চিলেকোঠার সেপাই – ১৭
দুপুরবেলা ভাত খেয়ে আনোয়ার আবিষ্কার করলে যে, সিগ্রেটের স্টক প্রায় শেষ। সিগ্রেটের কথা বলতে মন্টু প্রস্তাব করে, আজ বিকালে চন্দনদহ চলেন।
সিগ্রেট কিনতে দুমাইল যাবো? জালাল ফুপার বাড়ির সঙ্গে ছোটো দোকানটা থেকে নিয়ে আয় না!
দূর ওখানে তিন মাসের বাসি সিগারেট। চন্দনদহ বাজারে আজ যাত্রা আছে। যাত্রা দেখবেন? আব্বাকে বলেন, আপনি গেলে আমাকেও যেতে দেবে।
সিরাজগঞ্জের নামকরা অপেরা পার্টি। চন্দনদহের নতুন কলেজের ফান্ড তৈরির জন্য সিরাজদ্দৌলা পালার আয়োজন। ঐ অপেরা পার্টির আরো ভালো ভালো পালা আছে, কিন্তু কলেজের সাহায্যে টাকা তোলা হচ্ছে, যে সে বই হলে চলে না। স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল করে যাত্রা, চারদিকে বাশের বেড়া। সামিয়ানার নিচে চাটাই পেতে খড় বিছানো রয়েছে, মঞ্চের সামনে তিন সারি চেয়ার। আনোয়ারকে খাতির করে সামনে বসতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু বিনয় করে সে বসেছে দ্বিতীয় সারিতে। ওর পাশের চেয়ারে মন্টু। কয়েক মিনিট পর আফসার গাজী টুকতেই সামনের সারির অনেকেই উঠে দাঁড়ালো। আফসার ১টা চেয়ারে বসে পাশের লোকটিকে বলে, ‘প্রিন্সিপ্যাল সায়েব বসেন। তারপর কার কথা শুনে সে তাকালো পেছনে, আনোয়ারকে বলে, ‘আকবর চাচার ব্যাটা না? আরে সামনে এসো, সামনে এসো। বসে বসেই আনোয়ারের হাত ধরে তাকে সামনের সারিতে টেনে আনে, প্রিন্সিপ্যাল চালান হয়ে যায় দ্বিতীয় সারিতে আনোয়ারের চেয়ারে। আনোয়ার ভালো করে আফসারকে দ্যাখে, এই লোকটিকেই চেংটু কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলো! লোকটা খুব মিশুক, আবার এক আধ পাইট টেনেও এসেছে। মঞ্চের চেয়ে আনোয়ারের দিকেই তার মনোযোগ বেশি, তুমি আমার চেয়ে অন্তত দশ বারো বছরের জুনিয়ার তো হবেই। তোমার বড়োভাইও আমার জুনিয়ার।’ বলে সে হাসে। তারপর আনোয়ারের ডান হাতটা নিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দেয় তার কোটের পকেটে, আনোয়ারের হাত ঠেকে একটা বোতলে, পাইটের সাইজের বোতল। আফসার তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, চলবে?
তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলে, কেরুর সিংহ মার্কা এখানে?’ – আনোয়ারের অবাক-হওয়া দেখে সে হাসে, ক্ষতি কি? কে কি বলবে? এখানে না চাইলে বাইরে চলো, বাজারে আমার রাইস মিল। বাসাও আছে।’
আনোয়ার না করলে লোকটা বলে, বুঝছি! বাড়িতে তো আসো না, বাড়ি এসে ক্যারেক্টারটা দ্যাখাতে চাও একেবারে ধোপাবাড়ির ইঞ্জি-করা শার্ট ভালো! ভালো! আমরা ভাই গ্রামেই থাকি, ভালো কও, মন্দ কও, দরবেশ কও, লোফার কও-সব খোলাখুলি, ওপেন টু অল –না কি কোস রে আবুলের বাপ? কিন্তু তার পায়ের সামনে নিচে বসা লোকটি কিছু না বলায় সে ধমক দেয়, ক্যারে শ্যালা, কথা কোস না কিসক? এতেও আবুলের বাপ সাড়া না দিলে সে বলেই চলে, তোমারা আসো দেশ দেখতে, এ্যাঁ? দুদিন থাকবে, চাষা-ভূষাদের উস্কে দিয়ে ঢাকা যাবে, ঢাকায় সব বড়ো বড়ো হোটেল, বার তো আছেই, না কি বলো?
লোকটা একনাগাড়ে কথা বলেই চলে। একটু টিপসি হলেও কথাবার্তা কিন্তু বেসামাল নয়। এদিকে পালা যে কখন শুরু হবে কিছু বোঝা যায় না। স্টেজে ১টি মেয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফায়, তার লিকলিকে পা ২টো চোপ্ত পাজামায় মোড়ানো, মাংসহীন, উরু ও পাছা নিয়ে সে কতোরকম ক্যারদানি মারে, দেখে মেয়েটার জন্যে আনোয়ারের খারাপই লাগে, পায়ের ব্যথায় বেচার রাত্রে ঘুমাতে পারবে কি-না সন্দেহ। রোগ পটকা মেয়েটার বুক বেঢপ রকমের উঁচু, গ্যাটিস-মারা স্তন দুটো সে এমনভাবে এগিয়ে ধরে যে, যে কেউ হাত দিলে তার ভেতরকার কাপড় না হার্ডবোর্ড সব বেরিয়ে পড়তে পারে। স্নো পাউডার ও রুজের পলেস্তারার নিচে তার মুখের বসস্তের দাগ হাজাগের চড়া আলোয় অনেকগুলো কুতকুতে চোখের মতো পিটপিট করে। আফসার গাজীর দিকে চোখ রেখে তার শরীরের ব্যস্ত তৎপরতা পরিচালিত হয়। চোখের ইশারায় আফসার একবার দেখিয়ে দেয় আনোয়ারকে, কি গো সুন্দরী, আমার ভাইটাক চোখত পড়ে না? ভালো করা নাচ ঢাকার নেতামানুষ, একদিন মন্ত্রী হবো, দেখিসা তারপর আনোয়ারের দিকে ঝুঁকে সে বলে, তুমি তো ভাই রাজধানীর মস্তান, বলে তো ভালো মাল পাওয়া যায় কোথায়? বলে তো?-পারলে না?– বাদামতলী বলো, কান্দুপট্টি বলো, কুমারটুলী বলো, গঙ্গাজলী বলো,-নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের কাছে এসব একেবারে নস্যি। আর লাহোর যদি যাও তো এসব মনে হবে চুলার লাকড়ি। লাহোর কলকাতা কিছু বাকি রাখিনি। হীরামন্ডি কও, সোনাগাছি কও-পাকিস্তান হিন্দুস্থান সব চষ্যা বেড়ছি! কথার তোড়ে তার আঞ্চলিক বুলি বেরিয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে, একদিন শুনলাম বাদামতলী উঠে গেছে। আমি বলি, হায় হায় ঢাকা তো অন্ধকার হয়ে গেলো- কিসের কি? এখন গোটা ঢাকা শহর দেখি শালার একখান বেশ্যাপাড়া রাস্তায় মাগীরা সব কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশায় তোলো, জায়গায় নিয়ে কাজ সারো
আনোয়ার ভয় পায় যে, আফসার গাজীর বেশ্যাগমনের বর্ণনা এভাবে অব্যাহত থাকলে যাত্রা দ্যাখার বারোটা বাজবে। যে লোকটি নাম-ভূমিকায় নেমেছে, চলচ্চিত্র অভিনেতা আনোয়ার হোসেন তার আদর্শ। সিরাজদ্দৌলা’ ছবির সংলাপ সে হুবহু মুখস্থ বলে, চোখ বড়ো করে এদিক ওদিক তাকায়। আফসার গাজী কথা বলা বন্ধ করে ঢুলুঢুলু চোখ যতোটা পারে খুলে তার গতিবিধি দাখে। একেকটি দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে রিকেটগ্ৰস্ত মেয়েটি মঞ্চে নামে, লাফায় ও লাফাতে লাফাতে হাপায়। তার কৃত্রিম স্তন ও অকৃত্রিম উরু-পাছ এবং সিরাজদৌলার দেশপ্রেম আফসার গাজীকে ক্রমেই উত্তেজিত করে তোলে। মেয়েটি এলে সে একেকবার হাত পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, তবে মঞ্চ অনেক দূরে, তার ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়। আর নবাব সিরাজদ্দৌলাকে দেখলে সে বুক টান করে বসে। পরাজিত সিরাজদ্দৌলা বন্দি হবার পর তার শক্ররা যখন তাকে কাটার আসনে বসিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে, চেয়ার থেকে আফসার গাজী চিৎকার করে ওঠে, শালারা তোরা হাসিস দ্যাশের স্বাধীনতা যায়, তোরা মজা করিস। গাদারের পয়দা গাদ্দার। বাঙলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিলুপ্তিতে লোকটা ক্ষোভে ছটফট করে। এরপর শক্রদের সামনে নিজের ও দেশের দুর্ভাগ্যে সিরাজদ্দৌলা যখন খুব চটপটে গলায় বিলাপ করছে এবং দর্শকমণ্ডলী চোখের পানির ট্রান্সপারেন্ট পর্দা ভেদ করে তাই দেখছে, অফসার গাজী হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, থামো, থামো বাড়ার এ্যাঁকটো করো আনোয়ার হোসেনের লাকান হলো না। আবার করো।
এদিকে আনোয়ার ভাবে পাবলিক এই উত্তেজিত দর্শককে ধরে মার না দেয়। নবাব সিরাজদ্দৌলার আঠালো সংলাপের মাঝখানে আফসার ফের হুকুম ছাড়ে, কল্যাম না শালা রিপিট করো। কানোত কথা যায় না, না?
বিড়িটা হাত থেকে ফেলে যাত্রার অধিকারী মঞ্চে উঠে বাঙলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতিকে কি নির্দেশ দেয়, নবাব ঐ সংলাপের পুনরাবৃত্তি করে।
আনোয়ার নবাব সিরাজদ্দৌলার কথা একরকম ভুলেই যায়। তার অবিচল দৃষ্টি তার পাশে-বসা আফসার গাজীর দিকে। তার চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে আসছে, মনে হয় নেশা বোধ হয় জমছে। যাত্রার ঐ দৃশ্য শেষ হতে না হতে সে চেচিয়ে ওঠে, অনেকটা হছে। আবার করো। দোবারা এরশাদ। লোকটা বোধ হয় হীরামণ্ডি কি সোনাগাছির কোনো বাইজির আসর রিপিট করছে।
যাত্রার অধিকারী মশাই এবার মঞ্চে না উঠে জোড়হাতে এসে দাঁড়ায় আফসারের সামনে। বলে, ‘হুজুর এক সিন বারবার রিপিট করলে বোঝেন তো পাবলিকে
আফসার গাজী অধিকারীকে ঢালাও নির্দেশ দেয়, পাবলিকের গোয়া মরো এই আদেশ পালনে অধিকারী মশাই তার সম্মতি বা অপারগতা জানাবার আগেই পেছন থেকে চিৎকার শোনা যায়, হামরা পয়সা খরচ করা দেখবার আসছি। একজনের কথাত সব হবো? অডিয়েন্স পেছনে তাকায়, আনোয়ারও ঘাড় ফেরালো। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে লোকটি
তাকে সে চিনতে পারে। কাল দুপরে আনোয়ারদের কাঁঠালতলায় জালাল মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলো, এর নাম করমালি, জালাল মাস্টারের জমির বর্গাচাষী। বৈরাগীর ভিটা পার হয়ে কয়েক বিঘা জমি আছে জালাল মাস্টারের, সেই জমির ওপারে তালপোতাগ্রামে এদের বাড়ি। লোকটার দাত অস্বাভাবিক উঁচু বলে একে ১বার দেখলে ভোলা যায় না। তো তার এই চিৎকারের সঙ্গে ৩ সারি চেয়ারের দর্শকদের ভেতর থেকেও তাকে সমর্থন জানানো হয়, যাত্রার মাঝখানে আফসার ভাই কি আরম্ভ করলো? এমনকি গাজীদের কলেজে-পড়া একটি ছেলেও বলে ওঠে, মাতলামি করার আর জায়গা পায়নি, না?
এরপর পেছন থেকে একসঙ্গে এমন হৈ চৈ শুরু হয় যে, কারো কথাই স্পষ্ট বোঝা যায় না। এর মধ্যে ২/১ টি বাক্য বেশ পরিষ্কার, যেমন, মাস্টার, তুমি পয়সা নিছো সোগলির কাছ থাকা আর যাত্রা দ্যাখাবা খালি একজনেকি?
তুমি এক চোখত নুন ব্যাচো এক চোখত তাল ব্যাচো, না? ‘চিয়ারত বস্যা তাই লবাব হছে নাকি? হামরা পয়সা দিয়া ঢুকছি, চিয়ারত বস্যা মাগনা দেখি না।
লবাব সিরাজদ্দৌলার লাতি। শালাক এ্যাঁকটো করবার দিলেই হয় এইসব উক্তির ফলে চেয়ারে উপৰিষ্ট দর্শকরা উসখুস করে এবং হঠাৎ চুপ করে যায়। পেছনের কোলাহল অব্যাহত থাকে। চেয়ারে বসা ১জন দর্শক, আনোয়ারদের এক আত্মীয়, দাঁড়িয়ে ধমক দেয়, করমালি থাম! কি শুরু করলি?
‘দ্যাখেন না ভাইজান খালি ক্যাচাল করবো! ইগল্যান করলে যাত্রা হবো? করমালির অভিযোগ শেষ হতে না হতে আফসার গাজী শক্তি পুনরুদ্ধারে ব্যাপৃত হয়, শালা বেন্ন্যার বাচ্চাগুলাক ঢুকাছে সামিয়ানার তলাত। ট্যাকার গরম দ্যাখাস? এই শালার কলেজের নাম করা যাই যা খুশি করবো?
আনোয়ার মৃদু গলায় বলে, আঃ! আপনি কি শুরু করলেন? আফসার এবার দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে আনোয়ারের দিকে, আরে ভাই, দ্যাথো না। আমার দাদার দান-করা এই জায়গা-এখানে শালারা আমাকে বেইজ্জত করে। আমার দাদার জায়গা আর তোমার দাদার টাকায় এই স্কুলের দালান,—এখানে আমাদের সঙ্গে নিমকহারামি করে !
স্কুলের জায়গাটা গাজীদের দেওয়া, এটা ঠিক। কিন্তু এই স্কুল ভবন নির্মাণে তার নিজের পূর্বপুরুষদের কোনোরকম অবদানের কথা আনোয়ারের জানা নাই। ওর দাদা স্কুলের জন্য টাকা দিলে জালাল মাস্টার অন্তত একদিন না একদিন বলতো। তবে আফসারের এই তথ্য চ্যালেঞ্জ না করে সে বলে, আপনি বরং বাইরে যান। আপনার শরীর ভালো না।
বাইরে যাবো কেন হে? আমার জায়গা ছেড়ে বাইরে যাবে আমি? আফসার গাজীর বাক্যে যাত্রার প্রভাব লক্ষ করা যায়, ‘ছোটোলোকের দাপট সহ্য করবো আমি।
তাহলে চুপচাপ বসেন। এবার আনোয়ারের অসহ্য ঠেকে, দাপট তো দ্যাখ্যাচ্ছেন আপনি সবাই চুপচাপ শুনছিলো, আপনিই তো গোলমাল শুরু করলেন।
আফসার গাজীও ধৈর্য রাখতে পারে না, নেতাগিরি দ্যাখাবার আসছে, না? হৰো না! লাভ হবো না, তোমার মামু আসছিলো ভোট নিবার, ভোট পায় নাই। তোমাকও ভোট দেওয়া হবো না, বুঝল্যা?
‘ভোটের কথা কি হলো? আপনি তো ইতরামো করছেন। হয় চুপচাপ বসেন, নয় বেরিয়ে যান।’ এই সময় চেয়ারের দ্বিতীয় সারি থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানী হামিদ মণ্ডল এসে আফসারকে একরকম জোর করে বসিয়ে দেয়। লোকটি খয়বার গাজীর খাস লোক। তার অনুপস্থিতিতে তার ভাইপোর নিরাপত্তা ও কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রাখাও হামিদের কর্তব্য। আফসার গাজী এবার নেতিয়ে পড়ে। সে বেশ জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে শুরু করে। আনোয়ার বুঝতে পাচ্ছে যে, ওর নেশা কিন্তু একেবারে কেটে গেছে। কিন্তু আপাতত কিছুই করা সম্ভব নয়, তাই মাতলামোর ভাণ করে, কিছুই না বোঝার ভাব করেও খানিকটা উদ্ধার পায়।
যাত্রার প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে করমালি দাঁড়ায় আনোয়ারের পাশে। বলে, ‘চলেন। মন্টু জিগ্যেস করে, তুই বাড়ি যাবি না?
চলেন, আপনাগোরে বাড়ির উপর দিয়া যামু।
আনোয়ার একটু অবাক হয়, বেশ ঘোরা হবে না?
অল্প এ্যাঁনা !
মন্টু বলে, চল যে অকামটা করলি আজ তুই খালি লাফ পাড়িস মন্টু বেশ বিরক্ত। আফসার গাজীকে সে দুইচোক্ষে দেখতে পারে না, এতোক্ষণ ছিলো, ভালো করে কথাও বলেনি। তার অপমানে মন্টু বেশ খুশি। কিন্তু তাই বলে করমালি এভাবে কথা বলবে কেন?
একটু দূরে আবুলের বাপের পাশে দাঁড়িয়ে আফসার গাজী ডাকে, মন্টু শোনা’
এরা একটু দাঁড়ায়। মন্টু ফিরে এলে করমালি জিগ্যেস করে, কি কলো?
কিছু না!
তাই বাড়িতে যাবো না?
না! আজ বাজারে থাকবে।
আনোয়ার বলে, কেন? বাজারে থাকবে কেন?
মন্টু জবাব দেয়, কি জানি? বোধহয় নষ্টামি ফষ্টামি করবে। এইসব মানুষ শয়তানের হাড্ডি। এইসব মানুষের সাথে লাগা ভালো না, বুঝলেন? আমাকে বলে কি, আনোয়ার ইচ্ছা করলে আমার সাথে থাকতে পারে। আপনাকে কিসব খাওয়াতে চায়! লোকটার ছোটো বড়ো জ্ঞান নাই!’
করমালি তার বড়ো দাঁতে হাসে, বাড়িত যাবো না ভয়ে! ভয় পাছে, বুঝলেন না? ইন্দুরের জান নিয়া তাই নাফ পড়ে। রাত হছে তো, ঘাটা ধরা যাবো, ভয় করে। হামরা ইগল্যান বুঝি না? হাটতে হাটতে বলে, ’অর কল্লাখান দিয়া কেড়া কি করবো? অরটিংটিঙী কল্লাখানের কানা পয়সা দাম আছে? অর চাচা খয়বার গাজী সন্ধ্যা হতে না হতে বাড়ির মধ্যে সান্ধায়, তামাম আত বাড়িত ডাকাত পড়লেও বারাবার সাহস পায় না। আর উই তো ইন্দুরের বাচ্চাও না।
করমালি কথা বলে একটু বেশি। এটা বরং ভালো। আনোয়ারের এতে সুবিধাই হয়। চেন্টুর মতো হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে আনোয়ারের অকারণ অপরাধবোধটিকে কাটার মতো উস্কে তোলে না। চেংটু চুপ করলেই মনে হয় খুব মনোযোগ দিয়ে সে যেন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে।
সেদিন কাঁঠালতলায় করমালি এসেই আনোয়ারকে দেখিয়ে জালাল মাস্টারকে জিগ্যেস করছিলো, বড়োমিয়ার নাতি, না? চেংটুর মুখোত শুনলাম ঢাকাত থাকা আসছে? তা কতোদিন থাকার নিয়ত করা আসছেন?
জালাল মাস্টার সব প্রশ্নের জবাব বলে, করমালি, আরেকটা হাল দিয়া গম বুন্যা দে। করমালি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, গোরু পাই না সরকার। হামার গোরু তো গেছে– ‘
‘গোরু কি আর নাই? তোর গাওত গোরু কি খালি তোরই আছিলো?
না চাচামিয়া, করমালি ফের হাসে, হামাক কেউ গোরু দিবার চায় না। সোগলি ভয় করে, হামাক গোরু দিলে তার নিজের গোরুখানও চুরি হয়া যাবো।
মানে?-মানে তো করমালির কাছেও দুর্বোধ্য। তার গোরু চুরি হয়েছে, এতে অন্যদের ধারণা যে, গোরুচোরেরা তার ওপর অসন্তুষ্ট। তার প্রায় একঘরে হবার দশা, তার সঙ্গে কথা বলার সময় সবাই এদিক ওদিক দ্যাখে, তার বাপটার সঙ্গে পর্যন্ত ভালো করে কথা বলতে চায় না। এমনকি করমালির প্রতিবেশী, তার জ্যাঠা, বাপের বড়ো ভাই, সে আরো বেশি সাবধান। গোরু চাইলে নানা বাহানা দ্যাখায়। তার কথাবার্তা বড়োলোকদের মতো। কি রকম?-না, আজ গোরু দেওয়া যাবে না। কেন? গোরুকে বেশি খাটানো ঠিক নয়। ১ জোড়া গোরু, ৭/৮ দিন টানা খাটনি পড়লো, ২টো দিন আরাম করুক। আবার করমালির ফুপাতো ভাই না ভাইপো, সে আজ-দেবো কাল-দেবো করছিলো, তার গোরু শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেলো কিসমত সাকিদার।
কিসমত হলো খয়বার গাজীর পুরনো বর্গাদার, সে চাইলে তাকে গোরু না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এখন করমালি গোরু পায় কোথায়? জালাল মাস্টারও ঘাবড়ে যায়, এখন চাষ করবি কি দিয়া? আমার গোরুও তো একটা মরলো, একটা বেচা দিলাম।
করমালি ১টি সমাধান প্রস্তাব করে, এজন্যেই তার এখানে আসা। কি প্রস্তাব? জালাল মাস্টার নিজে একবার তাদের গ্রামে গিয়ে যদি গোরুওয়ালাদের কাউকে বলে তো কাজ হয়। কিন্তু জালাল মাস্টারের সময় কোথায়?—না, সময় একবার করে নিতেই হবে। গোরু নাই বলে করমালিকে বর্গাচাষ থেকে সে যদি খারিজ করে তো বেচারা একেবারে পথে বসবে।
এটা কয়েকদিন আগের কথা। এখন যাত্রা দেখে ফেরার পথে করমালি এক মুহুর্তের জন্য কথা থামায় না। প্রথমে কথা চললো সিরাজদ্দৌলা নিয়ে। পালার কাহিনী সে অর্ধেক বোঝেনি, মীরজাফর ও মোহনলালের ভূমিকা সম্বন্ধে একেক মন্তব্য করে। তবে খয়বার গাজীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চত, এবার তার মরণ ঠেকায় কোন বাপের ব্যাটা? কিভাবে?–আনোয়ারের এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সে দেখিয়ে দেয় মন্টুকে, মন্টু ভাইজানেক পুস করেন তো! তাই তো তার মামুই হয়। তাই কবো, খয়বার গাজী কতোগুলো মানুষের সব্বোনাশ করছে!’
তাতে তার অসুবিধাটা হচ্ছে কি? ‘বোঝেন না? এতোগুলা মানুষের শাপমণ্যি লাগলে তার উপরে আল্লার গজব পড়বো না? এই সব নিয়তিবাদী লোকজন কি করবে? মানুষের অভিশাপই যদি কাউকে প্রাপ্য দণ্ড দিতে পারে তো বিপ্লবের এতো প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার কি?
সাথে আপনেও তালপোতাত আসেন। সেদিন না কোল্যাম কোনো শালা গোরু দিব্যার চায় না, অ্যাসা দ্যাখেন, কি তামশা আরম্ভ হছে।’