সাহেবের তলোয়ার
গোঁসাইনি?
–আইজ্ঞা।
–আইলানি?
–আইজ্ঞা আইলাম।
–বহ বহ, খবর বার্তা কও।
–খবর বার্তা ভালো নয়। রাসুবাবু ঘাড় কাইত করলেন না।
–কও কী? মাইনকা ঢিপির মইধ্যে পড়লাম নাকি হে গোঁসাই?
–আইজ্ঞা মাইনকা ঢিপি বইলাই তো মনে হয়।
–পাকঘরে একখান চুপি মাইরা দেইখ্যা আসো তো, তাইন পাকঘরে নাকি!
–আইজ্ঞা চুপি মারতে হইব না। এইখান থিক্যাই ছ্যাক ছোঁক শব্দ পাইতেছি।
–তা হইলে নিশ্চিন্তে কথা কওন যায়। রাসুবাবু কয় কী?
–এয়ারলিং মানে জানেন?
–এয়ারলিং? না হে গোঁসাই। ইংরাজি শব্দ নাকি?
–তাই তো মনে হয়। কইলেন, এইটা হইল আমাগো এয়ারলিং। বেচুম ক্যান? এইটা বেচলে তো নিজেরেও বেচন যায়।
–ঘাড়খানা অখনও তেড়াই আছে, না?
–আইজ্ঞা। আমারে তো একরকম খেদাইয়াই দিলেন। কইলেন, পরেশরে গিয়া কইও, তার যে টাকার গমর হইছে হেইটা আমি জানি। কিন্তু টাকা দিয়া কি সব কিনন যায় হে?
–এত বড় কথা?
–আইজ্ঞা, কথা উনি বড়ই কন।
–ফুটানি যায় নাই। আর সব গেছে, ফুটানি যায় নাই।
অন্ধকার চেপে বসেছে চারদিকে। ঘর থেকে একটা লণ্ঠনের আলোর চৌখুপি এসে পড়েছে। উঠোনে। তার আভায় দেখা যাচ্ছে, উঠোনে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে দুটো দিশি কুকুর। উত্তর আর পুবদিকে আরও দু-খানা ঘর। আশেপাশে কচু বন, বাঁশঝাড়। জোনাকি পোকা উড়ছে খুব। মশার শব্দ হচ্ছে। শীতের প্রথম দিককার কুয়াশাও ঘন হয়ে আছে চারদিকে। একটা মাছ ভাজার গন্ধ ভাসছে চারদিকে। পরেশ ঘোষ তার নিবন্ত কোটায় দুটো নিষ্ফল টান দিয়ে একটা হাঁক মারল, বুচি রে, তামুক সাইজ্যা দিয়া যা।
ফ্রক-পরা আট নয় বছরের একটা মেয়ে এসে হুঁকো থেকে কলকেট তুলে নিয়ে গেল। মাছ। ভাজার গন্ধটা বড়ই ভালো লাগছিল কানু গোঁসাইয়ের। সারাদিন ঘুরে তার পেটে এখন উথাল। পাথাল খিদে। বাড়ি ফিরতে এখনও দেড় মাইল পথ। নাকটা তুলে গন্ধটা প্রাণ ভরে শুকছিল সে। বুচি এসে হুঁকোর মাথায় কলকে বসিয়ে গেল।
–তামুক খাইবা গোঁসাই?
–ন, থাউক গা।
–রাসু আমার টাকা দেখত্যাছে, কিন্তু আর কিছু দেখে না ক্যান কও না? প্যাটে গামছা বাইন্ধা, উদয়াস্ত খাইট্যা তবে না দুইটা পয়সার মুখ দেখছি। কেউ কইতে পারব পরেশ ঘোষের ফুটানি আছে?
–আমি কই কী, আপনি নিজে একবার গিয়া খাড়ান। আপনে গিয়া খাড়াইলে রাসুবাবু না কইতে পারবেন না।
পরেশ মাথা নেড়ে বলল , উপায় নাই হে গোঁসাই।
–ক্যান, কাইজ্যা হইছে নাকি?
–কাইজ্যা বলে কাইজ্যা? তার সামনে যাওনের উপায় নাই।
–হইছে কী কইবেন তো?
–শোনবা?
–কইয়া ফ্যালান।
অখন কওন যায়। পুরোনো ঘটনা তো, অখন কইলে দোষ নাই।
পরেশ ঘোষ কিছুক্ষণ তামাকে টান দিল। গুড়ুক গুড়ুক মিষ্টি শব্দের সঙ্গে এসে মিশল প্যাঁচার ডাক। মাছ ভাজার গন্ধটা মিইয়ে গিয়ে জিরা বাটা লঙ্কা আর হলুদের টগবগ করা ঝোলের টাটকা গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কানু গোঁসাইয়ের পেটের অস্বস্তিটা বাড়ল। এই শীতের মরসুমে মেলা মাছ উঠছে বাজারে। তেলাল সরপুঁটি, ভ্যাদা, ট্যাংরা, কই। একটু ধনেপাতা ছিটিয়ে রাঁধলে অমত। কিন্তু কানু গোঁসাইয়ের ট্যাঁকের জোর নেই। বাড়ি ফিরে চারটি ভাত আর একটু শাকপাত, কচু, ঘেঁচু জুটলেই বহুত। পরেশ ঘোষ আজ কিছু দেবে। দিলে কাল না হয় দুর্গা বলে কিনেই ফেলবে একটু মাছ। গন্ধটা তাকে বড় কাহিল করে ফেলেছে।
–রাসুর বইন চন্দ্রিমার কথা শোনছ?
–খুব শুনছি। কুসারি পাড়ায় শ্রীশদাসের লগে বিয়া হইছে যার।
–হেই। তার লগে আমার একখান সম্বন্ধ আইছিল।
–নাকি?
–সতেরো আঠারো বছর আগেকার কথা। বিয়া পাকা, আশীর্বাদও হইয়া গেছিল, নিমন্ত্রণের চিঠিও বিলি হইয়া গেছে, এমন সময়ে আমার পিতৃদেব একখান কাণ্ড কইরা বইলেন। পাঁচ হাজার টাকা নগদের কথা আছিল, কিন্তু তাইন হঠাৎ বাইক্যা বইস্যা কইলেন, আমাগো দক্ষিণের ঘর ভাইঙ্গা পড়ছে, ঘর না মেরামত করলে পোলা আর বউ থাকব কই? সুতরাং ঘর তোলনের লিগ্যা আরও পাঁচ হাজার লাগব।
–ছিল না?
–পাঁজ হাজার কি ফাইজলামি নাকি হে, গোঁসাই? রাসুর বাপের অবস্থা তখন পড়তি, ঘরে কর্জ কইরাই বিয়া দিতাছিল। গেল বিয়া ভাইঙ্গা।
–ইস রে! চন্দ্রিমা তো শুনছি খুব সুন্দরী।
–আরে হেই লিগ্যাই তো বাবার লগে আমার বনে নাই। বুড়া টাকা–টাকা কইরা দাপাইয়াই মইরা গেল। শ্যাষে কুলতলির এই কুচ্ছিৎটারে আমার গলায় আইন্যা ঝুলাইয়া দিল।
–কী যে কন! বউঠাইন তো লক্ষ্মীপ্রতিমা।
–তোমার মাথা। যেমন রূপ তেমনই গলার জোর। মাথার চুলগুলি কি আমার উইঠ্যা গেল সাধে? এই মাগির লিগ্যা উঠতে–বসতে অশান্তি।
কী যে কন ঘোমশায়? –মাগির গায়ের রংখান দেখছ? লণ্ঠনের কালি, ধলা না হইল, এমন কালাও মানুষ হয়? আর দেখো এই মাগির লিগ্যাই রাসুর পায়ে তেল দিতে হইতাছে।
–বৃত্তান্তখান কী?
–কী লেন, কী দেন, কী বৃত্তান্ত কইতে গেলে রাইত ফুরাইব। সংক্ষেপে কই, আমার শালা ব্রাউন নামে কোন এক সাহেবের লগে নারায়নগঞ্জে স্টিমার কোম্পানি খুলছে। পয়সা লুটতাছে মন্দ না। তবে সাহেবটার বাতিক আছে। গ্রামে গঞ্জে ঘুররা কেবল পুরোনো জিনিস খুইজ্যা বেড়ায়। রাসুর বাড়িতে গিয়াও হানা দিচ্ছিল। পুরোনো তরোয়ালখান দেইখ্যা খুব পছন্দ। শুনছি এক হাজার টাকায় কিনতেও চাইছিল। রাসু দেয় নাই।
–তাই কেন?
–খাড়াও, কথা অখনও শেষ হয় নাই।
রাসুর লগে না পাইরা অখন আমার শালা রামপদরে ধরছে সাহেব। যত টাকা লাগে লাগুক, তরোয়ালখান তার লাগব।
–সাহেব কততে উঠব?
–ওই যে তোমারে যা কইয়া দিছি, তিন হাজার। তিন হাজারে ষাইট বিঘা জমি হয়। সোজা কথা নাকি? সাহেবটা পাগল বইল্যা শ্যান টাকাটা জলে ফালাইতে চাইত্যাছে।
খিদেটা হঠাৎ যেন উধাও হল কানু গোঁসাইয়ের। টাকার কথা শুনতে তার ভালোই লাগে। একটা তরোয়ালের এত দাম হতে পারে তা তার ধারণায় ছিল না। সোনার কাজ করা, রুপোর খাপে মোড়া তরোয়ালটা নাকি রাসুদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। বিস্তর পুরোনো। কিন্তু দামটাও বেজায় বেশি হয়ে যাচ্ছে।
সে বলল , সাহেবটা পাগলই।
–আর কইও না। সাহেব কইছে, তরোয়ারলখানা না পাইলে রামপদর লগে আর কারবারই করব না। আর হেই লিগ্যাই রামপদর গুণধরী বইন, আমার অর্ধাঙ্গিনী আমারে উঠতে বইতে তিষ্ঠাইতে দিতাছেনা।
–রামপদ নিজে যায় না ক্যান?
–গেছিল। খেদাইয়া দিছে।
–খেদাইয়া দিল ক্যান? রামপদ তো আর আমার মতো ছাতামাতা মানুষ না।
–আর কইওনা হে গোসাই। রামপদ একটা বলদামি কইরা ফালাইছিল। গিয়া কথায় কথায় কইয়া ফালাইছে পরেশ ঘোষ আমার ভগ্নীপতি। ভাবছিল আমার নাম কইলে রাসু ভড়কাইব। আর যাইবা কই? এই মারে কি সেই মারে। কইছে কী জানো?
–আইজ্ঞা, ভালো কথা না নিশ্চয়ই?
–কইছে তোমরা ভগ্নীপতির বংশ খারাপ, তোমার ভগ্নীপতি হারামি, আরও কত কথা। মুখ তো না, ফ্যান ছিটাল।
–আইজ্ঞা, রাসুবাবুর বায়ু একটু চড়া। হইব না ক্যান কন। কত বড় বংশ অ্যাছিল। হাতি ফান্দে পড়ছে ঠিকই, তবে অখনও হামবড়াইটা তো যায় নাই।
–আরে রাসু হইল ফোতত কাপ্তান। অর আছেটা কী? বংশ ধুইয়া কী জল খাইব?
–আইজ্ঞা, কথাটা ঠিকই। শোনলাম গত মাসেও পঞ্চাশবিঘা জমি বেইচ্যা কর্জ শোধ করতে হইছে। সোনাদানাও বোধহয় আর বেশি কিছু নাই।
–আরে, থাকব কইথিকা? বেইচ্যা-বেইচ্যাই তো এতকাল খাইল। অকাল কুষ্মাণ্ড আর কারে কয়? তবু ফুটানি ছাড়ে না।
–আইজ্ঞা, যা কইছেন।
মাছের ঝোল নেমে গেছে উনুন থেকে। এবার একটা সোনামুগ ডালের গন্ধ ছড়াচ্ছে। জ্বালাতন আর কাকে বলে। এ সব গন্ধের পর বাড়ি ফিরে কচুর ঝোল দিয়ে আউস চালের মোটা ভাত কি মুখে রুচবে?
–কিছু দিবেন নাকি ঘোষমশায়?
পরেশ কোটা বাঁশের খুঁটির গায়ে ঝুলিয়ে রেখে বলল , আরে রও দিমু। কিন্তু কামটা উদ্ধার কইর্যা দাও।
–ক্যামনে?
–য্যামনে পারো। কথার লড়চড় হইব না। যদি তরোয়ালখানা বাগাইয়া আনতে পারো, তোমারে কড়কড়া পঞ্চাশটা টাকা দিমু।
–পঞ্চাশ?
–ক্যান, পঞ্চাশ কি কম হইল?
–আইজ্ঞা না, কথাটা ভালো শুনতে পাই নাই বইলাই আর একবার শুইন্যা নিলাম।
–যাওন আহনের খরচা আলাদা দিমু। কিন্তু কামটা উদ্ধার কইরা দাও। রামপদ পরশু দিন আইয়া মেলা কাকতি মিনতি কইরা গেছে। সাহেব যদি তারে খেদায় তবে তার গণেশ উল্টাইব। খোঁটার জোরে যেমন মেড়া কোন্দে, তেমন আমাগো রামপদ কোন্দেব্রাউনের জোরে।
–বুঝছি।
–আরও একটু বুইঝা যাও। এই যে কালি মাগিরে লইয়া ঘর করি সেই মাগি কিন্তু আমারে খাবলাইয়া খাইত্যাচে। তার ভাইরে উদ্ধার করতে না পারলে আমার আর শান্তিতে ঘরে বইয়া তামুকটুকু খাওনেরও উপায় থাকব না। কাজ কারবার লাটে উঠব। বোঝলা?
–ভাবতে দ্যান।
–বেশি ভাবতে হইব না। আমি জানি তুমি বুদ্ধিমান লোক। উপায় একটা করতে পারবাই।
–একটা চোরারে কামে লাগামু ঘোষমশায়? –চোর! কও কী?
–আইজ্ঞা, এই মাইনকা টিপি থিক্যা রক্ষা পাইতে হইলে আর উপায় কী? লাটু দাসেরে চিনেন?
–হবিবগঞ্জের লাটু নাকি?
–আইজ্ঞা। তারে লাগাইলে হয়। ব্যাটার খুব নামডাক। আমার লগে চিনা আছে। পরেশ পাল মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল , আরে বাঃ, এই মতলব তো আমার মাথায় আসে নাই হে গোঁসাই? তা হইলে তারেই লাগাও।
–দশ বিশটাকা খর্চ লাগব কিন্তু।
–ঠিক আছে। জিনিসটা আইন্যা আগে আমার হাতে দাও। খর্চ তো আছে। খাড়াও, তোমার দক্ষিণাটা দিতাছি।
মুগডালের গন্ধ তীব্র হচ্ছে। এ তো শুধু সেদ্ধর গন্ধ। এরপর ফুটন্ত ডালে জিরেবাটা, আদাবটা আর হলুদ পড়বে। তারপর পড়বে ঘি দিয়ে জিরে ফোড়ন। ওঃ, তখন যা গন্ধ ছাড়বে না, গোলাপ ফুলকে বলবে ওদিকে থাক।
পাঁচটা টাকা আশা করেনি কানু গোঁসাই। দুটো-একটা টাকাই জোটে। আজ পাঁচ টাকা পেয়ে বুকটা নেচে উঠল।
–গোঁসাই, কাইল সকালেই গিয়া লাটুরে ধইরা ফালাও। দেরি কইরো না। সাহেবের মতিগতি কুনদিন বদলাইয়া যায় ঠিক কী?
কানু গোঁসাই উঠে পড়ল। তার ট্যাঁকে ঘড়ি নেই ঠিকই, কিন্তু সময়ের আন্দাজ আছে। এখন রাত বড় জোর নটা। এ সময়ে চাঁদিপুরের রতন জেলে নদীয়াল মাছ ধরে এনে ঘাটে বসে। ভাগ বাঁটোয়ারা করে। অনেক সময়ে পাওয়া যায়। চার-ছ’আনার মাছ কিনতে পারলে আজ রাতে পেট ভরে দুটো ভাত খাওয়া যাবে।
–সে বলল , তা হইলে আসি গিয়া ঘোষমশয়।
–আহ গিয়া। মনে থাকে য্যান–
না, মাছ পেল না কানু গোঁসাই, ঘরে ফিরে ঠান্ডা ভাত আর মানকচুর ঝোলই খেতে হল। তা হোক, পকেটে পাঁচটা টাকা থাকায় আজ তেমন খারাপ লাগল না। মনটা নাচলে সবই ভালো লাগে।
মনের নাচ বন্ধ হল যখন হবিগঞ্জের ঘাটে লাটুর সঙ্গে দেখা হল পরদিন দুপুরে। রোগা ছোটখাটো চালাক চেহারার লাটু কথাটা শুনেই বলে উঠল, খ্যাফচেন নাকি গোঁসাই? রাসুবাবুর যে বন্দুক আছে হেইটা নি জানেন?
–বন্দুক? বন্দুকের ভয় পাও নাকি রে বাসি? তা হইলে আর কাজটা করলা কী?
–না মশয়, পাঁচ-সাত টাকায় আমার পোষাইব না।
–কত চাও?
–পঞ্চাশ টাকা দিলে ভাইব্বা দেখতে পারি।
পঞ্চাশ? পঞ্চাশ দিলে আর কানুর থাকে কী? সে বলল , এক বিঘা জমির দাম চাও?
–আমি চামু ক্যান? আপনে চুরিধারি করেন নাই, আপনে বুঝবেন ক্যামনে চোরের কাম কত কঠিন।
–আইজ্ঞা, বিশটাকাই দিমু।
–আপনার এত পয়সা হইল কবে? করেন তো পুরুতগিরি।
–আরে কাম আমার না, আমি নিমিত্ত মাত্র।
–হেইরে বুঝছি। আপনার পিছনে কেডা আছে কন তো।
–কওন যাইব না হে।
–তা হইলে মাপ করবেন মশয়, পারুম না।
–পোষাইল না নাকি হে? কামটা তো কঠিন না হে। একখান তরোয়াল বাইর কইরা আনবা।
–বন্দুক ফুটাইলে তো প্রাণটা আপনার যাইব না, যাইব তো আমার। বালবাচ্চা লইয়া ঘর করি মশয়, গুল্লি খাইয়া মারতে পারুম না।
লাটুকে যতটা বীর ভেবেছিল কানু, ততটা বীর সে নয় দেখে একটু হতাশই হল। সন্ধেবেলা ফের পরেশ ঘোষের কাছে এসে বলল , না ঘোষমশয়, লাটু একখান ভেড়ুয়া।
পরেশ ঘোষ তামাকটা একটু ঘন ঘনই খায়। উত্তেজিত হলে টানটাও দেয় উপর্যপুরি। বেশ কিছুক্ষণ তামাক খেয়ে বলল , তুমিই একবার চেষ্টা কইরা দেখবানাকি?
আজ ফুলকপি সাঁতলানোর মাতাল গন্ধটা আসছিল। আহা, নতুন কপি, তার গন্ধই আলাদা। ঘোষের কথাটা কানেই গেল না। ফুলকপির গন্ধ কথাটা খেয়ে নিল।
–কিছু কইলেন নাকি ঘোষমশয়?
–কইলাম। ঠেকায় পড়লে মাইনষে কী না করে?
–যা কইছেন। কিন্তু কামটা কী?
–লাটুর বদলে তুমিই লাইমা পড়।
–বুঝাইয়া কন।
–আরে, কৃষ্ণও তো ননী মাখন চুরি করত। করত না?
–আইজ্ঞা।
–হেই কথাই কই। তুমি চালাক মানুষ, লাটু পারলে তুমিই বা না পারবা ক্যান? রাসুর বাড়ির তো ঝুরঝুরা অবস্থা, বিড়ালের লাথিতে কপাট ভাইঙ্গা পড়ে। আমি কই রাত বিরাইতে গিয়া যদি ভিতরে ঢুইক্যা পড়, কাম ফরসা।
কানু গোঁসাই বিষণ্ণ মুখ করে বলল , চোরও হইতে কন? এই দুই হাতে পূজা করি।
–শোনো হে বাপু, মূল্য দিলে দোষ থাকে না। চুরি তো নিজের লিগ্যা করবা না, আমার লিগ্যা করবা। তার মূল্য ধইরা দিলে আর দোষ থাকব না। তুমি নিমিত্ত মাত্র।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানু বলে, আমি গরিব ঠিকই, তবে পইচ্যা যাই নাই ঘোষমশয়।
–চুরির বুদ্ধিটা কিন্তু তুমিই দিছিলা।
–তা দিছিলাম।
–তা হইলে আমার দোষ কী কও।
–দোষ আমার কপালের।
–চেইতো না হে গোঁসাই। মাথা ঠান্ডা কর।
–চেতি নাই। ভাবতাছি আসলে কথাটা কইলেন কেমনে। গরিবরে কি হলই কওন যায়?
–দোষের কথা কিছু কই নাই। মাথা ঠান্ডা কইরা ভাবলেই দিশা পাইবা। যাউকগা, কাজটা তো উদ্ধার করতে হইব। একখান বুদ্ধি বাইর কর।
কানু গোঁসাই ফের ফুলকপির গন্ধ পাচ্ছিল। এবার ঝোলের গন্ধ। নতুন আলু দিয়েই বোধ হয় হচ্ছে ঝোলটা। কই মাছ দিয়ে কি? হতেও পারে। ফুলকপি দিয়ে কই মাছ দেবভোগ্য। একটা ঢোঁক গিলে ফেলল কানু গোঁসাই।
–কিছু ভাবলা গোঁসাই? আগে ব্রাহ্মণরাই আছিল পরামর্শদাতা। তাগো বুদ্ধিতেই সমাজ চলত। তাগো ট্যাকে পয়সা নাই, গায়ে জোর নাই, কিন্তু বুদ্ধি আছিল ক্ষুরধার।
–আইজ্ঞা।
–কামটা উদ্ধার কইরা দাও গোঁসাই।
–রামপদর কি খুবই বিপদ ঘোষমশয়?
–বছরে ব্রাউন সাহেবের টার্ন ওভার জানো? লাখ টাকার ওপরে। রামপদ কম কইরাও বছরে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা কামায়। ব্রাউন যদি তারে ছাড়ে তা হইলে রামপদরে গলায় দড়ি দিতে হইব। বোঝলা?
–মেলা টাকা।
টাকার গল্প শুনতে কানু গোঁসাই খুবই ভালোবাসে। রামপদ বছরে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা কামায় শুনে কান জুড়িয়ে গেল। বড়লোকের দুঃখ সে সইতে পারে না। বড়লোকেরা তো আর এমনি–এমনি বড়লোক হয়নি, ভগবান তাদের দিয়েছেন বলেই না তারা বড়লোক।
পরেশ ঘোষ কোটা মুখ থেকে সরিয়ে বলল , হ, মেলা টাকা। এখন তুমিই কও গোঁসাই, ব্রাউন সাহেব রামপদরে ছাড়লে রামপদ যদি গলায় দড়ি দেয়, তা হইলে তার বইন আমারে পিছার বাড়ি না দিয়া ছাড়ব?
–ব্রাউন সাহেব তিন হাজার টাকার ওপরে উঠব?
–কইতে পারি না। তবে তিন হাজারে যে উঠেছে এইটাই আমার বিশ্বাস হইতে চায় না।
–সমস্যা কী জানেন? রাসুবাবু টাকারে টাকা মনে করে না। ছিড়া ত্যানা পইরা থাকলেও অহঙ্কার যায় নাই।
–ঘাড় ত্যাড়া হারামজাদা। একখান জং ধরা তরোয়াল পইড়া আছে, হেইটা দিয়া তর হইব কী রে নিব্বইংশার পো?
–এয়ারলিংনা কী জানি কইছিল।
–হ, এয়ারলিং না ঘোড়ার ডিম।
তরোয়ালখান অর ইসের মইধ্যে ঢুকাইয়া দিতে পারলে মেজাজটা আমার ঠান্ডা হইত।
–আইচ্ছা, ঘোমশয়, রামপদর বিয়া দিতে আছেন না ক্যান? সাতাইশ-আটাইশ বছর বয়স তো হইল।
–নবাবপুত্তুর বিয়া করলে তো? কইয়া দিছে বিয়া টিয়া করব না, কেবল টাকা কামাইব। টাকারেই বিয়ে করছে ধইরালও।
হ্যাঁ, কইমাছই বটে। এইবার ঝোলের গন্ধে কই মাছের গায়ের গন্ধও যেন পেল কানু গোঁসাই। কই মাছের সঙ্গে ফুলকপির বিয়েটা যেন রাজযোটক। নাঃ, আর বসে থাকলে কচুর ঝোল আর ভাত মুখে রুচবে না। কানু উঠে পড়ল।
–গেলা গিয়া নাকি? –
-আইজ্ঞা।
–খাড়াও, তোমারে কিছু দিই।
আজ দুটো টাকা এল হাতে। খারাপ কী!
পরদিন বাইশপুরের ঘাটে গিয়ে রামপদকে ধরল কানু। ধরা সোজা কথা নয়। রামপদ ব্যস্ত মানুষ। মালের স্টিমারে এখানে সেখানে বেঘোরে ঘুরতে হয়। তাকে ধরতে তিন চার জায়গায়। হানা দিতে হল কানুকে। শেষে খবর পেল, ব্রাউন সাহেবের লঞ্চ বাইশপুরের ঘাটে মাল নামাচ্ছে। রামপদ সেখানে। দুপুরে সেইখানে গিয়ে হাজির হল কানু। রামপদ দাঁড়িয়ে পাটের গাঁট গুনছিল। গোনা শেষ করতে সময় লাগল। ততক্ষণে নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় ফের শীত ধরে গেছে কানুর।
–রামপদ, কথা আছে।
–আসেন গোঁসাইদা, লনচে আইস্যা বসেন।
–বহনের সময় নাই। মেলা কাম।
–কী কাম?
–তোমারই কাম। ব্রাউন সাহেবের তরোয়ালখান লইয়াই কথা।
রামপদর মুখ উজ্জ্বল হল, কিছু উপায় করলেন? সাহেব তো আমার মাথা খাইয়া ফালাইল। কইয়া দিছে এক মাসের মইধ্যে তরোয়াল না পাইলে আমারে ত্যাজ্যপুত্র করব।
–আমার লগে তোমারে একখানে যাইতে হইব।
–কোনখানে?
–যেইখানে লইয়া যামু। যা কই শোনবা।
–তা যাইতে পারি। বাইশপুর থিক্যা মাল উঠব। লঞ্চ খান দুই দিন এইখানেই থাকব।
–তা হইলে লও, অখনই বাইর হইয়া পড়ি।
–চলেন। তার আগে নদীতে ডুব দিয়া চাইট্টা ভাত খাইয়া লই। আপনেও আসেন, কাজরী মাছের ঝোল দিয়া ভাত।
অনেকদিন পর কাজরী মাছ। জিব থেকে পেট অবধি যেন পদ্মার ঢেউ খেলে গেল আজ কানুর।
–যাইবেন কই গোঁসাইদাদা?
–রাসুর কাছেই যামু।
–সর্বনাশ, আমারে দ্যাখলে তো তার ঊনপঞ্চাশ বায়ু কূপিত হইব।
–জানি, তবে তোমর লিগ্যা একখান শ্যাষ চেষ্টা তো করতে হইব। তোমার ভগ্নীপতিও ঠেকায় পড়ছে তোমারে লইয়া। মাইনকা ঢিপি।
–আইজ্ঞা। তরোয়ালখান না পাইলে সাহেব যে কী করব আর না করব তার ঠিক নাই। আমার সোনার কারবার ছারেখারে যাইব গোঁসাইদা।
–বুঝছি। অখন লও, এখখান ডিঙ্গা ভাড়া করো। রাসুর গ্রাম বেশ দূরে না।
ডিঙেয় বসে কানুর একটু ভাতঘুম হল। তার ফাঁকে-ফাঁকে রামপদর কিছু দুখের কথা। বড়লোকের দুঃখ কানুর ঠিক সয় না। দুঃখ–টুঃখ যা কিছু তা এই তার মতো গরিবরাই করবে। বড়লোকদের দুঃখ হওয়ার দরকার কী? ভগবান তো তাদের দুঃখ করার জন্য পাঠাইনি। এই সাদা সাপটা ব্যাপারটা কানু পাকা বুঝেছে।
রাসুর দেখা পাওয়া গেল তার বাগানে। খুরপি হাতে বাগানে ফুলগাছের জমি উসকোচ্ছে। বিশাল বাগান, বিশাল বাড়ি তবে পড়তি অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। বাড়ির গায়ে চাপড়া খসে পড়ে খোস পাঁচড়ার মতো দাগ। বাগানের ঘের–পাঁচিল বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে, সেখানে কঞ্চির বেড়া দেওয়া। না, রাসুর অবস্থা খারাপই। শুধু হামবড়াই ছাড়া কিছু নেই।
–নমস্কার রাসুবাবু।
–কেডা রে? আরে গোঁসাই! আবার আইছ?
–আইলাম রাসুবাবু।
–আবার তরোয়ালের খোঁজে নাকি? পরেশ তোমায় কত টাকায় কিনছে কও তো?
–আইজ্ঞা, আমার মতো মাইনষের দাম কী কন?
–তোমারে তো কইয়াই দিছি, টাকার মলম দিয়া আমারে নরম করতে পারব না। টাকা আমি জীবনে মেলা দেখছি।
–আইজ্ঞা, একখান কথার মানে জিগাইতে আইছি।
–কী কথা?
হেইদিন যে কইলেন তরোয়ালখান আপনগো এয়ারলিং–হেই কথাটার মানে কী?
রাসু কিছুক্ষণ বেকুবের মতো চেয়ে থেকে বলল , কইছিলাম নাকি?
–কইছিলেন, পরেশবাবুও কথাটার মানে জানে না।
রাসু মাথা নেড়ে বলল , আমিও জানি না। ব্রাউন সাহেব কইছিল, হেইরেই কইলাম।
কানু হেসে বলল , আমি রামপদরে জিগাইছিলাম। হ্যায় কিন্তু জানে।
–কী জানে?
–এয়ারলিং মানে হইতাছে বংশের স্মারক। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দ্রব্য।
–তাই নাকি?
–আইজ্ঞা।
–তাতে হইল কী?
–কইতাছিলাম, আপনের তো একখান মাইয়া, পোলা নাই। আপনেরটা পাইব কেডা?
–ক্যান কমলি পাবি।
–হেই কথাই কইতে আইলাম। কমলিই যদি পায় তা হইলে তো আর বংশে জিনিসটা থাকব। বেহাতি হইবই।
–তরোয়ালখান লইয়া আর মাথা ঘামাইও না হে গোঁসাই। এখন আস গিয়া। আমার কাম আছে।
–আমি কই কি, তরোয়ালখান দিয়া গিটঠুটা কাইট্যা ফালান।
–তার মানে?
–কমলির বয়স চৌদ্দো গিয়া পনেরোয় পড়ছে। ঠিক কইছি?
–হ, হঠাৎ কমলির বয়স লইয়া কথা ক্যান?
–গিটঠুটা কাটনের লিগ্যা। রামপদ পাত্র ভালো। বছরে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা রোজগার।
–কও কী? পরেশ ঘোষের মতো ছোটলোক যার ভগ্নীপতি তার লগে মাইয়ার বিয়া?
–আইজ্ঞা, পরেশ ঘোষের বংশ খারাপ হইলে কি তার শ্বশুরবাড়িতেও দোষ অর্শায়? আপনে তো আহাম্মক নন, একটু ভাইব্যা দেখেন।
রাসুর মুখটা একটু ঝুলে পড়ল, গলার স্বরটাও নেমে গেল, ফান্দে ফালাইতে আইছ নাকি হে?
–আইজ্ঞা। ফান্দে না ফালাইলে সংসার চলে কেমনে? হল্পলেই হলরে ফান্দে ফালায়। সংসারের নিয়ম।
–দেখো হে, রামপদ পাত্র খারাপ না। কিন্তু তার বাপেও যদি পরেশ ঘোষের বাপের মতো হারামজাদা হয় তা হইলে?
–রামপদর বাপ নাই। বিধবা মা আছে। রামপদ বিয়া টিয়া না করিয়া জীবনটা কাটাইব বইল্যা ঠিক কইরা ফালাইছিল। তারেও ফান্দে ফালাইতে হইছে।
–রাজি আছে?
–আইজ্ঞা, রাজি না হইলে সাহেব যে তারে ত্যাজ্যপুত্র করব।
–নাকি? মাইয়া না দেইখ্যাই রাজি হইল?
–দেখে নাই কে কইল? কমলি ওই জামতলায় এক্কাদোক্কা খেলত্যাছে। লইয়া গিয়া দেখাইয়া দিছি। কী আর কমু, ওইরকম সুন্দরী মাইয়া পছন্দ না হইয়া উপায় কী? রামপদর তো অখন লোল পড়তাছে।
–রামপদ! তারে লইয়া আইছ নাকি?
–আনছি। হ্যায় ডিঙ্গায় বইস্যা আছে। আপনেরে ভয় পায়।
–আরে, আরে, কী কাণ্ড! যাও, যাও, তারে লইয়া আস। এই বাড়ির একটা মান মর্যাদা আছে।
রামপদ এল, ভারী লাজুক মুখ, মুখে রক্তাভাও। আর রাসুর মুখেও আজ অমায়িক হাসি। রামপদরাজি, রাসুরাজি, তলোয়ারও রাজি। চারদিকটায় যেন আজ রাজি–জি ভাব।
কথাবার্তা একরকম পাকাই হয়ে গেল। এমনকি রাসু বিয়েটা মাঘ মাসে পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল, রামপদই মৃদু স্বরে বলল , না, অঘ্রানেই হউক।
ফেরার সময়ে রাসু আড়ালে ডেকে বলল , না হে গোঁসাই, তুমি বাহাদুর লোক, এক কোপে দুই গিটই কাটলা। এক গাল হেসে কানু বলল , আইজ্ঞা, আমি বড়লোকের দুঃখ সহ্য করতে পারি না।