1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ১৯

চিলেকোঠার সেপাই – ১৯

নবেজ অবশ্য ব্যাপারটি গোপন রাখবার জন্যে চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু করমালিকে তার সব কথা বলতে হয়েছে। করমালি অতো সোজা মানুষ নয়।
১দিন খুব ভোরে, ফর্স হতে না হতে নবেজউদ্দিন রওয়ানা দিয়েছিলো তার সাদা বলদের খোজে। তার নিজের নৌকা নাই, নৌকা ভাড়া করতে গেলে খরচ পড়ে ১৫/২০ টাকা। বড়ো বড়ো খেয়ানৌকায় উঠে সে একেকটা চরে গেছে, চরপার হয়েছে হেঁটে, চরের আরেক মাথায় এসে ফের অপেক্ষা করেছে আর ১টি খেয়ানৌকার জন্য। যমুনার ১চর থেকে আরেক চরে খেয়ানৌকায় পার হওয়া মানে এই উঠলাম-আর-নামলাম নয়। ঘন্টার পর ঘণ্টা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়ানৌকা আসে, নৌকা একবার চলতে শুরু করলে ওপারে পৌছাতে ফের দেড় ঘণ্টা দুই ঘণ্টার ধাক্কা। এইভাবে সারাটি দিন এবং ১টি রাত্রি হেঁটে ও খেয়ানৌকায় পার হয়ে নবেজ পৌঁছেছিলো ডাকাত-মারা চরে। ফিরে এসেছে ১দিন পর। গোরুর দড়ি ধরে নবেজ যখন ফিরছে, ধারাবর্ষ চরের এদিকে খেয়ানৌকা থেকে তাকে দেখতে পায় আসমত আলি। খেয়ানৌকা দেখে নবেজ মুখ ফিরিয়েছিলো অন্যদিকে, আসমত অনেক ডাকাডাকি করলেও তার দিকে তাকায়নি। আসমত মরিচ বেচতে এসেছিলো ধুনটে, সে এই বৃত্তান্ত বলে করমালির ভাই বরকতালিকে। বরকতালির কাছে শুনে করমালি সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় উত্তরপাড়া।
বিকালবেলা নবেজউদ্দিন কাথা গায়ে শুয়ে ছিলো ঘরের ভেতর মাচার ওপর। নবেজের বৌ করমালির কিরকম ভাগ্নী হয়, গলা খাকারি দিয়ে করমালি সোজা টুকে পড়ে শুকন কলাপাতা ঘেরা উঠানে। মানুষের সাড়া পেয়ে মাচা থেকে নবেজ নিচে নামে এবং মাচার তলে বসে থাকে মাথা গুঁজে। তার বৌয়ের চোখের ইশারায় জানতে পেরে করমালি তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। নবেজ কথাই বলতে চায় না। গ্রামের মানুষের চোখ এড়াবার জন্য আজ ৩দিন থেকে সে কোথায় কোথায় ঘোরে-তার বৌ পর্যন্ত বলতে পারে না। বৌটা খুব বিরক্ত,-গোরু নিয়ে এলো, কিন্তু কিভাবে উদ্ধার হলো, কি সমাচার-সব কিছু সে চেপে রাখতে চায়। বৌ এদিক ওদিক থেকে নানারকম কথা শুনে তাকে খয়বার গাজীর কথা জিগ্যেস করে, ক্যাগো, গাজীর বেটা বলে ডাকাত-মারা চরত দুনিয়ার গোরু জড়ো করছে? নবেজ তাতে বৌয়ের চুল ধরে ঘাড়ে একটা থাপ্পড় মারে, আত নাই দিন নাই, খালি খয়বার গাজীর কথা কস ক্যা? খয়বার গাজীর সাথে তোর মায়ের নিকা দিবু? কাদো কাদো গলায় নবেজের বৌ করমালির কাছে সব বললে নবেজের হাত ধরে টানতে টানতে করমালি তাকে নিয়ে আসে নিজেদের পাড়ায়। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কুয়াশায়, অন্ধকারে, নাড়ার ধোঁয়ায় কিছুই ভালো করে দ্যাখা যায় না। পচার বাপের গোয়াল ঘরের পেছনে সারের গাদার পাশে তাকে বসিয়ে করমালি সোজাসুজি জিগ্যেস করে, কও তো দামান, গোরু ফেরত পাওয়া গেলো কেমন কর্যা?
নবেজউদ্দিন কথা বলবে কি?-তার ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলা, হাত-পা কাপা দেখে মনে হয় তাকে যেন গলা টিপে মারার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে। সে কি তবে চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছে? বেশ তো, তাতে ক্ষতি কি? করমালি তাকে অভয় দেয়, তারাও না হয় বাটপাড়ি করবে, তাতে নবেজের অপরাধ বিভক্ত হয়ে তারভার লাঘব হবে। নবেজ তবু কাপে হয়তো করমালির হাত থেকে নিজের রোগা-পটক গলা বাচাবার জন্যে সে জানায় যে, সে গিয়েছিলো ডাকাতমারা চরে। না, না, তার কোনা দোষ নাই, এটা তার নিজের সিদ্ধান্ত নয়। খয়বার গাজীর খাস বর্গাদার কিসমত সাকিদারের পরামর্শে সে ওদিকে রওয়ানা হয়। মাসে ১০ টাকা হার সুদে কিসমত তাকে ৬০ টাকা ধারও দেয়। নগদ ৫০ টাকা এবং এই ব্যাপারে পূর্ণ নীরবতা পালনের অঙ্গীকার দিয়ে সে তার গোরু ফেরত পেয়েছে। কোরান শরীফ ছুয়ে নবেজ কথা দিয়ে এসেছে যে, কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির কানে এই কথা দেবে না। এই কথা ফাঁস হয়ে গেলে নবেজউদিনের কপালে যে কি আছে তা কেবল সে-ই জানে, আর জানে খয়বার গাজী, আর জানে খয়বার গাজীর প্রধান সহকারী ও অংশীদার হোসেন আলি ফকির। এদের নাম বলতে বলতে সে কাপে এবং কিছুক্ষণ পর তার ভাগ্য সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞাতদের তালিকায় সর্বজ্ঞ আল্লাতালার নাম যোগ করে। এতো কথা বলে ফেলার পর নবেজউদ্দিন কিছুক্ষণ কাঁদে এবং নাক চোখ না মুছেই করমালির ঠোঁটের বিড়িটা চেয়ে নিয়ে কয়েকটা টান দেয়।
বিড়ি খেয়ে সে ঘ্যানঘান করতে শুরু করে নতুন উদ্যমে। এই বিশাল পৃথিবীতে করমালি ছাড়া কোনো কাকপক্ষীও এসব কথা জানে না। করমালির হাতে তার জীবনমরণ, করমালির মুখ থেকে এইসব কথাবার্তা বেরিয়ে পড়ে তো খয়বার গাজীর লোকজন নবেজউদ্দিনকে বাড়ি থেকে, গ্রাম থেকে তো বটেই, এই সাধের দুনিয়া থেকেও তাকে উৎখাত করবে। অথচ এবার বর্গাচাষ করে সে ফসল পেয়েছে ভালোই, বাড়ির পেছনে খাইখালাসি দেওয়া ১০ শতাংশ জমিটাও তার উদ্ধার হয়ে যাবে। এবার এমন কি বর্ষাতে তার বৌটাকে বাপের বাড়ি না পাঠালেও চলবে। ৫০টা টাকা গেছে, তা যাক। ওদেরও তো খরচা আছে। গোরু নিয়ে গেছে, গোরুকে জাবনা দিতে হয়েছে, গোরু দ্যাখাশোনার জন্যে কতোগুলো লোক পুষতে হয়। তারপর থানা সামলাও রে, আইয়ুব খার পাটির মেম্বারদের সামলাও রে, এমএনএ, এমপিএ, চেয়ারম্যান-কিসব হাবিজাবি, এদের কি লেখাজোকা আছে? এদের আদর্যত্ন করো, খাতিরদারি করো টাকা তো ওদেরও যায়! না, মামু খয়বার গাজী মানুষ খারাপ না। কলকাঠি নাড়ে সব হোসেন আলি ফকির!’ খয়বার গাজী চরের দিকে কোনোদিন পা-ও মাড়ায় না। আসল শয়তান হলো হোসেন ফকির। কার গোরু নিতে হবে, কার কতো জরিমানা ধার্য করা হবে, গোরু ফেরত দেওয়া যাবে না কাকে, কাকে মেরে পুঁতে ফেলতে হবে যমুনার নতুন চরে—সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক হোসেন আলি। খয়বার হাজার হলেও ভালো বংশের মানুষ, তার ছেলেপেলে সব লেখাপড়া জানা শহুরে লোক, তার এক ছেলে বিলাত থেকে ঘুরে এসেছে। না, হোসেন আলি ফকিরের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নেওয়া ছাড়া এইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খয়বার গাজীর কিছুমাত্র যোগ নাই।-নবেজউদ্দিন এক নাগাড়ে কথা বলে, কথা বলার পালা এখন তার। ৫০ টাকা জরিমানা দেওয়ার কথটা বলে এতো ভয় পেয়েছে যে, খয়বার গাজীর প্রতিশোধের কথা ভেবে সে নিজেই খয়বারের পক্ষে যুক্তি তৈরি করছে। খয়বার গাজী ভালো, সে নিষ্পাপ পুরুষ—এমনকি নিজের মধ্যেও এই বিশ্বাস খাড়া করার জন্যে নবেজ তখন অস্থির। কিন্তু এইসব বলতে বলতে তার বোধোদয় ঘটে যে, দাপট হোসেন আলিরও কম নয়। গতবার বড়ো ভোটের সময় আইয়ুব খানের ফুল মার্ক ক্যান্ডিডেটের পক্ষে এই এলাকার মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংগঠিত করেছে তো সে-ই। হারিকেন মার্কার ক্যান্ডিডেট ছিলো খয়বারের কি রকম আত্মীয়, খয়বার তাই একটু চুপচাপ ছিলো। এমএনএ হওয়ার পর ফুল মার্কা শালা এদিকে এসে খয়বার গাজীর বাড়িতে যতোই উঠুক, সে চেয়ারম্যান হোক আর মেম্বার হোক, কাজের মানুষ হলো হোসেন আলি। এই যে মেম্বারগুলো,-বেঈমানের বেঈমান, মোনাফেকের বাপ মোনাফেক-এদের সামলায় কে? হোসেন আলি ছাড়া আবার কে? সুতরাং হোসেন আলিকেও ভয় পাওয়া নবেজউদিনের কর্তব্য এবং তাই সে বলে, তারই দোষ দেই কি? চরের মদ্যে তার দাপট কি আজকালকার কথা গো? তা অবশ্য ঠিক। ২৫/২৬ বছর আগে যমুনায় ডাকাত-মারা চর যখন জেগে ওঠে তখন থেকে সেখানে তার বাথান। চরের একদিক ভাঙে, বাথানও সরে যায় অনদিকে। জামালপুর মহকুমার চর থেকে এমনকি বীর এলাকা থেকে গোরু বাছুর মোষ সব নৌকায় ভাসিয়ে সে নিয়ে আসতো এদিকের চরে। ওদিকে বালিজুড়ি, এদিকে ডাকাত-মারা চর-এই ২জায়গার নাম শুনলে গোরুওয়ালা চাষার বুক কাপে কি আজ থেকে? হোসেন আলির মস্ত বড়ো জলঙ্গি নৌকা যমুনার কোনো ঘাটে বাধা দেখলে সেই এলাকার মানুষ রাত জেগে গোয়াল পাহারা দেয়। এসব কি আজকের কথা? গোরওয়ালাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের ফন্দি কিন্তু তার মাথায় আসেনি। এই শালা খয়বারের বুদ্ধিতে তার এই ব্যবসার শুরু। খয়বার গাজীর কথা না শুনলেও আজকাল তার চলে না। ইউনিয়ন বোর্ড, আইয়ুব খানের পাটি, ভোট –এসবের মধ্যে না থাকলে এখন কোথাও সুবিধা করা মুশকিল। একবার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের গম সবটাই বেচে দেওয়ার সুযোগ করে দিলো খয়বার, তখন থেকে এসব লাইনে ঢুকলোসে। না, হোসেন আলি মানুষ ভালো, তার দেলটা পরিষ্কার।
এসব এলোমেলো কথা শোনার পর করমালিকে চুপচাপ থাকতে দেখে নবেজের ভয় ফের মাথাচাড়া দেয়। তার শ্বাসকষ্ট হবো হবো করে, হঠাৎ করে করমালির একটা হাত ধরে বলে, তোমার পাওত পড়ি মামু, ইগল্যান কতা কাকো কবা না। করমালি উঠে দাঁড়ালে নবেজ ফের তার হাত ধরে, মামু ইগল্যান কথা অস্ট্র হলে হামার বাড়িঘর ব্যমাক পুড়া দিবো গো! তুমি হামাক জবান দ্যাও, কাকো কয়া দিবা না, কও!
এদিকে পচার বাপের ছেলে পচা তখন গোয়ালঘরে ঢুকেছে। নবেজউদ্দিন করমালির প্রতিশ্রুতি না নিয়েই আড়ালে চলে যায়।
সেই রাত্রিটা করমালির খুব অস্থির কাটে। সারারাত ছটফট করে একটু ঘুমিয়েছে, ভোরবেলার দিকে স্বপ্ন দ্যাখে, চষা জমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নবেজউদ্দিন, নবেজের হাতে মাছ ধরার তরা জাল। নবেজের আগে আগে এক ভদ্রলোক। ‘কেডা গো? নবেজ জবাব দেয়, চিনলা না? হোসেন আলি ফকিরের ব্যাটা। করমালি জানতে চায়, কোটে যাও?’ নবেজ হাসতে হাসতে বলে, টাউনেত থাকে, বাড়িত আসা মাছ ধরার সখ হছে! স্বপ্লের মধ্যেই করমালির মনে হয়, হোসেন আলির ছেলে মাছ ধরা দাখার জন্য এই গ্রামে আসবে কেন? এই কথা ভাবতে ভাবতে নবেজ কোথায় উধাও হয়, পাটকিলে রঙের একটা কুকুর সেই ছিপছিপে ভদ্রলোককে তাড়া করে। করমালি বলে, ‘তু তু ধর শালাক ধরা ভদ্রলোক সামনের দিকে দৌড়ায় এবং কুকুর ঘেউঘেউ করতে করতে তার পেছনে ছোটে।
কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজে করমালির ঘুম ভাঙ্গে। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। বাইরে একটা কুকুর অবিরাম ডেকে চলেছে। করমালির তলপেটে তখন বেগ হচ্ছে, পানি ভরা মাটির বদনা হাতে সে বেরিয়ে পড়লো।
বাইরে কুয়াশা। বাড়ির সামনে কলাগাছের পেছন দিকে তাকিয়ে নেড়ি কুত্তাটা ডেকেই চলে। কলাগাছের ঝাড়ের ওদিকে জমির আলের দিকে যাচ্ছিলো করমালি, হঠাৎ চমকে উঠে দ্যাখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে নবেজ। কুকুরের ভয়ে কাঁপতে পারে, আবার শীতও পড়েছে সাঙ্ঘাতিক, তার গায়ে পোষাক বলতে কেবল ১টি জামা, নবেজ তাই শীতেও কাঁপতে পারে।
কারমালি বলে, ক্যাগো তুমি? এই জাড়ের মদ্যে খাড়া হয়া আছো? কি সমাচার?
এবার কাপে নবেজের গলা, না এমনি!’
একটু-আগে-দ্যাখা স্বপ্ন এবং একটু-আগে-বোধ-করা তলপেটের বেগ ভুলে করমালি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নবেজ হঠাৎ তার পায়ের ওপর পড়ে যায়, একটু হলেই করমালির বদনা তার মাথায় পড়তো। নবেজ কাঁদতে কাঁদতে বলে, মামু, তুমি হামাক বাঁচাও কাল তোমাক কি কছি না কছি হামি দিশা পাই নাই। অরা মানুষ খুব ভালো মামু, মানুষ খারাপ লয়। হোসেন ফকির মানুষ লয় বাপু উদিনক্য শালা হামার টাকা লিয়া আঙুলেত ছাপ দিয়া এটা এটা করা গোণে আর কয়, শালা ছোটোজাতের পয়দা, ইগল্যান কথা আষ্ট্র হলে তোর জান থাকবো না। মামু, তার কি? তার কিছু হবে না। হামাক ঝাড়ে বংশে শ্যাষ করবো! মামু, তুমি হামার ধর্মের ভাই, তোমাক কারুবারু করি, কাকো কিছু কয়ো না! তুমি হামাক জবান দ্যাও সে কিছুঁতেই করমালির পা ছাড়ে না। এদিকে করমালির পায়খানার চাপ ফের ফিরে এসেছে, সে পা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, দিলাম!’
কিন্তু কথা দিলেও নবেজউদিনের গোরু ফেরত পাওয়ার ঘটনা করমালি যাকে পায় তাকেই বলে।
খালি খালি মানুষটাক নিয়া টানাটানি করব, টাকা না দিলে গোরু অরা দিবে। না-পচার বাপ জ্যাঠাকে এই কথা বলে নবেজউদিনের কাহিনী সে বিস্তৃতভাবে বলার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু পচার বাপ তাকে আমল না দিয়ে দাঁড়ায় জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে। তার ফ্যাসফেসে গলা যতোটা পারে কোমল করে সে বলে, আপনে কলে পরে তারা শুনবো গো! হামরা চাষাভূষা মুখ্য মানুষ, হামাগোরে মূল্য কি? আপনে শিক্ষিত মানুষ, তাইও শিক্ষিত। হামরা গরিব-গরবা চাষা, হামাক বেচলেও দশ টাকা বারাবো না, ছেঁচলেও বারাবো না। আপনে এ্যাঁন কয়া দ্যাখেন, এই গায়ের সোগলি আপনেক মানে। খালি এই গেরাম কিসক, তামান ইউনিয়নের মদ্যে আপনের একটা কথা ফালাবার পারবো কেটা?
জালাল মাস্টার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বেঢপ খাচার মতো বুক থেকে তার ফসফস করে বাতাস বেরোয়, কিন্তু সেটা হাঁপানির টান নয়। তার নিজের সম্বন্ধে প্রকাশিত পচার বাপের মতামত সে সম্পূর্ণ অনুমোদন করে, তা ধরো, আমি কথা একটা কলে কেউ ফালাবার পারবো না। তার প্রভাবাধীন এলাকা সে আরো সম্প্রসারিত করতে চায়, এতদঞ্চলে, এই তামাম থানার যতো বড়ো অফিসার দেখবা, ম্যাজিস্ট্রেট কও পুলিশ কও আর জজ হাকিম ৬াক্তার ইঞ্জিনিয়ার-যার কাছে যে কামে যাই আমাক প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা কারো নাই।’ বলতে বলতে সে একটু থামে, হয়তো নিজের সম্বন্ধে এতোটা বলে ফেলে সে একটু লজ্জা পেয়েছে কিংবা আনোয়ারের সামনে একটু সঙ্কোচও হতে পারে। এবার একটু বিনীত ভঙ্গিতে বলে, তা কাকো তো কোনোদিন কোনো অনুরোধ করি নাই, তাই-।
করমালি বলে, আপনে গেলে খালি খালি বেইজ্জত হবেন। টাকা না হলে গোরুর একটা খুরও দিবো না!
জালাল মাস্টার সোজা হাটতে শুরু করে। এখনো তার নাক দিয়ে ফসফস করে বাতাস বেরিয়ে আসছে। করমালির ওপর সে বিরক্ত, তার ফুলে-ওঠা বুকটাকে ছোড়া একেবারে ফুটো করে দিয়েছে। মাঠের ভেতর আল পেরিয়ে দুজনেই এসে পড়েছে বৈরাগীর ভিটার কাছাকাছি। কয়েক পা পর বটগাছের এলাকা। পেছন থেকে ডাকে পচার বাপ, ও ভাইজান পা চালিয়ে জালালউদিনের পাশে এসে বলে, ভাইজান, কথাটা শোনেন। চ্যাংড়াপ্যাংড়ার কথা থোন! আপনে চলেন, হামরাও যামো!’
‘কোথায়?
গাজীর ব্যাটার কাছে না যান তো ডাকাত-মারা চর চলেন।’ আনোয়ারকে দেখিয়ে পচার বাপ বলে, এই চ্যাংড়ার চাচার নাও বান্দা আছে খালের ধারে, তাই তো আপনের সম্বন্ধীই হয়, আপনে কলেই নাও পাওয়া যাবো। খালেত এখন পানি নাই, তো নাও হামি কান্দোত করা নিয়া যামু মুলবাড়ির ঘাট।
নৌকা না হয় হলো, চরে অনর্থক যায়া ফল কি? বলতে বলতে জালাল মাস্টার বটগাছের দিকে হাঁটে।
আনোয়ারের চোখের সামনে এখন কেবল বটগাছ। পাশে জালাল মাস্টার, পাশে পচার বাপ, পেছনে মাঠের ওপার থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে করমালি, করমালির ছোটো বাড়ির সামনে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা চাষারা। কিন্তু বটগাছের এলাকায় পা দিয়ে সাঙ্ঘাতিক নির্জন মনে হচ্ছে। যেন জনমানবহীন বড়ো ১টি প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছে। জালাল মাস্টার বলে, বুঝল্যা আনোয়ার, এই বটগাছের বয়স কম করা হলেও আড়াইশো বছর তো হবেই ধরো—। কিন্তু পচার বাপ তাকে কথা শেষ করতে দেয় না, ‘কথাটা শোনেন ভাইজান ডাকাত-মারা চরেত হোসেন ফকিরেক কলে কাম হবো। হোসেন ফকির এখন থাকে ঐ চরেত, কিন্তু বাড়িঘর, জোতজমি, চাষবাস সব ধারাবর্ষা চরের মদ্যে। ধারাবর্ষা চরে মিয়াগোরে জমির বর্গাও তারই হাতোত আছিলো। এবার সে তাকায় আনোয়ারের দিকে, আপনের দাদার আমল থাকা হোসেন ফকিরের বাপ ঐ জমিত বাস করে। আপনের দাদা বড়োমিয়ার মেলা জমি তাই বর্গ নিছিলো, আপনের বাপচাচারা সব বেচ্যা দিছে তারই কাছে। অনেকদিনের কায়েমি চর, ধান পাট কালাই খুব ভালো হয়। আপনে গেলেও খুব কাম হলোনি গো!
কিন্তু আনোয়ার তখন দুই চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে বিশাল বটপ্রসাদ। যেদিকে চোখ পড়ে কেবল গাছের ঝুড়ি। অজস্র ঝুড়ি নেমে এসেছে ওপরের ডাল থেকে। অনেকগুলো ঝুড়ি দেখতে মোটা থামের মতো। এরকম থাম যে কতো গুণে শেষ করা যাবে না। আবার অনেকগুলো ঝোলে দড়ির মতো। মোটা থামগুলোর শরীরে শাদা কষ। স্নান ধূসর বাকলের ওপর এই কষ দেখে পুরনো বাড়ির নোনা-ধরা থামের কথা মনে পড়ে। আর ঝুলন্ত ঝুড়িগুলো একাগ্রচিত্তে মাটির দিকে নামছে, একদিন এরাও মাটি ছোবে, চুকে পড়বে মাটির ভেতর, পরিণত হবে একেকটি স্তম্ভে। কুড়ি ও থামের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেছে ১টা রাস্তা, রাস্তায় সাইকেলের চাকার দাগ। ১টা জায়গায় থাম ও ঝুলন্ত ঝুড়ি এমনভাবে সাজানো যে, একটু-ভাঙা পুরনো খিলানের মতো মনে হয়। এই সব থাম, কাণ্ড, ডালপালা, ঝুলন্ত ঝুড়ি নিয়ে বটবৃক্ষ কি কেবল বেড়েই চলবে? জালাল মাস্টার ও পচার বাপের সঙ্গে আনোয়ার বট এলাকার একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো কয়েক রকম পাখির বিচিত্র কলরব। এই কোলাহল এরকম আকস্মিক মনে হচ্ছে কেন? এটা কি এতোক্ষণ স্থগিত ছিলো? মাঠ থেকে, এমন কি বটগাছের তোরণে পা দিয়েও তো এর কিছুই বোঝা যায়নি। এর মানে কি? কিন্তু মানে বোঝার আগেই পচার বাপের প্রতি জালাল মাস্টারের কথা শোনা যায়, না, না, আনোয়ার যাবে কোথায়? ধারাবর্ষা কি এখানে?
‘না, আমার আপত্তি নেই। চলেন না। কবে যাবেন? আনোয়ার রাজি হওয়ায় পচার বাপ তার হাত জড়িয়ে ধরে, যাবেন? তুমি, আপনে, আপনে গেলে গরিবের বড়ো উপকার হয় বাবা। হোসেন আলী ফকিরকে কয়া বলা হামার গুনা গরিটা মাপ করায়া দাও বাপ। আল্লা আপনার ভালো করবো বাবা!
‘গুনাগারি? আনোয়ার দাঁড়ায়, গুনাগরি কিসের?
ঐ তো হলো বাপ। জরিমানা আর কি? পচার বাপ বোঝাতে চেষ্টা করে, জরিমানা কও দণ্ড কও, ট্যাকসো কও, খাজনা কও—ইগল্যান কি?-মানুষের পাপগুনার শাস্তি, নাকি কন, ভাইজান? মানুষের পাপের শাস্তি সম্বন্ধে তার মতামতের অনুমোদন লাভের জন্যে জালাল মাস্টারের দিকে তাকিয়ে পচার বাপ আনোয়ারকে বলে, ‘একদিক চলেন বাবা ফজরের আজানের আগেই নৌকা দিয়া মেলা করলে আগাবেলার মদ্যেই ধারাবর্ষা যায়া ওঠা যাবো। তাক বাড়িতে না পালে যামো ডাকাত-মারা চর। দুইটা চর এক্কেরে কাছাকাছি।
যাবো। কবে যাবেন?’
কিন্তু ইতস্তত করে জালাল মাস্টার, না বাপু টাউনের অধিবাসী। নদী খাল চরের মদ্যে ঘোরাঘুরি করলে একটা রোগ ধরতে কতোক্ষণ?
না আমার কোনা অসুবিধা হবে না।’ আনোয়ারের জেদ বেশ টের পাওয়া যায়। জালাল মাস্টার কিছু না বলে কেবল বটগাছের সাম্রাজ্য দ্যাখে।
আপনে বাড়িত যায়া বোঝেন আজ পাছাবেলা আপনের বাড়িত যামো, তখন না হয় তারিখ ঠিক করা যাবো। তো বাবা, গেলে দুই একের মদ্যেই যাওয়া লাগবো। নিচু ও শপষ্টভাবে কেবল আনোয়ারের উদ্দেশে বলে পচার বাপ তার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। তার চলে যাওয়াটা একটু আকস্মিক, তার অনুরোধে আনোয়ারের সায় পেয়ে সে হয়তো অভিভূত, তাই ঠিকঠাক নিয়মমতো বিদায় নিতে ভুলে যায়। আবার এও হতে পারে যে, আনোয়ারকে সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগ সে দিতে চায় না।
কিন্তু এসব নিয়ে আনোয়ার মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না। জালাল মাস্টারের মতো সেও তখন সম্পূর্ণভাবে বটগাছের কজায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *