ইচ্ছে
দেশলাইয়ের কাঠির অর্ধেক ভেঙে দাঁত খুঁচিয়েছিল কখন। বিড়ি ধরাতে গিয়ে সাঁটুলাল দেখে খোলের মধ্যে সেই শিবরাত্রির সলতে আধখানা বারুদমুখো কাঠি দেমাক দেখিয়ে পড়ে আছে।
আজ চৈত্রের হাওয়া ছেড়েছে খুব। কাল বৃষ্টি গেছে ক’ফোঁটা, কিন্তু আজই তেজাল রোদ আর খড়নাড়ার মতো শুকনো হাওয়া দিচ্ছে দ্যাখো। হাওয়ার থাবায় এক ঝটকায় কাঠির মিনমিনে আগুন নিবে যাবে। যদি তাই যায় তো আরও চার পো পথ বিন–বিড়িতে হাঁটো। তারপর হাজারির দোকানের আগুনেদড়িতে বিড়ি ধরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু অতক্ষণে বিড়ি ছাড়া হাঁটা যায়! মুখে থুথু আসবে, বুক আঁকুপাঁকু করবে, কী নেই–কী নেই মনে হবে।
সাঁটুলাল দেশলাইয়ের বাক্সটা নাড়ে। ভিতরে ঢুকাটুক শব্দ করে আধখানা কাঠি দেমাকভরে নড়ে চড়ে। কাঠিটার মতলব বুঝতে পারে না সাঁটু। শালা কি বিড়ি ধরানোর ঠিক মুখে নিবে গিয়ে তাকে জব্দ করবে?
তার জীবনে পাপের অভাব নেই। ফর্দ করতে গেলে শেষ হওয়ার নয়। বেশি কথা কি, এই দেশলাইটাই তো গত পরশু বাবুদের উঠোনে পড়ে থাকতে দেখে হাতিয়ে নেয়। ঝি উনুন ধরাতে এসে ফেলে গিয়েছিল ভুলে। পরে এসে দেশলাই খুঁজে না পেয়ে বাপান্ত করছিল। তা সে সাঁটুর উদ্দেশেই বলা, নাম ধরে না বললেও, শুনে সাঁটু ভেবেছিলনাঃ, কাল থেকে ভালো হয়ে যাব।
সাঁটু দেশলাইটা হাতে নিয়ে মাঠের মধ্যিখানে ঢিবিটার ওপর বসে থাকে। দাঁতে আটকানো বিড়ি। ধরায়নি। সাঁটু ভাবে, বাবুদের বাড়ির ঝি সরস্বতীর কি উচিত হয়েছে সাঁটুকে অমন বাপ-মা তুলে গাল দেওয়াটা? ছেলের মাথা খেতেও বলেছে। যত যাই হোক সরস্বতী তো সাঁটুরই বউ! আজ না হয় সে পয়সাওয়ালা লোকের সঙ্গে বিয়ে বসেছে। তা সুখচন্দ্রের পয়সাই বা এমনকী। আটাকল খুলে ধরাকে সরা দেখছে। তারও আগের পক্ষের বউয়ের হ্যাপা সামলাতে হয়।
সরস্বতী ভাবে সুখচন্দ্র তাকে চিরকাল মাথায় নিয়ে নাচবে। ফুঃ! লাথি দিল বলে। বেশি দিন নয়।
ছেলের মাথা খেতে বলা সরস্বতীর ঠিক হয়নি। ছেলে তো সাঁটুর একার নয়, তারও। কিন্তু রেগে গেলে সরস্বতীর আর সেসব খেয়াল থাকে না। রেগে গেলে সরস্বতী একেবারে দিগবসনা।
ঢিবির ওপর কয়েক জায়গায় ঘাস পুড়ে টাক পড়েছে। এখানে সেখানে আংরা পড়ে আছে, ছাই উড়ছে অল্পস্বল্প। ডাকাতে সাধুটা ক’দিন আগেও এখানে থানা গেড়ে ছিল।
আজকাল সাঁটুলালের খুব ইচ্ছে হয় কারও কাছে গিয়ে মনের দুঃখের কথা সব উজাড় করে বলে। তার দুঃখ ঝুড়িভরা। সাধুর খোঁজ পেয়ে একদিন সন্ধেবেলা চলেও এসেছিল সাঁটুলাল। সাধুটা নাকি ভীষণ তেজালো, শূল চিমটে কিংবা ধুনি থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে লোককে তাড়া করে। তা তেজালো সাধুই সবার পছন্দ। সাঁটুরও।
সন্ধেবেলা সাঁটু ঢিবিতে উঠে দেখল নেংটি–পরা জটাধারী ভয়ঙ্কর সাধু বসে-বসে খাচ্ছে। কাছেপিঠে কেউ নেই, কেবল বেলপুকুরের মতিলাল একধারে চোরের মতো খোলা ছাতা সমুখে ধরে বসে আছে। তামাকের কারবারে মতিলাল গতবার খুব মার খেয়েছে। সেই থেকে লটারির টিকিট কেনে, হাতে গুচ্ছের কবজ আর সাধুর খোঁজ পেলেই সেখানে গিয়ে খুঁটি গাড়ে।
সাঁটুলালকে দেখে মতিলাল হাতের ইশারায় ডেকে বলল ,–এখন কথাটথা বোলো না, বাবার ভোগ হচ্ছে। আর খুব সাবধান, বাবা কিন্তু হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে মারে। আমার ছাতার আড়ালে সরে এসো বরং।
মতিলালের ছাতার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে সাঁটুলাল সাধুর খাওয়া দেখে চোখের পাতা ফেলতে পারে না। ভালো ঠাহর হচ্ছিল না অল্প আলোয়, তবু মনে হচ্ছিল যেন কীসের একটা বড়সড় ঠ্যাং চিবোচ্ছে।
মতিলাল ঠেলা দিয়ে বলল –দেখছ কি! নিজের চোখে যা দেখলাম প্রত্যয় হয় না। সাঁটু মতির কাছ ঘেঁষে বলল –কী দেখলে?
মতিলাল ফিসফিস করে বলে–সবটা দেখিনি। সন্ধের মুখে-মুখে এসে হাজির হয়ে দেখি বাবার সামনে একটা আধজ্যান্ত শেয়াল পড়ে আছে, মুখ দিয়ে ভকভক করে রক্ত বেরোচ্ছে, তখনও পাঁজর ওঠানামা করছিল। ধুনি জ্বেলে সেই আধজ্যান্ত পশুকে আগুনে ভরে দিল মাইরি, কালীর দিব্যি। তারপর ওই দ্যাখো, কেমন তার করে খাচ্ছে।
সাঁটু শুয়োরের মাংস পর্যন্ত খেয়েছে, কিন্তু শেয়াল পর্যন্ত যেতে পারেনি। শুনে আর-একটু মতিলালের কাছে ঘেঁষে বসল। মতিলাল কানে-কানে বলল –স্বয়ং পিশাচসিদ্ধ মহাদেব। বুঝেছ? এমন মহাপুরুষের সঙ্গ পাওয়া কত জন্মের ভাগ্যি।
শেয়াল খেয়ে সাধু ঘাসে হাত পুঁছে মাটির ওপর শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। মতিলাল খুব সন্তর্পণে
উঠে গিয়ে সাধুর পা দাবাতে লেগে যায়।
সাধুর শেয়াল খাওয়া দেখে সাঁটুর গা বিরোচ্ছিল। মতি হাতের ইশারায় ডাকলে সে হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা কাছে গিয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ধানাইপানাই বলতে শুরু করল বাবা, আমি বড় পাপী। তা বাবা, দুঃখী লোকেরা পাপ না করেই বাঁচে কীসে বলো! তাই ভাবছি বাবা, তুমি যদি আশীর্বাদ করো তো কাল থেকে ভালো হয়ে যাব।
সাধু চিত হয়ে শুয়েছিল, কথা শুনে মুখটা ফিরিয়ে একবার তাকাল শুধু। ভারী ছুঁচলো নজরটা। সাঁটুর তো ছুঁচ ফোঁটানোর মতো যন্ত্রণা হয়েছিল।
সাধু কিন্তু গাল দিল না, একটু হেসে বলল –শালা নিমকহারাম পাঁচটা টাকা আর একটা জবাফুল নিয়ে আসিস কাল। এখন যা।
সাঁটু চারদিকে চেয়ে শেয়ালের নাড়িভুড়ি, ছাল আর পোড়া মাথাটা দেখে ‘ওয়াক’ তুলে সেই যে চলে এসেছিল আর যায়নি। যাবেই বা কোন মুখে? জবাফুলের জোগাড় ছিল, কিন্তু পাঁচটা টাকা?
সাধু চোত সংক্রান্তির স্নানে যাবে বলে তল্পি গুটিয়েছে, কিন্তু ঢিবির ওপরকার মাটিতে দাদের মতো পোড়া দাগ রয়ে গেছে। বাতাসে একটা পচাটে গন্ধও। শেয়াল খেলে লোকে পাগল হয় বলে শুনেছে সাঁটুলাল।
অর্ধেক কাঠিটা দেশলাইয়ের খোলের বারুদে ঠুকবে কি ঠুকবে না তা খানিক ভাবে সাঁটু। এ বাতাসে ধরবে না মনে হয়।
ঢিবি বেয়ে সাঁটুলাল নেমে আসে খানিক। এবার বাতাসে একটু আড়াল পড়েছে। ‘জয় মা কালী’ বলে সাঁটু কাঠিটা ঠুকে দিল খোলে। বিড়বিড়িয়ে উঠল আগুন। গেলঃ গেলঃ হুই রেঃ সাঁটু। বিড়ি হাতের খাপের মধ্যে খুঁজে প্রাণপণে টানে।
জয় মা! ধরেছে। নিবেই গিয়েছিল আগুনটা, শুধু কাঠিটা লালচে হয়েছিল বলে ধরল। ভারী খুশি মনে ঢিবির ওপর বসে সাঁটুলাল দূরের দিকে চেয়ে থাকে! বিড়িটা শেষ হয়ে এলে এটা থেকেই আর-একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে হাঁটা দেবে।
পাপ–তাপগুলো সবই যেমন–কে–তেমন থেকে গেল তার। কাউকে বলা হল না। মতিলালের পাপ–তাপ বোধহয় সাধু টেনে নিয়ে গেছে। সাঁটুলাল বিড়ি টানতে-টানতে ভাবলনাঃ শালা, কাল থেকে ভালো হয়ে যাব।
বড় রাস্তা দিয়ে একটা বাস আসতে দেখে সাঁটু তাড়াতাড়ি উঠে হাঁটা ধরে। হাত তুলতে বাসটা থেমেও গেল। কিন্তু কনডাক্টর নিত্যচরণ মুখ চেনে। উঠতে যেতেই হাত দিয়ে দরজাটা আটক করে বলল –উঠছ যে, পয়সা আছে তো?
–আছে–আছে।
দোনামনা করে নিত্যচরণ দরজা ছাড়ল বটে কিন্তু নাহক অপমান করে বলল –সিটে বোসো, মেঝেয় বোসো।
তাতে সুবিধেই সাঁটুলালের। মেঝেয় বসলে তেমন নজরে পড়বে না। পয়সা মাপও হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া সিটে জায়গাও নেই। সে বসেই টাঁক থেকে একটা বিড়ি বার করে নিত্যচরণের দিকে বাড়িয়ে দিল। যদি নেয় তো ভালো, না নিলে খুব দিক করবে।
তা নিত্যচরণ নিল। নেওয়ারই কথা। নিত্যচরণের দ্বিতীয়পক্ষ উলুবেড়ে থেকে চিঠি দিয়েছে আজ। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে অত হাওয়ার মধ্যেও কী করে কোন কায়দায় যেন নিত্যচরণ বিড়িটা ধরিয়ে ফেলল। তারপর বুকপকেট থেকে ন্যাতানো পোস্টকার্ডটা বের করে জড়ানো অক্ষরের লেখা পড়তে থাকে একমনে। তার মুখে রাগ, বিরক্তি, বৈরাগ্য আর হাসি ফুটে উঠতে থাকে। চামেলি লিখেছে শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম। তারপর লিখি যে, সুপারি সব পাড়া হইয়াছে। কিন্তু মুকুন্দ ঠাকুরপো এবং ভাশুরঠাকুর হিসাব দেয় নাই। এত ক’টা মোটে দিয়াছে। তুমি বৈশাখে এসে হিসাব চেও। আমাকে দিনরাত্রি কথা শুনায়। কেন আমি কি কেউ না। সতীনপো পর্যন্ত বলে তিন্নির মা, মা ডাকে না। কথা আরও কত আছে। বলে দুই বউতে সমান। ভাগ। ভাগ বড়। আমার ভাগের খড় শ্যামলালকে বিক্রি করিয়াছি। পাঁচ টাকা এখনও বাকি আছে। তোমার টাকা পাইনি। কী করে সংসার চলে বলো? তিন্নির আমাশা হওয়ায় কত খরচ হয়েছে সে খবর কেই বা রাখে। আমার কে আছে। হাটবারে মুকুন্দ ঠাকুরপোকে পাউডার আনিতে পয়সা দিয়াছিলাম। সে কী দোষের বলো। ঠাকুরপো আনে নাই পয়সা আমার হাতেও দেয় নাই, তিন্নির হাতে ফেরত দিয়া বলিয়াছে অত বিবি সাজতে হবে না পাঁচজনে কুকথা বলে। সতীন চরিত্রের দোষের কথা বলে বেড়ায়। মা কালীর নামে দিব্যি কেটে লিখি যে সে কথা কেউ বলিতে পারিবে না। পোস্টকার্ডে আর জায়গা নেই। প্রাণনাথ রাখো শ্রীচরণে! চরণাশ্রিতা চামেলি।
শেষ লাইনটা ‘রাবণ বধ’ যাত্রা থেকে নেওয়া। নিত্যচরণ শ্বাস ফেলে পোস্টকার্ডটা আবার পকেটে ঢোকায়। বিড়ি নিবে গেছে। আবার ধরিয়ে নিল নিত্যচরণ।
সাঁটুলাল নিত্যচরণের মুখের ভাব দেখছিল একমনে। মোটে মাইলখানেক রাস্তা। দেখি না দেখি না বলে কাটিয়ে দেবে। চিঠিটা আর-একটু যদি লম্বা হত! লোকে যে কেন লম্বা-লম্বা চিঠি লেখে না তা বোঝে না সাঁটুলাল।
নিত্যচরণ অবশ্য পয়সা আদায় করল না শেষপর্যন্ত। নামবার সময় শুধু বলল –এই চারশো বিশ, বাস কি জল দিয়ে চালাই আমরা? তেল কিনতে পয়সা লাগে না!
বাস তেলে চলে না জলে চলে তা জেনে সাঁটুর হবেটা কী? সে নিজে যে কীসে চলে সেইটাই এক ধাঁধা। চলেও গেল এই বছর পঞ্চাশেক বয়স পর্যন্ত।
পথটা খুব পার হওয়া গেছে। চোত মাসের রোদে এ-পথটুকু কমতি হল সে একটা উপরি লাভ।
সুখচন্দ্রের সঙ্গে আগে–আগে কথা বলত না সাঁটুলাল। এখন বলে। ভেবে দেখেছে, সুখচন্দ্রের দোষ কী? সরস্ব তাঁকে তো সে নিজে এসে ভাগায়নি। সরস্বতী নিজে থেকেই ভেগে গেল। বরং অন্য কারও চেয়ে সুখচন্দ্রের সঙ্গে আছে সে বরং ভালো। লোকটা কাউকে বড় একটা দুঃখ দেয় না। ফুর্তিবাজ লোক। যা আয় করে তা খেয়ে পরে ওড়ায়। বাজারের সেরা জিনিসটা আনবে। মরশুমের আমটা কাঁঠালটা বেশি দাম দিয়ে হলেও কিনবে, ঘরে তার রেডিও পর্যন্ত আছে। আগের পক্ষে বাঁজা বউ শেফালিকেও খারাপ রাখেনি। নিজের বাড়ি শেফালিকে ছেড়ে দিয়ে অন্য পাড়ায় সরস্বতীর জন্য আলাদা ঘর তুলেছে। দুই বাড়িতেই যাতায়াত।
অনেক ভেবেচিন্তে সাঁটুলাল দেখেছে, ব্যাপারটা খারাপ হয়নি। প্রথম প্রথম তার অভিমান হত বটে। কিন্তু এও তো ঠিক যে তিন–তিনটে বাচ্চা সমেত সরস্বতী তার ঘাড়ে গন্ধমাদনের মতো চেপেছিল এতদিন। এই যে সে গত রাতে খাড়ুবেড়েতে যাত্রা শুনতে গিয়ে রাত ভোর করে। তারপর বেলাভর ঘুমিয়ে নাড়ুগোপালের মতো হেলতে–দুলতে তিন প্রহর পার করে ফিরছে, সরস্বতী থাকলে হতে পারত এমনটা? মাগি গিয়ে এখন তার ঝাড়া হাত-পা। ওদিকে ছেলেপুলেগুলো দু-বেলা খেতে পায়, পরতে পায়। সরস্বতীর চেহারা আদতে কেমন তা সাঁটুলালের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পাঁচ-সাত বছর পর থেকে কেউ বুঝতে পারত না। এখন সরস্বতী পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন চামড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হাতপায়ের গোছ হয়েছে খুব। গায়ে রস হয়েছে। চোখে ঝলক খেলে। বেশ আছে।
গোঁজ মুখ করে ঘুরে বেড়াত সাঁটুলাল, একদিন সুখচন্দ্ৰ ডেকে বলল –সাঁটুভায়া, ভগবান আমার মধ্যেও আছে, তোমার মধ্যেও আছে। তুমি আমি কি আলাদা? সরস্বতী এসে জুটল, ফেলি কী করে বলো?
এমনি দু-চার কথা হতে-হতে সাঁটুলাল ভাব করে ফেলল। তবে সরস্বতীর পুরোনো সব রাগ যায়নি। সুখচন্দ্র যতই মিতালি করুক সরস্বতী এখনও দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর আকাশ বাতাসকে শুনিয়ে তার কেচ্ছা গায়।
গাওয়ার মতো কেচ্ছা কিছু কম নেই সাঁটুলালের। তার সারাটা জীবন চুরি ছ্যাঁচড়ামি আর ছিনতাইয়ের কাণ্ডে ভরা। সেসব পুরোনো কথা। গত সপ্তাহে পালপাড়ার কদমতলায় সাঁটু নিজের মেয়ে কুন্তিকে গঙ্গা–যমুনা খেলতে দেখে মায়ায় পড়ে দাঁড়িয়ে গেল। শত হলেও সন্তান। মেয়েটাও খানিক খেলা করে বাপের কাছে এল দৌড়ে। একগাল মিষ্টি হেসে ডাকল বাবা! বুক জুড়িয়ে যায়। মেয়েটার খালি গা, পরনে শুধু একটা বাহারি রঙচঙে ইজের।
সাঁটুর চোখটাই পাপে ভরা। যেখানে যত লোভানি আছে সেখানে তার পাপ নজর পড়বেই কি পড়বে। মেয়েটাকে দেখতে গিয়ে প্রথমেই তার নজর পড়ল মেয়ের কোমরের কাছে ইজেরের কষি এক জায়গায় একটু উলটো ভাঁজ হয়ে আছে। আর সেই ভাঁজে স্পষ্ট একটা আধুলি আর কয়েকটা খুচরো পয়সার চেহারা মালুম হচ্ছে।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খানিক আদর করছিল সাঁটু। তারপর মেয়ে ফের গঙ্গা–যমুনার কোটে ফিরে গেল, সাঁটু গেল বাজারে বাবুর জন্যে সিগারেট আনতে। আর যেতে-যেতেই টের পেল, কখন যেন তার হাতে একটা আধুলি দুটো দশ পয়সা আর-একটা পাঁচ পয়সা চলে এসেছে। মাইরি! মা কালীর দিব্যি! সে টেরও পায়নি কখন আপনা থেকে পয়সাগুলো এসে গেল। একেবারে আপনা থেকে।
এসে যখন গেলই তখন তাকে ভগবানের দেওয়া পয়সা মনে করে সাঁটুলাল তৎক্ষণাৎ নগদানগদি তাড়ি খেয়ে ফিরল। বাবুর বাড়ির ফটকে তৈরি হয়েই দাঁড়িয়েছিল সরস্বতী আর তার গা ঘেঁষে কুন্তি। আর যাবে কোথায়! প্রথমে মেয়েটাই দেখতে পেয়ে চেঁচাল–মা! মা! ওই যে আসছে। সঙ্গে-সঙ্গে সরস্বতী ঠিক কলেরগানের পুরোনো বয়ান ছেড়ে যেতে লাগল–বাপের ঠিক নেই, নষ্ট মাগির পুত, কেলেকুত্তার পায়খানা। ডোমে ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে তোকে টেনে ভাগাড়ে ফেলবে। নিব্বংশের ব্যাটা, মেয়েকে পয়সা দিয়ে ডাল আনতে পাঠিয়েছি–আর মেয়েরও বলিহারি বাবা কোন আকেলে তুই ওই গরুচোরের ব্যাটাকে সোহাগ দেখাতে গেলি! গেল তো ঘাটের মড়ার আক্কেল দ্যাখ! মেয়ের ইজেরের কষি থেকে পয়সা মেরে দিল। বলি ও ঢ্যামনা, পয়সার জন্য তুই না পারিস কী বল দেখি!
বলত আরও। বাবুর বউ বেরিয়ে এসে চোখা গলায় বলল –দ্যাখ সরস্বতী, ছোটলোকের মতো চেঁচাবে তো দূর হয়ে যাও। সাঁটু, তুমিও এক্ষুনি বিদেয় হও। একটা চোর, আর-একটার মুখ আস্তাকুঁড়। আমার বাচ্চাটা এসব শুনে আর দেখে শিখবে। যাও, যাও।
সরস্বতী অবশ্য বাবুর বউকে ভয় খায় না। উলটে তেজ দেখায়। কিন্তু সেদিন আর বাড়াবাড়ি করেনি। শুধু শাসিয়ে রেখেছিল আটাচক্কির বিশেকে দিয়ে মার খাওয়াবে। সেদিনই সন্ধের মুখে বিশে সাঁটুকে ধরে দোকানঘরের পেছনে আবডালে টেনে নিয়ে দিলও ঘা কতক। আরও দিত, সুখচন্দ্র সাড়াশব্দে এসে পড়ে বলল –যাক গে, বারো আনা তো মোটে পয়সা! কিন্তু সুখচন্দ্র মাপ করে তো সরস্বতী করে না। সে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল –মুখ দিয়ে রক্ত বেরোবার পর ছাড়া পাবে। সাঁটুলাল সরস্বতীর পা ধরতে উবু হয়ে বলে বলল –কাল থেকে হবে না।
সাঁটুলাল নিজেকে আজও জিগ্যেস করে–পয়সাটা কি সত্যিই মেরেছিল সাঁটু। সাঁটু শিউরে উঠে বলে–মাইরি না। মা কালীর পা ছুঁয়ে বলতে পারি। শালার পয়সাগুলোই ফক্কড়, বুঝলে! আমাকে জব্দ করতে কোন ফাঁকে সুট করে চলে এল হাতে।
এইসব দুঃখের কথা সাঁটুলাল কাউকে বলতে চায়। উজাড় করে বলবে সব। কিন্তু সাধুটা
সটকেছে। আছেই বা কে?
গতকাল সাঁঝের মুখে বাবুর বউ নদীয়াল মাছ কিনতে পয়সা দিয়ে পইপই করে বলেছিল–দেখো সাঁটু, পয়সার হিসেব দিও। সরে পোড়োনা।
সাঁটুলাল মনে-মনে দিব্যি কেটেছিল–আর নয়। এবার মানুষ হতে হবে। পাঁচজনের কাছে দেখানোর মতো মুখ চাই।
পয়সাটা ফেরত দিত সাঁটু যদি নিজে সে ফিরত। হল কি গ্রহের ফের। বাজারে গিয়ে দেখল নদীয়াল মাছ ওঠেনি। কয়েকটা ন্যাটাং চ্যাং মাছ উঠেছে যা বাবুরা খায় না। পয়সা নিয়ে ফিরেই আসছিল। তেমনি সময়টায় হরগোবিন্দ খবর দিল খাডুবেড়েয় যাত্রা হচ্ছে। যাবে নাকি সাঁটুলাল? আগুপিছু ভাবনা সাঁটুলালের কোনও কালেই ছিল না। চাঁদনি রাত ছিল। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। বাবুর বাড়িমুখো হতে আর ইচ্ছে হল না তার। মনে-মনে ভাবল–আজকের রাতটাই শেষ পাপ তাপ করে নিই। কাল থেকে মাইরি–কাল থেকে ভালো হয়ে যাবে একেবারে। এই ভেবে তাড়ি খেয়ে নিল প্রাণভরে। তারপর খাড়ুবেড়ের রাস্তা ধরল।
আজ তাই ফিরতে একটু লজ্জা–লজ্জা করছে তার। সরাসরি গিয়ে ঢুকে পড়লে বাবুর বউ বড় চেঁচামেচি করবে।
সাঁটুলাল তাই বাজারের দিকে আটাচক্কির দোকানে গিয়ে উঠে বলল কী খবর হে সুখচন্দ্র? ভালো তো?
সুখচন্দ্র বেশ মানুষ। মুখে একটা নির্বিকার ভাব। ঝড় হোক, ভূমিকম্প হোক সুখচন্দ্রের মুখে কোনও শুকনো ভাব নেই। বলল –ভালো আর কই? কাল থেকে নাকি তুমি হাওয়া। বাবুর বাড়িতে খুব চেঁচামেচি হচ্ছে, যাও।
যাচ্ছি। বলে সাঁটুলাল বেঞ্চিতে বসে পড়ে। বিশে চাক্কি চালাচ্ছিল। আটা উড়ছে ধুলোর মতো চারদিকে। হুড়ো দিয়ে বলল যাও যাও। কাজের সময় বসতে হবে না।
সাঁটুলাল দাঁত খেচিয়ে বলে–তুমি কে হে। যার দোকান সে কিছু বলে না তোমার অত ফোপরদালালি কীসের?
লেগে যেত। কিন্তু এ সময়ে সাঁটুর ছেলে বিষ্ণু রাস্তা থেকে উঠে এসে সুখচন্দ্রকে বলল বাবা, মা বলে দিল ফেরার সময় আনাজ নিয়ে যেতে।
সাঁটু প্রাণভরে দেখছিল। তার ছেলে। হ্যাঁ তারই ছেলে। সুখচন্দ্রকে ‘বাবা’ ডাকছে! আহা ডাকুক। ওর ‘বাবা’ ডাকার মতো লোক চাই তো। সে নিজে তো আর মানুষ নয়।
ছেলে বেরোল তো পিছু–পিছু সাঁটুলালও বেরোয়। ছেলে কয়েক কদম হেঁটেই পিছু ফিরে বলে –তুমি আসছ কেন?
সাঁটু একটু রেগে বলে–কেন, তোর বাবার রাস্তা?
–তুমি অন্য বাগে যাও। নইলে মাকে বলে দেব।
–কী বলবি?
–তুমি কুন্তির পয়সা চুরি করেছিলে না? মনে নেই?
–ওঃ চুরি! গঙ্গা-যমুনা খেলতে গিয়ে খুঁড়ি কোথায় পয়সা হারিয়ে আমার ঘাড়ে চাপান দিলে।
–সে যাই হোক, তুমি কাছে আসবে না আমাদের।
–বাপকে কি ভুলে গেলি বুঝি?
ছেলে চলে গেল।
পালপাড়ার পুকুরধারে শেফালি ধরল তাকে। গা ধুয়ে ঘরে ফিরছে। দেখতে পেয়ে বলে–তোমার সঙ্গে কথা আছে।
শেফালি মোটা মানুষ। শরীর ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। ঘামাচিতে গা কাঁথার মতো হয়ে আছে। গোলপানা থোম্বা মুখখানা দেখলে কাতলা মাছের মাথার মতো মনে পড়ে। দাঁতে নস্যি দেওয়ার নেশা আছে। একগাল হেসে বলল –খবর শুনেছ নাকি? তোমার যে আবার ছেলে হবে।
ছেলে কি বাতাসে হয়! সাঁটু অবাক হয়ে বলে–আমার ছেলে হবে কী গো!
–ওই হল! তোমার বউয়ের।
সাঁটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে–কী যে বলো বউঠান!
–বলছি বাপু, শুনে রাখো! তবে এও বলি, সরস্বতীর পেটেরটা যদি তোমার ছেলে না হয় তবে সে তোমাদের সুখবাবুর ছেলেও নয়।
সরস্বতীর ছেলে হবে শুনে সাঁটুলাল খুশিই হল। আহা! হোক, হোক। ছেলেপুলে বড় ভালোবাসে সরস্বতী। ছেলেপুলে নিয়ে সব ভুলে থাকে।
খুশি মনে সাঁটুলাল বলল –ভালো, ভালো।
ভালো কী! অ্যাঁ! ভালোটা কী দেখলে? পাঁচজনে যাই বলুক, আমি তো সুখবাবুর মুরোদ জানি। ছেলের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা সে মেনিমুখোর নেই। থাকলে আমার বাঁজা বদনাম ঘুচত। তুমি বুঝি ভেবেছ সুখবাবুর ক্ষমতায় কাণ্ডটা হচ্ছে? আচ্ছা দিনকানা লোক তোমরা। এ সুখবাবুর কাজ নয় গো। সাঁট আছে।
কীসের সাঁট?
থোম্বা মুখে ঢলাঢলি হাসি খেলিয়ে শেফালি বলে–দেখেও দ্যাখো না নাকি? বিশে যে তোমাকে সেদিন খুব ঠেঙাল সে কেন জানো? বিশেকে যে দীনবন্ধুবাবু তার কারবারে বেশি মাইনেয় লাগাতে চেয়েছিল তাতে বিশে গেল না কেন জানো? সে যে এখানে বিশ টাকা মাইনে আর দুবেলা খোরাকি পেয়ে আঠার মতো কেন লেগে আছে জানো? বোঝো না? বিশে আর সরস্বতীর ভাবসাব দেখেও বোঝো না? চোখ–কান খোলা রেখে চলবে। তাহলে আর পাঁচজনের কাছে শুনে বুঝতে হবে না। যাও, বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাব।
ভাবাভাবির কী আছে তা সাঁটুলাল বোঝে না। দিনের মতো পরিষ্কার ব্যাপার। তবে কিনা সাঁটু এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আসল ব্যাপার হল, সরস্বতীর আবার ছেলে হচ্ছে।
.
বাড়ি ঢুকতেই আগে বাবুর সঙ্গে দেখা। বাগানের রাস্তায় শোয়ানো চেয়ার পেতে বসে বই পড়ছে। কেবল বই পড়ে। শোনা যায় কলেজের খুব নামকরা মাস্টার। মেলা বিদ্যা জানে। যদিও ধান আর চিটের তফাত বুঝতে পারে না। তা সে যা হোক, বেশি বোঝেন না বলেই ভালো। বুঝলে বড় মুশকিল।
বাবু মুখ তুলে দেখে বললেন–সাঁটুলাল যে! কোথায় গিয়েছিলে?
–এই আজ্ঞে। কাল থেকে আর হবে না।
–সে জানি। কিন্তু বাড়ির সবাই ভাবছিল খুব।
–আর হবে না।
বাবু রোগা-রোগা লোক, বেশি কথা বলে না। শুধু গম্ভীর হয়ে বলল –বিশ্বাসী লোক পাওয়া বড় মুশকিল দেখছি।
ভিতর বাড়িটা থমথম করছে। বউদি এই সবে দুপুরের ঘুম থেকে উঠল। মুখ–টুখ ফুলে রাবণের মা। তার ওপর এলোকেশী ঠোঁটে শুকনো রক্তের মতো পানের রস। গলায় কপালে ঘাম। আঁচল কুড়োতে–কুড়োতে কুয়োতলায় যাচ্ছিল, ভিতরের বারান্দায় তাকে দেখে থমকে গিয়ে বলল –তুমি কার হুকুমে বাড়িতে ঢুকেছ? বেরোও এক্ষুনি।
সাঁটুলাল টপ করে কান ধরে ফেলে বলল –কাল থেকে আর হবে না।
ঘুম থেকে উঠলে মানুষের তখন–তখন আর তেমন তেজ থাকে না। বউদিরও রাজ্যের আলিস্যি। হাই তুলে বলল –পয়সাটা ফেরত দেবে তো?
–মাইনে থেকে কাটান দিয়ে দিব বরং।
–চায়ের জল চড়াও গে যাও। বলে বউদি কুয়োর দিকে গেল।
চায়ের জল চড়ানোর কথা সাঁটুলালের নয়। সে বাইরের কাজের লোক। জল তোলে, গরুর দেখাশোনা করে, দুধ দোয়ায়, বাগান করে, কাপড় কাঁচে আর ফাইফরমাশ খাটে। ঘরের কাজ সরস্বতীর ওপর। রান্না বাসন মাজা, ঘর ঝাঁটানো বা মোছা। তাই চায়ের জল করার কথায় অবাক মানে সাঁটুলাল।
কাজ তেমন জানা নেই। তবু পায়ে-পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল। রান্নাঘরের দরজা জুড়ে মেঝেয় আঁচল পেতে সরস্বতী শোওয়া। অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
আহা, ঘুমোক। আবার মা হবে। এ সময়টায় শরীর এলিয়ে যায়। সরস্বতীর হাঁ মুখের কাছে মাছি উড়ছে, বসছে। হাত নেড়ে তাড়াল সাঁটুলাল।
তারপর খুব সাবধানে সরস্ব তাঁকে ডিঙিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে সে। কেরোসিনের স্টোভকে জুত করতে পারছিল না। খুটুরমুটুর করে নাড়ছিল। শব্দ পেয়ে সরস্বতী পাশ ফিরে রক্তচোখে চেয়ে বলল –ও কী! রান্নাঘরে ধুলোপায়ে ঢুকেছ যে বড়! বাইরের জামাকাপড় নিয়ে ছিষ্টি ছুঁচ্ছো! তুমি কি মানুষ? সাতবাসি হেগো মোতা কাপড়। তার ওপর কোথায় কোন আস্তাকুঁড়ে রাত কাটিয়েছ! বেরোও!
সাঁটুলাল সরস্বতীর মুখপানে চেয়ে খুব হাসে। বেশ লাগছে দেখতে। মা হওয়ার চেহারাই আলাদা।
সরস্বতী উঠে বসতে-বসতে বলল –চৌকাঠ পেরোলে কেমন করে বলো তো। আমাকে ডিঙোলে নাকি?
–তা কী করব!
কী করব মানে? জলজ্যান্ত মানুষকে ডিঙোতে হয়?
সাঁটুলাল খুব গম্ভীর মুখ করে বলল –পোয়াতি মানুষ যেখানে সেখানে শুয়ে থাকো কেন? এ সময়টায় অসাবধান হওয়া ভালোনা।
কে জানে কেন, এ কথায় সরস্বতীর মুখে বন্ধন পড়ে গেল। আর একটাও কথা না বলে উঠে চলে গেল বোধহয় কুয়োতলায়। একটু বাদে ভেজা মুখচোখ নিয়ে ফিরে এসে বলল –সরো, আমি চা করছি।
সাঁটুলাল সরল বটে, কিন্তু গেল না। দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল সরস্বতীর দিকে। সরস্বতী টের পাচ্ছে তবু চোখ তুলে তাকাচ্ছে না।
সরস্বতী তাকাচ্ছে না বলে যে সাঁটুকে খাতির দেখাচ্ছে তা নয়। আসলে এই পোড়ামুখখানা দেখাতে তার ইচ্ছেই করে না।
স্টোভের সলতে কমে গিয়েছিল। টিনের চোঙাগুলো খুলে সরস্বতী সলতে টেনে বড় করে দেশলাই জ্বেলে সলতে ধরাল। কেটলি চাপিয়ে কেরোসিনের হাত ধুতে গেল উঠোনবাগে। দেশলাইটা পড়ে রইল মেঝেয়।
সাঁটুলালের দেশলাই ফুরিয়েছে। সেই আধখানা কাঠি দিয়ে কখন একটা বিড়ি খেয়েছে। ভাবাভাবির বড় ঝামেলা। দেশলাইটা তুলে নিয়ে সাঁটু সরে পড়ল। রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। জল তুলতে হবে, গরুর জাবনা দিতে হবে, গোয়ালে ধোঁয়া। তার আগে আবডালে কোথাও বসে ভরপেট বিড়ি খাবে এখন।
তেঁতুলের ঠান্ডা ছায়ায় বসে সাঁটুলাল পশ্চিম আকাশে রঙের বাহার দেখছিল। বিড়ি খেলে মাথাটা খুলে যায়। সব ভালো লাগে কিছুক্ষণ। তাড়ি খেলে আরও খোলে। গাঁজা খেলে তো স্বর্গরাজ্য হয়ে যায় দুনিয়াটা।
বিড়িটা যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন বাবুর ছ’বছরের মেয়ে বাবলি এসে পিছন থেকে গলা। জড়িয়ে ধরল–সাঁটুদা, তুমি পয়সা চুরি করে পালিয়েছিলে?
সাঁটু একগাল হেসে বলে–না। মাইরি না।
–আমি জানি। তুমি পয়সা চুরি করে কাল চলে গিয়েছিলে। কান ধরো।
সাঁটু কান ধরে জিভ কেটে বলে, ছিছি। বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কাল থেকে আর বলব না।
রোজ নতুন-নতুন সব ব্যাপার শিখেছে বাবলি। আজকাল ইস্কুলে যায়। ইস্কুল থেকে কত কী শিখে আসে। যেমন এখন বাবলি একটা শুকনো গাছের ডাল কুড়িয়ে এনে বলে হাত পাত।
সাঁটু হাত পাতে। বাবলি দুর্বল হাতে গাছের ডালটা দিয়ে সাঁটুর হাতে মারে। বলে, আর করবে?
–না গো।
–নীলডাউন হও।
সাঁটু নীলডাউন হয়।
আর কী করবে ভেবে না পেয়ে বাবলি–আচ্ছা, হয়েছে। মেরেছি তো! শাস্তি দিয়েছি তো! এসো, এবার আদর করি।
বলে কাছে এসে বাবলি সাঁটুর মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে বলে–যাট, ষাট, ষাট। লেগেছে সাঁটুদা?
বড় যন্ত্রণা হল সাঁটুর বুকটার মধ্যে। এক পুকুর জল উঠে আসতে চায় চোখে। মাথা নেড়ে বলে–না, না, লাগেনি। আমি চোর খুকুমণি, তাই আমার ছেলেপুলেরাও আমাকে ঘেন্না পায়। তুমি রোজ মেরো আমাকে। বুঝলে?
–এমন শাস্তি দেব তোমাকে রোজ সাঁটুদা, দেখবে ভয় পেয়ো না, আবার ষাট করে দেব।
ভিতর বাড়িতে দেশলাই নিয়ে ফের চেঁচামেচি হচ্ছে। হোক। সব দিকে কান দিলে হয় না। সাঁটুলালের অনেক কাজ। তাই উঠে গোয়ালঘরের দিকে গেল।
সন্ধের পর বাগানের রাস্তা থেকে বাবুর শোয়ানো চেয়ার আর জল বা চা রাখবার ছোট টুল তুলতে গিয়ে সাঁটুলাল সিগারেটের প্যাকেটটা পেয়ে গেল। তাতে দু-দুটো আস্ত সিগারেট। সাঁটু খুব অভিমানভরে ভাবল, নিলে লোকে বলবে চোর। কিন্তু এই যে হাতের নাগালে দুটো সিগারেট তার ভাগ্যে পড়ে আছে, এর মধ্যে কি ভগবানেরও ইচ্ছে নেই?
সাঁটু সিগারেটের প্যাকেটটা কামিনীঝোঁপের মধ্যে খুঁজে রেখে দিল। রাতে ভাত খাওয়ার পর জমবে ভালো।
রাতের কাজ সেরে সরস্বতী বিদেয় নিয়েছে। বিকেলে দেশলাই নিয়ে আজ আর বেশি চেঁচায়নি। মুখোমুখি দেখা হতে তেমন চোখে চোখে তাকায়ওনি লাল চোখ করে। বাবু আর বউদিও আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে গেল।
বাইরের বারান্দায় শতরঞ্চি আর একটা কাঁথা পেতে শুয়ে সিগারেট টানছিল সাঁটুলাল। ঠিক সে সময়ে অন্ধকার কুঁড়ে সরস্বতী উঠে এসে বলল –আমি পোয়াতি–এ কথা কে বলল তোমায়?
সাঁটু শুয়ে-শুয়েই ঠ্যাং নাচাতে-নাচাতে বলে–আমার সঙ্গে থাকতে তিনবার হয়েছিলে, লক্ষণ সব চিনি কি না। বলবে আবার কে?
সরস্বতী উবু হয়ে বসে বলে–মিছে বলো না। শেফালি কুচ্ছো গেয়ে বেড়াচ্ছে। তার কাছেই শুনেছ। আচ্ছা পাজি মেয়েছেলে যা হোক। নিজের হবে না, অন্যের হলে শতেক দোষ খুঁজবে। এসব কথা জানাজানি হলে সুখকর্তা আর রাখবে ভেবেছ?
সাঁটুলাল মাথা চুলকোয়।
সরস্বতী আস্তে করে বলল –শোনো, তুমি সুখচন্দ্রকে বুঝিয়ে বলবে যে, তোমার সঙ্গে যখন থাকতুম তখনও আমার চরিত্রের দোষ ছিল না, এখনও নেই। বুঝলে? তোমার মুখের কথার দাম হবে। নইলে সুখচন্দ্র আজ রাতে ওই মাগির কাছে থাকতে গেছে, রাতভর এমন বিষ ঢালবে কানে যে, পুরুষটা বিগড়োবে। কালই গিয়ে সুখচন্দ্রের সঙ্গে বসে নানা কথার মধ্যে এক ফাঁকে কথাটা তুলো।
উদাসভাবে সাঁটুলাল বলে–তুলব’খন।
–তুলো! তুমি লোক খারাপ নয় আমি জানি। দুটো টাকা রাখো। বলে আঁচলের গেরো খুলে ভাঁজ–করা টাকা বের করতে যায় সরস্বতী।
ভারী লজ্জা পায় সাঁটুলাল। বলে–আরে থাক, থাক। ওসব রাখো।
–নাও। বিড়িটিড়ি খেও। মাসে দশ টাকা মাইনে পাও, তাতে কী হয়। রাখো এটা। আমি সদর ভেজিয়ে রেখে চলে এসেছি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
–হ্যাঁ, যাও। চারিদিকে ভারী চোর-ছ্যাঁচোড়।
–সে জানি। বলে সরস্বতী আঁধারে মিলিয়ে যায়।
সাঁটুলাল দু-নম্বর সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। সরস্বতী বলে গেল, সে নাকি ভালো লোক। সত্যিই কি আর বলেছে! মন রাখা কথা। কিন্তু যদি সত্যিই তাকে ভালো লোক বলে জানত সবাই।
হাতের সিগারেটটার দিকে চেয়ে রইল সাঁটুলাল। ভারী রাগ হল নিজের ওপর। আচমকা সিগারেটটা প্রায় আস্ত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের দু-গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটা চড় দেয়।
রাগ তাতে কমে না। নিজের ঘাড় ধরে নিজেকে তোলে সে। তারপর নিজেকে নিয়ে ফটকের বার করে দিয়ে বলে–যা হারামজাদা আহাম্মক ছ্যাঁচড়া চোট্টা কোথাকার! ফের যদি আসিস তো জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।
এই বলে হাত ঝেড়ে সাঁটুলাল ফিরে আসে। কালই গিয়ে সুখচন্দ্রকে বুঝিয়ে আসবে যে, সরস্বতী বড় সতী মেয়ে। তার গর্ভে সুখচন্দ্রেরই ছেলে। আর টাকা দুটোও ফেরত দেবে সরস্ব তাঁকে। সে ঘুষ–টুষ খাবে না আর। পুরোনো সাঁটুলাল বিদেয় নিয়েছে।
খুব আনন্দে খানিক ডগমগ হয়ে বসে রইল সাঁটুলাল। মনটা ভারী বড়সড় হয়ে গেছে। বুকে যেন হাওয়া–বাতাস খেলছে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
কামিনীঝোঁপের নীচে পড়ে থাকা সিগারেটটা ধোঁয়াচ্ছে। এখনও অনেকটা রয়েছে। খামোকা পয়সা নষ্ট।
সাঁটুলাল গিয়ে সিগারেটটা তুলে আনল ফের। বসে-বসে মনের সুখে টানতে লাগল। দেশলাইটা নেড়ে দেখল অনেক কাঠি রয়েছে। বাঁ-ট্যাঁকে সরস্বতীর দেওয়া টাকাটা।
সাঁটুলাল ভাবল–এই শেষ পাপ–তাপ বাবা। কাল থেকে ভালো হয়ে যাচ্ছি।