হরণ

হরণ

হ্যালো! হ্যালো!

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন না।

আচ্ছা, এটা কি টু ফোর সেভেন থ্রি ফোর জিরো ফোর জিরো?

এই মেরেছে, নম্বরটা তো ঠিক জানা নেই।

আচ্ছা, এটা বিজয় ঘোষের বাড়ি কি?

বিপদে ফেললেন মশাই, এই বাড়ির কর্তার নাম কি বিজয় ঘোষ নাকি?

আপনি কে বলছেন বলুন তো!

আমি এ-বাড়ির একজন গেস্ট বলতে পারেন।

গেস্ট! গেস্ট? অথচ হোস্টের নামটা বলতে পারছেন না?

আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন?

শিকাগো।

শিকাগো? ও বাবা, সে তো অনেক দূরের পাল্লা!

তাহলে আপনাকে সত্যি কথাটা বলাই যায়।

আপনার দিক থেকে কোনো বিপদের ভয় নেই।

কী যা তা বলছেন! পাগল নাকি?

না, ঠিক পাগল নই। আমি আসলে একজন চোর।

চোর! বলেন কী মশাই! আপনি চোর!

হ্যাঁ, অত অবাক হচ্ছেন কেন? চোর কথাটা নিশ্চয়ই আপনি এই প্রথম শুনছেন না!

ইয়ার্কি মারছেন না তো!

না মশাই, না। অনেক মেহনত করে সবে ঘরে ঢুকেছি, এমন সময় হঠাৎ ফোনটা বাজতে লাগল। কাজের সময় ফোনটোন বাজলে বড় ফ্যাসাদে পড়তে হয় মশাই, তাই ফোনটা তুলে কথা কইছি।

সর্বনাশ! আমি যে, ভীষণ নার্ভাস ফিল করছি!

আমিও। আপনার চেয়ে বরং একটু বেশিই।

দেখুন, আপনার কাছে আর্মস নেই তো! পিস্তল টিস্তল বা ছোরাছুরি?

আরে না। ওসব নিয়ে বেরোলে আরও বিপদ। ওসব কাছে থাকলেই মনে জিঘাংসা আসে, আর তা থেকে খুনোখুনিও হয়ে যেতে পারে। তাই আমি ওসব রাখি না।

দেখুন, আমার টেলিফোনের স্ক্রিনে ডায়াল করা যে-নম্বরটা দেখতে পাচ্ছি সেটা আমাদের বাড়ির নম্বর-ই বটে। আচ্ছা, এটা কত নম্বর বাড়ি বলুন তো! সেভেনটি ফোর ডি বাই ওয়ান…?

বিপদে ফেললেন মশাই, বাড়ির নম্বরটা তো দেখিনি।

বাইরের দরজায় আমার বাবা বিজয় ঘোষের নেমপ্লেট আছে।

সদর দিয়ে তো ঢুকিনি মশাই যে নেমপ্লেট দেখতে পাব। আমি ঢুকেছি পেছনের জানালার গ্রিল কেটে। পরিশ্রম বড়ো কম হয়নি।

দেখুন, আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি কি?

আহা, অত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে? বলে ফেলুন।

আপনি যখন চোর তখন চুরি তো করবেন-ই, সে তো আর আটকাতে পারব না। কিন্তু প্লিজ, আমার মা বাবার কোনো ক্ষতি করবেন না। আর আমার একটা ছোটোবোনও আছে। প্লিজ, প্লিজ, ওদের ওপর চড়াও হবেন না, আপনার যা খুশি নিয়ে যান।

কিন্তু কেউ যদি জেগেটেগে যায় তাহলে তো আমাকেও মাথা বাঁচাতে হবে মশাই! চোরের প্রাণ বলে কি প্রাণটার দাম নেই?

অবশ্যই আছে, অবশ্যই আছে।

তাহলে কথা দিই কী করে?

আচ্ছা, একটা কাজ করছি। লাইনটা আমি ধরে ধাকছি, আপনিও লাইনটা কাটবেন না। কেউ যদি বাইচান্স জেগে যায়, তাহলে তাকে আগে আমার সঙ্গে কথা বলে নিতে বলবেন।

এ-প্রস্তাবটা অবশ্য খারাপ নয়। বাড়িতে আর কেউ নেই তো? ধরুন, গুণ্ডা প্রকৃতির কোনো ভাই বা আহাম্মক কোনো চাকর?

না, না আর কেউ নেই। আমরা দুই ভাই-বোন আর বাবা-মা।

বাঃ, আপনাদের বেশ ছিমছাম ফ্যামিলি।

হ্যাঁ। আপনার ফ্যামিলি কি বড়ো?

নাঃ। ফ্যামিলিই নেই।

ও। বিয়ে করেননি বুঝি?

নিজেরই পেট চলে না, তার বিয়ে।

সে তো ঠিকই। আমাদের গরিব দেশ, কত লোক খেতে পায় না।

খিদের কষ্টটা কি টের পান? আপনি তো একটা ঝিনচাক দেশে আছেন। শুনেছি সেখানে নাকি মানুষ বেশি খেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে!

ঠিকই শুনেছেন। আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো প্রবলেম ওবেসিটি। খুব জাঙ্ক ফুড খায় তো!

ওই হট ডগ, পিৎজা, হ্যামবার্গার এইসব তো!

হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি তো বেশ জানেন দেখছি!

ওসব আজকাল সবাই জানে। পড়াশুনো করতে গেছেন, না চাকরি করতে? দুটোই। আমি আই টি-র ছাত্র। আবার চাকরিও করছি।

বাঃ, খুব ভালো। এখন তো আই টি-রই যুগ! আশ্চর্য! আপনি তো সত্যিই বেশ জানেন। চোর বলেই কি আর মুখ? সামান্য হলেও বিদ্যে একটু আছে। রোজ খবরের কাগজ পড়ি।

না, না, আমি আপনাকে মূর্খ বলতে চাইনি। আসলে আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে আপনি অন্য সব চোরদের মতো নন।

কী করে বুঝলেন? ক-টা চোরের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?

তা নেই ঠিকই। আন্দাজ থেকে বলছি।

দিনকাল পালটে গেছে মশাই। এখন আর আগেকার মতো বোকা বোকা চোরের যুগ নেই। গেরস্তরাও যেমন চালাক-চতুর হয়েছে, চোরও হয়েছে সেয়ানা। আগে ঘরে ঘরে জানালায় শিক থাকত। সেটা বেঁকিয়ে ঘরে ঢাকা সোজা। আজকাল গ্রিল হয়েছে, সেটা বাঁকানো যায় না বলে আমাদের গ্যাস কাটার ব্যবহার করতে হয়। আর আমেরিকার চোররা তো রীতিমতো ইলেকট্রনিক এক্সপার্ট।

ঠিক কথা। খুব সংকোচের সঙ্গে একটা কথা বলব?

বলুন না। আমি কথাটথা কইতে ভালোই বাসি।

কথা শুনলে জ্ঞানও বাড়ে।

বলছিলাম কী, আমাদের বাড়িতে ক্যাশ টাকা বেশি থাকে না। গয়নাগাটিও সব লকারে।

এই তো মাটি করলেন। গয়নাগাটি লকারে রাখতে গেলেন কেন? আজকাল তো ব্যাঙ্কের লকার থেকে দেদার জিনিস হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এটা কাঁচা কাজ হয়েছে মশাই।

লকারের জিনিসে ব্যাঙ্ক কোনো গ্যারান্টিও দেয় না। গেলেই গেল।

আপনি হয়তো ঠিক বলছেন। কিন্তু আমার মা-বাবার ব্যাঙ্কের ওপর অগাধ বিশ্বাস। তবে আপনাকে শুধু হাতে ফিরে যেতে হবে না।

ক্যাশ টাকা কোথায় পাওয়া যাবে আমি বলছি। রান্নাঘরে মিটসেফের মধ্যে একটা পুরোনো গ্ল্যাকসোর কৌটো আছে। বড়োকৌটো। তাতে মুসুরির ডাল রাখা হয়। ওই ডালের মধ্যে হাত চালালেই কিছু টাকা পাওয়া যাবে।

কত হবে? বিশ-ত্রিশ নাকি?

কিছু বেশিও হতে পারে। ধরুন শতখানেক।

দুর। ওসব পেটি ক্যাশ ছুঁই না আমি।

আপনার কাছে কি টর্চ আছে?

আছে। তবে চোরেদের আলো জ্বালানো বারণ। টর্চের কথা কেন?

বলছিলাম কী, টর্চ থাকলে আপনার একটু সুবিধে হবে। দক্ষিণদিকে যে শোয়ার ঘরটা আছে সেখানে গোদরেজের আলমারির নীচের তাকে চারটে অ্যালবাম পাবেন। সবুজ মলাটঅলা অ্যালবামের ভেতরে খুঁজলেই অন্তত হাজারখানেক টাকা পেয়ে যাবেন।

আহা, শুধু ক্যাশ টাকাই তো আমার টার্গেট নয়। দামি জিনিস কিছু নেই? এরকম একটা ঘ্যামা বাড়িতে তো দামি দামি জিনিস থাকার কথা।

হ্যাঁ আছে। গোদরেজ আলমারির পাশেই আরও একটা আলমারি পাবেন। তারমধ্যে একটা ক্যামেরা, একটা হ্যাণ্ডিক্যাম আর পোর্টেবল ভি সি ডি, অডিও ভিডিয়ো প্লেয়ার পেয়ে যাবেন।

ওসব জিনিসের সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মার্কেট খুব খারাপ। কারণ হচ্ছে, ওগুলো সারা পৃথিবীতে এত একসেস প্রোডাকশন হয়েছে যে, দামও কমে যাচ্ছে হু হু করে।

আপনি সত্যিই খবর রাখেন।

সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মার্কেটের খবর না রাখলে কী আমাদের চলে?

আচ্ছা এখন ওখানে ক-টা বাজছে বলুন তো?

দুটো পাঁচ। আপনি তো সাড়ে এগারো ঘণ্টা পিছনে আছেন। ওখানে বোধ হয় এখন দুপুর তিনটে পঁয়ত্রিশ শনিবার।

মাই গড। আপনি শিকাগোর সময় জানলেন কী করে?

জানা শক্ত নাকি?

না, শক্ত নয়, তবে–। যাকগে, আপনার টার্গেটটা কী, আমাকে একটু বলবেন?

না মশাই, কোনো টার্গেট ঠিক করে তো আর চুরি করতে ঢোকা যায় না। আর যা জোটে তাই নিয়ে পিটটান দেওয়ার মতো ছিচকে চোরও আমি নই। মেহনত করে ঢুকেছি, চারদিকে দেখে-টেখে যা পছন্দ হবে নিয়ে যাব।

অ্যান্টিক কিছু আছে?

অ্যান্টিক! না, আমাদের বাড়িতে অ্যান্টিক কিছু আছে বলে তো জানি না। তবে ছিল। শুনেছি, আমাদের ঢাকার বাড়িতে ব্রিটিশ আমলের পুতুল, ঘড়ি, খেলনা, অয়েল পেন্টিং, এনগ্রেভিং, ফরাসি দেশের রুপোর চামচের সেট এইসব ছিল।

আপনাদের দেশ কি ঢাকা?

হ্যাঁ। আমাদেরও ঢাকা। তবে শহরে নয়। গাঁয়ে।

বিক্রমপুর।

বাঃ, শুনে খুশি হলাম।

খুশি হওয়ার কিছু নেই মশাই, ঢাকাতেও শুনেছি, আমাদের তেমন সুখের সংসার ছিল না। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনারা বেশ বনেদি বড়োলোক।

না, না, বড়োলোক নই। তবে ঢাকা শহরে আমাদের বেশ বড়ো ব্যাবসা ছিল। মিষ্টির দোকান আর মনোহারি স্টোর। দেশত্যাগ হওয়ার পর ব্যাবসা লাটে উঠল।

ঢাকায় গেছেন কখনো?

না। দেশত্যাগের সময় তো আমার বাবারই জন্ম হয়নি।

আপনার বাবার বয়েস কত?

সাতান্ন। এ-কথা কেন জিজ্ঞেস করলেন?

মিলিয়ে দেখলাম। বেঁচে থাকলে আমার বাবার বয়স হত পঞ্চান্ন।

বেঁচে নেই বুঝি?

না, ইস্কুল মাস্টার ছিলেন।

তাই? তাহলে আপনি এই লাইনে এলেন কেন?

কেন, এই লাইন কি খারাপ?

না, মানে চুরি-টুরি কি আর ভালো জিনিস?

হাসালেন মশাই, যে-দেশের মন্ত্রী চোর, পুলিশ চোর, আমলা চোর, আপামর জনসাধারণের তিনজনের দুজন চোর সেই দেশে চুরি ভালো জিনিস না-হবে কেন? আমার বাবা মাস্টারি করতেন, চুরির সুযোগ ছিল না আর তেমনি কষ্ট পেয়ে অভাবের তাড়নায় কুঁকতে ধুকতে অকালে চলে গেলেন।

আপনি কি বলতে চান যে, আপনার অবস্থা আপনার বাবার চেয়ে ভালো?

খারাপ কী বলুন! আমার মোটরবাইক আছে, মোবাইল ফোন আছে, ঘরে কালার টিভি, ফ্রিজ আছে। এমনকী রান্নাবান্না করে দেওয়ার জন্য একজন মাইনে করা লোকও আছে। আর হ্যাঁ, আমি সেলিমপুরে যে ফ্ল্যাটে থাকি সেটা আমার ওনারশিপ ফ্ল্যাট।

বলেন কী? তাহলে তো আপনি রীতিমতো এস্টাব্লিশড!

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। তবে নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখম।

আমার কম্বিনেশনে সংস্কৃত ছিল না। ওটার মানে কী?

আমার বাবা সংস্কৃতে মস্ত পন্ডিত ছিলেন, আমাকে সংস্কৃত শিখতে হয়েছিল। আর যেটা বললাম, সেটার মানে আপনার না জানলেও চলবে।

আচ্ছা, আপনার কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, আপনি লেখাপড়া জানেন।

ওটা বলে লজ্জা দেবেন না। যা জানি তাকে লেখাপড়া জানা বলে না। আমাকে শিক্ষিত ভাবলে ভুল করবেন।

আপনি আমাকে খুব ডাইলেমায় ফেলে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আপনি আমাদের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছেন। এ-যুগটা তো বোলচালেরই যুগ। যে যত বুকনি আওড়াতে পারে সেই তত খাতির পায়।

আমার কথা শুনে ইমপ্রেসড হবেন না যেন। ভুল করবেন, আমি সত্যিই চোর।

সেটাই তো ধাঁধায় ফেলেছে আমাকে। চোর হলেও আপনার বেশ স্ট্যাটাস আছে মনে হচ্ছে। আমাদের বাড়িতে কি আর তেমন কিছু পাবেন?

ঠিকই ধরেছেন। চোর হলেও আমি একটু উন্নাসিক।

হ্যাঁ, তাই ভাবছি আপনার মতো একজন হাইফাই বার্গলারের সম্মান রক্ষার মতো কিছুই তো আমাদের নেই।

আছে মশাই, আছে। একেবারে বিনা খবরে কি আমি সময় নষ্ট করতে এসেছি? কী আছে বলুন তো? উনিশ-শো আঠারো বা উনিশের একটা রোলেক্স ঘড়ি। বেশ বড় সাইজের। পুরোনো আমলের দম দেওয়া। ঘড়ি। ঠিক কি না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে। ওটা আমার দাদুর বাবার ঘড়ি বলে শুনেছি। ওটা বাবা খুব যত্ন করে রোজ দম দেন। আশ্চর্যের বিষয়, ঘড়িটা আজও চলে। কে আপনাকে ঘড়িটার কথা বলল বলুন তো?

আমার একটা নেটওয়ার্ক আছে।

বাব্বাঃ, আপনি তো বেশ অর্গানাইজড ম্যান।

না হলে, এযুগে ব্যাবসা চলবে কেন বলুন? আপনার বাবা এই ঘড়িটা সম্পর্কে সব ইনফর্মেশন ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানিয়েও দিয়েছেন। আমি ইন্টারনেটেই সার্চ করে করে খবরটা পাই।

তার মানে আপনি ইন্টারনেটেই আমাদের ঠিকানা পেয়েছেন? তবে যে বললেন আপনি বাড়ির মালিকের নাম জানেন না, বাড়ির নম্বর জানেন না।

সাবধানের মার নেই মশাই, তাই একটু ন্যাকামি করতে হয়েছিল।

ঘড়িটা হলেই কি আপনার চলবে?

আপাতত ঘড়িটাই আমার টার্গেট। ওটার বাজারদর যাচাই করে দেখেছি পাঁচ থেকে সাত লাখ অবধি পাওয়া যেতে পারে।

বলেন কী? এই ঘড়িটার এত দাম কে দেবে?

কালেকটাররা দেবে, কোম্পানি নিজেও দেবে। ইন্টারনেটে রেগুলার ওদের বিজ্ঞাপন থাকে।

কালেকটারদের এজেন্টরা কলকাতাতেও আসে।

তবু আপনি নিজেকে শিক্ষিত বলতে চান না?

কেন বলুন তো! আপনি তো রীতিমতো শিক্ষিত মানুষ। ইন্টারনেট সার্ফ করেন মানে আপনি দুনিয়ার সব খবরই রাখেন।

না মশাই, বেশি খবর রেখে লাভ কী? আমার যেটুকু দরকার সেই খবরটুকু রাখি।

তার মানে আপনার কম্পিউটারও আছে।

আছে। চাঁদনি মার্কেট থেকে অ্যাসেম্বল করিয়ে কিনে এনেছি।

ল্যাপটপও আছে নাকি?

না। তবে আপনার বাবার ঘড়িটা গ্যাঁড়াতে পারলে ল্যাপটপও হয়ে যাবে।

ঠিক আছে। বাবা দোতলার দক্ষিণের ঘরে থাকেন। পাশের ঘরে মা আর বোন। বাবার ঘরে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল আছে। তার ডানধারে টপ ড্রয়ারে ঘড়িটা পেয়ে যাবেন।

বাঃ, ইউ আর ভেরি কো-অপারেটিভ।

কিন্তু মুশকিল হল, দোতলায় সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া আছে। আপনি তো আমেরিকায় থাকেন। জানেন কি সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ মাগারদের একটা গাড়ির লাগেজ বুট খুলতে ক-সেকেণ্ড সময় লাগে? তিন থেকে পাঁচ সেকেণ্ড।

ভগবান! আপনি কি আমেরিকাতেও হানা দিয়েছিলেন নাকি?

এ-প্রশ্নের জবাব আপনার না জানলেও চলবে। আমি কর্ডলেস ফোনটা নিয়েই ওপরে উঠছি। আপনি আমাকে গাইড করতে থাকুন।

আর একটা কথা। আমার বাবার ঘুম খুব সজাগ। সামান্য শব্দ হলেই জেগে যাবেন। যদি জেগে যান তাহলে কী করতে হবে, তা তো আপনাকে বলেই রেখেছি।

হ্যাঁ, মনে আছে। তাঁকে ফোনটা ধরিয়ে দেব এবং আপনি তাঁকে রি-অ্যাক্ট করতে বারণ করবেন।

এগজ্যাক্টলি। আর দয়া করে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করবেন না। আমার বাবার পেসমেকার আছে। কেমিক্যাল ওষুধে রি-অ্যাকশন হতে পারে।

আপনি আপনার বাবাকে খুব ভালোবাসেন, না?

খুব।

ভালো। এই ভালোবাসাটা বজায় রাখবেন। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপঃ, পিতরি প্রতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।

আমি এই শ্লোকটার অর্থ জানি।

তা তো জানেন। কিন্তু বিয়ের পর অর্থটা যেন ভুলে যাবেন না। পিতায় শ্রদ্ধা, মায়ে টান, সেই ছেলেই হয় সাম্যপ্রাণ। এটা কার কথা বলুন তো?

একজন মহাপুরুষের। তিনি মানুষের ভালো চেয়েছিলেন।

আপনি কি দোতলা পৌঁছে গেছেন?

না। উঠছি। সিঁড়িটা খুবই অন্ধকার।

সাবধানে উঠবেন।

আচ্ছা, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে নাকি?

হ্যাঁ। সত্যিই নেই তো?

না, সত্যিই নেই, কিন্তু আপনার বাবার আবার পিস্তল বা রিভলভার আছে নাকি?

আছে।

এই রে! তাহলে তো বিপদের কথা।

না না। উনি খুব সাবধানি মানুষ। পিস্তল থাকলেও সেটা আলমারিতে তোলা থাকে। লোড করা থাকে না।

তাহলে পিস্তল রাখার মানে কী?

আমার মা পিস্তল-টিস্তল একদম পছন্দ করেন না। আগে বাবা পিস্তলটা বালিশের তলায় রেখে শুতেন। মা। রাগারাগি করে ওটাকে বিছানা থেকে বিদেয় করেছেন।

খুব ভালো কাজ করেছেন। আপনাদের বাড়িতে কুকুরও নেই দেখছি।

ছিল। একটা রাগি ডোবারম্যান। সেটা আমার খুব প্রিয় কুকুর। সেটা বুড়ো হয়ে মারা যাওয়ায়, আমি কী কান্নাটাই না কেঁদেছিলাম! এখন কুকুর পোষার প্রশ্নই ওঠে না। পেডিগ্রি কুকুর রাখার অনেক ঝামেলা। আমার মা-বাবা এখন আর অত পরিশ্রমের মধ্যে যেতে চান না।

ভালোই করেছেন। কুকুর থাকলে আমাকে অন্যরকম লাইন অফ অ্যাকশনের কথা ভাবতে হত।

না, না, ওসব ভাবতে হবে না আপনাকে। আই উইশ ইউ অল সাকসেস। উঠে পড়েছেন নাকি?

হ্যাঁ। ফোনটা একটু ধরে থাকুন। তালাটা খুলে নিই।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ধরছি, আপনি খুলুন। …হয়ে গেছে নাকি?

ইজি। তালা-ফালা কোনো ব্যাপার-ই নয়। কিন্তু অন্য একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে।

কী বলুন তো?

বাথরুমে জলের শব্দ হচ্ছে। কেউ বোধ হয় বাথরুমে গেছে।

সর্বনাশ!

ভয় পাবেন না। আমার অসীম ধৈর্য, এখন কিছুক্ষণ অ্যাকশন বন্ধ করতে হচ্ছে। বুড়ো মানুষরা ঘুম ভাঙলে ফের সহজে ঘুমোতে পারেন না। আমি বরং এই ফাঁকে আপনাদের ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি।

বেশ তো। উঠে পড়ন। তবে আমার বাবা রোজ-ই ট্রাংকুলাইজার খেয়ে ঘুমোন। তাই বোধহয় ঘুমোতে অসুবিধে হবে না।

এটা তো উনি খুবই খারাপ করেন। ওসব খেয়ে শেষে অভ্যেস হয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে আর ঘুমোতেই পারবেন না। না খেলে উইথড্রয়াল সিম্পটম দেখা দেবে।

তাহলে কী করা উচিত?

পরিশ্রম। পরিশ্রমই হচ্ছে ঘুমের সবচেয়ে ভালো ওষুধ।

হার্ট প্রবলেম আছে বলে, উনি পরিশ্রম করতে পারেন না।

আজকাল সফিসটিকেটেড পেসমেকার লাগালে কোনো প্রবেলেম হওয়ার কথাই নয়।

পেসমেকার নিয়ে টেনিস খেলা, সুইমিং, জিম সব কিছুই করা যায়।

পেসমেকার সম্বন্ধে এত জানলেন কী করে?

জানা শক্ত কী? আপনার বাবাকে বলবেন, সাতান্ন বছর বয়সে আজকাল কেউ বুড়ো নয়, আর পেসমেকার মানেই জবুথবু হয়ে থাকা নয়।

বলব, নিশ্চয়ই বলব।

আপনাদের ছাদটা তো ভারি সুন্দর! টাইলস বসিয়েছেন নাকি?

হ্যাঁ।

আপনারা বেশ শৌখিন। তাই না?

তা বলতে পারেন। বাবা একটু বাবুগোছের মানুষ।

বুঝেছি।…আপনি বোধহয় কোনো মেমসাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিলেন একটু, তাই-না?

সরি, আমার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট একটা ব্যাপার জিজ্ঞেস করছিল।

আপনি তাহলে এখন অফিসে?

হ্যাঁ। পিক আওয়ার। এক হাতে ফোন অন্য হাতে মাউস।

তাহলে তো মশাই, আপনার কাজের ডিসটার্ব হচ্ছে!

আরে না না, কাজে ডিসটার্ব হবে কেন? কাজ তো একটা সিস্টেমে চলে, তারজন্য অখন্ড মনোযোগের দরকার হয় না।

আচ্ছা মেয়েটা আপনাকে কি হ্যালো সুইট হার্ট বলে ডাকল? ও তো পুরুষরা মেয়েদের বলে!

না মশাই, আজকাল সব উলটেপালটে গেছে। যে কেউ, যে কাউকে ডাকে।

মেয়েটা সত্যিই আপনার গার্লফ্রেণ্ড নয় তো?

পাগল নাকি? মেয়েটা ব্ল্যাক, মোটা আর বোকা।

আমেরিকায় প্রেম-ট্রেম হয়নি আপনার?

খেপেছেন? মেমসাহেবদের খপ্পরে পড়লে উপায় আছে? দু-দিন পর যখন ছেড়ে যাবে তখন, অ্যালিমনি দিতে দিতে ফতুর হতে হবে।

আজকাল বাঙালি ছেলেরা সেয়ানা হয়েছে। লক্ষ্মীছেলের মতো একদিন দেশে এসে টোপর পরে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবেন, তাই-না?

উপায় কী বলুন? নইলে আলুপোস্ত, বেগুনপোড়া, ইলিশ ভাপে, ধোঁকার ডালনা ভুলতে হবে যে! বউয়ের সঙ্গে বসে রবীন্দ্রসংগীত, কী ভীষ্মদেব বা শচীনকর্তার গান শোনা বা সত্যজিৎ-তপন সিংহের ছবি দেখাও বন্ধ। হয়ে যাবে। আপনার গার্লফ্রেণ্ড নেই?

না। তবে একজনকে টার্গেট করে কিছুদূর এগিয়েছিলাম, হল না।

কেন মশাই? সে কি ডিচ করল নাকি?

ডিচ তো অ্যাকসেপ্ট করার পর করে। সে আমাকে অ্যাকসেপ্টই করল না কখনো।

স্যাড ব্যাপার বোধহয়?

হ্যাঁ, আমার পক্ষে তো স্যাড বটেই।

বলতে আপত্তি আছে?

আরে না। আমার লুকোছাপার কিছু নেই।

দাঁড়ান, বাথরুমের আলো এখনও জ্বলছে কি না দেখে নিই।

জ্বলছে?

হ্যাঁ। বোধহয় বড়ো-বাইরে গেলেন। মুশকিল হল।

আপনার তাড়াহুড়ো নেই তো?

না। তবে কাজটা মিটে গেলে স্বস্তি পাওয়া যেত।

বাবা একটু পেটরোগা আছেন। তবে বাথরুমে বেশি সময় নেন না। ততক্ষণে আপনি গার্লফ্রেণ্ডের কথাটা বলে নিন-না। ততক্ষণে বাবার হয়ে যাবে।

কী আর শুনবেন! দুনিয়ার সব প্রেমের গল্পই একরকম।

না, না, তা কেন, প্রেম তো নানারকম আছে। ঝগড়া থেকে প্রেম, আক্রোশ থেকে প্রেম, মুগ্ধতা থেকে প্রেম, অনেক কম্বিনেশন আছে মশাই।

আমাদের ঠিক প্রেম হয়নি। ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিক। আপনাকে বলে রাখা দরকার, পুরুষ হিসেবে আমি মোটেই অ্যাট্রাকটিভ নই।

কী করে বুঝলেন?

আমার চেহারাটা একটু রুক্ষ টাইপের। রাগেড বলতে পারেন। মুখশ্রী মোটামুটি কুচ্ছিত। তবে আমার হাইটটা বেশ ভালো। ছয় ফুট এক ইঞ্চি।

বাঃ দারুণ হাইট তো!

হ্যাঁ, ওটাই আমার একমাত্র প্লাস পয়েন্ট, এ তো গেল চেহারা। গুণের কথা যদি জিজ্ঞেস করেন তবে বলতে হবে, আমি মোটামুটি খারাপ ছাত্র, কোনো বাড়তি গুণ, যেমন গানের গলা, ছবি আঁকার হাত, একস্ট্রা স্মার্টনেস এসব আমার নেই। মেয়েরা আমাকে অপছন্দ করে বলেই আমি যৌবনের একেবারে শুরু থেকে টের পেয়ে আসছি।

এগুলো কোনো বাধা নয়।

না, বাধা নয়। তবে চেহারা বা ব্যক্তিত্বে রিপালসিভ কিছু থাকলে অনেক সময়ে নিজে টের পাওয়া যায় না। আমাদের এক বন্ধু ছিল অশোক, তার চোহারা খারাপ ছিল না, মানুষও খারাপ নয়। পয়সাকড়িরও অভাব ছিল না, কিন্তু আমরা প্রায় সবাই ইউনিভার্সালি তাকে অপছন্দ করতাম। এই অপছন্দের কোনো লজিক্যাল ব্যাখ্যা কখনো খুঁজে পাইনি।

আচ্ছা, আপনি আত্মগ্লানি বন্ধ করে ঘটনাটা বলুন।

ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানিয়ে রাখলাম তাতে আপনার বুঝতে সুবিধে হবে। কয়েক বছর আগে আমি দিল্লি থেকে পূর্বা এক্সপ্রেসে ফিরছিলাম। সেকেণ্ড ক্লাস থ্রি-টায়ারে। এই মেয়েটিও তার মা-বাবা আর মামা-মামির সঙ্গে বেড়িয়ে ফিরছিল। মিষ্টি চেহারা, ছোটোখাটো এবং রোগা। বেশ লাজুক ধরনের সভ্য মেয়ে।

ঠিক যে-ধরনের মেয়ে আমরা সবাই পছন্দ করি?

হ্যাঁ, অনেকটা তাই। সুন্দরী আর মিষ্টির মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। এবং এই পার্থক্যটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। সব সুন্দরীই কিন্তু মিষ্টি নন।

বটেই তো। আপনার চোখ আছে। আলাপ হল বুঝি?

না। প্রথমেই নয়। বললাম-না, সে বেশ লাজুক ধরনের! তবে বাবা, মামা এবং মামি, এরা বেশ আলাপী মানুষ। কিউবিকলে মোট ছটা বার্থের মধ্যে পাঁচটাই ওঁদের। আমি একটা আপার বার্থে। ক্লোজ প্রকসিমিটিতে কিছুক্ষণ থাকলে আলাপ হয়েই যায়। আমি গোমুখ, গঙ্গোত্রী হয়ে একটা অতিদুর্গম পথে কেদারবদরী পর্যন্ত ট্রেক করে ফিরছি শুনে মামাটি খুব ইমপ্রেসড। উনিও পাহাড় ভালোবাসেন। কাজেই আলাপ জমে গিয়েছিল। যতদূর মনে আছে, পাহাড়-পর্বতের কথাই হচ্ছিল। আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটি আমাকে অ্যাভয়েড করার জন্যই বোধহয় প্রায় লাগাতার বাইরের দিকে চেয়ে বসেছিল। সুন্দর হোক, কুচ্ছিত হোক, একটা পুরুষ তো! মেয়েরা এক-আধবার তাকাবে না?

সেটাই তো স্বাভাবিক।

সেই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই ঘটছিল না। মেয়ের মাও দেখলাম বেশ গম্ভীর প্রকৃতির। তাঁদের কিউবিকলে আমার উপস্থিতিটা, তিনি বিশেষ পছন্দ আর করছিলেন বলে মনে হল না। তবে যাইহোক, ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে তো আর বাছাবাছি চলে না। মানুষ আপনাকে অপছন্দ করলে বেশ বোঝা যায়, তাই না?

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

মেয়েটির মামি তাঁদের স্কট থেকে আমাকে লুচি অফার করায় মেয়েটির মা এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন যে, আমি লুচি রিফিউজ করতে বাধ্য হই। হাসছেন? এখন অবশ্য ব্যাপারটা আমারও হাস্যকরই লাগে। তবে তখন ভারি খারাপ লেগেছিল। লুচি আমার অত্যন্ত প্রিয় জিনিস, আমার বেশ ইচ্ছেও হচ্ছিল মশাই, কিন্তু…..

যা বলেছেন। কতকাল যে লুচি খাইনি। টোস্ট আর দুধ সিরিয়াল খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেল। বিদেশে থাকার ওইটেই তো অসুবিধে।

হ্যাঁ, লুচির কথা কী যেন, বলছিলেন?

হ্যাঁ, লুচির কথাটাই বলি। পাহাড়ে ট্রেক করতে গিয়ে খাবার-দাবার বেশি জোটেনি। পয়সাও ফুরিয়ে এসেছিল। প্রায় পঁচিশ দিনের ট্যুরে ভরপেট খাবার কদিন জুটেছে তা হাতে গুনে বলা যায়। কাজেই লুচি দেখে লোভ হওয়ারই কথা।

তা তো বটেই। লুচি শুনে আমার তো এতদূরে বসেও কেমন যেন খিদে-খিদে পাচ্ছে। এবার মেয়েটির কথায় আসুন।

হ্যাঁ। মেয়েটির নাম ইতু, বয়স বেশ কম, সতেরো-আঠারোর বেশি নয়। আমার তখন সাতাশ-আটাশ।

গুড কম্বিনেশন।

কম্বিনেশন আর হল কই, আমার ইনবিল্ট রিপালসিভনেসটা মেয়েটাকে সিঁটিয়ে রেখেছিল।

এভাবেই হয়তো বাকি পথটা কেটে যেত। কিন্তু মাঝপথে একটা ঘটনা ঘটেছিল।

ঘটনা! সুইট সামথিং?

সুইট হওয়ারই তো কথা মশাই, কিন্তু যার কপাল খারাপ তার সকলই গরল ভেল।

আগে শুনিই না।

ব্যাপারটি হয়েছিল, ওদের পাঁচজনের টিকিটটা ছিল ইতুর কাছে। একটু আগে যখন পাটনায় টিকিট দেখতে এসেছিল তখন মেয়েটাই টিকিট বের করে দেখায়। এটুকু আমি দেখেছিলাম। তারপর মেয়েটা নাকি আনমনে টিকিটটা হাতে পাকিয়ে বেখেয়ালে একটা খালি খাবারের বাক্সের গার্ডারে গুঁজে রেখে দেয়। সেটা মনে ছিল না, তারপর হঠাৎ বাক্সটা নেড়ে সেটা খালি টের পেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। তখন ভাগ্যিস সকালবেলা আর ট্রেনটা সবে পাটনা স্টেশন ছেড়ে ধীরে চলছে। মেয়েটা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, এ মা:, আমি টিকিটটা ফেলে দিলাম যে! শুনে সবাই তো চেঁচামেচি শুরু করে দিল। হঠাৎ বিপদ ঘটলে অনেক সময়েই বুদ্ধি স্থির থাকে না। আমি তাড়াতাড়ি উঠে চেন টেনে বললাম, ব্যস্ত হবেন না, আমি দেখছি। বলে ট্রেন ভালো করে থামবার আগেই আমি নেমে পেছন দিকে ছুটতে লাগলাম। সবে পাহাড়-পর্বতে চড়ে এসেছি, বডি খুব ফিট ছিল। কাজেই বেশ খানিকটা এবড়ো-খেবড়ো জমি পেরিয়ে গিয়ে সাদা রঙের বাক্সটা পেয়ে গেলাম। গার্ডার থেকে টিকিটটা খুলে নিয়ে ফের দৌড়ে এসে কামরায় উঠে পড়লাম। গার্ড আর অ্যাটেনড্যান্ট এসে ব্যাপার। জেনে একটু সতর্ক করে দিয়ে চলে গেল।

তখন তো আপনি হিরো!

অতটা না হলেও বরফ একটু গলল। ধন্যবাদ টন্যবাদ হল, বাবা, তুমি বাঁচালে, গোছের সাধুবাদও পাওয়া গেল, এমনকী এতক্ষণ আমাকে দর্শনযোগ্য মনে না হলেও ইতুও ভারি কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে ক্ষমা চাওয়ার মতো কিছু একটা বলেছিল। আর ইতুর মা খুব উদ্যমের সঙ্গে প্রচুর লুচি খাওয়ালেন। সঙ্গে তরকারি, আচার, মিষ্টি।

যাক, মশাই, লুচিটা শেষ অবধি জুটেছিল?

হ্যাঁ। আমি রিফিউজ করার চেষ্টা করেছিলুম, তবে উনি ছাড়লেন না।

তারপর?

অবশেষে পাঁচজনের সঙ্গেই আমার বেশ সহজ সম্পর্ক হয়ে গেল। এমনকী ওঁরা ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্যও আন্তরিকভাবে নেমন্তন্ন করলেন।

গেলেন নাকি?

কী করব বলুন, মেয়েটাকে এতই ভালো লেগে গিয়েছিল যে, মুখখানা কিছুতেই ভুলতে পারলাম না। সাধারণত ট্রেনের আলাপ ট্রেনেই শেষ হয়, কিন্তু আমার ভেতরে কী-যে একটা গন্ডগোল করে দিল মেয়েটা! তবে হ্যাংলার মতো পরদিনই ছুটে যাইনি। কয়েকদিন পর এক বিকেলে ঠিকানা খুঁজে গিয়ে হাজির হলাম। তাঁরা বেশ খাতিরও করলেন। এমনকী ইতুও এসে সামনে বসল। চা-টা খেয়ে চলে এলাম। প্রথমদিন খুব বেশিক্ষণ বসলে খারাপও তো দেখায়। কিছুদিন পর আবার গেলাম। ইতুদের বাড়ি আর ওর মামার বাড়ি হরিশ মুখার্জি রোডের একটা মাল্টিস্টোরিডের পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটে। দুই পরিবারে খুব ভাব। মামার ছেলেপুলে নেই। আর ইতু তার মা-বাবার একটিই সন্তান। খুবই আদরের পাত্রী।

তখন আপনি কী করতেন?

না, তখনও আমি চোর হইনি। চাকরি-বাকরির চেষ্টা না করে, আমি একটা ব্যাবসা করার চেষ্টা করছিলাম। তার আগে টু-হুইলার সারানোর একটা দোকান দিয়েছিলাম পার্টনারশিপে। আমার লেবার, পার্টনারের ক্যাপিটাল। কিন্তু পার্টনার পার্টনারশিপ ভেঙে দিল। এরপর গুঁড়ো মশলা।

গুঁড়ো মশলা? অফ অল থিংস গুড়ো মশলা? কেন মশাই, টু-হুইলার ছেড়ে গুঁড়ো মশলা কেন?

আমাদের কি কোনো চয়েস আছে মশাই? এক চাক্কিওয়ালার সঙ্গে একটু ভাব ছিল। সেই আমাকে পরামর্শ দিল, সস্তার হোটেলগুলোতে প্রচুর গুঁড়ো মশলার চাহিদা। সে আমাকে সাপ্লাইয়ের লাইন ধরিয়ে দেবে। সস্তায় মশলা কিনে এনে যদি, তার চাক্কিতে পেষাই করে নিই তাহলে সে আমার ব্যাবসায়ে টাকা খাটাতেও রাজি।

ব্যাবসাটা কি চলেছিল?

হ্যাঁ। আর আশ্চর্যের বিষয় চাক্কিওয়ালা বিহারী লোকটা আমাকে সত্যিই সাহায্য করেছিল। বছর দুয়েকের মধ্যে আমার অবস্থা বেশ ভদ্রস্থ হয়ে উঠল। যে সময়ে ইতুর সঙ্গে আলাপ সেই সময়ে আমার মান্থলি ইনকাম প্রায় হাজার পনেরো টাকা নিট। ব্যাবসা ভালো চলছে, এমনকী আমি কয়েকজন এজেন্টকেও কমিশন বেসিসে কাজ দিয়েছি। আমার সংসারের হালও ফিরেছে।

আপনার ফ্যামিলি কি বড়ো?

না। সেইটেই বাঁচোয়া। বাবা মারা গেছে, ছোটোবোন আর মাকে নিয়ে আমার ফ্যামিলি ছোটোই, তবে বোনের বিয়েতে কিছু ধারকর্জ হয়ে গিয়েছিল। লাভ ম্যারেজ বলে বাঁচোয়া। নেগোশিয়েট করে বিয়ে দিতে গেলে আরও ধসে যেতাম।

এবার ইতুর কথায় ফিরুন।

হ্যাঁ হ্যাঁ। দাঁড়ান, বাথরুমের আলোটা দেখে নিই।

নিভে গেছে?

হ্যাঁ। এবার ওঁকে ঘুমোনোর সময়টুকু ছাড় দিতে হবে। তবে খুব বেশি দেরি করা চলবে না, রাত প্রায় তিনটে বাজে।

অন্তত মিনিট দশেক ছাড় দিন। অবশ্য সেফগার্ড হিসেবে আমি তো আছিই। তবু হঠাৎ মাঝরাতে একটা চেঁচামেচি হওয়াটা ভালো নয়। আমাদের পাড়ায় আবার নাইট গার্ড ঘোরে।

জানি। ওসব না জেনে কি আর কাজে নামতে হয়?

এবার বলুন।

ইতুর মামি একদিন তাঁদের ফ্ল্যাটে আমাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমি ইতুর প্রতি ইন্টারেস্টেড কি না। আমি সঙ্গে সঙ্গে কবুল করলাম যে, ইতুকে আমার ভীষণ পছন্দ। উনি তখন আমার বাড়িঘর, রোজগার এসবের খোঁজ-খবর নিলেন। আমি সব বলে দিলাম। উনি বিরসমুখে বললেন, দ্যাখো বাপু, ইতু বাপের এক মেয়ে। মামারও বড্ড আদরের ভাগনি। তোমার যা অবস্থা তাতে স্বাভাবিক নিয়মে ইতুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তবে তোমাদের মধ্যে যদি ভাব-ভালোবাসা হয়ে থাকে, তবে গার্জিয়ানরা কেউ আপত্তি করবে না। বরং তোমারও একটা হিল্লে হয়ে যাবে।

ইতুর মনোভাব কী বুঝলেন?

সেইটেই তো গল্প। আমি একদিন ওদের বাড়ির বাইরে ইস্কুলের পথে ওর সঙ্গে দেখা করলাম। যেমনটা নিয়ম আর কী। ইতু আমাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়াল না। এমনকী রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসতেও রাজি হল। যেন এসব তার কাছে কিছু নতুন ব্যাপার নয়।

অত তাড়াহুড়োর দরকার নেই। এ জায়গাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। একটু আস্তে ধীরে বলুন।

আপনি ভাবছেন একটা রোমান্টিক অ্যাফেয়ার? তা নয় মশাই, একেবারেই তা নয়। আমি প্রস্তাবটা উত্থাপন করতেই ইতু হঠাৎ হেসে ফেলল। তারপর একেবারে সোজা চোখে চোখ রেখে বলল, দেখুন, আপনি যে কেন ঘুরঘুর করেন তা আমি অনেক আগেই জানি। আরও কয়েকজন আমার সম্পর্কে আপনার মতোই দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমি ইন্টারেস্টেড নই। আমার জীবনে কিছু অ্যাম্বিশন আছে। মাত্র সাড়ে সতেরো বছর বয়সে আমি আমার অ্যাম্বিশন বিসর্জন দিতে পারব না। আপনি প্লিজ, এসব নিয়ে আর ভাববেন না। মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া কি বাঙালি ছেলেদের আর কোনো কাজ নেই?

ইশ, বড্ড কড়া মেয়ে তো! আপনি কী করলেন?

মনের দুঃখে ব্যাবসা বন্ধ রেখে ফের হিমালয়ে চলে গেলাম।

হিমালয়ে?

হ্যাঁ। দেখলাম কিছু বিপজ্জনক মেহনত না করলে দুর্বল মনকে জব্দ করা যাবে না। প্রায় দেড় মাস ধরে আমি বিপজ্জনক সব পাহাড়ে ট্রেকিং করে বেড়ালাম। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিই যে, মূল্যবোধ-টোধ সব বিসর্জন দিয়ে একটা ভয়ংকর কিছু করতে হবে। বিগ মানি, বিগ সাকসেস, বিগ ব্যাং। নারী-চিন্তাকে আর প্রশ্রয় দেব না। ফিরে এসে কয়েকদিন গুম হয়ে বসে নিজের মনের ট্রানজিটারি স্টেটটাকে মোটিভেট করলাম। তারপর কাজে নামলাম।

কী কাজ?

অ্যান্টিক। হীরাভাই নামে এক গুজরাটি অ্যান্টিক মার্চেন্ট আছে। তার সঙ্গে জুটলাম। হীরাভাই লোক চেনে। আমাকে তাড়াল না। বরং তালিম দিল কিছু। আমি তার হয়ে অ্যান্টিক জোগাড় করতে শুরু করি। এ-ব্যবসায়ে জালি বা দু-নম্বরি জিনিসের হাতবদলও খুব হয়। কলকাতার অ্যান্টিকের দোকানগুলোয়জালি জিনিসেরই কারবার। হীরাভাই আসল-নকল ভালো বোঝে। তার ক্লায়েন্ট বা কালেক্টররা বোকা বা শৌখিন কাস্টমার নয়। কাজেই আমাকে জিনিসের সন্ধানে নানা জায়গায় হানা দিতে হতে লাগল, নানা অদ্ভুত লোকের সঙ্গে ভাব করতে হল, বিপদেও পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এক বুড়ো পারসি তো তার একশো বছরের পুরোনো একটা চারনলা বন্দুক দিয়ে আমাকে গুলিও করেছিল।

মাই গড!

না, আমি তার জিনিস চুরি করতে যাইনি। গিয়েছিলাম দর করতে। তাই থেকে সামান্য অল্টারকেশন। বুড়োটা খ্যাপাটে গোছের। এই ব্যবসায়ে একটু-আধটু বিপদ আছেই।

ভেরি ইন্টারেস্টিং। আপনার কি এখনও অ্যান্টিকের-ই ব্যাবসা?

হ্যাঁ। আমার ব্যাবসাটা কিন্তু চোরাই জিনিসের নয়। বেশিরভাগ জিনিসই আমি কিনে নিই। তবে সবসময়ে কিনতে চাইলেই কেনা যায় না। যার জিনিস সে হয়তো অত্যন্ত বেশি দাম চায়, কিংবা কোনো দামেই বেচতে রাজি হয় না। তখন আমাকে একটু পরিশ্রম করতে হয়।

চুরি?

হ্যাঁ।

কিন্তু আপনি তো সাধারণ চোর নন?

কে বলল আমি সাধারণ চোর নই? আমি অত্যন্ত সাধারণ, অত্যন্ত নীতিবোধহীন চোর। একজন কনফার্মড চোর। তবে আমি চুজি। কারো বাড়িতে তাদের সোনাদানা বা টাকাপয়সা চুরি করতে যাই না। আমার টার্গেট শুধু অ্যান্টিক এবং তাও প্রপার নেগোসিয়েশন ফেল করলে, দর কষাকষিতে রফা না হলে, তবেই। কিন্তু তা বলে আমাকে মহৎ চোর বলে ভাববার কোনো কারণ নেই।

ঘড়িটা নিয়ে কি আমার বাবার সঙ্গে আপনার নেগোসিয়েশন হয়েছিল?

হ্যাঁ, ফোনে। উনি সাত লাখ টাকার এক পয়সা কমে ওটা ছাড়বেন না। অথচ আমার কাস্টমার পাঁচের বেশি দিতে চাইলেন না। মুশকিল কী জানেন, অ্যান্টিক-এর কোনো ধরাবাঁধা প্রাইস ট্যাগ নেই। মনে করুন, একটা গুপ্ত যুগের কয়েনের দাম আমরা মোটামুটি একলাখ টাকা ঠিক করে রাখলাম। হট হেডে কালেক্টর কাস্টমার হলে এবং সে যদি জিনিসটার জন্য খেপে ওঠে তাহলে দশগুণ দাম দিয়ে নিয়ে যাবে। আর যদি কুল কাস্টমার হয়, তাহলে অনেক নীচে দর দেবে। এই অ্যান্টিকের বাজারটা কিন্তু অদ্ভুত।

তাই দেখছি, কিন্তু এসব কথার মধ্যে যে ইতু হারিয়ে গেল!

না, হারায়নি, সে আমার মনের মধ্যে আজও আছে। প্রত্যেক দিন, রাতে শোয়ার সময় তার মুখ আমার মনে পড়বেই। ঠিক কথা, তার সঙ্গে আর আমার কোনো যোগাযোগ নেই, খবরও রাখি না। সম্ভবত তার বিয়েও হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।

কিছু না?

না।

আপনি তার খবর রাখেন না কেন? এক-আধবার ফোনও তো করতে পারেন! কেন? তাকে তো আমার রক্তমাংসের শরীরে আর দরকারও নেই। ওয়ান ওয়ে প্রেমের তো ওইটেই সুবিধে। প্রত্যাশা থাকে না, প্রত্যাঘাত থাকে না, কিন্তু অন্যভাবে শি বিকামস দি ক্যাপটিভ লেডি। যখন মনের মধ্যে তার আর আমার খেলা শুরু হয়, তখন সে-আমি যেমন বলাই তেমনই বলে, যেমন তাকে দেখতে চাই, সে তেমনই সেজে আসে। সত্যিকারের ইতু হয়তো সেরকম নয়।

একটা কথা বলব?

বলুন-না। তবে আমার হাতে কিন্তু আর সময় নেই। এবার অ্যাকশন।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, বাবার ঘড়িটার জন্য আপনি কত দাম দিতে চান?

আমি চার লাখ বলেছিলাম।

আচ্ছা, যদি আমি ওঁকে ওই দরেই রাজি করাই?

আপনি! কেন বলুন তো? ওঁর কোনো ক্ষতি করব বলে ভয় পাচ্ছেন নাকি?

ভয় পাচ্ছি না, এমন কথা বলতে পারি না। চুরি করলে আপনি বিনা পয়সাতেই পেয়ে যাবেন। আর যদি আপনার দরে কিনতে চান, তাহলে বাবাকে আমি রাজি করানোর ভার নিতে পারি। দি চয়েস ইজ ইয়োরস।

চুরি করতে আমি আগ্রহী নই। কিন্তু হাতে সময় কম এবং কাস্টমার ডেডলাইন দিয়ে রেখেছে বলেই কাজটা করতে হচ্ছে।

প্লিজ! ভেবে বলুন।

ঠিক আছে। কিন্তু গ্যারান্টি কী?

আপনি কাল সকাল দশটা নাগাদ বাবাকে ফোন করলেই বুঝতে পারবেন এভরিথিং হ্যাজ বিন টেকেন কেয়ার অফ।

বলছেন?

বলছি। ইটস আ প্রমিস।

ঠিক আছে, আপনার প্রস্তাব আমি মেনে নিলাম। আপনি সত্যিই আপনার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসেন। কিপ ইট আপ, কিপ ইট আপ। তাহলে আমি পাইপ বেয়ে নেমে যাচ্ছি। দাঁড়ান। আরও একটু কথা আছে।

কী কথা?

ইতু সম্পর্কে।

ইতু সম্পর্কে আপনাকে তো সবই বলেছি।

আপনি বলেছেন, কিন্তু আমারও যে কিছু বলার আছে!

আপনি ইতু সম্পর্কে বলবেন? কী আশ্চর্য!

কিছু কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা আজও ঘটে বলেই জীবনটা আনইন্টারেস্টিং হয়ে যায় না।

তাহলে বলুন।

ইতু হরিশ মুখার্জি রোডে থাকে, তাই তো?

হ্যাঁ।

বয়েস এখন উনি প্লাস বা কুড়ির কাছাকাছি?

হিসেবমতো তাই।

আমার ছকটা মিলে যায় যদি সে নিমচাঁদ বসুর মেয়ে হয়ে থাকে।

আপনি আমাকে খুব চমকে দিয়েছেন। হ্যাঁ, ইতু নিমচাঁদ বসুর-ই মেয়ে। চেনেন বুঝি?

চিনি। আপনি যেমন বলেছেন, ইতু হচ্ছে সেরকমই, নরম নরম শান্ত, স্নিগ্ধ চেহারা। স্বভাবে বা মুখশ্রীতে কোনো উগ্রতা নেই। চোখ দুটিও ভীষণ মায়াবী।

সর্বনাশ! আপনিও যে তার প্রেমে পড়েছেন মশাই।

তাতে কি দোষ হয়েছে?

আরে না, না। দোষের কথা হচ্ছে না। পছন্দ হলে আপনি তাকে বিয়ে করে ফেলুন-না। আমি আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি। এত সহজে অধিকার ছেড়ে দেবেন?

অধিকার! হাসালেন মশাই, অধিকার কীসের যে ছেড়ে দেব? তার জীবনে আমি বরাবর একজন নন-এন্টিটি। এবং তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না। আপনাকে তো বললাম, ইতু নয়, ইতুর ইমেজটাই আমাকে চমৎকার সঙ্গ দেয়। আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি নাউ।

অনেকক্ষণ কথা বলে, আপনাকে আমার খুব ভালো লাগল মশাই। আপনি একজন লাভিং, কেয়ারিং, কনসিডারেট এবং ভদ্র মানুষ। আপনার মনটাও বেশ নরম। আমার মতো রাফ অ্যাণ্ড টাফ নন। আপনার সঙ্গে ইতুকে চমৎকার মানাবে।

জেনেটিক্স কিন্তু অন্য কথা বলে। জেনেটিক্স বলে, সমধর্মীর মিলন ভালো হয় না।

সায়েন্স-এর নিয়মে কি আর জীবন চলে মশাই? এসব না ভেবে, ইতুকে বিয়ে করে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে জমিয়ে সংসার করুন। আপনার মতো সজ্জনের সঙ্গে বিয়ে হলে ইতু সুখী হবে।

তাতে কি আপনি খুশি হবেন?

ভীষণ। ওরকম ভালো একটা মেয়ে কোনো গোলমেলে লোকের পাল্লায় পড়লে খুব কষ্ট পাব। আমি সত্যিই খুশি হব আপনি বিয়ে করলে।

কিন্তু ইতু খুশি হবে না।

কী করে জানলেন?

অভিজ্ঞতা থেকে।

কথাটার মানে বুঝলাম না।

বলছি। ইতুর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল। মোটামুটি কথা একরকম পাকাও হয়ে গিয়েছিল। গত জুলাই মাসে আমি কয়েকদিনের জন্য দেশে যাই মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করার জন্য। পরস্পরকে গ্রহণযোগ্য মনে হলে সামনের ডিসেম্বরে বিয়ে হওয়ার কথা।

কার কাকে পছন্দ হল না বলুন তো!

বলছি। ইতুর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ামাত্রই আমার ওকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল।

হওয়ারই কথা।

তারপর আমরা কলকাতাতেই একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করে নিজেদের সব সুবিধে আর অসুবিধের কথা পরস্পরকে জানাব বলে ঠিক হল। ফ্রি অ্যাণ্ড ফ্র্যাঙ্ক কথাবার্তা। গন্ডগোলটা ঘটল সেখানেই।

কী গন্ডগোল?

গন্ডগোলটার নাম অনিরুদ্ধ মিত্র। নামটা কি চেনা-চেনা লাগছে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নাকি? না না, অনিরুদ্ধ মিত্রকে আমি চিনি না। আপনার কি ধারণা আমি আপনার নাম পুলিশকে জানিয়ে দেব?

এটা আমার নাম তা আপনাকে কে বলল?

কেউ বলেনি, আমার অনুমান। ইতু আমার কাছে খুব করুণভাবে কনফেস করেছে যে, সে একজনকে ভালোবাসে, সে নাকি অভিমানবশে সম্পর্ক রাখছে না। হতেই পারে মশাই, হতেই পারে। ইতুর পাণিপ্রার্থী ও প্রেমিক তো আরও ছিল। অনিরুদ্ধ মিত্র তাদেরই কেউ হবে।

ইতুর বর্ণনা অনুযায়ী বেশ লম্বা, টাফ লুকিং এবং দুঃসাহসী মানুষ। পাহাড়ে চড়ে এবং পরোপকার করে বেড়ায়। বোধহয় খুব একটা বলিয়ে-কইয়ে ছেলে নয়। ইতু তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বটে, কিন্তু সেটা একটা মেয়েলি অহংকার থেকে। সে প্রত্যাশা করেছিল, নিরস্ত না হয়ে অনিরুদ্ধ ফিরে আসবে। কিন্তু অনিরুদ্ধ যে অন্য ধাতুর মানুষ, সে তা বুঝতে পারেনি। ইতু কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছে না।

কে একজন অজ্ঞাতকুলশীল অনিরুদ্ধ মিত্রকে নিয়ে কি আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার আছে মশাই?

ও হ্যাঁ, ভালো কথা। এই অনিরুদ্ধ মিত্রের সঙ্গেও ইতুর আলাপ হয়েছিল দিল্লি থেকে ফেরার পথে, পূর্বা এক্সপ্রেসে। এবং কী আশ্চর্য মিল যে, এই অনিরুদ্ধও ইতুর ফেলে-দেওয়া টিকিট কুড়িয়ে এনেছিল। চেনেন নাকি অনিরুদ্ধকে?

মেয়েটা একেবারে যাচ্ছেতাই রকমের আহাম্মক।

কার কথা বলছেন? ইতু?

আপনার মতো ছেলে, কোয়ালিফায়েড, আমেরিকায় সেটেলড, তাকে ছেড়ে কোন ঢ্যাঙা রংবাজের পেছনে ঘুরছে। ছিঃ ছিঃ! আপনি ওকে বোঝাতে পারলেন না? এক কাজ করুন, এসব মেয়েদের মনের জোর কম হয়, আপনি ওকে জোর করে বিয়ে করে আমেরিকায় নিয়ে যান তো। ভালোবাসা পেয়ে গেলে অনিরুদ্ধর ঘা শুকোতে দেরি হবে না।

জোর তো করাই যেত। ওর বাড়ির লোকরাও চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু আমার বড়ো মায়া হল। চোখ দুটো টস টস করছিল জলে।

কেলো। চোখের জল দেখেই ভুলে গেলেন? আপনি না পুরুষমানুষ।

পুরুষমানুষ তো আপনিও। ওই একরত্তি মেয়ের সামান্য কড়কানিতে ভড়কে গিয়ে তফাত হননি আপনি? জোর তো আপনিও করতে পারতেন।

না পারতাম না। গায়ের জোর ছাড়াও পুরুষমানুষের আরও কিছু জোরের দরকার হয়। যেমন লেখাপড়ার জোর, কেরিয়ারের জোর, টাকার জোর, ব্যক্তিত্বের জোর। এসব না থাকলে কীসের জোর ফলাব বলুন তো? যাই হোক, ওসব নিয়ে আর ভাববেন না। ওই অনিরুদ্ধ রংবাজের হাত থেকে যদি, ইতুকে বাঁচাতে চান। তাহলে টক করে চলে আসুন। বেচারি নিশ্চয়ই এতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।

তাই কি? কালই তো ওর ই-মেল পেলাম।

তাতে অন্যান্য কথার পর লিখেছে, আই ডোন্ট নো হাউ লং আই হ্যাভ টু ওয়েট ফর হিম। বাট আই। অ্যাম লাভিং টু ওয়েট।

মশাই, আমি একজন চোর। কনফার্মড চোর।

আমাকে আর প্রেমের প্রলাপ শুনিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। ভোর হয়ে আসছে। এবার আমাকে সরে পড়তেই হবে। শুধু বলে যাচ্ছি, ইতুর এইসব ছেলেমানুষিকে একদম প্রশ্রয় দেবেন না। ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং। ত্যক্তোক্তিষ্ঠ পরন্তপঃ।

এর মানে কী?

মনের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে তেড়েফুঁড়ে উঠুন। মেয়েটাকে দয়া করে বাঁচান।

ওকে বাঁচানোর লোক আছে। আমার কী গরজ, বলুন?

দাঁড়ান, ওই অনিরুদ্ধ রংবাজকে একটু কড়কে দিতে হবে।

হ্যাঁ, এটা ভালো প্রস্তাব। খুব ভালো করে কড়কে দিন তো ছোঁকরাকে। তাকে বুঝিয়ে দিন যে, সে একটি মেয়ের প্রতি চূড়ান্ত অবিচার করছে।

গাড্ডায় ফেলে দিলেন মশাই।

কথা দিলেন তো।

কীসের কথা?

অনিরুদ্ধকে রাজি করাবেন।

আচ্ছা জ্বালা তো! একটা ঘড়ি চুরি করতে এসে যে বড় চক্করে পড়ে গেলাম।

কথা দিন মশাই, কথা দিন।

ঠিক আছে। ঘড়িটার কথা যেন মনে থাকে।

চার লাখ। ক্যাশ ডাউন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর শুনুন। বাবাকে আমি একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়ে এসেছি। সেটা বাবার কোনো কাজে লাগে। না, পড়ে আছে। ওটাও বাবা আপনাকে ঘড়ির সঙ্গে দিয়ে দেবেন।

ওটা আবার কেন?

আপনাদের বিয়ের যৌতুক। আগাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *