ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
সাইকস্ আগে যে বাসায় থাকতো, এখন আর সেখানে থাকে না। এখন একটা নোংরা গলির ভেতর অপরিষ্কার একটা ঘরে আস্তানা নিয়েছে। সেখানে আসবাবপত্র তেমন নেই। ঘরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, লোকটার আর্থিক অবস্থা রীতিমতো খারাপ হয়ে পড়েছে আজকাল।
তালি দেওয়া পোশাকে সাইক্স্ অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলো। মুখে একরাশ দাড়ি—হপ্তাখানেক কামানো হয়নি। কুকুরটা বিছানার কাছে শুয়ে প্রভুর দিকে পিট্পিট্ করে তাকাচ্ছিলো, কখনও বা চাপা গলায় গজরাচ্ছিলো। জানালার ধারে বসে একমনে সাইকসের একটা ছেঁড়া জামায় তালি দিচ্ছিলো ন্যানসি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দিনরাত একনাগাড়ে সাইকে সেবা করার ফলে তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। এখন আর আগের মতো চেহারার জৌলুস নেই—বেশ রোগা হয়ে গেছে সে।
হঠাৎ সাইক্স্ জিজ্ঞাসা করলো : “কটা বাজে?”
ন্যানসি জবাব দিলো : “সাতটা বেজে গেছে। কেমন আছো আজ বিল্?”
-–“বিলকুল কাদার মতো বনে গেছি ন্যানসি! হাতটা ধরো তো দেখি, এ হতচ্ছাড়া বিছানাটাকে ছেড়ে একবার উঠি!”
রোগে পড়েও সাইকসের মেজাজ কিন্তু ঠাণ্ডা হয়নি। উঠতে উঠতে সে এমন সব বিচ্ছিরি গালাগালি দিতে লাগলো ন্যানসিকে, যা শুনে বেচারা ন্যানসি বেহুঁশ হয়ে পড়লো।
এমন সময়ে ঘরে ঢুকে ফ্যাগিন্ বলল : “এ কি ব্যাপার ভায়া?”
সাইক্স্ রেগে উঠলো : “ওখানে দাঁড়িয়ে অমন করে চোখ পাকিয়ে দেখছো কি? পারো তো ওকে একটু সাহায্য কর…দেখছো না, ন্যানসি মুচ্ছো গেছে।”
ফ্যাগিনের পেছনে-পেছনে ধুরন্ধর ও চার্লি এসেছিল। ধুরন্ধরের বগলে ছিল একটা মোড়ক। সে সেটাকে মাটির ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চার্লির হাত থেকে একটা বোতল ছিনিয়ে নিলো। তারপর বোতলের মদটা নিজে একটু চেখে দেখে ন্যানসির মুখে ঢেলে দিতে দিতে বললো : “চার্লি, পাখা দিয়ে খুব জোরে জোরে বাতাস করো। ফ্যাগিন্, তুমি ওর হাতে আস্তে আস্তে থাবড়াতে থাকো। আর সাইক্স্, তুমি ততক্ষণ জামা-কাপড়গুলো একটু আলগা করে দাও।”
ধুরন্ধরের কথামতো সবাই চট্পট্ সেবা শুরু করায় ন্যানসি শীগগির চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ফ্যাগিন্ বললো : “বিল্, তোমার জন্যে কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছি।”
সাইক্স্ বললো : “বেশ করেছো, কিন্তু আজ রাতে যে কিছু চাঁদি চাই।” ফ্যাগিন্ বললো : “আমার কাছে এখন একটাও পয়সা নেই।”
–“তোমার বাড়িতে ঢের আছে।”
–“ঢের?”
“হ্যাঁ ঢের। কত আছে তা জানি নে, তুমিও বেশ ভালো করে না গুনে ঠিক তা বলতে পারবে না মোদ্দা, আজ রাত্তিরে কিছু টাকা আমার চাই-ই।”
—“বেশ, আমি ধুরন্ধরকে দিয়ে এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো ফ্যাগিন্।
সাইক্স্ বললো : “উহু! ধুরন্ধর হচ্ছে বহুৎ ধুরন্ধর! ও হয় এখানে আসতে ভুলে যাবে, নয়তো পথ হারিয়ে ফেলবে, নয়তো বা লাল পাগড়ীর ফাঁদে পড়বে। আসলে এখানে না আসার একটা কিছু সাফাই কৈফিয়ৎ ও বানিয়ে নিতে পারবে। সে হবে না—ন্যানসি যাক্ তোমার গরুর গোয়ালে টাকা নিয়ে আসতে।”
অগত্যা ফ্যাগিন্ তার দলবল আর ন্যানসিকে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলো। তারপর ফ্যাগিনের ঘরে ওরা যখন পৌঁছলো, তখন সেখানে টোবি ক্র্যাকিট আর টম চিলিং বসে তাসের জুয়া খেলছিলো। ওরা পৌঁছতেই সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো—রইলো কেবল ফ্যাগিন্ আর ন্যানসি। ফ্যাগিন টাকার বাক্স খুলতে যাবে, এমন সময় নিচে পায়ের শব্দ শুনে চমকে উঠলো—কে একজন ঘরের দিকে আসছে! তার গলার স্বর শুনে ফ্যাগিন্ চিনতে পারে আগন্তুককে, আর ন্যানসি চমকে ওঠে।
ফ্যাগিন্ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে : “বাঃ! এ লোকটারই তো এখানে আসার কথা ছিল না। যাক্ এসে গেছে ভালোই হলো। ন্যানসি! ওর সামনে টাকার কথা তুলো না। দশ মিনিটের মধ্যেই ও চলে যাবে।
ঘরে ঢুকলো মঙ্কস্।
ন্যানসিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে যাবার তোড়জোড় করতেই ফ্যাগিন বলে উঠলো : “আরে না-না, একে দেখে তোমার ঘাবড়াবার কিছু নেই হে। এ আমারই চেলাদের একজন।”
ন্যানসি কিন্তু তখন মসের দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে।
ফ্যাগিন্ জিজ্ঞাসা করে : “কোনো খবর আছে কি?”
মঙ্কস জবাব দেয় : “খুব দামী খবর আছে হে!”
ফ্যাগিন্ জিজ্ঞাসা করে : “ভালো কি খারাপ?”
মঙ্কস বলে : ‘অন্তত মন্দ নয়। তোমার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে।” এই বলে মঙ্কস ন্যানসির দিকে তাকালো। ন্যানসি কিন্তু ঘর ছেড়ে চলে যাবার কোনো আগ্রহ দেখালো না।
ন্যানসিকে চলে যেতে বললে পাশে সে চেঁচিয়ে টাকা চেয়ে বসে, এই ভয়ে ফ্যাগিন্ মকে নিয়ে ওপর তলায় গেল গোপন আলোচনার জন্যে। ওরা দু’জনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যানসি নিজের জুতো খুলে ফেললো ও কালো গাউনটায় তার সারা দেহ মুড়ি দিয়ে নিলো। তারপর খালি পায়ে চুপিচুপি পা টিপে-টিপে সিঁড়ি বেয়ে সে ওপরে উঠে গেল মঙ্কস্ ও ফ্যাগিনের গোপন কথাবার্তা শোনার জন্যে।
মিনিট পনেরো পরে ন্যানসি ফিরে এলো। ফ্যাগিন্ ফিরে এসে দেখে ন্যানসি বিবর্ণ মুখে ঘরে বসে আছে। সে বলে ওঠে : “ন্যানসি! মুখটা তোর ভয়ে আমসি হয়ে গেছে কেন?”
ন্যানসি বলে : “আমি তার কি জানি। এই ঘুপসি ঘরে কতক্ষণ অপেক্ষা করব! টাকা দাও, চলে যাই।” আর দেরি না করে ফ্যাগি ন্যানসির হাতে গুনে গুনে টাকা দিলো আর প্রতিটি টাকা দেওয়ার সাথে-সাথে সে একটা করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
উত্তেজিত অবস্থায় ন্যানসি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। তার ভাগ্য ভালো যে, সাইকস্ তার পরদিন সেই টাকা নিয়ে মনের সুখে মদ খেতে লাগলো –ন্যানসির আচরণে কোনো পরিবর্তন নজর করার মতো মনের অবস্থা আর তার রইলো না।
বেলা পড়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই ন্যানসির মানসিক উত্তেজনা খুব বেড়ে গেল। সে অপেক্ষা করতে লাগলো, সাইক্স্ কখন মদ খেতে-খেতে ঘুমিয়ে পড়বে। ন্যানসির মুখে এমন একটা বিবর্ণ ভাব আর তার চোখে এমন একটা জ্বালা ফুটে উঠলো যে, সাইকসেরও তা নজরে পড়লো, কিন্তু ন্যানসিকে জিজ্ঞাসা করে এর কোনো সদুত্তর পেলো না সে।
তারপর সাইক্স্ নিঝুম হয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার পর ন্যানসিকে হাত-পা টিপে দেবার জন্যে হুকুম করলো। এরপর এক নজরে ন্যানসির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সাইক্স্ যেন মনে মনে বললো : ‘নাঃ এমন বিশ্বাসী মেয়ে আর একটাও নেই, নইলে তিন মাস আগেই ওর গলা কেটে ফেলতাম!”
সাইক্স্ ঘুমোচ্ছে না দেখে ন্যানসি এবার মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে কয়েক পাত্র মদ খেতে দিতেই সাইক্স্ শীগগির ঘুমিয়ে পড়লো। ন্যানসিস তখন তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পোশাক বদলে চুপিচুপি ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।
রাত তখন সাড়ে ন’টা। রাস্তায় নেমে এত হন্ হন্ করে সে হাঁটতে লাগলো যে, পথিকেরা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। হাঁটতে-হাঁটতে ন্যান্স দেখলো রাস্তার দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে যতটা পারে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগোতে লাগলো হাইড পার্কের দিকে। ঘড়িতে এগারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে একটা হোটেলের সামনে এসে এদিক-ওদিক চেয়ে কয়েকবার পায়চারি করে হোটেলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। কিন্তু একটু ঢুকেই দারোয়ানের আসন খালি দেখে সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
ঠিক সেই সময়ে এক তরুণী পরিচারিকা তাকে জিজ্ঞাসা করলো : “কি চাই?” তার চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে অবজ্ঞার ভাব।
ন্যানসি বললো : “মিস্ মেইলীকে চাই।”
পরিচারিকার ডাকে একটা চাকর বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো : “কি নাম তোমার? কি দরকার তাঁকে?”
ন্যানসি তা জানাতে অস্বীকার করলো। চাকরটা তখন তাকে সদর দরজার দিকে ঠেলে আঙুল দেখিয়ে বললো : “তবে—ভাগো হিঁয়াসে।”
ন্যানসি বললো : “তা যদি বলো তো, তোমরা দু’জনে মিলেও আমাকে এখান থেকে বের করে দিতে পারবে না।”
এমন সময়ে এক ঠাণ্ডা মেজাজের পাচক এসে বললো : “আঃ! কি ঝামেলাই না তোমরা বাধিয়ে তুললে এতো রাতে! ওহে জো। খবরটা দাও না ছাই তেনার কাছে পৌঁছে। তাহলে তো হাঙ্গামা চুকে যায়।”
অগত্যা মিস্ মেইলীকে খবর দিতে গেল জো, আর বিবর্ণ মুখে রুদ্ধশ্বাসে তার আসার অপেক্ষা করতে লাগলো ন্যানসি। সেই সময় ন্যানসি পরিষ্কার শুনতে পেলো, হোটেলের পরিচারিকারা তাকে লক্ষ্য করে কুৎসিত ভাবে গালাগালি দিচ্ছে। ন্যানসি নীরবে সহ্য করে রইলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জো ফিরে এসে ন্যানসিকে নিয়ে দোতলার একটা ছোট কুঠরিতে বসালো।
.
রোজ ঘরে ঢুকতে ন্যানসি প্রথমে একটা চড়া মেজাজে বলে উঠলো : “আপনার সঙ্গে দেখা করা ভারী শক্ত ব্যাপার। আমি যদি আর দশজনের মতো রাগ করে চলে যেতাম, তাহলে হয়তো আপনাকে অনুতাপ করতে হতো সেজন্যে।
রোজ বললো : “কেউ যদি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকে ভাই, তার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমার অনুরোধ, তুমি সেসব কথা মন থেকে মুছে ফেলো। এখন বলো, কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো।”
রোজের ঠাণ্ডা মেজাজ ও তার মিষ্টি কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে ন্যানসি প্রায়
ন্যানসি কিন্তু তখন মসের দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে।
ফ্যাগিন্ জিজ্ঞাসা করে : “কোনো খবর আছে কি?”
মঙ্কস্ জবাব দেয় : “খুব দামী খবর আছে হে!”
ফ্যাগিন্ জিজ্ঞাসা করে : “ভালো কি খারাপ?”
মঙ্কস বলে : ‘অন্তত মন্দ নয়। তোমার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে।” এই বলে মঙ্কস ন্যানসির দিকে তাকালো। ন্যানসি কিন্তু ঘর ছেড়ে চলে যাবার কোনো আগ্রহ দেখালো না।
ন্যানসিকে চলে যেতে বললে পাশে সে চেঁচিয়ে টাকা চেয়ে বসে, এই ভয়ে ফ্যাগিন্ মকে নিয়ে ওপর তলায় গেল গোপন আলোচনার জন্যে। ওরা দু’জনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যানসি নিজের জুতো খুলে ফেললো ও কালো গাউনটায় তার সারা দেহ মুড়ি দিয়ে নিলো। তারপর খালি পায়ে চুপিচুপি পা টিপে-টিপে সিঁড়ি বেয়ে সে ওপরে উঠে গেল মঙ্কস্ ও ফ্যাগিনের গোপন কথাবার্তা শোনার জন্যে।
মিনিট পনেরো পরে ন্যান্স ফিরে এলো। ফ্যাগিন্ ফিরে এসে দেখে ন্যানসি বিবর্ণ মুখে ঘরে বসে আছে। সে বলে ওঠে : “ন্যানসি! মুখটা তোর ভয়ে আমসি হয়ে গেছে কেন?”
ন্যানসি বলে : “আমি তার কি জানি। এই ঘুপসি ঘরে কতক্ষণ অপেক্ষা করব! টাকা দাও, চলে যাই।” আর দেরি না করে ফ্যাগিন ন্যানসির হাতে গুনে গুনে টাকা দিলো আর প্রতিটি টাকা দেওয়ার সাথে-সাথে সে একটা করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
উত্তেজিত অবস্থায় ন্যানসি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। তার ভাগ্য ভালো যে, সাইকস্ তার পরদিন সেই টাকা নিয়ে মনের সুখে মদ খেতে লাগলো ন্যানসির আচরণে কোনো পরিবর্তন নজর করার মতো মনের অবস্থা আর তার রইলো না।
বেলা পড়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই ন্যানসির মানসিক উত্তেজনা খুব বেড়ে গেল। সে অপেক্ষা করতে লাগলো, সাইক্স্ কখন মদ খেতে-খেতে ঘুমিয়ে পড়বে। ন্যানসির মুখে এমন একটা বিবর্ণ ভাব আর তার চোখে এমন একটা জ্বালা ফুটে উঠলো যে, সাইকসেরও তা নজরে পড়লো, কিন্তু ন্যানসিকে জিজ্ঞাসা করে এর কোনো সদুত্তর পেলো না সে।
তারপর সাইক্স্ নিঝুম হয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার পর ন্যানসিকে হাত-পা টিপে দেবার জন্যে হুকুম করলো। এরপর এক নজরে ন্যানসির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সাইক্ যেন মনে মনে বললো : ‘নাঃ এমন বিশ্বাসী মেয়ে আর একটাও নেই, নইলে তিন মাস আগেই ওর গলা কেটে ফেলতাম!”
সাইক্স্ ঘুমোচ্ছে না দেখে ন্যানসি এবার মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে কয়েক পাত্র মদ খেতে দিতেই সাইক্স্ শীগগির ঘুমিয়ে পড়লো। ন্যানসি তখন তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পোশাক বদলে চুপিচুপি ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।
রাত তখন সাড়ে ন’টা। রাস্তায় নেমে এত হন্ হন্ করে সে হাঁটতে লাগলো যে, পথিকেরা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। হাঁটতে-হাঁটতে ন্যান্স দেখলো রাস্তার দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে যতটা পারে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগোতে লাগলো হাইড পার্কের দিকে। ঘড়িতে এগারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে একটা হোটেলের সামনে এসে এদিক-ওদিক চেয়ে কয়েকবার পায়চারি করে হোটেলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। কিন্তু একটু ঢুকেই দারোয়ানের আসন খালি দেখে সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
ঠিক সেই সময়ে এক তরুণী পরিচারিকা তাকে জিজ্ঞাসা করলো : “কি চাই?” তার চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে অবজ্ঞার ভাব।
ন্যানসি বললো : “মিস্ মেইলীকে চাই।”
পরিচারিকার ডাকে একটা চাকর বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো : “কি নাম তোমার? কি দরকার তাঁকে?”
ন্যানসি তা জানাতে অস্বীকার করলো। চাকরটা তখন তাকে সদর দরজার দিকে ঠেলে আঙুল দেখিয়ে বললো : “তবে—ভাগো হিঁয়াসে।”
ন্যানসি বললো : “তা যদি বলো তো, তোমরা দু’জনে মিলেও আমাকে এখান থেকে বের করে দিতে পারবে না।”
এমন সময়ে এক ঠাণ্ডা মেজাজের পাচক এসে বললো : “আঃ! কি ঝামেলাই না তোমরা বাধিয়ে তুললে এতো রাতে! ওহে জো। খবরটা দাও না ছাই তেনার কাছে পৌঁছে। তাহলে তো হাঙ্গামা চুকে যায়।”
অগত্যা মিস্ মেইলীকে খবর দিতে গেল জো, আর বিবর্ণ মুখে রুদ্ধশ্বাসে তার আসার অপেক্ষা করতে লাগলো ন্যানসি। সেই সময় ন্যানসি পরিষ্কার শুনতে পেলো, হোটেলের পরিচারিকারা তাকে লক্ষ্য করে কুৎসিত ভাবে গালাগালি দিচ্ছে। ন্যানসি নীরবে সহ্য করে রইলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জো ফিরে এসে ন্যানসিকে নিয়ে দোতলার একটা ছোট কুঠরিতে বসালো।
.
রোজ ঘরে ঢুকতে ন্যানসি প্রথমে একটা চড়া মেজাজে বলে উঠলো : “আপনার সঙ্গে দেখা করা ভারী শক্ত ব্যাপার। আমি যদি আর দশজনের মতো রাগ করে চলে যেতাম, তাহলে হয়তো আপনাকে অনুতাপ করতে হতো সেজন্যে।”
রোজ বললো : “কেউ যদি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকে ভাই, তার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমার অনুরোধ, তুমি সেসব কথা মন থেকে মুছে ফেলো। এখন বলো, কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো।”
রোজের ঠাণ্ডা মেজাজ ও তার মিষ্টি কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে ন্যানসি প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে বললো : “আমার আসল পরিচয় না জেনে এমন সদয়ভাবে কথা বলবেন না আমার সঙ্গে। যাক, রাত বেড়ে যাচ্ছে, কাজের কথাটাই বলে ফেলি আগে—ওই দরজাটা বন্ধ আছে তো?”
ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে রোজ জানালো : “হ্যাঁ আছে। কিন্তু কেন বলো তো?”
ন্যানসি বললো : “কেননা আমি কয়েকজনের জীবন আপনার হাতে সঁপে দিচ্ছি।” বলার সাথে সাথে ন্যানসি ভীষণ মুষড়ে পড়লো।
কিভাবে নিজের মনের উদ্বেগের কথাটা পাড়বে, তা ঠিক করতে না পেরে রোজের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ন্যানসি মাথা নিচু করে বললো : “আমিই পেন্টন্ভিলের বাড়ি থেকে অলিভারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম ফ্যাগিনের আড্ডায়।”
—“তুমি!”
—“হ্যাঁ, আমিই। আমি সেই মহাপাপিনী, যে চোরেদের দলে বাস করে এবং যে জ্ঞান হবার পর থেকে ভালো পরিবেশে বাস করার কোনো সুযোগই পায়নি।”
বিস্ময়-ভরা চোখে রোজ সেই বিচিত্র নারীমূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলো। বেদনায় ভরে এলো তার মন। শান্ত গলায় সে বললো : “ভারী দুঃখ হয় তোমার জন্যে!” —“আপনি করুণাময়ী! ভগবান আপনাকে সুখে রাখুন। আমি পালিয়ে এসেছি আপনাকে খবরটা দিতে…ওরা জানতে পারলে নিশ্চয়ই আমাকে খুন করবে। আচ্ছা, আপনি মঙ্কস্ নামে কোনো লোককে চেনেন কি?”
—“না তো!”
সে কিন্তু আপনাকে চেনে, আর আপনি যে এখানে আছেন তাও তো সে জানে। আমি তার কথাবার্তা লুকিয়ে শুনেছি বলেই আপনার ঠিকানা পেয়ে এখানে আসতে পেরেছি।”
রোজ বললো : “আমি ও-নাম কখনো শুনিনি।”
—“তাহলে সে ছদ্মনামে আমাদের দলে মেশে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। অলিভারকে আপনাদের বাড়িতে ডাকাতির কাজে লাগিয়ে দেবার ক’দিন পরেই ওই লোকটা হঠাৎ ফ্যাগিনের সঙ্গে দেখা করে। ফ্যাগিন্ ওকে নিয়ে দোতলায় চলে যায় গোপনে কথা কইতে দরজা বন্ধ করে। আমার কেমন যেন লোকটাকে সন্দেহ হলো। তাই আমিও দোতলায় উঠে দ্রজার পাশে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে ফ্যাগিনের সঙ্গে ওই লোকটার গোপন পরামর্শ শুনি…তাতে জানতে পারি—অলিভার যেদিন পুলিশে ধরা পড়ে, মঙ্কস সেদিন হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়েই বুঝতে পারে যে, এতদিন যে ছেলেটার সে খোঁজ করছিলো অলিভারই হচ্ছে আসলে সেই ছেলেটাই। তখন সে ফ্যাগিনের সঙ্গে ফন্দি আঁটে যে, ফ্যাগিন্ যদি অলিভারকে আটকে রেখে চোর বানাতে পারে, তবে সে মসের কাছ থেকে মোটা টাকা পাবে।”
—“কিন্তু কি উদ্দেশ্য ওর?”
–“সেটা তখন জানতে পারিনি। কেননা, মঙ্কস জানালা দিয়ে আমার ছায়া দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে এবং ধরা পড়ার ভয়ে আমি তাদের আর কোনো কথা না শুনেই তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে নিচে নেমে আসি।”
—“তারপর?”
—“তারপর ওর দেখা পেলাম আবার কাল রাত্তিরে ফ্যাগিনের আস্তানায়। এসেই সে আগের মতো গোপন পরামর্শ করবার জন্যে ফ্যাগিকে নিয়ে দোতলার ঘরে চলে গেল। আমিও এবার সারা দেহ এমনভাবে মুড়ে নিয়েছিলাম, যাতে সে আমার ছায়া দেখতে না পায়। দরজার পাশে লুকিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনলাম। মঙ্কস্ বললো ফ্যাগিকে, “ছোঁড়াটার পরিচয়ের একমাত্র চিহ্ন এখন নদীর তলায়, আর যে-বুড়িটা ওর মায়ের কাছ থেকে সেটা নিয়েছিলো, সে বুড়িও আজ কবরে শুয়ে।” মঙ্কস আরও বললো যে, যদিও সে ওই শয়তান ছেলেটার টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিরাপদে ভোগ করছে, তবুও সে অন্যভাবে নিশ্চিন্ত হতে চায়, কেননা ওই ছেলেটাকে জেলে-জেলে ঘানি টানিয়ে এবং পরিণামে ফ্যাগিনের সাহায্যে ফাঁসির দড়ি তার গলায় ঝুলিয়ে বাপের উইলের শর্ত ভেঙে চুরমার করতে পারলে কী সুবিধে না হবে! অবশ্য বিপদের সম্ভাবনা না থাকলে সে নিজেই ছেলেটার ঘাড় মট্কাতো কিন্তু তা যখন সে পারছে না, তখন ছেলেটার জীবনের প্রত্যকটা পদক্ষেপ বিষময় করে তোলার দিকে সে নজর দেবে, আর ছেলেটার জন্ম ও তার মায়ের কলঙ্কজনক ইতিহাসের সুযোগ নিয়েও সে তার ক্ষতি করবে। সবশেষে সে বললো, ““ফ্যাগিন্, আমার ভায়ের জন্যে এমন ফাঁদ পাতবো যে, তোমারও তাক্ লেগে যাবে।”
রোজ সবিস্ময়ে বললো : “ভাই!”
ন্যানসি বললো : “হ্যাঁ, তাই তো সে বলেছে। আরও সে বলেছে যে, তার বিরুদ্ধে ভগবানের বা শয়তানের চক্রান্তের ফলে অলিভার যখন আপনাদের আশ্রয়ে এসে পড়েছে, তখন তার আসল পরিচয় জানার জন্যে আপনারা নাকি হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করতেও পেছ-পা হবেন না। যাক, রাত হয়ে গেছে—আমি এখন চলি, নইলে ওরা আমাকে সন্দেহ করবে।”
রোজ বললো : “তা, এ-খবর নিয়ে আমি কি করবো? আর, তুমিই বা সেখানে ফিরে যাবে কেন? তুমি তো বলছো যে, তোমার সঙ্গীরা সব সাংঘাতিক লোক। আমি বরং পাশের ঘর থেকে একজন ভদ্রলোককে ডেকে আনি, যিনি আধঘণ্টার মধ্যে তোমাকে একটা নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবেন।”
ন্যানসি বললো : “না, না, তা করবেন না। আমাকে সেখানে ফিরে যেতেই হবে। ওই চোরেদের মধ্যে সবচেয়ে সাংঘাতিক যে লোকটা, তাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না আমি। এমনকি যে গ্লানিময় জীবন আমি এখন কাটাচ্ছি, তা থেকে রক্ষা পাবার জন্যেও আমি তার সঙ্গ ছাড়তে পারবো না।”
রোজ বললো : “কিন্তু নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যখন একজন বালককে বাঁচাবার জন্য এত রাতে ছুটে এসেছো, তখন আমার বিশ্বাস—তোমার ভুল শোধরাবার এখনও উপায় আছে।” কথা বলতে বলতে রোজের চোখে জল এলো।
হাত জোড় করে রোজ আবার বললো : “আমার অনুরোধ রাখো—একজন মেয়েমানুষ হয়ে আমি তোমার কাছে আবেদন করছি—ভালো পরিবেশে রেখে তোমাকে রক্ষা করার সুযোগ দাও আমাকে।”
ন্যানসি হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললো : “আপনি সর্বপ্রথম আমাকে নানা সৎ কথা বললেন। উঃ, কয়েক বছর আগেও যদি ওসব শুনতাম, তাহলে হয়তো নিজেকে বাঁচাতে পারতুম। কিন্তু এখন বড্ডো দেরি হয়ে গেছে—ফেরার পথ আর নেই।”
রোজ বললো : “দেরি মোটেই হয়নি।”
আর্তকণ্ঠে ন্যানসি চেঁচিয়ে উঠলো : “দেরি হয়েছে—দেরি হয়েছে! আমি তাকে কিছুতেই ছাড়তে পারবো না, আমি তার মৃত্যুর কারণ হতে পারবো না।”
রোজ বললো : “তার মৃত্যুই বা হবে কেন?”
ন্যানসি বললো : “কেউ-ই তাকে বাঁচাতে পারবে না। আপনাকে যা বললাম তা যদি তাদের কাউকে বলি, তাহলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।”
রোজ বললো : “যে লোক আজ বাদে কাল ফাঁসির দড়ি গলায় দেবে, তার জন্যে কেন তুমি নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিচ্ছো তা বুঝতে আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না। যা হোক, তুমি যে খবর আমাকে দিলে, তা নিয়ে তদন্ত করতে হবে। এর পরে হয়তো তোমার আরও সাহায্য দরকার লাগতে পারে। তখন তোমাকে কোথায় পাবো?”
ন্যানসি বললো : “আপনি যদি আমাকে কথা দেন যে আমার ব্যাপারটা গোপন রাখবেন, তাহলে বলতে পারি প্রতি রবিবারে রাত এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আমি লন্ডন-ব্রিজের ওপর ঘুরে বেড়াবো, অবশ্য যদি বেঁচে থাকি। আপনি কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিন যে, হয় আপনি একাকিনী আমার সঙ্গে দেখা করবেন, নয় তো এমন একজনকে নিয়ে আসবেন যে অন্য কারও কাছে এ-বিষয়ে কিছু বলবে না।”
রোজ এরকম প্রতিশ্রুতি দিলে ন্যানসি চলে গেল।