চিলেকোঠার সেপাই – ২১
রায়সায়েবের বাজারের পুলের মুখে মসজিদের উল্টোদিকে বন্ধ হার্ডওয়্যার দোকানের রকে দাঁড়ালে মানুষের আর শেষ দ্যাখা যায় না। ওসমান প্রথমে তাকায় উত্তরে। কালো কালো হাজার হাজার মাথা এগিয়ে আসছে অখণ্ড স্রোতোধারার মতো। এই বিপুল স্রোতের মধ্যে ঘাইমারা রুইকাতলার কাক নিয়ে গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে কোটি ঢেউয়ের ঢল। দক্ষিণে তাকালেও দ্যাখা যায় এই সোতোধারা কেবল এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ক্যালেন্ডারে যা-ই থাক, ঢাকায় আজ আষাঢ় মাস। উত্তর থেকে আসে বরফ-গলা শহরের স্রোত, উপচে উঠে মানুষ গড়িয়ে পড়ছে পাশের গলিতে উপগলিতে। গলি-উপগলি ভরা কেবল মানুষ, দুই পাশের বাড়িগুলোর ছাদ পর্যন্ত মানুষ। গলি উপগলি থেকে স্রোত এসে মেশে মূলধারার সঙ্গে, মানুষ বাড়ে, নবাবপুর সামলাতে পারে না, মানুষের প্রবাহ ফের গড়িয়ে পড়ে পাশের ফাকা গলিতে। ফাকা গলি কি আর আছে? সব জায়গা কানায় কানায় ভরা। ঢাকায় কি এতো লোক বাস করে? মনে হয় ঢাকা শহর তার ৩৫০/৪০০ বছরের বুড়ো হাবড়া রোগাপটকা লোনা-ধরা গতর ঝেড়ে উঠে ছুটতে শুরু করেছে সামনের দিকে। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। ওসমানের বুক ধক করে ওঠে, এই এতোদিনকার শহর কি আজ তার সব মানুষ, সব রাস্তা গলি উপগলি, বাড়িঘর, সব অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে গড়িয়ে পড়বে বুড়িগঙ্গার অতল নিচে। না দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তার শীতের শীর্ণ তনু একেবারে নিচে ফেলে উঠে এসেছে বিপুল স্ফীত হয়ে, বুড়িগঙ্গার অজস্র তরঙ্গরাশির সক্রিয় অংশগ্রহণ না হলে কি এরকম জলদমন্দ্র ধ্বনি উঠতে পারে, আসাদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করে ওসমান, না হে, মিছিলের মাথা দ্যাখা যায় না। অনেক সামনে উঁচু ১টা বাশের মাথায় ওড়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের লাল ঝাণ্ডা। বাঁশের মাথায় এই শার্ট হলো দস্তি দারের হাতের লাললণ্ঠন। নদীর জাহাজ নয়, নদীই আজ ছুটতে শুরু করেছে দস্তিদারের লাল লষ্ঠনের পেছনে। এই পাগলপারা জলোস্রোতকে আজ সামলায় কে? ভরা বুকেও ওসমানের একটু খারাপ লাগে বৈ কি?-আনোয়ারটা এসব দেখতে পারলো না। এতো বড়ো মিছিল ঢাকায় কোনোদিন বেরিয়েছে? বেচারা কোথায় কোন গ্রামে গেলো, গ্রামে যতো আন্দোলন হোক, এতো মানুষ কি একসঙ্গে দ্যাখা যাবে? কাল ইউনিভারসিটির ছেলেকে মেরে ফেললো আইয়ুব খানের পুলিস, এতো বড়ো বিক্ষোভ ঘটে যায়, আনোয়ার কিছুই দেখতে পারলো না। আনোয়ার কি জানে যে ঢাকা এতো মানুষকে ঠাই দিতে পারে? সেই কোন ছেলেবেলায়, ৪ বছর বয়সে ওসমান ঢাকায় এসেছে। দিন যায়, লোকসংখ্যা বাড়ে, এলাকা প্রসারিত হয়। কিন্তু না, এতো মানুষ ঢাকায় সে কোনোদিন দ্যাখেনি। কোন বইতে যেন পড়েছে, শায়েস্তা খান কার আমলে ঢাকায় লোকসংখ্যা নাকি লন্ডনের চেয়ে বেশি ছিলো। সে কবে? কতোকাল আগে? ওসমানের বুক ছমছম করে: এই এতো মানুষের সবাই কি তার মতো শ্বাসপ্রশ্বাসনেওয়া মাছ-ভাত খাওয়া সাধারণ মানুষ? এই যে জনপ্রবাহ, এর অনেকের কাপড় চোপড়, চেহারা তার কাছে অপরিচিত ঠেকছে? এরা কে? তার মানে, অনেক কাল আগেকার মানুষও কি মিছিলে যোগ দিয়েছে? ঐ তো, মিছিলের মাঝখানে ইসলাম খাঁর আমলের খাটো-ধুতিপরা ঢাকাবাসী! এমনকি তারো আগে চালের বস্তা বোঝাই নৌকা বেয়ে যারা সোনারগাও যাতায়াত করতো তারাও এসেছে। বাঙলা বাজার, তাঁতীবাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তো ইব্রাহিম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি-পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খাঁর টাকায়-আট-মণ-চালের আমলে না-খেয়ে-মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই,-কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মোগলের হাতে মার-খাওয়া, মগের হাতে মারখাওয়া, কোম্পানীর বেনেদের হাতে মার-খাওয়া—সব মানুষ না এলে এই মিছিল কি এতো বড়ো হয়? রেসকোর্সের কালীবাড়ির ইটের শুকনা পরত খুলে খাড়া হাতে নেমে এসেছে মারাঠা পুরোহিত, মজনু শাহের ফকিররা এসেছে, ঐ তো বুড়ো আঙুল-কটা মুষ্ঠির ঘাই ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে মসলিন তাঁতী, তাদের কালে কালো খালি গা রোদে ঝলসায়। ৪০০০ টাকা দামের জামদানী-বানানো তাঁতীদের না-খাওয়া হাড্ডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলছে। সায়েবদের হাতে গুলিবিদ্ধ বাবুবাজার মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন মুসল্লিরা চলেছে, বিড়বিড় করে আয়াত পড়ার বদলে তারা আজ হুঙ্কার দিচ্ছে, বৃথা যেতে দেবো না লালমুখে৷ সাহেবদের লেলিয়ে-দেওয়া নবাব আবদুল গনি-রূপলাল মোহিনীমোহনের শ্বাদন্তের কামড়েক্ষতবিক্ষত লালবাগ কেল্লার সেপাইরা আসে, ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে গলায় দড়ি ছিঁড়ে নেমে আসে মীরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, সন্দ্বীপ-সিরাজগঞ্জ-গোয়ালদের সেপাই। না হে, তাতেও কুলায় না। যুগান্তর অনুশীলনের বেনিয়ান ও ধুতি-পরা মাতৃভক্ত যুবকেরা আসে, তাদের মাঝখানে কলতাবাজারে নিহত ছেলে ২টিকে আলাদা করে চেনা যায়। নারিন্দার পুলের তলা থেকে দোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। ঐ তো বরকত মাথার খুলি উড়ে গেছে, দেখে একটু ভয় পেলেও ওসমান সামলে ওঠে। এতো মানুষ। নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠেছে আজ, ঢাকা আজ সকাল-দুপর-বিকাল-রাত্রি বিস্মৃত, আর তার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ নাই, সপ্তদশঅষ্টাদশ-ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত। সীমাহীন কাল সীমাহীন স্থান অধিকারের জন্য ঢাকা শহর আজ একাগ্রচিত্ত। ওসমানের বুক কাপে এই বিশাল প্রবাহের সঙ্গে সে কতোদূর যেতে পারবে? কতোদূর? গোলক পাল লেনের মুখে কলের নিচে কাঁপতেথাকা কলসি যেমন পানিতে ভরে স্থির হয়, আমাদের ওসমান গনির বুকটাও দেখতে দেখতে পূর্ণ হলো, এই অবিচ্ছিন্ন স্রোতোধারার ক্ষুদ্রতম ১টি কণা হয়েও তো সে এই হৃৎপিণ্ডে তাপ বোধ করতে পারছে। তাই বা কম কি? ভরা-বুকে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে সে হুঙ্কার দেয়, বৃথা যেতে দেবো না।
ওসমান!
ওসমান প্রথমে এই ডাক শোনে নি। আরেকবার ডাকলে সে চমকে ওঠে, কে ডাকে? মজনু ফকিরের কোনো কর্মী তাকে চেনে? নাকি ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে দড়ি ছিঁড়ে-আসা-বেরিলির সেপাই? নাকি সোমেন চন্দ?-কে ডাকে? তার শরীর শিরশির করে। তাকে কে চেনে? এখানে কে চেনে?
‘ওসমান! এই যে!
কে?
আরে রকে দাঁড়িয়ে কি করছেন? আসেন। শওকতের হাতের চুরুট নিভে গেছে, ফের ধরাতে ধরাতে বলে, ‘আসেন।
শওকতের পাশে চলতে চলতে ওসমান এদিক ওদিক তাকায়। ঐ লোকগুলো গেলো কোথায়? আনোয়ার থাকলে এসব কথা বলা যেতো। শওকত বিশ্বাস করবে না।
বেলাগড়ায়। বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি ইসলামপুর ধরে আরেকটি স্রোতোধারা বইছে। চাপা রাস্তায় অকুলান হয় বলে উঁচু উঁচু বাড়ির মাথা থেকে পা পর্যন্ত থৈ থৈ করে মানুষ, কেবল মানুষের পাক, মানুষের ঢেউ।
বাবুবাজারে পৌঁছে শওকত বলে, ‘চলেন কিছু খেয়ে নিই। সোয়া তিনটে বেজে গেছে। কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছা ওসমানের একেবারেই নাই। যতোই বাজুক, হোক না শীতকাল, ঢাকায় আজ ভরা বর্ষা। বর্ষাকালের মেঘহীন আকাশে কিসের দুপুর, কিসের বিকাল? এই তো একটু গেলেই বাবুবাজারের পুল, তারপর দুদিকে কেমিক্যাল ও পারফিউমারি দোকান, সুগন্ধের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে কিছুটা পার হলেই চকবাজারের ফাঁড়ি, সেখানে একটা চক্কর দিয়ে এই সোতোধারা চলে যাবে জেলখানার দিকে, জেলখানার পাশ দিয়ে নাজিমুদিন রোড। জেলখানার দেওয়াল ঘেঁষে যাবার সময় এর ঢেউ কি আরো উত্তাল হয়ে উঠবে না? এমন তো হতে পারে জেলখানার কাছে পৌছুলে এই ঢলের মুখে ভেঙে পড়লো জেলখানার মস্ত উঁচু দেওয়াল হতে পারে না? ভেঙে পড়লো জেলখানা, জেলখানার নিচে লুকিয়ে থাকা ইব্রাহিম খাঁর দুর্গ, সাহাজাদা খুররমের দুর্গ? ওদিকে চলবে এই প্লাবনের ভাঙন, আর সে কি না বাবুবাজারের কোনো এক নিচু ছাদ-চাপা রেস্টুরেন্টে বসে রুটি-গোশত গিলবে?
না, না। চলেন। শহীদ মিনার পৌঁছে না হয় কিছু খেয়ে নেবো।
‘আরে আমরা খেতে খেতে মিছিল আর কতোদূর যাবে? এতো বড়ো মিছিল, এর শেষ মাথা আসার আগেই আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাবে।’
ওসমান কোনো খুঁকি নিতে চায় না, মিছিল যদি তাদের ছেড়ে এগিয়ে যায় বলে, দরকার কি? রেক্সে গিয়ে পরোটা-শিককাবাব খাওয়াবো। এখন চলেন।’
শওকতকে ঠেকানো অতো সোজা নয়, হু কেয়ার্স ফর পরোটা-শিককাবাব? চলেন, পালোয়ানের দোকানে মোরগ পোলাও মেরে দিই।
কিন্তু ওসমানের ভয় হয় মূল স্রোতোধারা থেকে ছিটকে পড়ে একটি নিঃসঙ্গ জলবিন্দুর মতো সে আবার হাওয়ায় শোষিত না হয়। খুব আস্তে করে বলে, আপনি খেয়ে নিন। আমি যাই। কিন্তু এই কথা এতো আস্তে বলা হয়েছে যে, শওকত তাতে কান দেয় না। কিংবা শওকতের চুরুটের গন্ধে কি তার খিদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে? চুপচাপ সে শওকতকে অনুসরণ করে। ওসমানের পাশ দিয়ে মিছিল গর্জন করতে করতে সামনের দিকে চলে।
রাস্তা থেকে খুব সরু ও ছোটো গলি, তারপর ২টো ৩টে ধাপ নিচে নামতে হয়। ঘরে ঢোকার আগেই মোরগ পোলাওয়ের গন্ধ মাথা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করে। ওরা বসার কিছুক্ষণের মধ্যে ২টো প্লেট আসে, পোলাওয়ের ওপরে ২টো মুরগির রান। পাশে এনামেলের ২টো পিরিচে কলজে ও গিলা।
খেতে খেতে মুখ তুললে দেওয়ালের আয়নায় ওসমান বাঁকা-চোরা প্রতিফলন দ্যাখে। চারিদকের দেওয়াল জুড়ে আয়না, যেদিক তাকানো যায় মোগর-পোলাওতে-মনোযোগী মানুষের মুখ। এতো মানুষের প্রতিকৃতির মধ্যে ওসমান নিজেরটা খোজে। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে না পেরে তার গলা শুকিয়ে আসে, তার মুখ কোথায়? আয়নায় সবাই আছে, তো সে নাই কেন? এতো মানুষের মধ্যে সে কি তবে হারিয়ে গেলো? তাহলে মিছিলে লক্ষ মানুষের মধ্যে তার গতি হবে কি? খাওয়া স্থগিত রেখে ওসমান আয়নায় নিজের চেহারা সনাক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শওকত জিগ্যেস করে, কি হলো? আর এক হাফ আনতে বলি? বলতে বলতে শওকত হাত তুললে আয়নায় তার প্রতিকৃতি আলাদা করে বোঝা যায়। পাশে ওসমান। স্বস্তি পেয়ে ওসমান ফের রান চিবায়। তবে আয়নায় তাকে বেশিরকম ইয়াং লাগছে, চেহারাটা একেবারে বালকোচিত হয়ে গেছে। মুরগির রানের হাড়ের ভেতরকার কচুকুচে শাস তার দাঁতে জিভে টাকরায় ও গালের ভেতরদিকের দেওয়ালে অপূর্ব স্বাদ ঘনীভূত করে তোলে। এই স্বাদ কি তার জিভের ও মুখের এতোকালের আস্তরণ ভেদ করে কতোকাল আগেকার অন্য ১টি মুরগির অন্য ১টি রানের পিষ্ট আমিষকে উথিত করে তুলছে? এইতো আয়নার দ্যাখা, দিব্যি বালক হয়ে ওসমান পোলাওয়ের এাস মুখে নিচ্ছে। তার সামনে কে? একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারে যে, সামনে ক্যান্টেন। কাপ্টেনকে মনে নাই? কুাস সিক্সে, কুসি সেভেনে ক্যাপ্টেন আর ওসমান একই বেঞ্চে বসতো, বাইরে বেড়াতো এক সঙ্গে। প্রথমদিকে কিন্তু এতো খাতির ছিলো না। স্যার কাসে ঢোকার আগে গোলমাল করার জন্যে ছেলেদের নাম লেখার দায়িত্ব ছিলো ক্যাপ্টেনের, তাকে তাই যমের মতো ভয় করতো সবাই। তাকে তোয়াজ করতে করতেই খাতির জমে গেলো। আজ এতোকাল পর ক্যাস্টেনের সঙ্গে সে এই দোকানে বসে মোরগ-পোলাও খাচ্ছে ওসমানের হাসিও পায়, এতোকাল আগেকার সব ঘটনা, ঠিক মনে থাকে। আবার দাখা পরশুদিন পড়া বই দিব্যি ভুলে যাই।-ওসমান চারদিকে তাকায়, এখানে এর আগে একবারই এসেছিলো; না, সব অমনি আছে। সামার ভ্যাকেশনের আগের দিন স্যারদের সেবার মোরগ-পোলাও খাওয়ানো হলো। ছুটির আগের দিন ওদের স্কুলে ক্লাসে ছোটো উৎসব হতো। হেড স্যারের নেতৃত্বে
পাকিস্তান জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ /পুরব বাঙালার শ্যামলিমায়/পঞ্চ নদীর তীরে অরুশিমায়/’-আর কোনো লাইন মনে নাই। গান করতে করতে কেউ হেসে ফেললেও স্যরর সেদিন কিছু বলতো না। গানের পর হেডসরের বক্তৃতা, তারপর খাওয়া দাওয়া। প্রস্তুতি চলতো কয়েকদিন আগে থেকে। সাররা ক্কাসে এসে উস্কে দিয়ে যেতো। রমিজ স্যর হয়তো বললো, কি রেকটাবানরের দল, এবারও কি কদলীভক্ষণ? গতবার এই ছেলেদের কুাসে সিঙাড়া মিষ্টি কম পড়ায় ঐ স্যরদের কেবল কলা খেয়ে বিদায় নিতে হয়েছিলো। রমিজ স্যর তাই মনে করিয়ে দিলো, ‘শোন, ‘ক্সাস ফোরের সব বাচ্চা বাচ্চা ছেলে, এবার পরোটা-কাবাব-পনিরের ব্যবস্থা করছে! তোমরা সব ধাড়িগুলো ডালে বসে কদলী সেবন করো। আবার সারদাবাবু এসে উপদেশ দেয়, এবার কালচান্দরে আগেই বইলা রাখিস। কাস সিক্স আষ্ট আনা প্লেট মিষ্টি দিবো, আগে অর্ডার না দিলে ফকির মধ্যে পড়বি কইয়া রাখলাম!’
সাইনু পালোয়ানের দোকানে আগেই বলা ছিলো, সেবার কুস সেভেন মোরগ-পোলাও দিয়ে সবাইকে থ করে দেবে! ক্যাপ্টেন খুব ভোরে জানলার কাছে এসে ডাকে, এই রঞ্জ, ওঠ। রঞ্জ তো রাত থাকতে জেগে বসে আছে, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বেরিয়ে দ্যাখে তাদের রাজার দেউড়ির ভাঙাচোরা বাড়িঘরের ছাদে, লোনা-ধরা দেওয়ালে, খোয়া ও পিচ-ওঠা গলিতে কী সুন্দর গোলাপি রঙের ভোর। কয়েক পা হেঁটে ক্যাপ্টেন বলে, ল, মালাউনটারে লগে লই। শঙ্করকে মালাউন বলে ওর প্রতি নিজের দুর্বলতাকে ক্যাপ্টেন আড়াল করতে চায়। রঞ্জ এসব তখনই বুঝতো বুঝতো না কে? কুসে স্যর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যাদের নামে শাস্তিবিধানের সুপারিশ করা হয় তাদের মধ্যে শঙ্কর কখনো থাকে না। আবার স্কুলের পায়খানার সারির পেছনে একদিন স্কুলে ছুটির পর ক্যাপ্টেন আর শঙ্করকে এক সঙ্গে প্যান্ট খোলা অবস্থায় দেখছে আমিন। ব্ল্যাকবোর্ডে কে যেন একদিন লিখেও রেখেছিলো ক্যাপ্টেন + শঙ্কর। রঙু এসব খুব বোঝে।
তাতীবাজার ঢুকে প্রসন্ন পোদ্দার লেনের উল্টোদিকে শঙ্করদের বাড়ি, বাড়ির সামনে হান্ধা নীল শাড়ি-পরা একটি মেয়ে টগর ফুল তুলছে। তার হাতে বেতের সাজিতে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা। গরমের ভোরবেলাটা কি ফর্সা, মেয়েটার গায়ের রঙ ফর্সা, ওর হাতের ফুলগুলো সাদা। ঝিররির করে হাওয়া বইলে মেয়েটার বাসি মাথায় এলোমেলা চুল একটু একটু ওড়ে। কয়েক গাছি চুলের নিচে ফর্স মুখ আরো ফর্স মনে হয়। ঠিক প্রতিমার মতো। স্কুলে সরস্বতী পূজার সময় একে বেদীতে বসিয়ে দিলে কার সাধ্য ধরে যে এ আসল দেবী নয়!
ক্যাপ্টেনকে দেখে সরস্বতী প্রতিমা বলে, কি কবীর, সব রেডি? মেয়েটির উঁচু-নিচু দাত দ্যাখা যায়, তাতে প্রতিমাত্ব অনেকটা কমে, ফলে সে আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কবীর বলে, ‘মেজদি, এতো ভোরে উঠছেন? ‘ভোর কোথায়? পোনে ছয়টা বাজে, সোয়া পাঁচটায় সূর্য ওঠে, এখন কি ভোর হলো? ফুল দিয়া পূজা করবেন মেজদি?
তোমাদের সারদের পূজা। শঙ্কর অর্ডার দিয়া রাখছে, ভোরবেলা ফুল চাই। রঞ্জর ইচ্ছা করে সে-ও একে মেজদি বলে ডাক। হিন্দুদের ডাকগুলো কি সুন্দর চেহারার সঙ্গে কি চমৎকার খাপ খায়! শরৎচন্দ্রের মেজদিদির চেহারা বোধহয় এরকম ছিলো। না, সে তো অনেক বড়ো, তার ছেলেও ছিলো ১টা। আর যে কেষ্ট না ফেষ্ট তাকে মেজদি বলে ডাকতো সেটা একটা গাধা। কয়েকদিন আগে রূপমহলে নিকৃত দেখেছে, সন্ধ্যারানীর সঙ্গে এই মেজদির মিল আছে নাকি? একদিন রাত্রে আব্বার নিয়ে-আসা কোন এক ম্যাগাজিনে সন্ধ্যারানীর ফুল-পেজ ছবিতে ওসমান চুপ চুপ করে কয়েকটা চুমুও খেয়েছে। সেই কথা মনে পড়লে রঞ্জর ঠোঁট শুকিয়ে এসেছিলো। আরে নাঃ! এই মেজদি কতো রোগা, কতো ফর্সা, কতো আবছা-আবছা।
মেজদি বলে, কবীর, যাও না। শঙ্কর তো এখনো ওঠে নাই। না ডাকলে ওর ঘুম ভাঙে? ক্যাপ্টেন গটগট করে ভেতর চলে যায়। শালার হাঁটুর নিচে এখনি লোম উঠেছে বড়ো বড়ো, ফেল করতে করতে ওঠে, নইলে এতোদিন কুসি নাইনে পড়তো! ভেতরে গেলো, রঞ্জকে একবার সঙ্গে যেতে বললো না পর্যন্ত!
তুমি ওদের সঙ্গে পড়ো, না? তার জবাব না শুনেই মেজদি ফের বলে, তোমাদের ইস্কুলই ভালো, আজ হইয়া ছুটি, না? আমাদের ছুটি হতে এখনো সাতদিন। পচা ইস্কুল। দেশে যাইতে যাইতে কাচা আম একটাও যদি পাই।’
ক্যাঠা রে আরতি? ক্যাঠা? কার লগে কথা কস, এ্যাঁ? কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসে এক প্রৌঢ়, ধুতিটা লুঙির মতো পরা, খালি গা খালি পা। বলে, কি চায়?
একটু রাগ ও একটু ভয় মেশানো গলায় আরতি বলে, ‘পটুর ক্লাসমেট বাবা’ রাত পোয়াইতে না পোয়াইতে বাবুর ইয়ারবন্ধুরা সব আইস পড়ছে? বাবাকে সামলাবার জন্য আরতি বলে, ‘মর্নিং স্কুল চলতাছে তো, তাই ডাকতে আসছে। নিশ্বাসের একই টানে রঞ্জকে জিগ্যেস করে, ও মা তোমার নামই শুনি নাই। তোমার নাম যেন কি?’
শেখ মোহাম্মদ ওসমান গণি। এবার শঙ্করের বাবা হঠাৎ বলে, ‘পল্টরে ডাইকা দে। ওসমানকে জিগ্যেস করে, পল্টর কুাসমেট?
‘জী। জবাব শুনে লোকটা চ্যাচায়, অরে ডাইকা দে না পন্টু, উঠলি না? নয়টা না বাজলে বাবুর ঘুম ভাঙবে না। মানুষ খাড়াইয়া থাকবো?
তার ব্যস্ততা বাড়াবাড়ি ঠেকে। চারদিকের কেমন ফাঁকা ফাকা। কয়েক মাস আগে রায়ট হয়ে গেছে, কোনো কোনো বাড়িতে লোকজন নাই, অনেকে হয়তো কোনোদিন ফিরবেও না। কয়েকটি বাড়িতে মেয়েরা নাই, তাদের ইন্ডিয়া পাঠিয়ে পুরুষগুলো সিচুয়েশন দেখছে। শঙ্করের বাবার উদ্বেগ ও ধমক এই বাড়িতে একটু কাপন তোলে, সেই কাপুনি বশ করার জন্যেই যেন আরতি ফের জিগ্যেস করে, কি নাম যেন বললে?
রঞ্জু!’ নাম জিগ্যেস করলে ওসমান কখনো কিন্তু ডাকনাম বলে না। কেউ জানতে চাইলে পুরো নাম না বললে আব্বা খুব রাগ করে। ইব্রাহিম শেখের কাছে নাম মানে পুরো নাম, তোমার নাম শেখ মোহাম্মদ ওসমান গনি। নাম জানতে চাইলে তো বললে, রঞ্জ কি তোমার নাম? তোমাকে যেমন বাবা বারু বলি, তেমনি রঞ্জও বলি। সবসময় আসল নাম বলবে। নইলে দুটো খাসি জবাই করে আকিকা দেওয়ার কি দরকার ছিলো?
কিন্তু মেজদির সামনে ওসমান রঞ্জুই থাকতে চায়। মেজদি কি তাকে ওসমান বলে ডাকবে? দূর! তাই কি হয়?
আরতি বলে, রঞ্জু ওসমান না কি যেন বললে? এই কথায় ওসমান লজ্জায় মরে যায়। সে যেন প্রত্যাখ্যাত হলো। কি থেকে প্রত্যাখ্যাত? সহপাঠীর বোনের কাছে তার ডাকনামটা নিবেদন করেছিলো, তাই কি নাকচ হয়ে গেলো? –রপ্পুটা বড়ডো ছেলেমানুষ ছিলো শওকতের মুখোমুখি মোরগ পোলাও খেতে খেতে ওসমান গনি আপন মনে হাসে, ছেলেবেলায় সে বড়ডো সেন্টিমেন্টাল ছিলো! কি কথায় যে রাগ হতো, কোন কথায় যে তার অপমান বোধে টং করে বাড়ি লাগতো আরতিকে মেজদি বলে ডাকার সাধটা একেবারে নিভে গিয়েছিলো।
শাখারি বাজার দিয়ে বেরিয়ে ৩জন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফুলের ডালা নিয়ে বসে ছিলো ২জন মালী। রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা চলতে শুরু করেছে। ফুলের ডালার বিপরীত দিকে মাঠা মাখন নিয়ে বসেছে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা বুড়োটা। সেখানে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন কি হিসাব করে, তারপর বলে, ‘মাঠা খাইবি?
এর মধ্যে কালাচাঁদের দোকানের ঝাড়পোঁছ শেষ হয়। হাড়িতে মিষ্টি ও ঝুড়িতে ফুল দিয়ে শঙ্কর একটা রিকশায় উঠলে ক্যাপ্টেন বলে, চল না, এক প্লেট খাইয়া এক লগে যামু! না। মোরগ পোলাও খেয়ে শঙ্কর জাত নষ্ট করবে না। ওর বাবা প্রায়ই বলে, রায়টে যখন বেঁচে গেছে তার মানে ভগবানের একটা ইঙ্গিত রয়েছে ভগবানে প্রাণটা রক্ষা করলো, জাত বাঁচাবার দায়িত্ব তার সৃষ্টির। হরেন ডাক্তারকে কে বোঝাবে যে আরতির বড়োবোন সবিতার দিকে তাহের গুণ্ডার একটা চোখ বিশেষভাবে সাটা ছিলো বলে ওরা প্রাণে বেঁচে গেছে। রায়টের পর পরই সবিতাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতায়। দূর সম্পর্কের মামার বাড়িতে রেখে তার বিয়ের চেষ্টা চলছে। এরপর রায়ট বাধলে জাত ও প্রাণ ২টোর ১টাও সামলাবার দায়িত্ব ভগবান নেবে কি-না সন্দেহ।
সাইনু পালোয়ান নিজে তদারক করে হাড়িতে ৫০ প্লেট মোরগ-পোলাও পরিপাটি করে গুছিয়ে দিলো। সঙ্গে ৫৫টা কাঁঠাল-পাতার ঠোঙা। ক্যাপ্টেন ও রন্ধু ২প্লেট খায় ফ্রি। খাওয়ার জন্যে ব্যবহৃত সেই সব দাঁতে অনেক খাবার চিবানো হয়েছে, জিভে আস্তরণ পড়েছে, অথচ দ্যাখা এখনো তারিয়ে তারিয়ে গলা পর্যন্ত সেই স্বাদ নেওয়া যাচ্ছে। ক্যাস্টেন খেতে খেতে বলছিলো, আমরা খাইছি কেউরে কইবি না, বুঝলি? জলদি খা’
জলদি করেন। চুরুট ধরাতে ধরাতে এখানে এখন তাড়া দিচ্ছে শওকত। তার মুখ দাখা যায় না, ওসমান বলে, রিকশায় যাবো, স্কুলে যেতে কতোক্ষণ লাগবে?
রিকশায় যাবেন? কোন স্কুলে? শওকতের হাসির শব্দে ও চুরুটের গন্ধে ওসমানের ঘোর কাটে।
ওসমান একটু হাপায়। কয়েকটি মিনিটের মধ্যে এতোগুলো বৎসর পারাপার করার ধকল কি কম? তার আর উঠতে ইচ্ছা করে না। ধীরেসুস্থে হাত ধুয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। শওকত তখন বিল শোধ করছে। ওসমান দেওয়ালের আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আরে একি! রঞ্জ এসে পড়লো কখন? রঞ্জুর সঙ্গে কি রানুও আছে? সামনের পারদ-ওঠা আয়নায় মঞ্জুর প্রতিকৃতি, তার হাওয়াই শার্টের পকেটে এম্বডারি করা প্যাগোড়া। রঞ্জকে দাখার জন্য সে পেছনদিকে মুখ ঘোরায়, নাঃ রঞ্ছ কোথায়। রঙ্গু এখানে আসবে কোথেকে? এইসব ৫০/৬০ বছরের আয়নায় মানুষকে যে কিরকম দ্যাখায়! ওসমান ঘুরে দাঁড়ালে আয়না থেকে রন্থ অদৃশ্য হয়।
আয়নায় রন্ধুকে দেখছে মনে করে যে চঞ্চলতা ও উত্তেজনা হয়েছিলো তা কেটে যাওয়ায় ওসমানের মাথা ও বুক খুব খালি খালি লাগে। অবসাদ আরো বাড়ে। মিছিলের ল্যাজের পাতলা অংশটি তাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দোকান থেকে সিগ্রেট কিনে ওসমান সিগেট ধরায়। মিছিলের গর্জনে তার ভয় হয়, এর ভেতর ঢুকে সে কি সমান তালে হাটতে পারবে? এমনকি শ্লোগানও দিতে পারবে কি? এতো মানুষের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে তাকে চিনবে কে? শওকতকে বলে, আপনি যান, আমি ফিরে যাবো।
মানে?
আমার শরীরটা খারাপ। খুব টায়ার্ড। আমি বরং বাসায় যাই।
বাসায় যেতে হলেও তো হেঁটেই যেতে হবে। তার চেয়ে চলেন, একটু তাড়াতড়ি হেঁটে মিছিলের মাঝামাঝি চলে গেলে দেখবেন ভালো লাগবে।
শওকতের যুক্তি ও পরামর্শে ওসমান ভূ কোচকীয়, এই লোকটা অন্যের প্রব্লেম বুঝতে পারে না। এর কথার প্রতিবাদ করাও মুশকিল। তার খুব বমি বমি লাগছে। আস্তে আস্তে বলে, ‘না, আমি চলি।
শওকত তাড়াতাড়ি মিছিলে যাবার জন্য উদগ্রীব, আপনি বোধহয় খুব সিক। একা যেতে পারবেন?
খুব!