি ফিরলো। তার তখন যা মনের অবস্থা, তা একমাত্র তার অন্তর্যামীই জানতেন।