চিলেকোঠার সেপাই – ২৮
ওসমানের ঐ চিঠি আনোয়ার পায়নি। এর ১টি কারণ এই হতে পারে যে চিঠিটা শেষ পর্যন্ত ডাকবাক্সে ফেলা হয়নি। ডাকে ফেললেও আনোয়ার ওটা সময়মতো পেতো কি-না সন্দেহ। আনোয়ার তখন ধারাবর্ষা চরে।
হোসেন আলি ফকির বসেছিলো হাতলওয়ালা ১টা চেয়ারে, হাঁটু-গোটানো পাজোড়া তার চেয়ারের ওপর ওঠানো। আনোয়ার বসেছে তার সামনে ১টি টুলে। খালি বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে করমালি। লম্বা চওড়া দশাসই ১ জোয়ান চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে হোসেন আলির ঘাড় ও পিঠ দলাইমলাই করে। হোসেন আলির মুখ থেকে মাঝে মাঝে সুখের ধ্বনি বেরোয়, আঃ। আস্তে! শালার হাত কিবা! মোষের পাও এ্যাঁর চায়া নরম হয়।
হোসেন আলির চোখের সামনে বিশাল চর। কালচে হলুদ জ্যোৎস্নায় নিকানো। আর আনোয়ারের পিঠ ফেরানো রয়েছে চরের দিকে, তার সামনে যমুনা। খুব উঁচু পাড় থেকে খাড়া মাটি লাফিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে নদীর স্রোতে। শীতকালের নিরীহ নদীর চলাচলও এই নির্জন জায়গায় ছলাৎ ছলাৎ করে প্রতিধ্বনিত হয়। নদীর ওপার দাখা যায় না। মনে হয় নদী হঠাৎ করে ঢুকে পড়েছে কুয়াশার খাপের মধ্যে।
ওরা বসেছিলো ঘরের পাশে। চালের পুরু খড়ের প্রসারিত ভাগ ওদের মাথার ওপর। মানুষের হাতে ছাওয়া হলে কি হবে, চাঁদের আলোয় খড়ের চাল বড়ো নির্লিপ্ত ও আদিম। যমুনার পানিহাওয়ায় হোসেন আলি ফকিরের স্বর মোটা ও ভারি। সে একনাগাড়ে কথা বলায় যমুনার পাশাপাশি আরেকটি ধ্বনিস্রোত বয়ে চলেছে। আনোয়ারের আবেদন শোনার পর সে জানায় যে, খয়বার গাজীর ১টা চিরকুট নিয়ে এলে ভালো হতো। খোয়াড়ের আসল পরিচালক তো খয়বার গাজী, শুধু তদারক করার কাজটা দেওয়া হয়েছে তাকে।
খোয়াড়? এখানে খোয়াড় আছে নাকি? আনোয়ার অবাক হলে হোসেন আলি জানায় যে খয়বার গাজীর মস্ত বাথানের সঙ্গে ডাকাত-মারা চরে একটা খোয়াড় করা হয়েছে। সরকারী আইন অনুসারে করা, সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত খোয়াড়। খোয়াড় তো আসলে সরকারের সম্পত্তি, পয়সা দিয়ে খয়বার গাজী কয়েক বছরের জন্য ডেকে নিয়েছে।–তা খোয়াড় কেন?-অসাবধান, দায়িত্বহীন ও পরিশ্রীকাতর লোকজন নিজেদের গোরুবাছুর দিয়ে অন্যের জমির ফসল নষ্ট করে, জমির মালিক সেগুলো ধরে নিয়ে আসে এখানে। উপযুক্ত জরিমান দিয়ে প্রকৃত মালিক নিজেদের গোরুবাছুর খালাস করে নেয়। খয়বার গাজীর অনুরোধে তাকে খোয়াড়ের তদারক করতে হয়, নইলে এসব কাজ করতে তার ভালো লাগে না।
‘আমি নিজেই এসেছি, খয়বার গাজী সায়েব জানেন না যে আমি এখানে আসবো। আনোয়ার এই কথা বললে হোসেন আলি অন্য প্রসঙ্গ তোলে। খয়বার গাজীর কথা বাদ দিয়ে সে তখন বলে নিজের কথা। প্রথম কথা, বাঁচতে তার আর ভালো লাগে না। ৩ কুড়ির ওপর বয়স হলো, সংসার ও পৃথিবীতে অরুচি ধরে গেছে। যমুনা ১৭বার তার ঘর ভেঙেছে। এই শালার নদী, শালী বেশ্যার অধম। কারো প্রতি তার মায়ামোহাব্বত নাই। ঘর ভাঙতে ভাঙতে হোসেন আলির এমন অবস্থা যে জীবনের বিভিন্ন সময়ে বসবাস-করা চরসমূহের কালানুক্রমিক তালিকাও সে দিতে পারে না। বাপজানের কাছে শুনেছে, তার জন্ম হয় যে চরে সেটা ছিলো মাদারগঞ্জ থানায়। হ্যাঁ, পুব পাড়ে। মাদারগঞ্জ থানা, জামালপুর মহকুমা, ময়মনসিং জেলা। তার ছেলেবেলায় চর-দখল নিয়ে মারামারি হলে বাপজানকে পুলিশ ধরে নিয়ে আটকে রাখে সিরাজগঞ্জ জেল হাজতে, পাবনা জেলায়। যৌবনকালে মামলা করতে তাকে যেতে হতো গাইবান্ধা শহরে, জেলা রংপুর। তখন তারা চর হাসুয়ার বাসিন্দা। বছর সাতেক হলো বসবাস করছে এই ধারাবর্ষায়, ভেবেছিলো বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবে। তা আর হলো কৈ?—কেন? এই চরে পলি পড়ছে পুবদিকে, ভাঙন শুরু হয়েছে পশ্চিমে। এই যে নদী, কয়েক বছর আগে ছিলো আরো পোয়া মাইল পশ্চিমে। গত বর্ষায় পোয়া মাইল ভেঙেছে, আরেকটা ছোবল দিলেই খড়ের এই চারচালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই ভাঙাগড়া আর মারামারি আর ভালো লাগে না। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন শান্তিতে থাকবে বলে খোয়াড় তদারকির নিরিবিলি কাজটা সে নিয়েছিলো। তখন কি জানে যে এখানেও এতো ঝামেলা, এতো ঝঞ্চাট? হিংসুটে লোকের কি অভাব? কার কাছে কিসব উল্টাপাল্টা খবর পেয়ে পুলিশ এসেছিলো, ধকল সামলাতে হয়েছে হোসেন আলিকেই। পুলিশ তো পুলিশ, পুলিশের বাপ এসে কি করবে তার? খোদ এমএনএ সায়েবের শেয়ার আছে খোয়াড়ের ব্যবসায়, গতবার ইলেকশনে এই এলাকার বিডি মেম্বারের ভোট জোগাড় করে তাকে পাস করিয়ে দিলো কে?–হোসেন আলি ছাড়া আবার কে? এমএনএ সায়েবের ওঠাবসা মন্ত্রীগবর্নরের সঙ্গে, এবার কেউ গোলমাল করলে টাইট করার জন্যে দরকার হলে মিলিটারি নিয়ে আসবে। মিলিটারির ডাণ্ডা না পড়লে মানুষ ঠিক পথে চলে না। হোসেন আলি আক্ষেপ করে, মানুষ কি আর সেই আগের মানুষ আছে? আল্লারসুল মানে না, মানীকে সম্মান করে না, ভদ্রলোকের ইজ্জত দেয় না। এই যমুনা পার হলে পুবে মাদারগঞ্জ থানা, সেখানে মানুষ চরম বেয়াদব হয়ে উঠেছে, খাজনা বন্ধ করার পায়তারা করছে। কোন বিডি মেম্বারের ধানের গোলা লুট করেছে, তহশীলদারের অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোর-ডাকাতের রাজস্ব শুরু হয়ে যাচ্ছে। আরে, সার্কেল অফিসার উচ্চশিক্ষিত ও সদ্বংশজাত ভদ্রলোক,-তার বাড়ি ঘেরাও করে চাষারা তার বৌ-ঝির হাত ধরে টানাটানি করে। এই জাতের ওপর গজব পড়বে না তো কি আল্লার রহমত নাজেল হবে?
না সরকার, মেয়ামানুষের গাওত হাত তোলা হয় নাই! করমালির কথায় হোসেন ফকিরের দীর্ঘ ও একটানা বাক্যস্রোত বাধা পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফের উপচে ওঠে, মিছা কথা কল্যাম? একটা অফিসারের বাড়ির মদ্যে চাষাভুষারা ঢুকা পড়ে, এটা জুলুম হলো না? ফুসে উঠতে উঠতে হোসেন আলি হঠাৎ নিভে যায়। আনোয়ার কিন্তু একটু ভয়ই পেয়েছিলো, করমালির উদ্ধত বাক্যে হোসেন আলি চট করে ১টা কিছু করে না ফেলে। এর মধ্যেই হোসেন আলির জীবনের অনেক বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী শোনা হয়েছে। তার শতকরা ৫০ ভাগ সত্যি হলেও সে ভয়াবহ বিপজ্জনক চরিত্র। হাসিয়া, বর্শা ও বল্লা নিয়ে বাপজানের সঙ্গে সে যে কতো জায়গায় কাজিয়া করতে গেছে তার হিসাবনিকাস নাই। এই হাতে সে খুন করেছে অন্তত ১৪জন মানুষ। আবার কোটকাচারি করতেও তার জুড়ি মেলা ভার। ফৌজদারী আইনে তার দখল দেখে বাঘা বাঘা উকিল মোক্তার থ হয়ে গেছে। কামিনীবাবু, গাইবন্ধার বাঘা উকিল কামিনী চক্রবর্তী পর্যন্ত বলেছিলো, ‘হোসেন, ল্যাখাপড়া করলে বড়ো ব্যারিস্টার হইতে পারতিস’ এ কথা কেন বলেছিলো?—হোসেন আলি একটুখানি হেসে বয়ান করে উগল্যান কি আজকার কথা বাপুঃ –সেবার খুব মজা হয়। সদ্য জেগে-ওঠা বাঘুরিয়া চরে হোসেন তখন সবে ঘরদোর তুলে বাস করার আয়োজন করছিলো। শিমুলবাড়ির তালুকদাররা যায় সেই চর দখল করতে। তাদের লাঠিয়াল ছিলো কাগমারীর, কাগমারীর লাঠিয়ালদের তখন খুব নাম। তাদের সঙ্গে পারা কঠিন। অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে হোসেন আলি ছিপনৌকা করে চম্পট দিলো সোজা সিরাজগঞ্জের দিকে। তবে পালাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নিজের দুজন কিষানকে তার গোয়ালঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেয়। সিরাজগঞ্জ কোর্টে মামলা ঠুকে দিলো, তালুকদারেরা তার বাড়িতে চড়াও হয়ে তার খাস ২জন কামলাকে পুড়িয়ে মেরেছে। এই ১ বুদ্ধির জোরে তালুকদারদের ৪ লাঠিয়ালের যাবজ্জীবন।-তো সেটা বৃটিশ আমল বাপু, তখন যে সে লোক হাকিম হতে পারতো না, চাষাভূষার বেটারা সব পায়ের তলায় পড়ে থাকতো। তা, এখন কি অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো নাকি যে করমালির কথায় হোসেন আলি সেভাবে জ্বলে উঠলো না? করমালির কথার জবাবে সে কেবল বিড়বিড় করে, বেশি কথা কস না। কিন্তু তার এই আদেশ তেমন শোনা যায় না, তার গলায় ঘন শ্রেম্ম।
সের দেড়েক মোষের দুধ দিয়ে প্রায় ঐ পরিমাণ ভাত খেয়ে করমালি চলে যায় ঘাটে, সে রাত্রিকাটাবে নৌকায়, পচার বাপের সঙ্গে। ভদ্রতাবোধ থেকে হতে পারে, আবার ভয়েও হতে পারে,-আনোয়ার হোসেন আলির আতিথ্য গ্রহণ করে। মোষের দুধ দিয়ে ভাত খেয়ে সে শুয়ে পড়ে হোসেন আলির অড়বিহীন লেপের নিচে। তার জন্য নিজের বিছানা ছেড়ে হোসেন আলি শুয়েছে মস্ত একটা কাঠের বাক্সের ওপর। শোবার পরও তার কথা শেষ হয় না: এই ভদ্রলোক-বিবর্জিত চরে আনোয়ারকে উপযুক্ত আদর যত্ন করতে না পেরে সে মরমে মরে যাচ্ছে। এখানে কি মানুষ থাকতে পারে? মেঘনা কি রমনা সিগ্রেট কিনতে হলেও ২ ঘন্টার পথ ধরে নৌকায় যেতে হয় চালুয়াবাড়ি। এদিকে চরের পশ্চিমে ভাঙন শুরু হওয়ায় হোসেন আলি তার ৩টে বৌয়ের সবকটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে পুৰে। তাদের বাথান বলো, খোয়াড় বলো সব ঐদিকেই। ওদিকটায় চর পড়ছে, ডাকাত-মারা চরের সঙ্গে এই ধারাবর্ষা এক হয়ে গেলে সেখানে হোসেন আলি স্থায়ীভাবে বাস করবে। টিনের আটচালা ঘর তুলবে, আম কঁঠালের গাছ লাগাবে।
এতো কথা বলে, কিন্তু কাজের কথা তুললেই বাক্য হয়ে আসে সংক্ষিপ্ত। যেমন, গোরু কার? আপনাগোরে তো নয়?
করমালির গোরু, ওর জ্যাঠা পচার বাপের গোরু। ‘দ্যাখা যাক। হোসেন আলি সশব্দে হাই তোলে। আনোয়ারেরও চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।
ঘণ্টা দুয়েক পর পেটে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা শুরু হলে আনোয়ারের ঘুম ভাঙে। ঘর অন্ধকার। কিন্তু ভেজানো দরজার ফাক দিয়ে দেড় ইঞ্চি চওড়া আলোর রেখা ভেতরে এসেছে। আনোয়ার উঠে দরজা সম্পূর্ণ খুললে জ্যোৎস্নার আলো ঘর জুড়ে থইথই করে। হোসেন আলি ফকিরের বিছানা ফাকা। দরজার পাশে রাখা পানি ভরা বদনাটা হাতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তলপেটের বেগ তীব্র হয়ে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে আনোয়ার এদিক ওদিক তাকাতেই লোহার শাবল লাগানো বাঁশ হাতে এগিয়ে আসে মস্ত এক জোয়ান। আঙুল দিয়ে লোকটা সামনের দিক নির্দেশ করে, ঐ জায়গাত বসেন।
কোথায়? পায়খানা কোথায়?’
ঐ সোতার ধারত বসেন।
মোষের দুধ খাওয়ার ফল প্রায় হাতে হাতে পাওয়া গেলো। এর ওপর নদীর পানিতে এরা এক দানা ফিটকিরি পর্যন্ত দেয় না। আমাশার আর দোষ কি? পায়খানা করে হোসেন আলির ঘরে ফিরতে দরজার সামনে বল্লমধারী ঐ যুবককে দেখে আনোয়ার এবার ভয় পায়। পেটের ব্যথাটা তখন খুব মোচড় দিচ্ছিলো বলে ভয় পাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। দশাসই চেহারার তরুণ মেয়েলি ভঙ্গিতে হাসে, যান, আপনে নিন্দ পাড়েন। আত এখনো মেলা আছে।’
সে তো ঘড়ি দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু হোসেন আলি কোথায়?
লোকটা পায়চারি করে, হাটতে হাটতে জবাব দেয়, তাই গেছে বাথানের দিকে।
কেন? হঠাৎ এতো রাত্রে?
পুব পাড় থাকা মানুষ আসছে। গোরুবাছুর ডাকাতি করবার আসছে। লোকটির বিশাল শরীর আচঞ্চল, মুখের হাসি হাসি ভাব অবিকৃত। এমনকি বাথান আক্রমণের খবর দেওয়ার সময়ও তার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। পূর্ব দিক থেকে দুৰ্বত্তের দল এসেছে লাঠিসোটা নিয়ে। হোসেন আলির লোকজনও প্রস্তুত। ওখানে সুবিধা করতে না পেরে ডাকাতরা আবার নৌকা নিয়ে পশ্চিমদিকে এসে হোসেন আলির বাড়িতে হামলা চালাতে পারে, তাই বল্লম ও হাসুয়াধারী কয়েকজন লোককে এখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তবে গত বর্ষায় ভাঙন হয়েছে বলে এদিককার পাড় খুব খাড়া, নৌকা ভেড়ানো কঠিন। নৌকা থেকে অস্ত্র ছুড়ে মারলেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বারো আনা। লোকটি অকারণে ফিসফিস করে কথা বলে, শুনল্যাম বাথানের একটা জ্বলঙ্গি শালারা নিয়া গেছে।
গোরু বহন করার বড়ো বড়ো জলঙ্গি নৌকা না দেখলেও জিনিসটা সম্বন্ধে আনোয়ার মেলা কথা শুনেছে। ৫০/৬০ হাত লম্বা এইসব নৌকায় কাঠের ঘের দেওয়া ঘর থাকে, ঘরের ভেতর চোখে খুলি-আঁটা গেরুবাছুর থাকার ব্যবস্থা। সংগঠিত লোকজন না হলে হোসেন আলির বাথান থেকে জলঙ্গি নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এতো সাহস কাঁদের?
কিন্তু এতো সব কথা এই লোকটি হয়তো জানে না। এদিকে আনোয়ারের তলপেটে ফের প্রবল বেগ শুরু হয়। আরো ২বার পায়খানা করলে ব্যথা থিতিয়ে আসে, তখন ঘুম পায়।
সকালবেলা দলবল নিয়ে হোসেন আলি ঘরে ফেরে এবং সকলের কোলাহলে আনোয়ার ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সকলেই দাবী করে যে আক্রমণকারীদের সফলভাবে হটানো গেছে এবং ১টি জলঙ্গি নৌকা নিয়ে গেলেও দুৰ্বত্তরা ১৫/২০ টির বেশি গোরু তুলতে পারেনি। তাদের সর্দার আলিবক্সের ডান হাতে বর্শা বেঁধানো হয়েছে, এ সম্মন্ধে এরা সবাই নিশ্চিত। এছাড়া আরো কয়েকজন জখম হয়েছে। এদের পক্ষে আহতের সংখ্যা মাত্র ৪, এবং এদের আঘাত তেমন মারাত্বক নয়। ২ জনের ১টা করে চোখ নষ্ট হয়েছে, ১ জনের উরু বোধহয় আর কোনো কাজে লাগবে না।
চুপ কর শালা মাগীমানষের দল দুটা চারটা জান নিবার পারলা না তো কিসের বাল ছেড়ো হে? পারে খালি আড়াই সের তিন সের চালের ভাত খাবার আর নিন্দ পাড়বার, না? আলিবঙ্গ শালার লাশ আনবার পারলু না তো কিসের মর্দানি দ্যাখাস?’ হোসেন আলি তার লোকজনের তৎপরতায় সম্ভষ্ট নয়, এই চরুয়াগুলা, বুঝলেন? আনোয়ারের মনোযোগ আকর্ষণ করে সে, শালারা একোটা বেজন্মর পয়দা বেজন্ম। শালারা খালি ভাত খাবো আর মাগীর ঠ্যাঙোতে ঠ্যাং থুয়া নিন্দ পাডুবো হামার বলে গোয়ার মদ্যে নোয়ার কাটি ঘোরে, শালারা দিশ পায় না।’ আলিবক্সকে হাতের ভেতর না পেয়ে লোকটা ঘর তোলপাড় করে, শালা বলে রাজা হবার চায়! শালা বেন্নার ব্যাটা, কলেঞ্জেত পড়া হালুয়া চাষার ব্যাটা আজ ধরাক সরা জ্ঞান করে। এটা কোন আলিবক্স? চেষ্ট্র যার কথা বলেছিলো এ কি সেই লোক? **মালিকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবে। এই সময় পচার বাপকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হয় করমালি। এদের দেখে হোসেন আলির লাফালাফি আরো বাড়ে, গোরু নিৰ্যা তো হামার কাছে আসছে কিসক? যাও, আলিবক্সের সাথে জোট পাকাও
পচার বাপ হাত জোড় করে দাঁড়ায়, উগল্যান কথা কয়েন না সরকার ইবলিসের নেভূড় ধরমু হামরা? হামাগোরে আখেরাত নাই?
আলিবক্সকে সরাসরি শয়তানের সঙ্গে তুলনা করায় হোসেন আলির ছটফটানি কমে। কাঠের লম্বা সিন্দুকে স্থির হয়ে বসে আস্তে আস্তে পা নাচায়। তোমাগোরে গোরু নিবা তো বাথানে যাও। ওটি মানুষজন আছে, হিসাব নিকাশ করা নাগবো না?
ধপ করে মেঝেতে বসে পচার বাপ হোসেন আলির পা চেপে ধরে। হুজুর, আপনে হামার ধর্মের বাপ। হামি বেন্ন্যা মানুষ আট শতাংশ জমিও নাই বাবা। আর বছর খরার সময় দশ শতাংশ জমি বেচ্যা খালাম। গোরু না থাকলে হামাক জমি বর্গা দিবো কেটা? উপাস কর্যা মরমু বাপ, পরিবার ছেলেপোল নিয়া উপাস করা লাগবো হামার গোরুবাছুর, বলদট না পালে হামি মর্যা যামু বাপ!’
জ্যাঠার এইসব কাকুতি মিনতি করমালি চুপচাপ দেখছিলো। হঠাৎ সে করলো কি, ২হাত জ্যাঠার ২ বগলের নিচে রেখে হ্যাঁচক টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। পায়ের ওপর থেকে পচার বাপের জোড়াহাত সরে যাওয়ায় হোসেন আলির শরীরের ওজন একটু কমে এবং ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় বসে বসেই সে একটু টাল খায়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা শরীরে পচার বাপকে সে বকে, তোমরা কোটে কোটে গোরু ছাড়া দিয়া রাখো, কারভিউ খিলাও, মানষে ত্যক্ত হয়৷ গোরু নিয়া এটি দিয়া গেছে। সরকারী খোয়াড়, সরকারেক ট্যাকসো দিয়া তোমরা গোরু নিয়া যাও, কান্দাকাটি করো কিসক? পচার বাপ এখন ফ্যাচফাচ করে কাঁদে, না সরকার। গোরু বাছুর হামার গোলের মদ্যে বান্দা আছিলো। ধুনট হাটোত থাকা হামিলিজে শিকল কিন্যালিয়া আসছিলাম বাপো, আতোত শিকল খুল্যা গোরু নিয়া আসছে। হামার গোরু-‘
রাগে হোসেন আলি উঠে দাঁড়ায়, জমিত মুখ না দিলে মানষে খালি খালি তোমার গোরু নিয়া খোঁয়াড়ত দিবো? হামি মানুষ পাঠায়া তোর গোরু চুরি কর্যা নিয়া আসছি? কথা কস, শালা শয়তান বুড়ো!’
না হুজুর। হামি ঐ কথা কই নাই। দ্বিগুণ বেগে ফ্যাচফাচ করতে করতে পচার বাপ তার বিবৃতি সংশোধন করে, না হুজুর হামি বুড়া মানুষ, মুখ্য জাহেল মানুষ, বেন্ন্যা মানুষকথা কবার পারি না হুজুর! হামাক মাপ করেন!
শিথিল কথাবার্তা বলার পক্ষে তার বার্ধক্য বা মূর্খতা বা অন্ত্যজ শ্রেণীতে তার অবস্থানের কৈফিয়ৎ হোসেন আলি গ্রাহ্য করে না। এই অবিশ্বাস জানাবার উদ্দেশ্যে সে বিকটভাবে চ্যাচায়, বুড়া, এক পাও তোর কবরের মদ্যে, তাও তুই মিছা কথা কস! তোর আল্লা-রসুলের ভয় নাই? তোর আখেরাত নাই? আল্লা, রসুল ও আখেরাতের প্রসঙ্গ এনে হোসেন আলি নিজেই একটু নরম হয় এবং হঠাৎ করে বলে, চলো বাথান মুখে চলো। দাখা যাবো কার গোরু এটি কিসক আসে!