বুদ্ধিরাম
বুদ্ধিরাম শিশিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। লেবেলে ছাপ অক্ষর সবই খুব তেজাল। ‘ইহা নিয়মিত সেবন করিলে ক্রিমিনাশ, অম্ল পিত্ত ও অজীর্ণতা রোগের নিবারণ অবশ্যম্ভাবী। অতিশয় বলকারক টনিক বিশেষ। স্নায়বিক দুর্বলতা, ধাতুদৌর্বল্য ও অনিদ্রা রোগেরও পরম ঔষধ। বড় বড় ডাক্তার ও কবিরাজরা ইহার উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন।…’ছাপা অক্ষরের প্রতি বুদ্ধিরামের খুব দুর্বলতা। ছাপা অক্ষরে যা বেরোয় তার সবটাই তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
আদুরি অবশ্য অন্য ধাতের। বুদ্ধিরামের সঙ্গে তার মেলে না। বুদ্ধিরাম যা ভাবে, বুদ্ধিরামের যা ইচ্ছে যায় আদুরির ঠিক তার উলটো হয়। বুদ্ধিরাম যদি নরমসরম মানুষ তো আদুরি হল। রণচণ্ডী। বুদ্ধিরাম যদি নাস্তিক, তো আদুরি হল ঘোর আস্তিক। বুদ্ধিরামকে যদি কালো বলতে হয়, তো আদুরিকে ফরসা হতেই হবে। বিধাতা (যদি কেউ থেকে থাকে) দুজনকে এমন আলাদা মালমশলা দিয়ে গড়েছেন যে আর কহতব্য নয়।
আর সে জন্যই এ জন্মে দুজনের আর মিল হল না। বলা ভালো, হতে-হতেও হল না। এখন যদি বুদ্ধিরামের বত্রিশ-তেত্রিশ তো আদুরির সাতাশ–আঠাশ চলছে। দুজনের কথাবার্তা নেই, দেখাশোনাও একরকম কালেভদ্রে, মুখোমুখি যদি বা হয় চোখাচোখি হওয়ার জো নেই। আদুরি আজকাল বুদ্ধিরামের দিকে তাকায় না।
কিন্তু বুদ্ধিরাম লোক ভালো। লোকে জানে, সে নিজেও জানে। বুদ্ধিরাম আগাপাশতলা নিজেকে নিরিখ করে দেখেছে। হ্যাঁ, সে লোক খারাপ নয়। মাঝে-মাঝে বুদ্ধির দোষে দু-একটা উলটোপালটা করে ফেললেও তাকে খারাপ লোক মোটেই বলা যাবে না।
খারাপই যদি হবে তবে সাত মাইল পথ সাইকেলে ঠেঙিয়ে চকবেড়ের হাটে কখনও আসে মন্মথ সেনশর্মার পিওর আয়ুর্বেদিক টনিক ‘হারবল’ কিনতে? মাত্র মাস চারেক আগে প্লুরিসিতে ভুগে উঠল বুদ্ধিরাম। এখনও শরীর তেমন জুতের নয়। কাদের মুখে কথাটা শোনা গিয়েছিল, আদুরির নাকি আজকাল খুব অম্বল হয়। তা এরকম কত মেয়েরই হয়। কার তাতে মাথাব্যথা? বুদ্ধিরাম মানুষ ভালো বলেই না খোঁজখবর করতে লাগল।
তেজেনের কাছে শুনল। হারবল খেয়ে তার পিসির অম্বলের ব্যথা সেরে গেছে। কথাটা মানিক মণ্ডলের কাছেও শোনা, হ্যাঁ, হারবল জব্বর ওষুধ বটে, তিন শিশি খেতে না খেতে তার বউ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আর একদিন পরিতোষও কথায় কথায় বলেছিল, হারবল একেবারে অম্বলের যম। তবে পাওয়া শক্ত। মন্মথ কবিরাজ সেই শিবপুরের লোক, আশির ওপর বয়স। বেশি পারেও না তৈরি করতে। কয়েক বোতল করে ছাড়ে। দারুণ চাহিদা। চকবেড়ের হাটে একজন লোক নিয়ে আসে বেচতে।
খবর পেয়েই আজ মঙ্গলবারে স্কুলের শেষ দুটো ক্লাস অন্যের ঘাড়ে গছিয়ে সাইকেল মেরে ছুটে এসেছে এত দূর। অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় আধবুড়ো খিটখিটে চেহারার একটা লোক। ময়লা চাদর পেতে কয়েকটা বিবর্ণ ধুলোটে শিশি সাজিয়ে বসেছিল। ভারী বিরস মুখ।
বুদ্ধিরাম জিগ্যেস করল, হারবল আছে?
লোকটা মুখ তুলে গম্ভীর গলায় বলল , আছে। সতেরো টাকা।
সতেরো টাকা শুনে বুদ্ধিরাম একটু বিচলিত হয়েছিল। দু-শিশি কেনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কুড়িয়ে বাড়িয়েও পকেট থেকে আঠাশটাকার বেশি বেরল না।
আচ্ছা দু-শিশি নিলে কনসেশন হয় না?
লোকটা এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখ তাকাল যেন মরা ইঁদুর দেখছে। মুখটা অন্য ধারে ফিরিয়ে নিয়ে বলল , পাচ্ছেন যে সেই ঢের। মন্মথ কবরেজের আয়ু ফুরল বলে। তারপর হারবলও হাওয়া। মাথা খুঁড়ে মরলেও পাওয়া যাবে না।
একটা শিশি কিনে বুদ্ধিরাম বলল , সামনের মঙ্গলবার আবার যদি আসি পাব তো! বলা যাচ্ছে না।
কথাটা যা-ই হোক সেটা বলার একটা রংটং আছে তো। লোকটা এমনভাবে ‘বলা যাচ্ছে না’ বলল যা আঁতে লাগে। মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাটাই যেন বাহাদুরি। বেচিস তো বাপু কবরেজি ওষুধ, তাও গাছতলায় বসে, অত দেমাক কীসের!
শিশিটা নিয়ে বুদ্ধিরাম হাটে ঘুরে বেড়াল। চকবেড়ের হাট বেশ বড়। বেশ গিজগিজে ভিড়ও হয়েছে। চেনা মুখ নজরে পড়বেই। আশপাশের পাঁচ-সাত গাঁয়ের লোকই তো আসে। বুদ্ধিরামের। এখন চেনা কোনও লোকের সঙ্গে জুটতে ভালো লাগছে না। মাঝে-মাঝে তার একটু একাবোকা থাকতে বড় ভালো লাগে।
জিলিপি ভাজার মিঠে মাতলা গন্ধ আসছে। ভজার দোকানের জিলিপি বিখ্যাত। শুধু জিলিপি বেচেই ভজা সাতপুকুরে ত্রিশ বিঘে ধানজমি, পাকা বাড়ি করে ফেলেছে। কিনেছে তিনটে পাঞ্জাবি গাই। ডিজেল পাম্প সেট আর ট্র্যাক্টরও। ছেঁড়া গেঞ্জি আর হেঁটো ধুতি পরে এমন ভাবখানা করে থাকে যেন তার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আজও ভজার সেই বেশ। নারকোলের মালার ফুটো দিয়ে পাকা হাতে খামি ফেলছে ফুটন্ত তেলে। চারটে ছোঁকরা রসের গামলা থেকে টাটকা জিলিপি শালপাতার ঠোঙায় বেচতে হিমিসিম খেয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের মানুষ মাছির মতো ভনভন করছে। দোকানের সামনে।
বুদ্ধিরাম কাণ্ডটা দেখল খানিক দাঁড়িয়ে। ডান হাতে বাঁ-হাতে পয়সা আসছে জোর। ক্যাশবাক্সটা বন্ধ করার সময় নেই। আর তার ভিতরে টাকা পয়সা এমন গিজগিজ করছে যে, চোখ কচকচ করে। টাকাপয়সার ভাবনা বুদ্ধিরাম বিশেষ ভাবে না বটে, কিন্তু একসঙ্গে অতগুলো টাকা দেখলে বুকের ভিতরটায় যেন কেমন করে।
বুদ্ধিরাম বেঞ্চে একটু জায়গা খুঁজল। ঠাসাঠাসি গাদাগাদি লোক। সকলেই জিলিপিতে মজে আছে। এমন খাচ্ছে যেন এই শেষ খাওয়া। ভোমা ভোমা নীল মাছি ওড়াউড়ি করছে বিস্তর। ভিতরভাগে তিনখানা বেঞ্চের একটা থেকে দুজন উঠে যেতেই বুদ্ধিরাম গিয়ে বসে পড়ল। এখনও আশ্বিনের শেষে তেমন শীতভাব নেই। দুপুরবেলাটায় গরম হয়। উনুনের তাপ আর কাঠের ধোঁয়ায় চালাঘরের ভিতরটা রীতিমতো তেতে আছে। বুদ্ধিরাম বসেই ঘামতে লাগল।
পাশের লোকটা এখনও জিলিপি পায়নি। বৃথা হাঁকডাক করছে, বলি ও ভজাদা, আধঘণ্টা হয়ে গেল হাঁ করে বসে আছি। দেবে তো!
দিচ্ছি বাপু, দিচ্ছি। দশখানা তো হাত নয়।
আর আমাদেরই বুঝি মেলা ফালতু সময় আছে হাতে?
এই চড়াটা হলেই দিচ্ছি গো।
লোকটা ফস করে বুদ্ধিরামের থেকে বোতলটা কেড়ে নিয়ে দেখল। তারপর মাতব্বরের মতো বলল , হারবল? মন্মথ কবরেজের ওষুধ। দূর-দূর, কোনও কাজের নয়। তিন শিশি খেয়েছি।
বুদ্ধিরাম তার হাত থেকে বোলতটা ফের নিয়ে বলল , তা বেশ। কাজ হয় না তো হয় না। লোকটা ভারী কড়া চোখে বুদ্ধিরামকে একটু চেয়ে দেখল। জিলিপি এসে পড়ায় আর কিছু বলতে পারল না। মুখ তো মাত্র একটা, একসঙ্গে দু-কাজ তো করা যায় না। তার ওপর ভজার জিলিপি মুখকে ভারী রসস্থ করে দেয়। কথা বলাই যায় না।
বুদ্ধিরামকে লোকে বলে ভাবের লোক। কথাটা মিথ্যেও নয়। বুদ্ধিরাম বড় ভাবতে ভালোবাসে। ভাবতে-ভাবতে তার মাথাটা যে তাকে কাঁহা–কাঁহা মুলুক নিয়ে যায়, কত আজগুবি জিনিস দেখায় তার কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। বুদ্ধিরাম ভজার জিলিপির দোকানে বসে-বসে ভাবতে লাগল, এই যে ভজা বাঁ-হাতে ডান হাতে হরির লুটের মতো পয়সা কামাচ্ছে এতে হচ্ছেটা কী?
এত জমিজিরেত, ঘরবাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, এসব ছেড়ে একদিন ফুটুস করে চোখ ওলটাতে হবে। তখন ভজার ছেলেরা কেউ জিলিপির প্যাঁচ কষতে আসবে না। ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে লাঠালাঠি মারামারি করে ভাগ ভিন্ন হবে। ভজা কি আর তা জানে না। তবু খেয়ে–না-খেয়ে মেলায়-মেলায় রোদ জল মাথায় করে গিয়ে চালা বেঁধে কেবল জিলিপি খেলিয়ে যাচ্ছে। টাকার নেশায় পেয়েছে লোকটাকে।
বসে থাকতে–থাকতে বুদ্ধিরামের পালা এসে গেল অবশেষে। ঠোঙায় আটখানা রসে মাখামাখি গরম জিলিপি। আহা, এইরকম এক ঠোঙা যদি আদুরির হাতে গরমাগরম পৌঁছে। দেওয়া যেত!
প্রথম জিলিপিটা দাঁতে কাটতে গিয়েই টপটপ করে অসাবধানে দু-ফোঁটা রস পড়ে গেল টেরিকটনের পাঞ্জাবিতে। বড় সাধের পাঞ্জাবি। ঘি রঙের, গলায় আর পুটে চিকনের কাজ করা। বুদ্ধিরাম রুমালে মুছে নিল রসটা। মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। এক্কেবারে নতুন পাঞ্জাবি। কাঁচি ধুতির ওপর এটা পরে আদুরির বাড়ির সামনে খুব কয়েকটা চক্কর দিয়েছিল সাইকেলে। আদুরি অবশ্য বেরোয়নি। কিন্তু বুদ্ধিরামের ধারণা যে, আদুরি তাকে আড়াল থেকে ঠিকই দেখে।
জিলিপির দাম দিয়ে বুদ্ধিরাম উঠে পড়ল। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তেড়াবেঁকা আয়নায় নিজেকে একটু দেখে নিল। না, বুদ্ধিরাম দেখতে খারাপ নয়। রংটা যা একটু ময়লা। কিন্তু মুখচোখ বেশ কাটা–কাটা। নিজেকে দেখে সে একটু খুশিই হল। রুমাল দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে নিল।
একটা দোকানে পঞ্চাশ পয়সার কড়ারে সাইকেল জমা রেখেছিল। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
চারদিকে উধাও মাঠঘাট, ধানখেত। আকাশটা কী বিশাল। বাঁশবনের পেছনে সূর্য একটু ঢলে গেছে। ফুরফুরে হাওয়া।
বুদ্ধিরাম ধানখেতে নেমে পড়ল। চওড়া আল। খানিকদূর গিয়ে রাস্তা।
ধানক্ষেতের ভিতরে নেমে বুদ্ধিরামের মনটা আবার কেমন যেন হয়ে গেল। আদুরি কি ওষুধটা খাবে? এমনিতেই মেয়েরা ওষুধ খেতে চায় না, তার ওপরে বুদ্ধিরামের পাঠানো ওষুধ। আদুরি বোধহয় ছোঁবেও না। এত পরিশ্রম বৃথাই যাবে। তা যাক। বুদ্ধিরামের কাজ বুদ্ধিরাম করেই যাবে।
পুজোয় একটা শাড়ি পাঠিয়েছিল বুদ্ধিরাম। বুদ্ধিরামের বোন রসকলি গিয়ে দিয়ে এসেছিল। হাত বাড়িয়ে নেয়ওনি। বিরস মুখে নাকি জিগ্যেস করেছিল, কে পাঠিয়েছে রে?
রসকলি বোকা গোছের মেয়ে। ভয়ে-ভয়ে শেখানো কথা বলেছিল, মা পাঠাল।
তোর মা আমাকে শাড়ি পাঠাবে কেন?
তা জানি না। এটা পরে অষ্টমী পুজোর অঞ্জলি দিয়ো।
শাড়িটা ভালোই। কালু তাঁতির ঘর থেকে কেনা। লাল জমির ওপর ঢাকাই বুটি।
শাড়িটার দিকে তাকায়ওনি আদুরি। শুধু দয়া করে বলেছিল, ওখানে কোথাও রেখে যা।
সেই শাড়ি আজ অবধি পরেনি আদুরি। নজর রেখে দেখেছে বুদ্ধিরাম। খোঁজ খবরও নিয়েছে। শাড়িটা পরেনি। তবে নিয়েছে ফিরিয়ে দেয়নি, এটাই যা লাভ হয়েছিল বুদ্ধিরামের। তারপর একদিন হঠাৎ নজরে পড়ল, সেই শাড়িটা পরে রসকলি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শাড়িটা কোথায় পেলি?
ভয়ে ভয়ে রসকলি বলল , আদুরদিদি দিল।
দিল বলেই নিলি?
তা কী করব?
বুদ্ধিরাম আর কিছু বলেনি। রাগটা গিলে ফেলেছিল। মনটা বড্ড উচাটন ছিল কয়েকদিন অপমানে।
দোষঘাট মানুষের কি হয় না?
তখন বুদ্ধিরাম তো আর এই বুদ্ধিরাম ছিল না। আজকের এক গেঁয়ো স্কুলের মাস্টার বুদ্ধিরামকে দেখে কে বিশ্বাস করবে যে, ইস্কুলে সে ছিল ফার্স্ট বয়। পাশটাও করেছিল জব্বর, দু দুটো লেটার নিয়ে। বিয়ের কথাটা তখনই ওঠে। বুদ্ধিরাম যখন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কেওকেটা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
বুড়ি ঠাকুমা তখন এতটা বুড়ো হয়নি। একদিন আদুরিকে একেবারে কনে–সাজে সাজিয়ে নিয়ে এসে বলল , দেখ তো ভাই, পছন্দ নয়? হলে দেগে রাখি। পাশ–টাশ করে থিতু হলে মালাবদল করিয়ে দেব।
আদুরি অপছন্দের মেয়ে নয়। ফরসা তো বটেই মুখচোখ রীতিমত ভালো। কিন্তু গাঁয়ের মেয়ে, নিত্যি দেখাশোনা হয়। যাকে বলে ঘর কা মুরগি, তাই বুদ্ধিরাম ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, ফুঃ, এর চেয়ে গলায় দড়ি দেওয়া ভালো।
কেন রে, মেয়েটা কি খারাপ? দেখ তো কেমন মুখচোখ! কেমন ফরসা।
সাতজন্ম বিয়ে না করে থাকলেও ও মেয়ে আমার চলবে না। যাও তো ঠাকুমা, সঙ বন্ধ করো।
একেবারে মুখের ওপর থাবড়া মারা যাকে বলে। আদুরির খুব অপমান হয়েছিল। তার তখন বছর বারো বয়স। এক ছুটে পালিয়ে গেল। আর কোনওদিন এল না। খুব নাক গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছিল মেয়েটা। দিন তিনেক ভালো করে খায় দায়নি।
বুদ্ধিরামের তখন এসব দিকে মাথা দেওয়ার সময় নেই। চৌদ্দো মাইল দূরের মহকুমা শহরে কলেজে যেতে হয়। নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন রকমের জীবন। সেখানে কে একটা গেঁয়ো মেয়েকে নিয়ে ভাবার মতো মেজাজটাই তার নেই।
আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। বুদ্ধিরামের সঙ্গে মেলা মেয়েও পড়ত। তাদের একজন ছিল হেনা। দেখতে–শুনতে ভালো তো বটেই, তার কথাবার্তা চাউনি টাউনিও ছিল ভারী ভালো। কথাবার্তা বলত টকাস টকাস।
বুদ্ধিরাম ছাত্র ভালো। সুতরাং হেনা তার দিকে একটু ঢলল। বছর দেড়েক হেনার সঙ্গে বেশ মাখামাখি হয়েছিল বুদ্ধিরামের। তবে সেটাকে ভাব ভালোবাসা বলা যাবে কি না তা নিয়ে বুদ্ধিরামের আজও সংশয় আছে।
তবে হেনা আর যা-ই করুক না করুক বুদ্ধিরামের লেখাপড়ার বারোটা বাজাল। কলেজের প্রথম ধাপটা ডিঙোতেই দম বেরিয়ে গেল বুদ্ধিরামের। ডিঙোলো খোঁড়া ঘোড়ার মতো। কিন্তু হেনা দিব্যি ভালো পাশ–টাশ করে কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে চলে গেল।
বুদ্ধিরামের পতনের সেই শুরু। বি . এসসি, পাশ করল অনার্স ছাড়া। বাবা ডেকে বলল , পড়াশুনোর তো দেখছি তেমন উন্নতি হল না। তা গেঁয়ো ছেলের আর এর বেশি কীই বা হওয়ার কথা!
বুদ্ধিরাম সে-ই গাঁয়ের ছেলে গাঁয়ে ফিরে এল। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া আর হল না। পাশের গাঁ বিষ্ণুপুরের মস্ত ইস্কুলে তখন সায়েন্সের মাস্টার খোঁজা হচ্ছে। বুদ্ধিরামকে তারা লুফে নিল।
বুদ্ধিরামের মনের অবস্থা তখন সাঙ্ঘাতিক। রাগে দুঃখে দিনরাত সে ভিতরে ভিতরে জ্বলে আর পোড়ে। লেখাপড়ায় একটা মারকাটারি কিছু করে বিজয়গর্বে গাঁয়ে ফিরে আসবে, এই না সে জানত। আর সে জায়গায় টিকিয়ে–টিকিয়ে মোটে বি . এসসি.! বুদ্ধিরাম কিছুদিন আপনমনে বিড়বিড় করে ঘুরে বেড়াত পাগলের মতো, দাড়ি রাখত, পোশাক আশাকের ঠিক ছিল না। আত্মহত্যা করতে রেল রাস্তায় গিয়েছিল তিনবার। ঠিক শেষ সময়টায় কেমন যেন সাহসে কুলোয়নি।
তারপরই একদিন একটা ঘটনা ঘটল। এমনি দেখতে গেলে কিছুই নয়। কিন্তু তার মধ্যেই বুদ্ধিরামের জীবনটা একটা মোড় ঘুরল। আম বাগানের ভিতর দিয়ে বিশু আর বুদ্ধি জিতেন পাড়ুইদের বাড়ি যাচ্ছিল মিটিং করতে। জিতেন সেবার ইউনিয়ন বোর্ডের ইলেকশনে নেমেছে। জিতেনকে জেতানোর খুব তোড়জোড় চলছে। বুদ্ধিরাম তখন যা হোক একটা কিছু নিয়ে মেতে থাকার জন্য ব্যস্ত। জীবনের হাহাকার আর ব্যর্থতা ভুলে মাথাটাকে কোনও একটা ভূতের জিম্মায় না দিলেই নয়। নইলে জিতেনের সিলেকশন নিয়ে কেনই বা বুদ্ধিরামের মাথাব্যথা হবে।
আমবাগানের শরঙ্কালের একটা সোনালি রূপালি রোদের চিকরিকাটা আলোছায়া। সকালবেলটায় ভারী পরিষ্কার বাতাস ছিল সেদিন। ঘাসের শিশির সবটা তখনও শুকোয়নি।
উলটোদিক থেকে একটা ছিপছিপে মেয়ে হেঁটে আসছিল। একা, নতমুখী। তার চুল কিছু অগোছালো এলো খোঁপায় বাঁধা। আঁচলটা ঘুরিয়ে শরীর ঢেকেছে। দেখে কেমন যেন মনটা ভিজে গেল বুদ্ধিরামের।
কে রে মেয়েটা?
দূর শালা! চিনিস না? ও তো আদুরি।
আদুরি! বুদ্ধিরাম এত অবাক হল যে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল হাঁ হয়ে। এক গাঁয়ে বাস হলেও আদুরির সঙ্গে তার দীর্ঘকাল দেখা হয়নি। কারও দিকে তাকায়ও না বুদ্ধিরাম। সেই আদুরি কি এই আদুরি?
আদুরি মাথা নীচু করে রেখেই তাদের পেরিয়ে চলে গেল। ভ্রূক্ষেপও করল না।
আর সেই ঘটনাটা সারাদিন বুদ্ধিরামের মগজে নতুন একটা ভূত হয়ে ঢুকে গেল।
বাড়ি ফিরেই সে ঠাকুমাকে ধরল, শোনো ঠাকুমা, একটা কথা আছে।
কী কথা?
সে-ই আদুরি মনে আছে?
আদুরিকে মনে থাকবে না কেন?
ওকেই বিয়ে করব। বলে দাও।
ঠাকুমা তার মাথায় পিঠে হাতটাত বুলিয়ে বলল , বড্ড দেরি করে ফেললি ভাই, আদুরির তো শুনছি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। হরিপুরের চন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে পরেশের সঙ্গে।
বুদ্ধিরাম এমন তাজ্জব কথা যেন জীবনে শোনেনি। আদুরির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! তাহলে তো খুব মুশকিল হবে বুদ্ধিরামের।
সেই দিনই সে গোপনে তার দু-একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শে বসে গেল।
কেষ্ট বলল , বিয়েটা না ভাঙতে পারলে তার আশা নেই। ভাঙতে হলে সবচেয়ে ভালো উপায়। হল চন্দ্রনাথ মল্লিককে একখানা বেনামা চিঠি লেখা।
তো তাই হল। কেষ্ট নানা ছাঁদে লিখতে পারে। তার সাইন বোর্ডের দোকান আছে। চিঠিটা সেই লিখে দিল।
দিন সাতেক বাদে শোনা গেল, বিয়ে ভেঙে গেছে।
বুদ্ধিরাম ভেবেছিল, এবার জলের মতো কাজটা হয়ে যাবে। সে গিয়ে ফের ঠাকুমাকে ধরল, শুনছি আদুরির বিয়েটা ভেঙে গেছে। তা আমি রাজি আছি বিয়ে করতে।
ঠাকুমা গেল প্রস্তাব নিয়ে। বুদ্ধিরাম নিশ্চিন্তে ছিল। এরকম প্রস্তাব তো মেয়ের বাড়ির পক্ষে স্বপ্নের অগোচর।
কিন্তু সন্ধেবেলা ফিরে এসে ঠাকুমা বিরস মুখে বলল , মেয়েটার মাথায় ভূত আছে।
কেন গো ঠাকুমা?
মুখের ওপর বলল , ও ছেলেকে বিয়ে করার চেয়ে গলায় দড়ি দেওয়া ভালো।
বুদ্ধিরাম একথায় এমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল যে বলার নয়। বলল ? এত বুকের পাটা? সেই রাতে বুদ্ধিরাম ঘুমোতে পারল না। কেবল ঘরবার করল, দশবার জল খেল, ঘন–ঘন পেচ্ছাব করল। মাথায় চুল মুঠো করে ঘরে বসে রইল। রাগে ক্ষোভে অপমানে তার মাথাটাই গেল ঘুলিয়ে।
ভোরের দিকে সে একটু ঝিমোল। ঝিমোতে–ঝিমোতে ভাবল, বহোৎ আচ্ছা। এইরকমের তেজি মেয়েই তো চাই। গেঁয়ো মেয়েগুলো যেন ভেজানো ন্যাতা। কারও ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। আদুরির আছে, এটা তো খুব ভালো খবর।
সকালবেলায় সে একখানা পেল্লায় সাত পৃষ্ঠার চিঠি লিখে ফেলল আদুরিকে। মেলা ভালো ভালো শব্দ লিখল তার মধ্যে। অন্তত গোটা পাঁচেক কোটেশন ছিল সবশেষে লিখল…’তোমাকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা।
রসকলির হাত দিয়ে চিঠিটা পাঠিয়ে সে ঘরে পায়চারি করতে লাগল তীব্র উত্তেজনায়। আজ অবধি সে কোনও মেয়েকে প্রেমপত্র লেখেনি। এই প্রথম।
রসকলি ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এসে বলল , ও দাদা, চিঠিটা যে না পড়েই ছিঁড়ে ফেলল গো।
চুপ। চেঁচাস না। কিছু বলল না?
কী বলবে? শুধু জিগ্যেস করল চিঠিটা কে দিয়েছে। তোমার কথা বলতেই খামসুষ্ঠু চিঠিটা কুঁচি–কুঁচি করে ছিঁড়ে ফেলল।
বোনের কাছে ভারী অপদস্থ হয়ে পড়ল বুদ্ধিরাম। তবে রসকলি হাবাগোবা বলে রক্ষে।
বুদ্ধিরাম বলল , কাউকে কিছু বলিস না। ভালো একটা জামা কিনে দেব’খন।
তখন অপমানে লাঞ্ছনায় বুদ্ধিরামের পায়ের তলায় মাটি নেই। সারাদিনটা তার কাটল এক ঘোরের মধ্যে। কিন্তু দু-দিন বাদে সে বুঝতে পারল, আদুরি যত কঠিনই হোক তাকে জয় করতে পারলে জীবনটাই বৃথা। তবে বুদ্ধিরাম আর বোকার মতো চিঠি চাপাটি চালাচালিতে গেল না। আদুরির ধাতটা বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল সে।
গাঁয়ের মেয়ে। সুতরাং তাদের বাড়ির সকলের সঙ্গেই আজন্ম চেনাজানা বুদ্ধিরামের। তবে সে দেমাকবশে কারও বাড়িতেই তেমন যেতটেত না। ঘটনার পর দিনকয়েক আদুরিদের বাড়িতে হানা দিতে লাগল সে। আদুরির কাকা জ্যাঠা মিলে মস্ত সংসার। বড় গেরস্ত তারা। তিন-চারখানা উঠোন, বিশ–পঁচিশটা ঘর। সারা দিন ক্যাচ ম্যাচ লেগেই আছে। বুদ্ধিরাম গিয়ে যে খুব সুবিধে করতে পারল তা নয়। বাইরের দাওয়ায় বসে হয়তো কখনও আদুরির কেশোদাদুর সঙ্গে খানিক কথা কয়ে এল। না হয় তো কোনওদিন আদুরির জ্যাঠা হারুবাবুর কিছু উপদেশ শুনে আসতে হল।
চা–বিস্কুটও যে জোটেনি তা নয়। সে গাঁয়ের ভালো ছেলে। খাতির একটু লোকে করেই। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে যাওয়া সেদিকে কিছুই এগোল না।
কিছুদিন পর সে বুঝল, এভাবে আদুরির কাছে এগোনো যাবে না। মহিলা মহলে ঢুকতে হবে। তা তাতেও বাধা ছিল না। আদুরিদের অন্দরমহলেও ঢুকতে সে পারে। আদুরির এক বউদি হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলল, হ্যাঁ গো বুদ্ধি ঠাকুরপো, কোনওকালে তো তোমাকে এ বাড়িতে যাতায়াত করতে দেখিনি তোমার মতলবখানা কী খুলে বলো তো! আমার তো বাপু, তোমার। মুখচোখ ভালো ঠেকছে না।
এ কথায় আর এক দফা অপমান বোধ করল বুদ্ধিরাম। সে পুরুষ মানুষ কোনও লজ্জায় মা মাসি বউদি শ্রেণির মেয়েদের সঙ্গে বসে গল্প করে?
সুতরাং বুদ্ধিরামকে জাল গোটাতে হল। তারপরই আবার বিপদ। আদুরির ফের সম্বন্ধ এল। চেহারাখানা ভালো, কিছু লেখাপড়াও জানে, সুতরাং আদুরিকে যে দেখে সে-ই পছন্দ করে যায়।
দ্বিতীয় পাত্রপক্ষকেও বেনামা চিঠি দিতে হল। ভেঙেও গেল বিয়ে। কিন্তু তাতে বুদ্ধিরামের যে কাজ খুব এগোল তাও নয়। বরং উলটে একটা বিপদ দেখা দিল। কেউ যে বেনামা চিঠি দিয়ে আদুরির বিয়ে ভাঙছে এটা বেশ চাউর হয়ে গেল। লোকটা কে তার খোঁজাখুঁজিও শুরু হল। তৃতীয়বার যখন আদুরিকে পছন্দ করে গেল আর-এক পাত্রপক্ষ তখন আদুরির বাপ জ্যাঠা পাত্রপক্ষকে বলেই দিল, বেনামা চিঠি যেতে পারে, আমল দেবেন না। কোনও বদমাশ লোক করছে এই কাজ।
খুবই ভয়ে ভয়ে রইল বুদ্ধিরাম। কেউ ভরসা দিয়ে বলল , আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? এমন কলঙ্কের কথা লিখে দেব যে, পাত্রপক্ষ আঁতকে উঠবে।
কিন্তু এই তৃতীয়বার বুদ্ধিরাম ধরা পড়ে গেল। আদুরির সাত সাতটা গুন্ডা ভাই একদিন বাদামতলায় চড়াও হল তার ওপর। সতীশটা মহা ষণ্ডা। সে-ই সাইকেল থেকে টেনে নামাল বুদ্ধিরামকে।
বলি, তোর ব্যাপারটা কী?
কীসের ব্যাপার?
ন্যাকা! আদুরির বিয়ে ভাঙতে চিঠি দেয় কে?
আমি না।
তুই ছাড়া আর কে দেবে!
আমার কী স্বার্থ?
মেজবউদি বলছিল তুই নাকি আমাদের বাড়িতে ঘুরঘুর করতিস!
বুদ্ধিরাম বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছিল। সত্য গোপন করার অভ্যাস তার নেই। গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলা তার আসেও না। সে আমতা-আমতা করতে লাগল।
সতীশ অবশ্য মারধর করল না। বলল , যদি আদুরিকে বিয়ে করতে চাস তো সে কথা বললেই হয়। গাঁয়ে তোর মতো ছেলে ক’টা? আর যদি নিতান্তই বদমাইসির জন্য করে থাকিস তাহলে…
বুদ্ধিরাম কেঁদে ফেলেছিল। একটু সামলে নিয়ে বলল , বিয়ে করতে চাই।
শাবাশ বলে খুব পিঠ চাপড়ে দিল সতীশ। বলল , একথাটা ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো হল। আগে বললেই ব্যবস্থা হয়ে যেত।
কিন্তু ব্যবস্থা হল না। পরদিনই সতীশ এসে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল , মুশকিল কী হয়েছে জানিস? তোর ওপর আদুরি মহা খাপ্পা। কী করেছিলি বল তো!
সব শুনেটুনে সতীশ বলল , আচ্ছা, চুপচাপ থাক। দেখি কী করা যায়! বলা পর্যন্তই। সতীশকিছু করতে পারেনি। চিড়ে ভেজেনি। কিন্তু এরপর থেকে আদুরির আর সম্বন্ধ আসত না। এলেও আদুরি বেঁকে বসত।
এ সবই সাত-আট বছর আগেকার কথা। এই সাত-আট বছরে বুদ্ধিরাম আড়াল থেকে আদুরির উদ্দেশে তার সব অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ করেছে। প্রতিবার পুজোয়ে শাড়ি পাঠায়, টুকটাক উপহার পাঠায়, কোনওটাই আদুরি নেয় না। নিলেও ফেলে টেলে দেয় বা অন্য কাউকে দান করে।
কিন্তু বয়স তো বসে নেই। আদুরির বিয়ের বয়স পার হতে চলল। বুদ্ধিরামও ত্রিশ পেরিয়েছি। কোনও দিকেই কিছু এগোল না। আদুরির কপাট বজ্র আঁটুনিতে বন্ধই রইল।
ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে সাইকেলে ঠেলে নিয়ে যেতে-যেতে এসব কথাই ভাবছিল বুদ্ধিরাম।
বড় রাস্তায় উঠে সে সাইকেলে চাপল। পাঞ্জাবির পকেটে ভারী শিশিটা ঝুল খাচ্ছে। কষ্ট করাই সার হল। কোনও মানে হয় না এর।
গাঁয়ে ঢুকবার মুখে বাস রাস্তায় কয়েকটি দোকান। আঁধার হয়ে এসেছে। টেমি জ্বলছে। দোকানে দোকানে। মহীনের চায়ের দোকানে দু-চারজন বসে আছে। ষষ্ঠী হাঁক মারল, কে রে! বুদ্ধি নাকি?
বুদ্ধি নেমে পড়ল। সাইকেলটা স্ট্যান্ডে দাঁড়ি করিয়ে বসে গেল। একটু ঠান্ডা–ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে এখন। এক ভাঁড় চা হলে হয়।
ষষ্ঠী একটু বেশি কথা কয়। নানা কথা বকবক করে যাচ্ছিল। সে একটু তেলানো মানুষ। যাকে দেখে তাকেই একটু-একটু তেল দেওয়া তার স্বভাব। পুরোনো কথার সূত্র ধরে বলল , তোর কত বড় হওয়ার কথা ছিল বল তো! গাঁয়ে আজ অবধি তোর মতো বেশি নম্বর পেয়ে কেউ পাশ করেছে? বসন্ত স্যার তো বলতই, বুদ্ধিরামের মতো ছেলে হয় না। যদি লেগে থাকে তো জজ ম্যাজিস্ট্রেট কিছু একটা হয়ে ছাড়বে।
এসবই পুরোনো ব্যর্থতার কথা। বুদ্ধিরাম যা খুঁচিয়ে তুলতে চায় না। ধীরে-ধীরে তার আঁচ নিবে গেছে। সে গাঁয়ের মাস্টার হয়ে ধীরে-ধীরে নিজেকে মাপে ছোট করে ফেলেছে। সয়েও গেছে সব। কিন্তু কেউ খুঁচিয়ে তুললে আজও বুকটা বড় উথাল–পাথাল করে।
ষষ্ঠী, চুপ কর, ওসব কথা বলে আর কী হবে!
আমরা যে তোর কথা সবসময়েই বলাবলি করি। চোখের সামনে দেখছি কিনা। কী জিনিস ছিল তোর ভিতরে।
বুদ্ধিরাম ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে উঠল। বলল , যাই, ছাত্ররা সব এসে বসে থাকবে।
যা।
বুদ্ধিরাম সাইকেলে চেপে বড় রাস্তা থেকে গাঁয়ের পথে ঢুকে পড়ল। অন্ধকার রাস্তায় হাজার হাজার জোনাকি জ্বলছে। তাদের মিটিমিটে আলোয় কিছুই প্রতিভাত হয় না। অথচ জ্বলে। লাখো লাখো জ্বলে। তাহলে কী লাভ জ্বলে।
মোট দশ জন ছাত্র তার বাড়িতে এসে পড়ে। মাথা পিছু কুড়ি টাকা করে মাস গেলে দুশো টাকা তার আসার কথা। কিন্তু নগদ টাকা বের করতে গাঁয়ের লোকের গায়ে জ্বর আসে। বাকি বকেয়া পড়ে যায় অনেক। তবু বুদ্ধিরাম সবাইকেই পড়ায়। বেশির ভাগই গবেট। দু-একজন। একটু-আধটু বোঝে–সোঝে।
পড়াতে বসবার আগে পাতুকে ডেকে শিশিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল , ও বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আয়। তার হাতে দিস।
রসকলির বিয়ে হয়ে গেছে। একটু বয়সকালেই হল। এখন রসকলির জায়গা নিয়েছে বুদ্ধিরামের ভাইঝি পাতু। আদুরি আর বুদ্ধিরামের ব্যাপারটা দুবাড়ির কারও আর অজানা নেই। সুতরাং নাহক লজ্জা পাওয়ারও কোনও মানে হয় না।
হাত–মুখ ধুয়ে পড়াতে বসে গেল বুদ্ধিরাম। কিছুক্ষণ আর অন্যদিকে মনটা ছোটাছুটি করল। ছাত্রের মুখের দিকে চেয়ে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়।
এই ভুলে থাকাটাই এখন বুদ্ধিরামের কাছে সবচেয়ে বড় কথা। যত ভুলে থাকা যায় ততই ভালো। জীবনটা আর কতই বা লম্বা। একদিন আয়ু ফুরোবেই। তখন শান্তি। তখন ভারী শান্তি।
পড়িয়ে যখন উঠল বুদ্ধিরাম তখন বেশ রাত হয়েছে। ছাত্ররা যে যার লণ্ঠন হাতে উঠোন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। বুদ্ধিরাম দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দেখল। এরপর তার একা লাগবে। খুব একা।
পাতু ফিরে এসেছে। বারান্দায় ঘুরে-ঘুরে কোলের ভাইকে ঘুম পাড়াচ্ছিল।
হাতে দিয়েছিস তো!
হ্যাঁ গো।
কিছু বলল ?
না। শিশিটার গায়ে কী লেখা আছে পড়ল। তারপর তাকে রেখে দিল।
ভাতের গন্ধ আসছে। জ্যাঠামশাইয়ের কাশির শব্দ। কে যেন কুয়ো থেকে জল তুলছে ছপাৎ ছপাৎ করে। দুটো কুকুরে ঝগড়া লেগেছে খুব। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধিরাম বাইরের কুয়াশা মাখা জ্যোৎস্নার দিকে আনমনে চেয়ে রইল।
না, বেঁচে থাকাটার কোনও মানেই খুঁজে পায় না সে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিজের ঘরে ঢুকল। বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরখানা তার। ঘরে একখানা চৌকি, একটা টেবিল আর চেয়ার আর একখানা বইয়ের আলমারি।
বুদ্ধিরাম চেয়ারে বসে লণ্ঠনের আলোয় একখানা বইয়ের পাতা খানিকক্ষণ ওলটাল। বইটা কী, কোন বিষয়ের তাও যেন বুঝতে পারছিল না। বইটা রেখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। গাছের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নারও কোনও অর্থ হয় না। ঝড়–বৃষ্টি, শীত–গ্রীষ্ম কোনওটারই কোনও অর্থ হয় না। অথচ বেঁচে থাকতে হবে। এ কী জ্বালা রে বাপ?
বউদি এসে খেতে ডাকল বলে বেঁচে গেল বুদ্ধিরাম। খাওয়ারও কোনও অর্থ হয় না। তবু সেটা একটা কাজ। কিছুক্ষণ সময় কাটে। কথাবার্তা হয়, হাসিঠাট্টা হয়। সময়টা কেটে যায়। বুদ্ধিরাম গিয়ে সাগ্রহে খেতে বসল।
খেয়ে এসে বুদ্ধিরাম ফের কিছুক্ষণ বসে রইল চেয়ারে। চেয়ারে বসে-বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়ল, কে জানে।
পাতু এসে জাগাল, ওঠো সেজকা, বিছানা করে মশারি ফেলে গুঁজে দিয়েছি। শোওগে।
হাই তুলে উঠতে যাচ্ছিল বুদ্ধিরাম, পাতু ফের বলল , আজ ও বাড়ির সকলের মন খারাপ। নিবারুণদাদুর অবস্থা ভালা নয়। আদুরি পিসির চোখ লাল। খুব কাঁদছিল।
নিবারণ মানে হল আদুরির বাবা। বুদ্ধিরাম খবরটা শুনল মাত্র। মনে আর কোনও বুজকুড়ি কাটল না। কলঘর ঘুরে এসে শুয়ে পড়ল। বাপ যদি মরে তো আদুরির মাথা থেকে ছাদ উড়ে যাবে।
ভাবতে-ভাবতে ঘুমোল বুদ্ধিরাম। আজকাল নির্বোধের মতোই সে ঘুমোতে পারে। মাথাটা আস্তে আস্তে বোকা হয়ে যাচ্ছে তো। বোধবুদ্ধি কমে যাচ্ছে। আজকাল তাই গাঢ় ঘুম হয়।
মাঝরাতে আচমকা চেঁচামেচিতে ঘুমটা ভাঙল। ভাঙতেই সোজা হয়ে বসল বুদ্ধিরাম। চেঁচামেচিটা অনেক দূর থেকে আসছে। আদুরির বাপের কি তবে হয়ে গেল?
উঠবে কি উঠবে না তা ভাবছিল বুদ্ধিরাম। ও বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক কীই বা আর? না গেলেও হয়। রাতে একটু শীত পড়েছে। পায়ের কাছে ভাঁজ করা কাঁথা। সেটা গায়ে টেনে নিতেই ভারী একটা ওম আর আরাম হল। বুদ্ধিরাম চোখ বুজল।
ঘুমিয়েই পড়ছিল প্রায় এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিয়ে মেজদা বলল , বুদ্ধি, ওঠ। নিবারণ জ্যাঠার হয়ে গেল। একবার যেতে হয়। ও বাড়ি থেকে ডাকতে এসেছে।
বুদ্ধিরাম উঠল। যারা বেশি রাতে মরে তাদের আক্কেল বিবেচনার বড় অভাব। বলল , যাচ্ছি।
গামছাখানা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ল বুদ্ধিরাম। গাঁসুষ্ঠু জেগে আছে। আজকাল গাঁয়ে লোকও বেড়েছে খুব। রাস্তায় নামলেই বেশ লোকজন দেখা যায়। এই মাঝরাতেও ঘুম ভেঙে অন্তত জন ত্রিশ-চল্লিশ লোক নেমে পড়েছে রাস্তায়, আদুরিদের বাড়ি যাবে বলে।
একটা হাই তুলল বুদ্ধিরাম। শরীরটা এখনও ঘুমজলে অর্ধেক ডুবে আছে। শরীরের যেটুকু জেগে আছে সেটাকেও চালানো যাচ্ছে না।
বাইরের উঠোনেই নিবারণ জ্যাঠাকে তুলসীতলায় শোয়ানো হয়েছে। চেঁচিয়ে এ ওর গলাকে ছাপিয়ে কান্নার কম্পিটিশন চলেছে। কোনও মানে হয় না। জন্মালেই তো মানুষের মধ্যে মৃত্যুর বীজ পোঁতা হয়ে গেল। এভাবেই যেতে হবে। সবাই যায়।
গোটা দশেক লণ্ঠন আর দু-দুটো হ্যাজাক বাতির আলোতেও এই ভিড়ের মধ্যে আদুরিকে দেখতে পেল না বুদ্ধি। আদুরি খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। চেঁচিয়ে কাঁদবে না, জানে বুদ্ধিরাম। আর সে আসায় হয়তো ঘরে গিয়ে সেঁধিয়েছে। মুখ দেখতেও বুঝি ঘেন্না হয় আজকাল।
মাস চারেক আগে প্লুরিসি থেকে উঠেছে বুদ্ধিরাম। বুক থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে জল টেনে বের করতে হয়েছিল গামলা গামলা। তার ঠান্ডা লাগানো বারণ। কিন্তু সে কথা বুদ্ধিরাম ছাড়া আর কে-ই বা মনে রেখেছে।
শ্মশানে গেলে স্নান করতে আসতে হবে। শেষ রাতের শীতে হিম বাতাস লাগবে শরীরে। ডাক্তার ঠান্ডা লাগাতে বারণ করেছিল।
বুদ্ধিরাম একটু হাসল। সে রেলরাস্তায় গলা দিতে গিয়েছিল। মরণকে তার ভয়টয় নেই। একভাবে না একভাবে তো যেতেই হবে।
কান্নাকাটির মধ্যেই কিছু লোক বাঁশ–টাশ কাটতে লেগেছে। দড়িদড়া এসে গেছে। বুদ্ধিরাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। কিছুই দেখার নেই অবশ্য।
মোড়লদের মধ্যে শলা–পরামর্শ হচ্ছে। সেই দলে বুদ্ধির বাপ জ্যাঠাও আছে। অন্য ধারে গাঁয়ের অল্পবয়সি ছেলেরা কোমরে গামছা বেঁধে তৈরি।
আচমকাই–একেবারে অপ্রত্যাশিত, আদুরিকে দেখতে পেল বুদ্ধিরাম। উত্তরের ঘরের দাওয়ায় তিন-চারজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দলে বুদ্ধির জ্যাঠাইমাও। আদুরি হঠাৎ ঘর। থেকে বেরিয়ে এসে সোজা বুদ্ধির দিকে তাকাল। গত দশ বছরে বোধহয় প্রথম।
বুদ্ধি একটু হতবুদ্ধি হয়ে গেল। না, ভুল দেখছে না। হ্যাজাকের আলো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। বাপের মড়া উঠোনে শোওয়ানো। তবু আদুরি সোজা তার দিকেই চেয়ে আছে। একেবারে নিষ্পলক।
আজ বুদ্ধিরামই চোখ সরিয়ে নিল। তারপর আড়ে-আড়ে চাইতে লাগল। মেয়েটার হল কী?
আদুরি তার জ্যাঠাইমার কানে কানে কী যেন বলল । তারপর একটু সরে দাঁড়াল। আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে নরম ভঙ্গিতে খুঁটিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তাতে যেন ভারী ফুটে উঠল আদুরি। কী যে দেখাচ্ছে।
জ্যাঠাইমা হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছিল।
বুদ্ধিরাম অগত্যা গিয়ে বলল , কী গো জ্যাঠাইমা?
মড়া ছুঁয়েছিস নাকি?
না। তবে এবার তো ছুঁতে হবেই।
কাজ নেই বাবা। বাড়ি যা। গায়ে গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা ছিটিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়। তোকে শাশ্মশানে যেতে হবে না।
কেন?
কেন আবার। ক’দিন আগে কী অসুখটা থেকেই না উঠলি। ঠান্ডা লাগলে আর বাঁচবি নাকি?
আমার কিছু হবে না জ্যাঠাইমা, ভেবো না।
কেন, তোরই বা যেতে হবে কেন? শ্মশানে যাওয়ার কি লোকের অভাব? কত লোক জুটে গেছে। আদুরি মনে করিয়ে দিল, তাই। যা বাবা, ঘরে যা।
আর-একবার শুনতে ইচ্ছে করছিল, বলল , কে মনে করিয়ে দিল বললে?
আদুরি অদূরে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পাচ্ছে। নড়ল না।
জ্যাঠাইমাও আর তাকে আমল না দিয়ে অন্য মহিলাদের সঙ্গে কথা কইতে লাগল।
বুদ্ধিরাম ধীরপায়ে ছেলে ছোঁকরাদের দঙ্গলটার কাছে এসে দাঁড়াল।
বুদ্ধিদা, যাবে তো!
তা গেল বুদ্ধিরাম। মড়া কাঁধে নেচে–নেচে গেল। বহুকাল পরে তার এক ধরনের আনন্দ হচ্ছিল আজ। না, প্রতিশোধ নেওয়ার আনন্দ নয়। প্রতিশোধের মধ্যে কোনও আনন্দ নেই। আজ তার আনন্দ হচ্ছিল একটা অন্য কারণে। ঠিক কেন তা সে বলতে পারবে না।
মড়া পুড়ল। বুদ্ধিরাম কষে স্নান করল নদীর পাথুরে ঠান্ডা জলে। দুনিয়ার একজনও অন্তত তার অসুখটার কথা মনে রেখেছে, এখন আর মরতে বাধা কী!
ভেজা গায়ে যখন উঠে এল বুদ্ধিরাম তখন শেষ রাতের হিম বাতাসে সে থরথর করে কাঁপছিল। সবাই কাঁপছে। কিন্তু তাঁর কাঁপুনিটা আলাদা। লোকে বুঝতে পারল না। শুধু বুদ্ধিরামের নিজের ভিতরে যে নানা ভাঙচুর হচ্ছিল তা নিজেই টের পেল সে।
হোঁৎকা সতীশ কাছেই দাঁড়িয়ে গামছা নিংড়োচ্ছিল। হঠাৎ কী খেয়াল হতে বুদ্ধিরামের দিকে ফিরে বলল , হ্যাঁরে বুদ্ধি, তুই যে বড় স্নান করলি?
করব না তো কী?
সতীশ মুখে একটা চুকচুক শব্দ করে বলল , তোর না কী একটা অসুখ হয়েছিল ক’দিন আগে।
কে বলল তোকে?
সতীশ গামছাটা ফটাস–ফটাস করে ঝেড়ে নিয়ে মাথা মুছতে-মুছতে বলল , বেরোবার মুখে আদুরি এসে ধরেছিল আমায়। বলল বটে, রাঙাদা, বুদ্ধিরামের কিন্তু শরীর ভালো নয়। হিমজলে স্নান করলে মরবে। ওকে দেখো।
বুদ্ধিরাম কোনও কথা বলল না। গলার কাছে একটা দলা আটকে আছে। চোখে জল আসছিল।
সতীশ গা মুছতে মুছতে বলল , তোর আক্কেল নেই? কোন বুদ্ধিতে এই সকালে স্নান করলি?
দূর শালা! আজই তো স্নানের দিন। আজ স্নান করব না তো কবে করব?