কীট – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
একদিন নীলা চলে গেল।
একদিন না একদিন চলে যাওয়ার কথাই ছিল নীলার। তাই না যাওয়া এবং যাওয়ার মধ্যে খুব একটা তফাৎ হল না। সুবোধ নিজেই গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে নীলাকে গাড়িতে তুলে দিতে। বিদায়-মুহূর্তে স্বামী-স্ত্রীর যেমন কথা হয় তেমন কিছুই হল না। রুমাল উড়ল না, চোখের জল পড়ল না, এমন কি গাড়ি যখন ছেড়ে যাচ্ছে তখন জানালায় নীলার উৎসুক মুখও দেখা গেল না।
নীলা গেল তার বাপের বাড়ি মধুপুরে। সেখানেই থাকবে, না আর কোথাও যাবে তার কিছুই জানল না সুবোধ শুধু জানল নীলার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই; অনেকদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এরকমটাই হবে। খুব শান্তিপূর্ণ ভাবেই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল ব্যাপারটা।
খুব যে খারাপ লাগল সুবোধের—তা নয়। ভালও লাগল না অবশ্য। তার সম্মানের পক্ষে, পৌরুষের পক্ষে ব্যাপারটা মোটেই ভাল নয়। কত লোকের কত জিজ্ঞাসাই যে এখন তার ঘরে উঁকি মারবে তা ভাবতেও ভয় লাগা উচিত। লু ধ্ব ভেবেও সুবোধের মন শান্তই রইল। খুবই শান্ত। বাসে জানালার ধারের বদ্বার জায়গায় গঙ্গার সুন্দর হাওয়া এসে লাগছিল। এখন বসন্তকাল। কলকাতায় চোরা-গরম শুরু হয়ে গেছে। বাতাসটুকু বড় ভাল লাগল সুবোধের। লোহার প্রকাণ্ড জালের মধ্যে দিয়ে সে উৎসুক চোখে গঙ্গার ঘোলা রূপ, নৌকো, জাহাজের মাস্তুল আর কলকাতার প্রকৃতিশূন্য আকাশরেখায় প্রকাণ্ড বাড়িগুলোর জ্যামিতিক শীর্ষগুলি দেখল। মনোযোগ দিয়ে দেখল, দেখায় কোনো অন্যমনস্কতা এল না। ভালই লাগল তার। এমন অলস ভাবে আয়েসের সঙ্গে অনেককাল কিছু দেখেনি সে। বিয়ের পর থেকেই তার মন ব্যস্ত ছিল, গত দশ বছর ধরে সেই ব্যস্ততা, সেই উৎকণ্ঠা আর বিষণ্ণতা নিয়েই সে সবকিছু দেখেছে। আজ দশ বছর পর সেই ব্যস্ততা হঠাৎ কেটে গেছে। বড় স্বাভাবিক। লাগে সবকিছু। বঙ্কালের চেনা পুরোনো কলকাতার হারানো চেহারাটি হঠাৎ তার চোখে আবার ফিরে এসেছে আজ।
অনেকক্ষণ ধরে চলল বাস। ট্রাফিকের লাল বাতি, মন্থরগতি ট্রাম, রাস্তা পেরোনো মানুষের বাধা। সময় লাগল, কিন্তু অস্থির হল না সুবোধ। কোনোখানে পৌঁছোনোর কোনো তাড়া নেই বলে জানলার বাইরে তাকিয়ে ঘিঞ্জি ফুটপাথ, দোকানের সাইনবোর্ড, দোতলা বাড়ির জানালায় কোনো দৃশ্যকত কি দেখতে দেখতে মগ্ন হয়ে রইল।
সন্ধ্যের মুখে ঘরে এসে তালা খুলল সে। বাতি জ্বালল, জামাকাপড় ছাড়ল, হাতমুখ ধুল, চুল আঁচড়াল, তারপর একখানা চেয়ার টেনে জানালার পাশে বসে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে দেবার কিছু নেই। ঢাকুরিয়া বড় ম্যাড়ম্যাড়ে জায়গা, প্রায় আট বছরের টানা বসবাসে এ জায়গায় সব রহস্য নষ্ট হয়ে গেছে। চেনাশুনোও বেড়েছে অনেক। এবার জায়গাটা ছাড়া দরকার। দু এক মাসের মধ্যেই। যতদিন নীলার বাপের বাড়ির থাকাটা লোকের চোখে স্বাভাবিক দেখায় ততদিনই নিরুদ্বেগে থাকতে পারে সুবোধ। তারপর অচেনা একটা পাড়ায় তাকে উঠে যেতে হবে।
ঘরের দিকে চেয়ে দেখল সুবোধ। জিনিসপত্র বেশি কিছু নিয়ে যায়নি নীলা, কেবল তার নিজস্ব জিনিসগুলি ছাড়া। তাই ঘরটা যেমন ছিল প্রায় তেমনই আছে। কেবল আলনায় নীলার শাড়িগুলোর রঙের বাহার দেখা যাচ্ছে না, আয়নার টেবিলে কাপটানের শিশি-কৌটোগুলিও নেই। তাই তফাৎটা খুব চোখে পড়ে না। যেমন নীলার থাকা এবং না থাকার মধ্যে নিজের মনের তফাৎটাও সে ধরতে পারছে না।
না, ব্যাপারটা মোটেই ভাল হল না। গভীরভাবে ভাবলে এর মধ্যে লজ্জার ঘোর অনেক কিছু খুঁটিনাটি তার লক্ষ্যে পড়বে। মন-খারাপ হওয়ার মতো অনেক স্মৃতি। তবু কি এক রহস্যময় কারণে মনটা হাল্কাই লাগছিল সুবোধের। জানালার কাছে বসে রইল, সিগারেট খেল। নীলা থাকলে এখানে বসেই এক কাপ চা পাওয়া যেত। সেটাই কেবল হচ্ছে না। মাত্র এক কাপ চায়ের তফাৎ। তবে চা করার একটা লোক রাখলেই তো তফাৎটুকু বুজে যায়। ভেবে একটু হাসল সুবোধ। হাতঘড়িতে প্রায় আটটা বাজল। তাদের রান্নার লোক নেই, নীলাই রাঁধত। সুবোধ ভেবেছিল হোটেলে খেয়ে আসবে। তারপর ভাবল হোটেলে খেতে গেলে তফাটুকু আরো বেশি মনে পড়বে। তাই সে ঠিক করল রান্নার চেষ্টা করলেই হয়।
রান্নাঘরে একটা প্রেসার কুকার ছিল। কেরোসিনের স্টোভে সেইটেতে ভাতে ভাত রান্না করে খেল সুবোধ। দেখল এই সামান্য রান্নাটুকুতেই সমস্ত রান্নাঘরটা সে ওলট পালট করে দিয়েছে। আবার সেই তফাৎ! সুবোধ আপনমনে হাসল। তারপর বিছানা ঝাড়ল, মশারি টাঙাল, বাতি নেভাল—এই সব কাজই ছিল নীলার। শুয়ে শুয়ে সে অনেকক্ষণ মশারির মধ্যে সিগারেট খেল সাবধানে। ঘুম এল না। নীলা মাঝরাতে পৌঁছোবে আসানসোলে। সেখানে ওর জামাইবাবুকে খবর দেওয়া আছে, ওকে নামিয়ে নেবে। কয়েকদিন পরে যাবে মধুপুরে। নীলার এখন বোধ হয় সুখের সময়। ঘুরে ঘুরে বেড়াবে খুব। এখন এই রাত এগারোটায় নীলা কোথায়! কী করছে নীলা! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। কাল থেকে তার ঝরঝরে একার জীবন শুরু হবে। মাত্র ছত্রিশ বছর তার বয়স, এখনো নতুন করে সব কিছুই শুরু করা যায়। সময় আছে।
সকালে ঘুম ভাঙলে তার মনে পড়ল সারারাত সে অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন দেখেছে। অধিকাংশ স্বপ্নেই নীলা ছিল। একটা স্বপ্নে সে দেখল—সে অফিস থেকে ফিরে এসেছে। এসে দেখছে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজার কড়া না নেড়ে দরজার গায়ে কান পাতল। ভিতরে নীলা আর একটা পুরুষ কথা বলছে। মৃদু স্বরে কথা, সে ভাল বুঝতে পারছে না, প্রাণপণে শোনার চেষ্টা করল সে। বুঝল কথাবার্তার ধরণ খুবই অন্তরঙ্গ। ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল সুবোধ, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার হাত এত দুর্বল লাগছিল যে মোটেই শব্দ হল না। ভিতরে কথাবার্তা তেমনিই চলতে লাগল, সে চীৎকার করে নীলাকে ডাকল—দরজা খোলো। বলতে গিয়ে সে টের পেল, সে মোটেই চীৎকার করতে পারছে না। দরজা খোলো বলতে গিয়ে সে ফিস ফিস করে বলছে ‘জোরে কথা বলো।’ এরকম বারবার হতে লাগল। এত হতাশ লাগল তার যে ইচ্ছে করছিল দরজার সামনেই সে আত্মহত্যা করে। ভাবতে ভাবতে সে একই সঙ্গে চীৎকার করে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। অবশেষে দরজায় মৃদু শব্দ হল, থেমে গেল ভিতরের অন্তরঙ্গ কথা, তারপর হঠাৎ দরজা খুলে গেল। বিশাল শরীরওলা একজন পুরুষ দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে লাগল। চমকে উঠল সুবোধ। চেনা লোক—মনোমোহন। তার অনেকদিন আগেরকার বন্ধু। হায় ঈশ্বর! মনোমোহন কোথা থেকে, কি করে যে এল। রাগে দুঃখে ঘেন্নায় লাফিয়ে ওঠে মনোমোহনের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করল সুবোধ। কিন্তু পারল না। পা আটকে যাচ্ছিল, যেন এক হাঁটু জল ভেঙে সে দৌড়োবার চেষ্টা করছে। মনোমোহন দুতিন লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে পিছু ফিরে দেখল, নীলা অসভৃত শাড়ি পরে দরজায় দাঁড়িয়ে নিস্পৃহ মুখে তার ভোলা চুলের ভিতরে আঙুল দিয়ে জট ছাড়াচ্ছে। কাকে যে আক্রমণ করবে সুবোধ, তা সে নিজে বুঝতে পারছিল না। রাগ দুঃখ ঘেন্নার সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র একটা আনন্দকেও সে টের পাচ্ছিল। পাওয়া গেছে, নীলাকে এতদিনের সুবিধে মতো পাওয়া গেছে। এইরকম স্বপ্ন আরো দেখেছে সে রাতে। কখনো নীলাকে অন্য পুরুষের সাথে দেখা গেল, কখনো বা দেখা গেল নীলা এরোপ্লেনে বা নৌকোয় দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।
সকালের উজ্জ্বল আলোয় জেগে উঠে সুবোধ স্বপ্নগুলোর কথা ভেবে সামান্য জ্বালা অনুভব করল বুকে। বস্তুতঃ নীলার সঙ্গে কারো প্রেম ছিল এটা এখনো পর্যন্ত প্রমাণসাপেক্ষ। মনোমোহনের স্বপ্নটা একেবারেই বাজে। কারণ নীলার সঙ্গে তার বিয়ের অনেক আগে থেকেই মনোমোহনের সঙ্গে পরিচয়। মনোমোহনের সঙ্গে আর দেখা হয় না সুবোধের। মনোমাহন বোধহয় এখন পুলিশে চাকরি করে তার ঘর সংসার আছে, সে নিরীহ মানুষ। স্বপ্নে যে কত অঘটন ঘটে!
তবু বুকে মনে কোথাও একটু জ্বালার ভাব ছিলই সুবোধের। স্টোভ জ্বেলে সে চা করল। চা-টা তেমন জমল না, লিকার পাতলা হয়েছে, চিনি বেশি। সেই চা খেয়ে। সকাল বেলাটা কাটাল সে। ঝি এসে বাসন-কোসন মেজে দিয়ে গেছে, তবু নিজে আজ আর রান্না করবে না সুবোধ। আজ ছুটির দিন রবিবার। দুপুরে গিয়ে কোনো হোটেলে খেয়ে আসবে। সকাল বেলাটায় সে ঘরের কোথায় কি আছে তা ঘুরে ঘুরে দেখল। এখন সবকিছু তাকেই দেখতে হবে। নিজেকে নিজেই চালাতে হবে তার। ব্যাপারটা যে খুব সুবিধেজনক হবে না—তা বোঝা যাচ্ছিল। বিয়ের আগে সেছিল মা বোন বৌদিদের ওপর নির্ভরশীল। বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই গড়পাড়ের সেই যৌথ সংসার ছেড়ে চলে এল ঢাকুরিয়ায় নীলাকে নিয়ে। কখনো সে একা থাকেনি বিশেষ। যে কয়েকবার নীলা একটু বেশিদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছে সে কয়েকবারই মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে সুবোধ। কাজেই এখন একা একা সংসারের মতো কিছু চালাননা তার পক্ষে মুশকিল। মাকেও আর আনা যায় না— বাতে অম্বলে এই বুড়োবয়সে মা বড় জবুথবু হয়ে গেছে। তা ছাড়া মাকে আনলেও স্থায়ীভাবে আনা যায়না, গড়পাড়ের সংসার ছেড়ে মা এখানে থাকতেও চাইবে না বেশিদিন। এর ওপর আছে মায়ের অনুসন্ধানী চোখ—এক লহমায় বুঝ নেবে যে। নীলা আর আসবে না।
নীলা আর আসবে না ভাবতেই সকাল বেলায় একটু কষ্ট হল সুবোধের। কষ্টটা নিতান্তই অভ্যাসজনিত। দশ বছদ্ম একসঙ্গে বসবাস করার অভ্যাসের ফল। নীলা না থাকলে হরেকরকমের অসুবিধে। সেই অসুবিধেটুকু বাদ দিলে মনটা বেশ তাজা লাগল তার। বেলা বাড়লে রাতের স্বপ্নগুলোর মধ্যে একমাত্র মনোমোহনের স্বপ্ন ছাড়া আর কোনো স্বপ্নই তার মনে থাকল না। মনোমোহনের সঙ্গে নীলার কিছুই ছিল না—সুবোধ জানে। তবু স্বপ্নটার মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য একটা কিছু আছে বলেই তার মনে হচ্ছিল। হয়তো এই ঘরে, তার এই সংসারের মধ্যে থেকেও নীলা কখনো ঠিক পুরোপুরি সুবোধের ছিল না। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই সুবোধের এইরকম ধারণা শুরু হয়। গড়পাড়ের বাড়িতে বাচ্চা ছেলেমেয়ের অভাব ছিল না। দুই দাদার গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি তেমন পাকেনি তাদের কাছে সে প্রায়ই গোপনে জিজ্ঞেস করত, সে অফিসে চলে গেলে নীলা কি কি করে, বিকেলে ছাদে যায় কিনা, নীলার নামে কোনো চিঠি এসেছিল কিনা। বস্তুতঃ কেন যে সেসব জিজ্ঞাসা করত সুবোধ তা স্পষ্টভাবে নিজে আজও জানে না। বাপের বাড়ির কোনো লোক এসে নীলার খোঁজ করলে সে বিরক্ত হত। কখনো কখনো ঠাট্টার ছলে সে নীলাকে জিজ্ঞেসও করেছে বিয়ের আগে নীলার জীবনে কে কে পুরুষ এসেছে। সুবোধের মনের গতি তখনো ধরতে পারেনি নীলা, তাই ঠাট্টা করেই উত্তর দিত ছিল তো, সে তোমার চেয়ে অনেক ভাল। ঠাট্টা জেনেও মনে মনে ম্লান হয়ে যেত সুবোধ। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই বাড়িতে একটা গণ্ডগোল শুরু হল মেজদাকে নিয়ে। মেজদার কারখানায় গণ্ডগোল হয়ে লক-আউট হয়ে গেল। ছ মাস পরে কারখানাটা হাত বদল হয়ে গেল। মেজদা পুরোপুরি বেকার তখন। লোকটা ছিল বরাবরই একটু বন্য ধরনের, হৈ-চৈ করা মাথা-মোটা গোঁয়ার মানুষ। চাকরি গেলে এসব লোকের। সচরাচর হয় তাই হল। বাংলা মদ খেয়ে রাত করে বাসায় ফিরত। গোলমাল বা চেঁচামেচি করত না, কিন্তু মাঝে মাঝেই কান্নাকাটি করত অনেক রাত পর্যন্ত। তিন ঘরের ছোট্ট বাসাটায় ঠাসাঠাসি লোজনের মধ্যে ব্যাপারটা বিশ্রী হয়ে দাঁড়াল। মেজদার মদ খাওয়ার স্বভাব ছিলই, কিন্তু আগে মাত্রা রেখে খেতে, পুজো পার্বণ বা অন্য উপলক্ষে বেশি খাওয়া হয়ে গেল বাসায় ফিরত না। কিন্তু চাকরি যাওয়ার পর লোকটাকে রোজই মাত্রার বেশিই খেতে হত, আর বাসা ছাড়া অন্য জায়গায়ও ছিল না তার। প্রতি রাত্রে মেজদাকে গালাগাল করত সবাই, মা বলত—ওকে রাতে ঘরে ঢুকতে দিস না। বৌদি সামলাতো বটে, কিন্তু কিছুদিন পর বৌদিরও ধৈর্য থাকল না। কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি চলে গেল বৌদি। সে সময়ে সত্যিই মুশকিল হল মেজদাকে নিয়ে। তাকে সামলানোর নোক কেউ রইল না। মাঝে মাঝে সদরের বাইরেই সারা রাত শুয়ে থাকত মেজদা। দরজা খুলত না কেউই। সে সময়ে এক বৃষ্টির রাতে নীলা উঠে গিয়ে মেজদাকে দরজা খুলে দিয়েছিল। সুবোধ জেগে থাকলে নীলাকে এ কাজ করতে দিত না। যখন জাগল তখন নীলা উঠে গিয়ে দরজা খুলছে। রাগে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে নীলাকে ধরল। সুবোধ কোথায় গিয়েছিলে? নীলা দুর্বল গলায় উত্তর দিল–মেজদাকে দরজা খুলে। দিতে। ভীষণ রেগে গিয়ে সুবোধ চেঁচিয়ে বলল— কি দরকার তোমার? মাতাল, লোফার, লুম্পেন ঐ ছোটোলোকটার কাছাকাছি তুমি কেন গিয়েছিলে? সে কেন তোমার গায়ে হাত দিল? নীলা এবার অবাক হয়ে বলল— গায়ে হাত দিল! কই, না তো! সুবোধ তবু চেঁচিয়ে বলল—আমি নিজে দেখেছি সে তোমার হাত ধরে আছে। অন্ধকারে নীলার মুখের রঙ দেখা গেল না, নীলা একটু চুপ করে থেকে বলল—চেঁচিও না। বিছানায় চল। বলে দরজায় খিল দিল নীলা। সুবোধের সমস্ত শরীর জ্বলে গেল। সে বলল—কেন গিয়েছিলে? তোমাকে আমি বারণ করিনি ওই লোফারটার কাছাকাছি কখনো যাবে না? নীলা সামান্য হাঁফ ধরা গলায় বলল— দরজা খুলে না দিলে উনি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজতেন। সুবোধ ছিটকে উঠল—তাতে কী হত। মাতালের সর্দি লাগে না। কিন্তু তাকে তুমি প্রশ্রয় দাও কেন? এ বাসায় তার আপনজন কেউ নেই? লোফারটা তোমার হাত…। সামান্য কঠিন হল এবার নীলার গলা—তুমি নিজে দেখেছো? বাস্তবিক সুবোধ কিছুই দেখেনি, সে উঠে দেখেছে নীলা ঘরে ফিরে আসছে, তবু কেন যেন তার মনে হয়েছিল ওরকম কিছু একটা হয়েছে। তাই সে গলার তেজ বজায় রেখে বলল—হা, দেখেছি। নীলা আস্তে আস্তে বলল—উনি মাতাল অবস্থাতেও চিনতে পেরে আমায় বললেন–তোমাকে কষ্ট দিলাম বৌমা। আমার হাতে ওঁর হাত লাগেনি। সত্যিই কি তুমি নিজে দেখেছো। সুবোধের আর তেমন কিছু বলার ছিল না, তবু সে খাকিক্ষণ গোঁ গোঁ করল। সারারাত ঘুমের মধ্যেও ছটফট করল। জ্বালা যন্ত্রণা হিংস্রতার এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি। হাতের কাছেই নীলা, তু কেন নীলাকে দূরের বলে মনে হচ্ছে কে জানে! পরদিন থেকে ব্যাপারটা অন্য চেহারা নিল। রাতে সুবোধের চীৎকার সবাই শুনেছিল। সম্ভবত হাত ধরার ব্যাপারটা বিশ্বাস করে নিয়েই মা আর বড়দা কিছু বলেছিল মেজদাকে। মেজদার সম্বন্ধে তখন ওরকম কোন ব্যাপারই অবিশ্বাস্য ছিল না। সুস্থ অবস্থায় সম্ভবতঃ মেজদাও বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছিল কিনা। তাই পরদিন থেকেই মেজদা কেমন মিইয়ে গেল। দিনের বেলাতে আর বাসায় থাকতই না। নীলা সুবোধকে এ ব্যাপারে সরাসরি দায়ী করেনি, কিন্তু তখন থেকেই আলাদা বাসা করার জন্য সুবোধকে বলতে শুরুকরে নীলা। তাই বিয়ের দু বছরের মাথায় সুবোধ আলাদা হয়ে এল।
তবু শান্তি ছিল না সুবোধের। যাতায়াতের পথে দেখত রকে বসে পাড়ার ছেলেরা মেয়েদের টিটিকিরি দিচ্ছে, পথে ঘাটে দেখত সুন্দর পোশাক পরে সুপুরুষ মানুষেরা যাচ্ছে, কখনো বা বন্ধুদের কাছে শুনত চরিত্রহীনতার নানা রঙদার গল্প। সঙ্গে সঙ্গেই নীলার কথা মনে পড়ত সুবোধের। পৃথিবীতে এত পুরুষ মানুষের ভীড় তার পছন্দ হত না। তার ইচ্ছে হত নীলাকে সে সম্পূর্ণ পুরুষশুন্য কোনো এলাকায় নিয়ে গিয়ে বসবাস করে। অফিসে বেরিয়ে বোধহয় সে অনেকবার মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়েছে। মনে বিষের যন্ত্রণা। একটু এদিক ওদিক ঘুরে চুপি চুপি ফিরে এসেছে বাসায়। নিঃসাড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছে দোতলায়, দরজায় কান পেতে ভিতরে কোনো কথাবার্তা হচ্ছে কিনা শুনতে চেষ্টা করেছে। তারপর আস্তে আস্তে দরজায় কড়া নেড়েছে। প্রায়ই দরজা খুলে নীলা অবাক হত—এ কী, তুমি! খুব চালাকের মতো হাসত সুবোধ, বলত—দূর রোজ অফিস করতে ভাল লাগে? চলো আজ একটা ম্যাটিনি দেখে আসি। শেষের দিকে নীলা হয়তো কিছু টের পেয়েছিল। আর তাকে দেখে অবাক হত না। শক্ত মুখ আর ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে একদিন বলেছিল-চৌকির তলাটলাগুলো ভাল করে দেখে নাও।
ধরা পড়ে মনে মনে রেগে যেত সুবোধ। নিজের সঙ্গে নিজেই বিজনে ঝগড়া করত— কিছু একটা না হলে আমার মনে এরকম সন্দেহ আসছে কেন! আমার মন বলছে কিছু একটা আছেই। বাইরে থেকে আর কতটুকু বোঝা যায়।
তবু নীলা চোখের জল ফেলেনি কোনোদিন। ঝগড়া করেনি। কেবল দিনে দিনে আরো গভীর, শীতল, কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সুবোধের ধরাছোঁয়ার বাইরেই চলে যাচ্ছিল নীলা। বছর চারেক আগে পেটে বাচ্চা এল তার। তখন আরো রুক্ষ আরো কঠিন দেখাল নীলাকে। হাসপাতালে যাওয়ার কয়েকদিন আগে সে খুব শান্ত গলায় একদিন সুবোধকে বলেছিল— শুনেছি মেয়ের মুখে বাপের ছাপ থাকে। আমার যেন মেয়ে হয়। সুবোধ অবাক হয়ে বলল—কেন? নীলা মৃদু হেসে বলল—তাহলে প্রমাণ থাকবে যে সে ঠিক বাপের মেয়ে। মুখের আদল তো চুরি করা যায় না। মেয়েটা বাঁচেনি। বড় রোগা দুর্বল শরীর নিয়ে জন্মেছিল। আটদিন পর মারা গেল। মুখের আদল তখনো স্পষ্ট হয়নি। কোথায় যেন একটা কাঁটা এখনো খচ করে বেঁধে সুবোধের। নীলা কথাটা যে কেন বলেছিল।
তারপর থেকেই সুবোধ জানত যে নীলা চলে যাবে। আজ কিংবা কাল। আজ কাল করে করেও বছর তিনেক কেটে গেল। খুব অশান্তি কিংবা ঝগড়াঝাটি কিছুই হয়নি তাদের মধ্যে। বাইরে শান্তই ছিল তারা। ভিতরে ভিতরে বাঁধ তুলে দিল কেবল। অবশেষে নীলা চলে গেল কাল।
সারা সকাল কাটল নির্জনতায়, ঘরের মধ্যে! একরকম ভালই লাগছিল সুবোধের। দশ বছরের উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, অস্থিরতা, রাগ—এখন আর তেমন অনুভব করা যায় না। কোনো দুঃখও বোধ করে না সে! সন্দেহ হয় নীলাকে সে কোনদিন ভালবেসেছিল কিনা। সে বুঝতে পারে না ভাল না বেসে থাকলে নীলার প্রতি ওরকম অত আগ্রহই বা তার কেন ছিল! গত দশবছরে নীলার কথা সে যত ভেবেছে তত আর কারো কথা নয়।
দুপুরের দিকে ঘরে তালা দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। বিয়ের আগে যেমন হঠকারি দায়িত্বহীন সুন্দর সময় সে কাটিয়েছে সেরকমই সুন্দর সময় আবার ফিরে এসেছে আজ বাধাবন্ধনহীন। মনটা ফুরফুরে রঙীন একটি রুমালের মতো উড়ছে। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়স তার, সামনে এখনো দীর্ঘ জীবনদায়দায়িত্বহীন। তার চাকরিটা মাঝারি গোছের। উঁচু থাকের কেরানী। তাদের দুজনের মোটামুটি চলে যেত। এবার একা তার ভালই চলবে। নীলা টাকা চাইবে না বলেই মনে হয়। চাইলেও দিয়ে দেওয়া যাবে। মোটামুটি নীলার ভাবনা থেকে মুক্তিই পেয়েছে সে। এবার পুরোনো আড্ডাগুলোয় ফিরে যাওয়া যেতে পারে। এবার গ্রীষ্মে প্রতিটি ফুটবল খেলাই দেখবে সে। রাত্রে লোয়ে দেখবে সিনেমা। ছুটি পেলেই পাড়ি দেবে কাশ্মীর কিংবা হরিদ্বারে, দক্ষিণ ভারত দেখে আসবে। এবার থেকে সে মাঝেমধ্যে একটু মদ খাবে। খারাপ মেয়েমানুষদের কাছে যায়নি কোনোদিন, এবার একবার যাবে। আর দেখে আসবে ঘোড়দৌড়ের মাঠ। মুক্তি–মুক্তি—তার মন নেচে উঠল।
হোটেলে খেয়ে আর ঘরে ফিরল না সুবোধ। সিনেমায় গেল। দামী টিকিটে বাজে বই দেখে বেরিয়ে গেল কলেজ স্ট্রীটে। ঘিঞ্জি পুরোনো একটা চায়ের দোকানে আট নয় বছর আগেও তাদের জমজমাট আড্ডা ছিল। সেখানে পরপর কয়েক কাপ চা খেয়ে সন্ধ্যে কাটিয়ে দিল সুবোধ। পুরোনো বন্ধুদের কারোই দেখা পেল না। বেরিয়ে পড়ল আবার।
সন্ধ্যে সাতটা। কোথায় যাওয়া যায়!
অনেকদিন আগে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে শখ করে মদ খেয়েছে সুবোধ। সঙ্গীছাড়া কোনোদিন খায়নি। মদের দোকানগুলোকে সে ভয় পায়। তবু আজ একটু খেতে ইচ্ছে করছিল তার। উত্তেজনার বড় অভাব বোধ করছিল সে।
বাসে ট্রামে ভিড় ছিল বলে সে হেঁটে হেঁটে এসপ্ল্যানেডে এল। অনেক মদের দোকানের আশেপাশে ঘুরে দেখল। বেশি বাতি, বেশি লোকজন, হৈ-চৈ তার পছন্দ নয়। অনেকগুলো দেখে সে গলি-খুঁজির মধ্যে একটা ছোট্ট দোকান পছন্দ করে ঢুকল। ভিতরে আলো কম, দু-চারজন লোক বসে আছে এদিক ওদিক। কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ে—আবছা আলোয় তাদের মুখ বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েগুলোর দিকে বেশি তাকাল না সুবোধ। ফাঁকা একটা টেবিলে দেয়াল ঘেঁষে বসল। বেয়ারা এলে একসঙ্গে তিন পেগ হুইস্কির হুকুম করল সে।
বেশিক্ষণ লাগল না। অনভ্যাসের মদ তার মাথায় ঠেলা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে গুলিয়ে যায় চিন্তা ভাবনা, শরীরের মধ্যে একটা অবোধ কষ্ট হতে থাকে, পা দুটো ভারী হয়ে ঝিন ঝিন করে। এই তো বেশ নেশা হচ্ছে—ভেবে সুবোধ কাউন্টারের কাছে দাঁড়ানো একটি মেয়ের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি পরিচিতার মতো হাসে। সুবোধ হেসে তার উত্তর দেয়। পরমুহূর্তেই গ্লাসে চুমুক দিয়ে চোখ তুলে সে দেখে মেয়েটি তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আছে। মেয়েটি কালো, মোটা থলথলে বয়স ত্রিশের এদিক ওদিক। মেয়েটি বলে–বাব্বাঃ তেষ্টায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু খাওয়াও তো।
কোনো কোনো বন্ধুর কাছে এদের কথা শুনেছে সুবোধ। তাই অবাক হয় না। মেয়েটির জন্যও এক পেগের হুকুম দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে—তোমার ঘর কোথায়?
–কাছেই। যাবে?
—মন্দ কী?
–তবে আরো দু পেগের কথা বলে দাও। তাড়াতাড়ি বলো। এরপর বন্ধ হয়ে যাবে।
সুবোধ আরো দু পেগের কথা বলে দিয়ে হাসল—মদ খাও কেন?–তুমি খাও কেন?
আমার বউ চলে গেছে।
-আমারও স্বামী চলে গেছে। বলেই মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে বলে–শোনো ঘরে যেতে কিন্তু ট্যাক্সি করতে হবে। হেঁটে যেতে নেশা থাকে না।
—ট্যাক্সি! হাঃ হাঃ। বলে হাসল সুবোধ। তার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। বলল—আমার বৌয়ের গল্প তোমাকে শোনাবো আজ
-খুব ছেনাল ছিল?
–না না। ছোল নয় তবে অন্যরকম—
–চলে গেল কেন?
—সেটাই তো গল্প। —ওরকম আকছার হচ্ছে। তোমার বৌয়ের দুঃখ আমি ভুলিয়ে দেবো।
—দুঃখ! বড় অবাক হল সুবোধ। দুঃখের কোনো ব্যাপারই তো নয় নীলার চলে-যাওয়াটা! তবু নেশার ঘোরে এখন তার মনটা হু-হু করে উঠল। দুঃখিত মনে সে মাথা নেড়ে বলল—হ্যাঁ খুব দুঃখের গল্প—
—কেটে যাবে। বিলটা মিটিয়ে দাও।
বিল মেটাল সুবোধ। তারপরও গোটা ত্রিশেক টাকা রইল ব্যাগে। মেয়েটা আড়চোখে দেখে বলল—তুমি কি আমার ঘরে সারারাত থাকবে?
—মন্দ কী? সুবোধ হাসল।
—ত্রিশ টাকায় হবে না কিন্তু।
—হবে না?
—হয়! বলো না, এই বাজারে…ত্রিশ টাকায় ঘণ্টা দুই, তার বেশি না।
–না। ত্রিশ টাকায় সারারাত।
—পাগল!
—তবে কেটে পড়ো। আমি কেরানীর বেশি কিছু না।
দাঁত বের করে হাসল মেয়েটি। গ্লাস নিঃশেষ করে আঁচলে মুখ মুছল। বলল—মদ খাওয়ালে, ভালবাসলে, ছাড়তে ইচ্ছে করে না।
—কেটে পড়ো।
—ঠিক আছে। চলো। ত্রিশটাকাতেই হবে। আহা, তোমার বৌ চলে গেছেনা? ঠিক আছে। চলো তো দেখি তোমার বৌ ভাল না আমি ভাল। বলতে বলতে সুবোধকে হাত ধরে টেনে তুলল মেয়েটা।
ট্যাক্সিতে সুবোধ মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখেছিল। সস্তা প্রসাধন আর তেলের বিশ্রী গন্ধ। তবু মুখ সরিয়ে নিতে তার ইচ্ছে করছিল না। মেয়েটি ট্যাক্সিওলাকে নানা জটিল পথে নিয়ে যেতে বলছে। কথা আর কথায় বুক ভরে আসছিল সুবোধের। সে অনর্গল কথা বলছিলনীলার কথা, কাল রাতের স্বপ্নের কথা, মেজদার কথা, মরা মেয়েটার কথা। কখনো সে বলছিল সে এবার বেড়াতে যাবে হরিদ্বারে, যাবে ঘোড়দৌড়ের মাঠে, ফুটবল ম্যাচ দেখবে। একা একাই থাকবে সে। মেয়েটি কোনো কথাতেই কান দিল না। শুধু মাঝেমাঝে বলল—শুয়ে পোড় না বাপু গায়ের ওপর। পুরুষমানুষগুলো যা ন্যাতানো হয়, একটু দুঃখটুঃখ হলেই গড়িয়ে পড়ে। কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারছিল না সুবোধ! দুঃখ! দুঃখ কিসের! মেয়েটি জানেই না তার মন রঙীন একখানা রুমালের মতো উড়ছে।
ট্যাক্সি যেখানে থামল সে জায়গাটা সুবোধ চিনল না। শুধু টের পেল গোলকধাঁধার মতো খুব জটিল প্রকাণ্ড একটা বাড়ির মধ্যে সে ঢুকে যাচ্ছে। অনেক সিঁড়ি, সরু বারান্দা, আবার সিঁড়ি বিচিত্র অচেনা লোকজন, মাতাল, বেশ্যা, ফড়ের গা ঘেঁষে মেয়েটি তাকে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে নীলার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে। অথচ জানে না দুঃখই নেই আসলে। ভেবে সে হাসল—ভাল জায়গায় থাকো তুমি কি যেন নাম তোমার!
মেয়েটি বলল–অনিলা।
হাসল সুবোধ—চালাকী হচ্ছে?
-কেন?
—আমার বৌয়ের নাম তো নীলা।
—ওমা! তাই নাকি! বলোনি ত!
–বলিনি?
–না। মাইরী…
চালাকী হচ্ছে? অ্যাঁ।
মেয়েটি হাসে—সত্যিই আমি অনিলা। তোমার বৌয়ের উল্টো। দেখো প্রমাণ পাবে। খুব সুন্দরী ছিল তোমার বৌ? ফর্সা?
–না। কালোই। মন্দ না।
—খুব কালো?
–না। শ্যামবর্ণ। এই আমার গায়ের রঙ।
—ওমা। তুমি তো ফর্সাই!
–যাঃ–হাসল সুবোধ। লজ্জায়।
ঘরখানা ভালোই। ছিমছাম। বসতে ঘেন্না হয় না। পরিষ্কার বিছানাটাই আগে চোখে পড়ল সুবোধের। ভারী মাথা নিয়ে গড়িয়ে পড়ল। বলল–মদ খেয়ে কিছু হয় না। উত্তেজনা লাগছে না।
—আর খাবে।
–না। পয়সা নেই।
—পয়সা না থাক, ঘড়ি আংটি আছে। জমা রেখে খেতে পারো, পরে পয়সা দিয়ে ছাড়িয়ে নেবে।
-না। আর খেলে ঘুম পাবে, বমিও হবে।
—তবে থাক।
সুবোধ মেয়েটিকে অনাবৃত হতে দেখেছিল। হঠাৎ কি খেয়াল হল, জিজ্ঞেস করল—আজ কি তোমার আর খদ্দের আছে? তাড়াতাড়ি করছ কেন?
মেয়েটি হাসল—আছে। কিন্তু তাতে তোমার কি! তোমাকে আলাদা বিছানা করে ঘুম পাড়িয়ে রাখবো। তুমি টেরও পাবে না।
—পাবো না?
–না।
মেয়েটি কাছে আসে। আস্তে আস্তে উঠে বসে সুবোধ—তুমি তো অনিলা!
—হুঁ।
—দূর। তাহলে হবে না। বলে হাই তোলে সুবোধ।
–কেন?
সুবোধ উত্তর দেয় না! অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে থাকে। নীলা! নীলা এখন কোথায়। তার মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। পৃথিবীময় লক্ষ লক্ষ পুরুষ। তার। মধ্যে নীলা একা কোথায় চলে গেল? কী করছে এখন নীলা?
মেয়েটি বলে—আমার দিকে তাকাও। দেখ না আমাকে।
সুবোধ গরুর মতো নিরীহ চোখে তাকায়। হাসে। বলে—দূর। তোমার দ্বারা হবে না।
-কেন?
-তুমি তো পরিষ্কার মেয়ে। কিছু লুকোনো নেই তোমার। তোমাকে একটুও সন্দেহ হয় না।
বাঃ। তা তুমি চাও কি? সন্দেহ করতে। বলতে বলতে সে সুবোধ। হেসে চোখ ফিরিয়ে নেয়।