চিলেকোঠার সেপাই – ৪২
৩ দিন রহমতউল্লা অনেকটা সামলে উঠেছে। তার বেইশ অবস্থা কেটে গেছে, ব্লাড-প্রেশার স্বাভাবিক, গতরাতে ঘুমও ভালো হয়েছে। তবে শরীরের ডান দিকটা তার একেবারে অবশ, যতদিন বাঁচে এটাকে এমনি করে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। আজ সকাল থেকে তার কথাবার্তা অর্থাৎ বিলাপ ও গালাগালি ফের শুরু হয়েছে। কিন্তু জিভ, ঠোঁট ও টাকরার ১টা সাইড অকেজো বলে বেশির ভাগ শব্দ পরিণত হয় ধ্বনিসর্বস্বতায়। মেয়েকে পাশে বসিয়ে সে কাঁদে, বৌয়ের কান্না দেখে কাঁদে, আলাউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে কাঁদে। তাঁর মৃত পুত্র আওলাদের নাম ধরেও কাঁদে। আবার জুম্মনের মাকে দেখেও মহাজন হাউমাউ করে কাঁদে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে তার বিলাপ মোটামুটি আন্দাজ করা যায়: এই বাড়ির খাইয়া পোলাটা মানুষ হয়েছে। ছ্যামরাটার কুনোদিন গোলামের লাহান দেহি নাই। আউজকা উই মরে গুলি খাইয়া, এ্যাঁ? আল্লার কাছে কি গুনা করছিলো, আল্লা মালিক, আল্লাই জানে!
না, না, খিজির গুনা করবে কেন? ওসমান সান্তুনা দেয়, মিলিটারি তো চারদিকে মানুষ মারছে, এর প্রোটেস্টে খিজির মিছিলে বেরিয়েছিলো!
‘আব্বার লগে এইগুলি কইয়া লাভ কি? আব্বা কি জানে? সিতারার এই কথা শুনে ওসমান তখন তাকেই দ্যাখে। ওসমান অবশ্য দেখতে এসেছে রহতমউল্লাকে। সিতারা এখন দিনরাত কেবল রুগ্ন বাবার শুশ্রুষা করে, নইলো তার সঙ্গে এতাক্ষণ একই ঘরে বসে থাকার কথা ওসমান কি ভাবতেও পারে?
তা ঠিক! সিতারার কথায় ওসমান সায় দেয়, উনি তো কারেক্ট সিচুয়েশনটা জানেন না।
আলাউদ্দিন মিয়া একটু বাইরে গিয়েছিলো। আধঘণ্টা পর ফিরে এসে কি ১টা ইঞ্জেকশন ঠিকমতো দেওয়া হলো কি-না জিগ্যেস করে। লোকটা বড়ো ব্যস্ত, ১বার বসে তো ২বার দাঁড়ায়। চারদিকে তার ঝামেলা! মহল্লার রিকশাওয়ালারা নতুন আবদার ধরেছে, খিজিরের লাশ ফেরত চাই খিজিরের লাশ তো নিয়ে গেছে আর্মির গাড়ি, সে তো ওকে মেরে ফেলার পর পরই। এখন মানুষের নতুন সখ হয়েছে, তার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অতো সোজা? ক্যান্টমেন্টে গিয়ে বললাম আর লাশ ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলো? এখন পাবলিককে বোঝায় কে? আলাউদ্দিন মিয়া অকারণে সিতারার ওপর দাপট হাকে, দ্যাখো না শেখ সায়েবে বারাইয়া আহুকা শেখ সায়েবে আইলে এইগুলির হাউকাউ থামো
‘মনে হয়। বলেই ওসমানের ভুল ভাঙে। কারণ কাল রাত্রে খিজিরের ডাকে রাস্তার বেরিয়ে ওসমান দ্যাখে যে পথচারীদের হাতে হাতে মশাল জ্বলছে। খিজিরকে অবশ্য পাওয়া যায়নি। মরে গেছে বলেই সে হয়তো অদৃশ্য হতে শিখেছে। অন্যান্য লোকের সঙ্গে ওসমান সারাটা রাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলো। সব জায়গায় আগুন জ্বলছিলো। নবাবপুরে আগুন, নিমতলীতেও আগুন। ফায়ার ব্রিগেডের বড়ো গাড়ি থেকে মোটা মোটা পাইপ দিয়ে জলধারা পড়ে রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু আগুনের শিখা নিচে নামে না। দেখতে দেখতে এইসব জলধারা পরিণত হয় নদীতে। সদরঘাট থেকে জনসন রোড, নবাবপুর হয়ে নিমতলী পেরিয়ে মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে স্যাভেজ রোড হয়ে বুড়িগঙ্গা ছুটে চলেছে শাহবাগ এ্যাভেনু্যতে। সেখান থেকে নদী ছোটে এয়ারপোর্টের দিকে। তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে যায়, নীলক্ষেতে, নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে মীরপুর রোডে। নদীর ঢেউ এসে লাগে ধানমণ্ডির এ-রাস্তা সে-রাস্তায়। কিন্তু আগুনকে তা এতোটুকু দমাতে পারে না। ওসমান কি আর বলবে, বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, পানি বাড়ার সঙ্গে আগুনের শিখা আরো ওপরে ওঠে। ওসমান ঠিক টের পায় নদী এসেছে আগুনকে উস্কে দেবার জন্যে। আগুনকে কদমবুসি করতে করতে নদী এগিয়ে যায়। লোকজনের পা ডুবে যায় পানিতে, কিন্তু পানির একেকটি ঝাপটায় মশালের আগুন আরো পুরুষ্ট্র হয়ে ওঠে। ওসমানের কোমর পর্যন্ত ভিজে গিয়েছিলো, ওখান থেকে কখন এসে বিছানায় শুয়েছিলো তার মনে নাই কিন্তু সকাল বেলা তার কোমর পর্যন্ত লুঙি পানিতে ভিজে চপচপ করছিলো—এইসব ব্যাপার মনে হলে আলাউদিনের বিবৃতির প্রতি সমর্থনটি ওসমান প্রত্যাহার করে নেয়, না। সারাটা শহর জুড়ে যেভাবে আগুন জ্বলছে, কারো সাধি নেই যে এটা নেভাতে পারে।’
‘খালি আগুন জ্বালাইলে হয় না ওসমান সাব, লিডারের মতো লিডার হইলে আগুন নিভাইবার ভি পারে, বুঝলেন?
কিন্তু কাল যে দেখলাম এতো বড়ো বুড়িগঙ্গা নদী, আগুনের পায় সে-ও তো কদমবুসি করে।’
সিআরা জিগ্যেস করে, বুড়িগঙ্গা কি করে বললেন?
ওসমান উৎসাহ পায়, কাল, বুঝলেন আগুন নেভাবার কাজে মিলিটারি শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীকে ফিট করে দিলো রাস্তার সঙ্গে। বুড়িগঙ্গার ঢেউ লেগে আগুন তো আরো লকলক করে বাড়ে!
সিতারা একটু একটু হাসে। আলাউদ্দিন উঠে পড়ে চেয়ার থেকে, আপনি কি কন এইগুলি?
হ্যাঁ। আমি দেখলাম তো, মিলিটারি সব ফায়ার ব্রিগেড দিয়েও আগুন নেভাতে পারলে৷ না। শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার কোর্স চেঞ্জ করে নিয়ে এলো, তো নদীর ঢেউ লেগে আগুন খালি বেড়েই চলে।
আপনার ব্রেনের ইস্কুপ ব্যাকগুলি চিলা হইয়া গেছে। আপনে বাইরে আসেন ক্যান? যান, ঘরে গিয়া ঘুমাইতে চেষ্টা করেন। রাইতে ঘুম হয়? বলে কার ডাকে আলাউদ্দিন বাইরে যায়।
ওসমান বেশ জুত করে চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে। সিতারার সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে। কিন্তু সিতারাও ভেতরে চলে গেলে তার একমাত্র শ্রোতা থাকে রহমতউল্লা।
আলাউদ্দিন সায়েব বিশ্বাস করলেন না, কিন্তু আমি নিজে দেখলাম। মিলিটারির তো যন্ত্রপাতির অভাব নেই, কি সব মেশিন দিয়ে নদীর একটা সাইড ধরে প্রেশার দিয়ে পানি টেনে এনেছে। কিন্তু দেখলাম নদীর পানিতে আগুনের তেজ আরো বাড়ে।
রহমতউল্লার জবাব এখন একেবারেই অস্পষ্ট। ওসমান আরো উৎসাহিত হয়ে তার বিবরণ দেওয়া অব্যাহত রাখে। এমন সময় ঘরে ঢোকে জুম্মনের মা, হাতে বালতি ও বদনা। তার পেছনে অয়েল-ক্লথ হাতে সিতারা। জুম্মনের মা বলে, অহন মাথা ধোঁয়াইতে হইবো। আপনে এটু বরাদায় গিয়া বহেনা’
না, না, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তোমারা কাজ করো। হঠাৎ করে ওসমানের মনে পড়ে, জুম্মনের মায়ের পেটের ভেতরকার প্রাণীটির খবর কি? হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে জিগ্যেস করে জুম্মনের মা, তোমার বাচ্চার খবর কি?
বদনার নল দিয়ে রহমতউল্লার মাথার পানি ঢালতে ঢালতে জুম্মনের মা বলে, ‘জানেন না? পরশুদিন থাইকা অরে পাই না।’
তবে কি পেটের ভেতর থেকে তার সন্তানকে চুরি করা হলো? ওসমান টোক গিলে বলে, মানে?
কি জানি কৈ গেছে। জুম্মনের বাপে ভি বহুত বিচরাইতাছে না, জুম্মনেরে পাওয়া যায় না।
জুম্মনের জন্যে ওসমানের উদ্বেগ কম নয়, হঠাৎ কোথায় গেলো?
আল্লা মালুম। উদিনকা আপনাগো খিজির মিয়ার কি যন্ত্রপাতি লইয়াকৈ গেলো, আর দেহি না।
খিজিরের আবার যন্ত্রপাতি কি? চট করে মনে পড়ে, ঐ স্ত্রু-ড্রাইভার প্লাস?
হ। কাউলকা দেহি ঐগুলি নাই। তামান দিন জুম্মনে ঘরে আহে নাই। ওসমানের সন্দেহ হয়, খিজিরই বোধহয় জুম্মনকে নিয়ে কোথায় গেছে। তা এটা অবশ্য খিজিরের অন্যায়, মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে এভাবে না বলে নেওয়াটা ঠিক নয়। খিজিরকে আজ কোথায় যেন দেখলো? না, মনে পড়ে না!—মনে করতে গিয়ে ওসমানের মাথা খুব ঘোরে এবং জুম্মনের মা, সিতারা ও রহমতউল্লার চেহারা ঝাপশা হয়ে আসে।
সারাটা দিন ঘরেই কাটলো, সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও খিজিরের পাত্তা না পেয়ে ওসমান বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালাবার জন্য সুইচ টিপলো।
কারেন্ট নাই। খিজিরই কি বিদ্যুৎ নিয়ে গায়েব হয়ে গেলো!
নিচে নামতে নামতে ওসমান দ্যাখে রঞ্জুদের ঘরের দরজা খোলা। হ্যারিকেন জ্বলছে, মানে এখানেও বিদ্যুৎ নাই। খিজির আবার এখানে ঘাপটি মেরে বসে নাই তো?-না। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে মকবুল হোসেন আমন্ত্রণ জানায়, আসেন আসেন। খবর জানেন তো?
খিজিরের খবর জানতেই তো ওসমান এসেছে, কি? খিজির-।
মকবুল হোসেন তাকে শেষ করতে দেয় না আরে আজকের খবর জানেন না? শেখ সায়েব তো রিলিজড!
বলেন কি? ওসমান এবার রাস্তায় মানুষের উল্লাস শুনতে পায়।
হ্যাঁ। আমি প্রথমে ভাবলাম রিউমার। পরে রঞ্জু আইস্যা বলে—
রঞ্জু নিজেই কথা বলে। শেখ মুজিবুর রহমানকে দ্যাখার জন্য রঞ্জু আজ একা একা অনেক ঘুরেছে। ধানমণ্ডিতে ৩২ নম্বরে গিয়েছিলো, শোনে যে মিছিল করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শহীদ মিনার। রানু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে না, তুই দেখবি ক্যামনে? এতো মানুষের মধ্যে দেখতে পারলি?
পারবো না ক্যান? উনি শহীদ মিনারে উঠছেন, আমি উইঠা দাঁড়ালাম উল্টাদিকের একটা দেওয়ালের উপরে। কতো মানুষ গাছে উইঠা দেখছে!’
রানু আফসোস করে, আমি দেখতে পারলাম না।
রঞ্জু আশ্বাস দেয়, কাল দেখতে পারো। কাল রেসকোর্সে শেখ সায়েবের মিটিং।
রেসকোর্স মকবুল হোসেন অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে, রেসকোর্স, না পল্টন?
রেসকোর্সই হবে। ওসমান সমর্থন করে রঞ্জকে, পল্টনে আগুন জ্বলছে। শাহবাগ এলাকায় আগুন নেভাবার জন্য আর্মির লোকজন রেসকোর্সের কাঠের রেলিং ডিঙিয়ে রাস্তায় নামছে। মিলিটারি নদীকে টেনে এনেছে। নদী আর আগুন নেভাবে কি? বরং নদীর পানির ঝাপটায় আগুন আরো বাড়ে।
রঞ্জু বলে, কি বললেন? নদী?
‘হ্যাঁ। নদীর ওপর আগুন জ্বলছে। নদীর স্রোতে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ছে।’
মকবুল হোসেন উঠে দাঁড়ায়। তার বোবা মেয়েটা তেলনুন মাখানে মুড়ির গামলা নিয়ে আসে, সে-ও বাপের পাশে দাঁড়ায়।
রঞ্জু বেশ মজা করে বলে, আপনি বোধহয় নৌকায় বইসা দেখলেন?
মকবুল হোসেন ছেলেকে থামায়, আঃ রঞ্জু তার ভয় ওসমান আবার লাফালাফি শুরু না করে। তার সমস্ত তৎপরতা কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই ভালো হয়।
রানুর পাতলা ঠোঁট যেন আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটু রেখা নাই, ঠোঁটজোড়া কি পাথরে পরিণত হলো? কিন্তু রানু কি রঞ্জু কি মকবুল হোসেন-কারো দিকে ওসমানের খেয়াল নাই। তার নিজের চোখে দ্যাখা আগুন ও নদীর ঘটনা সে বর্ণনা করে চলে।
বলতে গেলে আগুন ও পানির পটভূমিতে বিশাল জনসমাবেশ দাখার আশায় ওসমান পরদিন গেলো রেসকোর্স। রেসকোর্সে দারুণ ভিড়। কয়েক লক্ষ মানুষ মিটিং শেষ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশাল মাঠ পেরিয়ে লোকজন কাঠের রেলিঙ ডিঙিয়ে রাস্তায় নামছে। সবাই কথা বলেছে, সবাই শ্লোগান দিচ্ছে, জেলের তালা ভেঙেছি’-‘শেখ মুজিবকে এনেছি। ঐ চলন্ত সমাবেশে ১টি ছোটো ঢেউয়ের মতো দুলতে দুলতে ওসমান সামনে এগোয়। কিন্তু নাঃ আগুন কোথায়? এই রেসকোর্স পার হয়ে শাহবাগ এ্যাঁভেনু্যতে সেদিন ছিলো বুড়িগঙ্গার স্ফীত প্রবাহ, তার ওপর জুলছিলো আগুনের স্রোত। আজ কি আবার শুকনা ও নেভানো রাস্তা জেগে উঠলো? আগুন কোথায়? নদী কি শেষ পর্যন্ত আগুন নিভিয়ে ফের ফিরে গেছে নিজের খাতে? আগুনের খোজে গোটা মাঠ ঘুরে ওসমান এপাশে এসে রাস্ত Tয় নামে। মাঝে মাঝে ছাত্রদের একেকটি দল, নাচতে নাচতে ইউনিভারসিটির দিকে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু আগুন কোথায়? এই কয়েকদিনে কারফ্যু দিয়েও আগুন নেভানো যায়নি, আজ এতো মানুষ বেরিয়ে এলে কি শালার আগুন একেবারে নিভে গেলো?
এদিকে রোদ পড়ে আসছে। উৎসবমুখর মানুষ ঘরে ফেরে। বুকটা ওসমানের ফাকা ফাকা ঠেকে। হতাশ হয়ে সে নুয়ে নুয়ে হাটছিলো। এমন সময় ঢাকা ক্লাবের দিক থেকে গোলমাল শোনা যায়। আহা! এবার আগুন লাগবে। আহারে। এবার যদি আগুন লাগে। কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজের প্রায় সঙ্গে ছুটে যায় ১টা জিপ। ঢাকা ক্লাবের ভেতর থেকেই জিপটা বেরিয়েছে। কয়েকটা মানুষ পায়ে ও উরুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেছে। লাগাঁও! রাগে ও উৎসাহে ওসমান ঢাকা ক্লাবের দিকে দৌড়ায়। আহ! ভালো করে আগুন ধরাতে পারলে দালানটা চমৎকার জ্বলে উঠবে, তার আভায় লাল হয়ে উঠবে চলন্ত সমাবেশটি। ঢাকা ক্লাবের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে মানুষ। মূল দালানের বাইরে এক জায়গায় শূন্য মদের বোতল ও বিয়ারের কেন স্তূপ করে রাখা। লোকজন সেইসব তুলে নিয়ে ছুড়তে শুরু করে ভেতরের দিকে। ওসমানও ২টো বোতল ছুড়ে কি হবে? কিন্তু তার ইচ্ছা এখানে আগুন লাগানো হোক। তাই চৎকার করে ওঠে, আরে ভাই বোতল ছুড়ে কি হবে? আগুন লাগান, আগুন লাগান। —উত্তেজনায় সে লাফায়, ‘আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো।
ক্লাবের ভেতর থেকে কয়েকজন সাহসী পুরুষ বেরিয়ে এলে বেশ কয়েকজন বোতল নিক্ষেপকারী শ্লোগান দেয়, আগুন জ্বলো, ‘আগুন জ্বালো!
এর মধ্যে বাইরের কয়েকজন তরুণ ঢুকে পড়লে ঐসব সাহসী পুরুষদের কেউ কেউ তাদের দিকে এগিয়ে যায়, এসবের মানে কি? আমরা কি বাঙালি নই?
ওসমানও ছেলেদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, আগুন জ্বালান, আগুন জ্বালান। এরা সব কলেজ ইউনিভারসিটির ছাত্র, আগুন জ্বালাবার পরিচালনা তো এদেরই হাতে। একজন পকেটে হাত দিয়ে ফের খালি হাত বের করে আনলে ওসমান তাকে দেশলাই দেয়, ‘আগুন জ্বালান। তরুণ নিম-ছাত্রনেতা দেশলাই নিয়ে সিগ্রেট ধরায়, ধন্যবাদ। তার সঙ্গী যুবকটি জুতমতো জায়গা বেছে নিয়ে উত্তেজিত বোতল নিক্ষেপকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা ঝাড়ে, ভাইসব, আপনারা এই জায়গা ছেড়ে দয়া করে চলে যান। আমাদের আন্দোলন এখন চূড়ান্ত সাফল্যের পথে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্ত করে এনেছি। এই ক্লাব, এইসব দালান-কোঠা,-সব এখন আমাদের সম্পত্তি। বাঙালার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এসবের মালিক। এসবের ক্ষতিসাধন করা মানে নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগানো। গোলটেবিল বৈঠকের প্রাক্কালে এরকম উচ্ছঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের সাফল্যের পথে বিয়ের সৃষ্টি করবে। ভাইসব-‘
তার কথায় এবং অন্যান্য তরুণ নেতাদের অনুরোধে লোকজন হতে একেকটি হুইস্কি বা জিন বা ব্রাণ্ডির শূন্য বোতল কি বিয়ারের খালি টিন নিয়ে ঢাকা ক্লাব ছেড়ে চলে যান। ওসমান অবশ্য কোনো খালি বোতল নেয়নি।
ওদের বাড়ির সামনে রাস্তায় ছোটোখাটো জটলার সামনে কথা বলছে আলাউদ্দিন মিয়া। দেখে ওসমান বেশ খুশি, আলাউদ্দিন মিয়াকে বলে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু লোকটা কথা বলছে অন্য ১টি বিষয়ে। কি ব্যাপার? না, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের ওপর সে খুব চটা -এদের আক্কেলটা দ্যাখো! কিসব দাবী নিয়ে স্ট্রাইক করেছে, ১০ ঘণ্টা হয়ে গেলো কোথাও কারেন্ট নাই। আরে বাবা, এইভাবে ধর্মঘট করলে কষ্ট পায় কারা? তারা কি বাঙালি নয়? হাসপাতালে বাঙালি রোগীদের কতো কষ্ট বাঙালির হাতেই তো পাওয়ার আসছে, নেতা বেরিয়ে এসেছে, তার কথা শোনো! এই যে ঢাকা ক্লাবের সামনে গোলমাল করতে গিয়েছিলো, এর কোন মানে হয়? ঢাকা ক্লাব কি পাঞ্জাবির পকেটে করে নিয়ে যেতে পারবে? বাঙালির সম্পদ নষ্ট হবে বাঙালির হাতে?-বক্তৃতা দিতে দিতে আলাউদ্দিন মিয়ার গলা শেষের দিকে ধরে আসে।
তার সাময়িক বিরতির সুযোগে ওসমান বলে, ঢাকা ক্লাবর ভেতর থেকে একটা জিপ বেরিয়ে পাবলিকের দিকে গুলি করে। মানুষ তাই একসাইটেড হয়ে গিয়েছিলো। আজ ওখানে আগুন ধরালে ঠিক হতো!
আরে, আপনে আবার রাস্তায় বারাইছেন? আলাউদ্দিন মিয়ার ভারাক্রান্ত গলা এখন খরখরে হয়ে উঠে, ঘরে যান। মাথার নাই ঠিক-ঠিকানা, উনি অহন লেকচার দিবার আইছেন? যান!
কার হাতে ১টা ট্রানজিস্টার বাজছে। মাঝে মাঝে বিশেষ ঘোষণা বলা হচ্ছে। আলাউদ্দিন মিয়া বলে, ‘শোনেন, ভালো কইরা শোনেন। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ১টি বাণী বারবার প্রচার করা হচ্ছে। রেসকোর্সের লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে আজ এই শপথ নেওয়া হয়েছে যে শহীদদের রক্তে রঞ্চিত আন্দোলন যেন উত্তেজনা সৃষ্টির দ্বারা লক্ষভ্রষ্ট না হয়। সব রকম প্ররোচনা ও উত্তেজনার মুখে তার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী যেন আইন, শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষা করেন।