পেঁপেসেদ্ধ
যারা টিফিনে পেঁপেসেদ্ধ খায় আমি তাদের খুবই শ্রদ্ধা করি।
কেন মশাই, যারা পেঁপেসেদ্ধ খায় তাদের শ্রদ্ধা করার কী আছে?
যারা এভারেস্টে ওঠে, বানজি জাম্প দেয় বা ট্রাপিজের খেলা দেখায় তাদের প্রতি কি আমাদের শ্রদ্ধা হয় না? আমি যা পারি না তা আর একজন যখন অনায়াসে পারে তখন শ্রদ্ধাকে। ঠেকানো মুশকিল।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি পেঁপেসেদ্ধ পছন্দ করেন না।
আমি পেঁপেকে শ্রদ্ধা করি, যে খায় তাকেও শ্রদ্ধা করি।
বুঝেছি মশাই, আপনার কথার মধ্যে একটা প্যাঁচ আছে। প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ এবং চোরা ব্যঙ্গ। আমি পেঁপেসেদ্ধ খাচ্ছি বলে আপনার অসুবিধে হচ্ছে না তো!
না। মানুষকে খেতে দেখলে আমার বড় ভালো লাগে। পার্কের ওই দক্ষিণ কোণের ফুটপাথে দেখবেন দুপুরে পশ্চিমিরা পেতলের থালায় ছাতু মেখে খায়। আমি সুযোগ পেলেই দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখি। কিংবা ধরুন অফিস পাড়ায় টিফিনের সময় বাবুরা যে রাস্তায় চাউমিন, রোল বা ঘুঘনি দিয়ে রুটি সাঁটে সেই দৃশ্যটাও কিন্তু ভারী সুন্দর। তারপর ধরুন, সুন্দরী মেয়েরা যখন আকাশমুখো হয়ে হাঁয়ের মধ্যে জলভরা ফুচকা ফেলে তখন সেই দৃশ্য দেখে আমার বড় আনন্দ হয়। মানুষ খাচ্ছে, তাদের পেট ভরছে, তৃপ্তি হচ্ছে এ তো অতি সুন্দর ঘটনা। আপনি যে এই নিরিবিলিতে দুপুরের পার্কে গাছের ছায়ায় বসে পেঁপেসেদ্ধ খাচ্ছেন এরও সুষমা আছে।
পেঁপে সম্পর্কে আপনার বিরূপ ধারণা থাকতেই পারে, কিন্তু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, পেঁপের মধ্যে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ এবং হজমের সহায়ক উপাদান আছে। তাই নয় কি?
হ্যাঁ, পেঁপে অত্যন্ত উপকারী জিনিস।
তাহলেই বলুন। আর ভগবান কিন্তু সব খাদ্যের মধ্যেই এক একটি স্বাদ দিয়ে রেখেছেন। পেঁপের স্বাদও কিন্তু অতি ভালো। আমার বউ এতে বিটনুন এবং গোলমরিচ মাখিয়ে দেয় বলে স্বাদটা আরও খোলে।
হ্যাঁ, পেঁপের স্বাদগন্ধের গুণগ্রাহী মহান মানুষেরা আমাদের ঈর্ষারই পাত্র।
আপনি বেশ গোলমেলে লোক মশাই। তা সে যাই হোক, আমি রোজই কিন্তু এই পেঁপেসেদ্ধ দিয়েই টিফিন করি। ওই যে হলুদ বাড়িটা দেখছেন ওইটেই আমার অফিস। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। আড়াইটের পর একটু ফাঁক পেয়ে আমি এই পার্কে চলে আসি। প্রকৃতির মধ্যে বসে, গাছের ছায়ায় নিশ্চিন্তে টিফিন খাই। এটাই আমার বিলাসিতা।
আপনি ঠিক কাজই করেন। যে কোনও আস্বাদনের জন্য নিরিবিলিতে বসা প্রয়োজন। জীবনানন্দের কবিতা, বিভূতিভূষণের উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথের নাটক ওসব ঠিক নিরিবিলি না হলে সুবিধে হয় না।
আপনি ওসব পড়েন বুঝি! সেইজন্যেই আপনার কথায় একটু সাহিত্য–সাহিত্য গন্ধ পাচ্ছি। কম বয়সে আমিও পড়তাম। শরৎচন্দ্রের দেবদাস তো এক সময়ে প্রায় মুখস্থ ছিল। তারপর রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, নীহার গুপ্তের হাসপাতাল। এখন আর পড়াটড়া হয় না।
ভালোই করেন। সাহিত্য না পড়েও দুনিয়ার বারো আনা লোকের দিব্যি চলে যাচ্ছে। আমারও দৌড় বেশি দূর নয়। বেকার জীবনে সময় কাটত না বলে পড়তাম।
বেকার ছিলেন বুঝি? এখন কি চাকরি পেয়েছেন? ওই সামান্য একটা। তবে বেকারজীবনটা বড্ড ভালো ছিল। কেন মশাই, বেকারজীবনে ভালোটা কী? বাড়িতে গঞ্জনা, দোকানে ধারবাকি, পকেটমানির অভাব।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, তা বটে। তবু কতটা সময় পাওয়া যেত বলুন।
বেশিদিন বেকার থাকাটা মোটেই কাজের কথা নয়। তাতে ভিতরে ভিতরে মরচে পড়ে যায়। আপনার নামটি কী মশাই?
শুভাশিস মিত্র।
আমার নাম পীযূষ গুহ। আপনি চাকরি করেন, কিন্তু এই উইক ডে–তে দুপুরবেলা পার্কে এসে বসে আছেন যে?
আসলে আমার অফিসটাও কাছেই। দুপুরবেলা টিফিনের একটু ছুটি হলে আমি হাঁপ ছাড়তে এখানে চলে আসি কিংবা রাস্তায়–রাস্তায় ঘুরি। অফিসের বন্ধ ঘরে বসে থাকার ধাতটা এখনও তৈরি হয়নি। বেকারজীবনে ফ্যা–ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা একটু ঘুরে গেছে।
না-না, এটা ভালো কথা নয়। নতুন চাকরি, প্রথমেই অত লিবার্টি নেবেন না। বরং ছুটির পরেও কিছুক্ষণ কাজ করবেন, তাতে ইমপ্রেশন ভালো হয়। আমি পঁচিশ বছর চাকরি করছি মশাই, সব জানি। তা সরকারি চাকরি না বেসরকারি?
বেসরকারি।
বড় কোম্পানি?
না, মাঝারি।
তা হোক, লেগে থাকাটাই আসল। চাকরির যা বাজার, একটা যেমন তেমন চাকরি পাওয়াও কঠিন।
তা তো ঠিকই।
বাড়িতে কে কে আছে?
মা, আর আমি।
বাবা কি নেই?
আছেন।
কোথায়?
দিল্লিতে।
চাকরি করেন বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
দিল্লি বড় ভালো জায়গা। নিট অ্যান্ড ক্লিন। তা আপনার বাবা মাঝে-মাঝে আসেন তো!
সময়ে পেলে আসেন।
আপনারা যান না?
তাও যাই।
ভাইবোন নেই?
আজ্ঞে না।
আপনার চাকরিটা কী ধরনের?
সব চাকরিই তো ফাইফরমাশ খাটবার কাজ। তাই না? এটা করো, সেটা করো, ওটা ভুল হল কেন?
না মশাই, আপনার হাবভাব আমার ভালো ঠেকছে না। চাকরিতে মন নেই কেন আপনার?
আমার মাও ওই কথাই বলে। আমার নাকি চাকরিতে মন নেই।
এ বাজারে চাকরি গেলে আবার পাওয়া মুশকিল।
জানি। ওপরওয়ালা আমাকে তেমন পছন্দও করেন না। বলছে, তোমরা স্বভাবটা বড় উড়
সর্বনাশ! একে প্রাইভেট অফিসে চাকরি, তার ওপর কর্তৃপক্ষের বিষনজর! আপনি তো বিপদে পড়বেন মশাই।
বিপদ! হ্যাঁ, বিপদই তো! তবে যদি চাকরিটা চলে যায় তাহলে আমার খুব একটা দুঃখ হবে। বেকারজীবনটার কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হয়।
এই রে! অতিরিক্ত সাহিত্যপাঠের এটাই হল কুফল। এই জন্যই বাড়িতে সাহিত্য–টাহিত্য আমি ঢুকতে দিতে চাইনি।
তবু কি সাহিত্য আপনার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে?
আর বলবেন না মশাই। আমার বউটির জন্যই। সে আবার সাহিত্যপাগল লোক। বই না পড়লে ভাত হজম হয় না। ওই বদ অভ্যাস আমার ছেলেমেয়ে দুটিও পেয়েছে। তবে ভাগ্য ভালো যে, তারা উচ্ছন্নে যায়নি। লেখাপড়ায় ভালোই। মেয়ে তো চাকরিও করছে।
বাঃ!
দেখবেন মশাই, যা করার চাকরি বাঁচিয়ে করবেন।
চাকরিটা নিয়েই তো সমস্যা। চার দেওয়ালের ভিতরে যতক্ষণ আটকে থাকি, ততক্ষণ মনে হয় যেন কবরখানা। বাইরে বেরোলেই মনে হয় মুক্তি।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, সে তো আমাদের সকলেরই প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগে। কিন্তু পরে অভ্যাস হয়ে যাবে দেখবেন। এখন মাথার ওপর বাবা আছেন বলে হয়তো সংসারের প্রেশার টের পাচ্ছেন না। কিন্তু প্রেশার যখন আসবে তখন বুঝবেন চাকরিটার মূল্য কতখানি।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, সে তো বটেই।
তারপর ধরুন, বিয়েও তো করতে হবে, তখন দায়িত্ব বাড়বে। চাকরি না হলে কি চলে?
বিয়ে?
নয় কেন? বাপের এক ছেলে, বংশরক্ষা করতে হবে না?
কিন্তু বিয়ে করলে যে আরও মুশকিল হবে।
কীসের মুশকিল?
আরও বন্ধন। ইচ্ছে করলে চাকরি ছেড়ে বেরোতে পারব না।
চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছেন কেন?
আমি ভাবছি না, চাকরিটাই ছেড়ে দিতে চাইছে আমাকে।
মাইনে কত দেয়?
দেয় কিছু। আমার চলে যায়।
চার-পাঁচ হাজার?
ওরকমই। কিছুকমবেশি।
খুব খারাপ তো নয়। তাহলে চাকরিটা আপনার ভালো লাগছে না কেন?
আমার তো সেটাই প্রবলেম। আমার কলিগরাও আমাকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করে।
প্রেমেট্রেমে পড়েছেন কখনও? কেন বলুন তো!
অনেক সময়ে প্রেমে পড়লে উড়ুউড়ু উড়নচণ্ডী ভাবটা কেটে যায়। স্বভাব বাউণ্ডুলেদের দাওয়াই হল প্রেম।
না, মেয়েরা আমাকে পছন্দ করে না।
কেন, আপনি তো বেশ হ্যান্ডসাম, স্মার্ট লুকিং।
প্রেমের ব্যাপারেও আমি বোধহয় সিরিয়াস নই। মেয়েরা আমাকে অ্যাট্রাকটিভ মনে করে না। হাসালেন মশাই, আজকালকার মেয়েরা কত অপদার্থ, ভ্যাগাবন্ড আর কাঁকলাস চেহারার ছেলেদের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর আপনার মতো উজ্জ্বল চেহারার ইয়ংম্যানের লাভার জুটছে না এ কি হয়? আপনি বোধহয় মেয়েদের ভয় পান।
ঠিক উলটো। আমার মনে হয়, মেয়েরাই আমাকে অ্যাভয়েড করে।
কেন করে ভেবে দেখেছেন?
না।
তাহলে ভাবুন এবং নিজেকে মেরামত করুন। ও কি, মুখটা অমন করুণ হয়ে উঠল কেন?
আমি তাহলে একটা ঘটনার কথা বলতে পারি।
বলুন না।
কিন্তু আপনার হাতে কি সময় আছে? আপনি তো পেঁপেসেদ্ধ শেষ করে টিফিনের বাক্স বন্ধ করে ফেলেছেন। এবার বোধহয় অফিসে ফিরবেন?
আরে তাতে কি? পঁচিশ বছর চাকরি হয়ে গেছে, আর চোদ্দো মাস পরে রিটায়ার করব। এখন একটু-আধটু লিবার্টি নিতেই পারি। দেরি হলেও কেউ কিছু বলবে না।
তাহলে বলব কি?
স্বচ্ছন্দে?
আমি যখন বেকার অবস্থায় ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি সেই সময়ে হঠাৎ একদিন সকালে রাস্তায় একটি মেয়েকে দেখে ভারী অবাক হয়ে যাই। মেয়েটি খুব একটা লম্বা নয়, বেঁটেও নয়, খুব ফরসা নয়, কালোও নয়। রোগাটে হলেও রোগাও বলা যায় না। কিন্তু আশ্চর্য এবং অদ্ভুত হল তার মুখখানা। মুখখানা যেন মুখের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এত নমনীয়, কোমল লাবণ্য চোখেই পড়ে না। আর ভারী মিষ্টি ছিল তার চোখ দুখানা। মায়ায় ভরা। তাকে দেখেই কেমন যেন আমার অস্তিত্বের মূল টলে গেল। তার আগে বা পরে কোনও মহিলাই আমাকে এত বিচলিত করেনি। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো, হিপনোটিক একটা স্পেলের মধ্যে তাকে পাছে হারিয়ে ফেলি এই ভয়ে ফলো করতে শুরু করি। আজকাল মেয়েদের ফলো করা–টরা উঠেই গেছে। ওসব আপনাদের আমলে ছিল।
তা বটে।
কিন্তু আমি এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করার সাহস পেলাম না, যদিও সেটাই স্বাভাবিক হত। ফললা করে করে আমি শেষ অবধি একটা গলির মুখ অবধি যেতে পেরেছিলাম। মেয়েটা গলির মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় আমি আর সাহস করে এগোতে পারলাম না। খুব নার্ভাস লাগছিল।
আচ্ছা, তারপর?
আমি গলিটা চিনে রাখলাম। পরদিন সকালে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম গলির উলটোদিকে। ঘণ্টাখানেক বাদে সে বেরোল এবং আমি তাকে আবার ফলো করতে শুরু করলাম। কলেজ অবধি।
কোন কলেজে?
এসব এখন গোপন থাক।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলুন।
বাড়ির গলি এবং কলেজ দুটোই আমার চেনা হল। এবং রোজই ফলো করা চলতে লাগল। এবং আমার নার্ভাসনেস, ভয় এবং লজ্জা আরও বাড়ল। বাড়ল তার প্রতি আকর্ষণ। মেয়েটা প্রথম কিছুদিন আমাকে লক্ষ করেনি। তারপর করল।
কী করে বুঝলেন?
ওসব বোঝা যায়।
মেয়েটা আপনাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছিল কি?
আজ্ঞে না। বরং মুখে বিরক্তি এবং পায়ে সন্ত্রস্ত ভাব দেখতে পেতাম। তেমন জাঁহাবাজ মেয়ে হলে গার্জিয়ান বা পাড়ার দাদাদের দিয়ে হামলা করাতে পারত। সেসব করায়নি। কিন্তু কাঠিন্য দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, ব্যাপারটা সে পছন্দ করছে না।
এমন হতেই পারে। হয়তো তার কোনও বয়ফ্রেন্ড ছিল। আজকাল তো লেজুড় জুটতে দেরি হয় না।
হ্যাঁ, সেটা একটা সম্ভাবনা বটে। আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু তার বয়ফ্রেন্ড থাকলে কোনও না কোনও সময়ে দেখা যেত হয়তো। কিন্তু সেরকম কাউকে মঞ্চে অবর্তীণ হতে দেখিনি। আমার চিন্তারাজ্যের যাবতীয় লজিক উধাও হল, আমি সবসময়ে তাকে নিয়ে নানা সম্ভব–অসম্ভব চিন্তা করতাম এবং সবই পরাবাস্তব চিন্তা। ঠিক এরকম ইনফ্যাচুয়েশন এ যুগের ছেলেদের হওয়ার কথাই নয়।
হুঁ-হুঁ, খুব কঠিন।
মেয়েটির ব্যক্তিত্ব ছিল সাংঘাতিক। কখনও উগ্র সাজে সাজত না। খুব সাদামাটা পোশাক পরত, সঙ্গীসাথীও বিশেষ দেখিনি। যখন কলেজ থেকে বেরোত তখন দুজন বা তিনজন বান্ধবী কখনও-সখনও সঙ্গে থাকত।
নামটাম বা ঠিকানা জানার চেষ্টা করেননি?
না। কারণ উপায় ছিল না।
তাহলে তো লস্ট কেস।
ঠিক তাই। মাত্র মাস তিনেক বাদে একদিন মেয়েটি গলি থেকে বেরোল না। পরদিনও না। তারপর দিনও না। মেয়েটি সম্পূর্ণ মুছে গেল।
অ্যাঁ! কোথায় গেল?
আমার অনুমান কোনও একটা ছুটির মধ্যে তারা বাড়ি পালটে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল।
এঃ হেঃ। আপনি তখন কী করলেন?
বুঝতেই পারছেন। আমি কয়েকদিন সম্পূর্ণ বেহেড হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর এম বি এ পড়তে দিল্লি চলে যাই।
কী বললেন! এম বি এ?
হ্যাঁ। বাপ রে! দিল্লির সেই বিখ্যাত ইনস্টিটিউটে নাকি?
ইয়ে–ওই আর কি!
তাহলে তো আপনি সোজা লোক নন! এম বি এ পাস। আহা, অমন লজ্জা পাওয়ার কি আছে! শিক্ষা কি লজ্জার ব্যাপার?
ওটা কিছু নয়। গুরুত্ব দেবেন না।
ঠিক আছে, দিচ্ছি না। তারপর?
কলকাতায় এসে আমি এই অফিসটায় চাকরি পেয়ে যাই।
বেতনের কথাটা কি আবার জিগ্যেস করব?
আর লজ্জা দেবেন না। এটা অর্থনৈতিক গল্প নয় কিন্তু।
বুঝলাম। বলুন।
চাকরি পেয়ে যাওয়ার পরই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটল। আমি দেখলাম, মেয়েটিও এই অফিসেই চাকরি করছে।
বলেন কি?
হ্যাঁ, সে আমার সহকর্মী।
এ তো দারুণ গল্প! এবার নিশ্চয়ই–
না। আপনি যা ভাবছেন তা নয়। মেয়েটা ঠিক আগের মতোই কঠিন ও অবিচল। লক্ষ করলাম, অফিসের কেউই তাকে ঘাঁটায় না। সবাই প্রবল সমীহ করে এবং দূরত্ব বজায় রাখে।
মেয়েটা কি আপনাকে চিনতে পারল?
না পারার কথা নয়। কিন্তু সেটা একেবারেই প্রকাশ করল না। এমনকী কোনও সূত্রেই আমার সঙ্গে পরিচয় বা বাক্য বিনিময়ও করল না।
এরকমও হয় নাকি?
খুব প্রয়োজন হলে সে বেয়ারা দিয়ে আমার কাছে নোট পাঠায়। কখনও নিজে যেচে কথা বলে না।
আর সকলের সঙ্গে বলে?
হ্যাঁ। প্রয়োজনে সকলের সঙ্গেই কথা বলে। বাদ শুধু আমি।
লক্ষণটা ভালো না খারাপ?
জানি না। এসব ব্যাপারে আমি খুবই অনভিজ্ঞ।
আপনি নিজে কথা বলার চেষ্টা করেননি?
পাগল নাকি? মেয়েটিকে দেখেই আমি এমন নার্ভাস হয়ে পড়ি যে ভালো করে তাকাতেও পারি না।
আপনার অফিসে ক’টা মেয়ে কাজ করে?
অনেক। অধিকাংশ স্টাফই তো মহিলা। তাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ সুন্দর দেখতে। আমাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তো কোনও একটি বিউটি কন্টেস্টে মিস কী যেন হয়েছিল।
তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীরকম?
অত্যন্ত ফ্রেন্ডলি। জড়তাহীন সম্পর্ক।
আপনি কি ওই মেয়েটির কারণেই চাকরি ছাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন?
বোধহয় ওই মেয়েটিই প্রধান কারণ।
সে কি আপনার অধস্তন? আমাদের অফিসে ঠিক ওরকম কিছু হায়ারার্কি নেই। সবাই নিজের নিজের কাজ করে। প্রত্যেকেই প্রফেশনাল। প্রাইভেট অফিসে কেউ কোনও সুবিধে পায় না। সবাইকেই প্রচণ্ড কাজ করতে হয়। বসিং ব্যাপারটা দরকার হয় না। অফিসের মোটো হচ্ছে, ইট ইজ এ ফ্যামিলি।
হ্যাঁ। আজকাল এরকম একটা স্লোগান শোনা যাচ্ছে বটে। তাতে নাকি কাজ ভালো হয়।
হ্যাঁ।
আপনার কোম্পানির অন্য কোনও ব্রাঞ্চ নেই?
আছে। বোম্বে, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর। হেড অফিস দিল্লি।
আপনি বদলি হয়ে যেতে পারেন না?
পারি। কিন্তু কলকাতার অফিসটা নতুন। এখানে কনসেনট্রেট করা বেশি প্রয়োজন বলেই আমাকে এখানে কাজ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আমাকে অন্যান্য অফিসেও ট্যুর করতে হয়।
একটা কথা বলব?
বলুন। মেয়েটির কোনও বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা খোঁজ নিন।
দিগন্তে সেরকম কোনও মেঘ এখনও দেখা যায়নি।
যা দেখা যায় না তা কি নেই? হয়তো বয়ফ্রেন্ড এখন বিলেত বা আমেরিকায়। কিংবা অন্য কোথাও চাকরি করছে। মেয়েটি তার জন্যই অপেক্ষায় আছে।
সর্বনাশ!
কী হল?
একথাটা ভাবিনি তো!
এটাও তো সম্ভব!
হ্যাঁ। খুবই সম্ভব।
লক্ষণ দেখে আমার সে কথাই মনে হচ্ছে।
হাঁ। আমারও তাই মনে হচ্ছে।
তাহলে?
সেক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। বয়ফ্রেন্ড না থাকলেও কিছু করার ছিল না অবশ্য।
আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?
কী করবেন?
আমি মেয়েটিকে অ্যাপ্রোচ করতে পারি।
করে?
আমি একজন বয়স্ক মানুষ, কাজেই সে আমাকে হয়তো অসম্মান করবে না। আমি তার অবস্থানটা জানবার চেষ্টা করতে পারি।
সেটা কি খুব খারাপ দেখাবে না?
হুঁ। আপনি তো বেশ পাকিয়ে তুললেন দেখছি।
সমস্যা আছে বটে। সমাধানও আছে।
কী সেটা?
আমার ফের ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাওয়া। মাকে আমি বলেছি যে, চাকরি করতে আমার ভালো লাগছে না। আমাদের গ্রাসাচ্ছদন কোনওরকমে চলে যাবে। আমার মা তাতে খুব একটা আপত্তি করেনি। মা বরাবরই আমার সাপোর্টার।
ভ্যাগাবন্ড হলেই কি সমস্যা মিটবে?
হ্যাঁ। ছুটি পেলে আমি ফের আগের মতো রাস্তায়–রাস্তায় ঘুরব। গাঁয়ে–গঞ্জে চলে যাব। আপনার জানার কথা নয়, যে, আমি গান লিখি, সুর দিই এবং গাই।
তাই নাকি?
আমি ছবি–টবিও আঁকতে পারি। এক সময়ে সেসবই আমার প্রিয় বিষয় ছিল। অফিসে বন্দি হওয়ার জন্য আমার জন্ম নয়। মুক্ত, চিন্তাশীল, দায়িত্বহীন জীবনে ফিরে যেতে পারলে আমি এসব ছোটখাটো ব্যাপার ভুলে যেতে পারব।
আপনি যে একজন কালচারগেঁড়ে তা আপনাকে দেখেই আমি বুঝেছি। সত্যি কথা বলতে কি আপনি একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন, বাস্তববোধবিবর্জিত, ইমপ্র্যাকটিক্যাল, ভাবালু এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন মানুষ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি ঠিক ওইরকম।
এইসব ভৎর্সনা শুনেও আপনি যে বিন্দুমাত্র অপমান বোধ করলেন না এবং আপনার চোখ যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাতেই বুঝতে পেরেছি যে, আপনার জীবনে উন্নতির কোনও আশা নেই। এ যুগের মেয়েরা আপনার মতো পুরুষকে পছন্দ করার মতো আহাম্মক নয়। তবে একথাও আমাকে কবুল করতে হবে যে, আপনার মতো দু-একটা পাগল ধারে কাছে না থাকলে পৃথিবীটা। সহনীয় হত না। আপনার সম্পূর্ণ অপদার্থতা সত্বেও আপনাকে আমার বেশ ভালোই লাগছে।
ধন্যবাদ, অজস্র ধন্যবাদ।
যদিও আপনার মতো ভাবালু লোক কোনও মহিলাকে বিয়ে করলে তার জীবনটাই বরবাদ হবে, তবু আপনার মতো লোকেরই বিয়ে করাটা জরুরি। তেমন মেয়ে হলে সে আপনার মাথা থেকে ভাবের ভূত ঝেড়ে তাড়াবে। বিয়ের পর পুরুষদের নানারকম পরিবর্তন হয়ে থাকে।
আপনি বেশ বিজ্ঞ মানুষ।
বিজ্ঞ নই, অভিজ্ঞ।
সঞ্চিত অভিজ্ঞতাই তো বিজ্ঞতা!
তাহলে এই বিজ্ঞ লোকটির একটা কথা শুনুন। এইবেলা চোখ বুঝে চট করে একটা বিয়ে করে ফেলুন। তাতে প্রেমজ্বর সেরে যাবে। যে মেয়েটা আপনাকে পাত্তা বা মূল্য দিচ্ছে না, ফিরেও তাকাচ্ছে না, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে তার জন্য বিবাগি হওয়াটা কি পুরুষ মানুষের কাজ? সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ের তো অভাব নেই।
সেটা কি নিজের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না? যে মেয়েটিকে আমি বিয়ে করব তার প্রতিও হয়তো অবিচারই করা হবে।
আরে মশাই, বিয়ের পর দেখবেন ওই ধিঙ্গি মেয়েটাকে ভুলে যেতে আপনার সাতদিনও লাগবে না। আমার মেয়েকেও তো আমি ওই কথাই বলি।
কী বলেন?
এমনিতে আমার মেয়ে ভীষণ স্ট্রং মর্যোলের মেয়ে, ছেলেদের পাত্তা দেয় না, সিরিয়াস টাইপের। পড়াশুননা আর নিজের কাজ নিয়ে থাকে। কথাও বলে কম। কিছুদিন হল দেখছি খুব অন্যমনস্ক, অস্থির, রাতে ভালো ঘুম হয় না। চাপা স্বভাবের বলে কিছু ভেঙে বলেও না। আমরা বুঝতে পারছি, কারও প্রেমেট্রেমে পড়েছে এবং সেটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ওর মা অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেও কথা বের করতে পারেনি। তবে আমার ছেলের কাছে নাকি একদিন বলেছে, সে চাকরি ছেড়ে দেবে।
সে কী? চাকরি ছাড়ার মতো কী হল?
আমাদের কাছে তো বলে না। তবে দাদার সঙ্গে খুব ভাব। দাদাকে নাকি কথায়-কথায়। বলেছে, সে তার টপ বসের প্রতি মনে-মনে ভীষণ সফট হয়ে পড়েছে, কিন্তু এক্সপ্রেস করা সম্ভব। নয়। তাই চাকরি ছাড়তে চায়। চাপা এবং অহংকারী মেয়েদের তো ওটাই প্রবলেম কি না।
ঠিকই বলেছেন। ভীষণ প্রবলেম।
আমাদের প্রবলেম কী জানেন?
কী বলুন তো!
মেয়েকে কিছুই বলার মতো সাহস আমাদের নেই। আমার মেয়ের ভীষণ স্ট্রং পারসোনালিটি। শি ইজ অ্যান অ্যাভিড অ্যানিম্যাল লাভার, যে কারণে নিরামিষ খায়, তার ওপর স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে বলে জাংক ফুড বা ভাজাভুজি বাড়িতে একরকম বন্ধ করে দিয়েছে। ওর জন্য আমরা তটস্থ। নিজের কোনও প্রবলেম হলে বরাবর নিজেই সলভ করে, কখনও আমাদের সাহায্য নেয় না। এই যে দশ-বারো হাজার টাকা বেতনের চাকরিটা পেল এটাও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। কারও সুপারিশে নয়।
হ্যাঁ, আমি জানি।
আপনি জানেন! তার মানে?
না, মানে ওরকম মেয়ের পক্ষে ওটাই তো স্বাভাবিক কি না।
একজ্যাক্টলি। মাঝখানে আমরা ওর বিয়ের জন্য একটু সম্বন্ধ–টম্বন্ধ করছিলাম। কিন্তু পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে শুনলে এমন খেপে যায় যে, আমরা রণে ভঙ্গ দিয়েছি।
আমি ভদ্রমহিলার পোট্রেটটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
ভিসুয়ালাইজ করলেন তো!
হ্যাঁ।
আমার ছেলেও ভালো চাকরি করে। কেমিক্যাল ইনজিনিয়ার। সে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। সেই মেয়েটি আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসেটাসে, আমাকে বাবা আর আমার স্ত্রীকে মা বলে ডাকে। সবর্ণ, পালটি ঘর। নো প্রবলেম। আসা করি সুথলি বিয়েটাও হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে কী করি বলুন তো! যাকে ভালোবাসে তাকে একবার চোখ বুজে বলে ফেললেই তো হয় ব্যাপারটা। তাও বলবে না, দগ্ধে দগ্ধে মরবে। কী যে জ্বালা আমাদের।
বস বলেই বুঝি সংকোচ বোধ করছেন?
আরে না মশাই, তা নয়। দাদাকে তো বলেছে, বস হওয়ার অনেক আগে থেকেই নাকি ও ছেলেটার ইয়েতে পড়েছে। তা মুখে বলতে না পারিস আজকাল তো ই–মেলটেল করা যায়, তাই কর না। ঠিক কি না বলুন?
ঠিকই তো! বিশেষ করে বসটি যখন অবিবাহিত এবং ইকুয়ালি ইল লাক।
কিছু বললেন?
একটা স্বগতোক্তি করছিলাম আর কি। মাঝে-মাঝে স্বগতোক্তি করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকে না কি না।
আচ্ছা, আপনিও তো সেই মেয়েটিকে একটা ই-মেলে করতে পারেন!
পারি। কিন্তু মেয়েটা হয়তো জবাব দেবে না। হ্যাংলা ভাববে।
কী মুশকিল! আপনিও তো দেখছি আমার মেয়ের মতোই সনাতন যুগের লোক। এ যুগের ছেলেমেয়েরা মেন্টালি কত ফ্রি, কত স্মার্ট!
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমাদের খুব মিল। সনাতন যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
আপনার কোম্পানির নামটা কী যেন?
টাইট রোপ।
অ্যাঁ। ঠিক শুনলাম কি? টাইট রোপ?
আপনি ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ঠিকই শুনেছেন।
টাইট রোপের অফিস তো ক্যামাক স্ট্রিটে?
ক্যামাক স্ট্রিটেই।
তাহলে যে বললেন, আপনার অফিস কাছেই? ক্যা
মাক স্ট্রিটটাই বা কী এমন দূর বলুন! আপনি কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন?
ফেললাম।
কেন?
কারণ পেঁপেসেদ্ধ সম্পর্কে আপনার মতামত এর পর হয়তো পালটাতে হবে।
পেঁপেসেদ্ধ খেতে কি খুবই খারাপ? আপনার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছিল যেন অমৃত খাচ্ছেন।
পেঁপেসেদ্ধর মতো খারাপ জিনিস দুটো হয় না মশাই। আর শুধু পেঁপেসেদ্ধই বা কেন? পেঁপেসেদ্ধর পরদিন কাঁচকলাসেদ্ধ, তারপর গাজর বিন টমেটোসেদ্ধ, তারপর বরবটি আর ঢ্যাঁড়শসেদ্ধ, পরদিন আলু আর ঝিঙেসেদ্ধ। জিভ অসাড় হয়ে গেছে, বুঝলেন! কিন্তু ওই একরত্তি মেয়ের শাসনে এসব খেয়েই আমাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। খেতে যখন হবেই তখন সোনাহেন মুখ করেই খাই। তবে হ্যাঁ, একটা কথা কবুল করতেই হবে যে, এসব খাই বলে গ্যাস অম্বল বা পেটের কোনও কমপ্লেন হয় না। ভেবে দেখুন, পারবেন তো?
মানুষ তো এভারেস্টেও ওঠে, তাই না?
তা ওঠে বইকি। আজকাল তো শুনি এভারেস্টে কুম্ভমেলার ভিড়।
হ্যাঁ, তাই ভেবেচিন্তে আমি খুঁজে-খুঁজে আপনার কাছেই এসেছি। পেঁপে এবং অন্যান্য সেদ্ধ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের মত জানার জন্যই।
ভালো করছেন মশাই, ভালো করেছেন। আমি বলি পৃথিবীর অপ্রিয়তম কাজটি করার সময়ে হাসিমুখে করবেন, মনটাকে পজিটিভ রাখবেন এবং ভয়কে পরিহার করবেন। বাই দি বাই, মেয়েটা কি কোনও সিগন্যাল দিয়েছে?
গতকাল অনেক সাহস সঞ্চয় করে আমি তাকে একটা ই–মেল করেছিলাম। তাতে শুধু ছিল, ওয়াই অর এন–?
বটে! কী জবাব এসেছে?
ওয়াই।