1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ০৯

চিলেকোঠার সেপাই – ০৯

নাজিমুদিন রোডের মাথায় পৌঁছে খিজির দ্যাখে তার স্কুটারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১টি তরুণ দম্পতি। মেয়েটির মুখে ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়েছে, একবার দেখেই চোখ নামিয়ে খিজির বেবি ট্যাকসির ভেতরে বসতে যাচ্ছে, পুরুষটি বললো, ইন্দিরা রোড যাবে?
‘না।‘
‘চলো’ পুরুষটি বেশ ডাঁটের। দামী পাজামা পাঞ্জাবির ওপর কারুকাজ করা ছাইরঙ শাল। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। এই চেহারার মানুষের হুকুম অমান্য করা কঠিন। মেয়েটার ধবধবে ফর্স গায়েও লাল শাল। মিহি ও আদুরে গলায় সে বলে, চলোনা ভাই।’ স্টার্ট দিতে গিয়েও খিজির থামে, একটু আগে ঐ ভাউরা শালা যে গেরস্থ ঘরের মেয়ের কথা বলছিলো সে কি দেখতে এরকম হতো? ‘চলেন।
মহিলার পর লোকটি উঠতে উঠতে বলে, মিটার ঠিক নেই?
আজকার দিনেও মিটার লাগবে? ঈদের দিন বেশি দিয়েন সাব।’
মিটার চালাও মিটারটা কি শো? লোকটির এই গম্ভীর আদেশ শুনে মহিলা মন্তব্য করে, ডেকোরেশন, অর্নামেণ্ট! এই ২টো ইংরেজি শব্দে স্বামী-স্ত্রী হেসেই গড়িয়ে পড়ে। সারা পথ জুড়ে এমনি হলো। লোকটি কি বলে আর মেয়েটি হাসতে হাসতে একেবারে কাত হয়ে পড়ে। আবার মেয়েটি কি বলে আর লোকটি হেসে লুটোপুটি খায়। ভদ্দরলোকেরা যে কতো ছুতোনাতায় হাসে। কিন্তু যতোই হাসুক আর যতোই কথা বলুক, তাদের এই হাসি ও কথা খিজিরের কানে ধ্বনির অতিরিক্ত কিছু তৈরি করতে পারে না। স্কুটারের পটপট আওয়াজ ও নরনারীর হাসিকথার মিলিত ধ্বনি ১টি অখণ্ড ধ্বনিপ্রবাহ হয়ে বেজে চলে খিজিরের একটানা ভাবনার পেছনে জুম্মনকে পাওয়া গেলে এখন গাড়িতে থাকতো সে-ই। গাড়িতে উঠিয়ে কয়েক গজ যাওয়ার পরই খিজির তাকে লজেন্স কি বিস্কিট কিনে দিতো। ভদ্রলোকদের ছেলেমেয়েরা আজকাল খুব কাঠি-লজেন্স খায়। জুম্মন একটা চুষতে চুষতেই গাড়ি ওদের বাড়ির সামনে চলে আসতো। বস্তির কাছে বেবি ট্যাকসি রেখে লাফিয়ে নামতো খিজির। কয়েক পা হেঁটে বস্তিতে ছুকেই হাঁকডাক শুরু করতো, জুম্মনের মাও, দেইখা যা, কারে ধইরা লইয়া আইছি, দ্যাখ্য’ জুম্মনের মায়ের জবাবটাও তার জানাই আছে, কোন মরারে লইয়া আইছ ককার দিবার লাইগা? এসব শুনেও খিজির একটুও রাগ করতো না। সে তো জুম্মনকে ভেতরে ঠেলে দিলেই এই কবর দেওয়ার কথা বলার জন্য জুম্মনের মায়ের খুব খারাপ লাগতো। খিজির দাঁড়িয়েই থাকতো, বৌয়ের প্রতিক্রিয়াটা সে দেখবে। জুম্মনের মায়ের চোখে পানি টলটল করে, সে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে-এরকমভাবে বৌকে সে কোনোদিন দ্যাখেনি। চোখে টলমল পানি নিয়ে ছেলেকে ধরে সে গড়িয়ে পড়তো স্বামীর বুকে, এ্যাঁরে তুমিকৈ পাইলা? ক্যামনে আনলা? খিজির চোখ ভরে সেই ছবি দেখতো। এই ছবি দেখতে দেখতে সে রাস্তা বেয়ে চলে। ইউনিভারসিটি এলাকায় লোকজন নাই। পাবলিক লাইব্রেরী পার হলো, ডানদিকে পাতলা কুয়াশা-টাঙানো রেসকোর্স। মাথায় ও চোখে অভিভূত জুম্মনের মা। —একবার আরোহী ভদ্রলোকের ধমকে সে পেছনে তাকায়, ‘সাইড দাও না কেন? হর্ন শুনতে পারো না? তারপর পাশে তরুণীকে বলে, ঈদের দিন বোতল টেনে চুর হয়ে আছে! মেয়েটি খিলখিল করে হাসে। ভদ্রলোকের বেঝিরা এতোও হাসতে পারে। পেছনের গাড়ির অসহিষ্ণু হন এবং আরোহীদের ধমক, ঠাট্টা ও হাসি, কিন্তু খিজিরের গতিশীল বেবি ট্যাকসির সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা ও কান্নায় ভেঙে-পড়া জুম্মনের মাকে একটুও টলাতে পারেনি। কিন্তু একটু সাইড পেয়ে সাদা জিপ তাদের ঠিক সামনে এসে ব্রেক কষতেই জুম্মনের মা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। হয়তো তার ছবি জিপের ওপরেও প্রতিফলিত হতো, তার আগেই শাদা জিপ থেকে লাফিয়ে নামে তিনজন যুবক। জায়গাটা ঠিক কোথায়?-আর্ট কলেজ পার হয়ে বা দিকে খালি জায়গা, এখানে বহু পুরনো একটা ঘর, ঘরের পাশে অনেকদিনের পরিচিত পচা ও মিষ্টি একটা গন্ধ, নিজের নাভিতে আঙুল ঘুরিয়ে আঙুল শুকলে খিজির এই গন্ধ পায়। সেই গন্ধ, দাঁড়িয়ে থাকা সাদা জিপ এবং নিয়নের তরল-সাদা আলোতে পাতলা কুয়াশা খিজিরকে সম্পূর্ণ চিত্রশূন্য করে ফেলে। একটি যুবকের পরনে ধূসর রঙের চাপা প্যান্ট ও কালো জ্যাকেট। হাতের রিভলভার সামনে তুলে শক্ত গলায় সে হুকুম দেয়, রাখো! ল্যাম্পোস্টের
ফাঁকে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে। সেই আলোতে রিভলভারওয়ালার মুখ বেশ স্পষ্ট তার ফর্স টিকলো নাকের নিচে এক জোড়া পাতলা মেয়েলি ঠোঁট। তার পেছনে আরো দুজন যুবক, এদের পরনে যথাক্রমে নেভি-রু প্যান্ট ও লাল পুলওভার এবং প্যান্ট ও কালো কোট। শেষ যুবকটির চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা এবং তাতে ড্যাগার। সে এসে দাঁড়ায় খিজিরের পেছনে, তরুণ আরোহীকে জিগ্যেস করে, এতো রাত্রে মেয়েছেলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
ইঞ্জিন থামা শালা শুওরের বাচ্চা কেটে পড়ার তালে আছে, না?–রিভলভারওয়ালার এই হুকুমে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ইঞ্জিনও কি তার বশ? কখন কিভাবে যে ইঞ্জিন বন্ধ হলো
সে কথায় আমল না দিয়ে আনোয়ার বলে, তাহলে ছয় দফাই তোমাদের ফাইনাল? ছয় দফা দিয়ে সাধারণ মানুষের লাভ কি হবে?
আলতাফ জবাব দেয়, আমাদের সমস্ত দুর্ভোগের কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। ছয় দফায় বাষ্ট্রীয় কাঠামো এমন করার ব্যবস্থা রয়েছে যাতে একটি অঞ্চল আরেকটি অঞ্চলকে শোষণ করতে না পারে। আমরা যা উপার্জন করবো খরচ করবো আমরাই। আমাদের টাকা পাচার হয়ে যেতে পারবে না। ট্যাক্স বসাতে পারবো আমরা। বাইরের দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবো আমরা। প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে বাঙালি ব্যবসা করেনি?’
বলতে বলতে আলতাফের গলা থেকে রাগ কিংবা বিরক্তি ঝরে পড়ে। সে খুব অভিভূত, আবেগে তার গলা জড়িয়ে আসে, বাঙালি এককালে জাভা, বালি, সুমাত্রায় যেতো মশলা কিনতে, নিজেরা কাপড় নিয়ে যেতো বিক্রি করতে। বাঙালি তাতীর তৈরি কাপড় ইউরোপে বেস্ট কোয়ালিটি কাপড় বলে দাম পেয়েছে। সেই দক্ষতা আমরা আবার দাখাবো। ওয়েস্ট পাকিস্তান আর্মির পেছনে বাঙালির রক্ত-পানি-করা টাকার অপচয় ঘটবে না। আমরা আলাদা আর্মির কথাও বলেছি।’
আনোয়ার বলে, ‘হ্যাঁ, বাঙালি আর্মির পেছনে পিপলের টাকা খরচ হবে, তাতে মানুষের লাভ কি?
সেটা নির্ভর করবে আমাদের ওপর। বাঙালি আমি আমাদের লোক, আমাদের মানুষের সেনাবাহিনী। আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের নির্যাতন করবে কেন?
শোষণ কি কেবল আঞ্চলিক? এখানে প্রধানত এবং প্রথমত তাই।
তাহলে কোটি কোটি বাঙালি যে হাজার হাজার বছর ধরে এক্সপ্লয়টেড হয়ে আসছে সে কার হাতে? দেশের ভেতরেই এক্সপ্লয়টার থাকে, বিদেশীর কোলাবোরেটার থাকে। গ্রামে গ্রামে থাকে। জমিতে থাকে, মিল ফ্যাক্টরি হলে সেখানেও থাকবে। ট্যাক্স বসাবার রাইট চাও? কে বসাবে?-কার ওপর?-এই দুই বাঙালি কি একই ধরনের? শোনো, যারা কাপড় বুনেছে, তারা বাইরে গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করেনি। তারা কাপড় পরতেও পারতো না ঠিকমতো। বাঙালি সেনাবাহিনী হলেই বাঙালির উদ্ধার হবে? বাঙালি আর্মি তখন চেপে বসবে বাঙালির ওপরেই, বাঙালি ছাড়া আর কার ওপর দাপট দ্যাখাবার ক্ষমতা হবে তার? পাঞ্জাবি সোলজারের উর্দু গালাগালি শুনতে খারাপ লাগে, বাঙালি কর্নেল সায়েব বাঙলা ভাষায় শুওরের বাচ্চা বললে কি তার পা জড়িয়ে ধরে বলবো, আ মরি বাঙলা ভাষা তোমরা ওয়েস্ট পাকিস্তানের হাত থেকে ইম্যানসিপেশনের কথা বলছো, কিন্তু কাঁদের জন্যে?
ইস্ট পাকিস্তানের পিপলের জন্য। না। ট্যাক্স বসাবার রাইট পিপল পায় না, পিপলের রাইট শুধু ট্যাক্স দেওয়ার। বাঙালির হাতে পাওয়ার চাও তো? মানে বাঙালিদের এক্সপ্লয়েট করার লাইসেন্স চাও?’
*ক্ষমতা মানেই শোষণ নয়। ক্ষমতা যদি তোমার লক্ষ্য না থাকে তবে এই সব আন্দোলন করার উদ্দেশ্য কি?
ড্যাগারধারী বলে, তাহলে তো আরো ভাল। ভাবীর সংগে একটু প্লেজার ট্রিপ মেরে আসবো। আপনি ওয়েট করেন, ম্যাটার অফ এ্যাঁন আওয়ার।’
এই শীতল বাক্য সুদর্শন আরোহীর কানে ঢুকেছে কি-না বোঝা গেলো না। নীলডাউন হওয়ার ভঙ্গিতে বসে সে হাত জোড় করে, আপনাদের পায়ে পড়ি ভাই। আমি একজন সেকশন অফিসার। বিশ্বাস করেন। ভাই শোনেন-।
আপনার ভাই আবার কে? পা ছেড়ে দিন বলছি। প্লীজ স্যর প্লীজ বি কাইন্ড এ্যাঁন্ড মার্সিফুল সার। আমি একজন সেকশন অফিসার সার, মিনিস্ট্রি অফ হোম, গভর্নমেন্ট অফ ইস্ট পাকিস্তান। আপনারা কাল সেক্রেটারিয়েটে আসেন, কালতো ছুটি, বুধবার আসেন, আমি গেটে পাস পাঠিয়ে দেবো, ডবল প্রোটেকটেড এরিয়ার গোলাপি রঙের পাস সার। আপনাদের কোনো সার্ভিসে আসতে পারলে স্যর-।
তার কথা শেষ হতে না হতে ছুরিধারী বলে, আপনি সেকশন অফিসার? আমি আপনার মিনিস্ট্রির জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর ২জনকে দেখিয়ে সে বলে, ঐ যে আপনার সেক্রেটারি, আর উনি আপনার চীফ সেক্রেটারি। নীলডাউন অবস্থাতেই সেকশন অফিসার ৩ জনের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ৩বার স্লামালেকুম স্যর’ বলে।
ড্যাগারধারী বলে, জাস্ট এ সেকশন অফিসার প্রমোশন পাওয়ার জন্যে বৌকে বসের বেডরুমে পাস করবি না? এখন থেকে প্রাকটিস কর!’ রিভলভারধারী তাদের আস্তে করে ধমক দেয়, মিসবিহেভ করো কেন? গো এ্যাঁহেড!’ তারপর সেকশন অফিসারকে আশ্বাস দেয়, নাথিং টু ওরি এ্যাঁবাউট। আমাদের ম্যাক্সিমাম এক ঘণ্টা। কুইক মেরে দেবো।
মেয়েটিকে পাজাকোলা করে তুলে ৩ জনের এই তরুণসমাজ উল্টোদিকের ফুটপাথে চলে যায়। ফুটপাথ ধরে একটু এগিয়ে রেসকোর্সের কাঠের রেলিঙ ডিঙিয়ে ফের সামনের দিকে হাটতে শুরু করে। কুয়াশায় তাদের আর দ্যাখা যায় না।
তরুণ আরোহীর সেই নীলডাউন অবস্থা তখনো কাটেনি। খিজির বলে, চলেন সার, থানায় যাই গিয়া। নীলখেত ফড়ি তো কাছেই।
লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। খিজির ফের বলে, চলেন, যাই। লোকটি তখন রাস্তায় ধপাস করে বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে কাঁদতে শুরু করলো। তার কানের কাছে মুখ রেখে যতোটা সম্ভব নরম করে খিজির বলে, চলেন যাই। অখনও টাইম আছে। থানায় চলেনা চলেন।
কান্নায় সাময়িক বিরতি দিয়ে লোকটি ফোপাতে ফোপাতে জবাব দেয়, এদের চেনো? এরা সব এনএসএফের গুণ্ডা। আইয়ুব খানের বাস্টার্ড মোনেম খান, মোনেম খানের বাস্টার্ড এরাt’
খিজির তাড়া দেয়, ‘লন যাই। ইউনিভারসিটির এতোগুলি হল এহানে পোলাপানেরে খবর দিই। চলেন সাব!’
লোকটির ফোপানে কণ্ঠস্বরফের গুমরে ওঠে, না। তা হয় না। আরো বিপদ হবে। ওরা এক ঘণ্টা ওয়েট করতে বললো না? এসে আমাকে না পেলে ফায়ার হয়ে যাবে চাকরি বাকরির কথা সব বলে ফেললাম, শুওরের বাচ্চারা আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে দেবে!’ লোকটি ফের হাতে মুখ গুঁজে ফোপায়, এরা ডেঙ্গারাস, মোস্ট পাওয়ারফুল! ফের নতুন উদ্যমে কাঁদবার প্রস্তুতি নিলে নিজের স্কুটারে ফিরে আসা ছাড়া খিজিরের কোনো কাজ থাকে না। তুমি আমাকে একা রেখে চলে যেও না ভাই! —লোকটির এই মিনতির জবাবে সে বলে, অরা আপনাগো গাড়ি কইরা পৌছাইয়া দিবো! ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে এক্সিলেটর থেকে হাত উঠিয়ে খিজির ফের রাস্তায় নামে, সায়েব, ভাড়াটা?
ভাড়া? তরুণ রাজকর্মচারী হাত থেকে মুখ তুলে অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকায়। মিটার দেইখা ভাড়াটা দিয়া ফালান? প্রচণ্ডরকম বিস্ময় ও মর্মাঘাতে লোকটির মুখের খুচরা-খাচরা পার্টস ওলট-পালট হওয়ার উপক্রম ঘটে। পকেট থেকে টাকা বের করে ভিজে গলায় সে বলে, তোমরা মানুষ না! মানুষ হলে এ সময় কেউ– ‘
স্কুটার রাস্তায় গড়িয়ে দিলে খিজির তার উক্তিকে স্বীকার করে চিৎকার করে, না। আমরা কুত্তার বাচ্চা, মানুষ হইলেন আপনেরা!

খিজিরকে দেখে আলাউদ্দিন মিয়া বলে, কৈ গেছিলি তুই? আপারে ফোন করছি নয়টার সময়। কয় ওরে তো ছাইরা দিছি বহুত আগে। পাসিঞ্জার লইয়া যাইবি তো আমারে কইলি না ক্যান? গ্যারেজ বন্ধ কইরা আমার বাসা হইয়া যাইস! কাম আছে!’ আলাউদ্দিন মিয়ার বাড়ি থেকে বেরোবার সময় পেছন থেকে ডাক শুনলো খিজির, কি মিয়া, ঈদের দিন খুব খ্যাপ মারতাছেন? বহুত কামাইলেন, না? রাস্তার ওপার থেকে ডাকছে কামরুদিন। রাস্তা ক্রস করে সামনে এসে কামরুদিন বলে, কৈ গেছিলেন? এর আগে সে খিজিরকে ‘তুমি’ এবং রেগে গেলে ‘তুই’ বলতো, ওর বৌকে বিয়ে করার পর তাকে মর্যাদা দিতে শুরু করেছে। বলে, ‘জুম্মনেরে রাইখা গেলাম। মাহাজনে একটা ছ্যামরারে পাঠাইছিলো, মাহাজনে আমারে আইতে কইছিলো।’
কৈ পাঠাইছিলো? আপনে থাকেন কৈ?
‘আমি তো মালীবাগ থাকি। জুম্মন থাকে আর ফুফুর সাথে, নিমতলীর লগে। তে মাহাজনে কয় জুম্মনের মায়ে পোলার লাইগা বলে ভাত পানি ছাড়ছে। অর মায়ে কয়দিন আরে রাখতে চায়। আমি কই থাউক। আমি হালায় কৈ যাই, কৈ থাকি! কোন জাগায় কহন কাম পড়ে, থাউক কয়টা দিন!’ বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর বিশেষ ব্যবহারে সিগ্রেটের গোড়া ছুড়ে ফেলে সে আরেকটা সিগ্রেট ধরায়, খিজিরের দিকে কিংস্টর্কের প্যাকেট এগিয়ে ধরে। সিগ্রেট কষে একটা টান দিয়ে বলে, আমার বইন তো ছাড়তে চায় না, পোলায় আবার ফুফুর কাছে থাকবার চায় না! কি মুসিবতে পড়ছি আমি!’
খিজির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জুম্মনকে তো নিয়ে আসার কথা তার। দ্যাখো, ঐ বস্তিতেই জুম্মন থাকে, অথচ সে কি-না মিছেমিছি ঘুরে মরলো। আর এই সুযোগে ছেলের জন্যে ওর বৌয়ের সত্যিকার ও বানানো কান্নাকাটি সব দখল করে নিলো শালার মহাজন।
কিন্তু এই নিয়ে দিওয়ানা হবার সময় কি আর খিজির আলির হবে? তাকে যেতে হয় আলাউদিনের ঘরে। আলাউদ্দিন মিয়া জানায় যে, ওসমানকে একটু খবর দেওয়া দরকার, কাল ভোরবেলাতেই ওসমান যেন আলাউদ্দিনের সঙ্গে দ্যাখা করে। পরশু মহল্লায় জনসভা, কয়েকজন বড়ো নেতা আসবে, সব আয়োজন করতে হবে আলাউদ্দিন মিয়াকে। তার বক্তৃতা ঠিক করার জন্য ওসমানকে চাই। খিজির ভাবে, ওসমান এসব ব্যাপারে এগিয়ে এলেই তো পারে। লোকটা মিছিলে যায়, মিটিং শোনে, শ্লোগান দেয়,—আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে কাজ করতে তার আপত্তি হবে কেন? এসব লোককে সঙ্গে পেলে আলাউদ্দিন মিয়া এই শালা রহমতউল্লাকে চিরকালের জন্য ধসিয়ে দিতে পারে।

সিঁড়ির সবচেয়ে উঁচু ধাপে একুট আগুনের বিন্দু দেখে খিজির চমকে ওঠে, কে?
কে? ভয় পেয়ে দুজনেই পরস্পরের পরিচয় জানতে চায় তারপর খিজির বলে, সিঁড়ির উপরে একলা বইয়া রইছেন?
ওসমান উঠে দাঁড়ায়, সিগ্রেটের শেষ অংশ ফেলে দিয়ে বলে, তুমি এতো রাত্রে?
‘লন, ঘরে চলেন। কথা আছে। আলাউদ্দিন মিয়া পঠাইয়া দিলো।
হঠাৎ?
‘সায়েব নিজে আপনার কাছে আইছিলো, আপনে ঘরে আছিলেন না। কাউলকা ভোরে থাইকেন, সায়েবে আইবো।’
কি ব্যাপার?
‘মহল্লার মইদ্যে জনসভা হইবো। মিটিং লইয়া আপনার সাথে বাতচিত করবো।
আচ্ছা।
‘তে আপনে ঘরে যাইবেন না? চলেন, ঘরে গিয়া বহি।
ওসমান একটা সিগ্রেট ধরায়, সিগ্রেটে টান দিয়ে বলে, একটু মুশকিল হয়েছে।
কি?
রঞ্জকে চাবি দিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা ছাদে ছবি তুলছিলো। তা এখন বোধ হয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চাবিটা না পেলে—।
‘তামামটা রাইত আপনে সিঁড়ির উপরে বইয়া থাকবেন?
না, না, ওসমান একটু হাসে, ভাবছিলাম একটু ওয়েট করে দেখি। এর মধ্যে ওরা জেগেও উঠতে পারে। নইলে ওয়ারিতে এক বন্ধুর বাড়িতে যাবো।
রাখেন। আপনে কেমুন মানুষ? ওসমানের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিয়ে খিজির বলে, নিজের ঘরের চাবি পরের কাছে রাইখা সিঁড়ির উপরে বইয়া থাকেন। লন, রঞ্জুর ডাইকা ड्रलि।’
না, না থাক!
কিন্তু খিজির দূর!’ বলে নিচে নামতে শুরু করলে তাকে অনুসরণ করতে হয়। খিজির যাতে রঞ্জুদের দরজায় জোরে কড়া নাড়তে না পারে ওসমান সেজন্য আগে ভাগে দরজায় আস্তে করে দুটো টোকা দেয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চাবি হাতে বেরিয়ে আসে রানু। ওসমান একটু নুয়ে বলে, তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
রানু বলে, না। আমি তো ঘুমাই নাই।
রঞ্জু?
রঞ্জ ঘুমাইছে কখন সাড়ে নয়টা দশটার দিকে। খিজির বলে, ‘হায় হায়! আপনে জাগনা? আর এই সাবে সিঁড়ির উপর বইয়া দুই হাতে মশা থাবড়ায়!
খিজিরের কথায় ওসমান বিব্রত হয়, তাড়াতাড়ি বলে, ‘তুমি এতো রাত্রি পর্যন্ত জেগে আছো? ক্লান্ত চোখে রানু স্নান হাসে, চাবি আমার কাছে, কখন আসেন ঠিক নাই। ঘুমাই কিভাবে?
খিজির হাসে, ওসমানের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার চাবি পাহারা দিতাছে। চাবি রাইখা যাইতেন ইনার কাছে, তা না, আপনে রাখছেন রঞ্জুর কাছে।
ঘরে ঢুকে খিজির মেঝেতে বসে পড়ে। বলে, ‘আউজকা একটা কারবার হইছে, বুঝলেন? রেসকোর্সের কাছে– ‘
ওসমান বাধা দেয়, খিজির অনেক রাত্রি হয়েছে। ঘরে যাও, তোমার বৌ চিন্তা করবে।’ নাঃ তার জন্য চিন্তা করবে কে? জুম্মনের মা আজ জুম্মনকে কাছে পেয়েছে, ঐটুকু বিছানায় মায়েপোলায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, তার জন্য জায়গা কোথায়। ঐ পোংটা পিচ্চিটা আজ খিজিরের জায়গা জুড়ে শুয়ে আছে। জুম্মনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারলে হাতটা আরাম পায়। তাই কি সে পারবে? ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে পড়তে পড়তে খিজির বলে, ‘না, একটা রাইত তো, আপনের ঘরে থাকুম’
‘বিছানা কোথায়?’ ‘লাগবো না। ওসমান তবু জোর করে একটা চাদর দেয়। রেসকোর্সের ঘটনা বলার আগেই খিজিরের নাক ডাকতে থাকে। ঘুমের মধ্যে মেঝের হিমে সে এপাশ ওপাশ করে। মনে হয় মস্ত বড়ো ঠাণ্ডা হাত দিয়ে কে যেন তাকে ঝাপশা ১টি মাঠের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *