চিলেকোঠার সেপাই – ০৩
সুভাষ বোস এ্যাঁভেনু ও হেমেন্দ্র দাস রোডে দোকানপাট সব বন্ধ। উল্টোদিকের মসজিদের বারান্দায় মক্তবে ছেলেমেয়ে নাই। একজন বুড়োমানুষ বারান্দায় একা এক রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে চলেছে। রাস্তা যানবাহনহীন, লোক চলাচল কিন্তু কম নয়। ছাদের সামনের দিককার উঁচু দেওয়ালের ওপার এইসব দেখতে দেখতে ওসমানের একটু উঁচুকরে-রাখা পায়ের পাতা ধরে আসে। ঠাকুর দাস লেনের মাথায় তোতামিয়া ডেকোরেটার্সের গা ঘেঁষে লোহার পোস্টে অজস্র ইলেকট্রিক তারের এলোমেলো ও জটিল সমাহার। ঐখানে একবার পড়ে গেলে তারগুলো সব জ্যান্ত হয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরবে যে, জীবনে আর বেরিয়ে আসা যাবে না। ওসমানের সারা শরীর শিরশির করে। নাঃ! তাড়াতাড়ি অফিস রওয়ানা হওয়া দরকার।
সিঁড়িতে রঞ্জুর সঙ্গে দ্যাখা। সঙ্গে ওর বোন, রঞ্জুর চেহারার সঙ্গে খুব মিল। তবে মেয়েটার গায়ের রং আরেকটু চাপা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের হলে ভালো হতো। সপ্তাহ দেড়েক আগে একদিন সন্ধ্যায় ওদের ঘরে মেয়েটিকে ওসমান ভালো করে দেখেছে। তখন কিন্তু রঙটঙ নিয়ে এসব কথা মনে হয়নি। সেদিন তালেবের কুলখানি হবে শুনে ওসমান আগেভাগেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তালেবের বাবা ওপরের বারান্দা থেকে ডাকতে ডাকতে একেবারে রাস্তায় এসে ধরলো। আমার একটু দরকার ছিলো –ওসমানের মুখ থেকে এই কথা বেরোতে না বেরোতে মকবুল হোসেন তার হাত ধরে ফেলে, আমার এ্যাঁবসেন্সে আপনারা এত করলেন, আজ একটু কষ্ট করেন। বাদ আসর মিলাদ, মিলাদের পরে এফতার দিয়া বিদায়। কোরান খতম করাইতেছি, মৌলবিগো লগে আপনেরা কয়জন থাকবেন। সামান্য আয়োজন করছি।
এফতারের পর বেশির ভাগ লোক চলে গেলে মৌলবিদের সঙ্গে কয়েকজনের জন্য খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ওসমানও চান্স পায়। এদিন রঙ্গুর মা ছাড়া ওদের আর সবাইকে তার দাখার সুযোগ ঘটে।
রঞ্জুর সবচেয়ে বড়ো বোনটি বেশ ফর্স এবং বোবা। তার বাচাল স্বামীর সঙ্গে আগের দিন সে নরসিংদি থেকে এসেছে। তবে তার স্বামীটা সেদিন সবাইকে কম সার্ভিস দেয়নি। তার অবিরাম কথাবার্তার জন্যেই নিহত তালেবের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে আয়োজিত মিলাদ সেদিন ভার হয়ে কারো বুকে চেপে বসেনি। মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর সবুজ চাদর পেতে খাওয়ার সময় ওরা ২ বোনই ভেতর থেকে ভাতের গামলা, গোশতের বাটি, বেগুন ভাজার হাফ-প্লেট, গ্লাস, মগ-এগিয়ে দিচ্ছিল ঘরের দরজা পর্যন্ত। বোবা মেয়েটি কিন্তু কাদছিলো না, বড়ো বড়ো একটু কটা চোখ কুঁচকে একেকজনের দিকে সে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যে, দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ ফেরানো খুব কঠিন। তার স্বামী নরসিংদি ইপিআরটিসি বাস টার্মিনালের ফোরম্যান। তালেব যেদিন মারা যায় সেদিনই, বলতে গেলে প্রায় একই সময় বেতকার কাছে গ্রামের লোকজন ১টি স্টেটবাস আটকায়। হরতালের দিন, স্টেটবাস চলতে দেওয়ার কোনো কারণও ছিলো না। লোকজন বাসের কাঁচ ভেঙে ফেলে, যন্ত্রপাতিও জখম করে। নরসিংদি ডিপো থেকে পরদিন এই ফোরম্যানকে পাঠানো হয়। যন্ত্রপাতি ঠিক করে বাস পাঠিয়ে ফোরম্যান বসে গেলো তাড়ি টানতে। খবর পেতে পেতে ২দিন কেটে যায়। ফোরম্যানের নাড়ি নক্ষত্রের খবর রাখে কে?-আলাউদ্দিন। নরসিংদির বাস ডিপোতে কি সব গোলমাল চলছে, আলাউদ্ধিনের দলের কর্মীরা এই নিয়ে কালকেও ঢাকায় এসেছিলো। কাল বিকালবেলা ওসমান নিজেই ফোরম্যানকে সন্ত্রীক আসতে দেখেছে। মেয়েটা ওপরে উঠেই বারান্দায় বাড়িওয়ালাকে দেখতে পায় এবং তার চোখ তাক করে ছুড়ে মারে নিজের হাতের চুড়ি। মেয়েটার হাতের সই ততো সুবিধার নয়। সোনার চুড়ি রেলিঙে লেগে পড়ে গেলো রাস্তায়, নালার ধার ঘেঁষে। শ্যালক-শোকে মুহ্যমান ফোরম্যান কান্নাকাটিতে বিরতি দিয়ে চুড়ি কুড়াতে নিচে দৌড়ে গেলে বোবা মেয়ে হাউমাউ করে কাদতে-থাকা মায়ের বুকে নিজের ফর্স ও গোলগাল মুখ ঠেসে চেপে ধরে। তার পর ওসমান তাকে দ্যাখে রাত্রে ওদের ঘরে খেতে বসে। তখনও তার রাগ পড়েনি, সকলের ওপর সমানে চক্ষুবর্ষণ করে চলেছে।
রঞ্জুর এই কালো বোনটি বরং নিরাপদ। কুলখানির সন্ধ্যায় এর চাপা ঠোঁটে বেগুনি রঙই ছিলো প্রধান। রঞ্জুর সঙ্গে সেদিন ওর ঠোঁটের পার্থক্য বোঝাই যায়নি। মিলাদ ও কোরান খতমের পর আলাউদ্দিন পুলিসের গুলিবর্ষণের উত্তেজিত বর্ণনা দিচ্ছিলো, কয়েকটা প্লেট হাতে এই মেয়েটি তখন ঠিক দরজায় এসে পড়েছে, আলাউদিনের কথা শোনার জন্যে থমকে দাঁড়ায়। ওসমান আড়চোখে তাকে দেখছিলো, ঘরের ঝুলন্ত ডিসি লাইনের ৪০ পাওয়ার বাম্বের ঘোলাটে আলোতে মেয়েটির ঠোঁটে বেগুনি রঙ গাঢ় হয়, আলাউদিনের খসখসে গলায় হড়হড় করে কথা বলার তোড়ে মেয়েটির শ্যামবর্ণের গাল তিরতির করে কপিছিলো। এমন হতে পারে যে, তার মুখের ভেতর কোনো বাক্য তৈরি হচ্ছিলো। কিন্তু সেই বাক্য প্রকাশের আগেই মকবুল হোসেন ডাকে, রানু প্লেট দে।
আজকে রানুর মুখ কিন্তু মোটেই থমথমে নয়। রঞ্জুজিগ্যেস করে, স্ট্রাইকের দিন অফিস যান? ওসমান জবাব দেয়, দেখি, বাইরের অবস্থাটা দেখি। তোমরা কোথায় যাচ্ছে?
‘এইতো বানিয়ানগর। এর বন্ধুর বিয়া।’
বিয়া না। রানু সংশোধন করে, গায়ে হলুদ। খালি দ্যাখা কইরা চইলা আসবো।
রাস্তায় একটা সাইকেল পর্যন্ত নাই। ২দিকের ভাঙাচোরা ও অনিয়মিত ফুটপাথে লক্ষ্মীবাজারের নিয়মিত জনপ্রবাহটি বন্ধ, পথচারীরা হাঁটছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। কায়েদে আজম কলেজের প্রবেশপথের গলির মুখে চওড়া জায়গায় ইট দিয়ে উইকেট সাজিয়ে পাড়ার ছোটো ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছে। খেলায় সবারই বেশ মনোযোগ, কিন্তু এদিক ওদিক কোনো রিকশা কি সাইকেলের খবর পেলেই হলো,-সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত বলের সামনে থেকে ব্যাট সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে চাকার হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। এদের খবর দেওয়ার দায়িত্ব রাস্তার বেওয়ারিশ পিচ্চিদের। পিচ্চির এমনি ঘুরে বেড়ায়, কোথাও ৭/৮ জনের এক একটি গ্রুপ, কোথাও ৫/৬ জন ছাত্রের নেতৃত্বে ২০/২৫ জনের মিছিল। মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছে, আইয়ুবশাহী, মোনেম শাহী’-‘ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’, ‘আইয়ুব মোনেম ভাই ভাই-এক দড়িতে ফাসি চাই’, ‘জুলো জ্বলো’-‘আগুন জ্বলো’। আবার মাঝে মাঝে শ্লোগান ভুলভাল হয়ে যায়। যেমন, আইয়ুবশাহী, জালেমশাহী’-এর জবাবে বলছে, বৃথা যেতে দেবো না। কিংবা ‘শহীদের রক্ত’-এর জবাবে বলছে, আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো।’
আশেপাশে কেউ দোকান খুললে এদের একেকটি ছোটো ছোটো দল দৌড়ে এসে খবর দিচ্ছে, লম্বু সালামের জিলাপির দুকান আছে না, অর বগলে সাইকেলের পাটসের দুকান আছে না, আছে না, ঐ বন্টু হালায় দুকান খুলছে।
আরেকজন বলে দুকান খুলছে।’
আমরা দুকান বন্ধ করবার কইছি তো, বন্ধ করবার কইছি তো, বন্ধ করবার-। উত্তেজনায় বাড়ি-বাড়ি-কাজ-করা মাতারির পোলা বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারে না। আরেক পিচ্চি তাকে উদ্ধার করে, ঐ বন্টু হালায় কয়, কিয়ের ইস্টাইক? ইস্টাইকের মায়েরে চুদি’ শুনে বয়সে ও বাপেদের-পরিচয়ে-বড়ো ছেলেরা ব্যাট হাতে ছুটে যাচ্ছে দোকান বন্ধ করতে। এর মধ্যে গোবিন্দ দত্ত লেনের ভেতর থেকে ১টি খোলা জিপ এসে পড়ে। ঘন ঘাস রঙের হেলমেটের সঙ্গে ফিট-করা পাঞ্জাবি, বালুচ ও বাঙালি সৈন্যদের কয়েকজন জিপের রেলিঙে মেশিনগান রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ট্রিগারে আঙুল বসানো, টিপলে এক মুহুর্তে কালো নোঙরা এই পিচ্চিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। তবে পিচ্চিরা ও ক্রিকেট খেলোয়াড়রা নিমেষে হাওয়া হয়ে যায় নন্দলাল দত্ত লেনের ভেতর। আরো ভেতরে পাঁচভাইঘাট লেন। এই ২ গলির মোহনায় খেলার জন্য চওড়া জায়গা, আবার সেখান থেকে নারিন্দার পুল পর্যন্ত খানিকটা জায়গার ওপর নজর রাখাও চলবে।
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে পৌঁছে ওসমান দ্যাখে পার্কের রেলিঙের বাইরে ফুটপাথে ও ভেতরে ইপিআরের জওয়ানেরা। পার্কের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো লরি থেকে লাফিয়ে নামছে হেলমেটসাটা লোকজন। নামতে নামতেই পজিশন ঠিক করে নিচ্ছে। কী হেভি প্রিপারেশন! শালদের প্রত্যেকটার মুখে ১টা লাথি মারার জন্য ওসমানের পাজোড়া নিসপিস করে। তার পায়ের কদম সোজা হয় না। টলমল করে। কিন্তু ১০০ বছরেরও আগে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাসি দেওয়ার জন্যে নবাব আবদুল গনিকে দিয়ে পোতানো পামগাছ বা সেইসব পামগাছের বাচ্চারা মানুষের শ্লোগানে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি বলে আস্তে আস্তে হাই তোলে। ওসমানের রাগ বা ইচ্ছা তাদের ধুলোপড়া পাতায় এতোটুকু চিড় ধরাতে পারে না। ডানদিকে মোড় নিয়ে একটু এগিয়ে আজাদ সিনেমার সামনে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা ইপিআরের কয়েকটি হেলমেটধারীর ধাতব ও শীতল মুখের সঙ্গে ওসমানের চোখাচোখ হয়। তাড়াতাড়ি করে সে চোখ নামিয়ে নিল। কী ভয়ানক ঠাণ্ড সব মুখ। এরা কী না করতে পারে। নিজের চোখ মুখ গাল ঠোঁট, এমন কি কান থেকেও রাগ ও ক্ষোভের সব চিহ্ন মুছে ফেলে নিবিষ্টচিত্তে সে হাটতে থাকে। তাড়াতাড়ি অফিস যাওয়া দরকার। স্ট্রাইক ছিলো বলে কালকেও যাওয়া হয়নি। এভাবে এক নাগাড়ে কতদিন চলবে? বসের সঙ্গে ওসমানের সম্পর্ক ভালোই। কিন্তু বসের বস লোকটি ল, অর্ডার ও ডিসিপ্লিনের ১জন নিষ্ঠাবান উপাসক। ওদিকে কারো সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হলেই ফিসফিস করে, পাঞ্জাবিরা একেবারে শেষ করে ফেললো। বাসটার্ড রেস, কারো জন্যে মিনিমাম কনসিডারেশন নেই। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সহ্য করার লোক তিনি নন, পলিটিশিয়ানদের কথায় নেচে লাভ কি? এরা পাওয়ারে ছিলো না? বাঙালি মিনিস্টারের কোটা কোনদিন খালি ছিলো? নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, সোহরাওয়াদি-এর প্রাইম মিনিস্টার হয়নি?–রেজাল্ট?এভরিবডি নোজ। এরপর সিগ্রেটে গোটা দুয়েক টান দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে গভীর দীর্ঘশ্বাস এবং সমস্যার সমাধান ছাড়ে, উই নীড় প্রপার প্লেস ইন দ্য পলিসি মেকিং। অফিসাররা ছাড়া এসব করবে কে? ঐসব ডেমাগগ পলিটিসিয়ান্স? ওসমানের বস এইসব শুনে আসে তার বসের কাছে এবং নিজের কামরায় এসে ঝাড়ে ওসমানের কানে। ওসমানের বসটি এমনিতে খুব বাঙালিঅও প্রাণ। মেয়েকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ালেও ছায়ানটে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখায়। আবার বাঙালি পলিটিশিয়ানদের ওপর লোকটি অতোটা চটা নয়, বরং তাদের সঙ্গে তার অনেক আগেকার পরিচয়ের প্রসঙ্গ সুযোগ পেলেই জানায়। তবে ল’ এ্যাঁন্ড অর্ডারভক্ত বসের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্যে অনুপস্থিত কর্মচারীদের নামে শো-কজ পাঠাতে পারে। যানবাহনশূন্য নবাবপুরের পথচারীদের অনেকেই অফিসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ একেকটি গাড়ি ‘রেডক্রস বা ‘প্রেস’এর জোরে এদিক ওদিক করছে। বাঁদিকে বংশালের রাস্তায় ছোটোখাটো ভিড়, মানসী সিনেমার সামনে ছাত্রদের কেউ বস্তৃতা করছে। রোজার মাস, লোকজন বড়ডো থুতু ফেলে। যানবাহন নাই বলে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটার মতো থুতু ছড়ানো। আলু বাজারের মাথায় সিগ্রেটের ছেঁড়া প্যাকেট দিয়ে তৈরি তাস বাজি রেখে পিচ্চিরা ডাংগুলি খেলছে, ছোটে ছোটো মিছিল দেখলেই স্লোগান দিতে দিতে মিছিলে ভিড়ে যাচ্ছে। ডানদিকে বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের মাথায় পানের দোকানটা একটু খোলা। বুড়ো পানওয়ালা পাতলা ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে পানে চুন লাগায়, খয়ের লাগায়, একটু জরদা ঝাড়ে। রোজার মাস বলে সামনে ১টা চট ঝোলানো। রাস্তা জুড়ে থুতু দেখে ওসমানের একটু গা ঘিনঘিন করছিলো, ভাবলো, ঠাঠারি বাজারের পর্দা ঝোলানো কোনো রেস্টুরেন্টে এক কাপ চামেরে বুড়োর হাতে মশলা-দেওয়া পান মুখে দিলে ভালো লাগবে। কিন্তু ডানদিকে পা দিতে না দিতে হড়হড় আওয়াজ করে বুড়ো দোকানের শাটার টেনে দিলো। কি হলো?—বনগ্রামের দিক থেকে মিছিল আসছে। একটু দাঁড়ালে মিছিলটা ধরা যায়, কিন্তু অফিসে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
নবাবপুর শেষ হলে রাস্তার ছবি পাল্টায়। রাস্তা হঠাৎ নদীর মোহনার মতো অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক চেহারায় প্রসারিত হয়। ইপিআরটিসি বাস টার্মিনালের সামনে ট্রাফিক আইল্যান্ড ঘেঁষে ধিকিধিক জুলছে ১টি সরকারী বাস। এখানে বেশ ভিড়, আবার এখানে অনেকে তাড়াতাড়ি হাঁটে, যে কোনো সময় ইপিআর এসে গুলিবর্ষণ শুরু করতে পারে।
অফিসে কিন্তু অনেক লোক। গতকালও কি সবাই এসেছিলো? লিফট বন্ধ। সিঁড়ি ঠেঙিয়ে পাঁচতলায় উঠে ডানদিকে বড়ো ঘরে একেকটি নীরব টাইপরাইটারের সামনে নিজনিজ চেয়ারে বসে সবাই গল্প করছে। কেউ কেউ হেঁটে এসেছে অনেক দূর থেকে, কিন্তু যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে রাস্তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে তাতে মনে হয় না যে, কারো কোনো কষ্ট হয়েছে। এই বড়ো ঘরের ভেতর দিয়ে মাঝারি ও ছোটো ধরনের সায়েবরা চলে যাচ্ছে নিজেদের কামরায়। এদের পা টেনে টেনে হাটা দেখে বা কল্পনা করে কেরানীকুল কখনো পুলক, কখনো মায়া অনুভব করে। তবে বড়ো সায়েবের জন্য সকলের প্রাণে আজ বড়ো হাহাকার: বড়ো সায়েব আজ সুট পর্যন্ত পরেনি। তার ফুল হাতা সাদা শার্ট এই শীতেও ঘামে না হলেও ভাপে ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে। তার কপাল ও গাল তেলতেলে। মুখের সেই মহানিলিপ্ত ডাটখানিতে চিড় ধরেছে। বড়ো সাহেব থাকে ধানমণ্ডির একেবারে ভেতর দিকে, এতোটা রাস্তা হেঁটে এলো, আহা! একটা কঠিন অসুখে না পড়ে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে যেতে বড়ো সায়েবকে ১০/১১ পা হাটতে হলো। এতোটা সময় জুড়ে তাকে দ্যাখার সুযোগ মেজো ও ছোট সায়েবরা ছাড়তে চায় না। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সবাই প্রায় কোরাসে স্লামালেকুম স্যর বলে।
মাঝারি গোছের এক সায়েব বড়ো ঘরে এসে বলে, ‘ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়ি কেউ আসেনি? একটু চাটা খাওয়া যাবে না?
‘কেউ আসেনি স্যর। এই সেকশনে কেউ আসেনি। মাঝারি গোছের সায়েব নিজের কামরায় চলে গেলে ছোকরা এক কেরানি বলে, পায়জামা ঢিলা শুনে সবাই অনেকক্ষণ ধরে হাসে। একজন কেবল বিরক্ত হয়েছে, এই শালারা বেশি বাইড়া গেছে!
কারা? ‘আবার কারা? লিফট বন্ধ, আবার চাবি লইয়া ভাগছে! পিওন চাপরাশিগো এতোটা বাড়াবাড়ি ভালো না!
এই ১টি মন্তব্যই তাদের গল্পের বিষয়বস্তু বদলাবার জন্যে যথেষ্ট। একজন বলে, ‘খালি পিওনদের বলছেন কেন? রিকশাওয়ালা, বাস কন্ডাক্টর, ড্রাইভার, কুলি—এদের তেজটা দেখছেন? আরে আইয়ুব খান গেলে তোদের লাভটা কি? তোরা মিনিস্টার হবি? নাকি অফিসে এসে চেয়ার টেবিলে বসবি?’
‘আরে শোনেন। ৪/৫ দিন আগে এক শালা রিকশাওয়ালা, নবাবপুর রেলগেট থেকে সদর-ঘাট যাবো, তো কতো হাকালো জানেন? —এক টাকার কম যাবে না। ভাড়া তো আট আনাও হয় না, না হয় দশ আনা নে, বারো আনাই চা; না, পুরো টাকাটা দিতে হবে।’
রেলগেট থেকে সদরঘাটের ভাড়া ছয় আনার বেশি হইতে পারে না। সহকর্মীর সমর্থন পেয়ে রিকশাওয়ালার ব্যবহারে ক্ষুব্ধ লোকটির উৎসাহ বাড়ে, ‘সীটে বসে, হ্যাঁন্ডেলে পা রেখে নবাবের বাচ্চা বলে, এক টাকার কমে হবে না। দিনকাল খারাপ, নইলে শালার পাছায় কষে একটা লাথি বসিয়ে দিতাম!’
বসের কামরায় টেবিলের এক পাশে বসে হার্ডবোর্ড ও কাচের পার্টিশনের ওপর থেকে কেরানীদের রিকশাওয়ালা পেটাবার সখের কথা শোনা যাচ্ছে।
ওসমানের বসের পাতলা গোঁফে অল্প অল্প ঘাম লনে-ছাট ঘাসের শিশিরবিন্দুর মতো চকচক করে। বস বলে, এদের ফল ইনএভিটেবল! কেরানিকুল না রিকশাওয়ালা-কাঁদের পতন অনিবার্য ওসমান এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার আগেই বস বলে, ‘পাবলিক কি রকম স্পনটেনিয়াসলি রি-এ্যাঁক্ট করছে, দেখছেন?
বসের মস্তব্যে ওসমান খুশি হয়। বসের কথাকে আরো জোরদার করার জন্যে সে বলে, একজ্যাক্টলি স্যর! তবে মানুষ ঠিক রি-এ্যাঁক্ট করছে না। মানুষ এবার এ্যাঁকশনে নেমেছে, রি-এ্যাঁক্ট করছে বরং গভমেন্ট, রাদার কাওয়ার্ডলি!’ এই বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ছাড়তে পারায় ওসমানের ভাল লাগে। কথাটা অবশ্য আনোয়ারের। আনোয়ারের পলিটিকাল এ্যাঁনালিসিস খুব ভাল। বস কিন্তু নিজের কথার সূত্র ধরেই এগোয়, আইয়ুব খানকে এবার ঈল্ড করতেই হবে। থিংস আর আউট অফ দেয়ার গ্রিপ। এখন আমার ভয় একটাই। আর্মি নামিয়ে ব্যাটারা একটা ম্যাসাকার না করে! ক্যাবিনেটে কয়েকটা হক্স আছে এ্যাঁন্ড দেয়ার ইজ এ ট্রিগার-হ্যাঁপি আর্মি।
সেনাবাহিনী নামিয়ে নির্যাতন করার আশংকার কথায় ওসমানের গা শিরশির করে। আনোয়ারের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েও ছেলেটা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলতে পারে। এ্যাঁনালিসিস এতো কনভিন্সিং। তবে একটা ব্যাপার কি, এবার ওয়েস্ট পাকিস্তানও ইনভলভড। কিছু করলে ওখানেও করতে হবে! নিজেদের ভাইবোনের ওপর কি রিপ্রেশন চালাতে পারবে? বলতে বলতে বসের স্বর নিচু হচ্ছিলো, বোধ হয় রাষ্ট্ৰীয় কোনো গোপন খবর জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।
রিসিভার তুলে বস বলে, ‘জী স্যর। প্লামালেকুম স্যর। অপারেটররা তাহলে স্যর এসেছে? গুড়। আসছি স্যর, জাস্ট এ মিনিট সার!
বসের ঘরের পাশেই ওসমানদের ঘর। ৪জন ছোটখাটো অফিসার এখানে বসে। এদের মধ্যে খলিলুর রহমান সিনিয়র। কেরানি থেকে এই পর্যন্ত আসতে আসতে বেচারার পেনশনের সময় হয়ে এলো। ঘরের টেলিফোন সেটটা তার টেবিলেই থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওসমান রিসিভার তুলে নেয়। নাঃ, কোনো সাড়া নাই, অপারেটররা এসেই বোধ হয় গুলতানি শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে ওসমান প্রায় ছেড়ে দেবে এমন সময় মহিলা কণ্ঠে শোনা যায়, নাম্বার প্লজ! কিন্তু আনোয়ারের নম্বর আর মনে পড়ে না। খলিলুর রহমানের টেবিলে কাচের নিচে মেলা ভিজিটিং কার্ড, পূর্ব পাকিস্তানের ১টা ম্যাপ, ম্যাপে ওদের ইপিআইডিসির বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা রয়েছে, অফিসের পিবিএক্স টেলিফোনের এক্সটেনশন নম্বর। এখানে আনোয়ারের টেলিফোন নম্বর খুঁজে লাভ কি? কী আশ্চর্য! আনোয়ারকে প্রায় প্রত্যেক দিনই একবার ফোন করা হয়, আর দ্যাখো আজ একি ঝামেলা হলো? ওদিকে সরু গলার তাগাদা আসে, হ্যাঁলো! কিন্তু কিছু মনে পড়ে না। কয়েকদিন আগে অফিসের কাজে সেক্রেটারিয়েটে কথা বলতে হবে, নম্বর ওর সামনেই লেখা ছিলো, অথচ ওসমান কিনা বলে বসলো ওদের বাড়ির নম্বর, তেইস বাই দুই। অপারেটর মেয়েটি হেসে ফেললে ওর চৈতন্য হয় এবং তখন টেলিফোন নম্বরটি বলে উদ্ধার পায়। কিন্তু আজ সংখ্যাবাচক কিছুই তার মনের ত্রিসীমানায় আসে না। অপারেটরকে আর প্রতীক্ষায় না রেখে ওসমান রিসিভার রেখে দিলো। টেলিফোনে টং করে একটি আওয়াজ হয় এবং ওসমান হঠাৎ খুব ভয় পায় আইয়ুব খান একটা ক্র্যাক-ডাউন না করে। আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরি। কি যে হবে! খলিলুর রহমান থাকলে তাদের গ্রামের খবর শোনা যেতো। তো গ্রামের কিসব খবর পেয়েই নাকি খলিলুর রহমান বাড়ি গেছে। হ্যাঁ, জামালপুরের ১টা বড়ো এলাকা জুড়ে দারুণ গোলমাল চলছে। খলিলুর রহমানের বাড়ির অবস্থা ভালো, জমিজমা, গোরুবাছুর, জনকিষাণ নিয়ে সচ্ছল গেরস্থ পরিবারের লোক। যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয় ওরাও ঝামেলায় পড়তে পারে। আবার পাশের টেবিলের মমতাজউদিনের সঙ্গে কথা বললেও কাজ হতো, সে ব্যাটা আজ অফিসে আসেনি। বাকি রইলো কামাল। তা কামাল তো মহাব্যস্ত; খুব ঝুঁকে বসে চিঠি লিখছে। ওসমান তবু তাকে বলে, কি কামাল সায়েব, আজ চিঠি লেখার দরকার কি? নিজেই চলে যান না! অফিস কি আর হবে?
১টি বাক্য সম্পূর্ণ লিখে কামাল তার সোনালি রঙের কলম চমৎকারভাবে কামানো নীলচে গালে ঠেকিয়ে বলে, আমারো ঐ রকম প্ল্যান ছিলো। কিন্তু ওদের এরিয়াটা ইজনো গুড়। এইসব ট্রাবল্ড স্পট এ্যাঁভয়েড করাই ভালো।
ধানমণ্ডিতে আবার ট্রাবল কি?’ কামাল ততোক্ষণে ওর চিঠি ফের পড়তে শুরু করেছে। ১টি জায়গায় ১টি শব্দ কেটে ফেললো, তীরচিহ্ন দিয়ে ওপরে কি লিখলো, তারপর মুখ না তুলেই বললো, মালীবাগে।
ওসমান অবাক হয়, আপনার ইয়ে ধানমণ্ডি থাকে না? * না ওটা কোল্যাপস করেছে। ‘মানে? ওটা আর কন্টিনিউ করছে না। এটা অন্য। এদের বাসা মালীবাগ। মালীবাগ মোড় পার হয়ে এগুলে একটি চওড়া রাস্তা গেছে খিলগায়ের দিকে, ঐ রাস্তার ওপরে। নিজেদের বাড়ি, অল মোজায়েক। ওখানে একটা কলেজ আছে, কলেজের ছেলেরা প্রতিদিন একটা না একটা ট্রাবল ক্রিয়েট করে। জায়গাটা রিস্কি।
কামালের তা হলে এটা নতুন পিক-আপ। প্রেম ছাড়া ছোকরা থাকতে পারে না। প্রথমদিকের প্রেম এমনি এমনি ঝরে পড়েছে। ভালো প্রস্পেষ্ট্রের ছেলে পেয়ে কোনো মেয়ে কেটে পড়েছে, কারো বিয়ে হয়ে গেছে। আবার কামালও আরো পছন্দসই মেয়ে পেয়ে ১টাকে ঝেড়ে ফেলেছে। তবে এখন সমস্যাটা ঠিক হৃদয়ের নয়, ফুসফুসের। কামালের একটু হাপানি আছে, শীতকালটায় ফুসফুস মন্থর হয়ে পড়লে হাওয়া চলাচল স্বচ্ছন্দ হয় না বলে বেচারা বেশ কষ্ট পায়। সাম্প্রতিক প্রেমিকারা তাই শীতকাল এলে সুড়সুড় করে সরে পড়ে। তবে কামাল বেশ খ্যানঘ্যান করে চিঠি লিখতে পারে, হাতের লেখা ভালো। ঠেসে চাইনিজ খাওয়ায়। তাই তার গ্যাপ বেশিদিন থাকে না। তবে এবার মালীবাগের মেয়ে বাছাই করার আগে তার চিন্তা করা উচিত ছিলো।
জায়গাটা রিস্কি। ওসমান কামালের ভয়কে অনুমোদন করে, খিলগাও মালীবাগ, শান্তিনগর-এই বেল্টটাই খুব সেন্সিটিভ। প্রায় প্রতিদিন গুলি চলেছে।’
স্পেশালি প্লাম এরিয়া। ব্যাটাদের কাজকাম নেই তো. রোজ প্রসেশন বার করে। পুলিসের গাড়ি দেখলেই চিল ছোড়ে। চিল দিয়ে অটোমেটিক উইপনস ঠেকাবে? স্টুপিড।’
পার্টিশনের ওপার থেকে ওসমান গনির বস ডাকে, ওসমান গনি সায়েব!’ বোঝা যায় যে, বস তার সায়েবের ঘর থেকে চার্জড হয়ে এসেছে।
‘আরে বসেন। আজ আবার কাজ কি? বসেন। বসের বস নিশ্চয়ই এভাবেই তাকে অভ্যর্থনা করেছে।
‘একটা খবর জানেন? কি? উৎসাহ বোধ করার জন্যে ওসমান যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর আক্রমণের ভয়টা হঠাৎ মাথাচাড়া দেয়, আর্মি কি ক্র্যাক ডাউন করবে স্যর?
আরে না! কি পাগলের মতো কথা বলেন বস এবার সুস্থ লোকের মতো নড়েচড়ে বসে, আইয়ুব খান ন্যাশনাল গভমেন্ট ফর্ম করতে চায় আফটার অল ট্যালেন্টেড লোক। সিচুয়েশন এ্যাঁপ্রিশিয়েট করতে পারে।’
‘ন্যাশনাল গভমেন্ট? কে বললো? জিনিসটা কি তাও ওসমানের ধারণার বাইরে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা কি বিজাতীয়? না মালটি-ন্যাশনাল?
শুনলাম। এই মহাগোপন খবরের উৎস বস ফাস করবে না, ন্যাশনাল গভমেন্ট ইজ এ মাস্ট। ইভন’-বস এদিক ওদিক তাকায়, তারপর ফিস ফিস করে বলে, ইভন শেখ মুজিব ইজ লাইকলি টু বি ইনকুডেড। শেখ না হলে এই সব এ্যাঁনার্কি স্টপ করবে কে? মওলানা ভাসানীর প্রভোকেশনে পিপল কি রকম রাউডি হয়ে উঠছে, দেখছেন না? টেলিফোনের সংক্ষিপ্ত বাজনায় তাকে থামতে হয়। বস তার বৌয়ের সঙ্গে কথা শুরু করলে ওসমান নিজের ঘরে ঢোকে।
কেরানীরা নিজেদের সুপারিনটেন্ডেন্টদের টেবিলে ভিড় জমায়। একটু ভীতু টাইপের গুলো প্যানপ্যান করে, যাই স্যর, আবার কখন কি হয়! সবারই সমস্যার অন্ত নাই। ‘আমার বাসা স্যর পুরা হাসপাতাল। ওয়াইফের গলা ফুলছে, মেয়েটার ব্লাড ডিসেন্ট্রি। যাই সার। বায়তুল মোকাররমে আজ বড়ো গ্যাদারিং, স্টুডেন্ট লিডাররা বলবে। মিটিং না শুনলে প্যাটের ভাত হজম হয় না স্যর। সুপারিনটেন্ডেন্টরা যায় যার যার অফিসারের কামরায়।
‘কেউ অফিস করতে চায় না স্যর। কি করি? ‘অফিস করি কি করে স্যর? পিওনরা প্র্যাকটিক্যালি সবাই এ্যাঁবসেন্ট।
এইগুলিরে লইয়া স্যর বহুত বিপদ! আরে তগো চিন্তা কি? গুলি খাইয়া মরলে আইজ বাদে কাইল তগো বৌপোলাপানে দ্যাশে যাইবো, ধান বানবো, খ্যাতে কামলা খাটবো। তগো চিন্তা কি?’
প্রব্লেম স্যর আমাদের। মিডল ক্লাসের আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। যাই স্যর। আমাদের এরিয়ায় কতগুলি খচ্চইরা পোলাপান আছে। পুলিস দেখলেই চাক্কা মারবো। ইপিআর পুলিস টুইকা পড়লে মহল্লায় ঢোকাই মুশকিল হইবো। যাই স্যর। অফিসারদের সমস্যাও বড়ো জটিল। তাদের বসদের ঘরে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে বলতে একেকজন নুয়ে নুয়ে পড়ে।
আমার সিস্টার-ইন-ল লন্ডন যাচ্ছে, টুয়েন্টি থার্ডে ফ্লাইট। এখনো ফর্মালিটিজ ইনকমপ্লিট। টেলিফোনে কাউকে পাওয়া যায়!
আমার থার্ড ছেলেটা, হি হ্যাঁজ বিকাম এ প্রব্লেম চাইল্ড। আমি ঘরে না থাকলেই বেরিয়ে পড়বে। এইচ এস সি-তে স্টার মার্কস পেয়েছে, ফিজিক্সে এ্যাডমিশন নিলো, ইউনিভার্সিটি তো—
আরেকজনের সমস্যা তার স্ত্রীর সঙ্গীত-প্রতিভা, ‘গায়িকাকে বিয়ে করে আমার হয়েছে প্রব্লেম। এতো সেন্সেটিভ, নয়েজ হলেই রি-এ্যাঁক্ট করে, নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হয়।‘
বসেরা তাদের ওপরওয়ালাদের সঙ্গে এবং ওপরওয়ালারা অফিসের এক নম্বরের কামরায় বিশাল টেবিলের চারদিক আলো করে বসে দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
ক্যাওস কনফিউশন কন্টিনিউ করলে ফিউচার ইজ ভেরি ক্লিক। পলিটিক্স যাই থাক, নাথিং সাকসিডস উইদাউট ডিসিপ্লিন।’
রিমোট কর্নারে ক্যাওস আরো বেশি। এভরিবডি মাস্ট বি রিজনেবল। এ্যাঁনার্কি শুড নেভার বি এ্যাঁলাউড টু কন্টিনিউ ফর ইনডেফিনিট পিরিওড।
এখন গভমেন্টের দ্যাখা দরকার এই আনরিজনেবল পিপলকে কষ্ট্রোল করতে পারে কে? হি এ্যাঁন্ড হি শুড বি টেকন ইনটু কনফিডেন্স।
সায়েবরা নিজেদের কামরায় ফিরে গিয়ে টেবিলের নিচে পা নাচায়। ছোটো অফিসারদের ডেকে নিচের দিকে খবর পাঠায়, কাউকে চাপ দেওয়ার দরকার নাই। তবে সবাই যেন হাজিরা খাতায় সই করে যায়। এই অলিখিত নির্দেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছবার আগেই অফিস প্রায় খালি হয়ে গেছে। তবে বেরিয়ে যাবার আগে অফিসের হাজিরা খাতায় নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গেছে সবাই।