1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ২৭

চিলেকোঠার সেপাই – ২৭

জুম্মনের মা, এইগুলি কি শুনি? কয়মাস চলে? কামরুদিনের প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে ভয় পেয়ে জুম্মনের মা সত্যি কথাটাই বলে। জবাব শুনে কামরুদিন স্বস্তি পায়, তাইলে চিন্তা নাই। দুই চাইর দিনের মইদ্যে প্যাট খসাইয়া ফালা!
জুম্মনের মা উসখুস করে। গতকাল সন্ধ্যায় ঘরে ডেকে নিয়ে কামরুদ্দিনকে মহাজন তাহলে পটিয়ে ফেলেছে।
কামরুদিনের অসম্ভষ্ট চেহারা দেখে রহমতউল্লা কাল খুব হাসছিলো। পরিণত ও অভিজ্ঞ বয়স্ক মানুষের সস্নেহ হাসি, তাতে প্রশ্ৰয় মেশানো। কামরুদ্দিন হলো বড়ো ঘরের ছেলে, তার পূর্বপৃরুষরা সব কীর্তিমান রাজমিস্ত্রি, নবাব বাড়ির গম্বুজটা তার দাদার বাপের তৈরি। আর সে কি-না নিকা করবে যে মেয়েমানুষকে তার পেটে এখন ছোটোলোকের সন্তান? না, না, কামরুদিন তো বটেই, রহমতউল্লাও এটা বরদাশত করে কি করে?–তবে এটা কি কোনো সমস্যা হলো? কতো উপায় বেরিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায়, রাস্তার মোড়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর ক্লিনিক। ২/৩ মাসের পোয়াতি হলে তো কথাই নাই, ক্লিনিকে একবার নিতে পারলেই হয়। আধা ঘণ্টা ভি লাগবে না, খালাস কইরা দিবো। জুম্মনের মায়েরে শাড়ি দিবো একখান, নগদটাকা দিবো কুড়িটা। দেশে অবাঞ্ছিত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রহমতউল্লা বড়ো উদ্বিগ্ন। এই যে সরকারের উন্নয়নের তোড়, ১০ বছরের ডেভেলপমেন্ট, সব ব্যর্থ হবে লোকে যদি সন্তান জন্ম দেওয়ার কাজে একটু চিলা দিতে না পারে।
মহাজনের শিখিয়ে দেওয়া পরিকল্পনার কথা কামরুদিনের মুখে শুনে জুম্মনের মা হেসে গড়িয়ে পড়ে, কি যে কন আপনে অহনতরি পোলাপানই রইলেন।’
‘ক্যামনে?
তয় কি? এইটা কি পুরান বাড়ির ছাদ পাইলেন? লোহার একটা বাড়ি মাইরা পলেস্তারা খসাইয়া ছাদ ফালাইয়া নয়া ঢালাই আরম্ভ করলেন। জুম্মনের মা বানানো হাসিটাকে কষ্ট করে টিকিয়ে রাখে, পয়দা হওনের আগে জানটারে কবচ করবার চান?
পরপর কয়েকদিন একইভাবে হেসে আর কথা বলে জুম্মনের মা কামরুদ্দিনকে একটুও ভেজাতে পারলো না। আবার মহাজনের ভাতের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ার পরিকল্পনাতেও জুম্মনের মা রাজি হয় না। কামরুদিন একদিন চটে যায়, ঠিক আছে। ঐ ভ্যাদাইমার লগে পইড়া থাক। জুম্মনরে আমার কাছে পাঠাইয়া দিস।’
জুম্মনের ব্যাপারে জুম্মনের মা কামরুদিনের ওপরেই বা ভরসা করে কিভাবে? মহাজন তার জন্যে বর্ণমালা এনে দিয়েছে, কাল পয়সা দিলো আদর্শ লিপি কিনতে। স্কুলে ভর্তি হলে সব খরচ জোগাবে মহাজন। মহাজন যদি সাহায্য করে তো আল্লার মেহেরবানীতে জুম্মন এমনকি ম্যাট্রিক পাস করতে পারে একদিন মহাজন যদি ১টা রিকশা কিনে দেয়, রিকশার ভাড়া যদি দিতে না হয় তো সেটা চালিয়ে জুম্মন তার নিজেই একদিন কতো রিকশার মালিক হবে। বেবি ট্যাকসি একটা কিনতে হবে কতোক্ষণ?—খিজিরের সঙ্গে থাকলে?—অসম্ভব! পেটেরটা দুনিয়ার মুখ দ্যাখার পর খিজির তো জুম্মনকে সহ্যই করতে পারবে না।
এর মধ্যে খিজির একদিন এসেছিলো। তখন অনেক রাত, মহাজনের বাড়ি থেকে ফিরে জুম্মনের মা কেবল খেতে বসেছে। খিজিরকে দেখে খাওয়া দাওয়া তার মাথায় উঠলো। ‘চোরের লাহান কি করতে আইছো? বাপ হওনের হাউস করো, পোলারে খাওয়াইতে পারবা? পরাইতে পারবা? বাপ হইবার চাও!—হায়রে মরদ!’
খিজির বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। বজলু শালার ঘরে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বস্তি ছাড়লে কি হয়, এই মহল্লা খিজির ছাড়বে না। জুম্মনের মাকে পাহারা দেওয়ার জন্য কাছাকাছি থাকা দরকার। আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য কথা দিয়েছে, খিজিরকে যে করে হোক এই এলাকাতেই থাকার বন্দোবস্ত করে দেবে। মহাজনের বস্তিতে কামরুদিনের বসবাসের সম্ভাবনার কথা শুনে আলাউদ্দিন মিয়া একটু ভাবনায় পড়েছে। রহমতউল্লা তাহলে মহল্লায় নিজের শক্তিবৃদ্ধির আয়োজন করছে? কামরুদিন এসে পড়লে খিজিরকে আলাউদ্দিন মিয়ার দরকার হবে আরো বেশি। বড়ো কথা, খিজিরের মতো এরকম জেনুইন ওয়ার্কার পাবে কোথায়? মামুজান অবশ্য কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, মহল্লার নেতৃত্ব তার হাত থেকে প্রায় যায় যায়। সেদিনকার পোলাপান—এখনো হাফপ্যান্ট পরে-তারা কিনা রহমতউল্লার বাড়ির সামনে দিয়ে হঁটিতে হাঁটতে একসঙ্গে চিৎকার করে, আইয়ুব খানের দালালরা -ভুট্টা দিয়া ছাতু খা’ মুশকিল হয় সিতারাকে নিয়ে। আলাউদ্দিন তাকে অনেকটা হাত করে এনেছে, তবে বাপের সম্বন্ধে এইসব টিটকিরি তার গায়ে লাগে, আলাউদ্দিন মিয়া গেলেই প্যানপান করে, আপনেরা আব্বার লগে কি শুরু করছেন?
আরে পোলাপানের কথা ছাড়ো!’
পোলাপানে তো আপনারই সাগরেদ। খিজিরটারে আব্বায় খেদাইয়া দিলো, অরে জায়গা দিলেন আপনে আব্বায় কয়, ভাইগ্লা কুনোদিন আপন হইতে পারে না! এখন মামুজানের মেয়েটিও যদি তাকে আপন করে নিতে অস্বীকার করে এই ভাবনায় আলাউদ্দিন মিয়ার প্রেমগদগদ বুক নেতিয়ে পড়ে। খিজিরকে ডেকে বলে, দাখ, মামু বুইড়া মানুষ, তারে ইজ্জত করতে হয়। তুই আমার গ্যারেজের মইদ্যে থাকস, মামুজানে কয়, ভাইগ্রা আমারে বেইজ্জত করবার লাইগা অরে রাখছে!’
এই মহল্লা ছেড়ে খিজির এখন কোথাও যেতে পারবে না। এই ব্যাপারে আলাউদ্দিন মিয়া তার সঙ্গে একমত। কিন্তু জুম্মনের মায়ের পেটে গচ্ছিত তার সন্তানের নিরাপত্তার জন্যে খিজিরের উদ্বেগ দেখে আলাউদ্দিন মিয়া অবাক, তুই হালায় আদমি না পায়জামা? আরে আউজকা বাদে কাউলকা ঐ মাগী বলে নিকা বইবো কামরুদিনের লগে, তার প্যাটের বাচ্চার লাইগা তুই দিওয়ানা হইয়া গেলি? খিজির এই ধিক্কারে কোনো সাড়া না দেওয়ায় আলাউদ্দিন তার পরিকল্পনার কথা ফিসফিস করে জানায়, ‘শোন। মামানীরে আমি হিন্ট দিয়া রাখছি, জুম্মনের মায়ের ক্যারেক্টার খারাপ, অরে রাইখা ঘরের বদনাম হইতাছে। দুইটা দিন যাইতে দে না। কামরুদিনের লগে নিকা বইবো তো, দুইটারে একলগে খেদাইমু মহল্লার ধারে কাছে ভি আইবার পারবো না!’
রাত ১টার দিকে রিকশা নিয়ে এসে খিজির দ্যাখে গ্যারেজে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জুলছে ৪টে। কাল ভোরবেলা থেকে পরশু বিকালের জনসভা সার্থক করার প্রস্তুতি শুরু হবে। এখন সেই প্রস্তুতির প্রস্তুতি। ছাত্রকর্মীদের কেউ কেউ বসে পোস্টার লিখছে, চাটাইয়ের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে বড়ো বড়ো পোস্টার। ১টি পোস্টারে ১জন সৈন্যের ছবি। তার মাথায় হেলমেট, কোমরে ফিট করা পিস্তল, হাতে রাইফেল। তাক-করা রাইফেলের সামনে হাজার হাজার মানুষের মিছিল। সৈন্যের চোখ দুটো কালো কাপড়ে ঢাকা। এর মানে কি? যে ছেলেটি ছবি আঁকছিলো সে বুঝিয়ে বলে যে মিলিটারির লোকজন অন্ধের মতো মানুষ হত্যা করে চলেছে।-কেন, মিলিটারির লোক কি কানা?—ছেলেটি গম্ভীর হয়ে বলে, ‘কানাই তো। কানা বলেই নির্বিচারে নরহত্যা চালাতে পারে।
কি জানি? খিজিরের কিন্তু মনে হয় না। আইয়ুব খান কি অন্ধ? শয়তানের চোখ বরং সংখ্যায় অনেক বেশি, আগে পিছে সে অনেক কিছু দেখতে পায়। তার হাত থেকে বাচতে হলে তার চোখগুলো চিরকালের জন্য অন্ধ করে দেওয়া দরকার। কথাটা ভাবতে ভাবতে খিজির গ্যারেজের ১ কোণে বিছানা পাতার উদ্যোগ নেয়। ১টি ছেলে বলে, ‘আজ এখানে শোবে কোথায়? আমরা আজ গোটা ঘর দখল করেছি।
তাদের পোস্টারের রঙ এখনো কাচা, পোস্টার মেলে রাখতে না পারলে ছবি লেস্টে যাবে। অনেক জায়গা দরকার, আরেকটি ছেলে বলে, আলাউদ্দিন ভাই বলছিলো তুমি নাকি আজ ওসমান সায়েবের ঘরে শোবে।’

এতো রাতেও ওসমান সায়েবের ঘরে আলো জুলছে। ওসমান বলে, ‘থাকো না? দাঁড়াও, মেঝেতে একটা সতরঞ্চি পেতে দিই!’
খিজির আসায় ওসমান বেশ খুশি। আনোয়ারকে চিঠি লেখার পর কেমন ফাকা ফাকা ঠেকছিলো। খিজিরকে পেয়ে মাথাটাকে ব্যস্ত রাখা যাবে। ওসমান একটা কিং স্টক এগিয়ে দিলে খিজির বলে, আমার বিড়ি আছিলো।
থাক না। তুমি তো এই সিগ্রেটই খাও দেখি।’
কয়দিন হইলো বিড়ি ধরছি। সিগারেটে জুত পাই না। বিড়িটা ধরাইয়া দুইটা টান দিলে শরীলটা গরম হইয়া ওঠে!’
কিন্তু ওসমানের দেওয়া কিং স্টর্কে তার প্রাণপণে টান দেওয়া দেখে মনে হয় না যে সিগ্রেটে তার কিছুমাত্র অরুচি ধরেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *