চিলেকোঠার সেপাই – ২৫
বস্তির ঘর কিন্তু খিজির ছাড়লো না। রহমতউল্লা তাকে ডেকে পাঠায় না, আবার মহাজনের সঙ্গে দ্যাখা করার মতো সময় কোথায় খিজিরের? প্যাসেঞ্জারবিহীন খালি রিকশা নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মিছিল বার হবে, সেই ব্যাপারে সে খুব ব্যস্ত। আলাউদ্দিন মিয়ার ঘরে ঘন ঘন মিটিং হচ্ছে। ইউনিয়নের লোকজন আসছে, ছাত্ররা আসছে, আলাউদ্দিন মিয়ার দলের লোকজনও এই ব্যাপারে আজকাল খুব তৎপর। দাবী-দাওয়া কি কি পেশ করা হবে তাই নিয়ে ৩/৪দিন ধরে খুব হাউকাউ চললো। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবের মুক্তি, ছাত্রদের এগারো দফা, আইয়ুব খান ও মোনেম খানের পদত্যাগ,–এসবের সঙ্গে টায়ার টিউবের দাম বাড়ার অজুহাতে রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে মহাজনদের বেশি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করা, ইচ্ছামতো রিকশাওয়ালা বদলানো বন্ধ করা, এ্যাঁক্সিডেন্ট হলে রিকশার ক্ষয়ক্ষতির ভার মহাজনের ওপর আরেকটু বর্তনো–এসব দাবীও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কথা ছিলো বেলা ২টার দিকে রিকশাওয়ালারা খালি রিকশা নিয়ে হাজির হবে বায়তুল মোকারম ৷ মিটিং সেরে খালি রিকশার মিছিল। কিন্তু ঘাপলা শুরু হলো সেদিন সকালবেলা। গ্যারেজে এতো রিকশাওয়ালা দেখে খিজির অবাক, আরে, মিছিল বারাইবো দুইটো বাজে, রাইত না পোয়াইতে তোমরা আইছো?
১ রিকশাওয়ালা বলে, এই বেলা গাড়ি চালাইলে মিছিলের লোকসান কি? আলাউদ্দিন মিয়ারও সেই মত, সকাল থেকে গাড়ি বন্ধ থাকবে কেন? গরিব লোকজন ১ বেলা গাড়ি চালিয়ে ২টো পয়সা রোজগার করবে না?
খিজিরের চিন্তা, গাড়ি একবার বারাইয়া পড়লে কহন আহে কিছু ঠিক নাই। আমাগো আবার পরথম যাইতে হইবো ভিক্টোরিয়া পার্ক। দ্যাড়টার মইদ্যে না গেলে দুইটা বাজলে বায়তুল মোকাররম যাইবার পারুম? মিছিল আরম্ভ করতে দেরি হইয়া যাইবো না?
আলাউদ্দিন মিয়া ঠোঁট থাকায়, মিছিলের গরজ মনে লয় আমার থাইকা তরই বেশি? রিকশাওয়ালা হাসে। কারো কোনো সন্দেহ নাই যে মিটিং বলো, মিছিল বলো, আন্দোলন বলো, সংগ্রাম বলে-এসব ব্যাপারে মহল্লায় আলাউদ্দিন মিয়া ১ নম্বর। আস্তে অস্তে সে জানায়, গরিব মানুষের দেশ, তাদের ভালোমন্দ না দেখলে কি চলে? তোমরা অহন গাড়ি লইয়া যাও। বারোটার মইদ্যে ফেরত আইবা। তাইলে খাওন দাওন সাইরা দুইটার মইদ্যে বারাইতে কেউরো দেরি হইবো না।
কিন্তু বিকালে যাদের রিকশা নেওয়ার কথা এই সিদ্ধান্ত তাদের সায় নাই, আমরা তাইলে কি গুনা করলাম? আমাগো রোজগারপতি হইবো না, আমরা খালি প্যাট বাজাইতে বাজাইতে মিছিল করুম?
খালি মালপানির ধাদা করলে আন্দোলন চলবো?—আলাউদ্দিন মিয়া প্রায় রাগ করে বেরিয়ে যায়। এই ব্যাপারে খিজির তার সায়েবের সঙ্গে একমত। কিন্তু এসব কথাই আবার খিজিরের মুখে শুনে সবাই হাসে। হাসাহসি শেষ হলে ধমক দেয়, চাপাবাজি রাখৰে। প্যাট খালি রাখলে কাম হইবো?
কিছুক্ষণ পর আলাউদ্দিন মিয়া ফিরে এসে ফের প্রথম থেকে সব শোনে এবং মন্তব্য করে যে পেটের ধাদা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ দূর করতে না পারলে পেটের জন্যে প্রয়োজনীয় অন্ন আদায় করা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানের। ৭কোটি মানুষের বাচার স্বার্থে নিজেদের সংকীর্ণ স্বাৰ্থ বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর লোকটা বক্তৃতা ঝাড়ে ৫টা মিনিট ধরে। তার বলার ঢঙ এতো ভালো যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কারো হয় না। এমনকি সকালে রিকশা চালাবার সুযোগ-পাওয়া ১ রিকশাওয়ালা আজ বায়তুল মোকাররমে তাকে বক্তৃতা করার জন্যে অনুরোধ পর্যন্ত করে। —আজ বাদে কাল পার্টির সিটি কমিটির এ্যাঁসিস্ট্যান্ট অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হতে যাচ্ছে আলাউদ্দিন মিয়া বায়তুল মোকাররম কেন, পল্টন ময়দানেই বক্তৃতা করার কতো সুযোগ পাবে। এ জন্যে কোনো রিকশাওয়ালার সুপারিশ দরকার হবে না।
বেলা সাড়ে বারোটায় ইউনিয়নের ২ জন লোক এসে রাগ করে, আপনারা এই বেলা গাড়ি চালাতে দিলেন কেন? বাসাবো, মুগদাপাড়া, খিলগাও, মালিবাগে কোনো রিকশা বেরোয়নি। গুলিস্তানে এসে দেখি চারদিকে রিকশা’
‘আরে ভাই, না ছাড়লে কি করি? আলাউদ্দিন মিয়া কৈফিয়ৎ দেয়, গরির মানুষ, অগো রোজগার করতে দিবেন না?
পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার পরা লোকটি তবু মানতে চায় না, না ঠিক করেননি। যাদের বিকালে রিকশা চালাবার কথা তারা হয়তো রাগ করে আসবে না। আবার যারা রিকশা চালিয়ে ফিরবে তারা টায়ার্ড হয়ে যাবে না। মিছিলে যাবে কি করে? বিশ্রাম নেবে না তারা? ১টা রিকশার চেসিসের সঙ্গে ফ্রকের যোগাযোগ স্কু-ড্রাইভার দিয়ে টাইট করতে করতে খিজির বলে, মিছিলে যাইবো তার আবার আরাম করতে হইবো ক্যালায়?’
সব মানুষেরই বিশ্রাম চাই ভাই রিকশাওয়ালাও মানুষ। মানুষ কথাটির ওপর জোর দিয়ে ইউনিয়নের নেতা রিকশাওয়ালাদের উন্নত পর্যায়ে ঠেলে তুলতে চায়। এই নিয়ে সে আরো কিছু ভালো ভালো কথা বলে, পুরু ঠোঁট ফাক করে খিজির সব শোনে। হাজার হলেও এরা লেখাপড়া জানা মানুষ,-ভদ্রলোকের ছেলে, আবার রিকশাওয়ালাদের জন্যে কতো কাজ করছে। এরা যা বোঝে তা খিজিরের মাথায় ঢুকবে কোথেকে?
বেলা দেড়টার দিকে রিকশাওয়ালারা সব রিকশা নিয়ে ফিরতে শুরু করে। উদ্বিগ্ন খিজির উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, আর একটা ঘণ্টা খাপ মাইরা আইলেই পারতি!
রিকশাওয়ালা চটে যায়, মাহাজনে ভাড়া লইবো পুরাটা, আর আমরা চালাইলেই দোষ?
আজাইরা প্যাচাল পাড়িস না! আউজকা ভাড়া লইবো ক্যাঠায়?’ ভাড়ার কথা কইয়া গাড়ি দিছে! মহাজনরে জিগা না। জিগ্যেস করার সুযোগ পাওয়া যায় না। ২টে বাজতে আলাউদ্দিন মিয়া এসে হস্তদন্ত হয়ে ভাড়া চেয়ে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে চ্যাচায়, ব্যাক গাড়ি আইছে? কেউরে বাড়ি যাইতে দিবি না। ঐ দোকানে ডালপুরি ভাঁজতে কইছি, বেশি কইরা ভাঁজবো খাইয়া মিছিলে চলো। মহল্লা থাইকা মানুষ কম হইলে বেইজ্জত হইতে হইবো!
রহমতউল্লার চায়ের দোকানে দারুণ ভিড়, ২জন লোক ডালপুরি ভাঁজতে ও পয়সা নিতে হিমসিম খাচ্ছে। আলাউদ্দিন মিয়া ঐ দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ইউনিয়নের নেতার সঙ্গে চা খায় আর একবার একে ধমকায়, একবার ওকে ধমকায়, এতোক্ষণ ধইরা খাইলে চলবো? যা না, মহল্লার মইদ্যে যতোগুলি গ্যারেজ আছে, একটা ঘূর্ণ দিয়ে আয়। ব্যাকটি ডেরাইভাররে লইয়া আইবি। ইউনিয়নের পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলারওয়ালাকে বলে, কি ভাই? কইছিলাম না? ডাক দিলে মানুষের অভাব হইবো না। দেরি দেইখা ঘাবড়ান, আমরা অতো জলদি ঘাবড়াই না। পলিটিক্স করি বিশ বচ্ছরের উপরে- আলাউদ্দিন মিয়া একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে, তার পরনে খন্দরের পাটভাঙা পাঞ্জাবি, ঘাড়ের ওপর ভাঁজ করা খন্দরের চাদর। ১টা মিটিং তার খুব দরকার।
মিটিং মিছিলের জন্য খিজির আলিও উদগ্রীব। রিকশা-মিছিলের জন্যে সে বেছে রেখেছে আলাউদ্দিন মিয়ার নতুন গাড়িটা। মাহুতটুলির ফকির মোহাম্মদ মিন্ত্রীর তৈরি,-দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। হুডের সঙ্গে লাগানো নানারকম ঝালর, হুডের সামনের দিকটায় পর্দার মতো গুটিয়ে রাখা গোলাপি রঙের পাতলা নাইলন। ২দিকে ঝুলছে প্লাস্টিকের লিচু ও আঙুরের গুচ্ছ। রিকশার পেছনে টিনের বোর্ড লাগানো। বোর্ডে আঁকা বহুবর্ণ ছবি। লাল-সবুজ পাহাড়ের উপত্যকায় নীল-হলুদ দোতলা প্রাসাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে লাল টকটকে মোটরগাড়ি। একটু দূরে পাহাড়ি নদী, নদীর ব্রিজের ওপর চলছে ট্রেন, ট্রেনের ওপরে উড়ন্ত এ্যাঁরোপ্লেন। নীল-হলুদ প্রাসাদের সামনে গিটার হাতে ত্রিভঙ্গমূর্তি যুবক, তাকে ঘিরে অপূর্ব ভঙ্গিতে নাচে কয়েকটা ডানাকাটা পরী। আহা, এই রিকশার প্যাডেলে পা ছোঁয়ালেই দুলদুল ঘোড়ার মতো উড়াল যা দেবে একখানা!—রাস্তার সমস্ত গাড়ি,–ট্রাক, বাস, বেবি ট্যাকসি, পেরাইভেট—সব ওভারটেক করে ছুটে যাবে সবচেয়ে আগে।
এইটা রাখ!’ আলাউদ্দিন মিয়া রিকশার হ্যাঁন্ডেলে হাত দিলো।
আমার নিজের হাতে রাখুম! কিছু হইবো না! দরকার নাই। গোলমালের টাইম। নয়া গাড়ি বাইর করনের কাম নাই।’ পুরানো ১টি রিকশা নিতে বলা হয় তাকে, ওটার বেল ঠিকমতো বাজে না। খিজির ক্ষুড্রাইভার দিয়ে বেলের ঢাকনি লাগাচ্ছে, বাইরে একটি উত্তেজিত সরব জটলা ক্রমে উচ্চকণ্ঠ হয়ে ওঠে। রহমতউল্লাহ মহাজনের গ্যারেজে আবার কি হলো?
নিজের গ্যারেজের দরজায় সমবেত রিকশাওয়ালা এবং ইউনিয়নের লোকজনের উদ্দেশে রহমতউল্লা ক্রমাগত হাত ও মুখ নাড়াচ্ছে, ‘মিটিং করো, মিছিল করো, নাচো, গাও—যা খুশি করবা। মগর আমার গাড়ি লইয়া ফুর্তি করবার দিমু না! আমি রিকশা করছি কি ঐগুলি লইয়া রোডের মইদ্যে ফুর্তি করনের লাইগা?
সব মাহাজনে দিতাছে, আপনে দিবেন না ক্যালায়? যাগো গরজ আছে তারা দিবো! আমার গরজ নাই!’ পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার এসে দাঁড়ায় তার সামনে, সবাই তো দিচ্ছে। আপনাকেও দিতে হবে।’
আপনার হুকুমে? মনে লয় ওয়ারেন্ট লইয়া আইছেন? – দিতে হইবো রিকশাওয়ালাদের গুনগুন পরিণত হয় গর্জনে, ‘গাড়ি দিতে হইবো!
‘একটা বেলা গাড়ি দিবার চায় না! মাহাজনে কতো খাইবো? আপনারা চুপ করেন। আমাকে বলতে দিন! পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার চিৎকার করে সবাইকে থামিয়ে রহমতউল্লার জন্যে গলাটা একটু নামায়, দ্যাখেন, এরা রোজ আপনার রিকশা চালায়। আপনাকে বোনাস দিতে হয় না, বেতন বাড়াবার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি বরং এদের কাছ থেকে পয়সা পান, নগদ পয়সা আপনার ইন্ডাস্ট্রি থাকলে হরতাল হতো, ছুটি চাইতো, বেতন বাড়াবার দাবী করতো। আমার রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা কোনো দাবী করে না। আজ, শুধু একবেলার জন্যে আপনার রিকশাগুলো চায়, প্যাসেঞ্জার নেবে না, পয়সা কামাবে না। আপনার দিতে আপত্তি কি?
রহমতউল্লা ভ্ৰ কুঁচকে তার দিকে তাকায়, ঐগুলি লেকচার পল্টন ময়দানে দিয়েন। আমার সাফ কথা, রিকশা ভাড়া দিয়া খাই, রিকশা লইয়া ফুর্তি আমি করবার দিমু না! গাড়ি লইলে ভাড়া দিতে হইবো। ইউনিয়নের আরেকজন এগিয়ে আসে, ঠিক আছে। আপনার রিকশা আপনি রেখে দিন। আমাদের কিছু করার নেই। আপনার রিকশা যারা চালায় তারাই যা করার করবে। আমাদের সঙ্গে কো-অপারেশন আপনি যখন করবেন না তখন আমরাও আপনাকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারবো না।’
আপনাগো কাছে আমি হেল্প চাইমু ক্যান? আরে, আমার মহল্লায় আইয়া আপনেরা হেল্প করবেন আমারে? রহমতউল্লা একবার পেছনে তাকাতে বজলু এসে হাজির হয় একেবারে সামনে। তার আশেপাশে কয়েকজন লোকও যে তার সঙ্গী তা বোঝা যাচ্ছে তাদের দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে।
রিকশা তো আমরাই চালাই। বজলুর রাত-জাগা গলা খনখন করে ওঠে, আমাগো মহল্লার মইদ্যে আইয়া গরম দ্যাহায় ক্যাঠা? রিকশা তো আমরা ভি চালাই। আমাগো মাহাজনেরে গরম দ্যাহায় ক্যাঠায়?
পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার বজলুর কথার তোড়ে একটু পিছিয়ে আসে, কি গরম দ্যাখালাম?
‘তো এইগুলি কি কইতাছেন? গাড়ি আপনারা জোর কইরা লইবেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আলাউদ্দিন মিয়া ধমক দেয়, বজলু থামলি?
তুই ফাল পাড়স ক্যালায়? রহমতউল্লাও বজলুকে থামতে বলে আলাউদ্দিন মিয়াকে উদ্দেশ করে অভিযোগ করে, তোমার মানুষজন কি আরম্ভ করছে? রিকশা কি জোর কইরা দখল করবো? ডাকাইত আইলে আমার মানষে ঠ্যাকাইবো না? ব্যাকটি কি নিমকহারাম হইয়া গেছে?
খিজির আলি জিভের কাপন আর ধরে রাখতে পারে না, ঐ সায়েবে বেইনসাফ কথাটা কইছে কি? মাহাজন, আপনের গাড়ি চাইয়া আমরা কি গুনা করছি?
লগে গাদ্দারি করস? তর গাদ্দারির মায়েরে বাপ! হাড্ডি হালায় চোপা মারে কতো? তর চোপারে টিকটিকি দিয়া চোদাই!’
বা হাতে প্লায়ার ও কু-ড্রাইভার এবং ডান হাতটি মুষ্টিবদ্ধ করে বজলুর দিকে এগিয়ে আসে খিজির, গুলিস্তান, মধুমিতা আর অভিসারের কাউন্টারের মইদ্যে তর মায়েরে চোদা পুলিশের লাঠি দিয়া। আয়, এই প্লাসখান দিয়া তর বিচি দুইখান ছেইচা পাঙখাবরফ বানাইয়া দেই। কিন্তু খিজিরের এই ঘোষণার সঙ্গে তার কাজের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য ঘটে না, বজলুর নিম্নাঙ্গ বাদ দিয়ে প্লায়ার দিয়ে সে আঘাত করে বসে বজলুর কপালে। আর বজলু করলো কি, খুব জোরে একটা ঘুষি লাগালো খিজিরের বুকে। তার লক্ষ্য ছিলো খিজিরের মুখ। কিন্তু খিজির বেশ লম্বা বলে বজলুর ঘুষি অতোদূর পৌঁছতেও পারে না। বজলুর ডান হাতের মধ্যময় ছুচলো লোহা আটকানো আংটি খিজিরের হাড্ডিসার বুকে লেগে ঠন করে আওয়াজ করে, তার সমস্ত শরীর নড়ে ওঠে দারুণভাবে। পরের ঘুষিটি লাগে তার কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে বজলুর সিনেমা হলের এক সহকর্মীর এক থাপ্পড় লাগে তার পিঠে এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। তবে হঠাৎ করে দেলোয়ারের হাতে বজলুকে মার খেতে দেখে খিজির সামলে নেয় এবং পেটের নিচে একটি ঘুষি খেতে সে তার প্রায়ার ও শকু-ড্রাইভার-ধরা হাত দিয়ে দারুণ জোরে আঘাত করে বজলুর ঘাড়ে। বজলু মাথা তুলতে না তুলতে খিজিরের ঐ হাত আছড়ে পড়ে ওর পিঠে ও কোমরে। বজলুর সঙ্গ। ২জন কিন্তু খিজিরের পেটে ও হাঁটুতে মেরেই চলেছে। তবে বজলুর পতনে তারা একটু দিশেহারা।
মারামারি চলছে, এদিকে মার হালার মাহাজানের দালালরে মার! চুতমারানিরে উপ্ত কইরা ফালাইয়া খানকির বাচ্চার হোগার মইদ্যে ইস্পোক হান্দাইয়া দে-প্রভৃতি সং ঘোষণা করতে করতে বেশ কিছু লোক ঢুকে পড়েছে রহমতউল্লার গ্যারেজের ভেতর। চল, চল, গাড়ি লইয়া বারাইয়া পড়’, ‘গাড়ি দিবো না কইলেই হইলো? এইসব কথা বলছে আর টানাটানি করছে রহমতউল্লার রিকশা নিয়ে। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে একেকটি গাড়ির পেছনে ৩/৪ জন লোক। শুরু হয় নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, কি মিয়া, তোমারে তো এই মাহাজনের গাড়ি চালাইতে দেহি নাই!’
আমি গাড়ি চালাই না তো কি করি? তুই ক্যাঠ্যায়? এই কথা বলায় অপরিচিত লোকটি ১ রিকশাওয়ালার ঘুষি খায়, তার পক্ষে আরেকজন জেনুইন রিকশাওয়ালা তেড়ে এলে মারামারি জমে ওঠে। এই অবস্থায় আসল হোক, নকল হোক-রিকশাওয়ালারা রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামে কি করে?
রহমতউল্লা প্রাণপণে চ্যাচায়, আরে আমার বজলুটারে মাইরা ফালাইলো রে! ধর না, আরে ধর না! তার আহবানে সাড়া দিয়ে কে ১জন বজলুকে-প্রহাররত কোনো রিকশাওয়ালার কোমরে লাথি মারে, সে পড়ে যায় খিজিরের পিঠে, খিজির পড়তে পড়তে টান দেয় বজলুর শার্টের কলার ধরে। শার্টের কলার ও পিঠ সম্পূর্ণ ছিঁড়ে গেলো। তার জামার নিচে গেঞ্জি নাই। সে যে এতোটা রোগা তা কিন্তু তার ১মাত্র খাকি শার্ট-ঢাকা অবস্থায় কখনো বোঝা যায়নি। তার পিঠের এপাশ-ওপাশে জুড়ে একটা কাটা দাগ, এ দাগটা পুরনো, কিন্তু নিচের রক্ত চিহ্নগুলো টাটকা। বজলু পড়ে গিয়ে মার খেয়েই ভেতর থেকে কে একজন এসে খিজিরের কোমরে কষে লাথি লাগালে সে নিচে পড়ে যায়। তখন তার ওপর ঘুষি পড়তে থাকে বৃষ্টির মতো।
গ্যারেজের ভেতরেও মারামারি। আলাউদ্দিন মিয়া আহত লোকটিকে টেনে বাইরে এনে হুঙ্কার ছাড়ে, শুওরের বাচ্চারা, থামলি? নিজের শরীরটা সে গলিয়ে দেয় ভিড়ের ভেতর এবং খিজিরের হাত ধরে বলে, ’ওঠ। গতরের মইদ্যে নাই এক ছটাক গোসতো, হাড্ডির উপরে আর কতো মাইর খাইবি? বজলুর সঙ্গী তখন সরে যায়, কিম্ভ কয়েকজন রিকশাওয়ালা তাকে ধরে দমাদম মারতে শুরু করে।
আমার মানুষগুলিরে কেমুন মারতাছে, তোমার নজরে পড়ে না। রহমতউল্লার অভিযোগেরে জবাবে আলাউদ্দিন মিয়া সমান উত্তেজনায় তাকে সতর্ক করে দেয়, ‘আপনের ভাড়াইটা গুণ্ডাগুলিরে সামলান। নইলে পাবলিকে আপনার গাড়িগুড়ি আমান রাখবো না কইলাম!’
আমার ভাড়াইটা মানুষ লাগে না। আমার বালা-মুসিবত দেখলে মহল্লার ব্যাকটি মানুষ বাপাইয়া পড়বো, বুঝলা?
কিন্তু বজলু ছাড়া রহমতউল্লার লোকজন সবাই দেখতে দেখতে কেটে পড়ে। রক্তাক্ত শরীরে চিৎপটাং শুয়ে রয়েছে বজলু, তার পাশে তার ১ সঙ্গী, সে-ও বোধ হয় অজ্ঞান, কিংবা অজ্ঞান হওয়ার ভাণ করছে। টলতে টলতে খিজির ঢুকে পড়েছে রহমতউল্লার গ্যারেজে, মেঝেতে রাখা রিকশার একটা সিটে ধপ করে বসে সে ঢালাও হুকুম ছাড়ে, গাড়ি লইয়া বারাইয়া পড়ো, মিটিঙের টাইম যায় গিয়া। সত্যি সত্যি রিকশাগুলো বেরিয়ে যেতে থাকে। আলাউদ্দিন মিয়া চোখ ছোটো করে তাকিয়ে থাকে রহমতউল্লার দিকে। সঙ্কুচিত চোখজোড়ায় তার আগুন জ্বলে বুই কাতলারা বলে হাসফাস করছে, আর কোথাকার কোন মহাজন এখন পর্যন্ত দাপট দ্যাখাতে সাহস পায় এখানে—তার ব্লাড প্রেসার হয়তো বেড়ে গেছে, কিংবা পরিস্থিতি প্রতিকূল—যে কোনো কারণে রহমতউল্লার জেদি মুখে পড়ে কালো ছায়া, সেই মুখ একদিকে যেমন অসহায় তেমনি বিরক্ত, সেখানে ঝাপশা হয়ে ফোটে সিতারার মুখ। আলাউদ্দিন মিয়া চোখ ফেরায় গ্যারেজের দিকে। আরে, মামুর গ্যারেজ তো সাফ হয়ে যাচ্ছে। তার চোখ যেমন জ্বলে উঠেছিলো, তেমনি নিভেও যায় দপ করে।
যারা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ লোক অপরিচিত। আর এই রিকশাওয়ালা জাতটাকে সে ভালোভাবে চেনে, এদের ওপর বিশ্বাস রাখা কঠিন। এরা আন্দোলনের কি বোঝে? রাজনীতির কি বোঝে? আইয়ুব খানের দালালের গ্যারেজ সাফ করে এদের মাথায় কি খেয়াল চাপে, কে জানে? এদের ছাড়া আন্দোলন হয় না, কিন্তু এদের হাতে আন্দোলন চলে গেলে মুশকিল। রহমতউল্লার গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে সব যাচ্ছে হাফিজ মিয়ার গ্যারেজের দিকে। পাতলা খান লেনের সবগুলো গ্যারেজের মালিকরা আলাউদ্দিন মিয়াদের দলের লোক। কিন্তু মুখগুলোর কি দলমত জ্ঞান কিছু আছে?—কি করা যায়?-ইউনিয়নের লোকজন শালারা কেটে পড়লো কোথায়? শালদের খালি লম্বা লম্বা পাঞ্জাবি আর আরো লম্বা কথাবার্তা। খালি চাপাবাজিা-স্টেজে উঠে মাইক সামনে পেলেই খালি মেহনতি মানুষ আর শোষণ আর বিপ্লবের ওপর বাখোয়াজি-এখন সব গেলো কোথায়?-অস্থির হয়ে আলাউদ্দিন মিয়া রাস্তার দিকে যাচ্ছে, এমন সময় চলে আসে ইউনিয়নের কয়েকজন লোক। সঙ্গে আলতাফ ও ইউনিভারসিটির ৫/৬ জন ছাত্র।
আলতাফ বলে, ‘খুব মারামারি করলেন। চলেন।
ছেলেরা খুব খুশি, দালালরা খুব টাইট হয়েছে, না?
আলাউদ্দিন মিয়া গম্ভীর হয়ে গেছে, ‘পাবলিকে বহুত রাউডি ব্যবহার করতাছে।
করুক না রিকশা দিতে দালালদের এতো আপত্তি কেন?
‘আরে মিয়া রাখেন।’ আলাউদ্দিন মিয়া রাগে ফেটে পড়ে, নীলখেতে বইয়া দাশ চালাইতে চান? নেতা হইয়া বইছেন জানেন এদিককার বেশির ভাগ রিকশার গ্যারেজের মালিক আমাগো মানুষ। কলুটোলার হাফিজ মিয়ার গ্যারেজে গিয়া তার পোলারে মাইর দিছে, খবর পাইছেন? এইগুলি সামলাইতে পারবেন?
রিকশাগুলো বড়ো রাস্তায় উঠে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোলাহল বেশ স্পষ্ট। কে যেন বলছে, কিয়ের মাহাজন? গাড়ি চালাই আমরা, একটা দিন গাড়ি লইয়া মিছিল করবার দিবো না?
চল না বে। দেহি চুতমারানি গাড়ি ফেরত পায় ক্যামনে, দেখুম!
ইউনিয়নের লোকজন, ছাত্রনেতৃবৃন্দ ও আলতাফের সঙ্গে আলাউদ্দিন মিয়া হাজির হয় বড়ো রাস্তার মোড়ে। যতোটা সম্ভব গম্ভীর ও যতোটা সম্ভব মিষ্টি গলা তৈরি করার অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করে সে, কি পাগলামো করস? মাহাজনরে কইয়া গাড়ি লইবি না?
আউজকা মহাজন নাই।
আরে পাগলা! মাহাজন ত থাকবোই। আলাউদ্দিন মিয়া প্রাণপন চেষ্টায় হাসে, তরা ভি মহাজন হইবার পারস একদিন তহন তগো গাড়ি না কইয়া বাইর করতে দিবি?
আলাউদ্দিন মিয়ার কথায় কাজ হয় না। রিকশা নিয়ে গ্যারেজে ফেরত যেতে কেউ রাজি নয়। রিকশা যারা পায়নি তারা রওয়ানা হয় অন্য কোনো গ্যারেজের দিকে। বোঝা যাচ্ছে, কুঞ্জবাবু লেনের আলম মেম্বারের গ্যারেজ এদের গন্তব্য। এখন আলাউদ্দিন মিয়া কি করতে পারে? ইউনিয়নের আরো লোক এসে জানায় যে শহরের অন্যান্য জায়গা থেকেও এরকম আসছে, গ্যারেজের মালিকরা রিকশা দিতে রাজি নয়।
আলাউদ্দিন মিয়া দোষ দেয় ইউনিয়নের লোকদের, এইগুলি প্রোগ্রাম করনের আগে আপনারা মাহাজনগো লগে আলাপ করবেন না?
ইউনিয়নের লোক চার্জ করে ছাত্রনেতাদের, কথা ছিলো বিকালবেলা হরতাল, রিকশা স্ট্রাইক, বায়তুল মোকাররমে সমাবেশের পর মিছিল। রিকশা নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম আপনাদের।
ছাত্রনেতা কৈফিয়ৎ দেয়, কেন, আমরা তো ইউনিয়নকে ইনফর্ম করেছি!
পরে করেছেন। ডিসিশন নিয়ে, কাগজে খবর পাঠিয়ে তারপর আমাদের জানিয়েছেন। এরকম করলে মুভমেন্ট চলে?
কুঞ্জুবাবু লেনের ওদিক থেকে স্লোগান শোনা যাচ্ছে, মাহাজনের গদিতে’-‘আগুন জ্বলো একসাথে’।
এসব শ্লোগান আলাউদ্দিন মিয়া কম শোনেনি। সে নিজেও অনেক মিটিঙে মিছিলে গেছে যেখানে এইসব স্লোগান দেওয়া হয়; এখন কিন্তু এই কথাগুলো বড়ো অস্বস্তিকর। সবাইকে হঠাৎ সে তাড়া দেয়, চলেন, চলেন। আলম মেম্বারের গ্যারেজের কিছু হইলে বহুত মুসিবত হইবো!’ আলম মেম্বারের চাঁদা ছাড়া এই মহল্লায় একটা মিটিং পর্যন্ত আয়োজন করা মুশকিল। এদিকে খোড়াতে খোড়াতে এসে পড়েছে খিজির। পাজামা-পাঞ্জাবিমাফলারওয়ালা নেতা তাকে অনুরোধ করে, ভাই তুমি গিয়ে ওদের ফিরিয়ে নিয়ে এসো।
আপনার মাথা খারাপ? আলাউদ্দিন মিয়া তাকে থামিয়ে দেয়, অরে দেখলে রিকশাআলারা আরো চেতবো। কইবো মাহাজনের গুণ্ডারা অরে মাইর দিছে, আমরা ভি মহাজনগো ছাড়ম না! মহাজনগো মইদ্যে ভি আমাগো মানুষ বহুত, জাহেলগুলি কি এইটা বুঝবো?
আলম মেম্বারের তালা-লাগানো গ্যারেজের বাশের দরশা ভেঙে কয়েকজন ততোক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ইউনিয়নের নেতার পিঠে হাতের চাপ দিয়ে আলাউদ্দিন মিয়া ফিসফিস করে, সামলাইতে পারবে? দরজা ভাঙা গ্যারেজের উল্টোদিকে একটি বাড়ির ঝুলন্ত সিমেন্টের পাদানীতে দাঁড়িয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, ভাইসব! আমাদের, আজ আমাদের যে আন্দোলন চলছে, আমাদের লুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার, মেহনতি মানুষের বাঁচার অধিকার ও আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলন নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের ভেতর অনুপ্রবেশকারী একদল হঠকারী লোক-।
প্যাচাল পাড়েন ক্যান? কামের কথা কন!’ হাঁটুতে আলাউদ্দিন মিয়ার খোঁচা খেয়ে
আপনারা মহাজনদের রিকশা ফেরত দিয়ে মিছিলে আসুন। মহাজনদের মধ্যে যারা দালাল তাদের আমরা সমুচিত শাস্তি দেওয়ায় ব্যবস্থা করবো।’
কিন্তু তার বক্তৃতায় কারো মনোযোগ নাই। গ্যারেজ থেকে রিকশার পর রিকশা বেরিয়ে আসছে। পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলারকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সিমেন্টে খুলও পাদানী দখল করে আলতাফ। এলোমোলো চুলের আলতাফকে লাল পুলওভারে চমৎকার মানিয়েছে। গড়গড় করে সে আওড়ায়, ভাইসব গত বাইশ বছর ধরে বাঙালির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্ৰ চলে আসছে। পশ্চিম পাকিস্তানের এই শোষণ আমরা অনেক সহ্য করেছি, আজ আমরা সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। বাঙালির স্বার্থরক্ষার দাবি জোরদার করে তোলার জন্যে আমাদের জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলার শিকার। তার ছয় দফা দাবি আদায়ের জন্যে আমাদের মরণপণ সংগ্রাম চলছে। কোনোরকম হঠকারিতার সুযোগ দিয়ে এই আন্দোলন যেন বানচাল না হয় সেজন্যে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শুধু ভাঙাচোরা আর জ্বালানো পোড়ানোর কথা বলে আমরা যেন বাঙালির মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি সেজন্যে
ছাত্রদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আলতাফের বক্তৃতার মাঝে মাঝে তারা স্লোগান দেয়, ছয় দফার সংগ্রাম—চলবেই চলবে। তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা। আরো ছাত্র আসে এবং এইসব স্লোগান গোট মহল্লা গমগম করে।
সিমেন্টের ঝুলন্ত পাদানী থেকে নেমে এসে আলতাফ সবাইকে আহবান জানায়, এখন এইসব গোলমাল ছেড়ে মিটিঙে চলেন। তাড়াতাড়ি চলেন।
আলাউদ্দিন মিয়া কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের কাছে গিয়ে বলে, ‘গাড়ি রাইখা যা? ছাত্রদেরও অভিন্ন মত, তাড়াতাড়ি চলেন ভাই। মানুষ যাবে হেঁটে আর আপনার যাবেন রিকশা চালিয়ে, এটা কেমন দাখাবে?
রিকশা কেউ ফেরত দেয় না। তবে রিকশা যারা পায়নি সেইসব রিকশাওয়ালা আর কোনো গ্যারেজে না গিয়ে রওয়ানা হয় সোজা বড়ো রাস্তার দিকে। খিজির আলির সঙ্গেও রিকশা নাই, হাটতে হাটতে সেটের পায় যে বজলু তার বা পায়ের হাঁটুটা বেশ ভালোরকম জখম করে দিয়েছে।
বায়তুল মোকাররমের সমাবেশের পরও আলতাফ কিন্তু তার কথা ভোলেনি। বেৰি ট্যাক্সি করে তাকে নিয়ে গিয়েছে মেডিক্যাল কলেজ। ছোকরা ডাক্তারদের অনেকে আলতাফকে চেনে, মানেও খুব। খিজিরের পায়ে, হাতে ও ঘাড়ে ব্যাণ্ডেজ করা হলো, ইঞ্জেকশন দিলো গোটা দুয়েক। এমনকি ফেরার সময় আলতাফ সায়েব তাকে একটা রিকশায় পর্যন্ত উঠিয়ে দিলো। বারবার বললো, তুমি অন্তত সপ্তাহখানেক বিশ্রাম নিও। আলাউদ্দিন ভাইকে আমি বলেছি, উনি ছুটি দেবেন।
আলাউদ্দিন মিয়া কিন্তু সত্যি তাকে কয়েকদিন কাজ করা থেকে অব্যাহতি দিলো, কয়টা দিন কাম করনের দরকার নাই। মামুর বস্তি থাইকা চইলা আয়। আমার গ্যারেজের মইদ্যে থাকবি। মামুরে যা চেতাইয়া রাখছস। আবার কেউরে দিয়া মামু তরে এমুন জখম করাইবে৷ কি এক্কেরে খতম হইয়া যাইবি।’