চিলেকোঠার সেপাই – ৩৪
হাতের ফাক দিয়ে রানু বেরিয়ে গেলে মনে হয় খুব শীতের মধ্যে তার হাতের গ্লাভস খুলে গেলো। হাতদুটো বড়ো ঠাণ্ডা। হাতে হাত ঘষে শীত কাটাবার চেষ্টা করলে সারা শরীর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা হয়। কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় শুয়ে ওসমান লেপ টেনে নেয় গায়ে। লেপের কল্যাণে শরীরের তাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে, রানুকে ওসমান আর কোনোদিন এভাবে কাদতে কাদতে ফিরে যেতে দেবে না। এই কয়েক মিনিট আগে ওসমান ওকে ১টা ২টো কেন, অনায়েসে ১০০/১৫০ চুমু খেতে পারতো। এতো দ্বিধা করার কোনো মানে হয়? দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে যে কি-না আইয়ুব খানকে পুড়িয়ে মারার অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে, তার এতো দ্বিধা রানুকে চুমু খেতে?-ওসমানের শরীরে রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে ওঠে। দূর। চুমু খেতে খেতেই তাকে নিয়ে দিব্যি শুয়ে পড়তো এই সরু তক্তপোষে। না, এমন কিছু সরু নয়, দুজনে দিব্যি শোয়া যায়। বিকালবেলা ওর ঘরে আসবে কে? সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো বেগুনি ঠোঁটে কয়েকটা গাঢ় চুমু পড়লে রানুর সমস্ত শরীর একেবারে এলিয়ে পড়বে ওসমানের ওপর। তারপর তাকে জড়িয়ে শ্যামবর্ণের নোনতা ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে ‘রানু! আমার রানু! বলে ফিসফিস করে ডাকলে মেয়েটির সমস্ত শরীর সাড়া দিয়ে উঠবে। এই মুহুর্তে রানুর অশ্রু, ঘাম, রক্ত, মাংস, হাড় ও মজ্জায় ওসমান নিজেকে তীব্রভাবে অনুভব করছে। রানুকে চোখের সামনে একে নিতে নিতে ওসমান লুঙির গেরো খুলে ফেললো। রানুর বুকে মুখ গুঁজে দেওয়ার জন্য বালিশটা উল্টিয়ে ঠেকিয়ে রাখলো নিজের গালের সঙ্গে। কাত হয়ে শুয়ে ওসমান বাম হাতটি রাখলো নিজের উরুসন্ধিতে। রানুর সঙ্গে একাকার হওয়ার সমস্ত উত্তেজনা সংহত হয়েছে ওখানেই। ওসমানের হাতে এখন তার ফেপে-ওঠা শিশ্ন; এই পাপের ভেতর দিয়ে সে ঢুকে পড়বে রানুর একান্ত ভেতরে। অন্য হাতে জড়িয়ে ধরবে তার পিঠ, বালিশটা যেভাবে আঁকড়ে ধরলে ঠিক সেইভাবে। রানুর ঠোঁটে ও গালে প্রবলভাবে চুমু খাওয়া সে অব্যাহত রেখেছে। বঁ হাতে নিজের যৌনাঙ্গ ঝাকাচ্ছে এইতো, এই পেরেক দিয়ে রানুকে গেঁথে নেবে নিজের সঙ্গে। এদিকে রানুর বুকে হাত দিতে গিয়ে দ্যাখে, সেখানে খয়েরি সুতার এন্ত্রয়ডারি করা প্যাগোডা আঁকা হাওয়াই শার্টের পকেট। তাইতো, রানুর ঠোঁট পরিণত হয়েছে রঞ্জুর ঠোঁটে। রন্ধুকেই সে অবিরাম চুমু খেয়ে চলেছে। এটা হল কি করে? রঞ্জকে নিয়ে সে করবেটা কি? তার চাই রানুকে। শীতের ময়লা বিকালে চোখ ভরা পানি নিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে গেলো তার ঘর থেকে নিজের তীব্র রক্তসোতের ঘন নির্যাস রানুকে সমর্পণ করে ওসমান তার চোখের পানি পুষিয়ে দেবে। কিন্তু একি বিপর্যয়? মাঝখানে কোথেকে এসে ঝামেলা বাধায় রঞ্জু। তাকে ঠেকানো খুব শক্ত। রঞ্জুর গালে কষে একটা চড় দিলে হয়। কিন্তু তার বদলে সে কি-না ওর গালে অবিরাম চুমু খেয়ে চলেছে। রানুকে রঞ্জ সম্পূর্ণ হটিয়ে দিয়েছে, রানুর চিহ্নমাত্র দ্যাখা যাচ্ছে না। ওসমান এখন কি করবে? রঞ্জকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে ওসমান ওকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে সে বালিশের একটা কোণ খুব জোরে খামচে ধরে। কিন্তু নারীকষ্ঠের তীক্ষ আর্তনাদে তার হাত শিথিল হয়ে আসে, আমার রঞ্জুরে মেরি ফেললে গো’ এ তো তার মায়ের গলা। -আম্মার ভুল উদ্বেগে ওসমানের হাসি পায়, আম্মা যে কাকে কি ভাবে? —ওর জন্যে মাগুর মাছের ঝোল রাধলাম, জ্বর থেকে উঠি আজ পথ্যি করবে, ছেলেটা আমার এক লোকমা ভাত মুখে দিতি পারলে না গোr—তাইতো! ওসমান বড়ো বিচলিত হয়। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ওসমান দেখতে পায়, যাকে সে এতোক্ষণ চুমু খেয়ে চলেছে এবং রানুর পুনর্বাসনের জন্য যার গলা টিপে ধরেছে সে বোধহয় রন্ধু নয়, মানে রানুর ভাই রঙ্গু নয়।-তবে সে কে?—এতো সব ঝামেলার মধ্যেও ওসমানের বাম হাতের তৎপরতা কিন্তু একটুও থামেনি। হাতের ভেতর তীব্র ও দ্রুত স্পন্দন বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে তার লুঙি ভিজে যায় এবং হাত ও উরু চটচট করে। এতো দূর থেকে অন্য ১টি রাষ্ট্র থেকে তার মা এরকম বিলাপ করে কেন?-লুঙি গুছিয়ে পরতে পরতে ওসমান হাপায়। বুকে তার প্রবলরকম ওঠানামা চলে, ভয় হয় হার্টে আবার নতুন কোনো উপসর্গ দ্যাখা গেলো না তো? অনেক হার্টের রোগী আছে একটুখানি পরিশ্রমে হাসফাস করে। অনেকে বাথরুমে গিয়ে গুমুতের সঙ্গে প্রাণটিও ত্যাগ করে বসে। যৌন সঙ্গম করার সময়ও মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এইভাবে কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুর কারণ তার যৌনসঙ্গী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। আর এই একা, কেবল নিজের হাত সম্বল করে যৌন কামনা মেটাতে গিয়ে ওসমান যদি মরে যায়, তাহলে? এভাবে মারা গেলে তার মৃত্যুর কারণ ভয়াবহভাবে অজ্ঞাত রয়ে যাবে।-এই ভাবনা ওসমানকে নিস্তেজ করে ফেলে, স্তিমিত রক্তপ্রবাহে টিপটিপ আওয়াজ ক্রমে ঝাপশা হয়ে আসে। নিশ্বাস আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলে সে টলে পড়ে তন্দ্রায়। নিশ্বাসে নিশ্বাসে তন্দ্র থেকে ঘুমের ভেতর গড়াতে গড়াতে ওসমান দ্যাখে যে রঞ্জুর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে তার তক্তপোষ জুড়ে। রঞ্জুর গলায় ওসমানের আঙুলের দাগ নীল হয়ে বসেছে। তবে কি স্বপ্নে কি জাগরণে, হত্যাকারীর যে ভয় পাবার কথা, তা কিন্তু তার হয় না। সে বরং তারিয়ে তারিয়ে লাশটা দ্যাখে। তার দৃষ্টির ঘষায় রঞ্জুর গলার আঙুলের নীল মুছে যায় এবং এমনকি তার বয়সও বাড়তে থাকে। বয়সের সঙ্গে পাল্টায় চেহারা, শরীরের গড়ন। সেটা পরিণত হয় ওসমানের লাশে। একটুও চমকে না উঠে কিংবা দুঃখিত না হয়ে, এমনকি অবাক না হয়ে তক্তপোষে খুঁকে নিজের লাশে ওসমান বুলেট খুঁজতে থাকে। মিছিলে গুলি হলো, বুলেটটা শরীরের কোথায় লাগলো, এর মধ্যেই কি সে বেমালুম ভুলে গেলো? বুলেট না হোক, বুলেটের দাগ তো পাওয়া যাবে। ময়লা চাদর তুলে তন্ন তন্ন করে ওসমান গনি নিজের মৃতদেহে বুলেটের দাগ খোজে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে ওসমান মন খারাপ করে, আরেকটু সময় পেলে বুলেটটা সে ঠিকই বার করতে পারতো। তার ভাগ্যটা বরাবরই এমন, স্বপ্নে পরম কাম্য কিছু হাতের মুঠোয় আসার ঠিক আগের মুহুর্তে তার ঘুম ভেঙে যায়।
মশারি টাঙন নাই? কহন ঘুমাইলেন? ঘরে চোকে খিজির, মিটিঙে ভি গেলেন না। আমি বহুত বিচরাইলাম!’
বিছানায় বসে ওসমান সিগ্রেট ধরায়, পাকিস্তান মাঠে মিটিং কেমন হলো? মিটিং আরম্ভ হইলো মাগরের বাদ, আগে খালি গ্যাঞ্জাম, খালি হাউকাউ।
কেন? ‘মহল্লার সর্দাররে দেইখা পাবলিকে চেইতা গেছে। জিগায়, আরে আইতে কইলো काठाम्न ?’
আলতাফ কিন্তু আগেই এরকম সম্ভাবনা আঁচ করেছিলো। আলতাফদের দলের ১টি ছেলেকে নিয়ে ঐ সর্দার সায়েব কয়েকদিন আগে আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে দ্যাখা করতে আসে। ছেলেটি তার ভাইপো, লতিফ সর্দার আবার রহমতউল্লার কিরকম আত্মীয়।
আলাউদ্দিন মিয়ার অফিসে বসে সে ছোটোখাটো ১টা বস্তৃতা ছাড়ে। লোকটার বয়স ৭০-এর কাছাকছি, এর বেশির ভাগ সময় কেটেছে নবাববাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। হঠাৎ করে সে উপলব্ধি করেছে যে পাকিস্তান সরকার হলো ১ নম্বর গণবিরোধী শক্তি। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানের উদ্যোগে পাকিস্তানের পয়দা, বাঙলার মুসলমান ছিলো কায়েদে আজমের ১ নম্বর বাছ। অথচ, পূর্ব পাকিস্তানের ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা আজ চাকরি পায় না, পেলেও প্রমোশন হয় না, প্রমোশন পেলেও তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নাই। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের আর লাইসেন্স জোটে না, সব দখল করে নেয় পাঞ্জাবি হার্মাদরা। পাকিস্তান সরকারের এই শোষণমূলক নীতির প্রতিবাদে লতিফ সর্দার সায়েব মৌলিক গণতন্ত্রীর পদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে এসে শামিল হবে বিরোধী দলের আন্দোলনে। গণবিরোধী সরকারকে উৎখাত করার জন্যে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সে প্রস্তুত। এমনকি জনসেবার জন্যে সরকার তাকে তমঘায়ে খিদমত খেতাব দিয়েছিলো, গভর্নর হাউসের অনুষ্ঠানে মোনেম খান নিজে তাকে মেডেল পরিয়ে দেয়, সেই খেতাব সে প্রত্যাখ্যান করবে এবং মেডেল বেচে টাকাটা দান করবে আন্দোলনের তহবিলে। তার এতোসব সংকল্পের কথা শুনেও কিন্তু আলতাফের মন টলেনি। আলাউদ্দিন মিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর পরই আলতাফ ওর অবিশ্বাস ও অসন্তোষ দেখিয়েছিলো, লোকটা টাফ রি-এ্যাঁকশনারি। নবাববাড়ির বুটলিকার, মুসলিম লীগের মধ্যেও মুসলিম লীগার এখন হাওয়া বুঝে এদিকে আসতে চাইছে। এদের নেওয়া মানে পার্টির ইমেজ নষ্ট করা, এরা পার্টির লায়াবিলিটি হবে।’ আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য আলতাফের সঙ্গে একমত হয়নি, ধরেন, বেসিক ডেমোক্র্যাট খসাইতে পারলে গওর্মেন্টের একটা ইটা খইসা পড়ে, আইয়ুব খানেরে একটু জখম করতে পারেন। আরো দশটা বিডি উনারে ফলো করতে পারে, অন্তত ডরাইয়া যাইবো তো! কিছুক্ষণ তর্ক করে আলতাফ বেরিয়ে ওসমানকে বলে, নিজের মহল্লায় লোকটা খুব আনপপুলার। ওখানে আমাদের পার্টি অফিসে সুবিধা করতে না পেরে এসেছে এখানে। আগেই খবর পেয়েছি, ইকবাল হলের সঙ্গেও লাইন করার চেষ্টা করছে। এখন এই লোককে আমাদের সঙ্গে দেখে ওদের মহল্লার লোক এ্যাডভার্সলি রি-এ্যাঁক্ট করতে পারে। এখন খিজিরের কাছে একই ধরনের রিপোর্ট পেয়ে ওসমান জিগ্যেস করে, পাবলিক চটে গিয়েছিলো?
‘পাবলিকে কয়, সর্দার হালায় দশটা বচ্ছর মহল্লাটারে জ্বালায়া খাইছে। এ্যাঁর দোকান দখল করে, অর দোকান উঠাইয়া নিজের বাইরে বহায়। একটা ইস্কুলের নামে সরকার জায়গা দিছিলো, সর্দার নিজে ঐ ইস্কুলের কমিটির পেসিডেন। ইস্কুল বাদ দিয়া ঐ জায়গার মইদ্যে মার্কেট বানাইয়া দিছে! পোলার নামে, বিবির নামে, ভাই ভাইসতার নামে মহল্লার ব্যাকটি র্যাশন দোকান রাইখা দিছে। আবার দোকানের মাল দিবো না, নিজের বাড়ির মইদ্যে মাল রাখে, কাস্টমারে গেলে কয়েলে কয়, মাল নাইক্কা। চিনি, গম, চাইল, তাল ব্যাকটি বেলাকে বেচে – পাবলিক এইগুলি লইয়া মিটিঙের মইধ্যে হাউকাউ করলো-
আলতাফ কি বললো? ‘আলতাফ সাব যায় নাই। আমাগো আলাউদ্দিন সাব ভাষণ দিয়া বহুত কোশেশ করলো, মগর পাবলিকে শোনে না, কয়, লতিফ সর্দাররে বাইর কইরা না দিলে আমরা মিটিং ভাইঙা দিমু!
‘তারপর?
আমাগো সাবে বুদ্ধি কইরা ইউনিভারসিটির মইদ্যে খবর পাঠাইলো, ছাত্র লিডাররা আইয়া মাইক লইলো। অরা ধরেন ল্যাখাপড়া করা মানুষ, প্যাটের মইদ্যে এলেম আছে। কয়, সর্দার সাবে নিজের ভুল বুইঝা আমাগো লগে আইছে, উনারে দেইখা আরো বহুত মানুষ আইবো। কয়দিন গেলে আইয়ুব খানে মালুম পাইবো কি তার লগে আর কেউ নাই, তখন গদি ছাইড়া না দিয়া উই করবো কি? ঠিক কইছে না? ওসমান কোনো মতামত না দিলে খিজির দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে বিড়ি ধরায়। এরপরও ওসমান তার অপরিচিত ছাত্রনেতার বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না দেখে খিজির উসখুস করে। বিড়িতে লম্বা লম্বা টান দিয়ে বলে, মগর আমাগো মহল্লার মাহাজনে জিন্দেগিতে ঠিক হইবো না। আর কপালের মইদ্যে আল্লায় কি লেখছে আল্লাই জানে।
‘কেন? উনিও হয়তো ভুল বুঝতে পেরে—।’ নাঃ মাহাজনে মানুষের পয়দা না। দ্যাহেন না, আমি অর ঘর ছাড়লাম, আমাগো সাবের গ্যারেজ ভি ছাড়লাম, অহন তরি আমার লগে কি করতাছে জুম্মনরে দিয়া মায়ে ঐদিন খবর পাঠাইলো—।
জুম্মন? জুম্মনের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে? থাকবো না ক্যালায়? ওসমানকে অবাক হতে দেখে খিজির আরো অবাক হয়, ‘ডেলি ডেলি আমার কাছে আহে। জুম্মনে কয়, মায়ে যাইতে কইছে। কিজানি হইছে। তয় আমি গেছি পরে আর মায়ে কান্দে।
‘কাঁদে? তোমাকে দেখে কাঁদে ?
হ। কাব্দে আর কয় মাহাজনে কামরুদিন ওস্তাগররে ফুসলাইয়া অরে হাসপাতাল পাঠাইবার চায়! উই তো যাইবো না, মহাজনে কইছে ঠিক আছে, দাওয়াই বহুত আছে, এমুন দাওয়াই দিমু, মাগী মালুম ভি করবার পারবে না, প্যাটপুট খইসা এক্কেরে সাফ হইয়া যাইবো।’
তোমার বাচ্চার জন্যে জুম্মনের মায়ের অতোই টান তো তোমার সঙ্গে বেরিয়ে আসে না কেন?’
এবার খিজির দমে যায়। বিড়িতে ফের কয়েকটা টান দিয়ে বলে, জুম্মনরে মানুষ করবার চায়। বড়োলোকের বাড়ি কাম কইরা অর নজরখান হইছে বড়ো। খালি এক প্যাচাল পাড়ে, ল্যাহাপড়া শিখাইয়া জুম্মনরে বেবি ট্যাকসির মাহাজন বানাইবো!
তোমার সঙ্গে থাকলে জুম্মন মানুষ হবে না? এ ব্যাপারে খিজিরের সন্দেহ আছে! আমি একটা ভ্যাদাইমা মানুষ। কহন কৈ থাকি ঠিক নাই। পরের পোলারে হুদাহুদি লইয়া—। বিড়ির ধোঁয়ায় হঠাৎ তার বেদম কাশি আসে, কাশতে কাশতে উঠে ছাদে গিয়ে কফ ফেলে। ওসমান মশারি টাঙায়, খিজিরের ওপর তার রাগ হয়, লোকটা একেবারে অপদার্থ। রানু একদিন ঠিকই বলেছিলো, সাহস থাকলে বৌটার চুলের গোছা ধরে টেনে আনতো।
ঘরে এসে খিজির ফের মেঝেতে বসে। ‘আপনে অমাগো সায়েবরে এটু কইবার পারবেন?
আলাউদ্দিন মিয়াকে? কি?
খিজির মেঝেতে নিজের জন্য বিছানা পাতে, ওসমানের দিকে তাকায় না, বিছানা পাতায় সমস্ত মনোযোগ দিয়ে বলে, আপনে কইবেন, খিজিরের তো পোলাপান নাই। আর বৌয়ের প্যাটের বাচ্চাটারে মাহাজন যানি নষ্ট না করে।’ তারপর? বাচ্চ হলে তুমি কি করবে? লইয়া আহুম। একটা বিয়া করুম। ঐ বৌ পোলারে মানুষ করবো। খিজিরের এতো সহজ সিদ্ধান্তে ওসমান থ হয়ে যায়। নিজের বিছানা ছেড়ে খিজির এসে বসে ওসমানের তক্তপোষের পা ঘেঁষে, বেশিদিন না। কয়টা দিন যুদিল অর মায়ের প্যাটের মইদ্যে বাচ্চাটার জান কবচ করা ঠেকাইতে পারি তয় আমার আর চিন্তা নাই।’
কেন? মহাজন তো যে কোনো সময়- আরে না। আইয়ুব খানের দিন খতম হইয়া আইছে। বোঝেন না পাবলিকে কেমুন গরম অর নিজের মানুষ ব্যাকটি অর পাট্রি ছাইড়া কইটা পড়ে, আইয়ুব খানে থাকবার পারবো?
‘পারুম না? আইয়ুব খান মোনেম খানে খতম হইলে আমাগো মাহাজন হালার রোয়াবি থাকবো? তহন মহল্লা ছাইড়া হালায় কৈ পলাইবো দিশা পাইবো না। এই তো এই কয়ট দিন আউজকা আমাগো আলাউদ্দিন সাবে কইলো, আবার ইউনিভারসিটির ছাত্র ভি ভাষণ করলো, আর কয়টা দিন গেলে পুরা পাকিস্তান গওরমেন্ট উপ্ত হইয়া পড়বো।’
তাহলে তুমি এতো ঘাবড়াচ্ছে কেন? ঘাবড়াই না। তয় ধরেন আগেই যুদিল জুম্মনের মায়েরে কিছু করে, তাই হুঁশিয়ার থাকতে চাই। খালি এই কয়টা দিন। খিজিরের কিং স্টর্ক সিগেট ও বিড়ি খাওয়া এবং চিৎকার-করা গলা মিনতিতে খসখস করে, আপনে খালি কইয়েন, কয়টা দিন রাখতে পারলেই কাম হয়। মাহাজনের দিন এই খতম হইয়া আইলো।
কিন্তু আলাউদ্দিন মিয়ার কাছে এই আবেদন নিয়ে ওসমান যায় কি করে? লোকটা কি ওসমানকে সহ্য করতে পারবে? রানু যা বললো তাতে মনে হয় রহমতউল্লা তার মেয়ের সঙ্গে ওসমানের বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে। আলাউদ্দিন মিয়া তাহলে তো ওসমানের সঙ্গে কথাই বলবে না। রহমতউল্লার মেয়েটা দেখতে ভালো, ওসমান ২/৩ বার দেখেছে মেয়েটাও কি তাকে দেখেছে? ওসমানের প্রতি সিতারা কি দুর্বল? মেয়ের দুর্বলতা বুঝতে পেরে রহমতউল্লা হয়তো ওসমানকে ডেকে পাঠিয়েছে। রহমতউল্লার মেয়ে কি তাকে নিয়ে কখনো ভাবে? —মহাজনের মেয়ের ভাবনায় ওসমানের মাথায় বেশ ঝিরঝিরে হাওয়া বইতে থাকে।