চিলেকোঠার সেপাই – ২২
শাঁখারি পট্টিতে ঢুকে পলেস্তারা-খসা ও ইট বার-করা চুনসুরকির উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে ওসমান হাঁটছে আর সেই সব বাড়িঘরের শুকিয়ে-যাওয়া মজ্জার গভীর ভেতরকার শাস থেকে সোদা সোদা ও ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে তার শরীরে। ফলে অবসাদ একটু একটু করে কাটে, শরীর ফুরফুরে মনে হয়। সেই হাওয়ার একেকটা দমক এসে হাথায় ঝাপটা মারে: ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এই রাস্তায় হঁটিতে হাটতে এরই একটা গলি ধরে সে ঢুকে পড়েছে তাতীবাজার, কিংবা বেরিয়ে গেছে ইসলামপুরের দিকে। না, শঙ্করদের বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। ক্যাপ্টেন ঐ একদিনই ওকে নিয়ে গিয়েছিলো, তা শঙ্করের কাছে যাবার সময় ক্যাস্টের কোনোদিন কাউকে সঙ্গে নিতো না। ওসমান পরে হয়তো যেতো, কিন্তু ম্যাট্রিক পাস করে আরতি কলকাতা চলে গেলো, মাস ছয়েকের মধ্যে গেলো শঙ্করদের বাড়ির আর সবাই। হ্যাঁ, ওসমানের সব মনে আছে। যতোই ইন্ডিয়া নিয়ে যাক, ঐ খাটো-ধুতি খালি গা, খালি পা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সাধ্য কি ওদের দুই ভাইবোনকে এই পাড়া থেকে শেকড়বাকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে? ওসমান এইতো শপষ্ট দেখতে পাচ্ছে, অপরিবর্তিত শাখারি পটির কলের ধারে ধারে কলসি, বালতি ও হাড়ির সারি। পাশে পাশে দাঁড়ানো শাড়ি ও ফ্রকওয়ালা ফ্যাকাশে ফর্স মুখের মেয়েগুলো। মেয়েদের ঝগড়া চলছে, তাদের নালিশ চলছে, তাদের স্বর এই আবদেরে আবদেরে, আবার পরের মুহুর্তে ঝাঁঝালো। ওসমান একটা গা-ঝাড়া নিশ্বাস ফেলে: না, এখানে অবিকল সব একই রকম রয়ে গেছে। ফ্রকের নিচে তাদের চিকন বা শাসালো পাগুলো এবং শাড়ির তলায় তাদের নিস্তেজ বা চাঙা বুক একইভাবে পুরুষের শরীরে হাওয়া খেলায়। খোঁচা খোঁচা কালো-সাদা দাড়িওয়ালা যে প্রৌঢ় লোকটি ওসমানের, এমন কি ওসমানের বাপ-দাদার জন্মেরও আগে থেকে পূর্ব পুরুষের সঙ্কীর্ণ বারান্দায় বসে রাস্তার নোঙরা নালায় সশব্দে খুধু ফেলতে ফেলতে মস্ত ভাঙা-চাদের মতো করাতে শাখ কাটতো, তার খুধু ফেলা ও শাখ কাটা আজো অব্যাহত রয়েছে। এমন কি এই ২টো নির্ধারিত কাজের মধ্যে সময় করে নিয়ে কলের পাশে পানির প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের কলাগাছের মতো পাগুলোর দিকে তার শ্যাওলা-পড়া চোখে তাকাবার অভ্যাস থেকেও লোকটা ছাটাই হয়নি।
তাঁতীবাজারে ঢুকেও ওসমান বেশ ধীরে সুস্থে হাঁটে। কিন্তু যে জায়গায় এসে সে থামবো থামবো করে সেখানকার চেহারা একটু পাল্টে গেছে। কয়েকটা বাড়ি ভেঙেচুরে এমন আকার দেওয়া হয়েছে যে ওসমানকে বারবার ওপরে নিচে এবং ডাইনে ও বায়ে তাকাতে হয়। চেনা জায়গায় থাকার ফুরফুরে ভাবটা নষ্ট হওয়ার দশা ঘটলে ওসমান টগর বা গন্ধরাজ বা শেফালি ফুলের গাছ দ্যাখার জন্য ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকায়। ১টি পুরনো অপরিবর্তিত বাড়ি তার তীক্ষ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। না, সেই বারান্দায় ঝুলও টবে অৰ্কিড, বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরতির বয়সের একটি মেয়ে। না, এই মেয়েটির পরনে সালওয়ার-কামিজ। এ বাড়ি হতেই পারে না। এরকম পর পর কয়েকটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। না, এ বাড়ি নয়। ওসমান অস্বস্তি বোধ করে এবং তার বুকের নিচে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। অথচ এরকম হওয়ার কোনো কারণ নাই। সকালবেলা ঘর থেকে বেরুবার সময় নোভালজিন ও এ্যাঁন্টাসিড ২টো করে ট্যাবলেট খেয়েছে। আবার এখন খিদে পাওয়াও উচিত নয়, একটু আগে পেট ভরে মোরগ-পোলাও খাওয়া হলো। দুৰ্ত্তোরি। তার খুব রাগ হয়। রাগের টার্গেট না পাওয়ার উত্তেজনায় ছটফট করে এবং দ্রুত পায়ে এ-গলি সে-গলি হয়ে বেরিয়ে আসে কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। আর হরতাল বলে এই রাস্তায় লোকজন কম। ছোট্রো ১টি রেস্টুরেন্টের সামনে কয়েকজন তরুণ দাঁড়িয়ে মিছিলের গল্প করছে। কিন্তু এই রাস্তাটি তার চোখে ধাবমান ছবিই রয়ে যায়, কোনো দৃশ্যে স্থির হবার সুযোগ পায় না। ওসমান বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে, মিছিলটাও মিস করলো, এখন কোথাও পৌছুঁতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৌছুঁতে হবে কোথায়? কৈলাস ঘোষ লেনের ১টি বাড়ির সামনে এসে দুরুদুরু বুকে সে বাড়িটাকে সনাক্ত করার চেষ্টা করে। এইতো ছোটো দোতলা বাড়ি, রাস্তার ঠিক ওপরে উঁচু ইট-বের-করা খয়েরি রঙের বারান্দা। দোতলা বরাদায় শিশু বটগাছের রোগা ডালপালার ভারে ঝুলে পড়েছে কার্নিশের অংশ। না। এই বাড়ি তাকে প্রতারিত করেনি। ওসমান একটু একটু হাঁপায় এবং সক্তজ্ঞ চোখে বাড়িটার দিকে দ্যাখে। এইতো নিচে রাস্তার দিকে জানলাওয়ালা ঘরটিতে ক্যাপ্টেন থাকে। সিমেন্টের প্ল্যাপে পা রেখে বারান্দায় উঠে সে আঁশ ওঠা, বৃষ্টির ঝাপ্টায় রেখা-রেখা-দাগ-হয়ে-যাওয়া এবং রোদে এবড়োখেবড়ো কাঠের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। কিন্তু ভেতর থেকে সাড়াশব্দ নাই। একটু বিরতি দিয়ে ওসমান এদিক-ওদিক দ্যাখে। উল্টোদিকের ডাস্টবিনটাও আছে, কেবল ড্রামের জায়গায় সিমেন্টের নিচু দেওয়াল। মুখ ফিরিয়ে সে ফের কড়া নাড়ে এবং ডাকে, ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন ২বার ডাকার পরও তার খুব হাসি পায়, এতোদিন পর ক্যাপ্টেন বলে ডাকলো কি করে? একি? সে কি এখনো কুাস VIB না VIIA-তে পড়ে? তাহলে কি ঘোরের মধ্যে ফের অনেকদিন আগে চলে গিয়েছিলো? এরকম যাওয়া যায়? খুশি ও কৌতুকে তার এতো হাসি পায় যে ঠোঠে হাত দিয়ে হাসি চাপতে হয়। ক্যাপ্টেন শালা আসুক, ওসমান বলবে, কি ক্যাপ্টেন চিনতে পারো? চিনতে পারলে ওসমান বলবে, দোস্ত তোমাকে শালা এতো ভয় পেতাম যে আজও নাম ধরে ডাকতে সাহস হয় না! ক্যাপ্টেন বলবে, রংবাজি ছাড়, তুই শালা আছিলি কৈ? ইস্কুলে থাকতে চিকনা আছিলি, অহনও আমসিই রইলি!’ ওসমান বলবে, তুমি আমাদের বডি-বিল্ডার ক্যাপ্টেন, তোমার সামনে সবাই আমসি’ ক্যাপ্টেন একটু হাসবে না দোস্ত বডি আর রাখতে পারলাম কৈ?
এই কাল্পনিক কথোপকথন স্থগিত রেখে ওসমান ফের ডাকে, কবীর। কবীর। এই কবীর। এইভাবে কয়েকবার ডাকার পর ওপর থেকে জবাব আসে, কে? ওপরের বারান্দার দিকে তাকাবার জন্যে ওসমানকে রাস্তায় নামতে হয়। দোতলার বারান্দায় একজন প্রৌঢ় মহিলা, ফর্স গালের মেচেতা থেকে তাকে কবীরের মা বলে চেনা গেলো, কাঠের রেলিঙে হাত রেখে জিগ্যেস করে, ‘কাকে চান?
‘কবীর আছে? ওসমান বলে, কবীর আছে? আমাকে চিনলেন না খালাম্মা?
এর আগে কবীরের মায়ের সঙ্গে ওসমানের তেমন কথাবার্তা হয়নি। ওসমান সাধারণ রাস্তা থেকেই কবীরকে ডাকতো, কবীর থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। আবার কোনো কোনোদিন ওপর থেকে টানা গলায় জবাব এসেছে না-ই!’ কবীরের মা একদিন বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেছিলো, তোমাদের ইস্কুল খুলবে কবে? ইস্কুল কি সারা বছর বন্ধই থাকে? আজ এতোদিন পর মহিলাকে খালাম্মা বলে ডাকতে ওসমানের ভালো লাগলো। মহিলা তার পুরু লেন্সের চশমা-পরা ২চোখের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওসমানকে চেনার চেষ্টা করে। ওসমান বলে, ‘আমার নাম রঞ্জ, কবীরের সঙ্গে ইস্কুলে পড়তাম।
মহিলার পাশে কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ২২/২৩ বছরের একটি যুবকের দিকে চোখ পড়লে ওসমান হাসে, ঐ তো ক্যাপ্টেন তার দিকে চোখ রেখে কি বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু না, সঙ্গে সঙ্গে সে সামলে ওঠে, ক্যাপ্টেন আমাদের আরো কালো, তার বয়স আরো বেশি। ক্যাপ্টেনের নাকের পাশে এরকম কালো তিল নাই। একেও চিনতে পারলো, এ হলো কবীরের ভাই। সগীর কি এতো বড়ো হয়ে গেছে? মায়ের ইঙ্গিতে সগীর ওসমানকে ডাকে, ওপরে আসেন।
নিচের দরজা খুলে যায়। দরজার ডান দিকে সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে রঞ্জু ওর ক্লাসের আরো ২জন ছেলের সঙ্গে একবার ওপরে উঠেছিলো। কবীরের বাবা মা সেদিন সারাদিনের জন্য কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলো। ওপরতলার বারান্দায় বসে গরমের একটি দীর্ঘ দুপুর ওরা ক্যারাম খেলে কাটিয়ে দেয়। সেই সময় কিন্তু সিঁড়ির এই ধাপগুলোকে আরো উঁচু মনে হতো। ক্যারাম খেলতে সেদিন ভয়ও হচ্ছিলো, ঘোড়ার গাড়ি করে কবীরের মা আবার কখন
এসে পড়ে। আর সেই মহিলার আহ্বানে ওসমান লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে। মোটা ও ভাঙা গলায় ঘরের ভেতর থেকে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি শোনা যায়, কে? কেডা? অ কবীরের মা, কেড়া কথা কয়? কিন্তু ওসমান ছাড়া এই গোঙনি কারো কান স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। গোঙনি আসছে সিঁড়ির ডানদিক থেকে, কবীরের ভাইয়ের পেছনে পেছনে ওসমান ঢুকলো বা দিকের ঘরে।
ঘরে ৩ রকম ৩টে চেয়ার। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ওসমান এবং মাদুর-পাতা তক্তপোষে বসে কবীরের মা। আরো আসন শূন্য থাকা সত্ত্বেও অন্য সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। চেয়ারে বসতে বসতে ওসমান বলে, কবীর বাসায় নেই? জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করেই বলে, ক্লাস এইট পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আপনাদের এই বাড়িতে কতো এসেছি? তারপর সে তাকায় সগীরের দিকে, তোমার নাম তো সগীর, না? আমাকে তুমি চিনতে পাচ্ছো?
ভাইয়ার সব বন্ধুরেই তো চিনি। কয় বছরে আরো ভালো কইরা চিনলাম। এর পরও ওসমানের মুড অবিকৃত থাকে, খালাম্মা, এই বরাদায় আমরা একদিন সারা দুপুর ক্যারাম খেলে গিয়েছি, আপনারা কোথায় যেন গিয়েছিলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে প্রায় আপন মনে বলে, ইস! কতোদিন হয়ে গেলো!
কবীরের মা আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, আপনে ইন্ডিয়া চইলা গেছিলেন না?
‘আট দশ মাসের জন্যে। আমার বাবা-মা আর ফিরলেন না। আমি ফিরে এসে অন্য স্কুলে ভর্তি হলাম। সেই থেকে কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেলো।
আপনার বাবা মা ইন্ডিয়া থাকে?
কতোদিন হয়ে গেলো, এই মহিলার সঙ্গে ওসমানের কোনোদিন তেমন আলাপও হয়নি, অথচ দাখো, সব মনে রেখেছে। ছেলেবেলার বন্ধুর মা, নিজের মায়ের চেয়ে কম কি? কথা বলতে গেলে তার গলা থেকে আঠোলো ধ্বনি বেরোয়, আব্বা ইন্ডিয়ায় থাকে। গ্রামের বাড়িতে। আম্মা মারা গেছে এখান থেকে যাবার পর কয়েক বছরের মধ্যেই। তার বলার ইচ্ছা ছিলো, আমার মা নেই খালাম্মা! কিন্তু ২/১বার চেষ্টা করে ঐ বাক্য নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে সে বলে, আমাকে আপনি বলছেন কেন?
আপনি বোধ হয়— ‘
ওসমান তাকে জোরেসোরে বাধা দেয়, আমাকে আপনি বলবেন না খালাম্মা। আমি কবীরের খুব ছেলেবেলার বন্ধু। আমার নাম রঙ্গু, মনে পড়ে?
কবীরের মা তার অনুরোধ মেনে নেয়, তোমার নাম কি কইলা? তাইলে ওসমান কার নাম?
রঙ্গু এবার নিভু-নিভু হয়ে যায়, তবু যতোটা পারে জোর দিয়ে বলে, আমারই নাম। কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধব সব ডাক-নামেই ডাকতো।
আচ্ছা। তুমি পরে আর্মনিটোলা থাকতা না?
‘জী। সেই জন্যেই তো আর্মানিটোলা স্কুলে ভর্তি হলাম। ওসমান ফের উৎসাহিত হয়।
‘কার বাড়ি জায়গির থাকতা না?
ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে ওসমান বাস করতে শুরু করে তার এক চাচার সঙ্গে, বাপের মামাতো ভাই। চাচাতো ভাইবোন ছিলো মেলা, তাদের পড়াতে হতো, চাচার স্ত্রী ঠিক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করতো না। আজ কবীরের মায়ের গলায় জায়গির কথাটি ওর খারাপ লাগলো। আমার চাচা-চাচী যে ব্যবহার করেছে তাতে কথাটার প্রতিবাদ করাও যায় না। তবে কবীরের সঙ্গে দাখা করার প্রবল স্পৃহা এইসব ফালতু ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম। সে জিগ্যেস করে, খালাম্মা, কবীর এলে আমার কথা বলবেন। ওকে বাসায় পাওয়া যায় কখন?
কবীরের মা ওসমানের চোখে ১বার সরাসরি তাকায়, তারপর হঠাৎ বলে, কবীর মারা গেছে।
ওসমান জিগ্যেস করে, কোথায় গেছে?
কবীরের মা একই ভঙ্গিতে তার বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু দ্বিতীয়বার শোনার আগেই ওসমান তার বন্ধুর পরিণতি বুঝতে পেরেছে। ভয়ানক বিচলিত গলায় সে বলে, কি? মারা গেছে?
তুমি জানো না?
না তো। কিন্তু আর কিছু জিগ্যেস করার মতো শক্তি তার হয় না।
এইতো পাঁচ বছর হইয়া গেলো। চৌষট্টি সালে রায়ট হইছিলো মনে আছে?
‘রায়টে মারা গেছে?
‘না। রায়টের আগের দিন।’
এইবার ওসমান নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেয়, কি হয়েছিলো?
কবীরের মা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরে ভয়ানক নীরবতা, এমনকি পাশের ঘরের গোঙানিও ফিরে যাচ্ছে দরজার কপাট থেকে। কিছুক্ষণ পর সগীর তার বড়োভাইয়ের মৃত্যুর কারণ জানায়, ‘খুন হইছে। গট কিলড়’
কিভাবে? কারা মারলো? কেন? ওসমান নিস্তেজ গলায় জিগ্যেস করে। কবীরের স্থায়ী অনুপস্থিতি তাকে এতোটা বিচলিত করেছে যে তার কারণ জানবার কৌতূহল তৈরি করার শক্তিও সে খুঁজে পায় না।
আর কারা? সগীর বলে, সেই সব কথা তুইলা লাভ কি? ভাইয়ার বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কারা? কার কার সাথে বিজনেস করতে নামলো, তারাই মারছে।
তারপর সবাই ফের নীরব হলে পাশের ঘরের গোঙানির আওয়াজ ফাক বুঝে ঘরে ঢুকে পড়ে, ’অ করীরের মা, অ হাসিনা, কেডারে? কথা কয় কেডা? কবীরের মা তার কিশোরী কন্যাকে হুকুম দেয়, হাসিনা দ্যাখ তো তর বাপে কি চায়? দ্যাখ না।’
কিন্তু বাপের বক্তব্য কি জিজ্ঞাসায় হাসিনার কোনো উৎসাহ নাই। দরজার চৌকাঠ ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে!
সঙ্গীর হঠাৎ খ্যাক করে ওঠে, যা না! এখানে কি দ্যাখস? যা।’ সেই বিরক্তি অক্ষত রেখে ওসমানকে বলে, ‘আপনে কিছুই জানেন না? পাঁচ বছর বাদে আসছেন বন্ধুর খবর লইতে? এতোদিন পুলিসের ভয়ে আসেন নাই?
কবীরের মা উঠে দাঁড়ায়, যাই। অর বাপের শরীর খুব খারাপ, সাত বচ্ছর প্যারালাইসিসে পইড়া রইছে। অপরিবর্তিত স্বরে ওসমানকে বলে, আমাদের উপরে খুব জুলুম গেছে। পুলিসের লোক একটা বচ্ছর খুব জ্বালাইছে। আবার কতো মানুষ যে আসছে, কেউ কয়, কবীর আমার সাথে বিজনেস করার কথা কইয়া পাঁচ হাজার টাকা নিছিলো। কেউ কয় কবীর হাওলাত নিছে তিন হাজার টাকা। আমরা খুব ভুগছি!
বন্ধুর জন্যে শোক ওসমানের দানা বাধতে পারে না। সগীরের কিংবা তার মায়ের কথাবাতায় যে অপমান বোধ করবে মনে সেরকম বলও পায় না।
বিদায় দেওয়ার জন্যে নিচে এসে সগীর বলে, ‘আপনে আছেন কোথায়?’
আমি লক্ষ্মীবাজার থাকি।
না, আই মিন আপনি কোন প্রফেশনে আছেন? কি করেন?
ইপিআইডিসি-তে কাজ করি।
‘কোন সেকশনে। কি পোস্টে?
ওসমানের জবাবে সগীর উৎসাহিত হয়, টাকা পয়সার জায়গা। আমি ফ্লাইং বিজনেস করি, আমারে একটু হেল্প কইরেন। ভাইয়া বিজনেসে নামলো, কতোগুলি শয়তানের পাল্লায় পইড়া লস দিলো। জানটা পর্যন্ত দিতে হইলো। নিজে মরলো, ফ্যামিলিটা রুইন কইরা দিয়ে গেলো। আপনারে কই, আব্বার স্ট্রোকের কজটা কি?-ভাইয়ার ডেথ।’
ওর বাবা তো কবীর নিহত হওয়ার আগে থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিন্তু এসব প্রশ্ন করে লাভ কি?
ওসমান রাস্তায় নামলে সগীর বলে, ‘আপনের এ্যাডরেসটা দিলেন না? ওসমান তার ঠিকানা দিলে সগীরও রাস্তায় নামে, তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, আমারে একশোটা টাকা দিতে পারেন? সামনের মাসে বিল উঠাইয়া আপনার বাসায় পৌছাইয়া দিয়া আসবো।
ওসমান বিব্রত হয়, টাকা তো নেই।’ আরে দেন না। সামনের মাসে মোটা বিল পাবো, ওয়াপদায় আড়ইশো ফ্যান সাপ্লাই দিলাম। আপনার বাসার এ্যাডরেস তো রাখলাম, মাসের ফাস্ট উইকে দিয়া আসবো। ওসমানের বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে তার দয়া হয়, কতো আছে? যা পারেন দেন।
প্যান্টের পকেট থেকে ১০ টাকার ১টা নোট বের করে ওসমান বলে, আর টাকা তিনেক সঙ্গে থাকলো। এই নেন। সগীরকে সে কখন থেকে আপনি করে বলতে শুরু করেছে নিজেও খেয়াল করেনি।
নোটটা হাতে নিয়ে সগীর তেতো হাসি ছাড়ে, ওনলি এ টেনার?
ওসমান এগিয়ে যেতে যেতে সগীরের উচ্চকণ্ঠ স্বাগতোক্তি শোনে, কি সব ফ্রেন্ড। দশটা টাকা দিতে জান বারাইয়া যায়, দোস্তের খবর নিতে আসছে।’
রাস্তা চিনতে ওসমানের অসুবিধা হয়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে চাপা প্যান্ট পরা কয়েকটা ছোকরা পোজ মোর দাঁড়িয়ে আশেপাশের বাড়ির জানলা ও দোতলার বারান্দা সার্ডে করছে। ওসমান এদের কাউকে চেনে না। ১টা সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় কথা বলছে৩জন লোক। কারা? কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে? উপচে-পড়া ডাস্টবিনে সামনের ২টো পা তুলে দিয়ে ১টা নেড়ি কুত্তা খাবার খোজে, এই কুকুর জাতটাকে বিশ্বাস নাই, ওসমানের দিকে হঠাৎ তেড়ে আসতে কতোক্ষণ? শাঁখারি পট্টির এই মাথায় চায়ের দোকানটা নতুন, দোকানের মুখে তন্দুরের ভেতর থেকে লোহার আকসি দিয়ে রুটি বার করে আনছে গেঞ্জি পর ১টি বালক, ব্যাটা কাজ করতে করতে ওসমানের দিকে তাকালো কেন? দোকানের ভেতর তারস্বরে হিন্দী গান চলছে, গানের সুরটা ওসমান কোনোদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারলো না। একবার ইচ্ছা হয়, শাঁখারি পট্টি ক্রস করে ইসলামপুর হয়ে চলে যায় চকবাজার। কিন্তু শাখারি রাস্তা যদি ঠিকমতো চিনতে না পারে? তাহলে? চকবাজার গিয়ে এখন লাভ কি? এই ১ঘন্টায় মিছিল কতোদূর চলে গেছে। শহীদ মিনারে মিলিত হয়েছে বিশাল সমাবেশে। রিকশা নাই, বাস নাই, স্কুটার নাই,-ওসমান কি অতোটা হাটতে পারবে? মিছিলে থাকলে মাইলের পর মাইল হাঁটলেও গায়ে লাগে না, ক্যাপ্টেনের খোজ করতে এসে সব বরবাদ হয়ে গেলো।