চিলেকোঠার সেপাই – ২৩
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসের লোকজন বেরিয়ে আসে সকাল ১০টার আগেই। মতিঝিলে বিরাট মিছিল। মিছিল ডিআইটির সামনে পৌছুলে স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শোনা যায়, ‘আরে চেয়ারম্যান, ডিআইটির চেয়ারম্যান মিছিলে ওসমান ছিলো মিছিলের মাঝামাঝি। সেদিন সে বেশ ব্যস্ত। তাদের যাদের অফিসার বলা হয় এই মিছিলে তাদের নামবার ব্যাপারে প্রেম-পত্র-লেখা কামালের সঙ্গে সে-ও বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলো। কামালের এখন প্রচুর অবসর, মালীবাগের প্রেমিকার কাছে তার হাপানির ব্যাপার ফাঁস হয়ে গেছে, প্রেমিকা ইদানীং রোগমুক্ত ১জন ছেলের সঙ্গে প্রত্যেক দিন চাইনীজ খেয়ে বেড়াচ্ছে। মিছিলের মাঝখানে চলতে চলতে কামাল ওসমানকে একটু ধাক্কা দেয়, দ্যাখেন না, ডিআইটির চেয়ারম্যান পর্যন্ত নেমে এসেছে।’
এ্যাঁ। এরা এ্যাঁকশনে নামলে আইয়ুব খান টিকতে পারে? ওদের সেকশনের প্রধান খলিলুর রহমান অন্য সংস্থার চেয়ারম্যানকে মিছিলে দেখে গদগদ হয়ে বলে, ‘আরে, ওরা হইল সব সিএসপি। পাকিস্তানের প্রথম দিকের সিএসপি। বিলিয়ান্ট প্রোডাক্টস অব দি ইউনিভারসিটি। এরা কেউরে পরোয়া করে?
কিন্তু কামাল কথাটা অগ্রাহ্য করে, কতো সিএসপি দেখলাম! কৈ আমাদের চেয়ারম্যান নামুক তো!
খলিলুর রহমান দমে না, আস্তে করে বলে, সকলের নামার দরকার কি? সরকারের মধ্যে থাইকাও সরকারের বারোটা বাজান যায়।’
সেক্রেটারিয়েটের কাছে এলে মিছিলের মূল প্রবাহ চলে যায় প্রেস কুবের দিকে। আর ছোটো ১টি ধারা টোকে আবদুল গনি রোডে। সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটে সার করে দাঁড়ানো হেলমেট ও রাইফেলধারী পুলিস। মিছিলের লোকজন রাস্তার মোড়ে সাজানো ব্যারিকেড সরিয়ে সমবেত হয় ঐ গেটের দুইদিকে। নতুন স্লোগান শোনা যায়, সেক্রেটারিয়েটের ভাইয়েরা’-বেরিয়ে এসো বেরিয়ে এসো। আইয়ুব খানের দালালদের জ্বলিয়ে মারো, পুড়িয়ে মারো’ পুলিসের সারির পেছনে গেটের ভেতরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ১টার পর ১টা স্লোগান তাদের শরীরে ঝাপ্টা দিচ্ছে। মিছিল থেকে বেশ কিছু লোক লাফিয়ে উঠে পড়ে সেক্রেটারিয়েটের দেওয়ালে। হঠাৎ কি করে পুলিসের দুর্ভেদ্য সারি ভেঙে পড়ে, হুহু করে বেরিয়ে আসে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা। আবদুল গনি রোড উপচে পড়ে মানুষে। বিপুল সমাবেশ চলতে শুরু করে কার্জন হলের দিকে। ওসমানও ঐদিকে রওয়ানা হয়েছিলো, হঠাৎ সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনে ওসমানের সমস্ত শরীর ও মাথা কেমন ফাঁকা ফাকা মনে হয়। ও দ্যাখেনি, তবে মনে হচ্ছে গুলিটা চলে গেছে ওর মাথা কিংবা বুকের ঠিক পাশ দিয়ে। লোকজনের এলোমেলো ছোটাছুটির মধ্যে সে এসে পড়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে,জিপিও-র কাছাকাছি। ছোটাছুটি করতে করতেই লোকজন স্লোগান দিয়ে চলেছে, ‘ধ্বংস হোক, নিপাত যাকা’ ১রাউণ্ড গুলির পর আর কোনো আওয়াজ নাই। মানুষ ফের দাঁড়ায় এবং ওসমানের চোখে পড়ে লাল রঙের সেই গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে জিপিও-র সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। গাড়িটা দেখে ওসমানের গা ছমছম করে অনেকক্ষণ ধরে তো সে এখানেই রয়েছে, এই রায়টকার কখন এলো? কিভাবে এসে পৌছুলো? এতো মানুষের চলমান স্রোত উজিয়ে এলো? ওই লাল গাড়িটাকে লোকে আক্রমণ করে না কেন? ওসমান তার ছমছম-করা গা একবার ঝাকালো, এই শালদের ভয় পেলেই এদের লাই দেওয়া হয়। যা হয় হোক, এই জায়গা ছেড়ে সে নড়বে না।
ওখান থেকে সত্যি সে অনেকক্ষণ সরেনি। আর আর মানুষের সঙ্গে সে-ও এদিক ওদিক থেকে কাঠের টুকরা কাগজ, গাছের শুকনা পাতা জোগাড় করে পাক-বাগিচার উল্টোদিকের ফুটপাথে স্তুপ করে ফেললো। আইয়ুব খানের মস্ত ১টা ছবি রেখে সেই স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে ওসমান তার প্যান্টের পকেট থেকে অফিসের একটা কাগজ ও লন্ত্রির রিসিট বার করে সেই স্তুপে অগুলি দিলো। আগুনের শিখার চারপাশে স্লোগান ওঠে, দিকে দিকে আগুন জ্বলো’–’আগুন জ্বলো আগুন জ্বালো! জাগো জাগো’—‘বাঙালি জাগো!’
এর মধ্যে তোপখানা রোড ও পল্টনের মোড়ে ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সামনে লোহার রডের সঙ্গে টাইট করে লাগানো মস্ত সাইনবোর্ড নিয়ে আসা হয়েছে। এটা হলো আইয়ুব খানের শাসনের ১০ বছর পূর্তির বাহাদুরি ঘোষণার বিজ্ঞাপন। আগুনের ভেতর বোর্ডটা ফেলতেই মানুষ সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো। এতো বড়ো টিনের বোর্ড দেখতে দেখতে দুমড়ে যায়। ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের পাশে সেক্রেটারিয়েটের গেট, সেই গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছিলো দমকলের গাড়ি। লোকজন ঐ গাড়ির দিকে ছুটে যেতেই সেটা ব্যাক গিয়ারে চলে গেলো ভেতরে।
দমকলের গাড়ির পলায়ন দেখে ওসমানের হাসি পায়, মানুষের বাড়িঘর দোকানপাট পুড়ে সাফ হয়ে গেলেও এই শালাদের টিকিট দ্যাখা যায় না। আর দ্যাখে আইয়ুব খানের বাহাদুরির বিবরণ বাঁচাবার জন্য শুওরের বাচ্চারা কেমন তৎপর। এইরকম ভাবতে ভাবতে ফট করে পর পর ২বার আওয়াজ হয়, ২টো শেল ফাটে এবং বাতাস হয়ে ওঠে ঝাঝালো। লাল রায়ট-কার থেকে টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছে। ঝাঁঝালো বাতাসে ওসমানের চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে, চোখ দারুনরকম জুলছে, নিশ্বাস নেওয়াটা এখন কষ্টের কাজ।
রায়ট কার মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেলো কোথায়? মানুষ এখন ছুটে চলেছে স্টেডিয়ামের দিকে। আউটার স্টেডিয়ামে খুব ভিড়। এই ভিড়ে ওসমান স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ভিড় ঠেলে ঠেলে অকারণে সে এদিকে-ওদিক ঘোরে। এরকম ঘুরতে ঘুরতে মাইকের একটি হনের সামনে এসে শুনতে পায় যে সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটের সামনে গুলিবর্ষণে দুজন মারা গেছে। তাদের লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তরুণ কোনো নেতার কণ্ঠ শোনা যায়, ভাইসব, স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনেমের লেলিয়ে দেওয়া কুকুরের গুলিতে আজ নিহত হয়েছে আমাদের দুজন ভাই। ভাইসব, আমাদের শহীদ মকবুলার রহমান ও রুস্তম আলির লাশ এক্ষুনি এসে পড়বে। শহীদ আসাদুজ্জামানের শোক-সভা আজ জানাজার পরিণত হলো কেন? কার জন্যে? ভাইসব-।
সমবেত জনতা বারবার তাকায় স্টেডিয়ামের গেটের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে কালো কাপড়ে ঢাকা দুটো মৃতদেহ কালো কালো চুলের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ভেসে আসে। তাদের বহনকারীদের দ্যাখা যায় না, মনে হচ্ছে শহীদদের লাশ যেন শূন্যে সাতার দিয়ে এগিয়ে আসছে।
ওসমানের বুকে খচ করে একটা কাটা বেঁধে গুলির সময় সে তো ঠিক ঐ জায়গাটাতেই ছিলো। ওসমান হয়তো একটুর জন্যে বিরাট এই সমাবেশের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হতে পারলো না! আহা, মানুষের উড়ন্ত চুলের টেউয়ে সাতরাবার কি সুযোগ সে হারালো।—তবে এই ক্ষোভ তার স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ১টি মুহূর্তের জন্য। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে মাইকে হঠাৎ বিকট স্বরে টাটা আওয়াজ হয়, এই আওয়াজে তার মগ্নতা ভাঙে এবং মনে হয়, আহা! একটুর জন্য সে বেঁচে গেছে। নইলে এই সমাবেশ, শহীদদের প্রতি সম্মান দ্যাখাবার জন্য মানুষের এই আকুলতা-কিছুই দ্যাখা হতো না। সে যে বেঁচে গেছে এবং বেঁচে আছে-এই বোধ চাঙা হয়ে ওঠায় ভিড় ঠেলে ওসমান এদিক ওদিক ঘোরে। ভিড়ের মধ্যে পান বিড়ি সিগেটওয়ালারা; হাতে লোহার চুলায় কেতলি নিয়ে চা বিক্রি করে এক ছোকরা। এমনকি স্টেডিয়ামের গেটে চটপটি ফুচকার ঠেলাগাড়ি। ১প্লেট চটপটি ও ৪টে ফুচকা খেয়ে ওসমান চা খেলো। খালি পেটে তেঁতুল-গোলা পানিতে চোবানো ফুচকা খেয়েও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কালো কাপড়ে ঢাকা নিহত মকবুলার রহমান ও রুস্তম আলি যেদিক দিয়ে এসেছিলো সেই গেট দিয়েই ফের উড়ে গেলো আজিমপুরের দিকে। সেদিকে না গিয়ে ওসমান চললে বাদিকে, মতিঝিলের দিক থেকে অনেক লোক ছুটে আসে, অনেকে ঐদিকেই যেতে শুরু করে। লোকজন যারা আসছে এবং যাচ্ছে সকলেরই হস্তদন্ত ভাব। মাথার উপর হালকা কালো রঙের ধোঁয়া। সম্প্রসারণমাণ একটি ছাদের মতো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত মতিঝিলে। একটু এগিয়ে গেলে দ্যাখা যায় মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বলছে। অফিসের সামনে জ্বলন্ত ২টো গাড়ি। এর মধ্যে উত্তেজিত মানুষের স্লোগান, আইয়ুবের দালাল, আইয়ুবের দালাল’-‘হুশিয়ার ইশিয়ার’ অফিসের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় ওসমানের গায়ে আগুনের তাপ লাগে, তার শরীর নিসপিস করে, সে কি কোনোভাবেই এই কর্মযজ্ঞে একটু অংশ নিতে পারে না? এর মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারের উল্টোদিকের ১টি বাড়িতে। এখানে আগুন লাগানো হলো কেন? একটু এগিয়ে যেতে শোনা যায় যে এটা মুসলিম লীগের ১ এমএনএ-র বাড়ি। লোকজন মন্তব্য করে, চুতমারানি, চুরি চামারি কইরা কি মহল বানাইছে একখান, ল, অহন ল! বইয়া বইয়া খা।’
চারদিকের আগুনের ধোঁয়ায় শীতকালের সন্ধ্যা নামে আরো তাড়াতাড়ি। কিন্তু লোকজন কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে না, মনে হয় আরো অনেক কিছু পোড়াবার দায়িত্ব সবার ঘাড়ে, দাঁড়াবার সময় তো নাই। অজস্র মানুষের সঙ্গে ওসমান গড়িয়ে পড়ে জিন্না এ্যাঁভেনুর বড়ো প্রবাহে। দোকানপাট সব বন্ধ, কিন্তু রাস্তা তাতে স্থগিত থাকেনি। রাস্তার ২দিকে আলো জ্বলছে। রাস্তা এখানে চওড়া বলে জনস্রোত একটু পাতলা। ইপিআরটিসি টার্মিনালের সামনে জটলা, টার্মিনালের গেটের পিলার ২টোর গোল গোল সিমেন্টের মাথা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙছে ২জন শ্রমিক যুবক, লোকজন চিৎকার করে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। এই টার্মিনালের পেছনে গভর্নর হাউস এখন পর্যন্ত অক্ষত। এই বাড়িটা জালানো খুব দরকার। কিন্তু ওসমান একা একা কি করে যায়? একা তার কিছু করবারই নাই, সে হলো এই বিশাল জনস্রোতের ১টি ঢেউ, ধাক্কায় ধাক্কায় গড়িয়ে চলেছে সামনের দিকে।
জিন্না এ্যাঁভেনু্য পার হবার আগেই নবাবপুর রোডে ২ পাশে আলো নিভে গেলো। নবাবপুর ১টা ল্যাম্পোস্টের ঘিঞ্জি মাথার জটায় আগুন লেগেছে। ওসমানের পাশে কে যেন বলে, ওদিকে যাবেন না, ইলেকট্রিক তারে আগুন ধরেছে আরজু হোটেলে। নিচে রেস্টরেন্টের মস্ত দরজায় আগুন জ্বলছে, দোতলাতেও আগুন। উল্টোদিকের আমজাদিয়া হোটেল থেকে চেয়ার টেবিল এনে তাও কিছু কিছু পোড়ানো হচ্ছে। তাদের আড়ড়ার কেন্দ্রেও ক্ষত বিক্ষত দেখে ওসমানের একটু খারাপ লাগে বৈ কি! কিন্তু কারেন্ট চলে যাওয়ায় অন্ধকার নবাবপুরে এই ১টি মাত্র জায়গায় আলো জ্বলছে, লেলিহান উর্ধ্বমুখ শিখা ভালো করে দ্যাখার জন্য জুত করে দাঁড়াবে বলে ওসমান ১টা জায়গা খোজে। অন্ধকারে লোকজনকে সব ছায়া ছায়া মনে হচ্ছে। এই ছায়াসমূহের মধ্যে আগুনের শিখায় দপ করে ওঠে হাড্ডি খিজিরের ভাঙাচোরা গাল। তার ১টি হাতে রয়েছে প্লায়ার। ব্যাটা বোধহয় গ্যারেজে কাজ করতে করতে হঠাৎ চলে এসেছে, জিনিসটা রেখে আসতে মনে ছিলো না। তার অন্য হাতটি ওপরে তুলে ধরা। এখান থেকে তার ভাঙা গালের উঁচু হাড়গুলো আগুনের আভায় লাল দ্যাখাচ্ছে, তাকে হঠাৎ খুব বিশিষ্ট বলে মনে হয়। খিজিরকে ডাকার জন্য ওসমান একটু এগিয়ে যায়, ভিড়ের মধ্যে যতোটা এগোনো সম্ভব। কিন্তু ওসমানের ডাক তার কানে পৌছুচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ডে সে মহা মগ্ন মনে হয়, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে-ই। এখন দগ্ধ বাড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মসূচী দেওয়ার কথা ভাবছে।
এর মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, কারফ্যু, কারফ্যু দিছে।’ সাড়ে সাতটা থাইকা কারফ্যু। বাড়ি যান, সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি যান। আবার কে যেন চিৎকার করে বলে, কারফ্যুর মারে বাপ। আমরা কারফ্যু মানি না! অন্ধকার নবাবপুর জুড়ে স্লোগান ওঠে, আইয়ুব শাহী’-‘ধ্বংস হোক!
লোকজন কিন্তু কমতে শুরু করে। কোন ১টি ট্রানজিস্টর সেট থেকে শোনা যায়, সাড়ে সাতটা থেকে শহরে করফু জারি হয়েছে। কতিপয় দুস্কৃতিকারী শহরে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে, সরকারী ও বেসরকারী সম্পত্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। আইন রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে ও নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। রাস্তায় কাউকে দ্যাখামাত্র সেনাবাহিনীর লোক সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করবে। এর পর লোকজন দ্রুত হাটতে থাকে। ১টি গুলির আওয়াজ আসে, একটু বিরতি দিয়ে আরো কয়েকবার গুলি চলে। কয়েকটি লোক গুলিস্তানের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে, বড়োকাটরায় পাবলিকে মুসলিম লীগ অফিসে আগুন দিছে। পুলিস গুলি করতাছে।’
খিজিরের সঙ্গে কথা না বলে ওসমান ভালোই করেছে। একবার দেখতে পারলে ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল হতো। ঠিক এই সময় খিজির এসে দাঁড়ায় তার পাশে, ‘আপনে? চলেন!
চলো’ ওসমান কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চায় না। এখানে থাকার জন্যে অনুরোধ করার কোনো সুযোগই খিজিরকে দেবে না। তাড়াতাড়ি চলো। সাড়ে সাতটা থেকে কারফ্যু, সোয়া সাতটা বোধহয় বাজে।
‘চলেন।’ খিজির কি ভয় পেয়েছে? তাহলে অন্ধকারে আগুনের আঁচে লাল মুখটা কি ওসমান ভুল দেখলো?
হাটতে হাটতে খিজির বলে, চলেন ঠাঁটারি বাজার দিয়া বারাই। দেইখেন, দেইখা পাও ফালায়েন, তারতুর ব্যাক পইড়া রইছে!
বঁদিকের রাস্তার মাথায় লম্বা লম্বা ইলেকট্রিক তার পড়ে রয়েছে মুখ থুবড়ে, বিদ্যুৎইন তারগুলো নিশপন্দ পড়ে থাকে মরা সাপের মতো। খিজির ভয় পেয়েছে ভেবে ওসমান স্বস্তি পায়, ওসমানের পদক্ষেপ তাই বেশ দৃপ্ত।
ওসমান জিগ্যেস করে, হোটেলে আগুন লাগাবার মানে কি? এটা কি গভমেন্টের বাড়ি? লাগাইবো না? খিজির খুব উত্তেজিত, মিছিল যায় আর হোটেলের মালিক হালায় উপর থাইক্যা দুইটা পানিভরা ঠিলা ফালাইয়া দেয়। এতোগুলি মানুষরে বেইজ্জত করে, হালাগো হিন্মতটা দেখছেন? বুঝলেন না? সইবার পারে না। গরীব মানুষ সিনা ফুলাইয়া রাস্তার মইদ্যে নাড়া লাগায়া হাঁটে, হালাগো কইলজা এক্কেরে ফালা হইয়া যায়! এতোগুলা মাইনষেরে তরা বেইজ্জত করস, পাবলিকে উংলি চুষবো? ওরা দুজন হাটছিলো বিসিসি রোড ধরে, তাদের পাশে আগুন ধরা হোটেলের দেওয়ালে। কথা বলতে বলতে খিজির হঠাৎ থামে। কি হলো? খুব মোটা-সোটা ১টা লোক হোটেলের পেছন দিয়ে বেরিয়ে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। তার পাশ দিয়ে লোকজন ছুটে যাচ্ছে হনহন করে। খিজির ফিসফিস করে, ফ্যাটি সোহরাব মালুম হয়! হায় হায়! চাল্লি হালায় বহুত মুসিবতে পড়েছে!’ ১ ভদ্রলোক হাটতে হাটতে বলে, ‘হ্যাঁ, হোটেলে ছিলো। আগুন লাগার পর বেরোতে গিয়ে হয়তো পড়ে গেছে! লোকটি চলে যায়, আরেকজন গতি কমিয়ে বলে, ঐ বডি নিয়ে এখন যাবে কি করে? সে-ও চলে যায়।
খিজির বলে, খাড়ান! মোটা লোকটির দিকে তাকিয়ে ওসমানের হাসি পায়। চলচ্চিত্রের কুাউন হয়ে লোকটা তার উপযুক্ত পেশা বেছে নিয়েছে। এতো বেঢপ মোটা যে কোনোরকম অভিনয় না করলেও তার চলে, তাকে দ্যাখামাত্র দর্শক হাসতে শুরু করে। কিন্তু তার দিকে ভালো করে তাকাবার পর ওসমানের হাসি মুছে যায়। তার ডান পায়ের পাতা আগুনে অনেকটা ঝলসে গেছে, পোড়া প্যাটের ফাক দিয়ে পায়ের ওপর ১টা ফোস্কা দ্যাখা যাচ্ছে, ফোস্কাটা মনে হয় বেশ বড়ো, তার শরীরের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়েছে। ব্যাটা কি পরিমাণে মদ টেনে ঘুমিয়েছিলো, এাঁ?ঠাঁটারি বাজার, আলু বাজার এমনকি এদিকে সিদিক বাজারের মানুষ পর্যন্ত এই আগুন-লাগা দেখে ছোটাছুটি করছে, আর সে কি-না তার বিশাল শরীরটাকে বিশালতর প্যান্টশার্টের ভেতর গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমায়? আহা, বেচারা এখন যায় কোথায়? শরীর দেখে মনে হয় সুস্থ অবস্থাতেই সে ঠিকমতো হাটতে পারে না, আর এখন তো রীতিমতো আহত।
ফ্যাটি সোহরাবের হাত ধরে খিজির বলে, ‘হায় হায়! আপ কেতনা মাল পিয়া থা ওস্তাদ? তামাম দুনিয়াক আদমি হালা হাউকাউ কর রাহা, আওর আপ আরামসে নিদ রাহা? তারপর তার পিঠে হাত রেখে বলে, মেরা হাত পাকড়িয়ে! কৌতুক-অভিনেতা ফ্যাটি সোহরাব কোকাতে কোকাতে জানায় যে আলুবাজারে লুৎফর রহমান লেনে তার বন্ধু থাকে, একটা রিকশায় উঠিয়ে দিলে সে সেখানে যেতে পারে। খিজির ফের হাসে, রিকশা কাহা ওস্তাদ? আজ ইস্ট্রাইক নেহি? তার হাসি আর থামে না, হাসতে হাসতে কোনো চলচ্চিত্রে এই অভিনেতার ১টি সংলাপ আওড়ায়, আরে বেগমসাব, তড়পাতে কিউ? ফিকির মত কিজিয়ে আগর আপ গির যায়ে তো ম্যায় খামোশ বয়ঠে কায়সে ইস দরিয়া মে দোনো কেলিয়ে কাফি জায়গা নেহি মিলেগা? ওসমান বলে, বাদ দাও খিজির, তাড়াতাড়ি চলো। খিজিরটা কি গাধা নাকি? এ কি রঙ্গতামাসার সময়? আর আহত মানুষটাকে নিয়ে সে কি শুরু করলো? খিজিরের কি দয়ামায়া নাই? খুব বিরক্ত হয়ে খিজিরকে সে ধমকায়, ভদ্রলোককে ছেড়ে দাও খিজির চলো, তাড়াতাড়ি চলো চল্লি-সম্বন্ধে ভদ্রলোক বলায় খিজির ফের একচোট হাসে, তারপর বলে, ‘ছাড়লে যাইবো কৈ? পায়ের মইদ্যে বহুত চোট পাইছে। দেখছেন? বলতে বলতে তার হাসির নতুন দমক ওঠে, ওস্তাদ, ডাকু লড়কি মে আপ ক্যায়সা করকে গিরা থা, ইয়াদ হ্যাঁয়?
ওসমান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, লোকটার কি কিছুমাত্র বিবেচনা বোধ নাই? একটু আগেই না এর রাগী ও ভাঙ্গাচোরা গাল গরম লোহার মতো ভয়ানক দ্যাখাচ্ছিলো! অথচ কিছুক্ষণ যেতে না যেতে তার এ কি তামাশা? খিজির বলে, ‘চলিয়ে ওস্তাদ, আপকো আলুবাজার পৌঁছ দে। তারপর সেই বিশাল মোটা দেহটি তার হাড়গিলা গতর দিয়ে ঠেক, দিয়ে সামনে যেতে যেতে ওসমানকে বলে, ‘আপনে যান গিয়া৷ ইনারে দোস্তের বাড়ি দিয়া আহি!
ওসমান অস্থির হয়ে বলে, কারফ্যু আরম্ভ হয়ে গেছে। তুমি ফিরবে কিভাবে? ফ্যাটি সোহরাবের শরীরের দিকে তাকিয়ে খিজিরের বোধহয় আরো ফিল্যের কথা মনে পড়ে, কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে বলে, কি করুম? মোটা মানুষ, পাও একখান তো গেছে, একলা যাইবো ক্যামনে?
আবার কোথেকে স্লোগান ও গুলিবর্ষণের আওয়াজ আসে। লোকটিকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে খিজির বলে, বহুত ভারি মাল! দশখান মাইনষের লাশ মালুম লয় পাকিন কইরা ফালাইয়া রাখছে!’ ফ্যাটি সোহরাবকে ধরে এগোতে এগোতে খিজির একবার পেছনে তাকায়, আপনে যান গিয়া!
১টি কথা না বলে ওসমান হন হন করে উল্লোদিকে হাঁটে। র্যাঙ্কিনস্ট্রিটেও কারেন্ট নাই। অন্ধকার বাড়ির সামনে জটলা করে লোকজন ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়ে। ফাঁকা হয়ে আসছে। ওদিকে কোথায় গুলি হচ্ছে তো হচ্ছেই। কারফ্যু শুরু হয়ে গেছে, কখন মিলিটারির লরি এসে ব্রাশ-ফায়ার শুরু করবে! বনগ্রামের মাথায় কয়েকজন লোক দেখে সে ঐ রাস্তাতেই ঢোকে এবং বনগ্রাম লেন হয়ে হেয়ার স্ট্রিটের এপারে ও ওপারের মুচিপাড়া পেরিয়ে পৌঁছে যায় গোপীকিষণ লেনে। এখানটা ঘোরতর অন্ধকার ও সাঙ্ঘাতিক নির্জন। এখন এই রাস্তার শেষে টিপু সুলতান রোড ধরে গেলে তার আর রক্ষা নাই, ঐ রাস্তাটা একেবারে খোলা, নারিন্দা বা নবাবপুর যে কোনো দিক থেকে আর্মির গাড়ি আসতে পারে। সে তাই নবাব স্ট্রিটে পা দিয়ে ফের র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের দিকে রওয়ানা হলো। অন্ধকার ও ছমছমে নির্জন রাস্তা! কারফ্যু আর আর্মি! আর্মি আর কাফু উদ্বেগ ও ভয়ে ওসমান খুব তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গন্তব্য ও হটবার উদ্দেশ্য হঠাৎ ঝাপশা হয়ে আসে। বুকের টিপ টপ আওয়াজ কানে বাজে প্রায় ঘন্টাধ্বনির মতো। এতো জোরে ঘন্টা বাজায় কোন দপ্তরি? রঞ্জুর কি স্কুল ছুটি হলো? স্কুল ছুটির পর ক্যাপ্টেনের পেছনে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন শালা আছে শঙ্করের সঙ্গে কেটে পড়ার তালে। যাক ওরা যেখানে খুশি যাক, রঙ্গু একা একা তাতী বাজারে গিয়ে আরতির সঙ্গে একটু গল্প করবে। ক্যাপ্টেন জানতেও পারবে না। কোথেকে একটা ঘর্ষর আওয়াজ এসে তাকে চমকে দিলো, একি, ক্যাপ্টেনকে গুলি করে মেরে ফেললো নাকি?—আওয়াজটা আসছে ওপর থেকে। ওপরের দিকে ঘাড় তুলে ওসমান দ্যাখে একটু দূরে দৈনিক পয়গাম অফিসের ছাদে জলপাই রঙের পোষাক ও হেলমেট পরা আর্মির লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে সার বেঁধে। ওখান থেকেই মাইকে কারফ্যু জারি ও কারফ্যু অমান্যকারীদের শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। ঐসব লোকের হাতে অটোমেটিক ফায়ার আর্মস। তাহলে ক্যাপ্টেন আসে কি করে? সমস্ত ব্যাপাটা বড়ো রহস্যময় ঠেকে। হয়তো এই রহস্যময় ও অলৌকিক দৃশ্যের তাড়ায় তার পা ২টো পরিণত হয় ডানায় এবং সে প্রায় উড়ে চলে। র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের টিপু সুলতান রোড ক্রস করে ওসমান পৌঁছে যায় ভজহরি সাহা স্ট্রিটে। পদ্মনিধি লেন পার হয়ে পুকুরের ধার দিয়ে হেঁটে দোলাই খালের ওপর এবড়োখেবড়ো-করে-ফেলা নতুন মাটির স্তুপ ডিঙিয়ে কলতাবাজারে পৌঁছেও তার ভয় কাটে না। এদিক কম হলেও লোকজন চলাচল করছে। এদের মধ্যে নিহত ক্যাপ্টেন শালাও থাকতে পারে। আর্মির সঙ্গে একজোট হয়ে ও কি তাকে তাড়া করছে? বাড়িতে যেতে হলে লক্ষ্মীবাজারের সদর রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয়। তবে এমন সব গলি উপগলি আছে যেগুলো তাকে প্রায় কোলে করে নিয়ে আস্তে রেখে দেয় এমন জায়গায় যেখান থেকে ঠিক ৫টা ৬টা স্টেপ পার হলেই বাড়িতে ঢোকার দরজা। ভেজানো দরজা ঠেলতেই খুলে গেলো। তবু বলা যায় না! আর্মির গাড়ি কিংবা নিহত কাপ্টেন তার পিঠ তাক করে ট্রিগার ছুড়লেই সিঁড়ি থেকে সে গড়িয়ে পড়বে নিচে। না, তা হতে দেওয়া যায় না। এতো জনাকীর্ণ রাস্তাঘাট, এতো মিছিল, এই রাগী শহর-সব, সবই অব্যাহত চলবে, আর সেই কেবল মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে এই সিঁড়ির নিচে? অতো সোজা?
ওসমান লাফিয়ে ওপরে উঠছিলো। দোতলা অতিক্রম করে গেলে পেছন থেকে তীব্ৰগতিতে এসে বিদ্ধ করে ২টো শব্দ, এতোক্ষণে আসলেন? আরো ২টো ৩টে ধাপ পেরিয়ে ওসমান পেছনে তাকায়। রানুকে সম্পূর্ণ দেখতে না দেখতে তার চোখজোড়া শাস্তিতে বুজে আসে। রানুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের রেশ তার কানে গুনগুন করে। ওসমান খুব ঝান্ত পায়ে এবার আস্তে আস্তে আরো ২টো ধাপ ওঠে, রানুর শুকনা গলার ফ্যাসফেসে ধ্বনিও তার সঙ্গে ওপরে ওঠতে থাকে। এবার সে নামে, ঘুরে দাঁড়িয়ে সরাসরি রানুর দিকে তাকায়। ঘোলাটে আলোতে তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রানু নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।
কয়েক পলক দাঁড়িয়ে ওসমান ফের নেমে এসে ধাক্কা দেয় রঞ্জুদের দরজায়, ডাকে, রানু রানু। এই দরজায় এসে সে রানুকে কখনো ডাকেনি। এখানে এলে রঞ্জু বলে ডাকতে তার ভালো লাগে এবং এই নামটা বেশ মোলায়েম ও স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা যায়। আজ কিন্তু রানুকে ডাকতে তার একটুও সঙ্কোচ হলো না।
দরজা খুললো রঞ্জ। খুলেই বলে, আপনে গেছিলেন কৈ কন তো? সন্ধ্যাবেলা না কারফ্যু দিছে! আমি ভাবলাম উনি হয়তো আর্মির হাতে গুলি টুলি খাইছেন? গুলি লাগলে আর আসতেন ক্যামনে?
ওসমানের একটু খারাপ লাগে। রঞ্জু কি ওসমানের মৃত্যু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলো না? দ্যাখা হওয়া দরকার রানুর সঙ্গে। রানু কোথায় গেলো? রঞ্জকে পাত্তা না দেওয়ার জন্যেই সে জোরে জোরে জিগ্যেস করে, রানু কোথায়?
জানেন, আজ কতো জায়গায় আগুন দিছে? পাবলিকে মিলিটারি টিলিটারি কিছু মানে না। দরজায় দাঁড়িয়ে রঞ্জ এক নাগাড়ে কথা বলে। ছেলেটার এই ১টা দোষ রানু কিন্তু এরকম নয়। রানু বরং তার কথাই শুনবে। ওসমানের এখন ১জন শ্রোতা চাই। তারানু ছাড়া তার কথা আর শুনবে কে? দরজায় দাঁড়িয়েই সে উঁচু গলায় বলে, ‘আরে আমি তো বাইরেই ছিলাম। দুপরবেলা সেক্রেটারিয়েটের সামনে আগুন জ্বালানো হলো আমার সামনে। মর্নিং নিউজ অফিস পোড়ানো হলো আমার সামনে। তারপর, আরজু হোটেল চেনো? আমার সামনে আগুন জ্বালালো। বড়ো কাটরায় মুসলিম লীগ অফিস পুড়ে শেষ। গভর্নর হাউসে গেলাম, মোনেম খান কোনদিক দিয়ে পালিয়ে গেছে, না হলে ব্যাটা পুড়ে মরতো! তার কথার সবটা সত্যি নয়, কিন্তু বলতে বলতে কোনটা ঘটেছে আর কোনটি ঘটেনি ওসমান নিজেই বুঝতে পারে না।
তার কথা শুনে দরজায় চলে এসেছে মকবুল হোসেন, ‘ভেতরে আসেন, ভেতরে আসেন। বসেন। আপনে সারাটা দিন আছিলেন কৈ, কন তো? রানু বললো আপনে ঘরে ফেরেন নাই। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। বসেন। ঘরে একটা ভাঙা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসতে যাচ্ছিলো ওসমান। মকবুল হোসেন একেবারে হা হা করে ওঠে, আরে এই চেয়ারে বসেন। এখানে বসেন।
ওসমান বিনা দ্বিধায় এই সম্মান গ্রহণ করে এবং হাতল ছাড়া ভালো চেয়ারটিতে বসে সারা দিনের দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাড়ে।
মকবুল হোসেন বলে, যাই কন, এইগুলি বাড়াবাড়ি। শৃঙ্খলা না থাকলে মানুষ সুখে থাকে ক্যামনে, কন? গভমেন্ট খারাপ, তো এ্যাঁরে সরাইয়া অন্য গভমেন্ট বসাও। কিন্তু এইরকম হট্টগোল কইরা, জ্বালাইয়া পুড়াইয়া লাভ কি?
ওসমান বেশ জোর গলায় জবাব দেয়, বাড়াবাড়ি করছে কে? কথা বললেই গুলি, টিয়ার গ্যাস। মানুষের মিনিমাম রাইট নেই। গভমেন্ট বাড়াবাড়ি করলে পাবলিক এ ছাড়া কি করতে পারে?
রানু আসে চা ও টোস্ট বিস্কুট নিয়ে। সরকারের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে জনতার কার্যকলাপে সে ঘোরতর সমর্থন জানায়, মানুষ খালি বইসা মার খাবে? পুলিশ মিলিটারি যদি গুণ্ডার মতো হয় তো মানুষ কি করতে পারে?
রানুর মন্তব্যে অভিভূত ওসমান কোনো কথা বলতে পারে না। তখন ভেতর থেকে আসে রানুর মায়ের একটানা কান্নার শব্দ। বাইরে আজ কোথায় কোথায় গুলিবর্ষণের খবর শোনবার পর থেকে মহিলা এভাবে কেদেই চলেছে। ওসমানের মনে হয় আজকের সব ঘটনার এতোটা বর্ণনা সে না দিলেই পারতো। চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়, যাই ঘরে যাই। রাত হলো!
আপনে তো খান, নাই? রাত্রে খাবেন কোথায়? রানুর এই কথায় মকবুল হোসেন মহা হৈচৈ করে। তাইতো, কারফ্যুর ভেতর ওসমান আবার খেতে যাবে কি করে? ওসমান এদের সঙ্গে খেতে রাজি হলে মকবুল হোসেন ভেতরে গেলো।
রানু বলে, ঠিক আছে, আপনে যান। হাতমুখ ধুইয়া বিশ্রাম করেন। রঙ্গু ভাত দিয়া আসবে।
ওসমান তার দিকে সরাসরি তাকায়, তুমি যাবে না? বলেই ফের যোগ করে, তোমার পড়াশোনা কি মাথায় উঠলো?
ভাত তরকারি নিয়ে এসেছিলো মকবুল হোসেন। বেশ স্বাভাবিক গলায় ওসমান বলে, কাল বোধহয় অফিস টফিস হবে না। রানুকে বইপত্র নিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। পরীক্ষা তো এসে গেলো।
খাওয়ার পর ওসমান সটান শুয়ে পড়ে। এক নাগাড়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রানুর এতোক্ষণে আসলেন’-শব্দ দুটোর রেশ কানে গুনগুন করলে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসলো না, রানু কোথায়? মাথার ওপর এক ঝাক মশার বিরতিহীন গুঞ্জন। লেপের বাইরে বেরিয়ে-পড়া পায়ের পাতায় এখনো শুড় আটকে রয়েছে বেশ কয়েকটা মশা। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লে ঘুম আর ভালো করে জমে না। সিঁড়ির দিককার দরজায় হাল্কা পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে কি? রানু কি পা টিপে পা টিপে ওর কাছে আসছে? রানু যদি এসে ওর পাশে বসে, যদি বলে, মশা খাইয়া একেবারে শেষ কইরা ফালাইলো-দূরা তাই কি হয়? কয়দিন আগে অফিসের বস ১৯৬৯ সালের ১টা ডায়েরি দিয়েছে, কাল রানু পড়তে এলে ওটা ওকে দিয়ে দেবে। রানু কি বিছানায় ওর পাশে বসবে? সেই সময় ওর গলা জড়িয়ে ধরে ওকে পাশে শুইয়ে দেওয়া যায় না?-দূর। এই মেয়েটার ভাবনা তার ঘুমটা নষ্ট করে দিলো। ছাদে একটু পায়চারি করে আসবে নাকি? গা থেকে লেপ সরিয়ে ওসমান একবার ওঠার উদ্যোগ নিলো। না, ঠাণ্ডা লাগছে। লেপটা গায়ে দিতেও ইচ্ছা করে না। এর মধ্যে কুস্তিতে চোখ জড়িয়ে আসে। কিন্তু মতিঝিল কি নবাবপুরের আগুনের আঁচে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। পাতলা ঘুম কি তন্দ্রায় আগুনের শিখার পাশে দ্যাখা যায় হাজার হাজার মানুষের লালচে শক্ত মুখ। কিন্তু ওসমান নিজেকে কোথাও খুঁজে পায় না। স্বপ্নে মানুষের ভিড়ে নিজের চেহারা ঠাহর করতে গিয়ে তার চোখ খচখচ করে। একবার খিজিরের মতো কাউকে দ্যাখা গেলো। হ্যাঁ, খিজিরই তো। ঐতো ১ হাতে প্লায়ার, অন্য হাতে কোরোসিন তেলের গ্যালন ভরা টিন। স্বপ্লের মধ্যেই মনে হয়, খিজিরের হাতে তো টিন ছিলো না। তাহলে ওটা কে? ১বার দ্যাখে খিজির তার লাল রেখা-উপরেখা খচিত চোখে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আগুনের শিখায় অতো দাখার বস্তু কি আছে? খিজির মনে হয় শিখার ভেতরকার শাস দেখে নেওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। স্বপ্নে দ্যাখা এই আগুনের ওমে ভোরের দিকে ওসমান গড়িয়ে পড়ে গভীর ঘুমের ভেতর।