তিন নম্বর বেঞ্চ

তিন নম্বর বেঞ্চ

আচ্ছা, এটাই তো পূর্ব দিক থেকে তিন নম্বর বেঞ্চ? তাই-না?

হ্যাঁ। এটাই তিন নম্বর বেঞ্চ।

আর আপনিই কি মধু রায়?

হ্যাঁ।

তাহলে আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আমার নাম নব চৌধুরী।

আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। তবে আসাটা উচিত হয়নি।

কেন বলুন তো? আমি আজ সকালেই আপনার এস এম এস পেয়েছি। আপনি আমাকে এই জায়গায় দেখা করতে বলেছেন।

আপনি কি আমাকে চেনেন?

না।

তাহলে? কোন সাহসে একজন অচেনা লোকের এস এম এস পেয়ে আপনি বিনা দ্বিধায় তার কথামতো চলে এলেন?

বিনা দ্বিধায় এসেছি, এ-কথা বলা যায় না। এস এম এস-টা পেয়ে আমি অনেক দুশ্চিন্তা করেছি। অজানা নানারকম আশঙ্কাও হয়েছে। এবং তারপর বেশ ভয়ে ভয়েই এসেছি।

এ যুগে ভয় পাওয়াটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। যত ভয় পাবেন ততই সুরক্ষিত থাকবেন। আসল কথা হল, আপনি একজন অবিমৃশ্যকারী এবং হঠকারী মানুষ।

আপনি কি আমাকে বকাঝকা করছেন?

করাই তো উচিত। একজন অজ্ঞাতকুলশীলের রহস্যময় বার্তা পেয়ে লেকের ধারে এই শীতের রাতে সাড়ে ন-টায় দেখা করতে আসাটা কি অবিমৃশ্যকারিতা নয়? আমি একজন গুণ্ডা, অপহরণকারী, ব্ল্যাকমেলার বা খুনিও তো হতে পারি।

তা তো বটেই। তবে কিনা কৌতূহল বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। চেনা ছকের বাইরে এই যে একটা বেশ অ্যাডভেঞ্চার বা রহস্যময় অ্যাপয়েন্টমেন্টের থ্রিলটাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আপনি কি সত্যিই গুণ্ডা বা অপহরণকারী বা ব্ল্যাকমেলার বা খুনির কোনো একটা?

হলে কী করবেন? পালাবেন, না লড়বেন?

অবস্থা বুঝে ভাবতে হবে।

বসুন।

বসলাম। কিন্তু শুনেছি রাতের দিকে পুলিশ লেকে খোঁজ নেয়। আমাদের এত রাতে বসে থাকতে দেখলে ধরে নিয়ে যেতে পারে।

আপনার চেয়ে পুলিশকে আমি একটু বেশি চিনি। আমি অনেকদিন জেল খেটেছি।

ও বাবা। আপনার অপরাধটা কী?

সেটা বলতে গেলে মহাভারত। তবে ভয় নেই, পুলিশ আসবে না। আপনি কি পুলিশকে ভয় পান?

কে না পায়?

আপনার ভয়ডর কিছু কম বলেই আমার ধারণা।

না, না, কী যে, বলেন। আমি তো ভীতুই।

কথাটা প্রশংসাসূচকভাবে বলিনি। আমি মিন করেছি, আপনি একজন আহাম্মক। আহাম্মকদের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা থাকে না। সময়মতো, পরিস্থিতি বুঝে ভয় পাওয়াটাও বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণের লক্ষণ। শুধু বুক ফুলিয়ে যেখানে-সেখানে হাজির হয়ে যাওয়া কাজের কথা নয়।

কী মুশকিল! আপনিই তো আসতে বলেছেন, এলাম বলে উলটে রাগারাগিও করছেন। তাহলে কি আমি চলে যাব?

না। এসে যখন পড়েছেন তখন বসুন। তবে সাবধান করে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে কখনো কোনো অচেনা লোকের এস এম এস পেয়ে বোকার মতো কোনো অজানা ফাঁদে পা দেবেন না! বুঝেছেন? আমি উগ্রবাদী ভাড়াটে খুনি হলে কী করতেন শুনি?

ভেবে দেখিনি।

তার মানে এই নয় যে, আমি ভালো লোক বা আমার উদ্দেশ্য মহৎ।

বুঝলাম। কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী?

উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্যটা যে ঠিক কী তা আমিও গুছিয়ে ভেবে আসিনি। বোধহয় আপনাকে একটু মেপে নেওয়াই আমার উদ্দেশ্য ছিল।

আমাকে মেপে নেবেন? কিন্তু কেন? মেপে নেওয়া তো মস্তানদের ধর্ম।

তা তো বটেই। আমি তো বলিনি যে, আমি মস্তান নই।

তা বলেননি। কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, প্রত্যেকটি মানুষেরই অস্তিত্বের একটা তরঙ্গ আছে?

আছে নাকি?

অবশ্যই আছে। লোকটা বদরাগি, মারমুখো, খ্যাপাটে, কিংবা খুব নরম-সরম, ভীতু, ম্যাদাটেমারা কি না তা কাছাকাছি এলে একটু-আধটু টের পাওয়া যায়। মস্তানদের একটা ওইরকম কিছু আছে, কাছাকাছি হলে টের পাওয়ার কথা। কিন্তু আপনার পাশে বসে সেরকম কিছু পাচ্ছি না।

নিজের বোধ-বিবেচনা আর অনুভূতির ওপর আপনি বেশ আস্থাশীল। কিন্তু আমি কোমর থেকে এখন একটা ভোজালি বা পিস্তল বের করলেই আপনার আস্থা ভেঙে যাবে।

তা হয়তো যাবে। কিন্তু আমার অনুমান, আপনার কাছে ওসব নেই।

না থাকলেই বা কী? নিজের স্ত্রীকে খুন করার দায়ে আমি যে, এক বছর জেল খেটেছি সেটা ভুলে যাবেন।

ভোলার কথা উঠছে কেন? আপনি যে স্ত্রীকে খুন করেছেন তা তো আমি জানিই না। তা ছাড়া আপনার সঙ্গে এই তো আমার প্রথম দেখা হল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাও তো বটে। আসলে আমার সব সময়ে মনে হয় আমি যে একজন খুনি এবং নিজের বউকে মেরেছি এটা বোধহয় বিশ্বসংসারের কারো অবিদিত নেই।

নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন নাকি?

লোকে তো তাই বলে। আদালতের রায়েও তাই বলা হয়েছিল।

সেক্ষেত্রে যতদূর জানি, আপনার যাবজ্জীবন বা ফাঁসিটাসি হওয়ার কথা। মাত্র এক বছরের জেল হওয়ার তো কথা নয়।

যাবজ্জীবনই হয়েছিল।

তাহলে কি আপনি জেল থেকে পালিয়ে এসেছেন?

না। তবে চেষ্টা করেছিলাম। খুব চেষ্টা করেছিলাম জেল ভেঙে পালানোর। দু-বারই ধরা পড়ে যাই। আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে। বন্ধ জায়গায় থাকতে পারি না। দমবন্ধ হয়ে আসে, মাথা পাগল-পাগল লাগে। দ্বিতীয় কথা, আমার মেয়েটা আন-অ্যাটেণ্ডেড ছিল, তার জন্যও জেল থেকে পালিয়ে আসা খুব জরুরি ছিল আমার।

আপনাকে কি সরকার-বাহাদুর দয়া করে ছেড়ে দিয়েছে?

হাসালেন মশাই। দুনিয়ার কোনো দেশে কি দয়ালু সরকার বলে কিছু আছে? সব দেশেরই সরকার হল অন্ধ, কালা, বোবা এবং হৃদয়হীন। মানুষের জন্য তারা আজ অবধি কিছুই করেনি। সরকার মানেই হচ্ছে একটা সিস্টেম। আর সেই সিস্টেমটা যারা চালায় তাদের অধিকাংশ হল, এই সিস্টেমের যন্ত্রাংশের মতো। সিস্টেমটা যা। বলায় এবং করায়, তারাও তাই বলে এবং করে। কিন্তু এসব কথা একটু কচকচির মতো হয়ে যাচ্ছে।

বুঝেছি। আপনি বরং জেল থেকে কী করে মাত্র এক বছর পর ছাড়া পেলেন সেইটে বলুন।

আমি জেলে যাওয়ার ছয়মাস বাদে আমার মেয়েটা কথা কয়ে উঠল যে!

সে কী? আপনার মেয়ে কি তার আগে বোবা ছিল?

না। কিন্তু নিজের চোখের সামনে মাকে খুন হতে দেখেই সম্ভবত মানসিক ধাক্কায় তার সাময়িক বিকার ঘটে। ফলে সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সাড়াশব্দহীন, বিভ্রান্ত এবং বোবা। চোখের চাউনিও ভ্যাকান্ট। ছয়মাস সে চুপ করে বসে থাকত। চলাফেরা ছিল অসংলগ্ন, আচরণ ছন্নছাড়া, আলো দেখলে ভয় পেত, জোরালো শব্দ শুনলে চমকে উঠত।

কে তাকে দেখে রাখত?

আমি একটু একা মানুষ। মা-বাপের একমাত্র সন্তান। মা-বাবা দুজনেই একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। মা বুকে আগলে রেখেছিলেন বলেই শিশু আমি বেঁচে যাই। তারপর বিপত্নীক দাদু পেলেপুষে খানিক বড়ো করে দিয়ে গত হলেন। এক জ্যাঠা ছিলেন। তিনি পাঁড়মাতাল, জেঠিমা চিররুগণা। তাঁদের ঘাড়ে ভর করে কিছুদিন কাটে। কিন্তু জ্যাঠতুতো তিন দাদাই ছিল যন্ডা-গুণ্ডা এবং বখা ছেলে। সেখানে টিকতে পারিনি বেশিদিন। মাত্র ষোলো বছর বয়স থেকেই আমি টিউশনি করে পেট চালাতে থাকি। বাবার চাকরির সুবাদে কিছু টাকা পাওয়া গিয়েছিল। কষ্টেসৃষ্টে সিএ পাশ করে যাই।

সি এ? ওরে বাবা! আপনি তো রীতিমতো—

দুনিয়ায় কয়েক লক্ষ সি এ আছে। উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। এটা দারিদ্র বা দারিদ্রমোচনের গল্প নয়।

তাহলে বললেন যে!

আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার জেল খাটার সময় আমার মেয়েকে কে দেখে রাখত! সেটা বলার জন্য এই পটভূমি দরকার ছিল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যাকগ্রাউণ্ড বলেও একটা ব্যাপার আছে।

আমি জানতে চাই, আমি কি আমার অটোবায়োগ্রাফিটা যথেষ্ট সংক্ষেপে বলতে পেরেছি?

হ্যাঁ। মাত্র তিন মিনিট বত্রিশ সেকেণ্ড লেগেছে।

আপনি বেশ ফাজিল এবং তরলমতি।

আসলে কী জানেন? আমি দুঃখের কথা বেশিক্ষণ শুনতে পারি না। একটু হাঁফ ধরে যায়।

অল্প বয়সের ধর্মই তাই। তবে দুনিয়ায় দুঃখের গল্প, সংখ্যায় সুখের গল্পের চেয়ে অনেক বেশি।

তা বটে। কিন্তু সি এ পাশ করার পর আর তো দুঃখ থাকার কথা নয়। কারণ, আমাদের বেশির ভাগ দুঃখের গল্পই তো অর্থনীতি রিলেটেড। তাই-না?

হ্যাঁ, কিছু কিছু প্রচলিত মতবাদ সে কথাই বলে। এটা ঠিকই যে, আর্থিক অভাব ঘুচলে পৃথিবীর অধিকাংশ দুঃখই অন্তর্হিত হয়। তারপর যেগুলো থাকে সেগুলোকে টাকাপয়সার প্রাচুর্য দিয়ে তাড়ানো যায় না। আর সেই কারণেই সেগুলো ভয়ংকর।

তার মানে কি, এরপর আরও কোনো ভয়ংকর দুঃখের গল্প আসছে?

না, ভয় পাবেন না। আমি শুধু বলতে চাইছি, টাকাপয়সা ছাড়াও আর একটা ব্যাপার থেকে দুঃখ বা প্রবলেম উপজাত হয়, সেটা হল রিলেশন।

রাইট। রিলেশনের কথাটা আমি ঠিক ভেবে দেখিনি।

রিলেশনগুলোর মধ্যে আবার সবচেয়ে সেনসিটিভ হল স্বামী-স্ত্রী রিলেশন।

আমি এটাই এক্সপেক্ট করছিলাম। আফটার অল এটা তো বধূহত্যারই গল্প।

হ্যাঁ, এটা বধূহত্যারই গল্প। খুনের উপকরণ বা হাতিয়ার হিসেবে ফ্লিভার জিনিসটাকে আপনার কেমন মনে হয়?

ফ্লিভারটা কী জিনিস বলুন তো?

কসাইখানায় দেখেননি, হাতল লাগানো চৌকোমতো একটা ইস্পাতের ভারী চপার গোছের, যা দিয়ে হাড়টাড় কাটে।

প্লিজ, আপনি আর ডিটেলসে যাবেন না, ওসব রক্তমাংস আমার একদম সহ্য হয় না।

তাহলেই বুঝে দেখুন, শুনেই আপনার যদি রি-অ্যাকশন হয় তাহলে চোখে দেখে আমার চোদ্দো বছরের মেয়েটার কী অবস্থা হয়েছিল। তার ওপর নিজের মা।

বোঝা একটুও শক্ত নয়, খুব বুঝতে পারছি। তবে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমি শুনতে চাই না।

চিন্তিত হবেন না, সে-ঘটনা বলার জন্য আপনাকে ডাকিনি। আসলে বলতে চাইছি, আমি একজন জেল-খাটা লোক।

ছয়মাস বোবা থাকার পর আপনার মেয়ে হঠাৎ কি একদিন কথা বলে উঠল?

হ্যাঁ।

এখানে আমার একটা প্রশ্ন।

করুন।

আপনি কি আমাকে চেনেন?

না।

তাহলে এ-কথাগুলো আমাকেই কেন বলা দরকার?

আপনি শুনতে না চাইলে না-ও শুনতে পারেন। শুভরাত্রি।

আরে না, না। রাগ করলেন নাকি? একটু কৌতূহল হচ্ছে। আর কিছু নয়। গল্পটা ইন্টারেস্টিং, বলুন।

কোথা থেকে বলব?

মনে হচ্ছে সবটাই শোনা ভালো। তবে বীভৎস রস যতটা সম্ভব বর্জন করে।

আপনি কোমলহৃদয় মানুষ।

তা বলতে পারেন।

আমার অফিসটা আমার বাড়ির কাছেই। আমি রোজ লাঞ্চ করতে বাড়ি আসতাম। কিন্তু যেদিন দুপুরে আমার স্ত্রী খুন হন, সেদিন আমি বাড়ি আসিনি। কারণ তার আগের দিন মুম্বাই থেকে একটা বড়ো কোম্পানির এক বড়োকর্তা আমাকে ফোনে একটা খুব বড়ো অফার দেন। এবং পরদিন আমাকে পার্কস্ট্রিটের একটা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চে নেমন্তন্ন করেন। সেখানেই কথাবার্তা পাকা হওয়ার কথা। আমি স্ত্রীকে সেটা জানিয়ে রেখেছিলাম। লাঞ্চে আমি ট্যাক্সি নিয়ে পার্কস্ট্রিটে যাই। কিন্তু সেই রেস্টুরেন্টে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে ছিল না নির্দিষ্ট টেবিলে। আমি একটু বোকা বনে ফিরে আসি।

সেই সময়েই খুনটা হয়ে গিয়েছিল তো!

হ্যাঁ। আই ওয়াজ ফ্রেমড, ভেরি টাইটলি ফ্রেমড। প্রথম কথা আমার কোনো অ্যালিবাই ছিল না। দ্বিতীয় কথা, আমি ছাড়া অন্য খুনি হলে একমাত্র সাক্ষী হিসেবে আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখত না। তাকেও মারত, আর সেটাই স্বাভাবিক। তৃতীয় কথা, খুনের একমাত্র সাক্ষী আমার মেয়ে আমার সপক্ষে কোনো কথা বলতে পারেনি। যদিও মোটিভের অভাব, আমার অতীতের জীবনযাপনের রেকর্ড ইত্যাদি মোটামুটি ফেভারে ছিল। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এটিকে বধূনির্যাতন, অনাদায়ী পণ এবং অন্যান্য নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আর তাতে তারা সফলও হয়। আমার উকিল বাঁচানোর চেষ্টা করেও হেরে যায়।

খুনটা তাহলে কে করেছিল?

সেটা এ-গল্পে অপ্রাসঙ্গিক। এটা ক্রাইম অ্যান্ড ডিটেকশনের কাহিনি নয়। মোটকথা, আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, আজও অনেকে করে না।

আপনার সম্পর্কে আপনার শ্বশুরবাড়ির ধারণা এখন কীরকম?

জানি না। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক চুকে গেছে।

তাহলে আপনার মেয়ে? আপনি জেলে যাওয়ার পর তার কী হয়েছিল?

আমি আদালতে আর্জি জানিয়েছিলাম, আমার মেয়েকেও আমার সঙ্গে জেলে রাখা হোক। আদালত তা নাকচ করে ওর দাদু-দিদিমাকেই কাস্টডিয়ান করে দিয়েছিল।

বুঝলাম, আপনার বেশ খারাপ সময় গেছে।

খুব খারাপ। তবে একটা ভালো ব্যাপারও হয়েছিল, বলা যায় মন্দের ভালো। আমার মেয়ে যখন তার মামাবাড়িতে আশ্রয় পেল, তখন সেখানে দিনরাত আমার নিন্দেমন্দ হত। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল খুনটা আমারই হাতের কাজ। আমার মেয়ে সেগুলো শুনতে পেত। তারা মাথা তখন বিভ্রান্ত, তবু সেই কথাগুলো তার মাথায় কোনো-না-কোনোভাবে ধাক্কা দিতে থাকে। খুব আবছাভাবে সে বুঝেছিল, তার বাবা বিপন্ন। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। ছয়মাস বাদে, একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পায় এবং চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার করে সে শুধু একনাগাড়ে একটা কথাই বলে যাচ্ছিল, আমার বাবা খুন করেনি। আমার বাবা খুন করেনি…

ভেরি ইন্টারেস্টিং!

হ্যাঁ। তাতে অবশ্য আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিব্রত হয়ে পড়ে এবং তার মুখ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টাও হয়। শুনেছি তার মেজোমামা তাকে মারধরও করেছিল। কিন্তু আমার মেয়েটা খুব স্টাববার্ন। সে ওই কথা থেকে নড়েনি। আর তার চেঁচামেচিতেই পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয় এবং একটা জনমতও তৈরি হতে থাকে। শেষ অবধি জনমতের চাপইে কেস রি-ওপেন হয়। নতুন করে সাক্ষী নেওয়া হয়, আমার মেয়ে পুলিশের কাছে। এবং আদালতে খুনটার নিখুঁত বিবরণ দিয়েছিল।

আর তার সাক্ষ্যতেই আপনি ছাড়া পেলেন তো?

হ্যাঁ। বেকসুর খালাস।

কিন্তু খুনটা! সেটা কী করে হয়েছিল?

আমি আপনাকে আমার স্ত্রীর হত্যাকান্ড বা তজ্জনিত কল-আউট শোনাব বলে ডাকিনি। কিন্তু কথাটা কেন যে সেদিকেই গড়িয়ে গেল কে জানে! আপনি কি এতে কোনো ইন্টারেস্ট পাচ্ছেন? চারদিকে নানাভাবে মানুষ খুন হচ্ছে, কোনো-না-কোনো কারণে। ব্যাপারটা বড্ড জলভাত হয়ে গেছে, তাই-না?

কোনো কোনো ঘটনা আছে যা ম্যাগনেটের মতো কথাকে টেনে নেয়। আপনি অন্য প্রসঙ্গে গেলেও, কথার গতি খুব অদ্ভুতভাবে সেইদিকেই মুখ ফেরায়।

তার মানে কি ব্যাপারটা খানিকটা ভৌতিক?

আমি ভূতে বিশ্বাসী নই।

আমিও নই। তবে কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন। কথার একটা নিজস্ব ইনার্সিয়া আছে। হ্যাঁ, আপনাকে যেন। কী বলছিলাম?

আপনার স্ত্রীর খুনের ঘটনাটা। আমরা এক জায়গায় থেমে আছি। আপনি একটা চৌকাঠে ঠেকে গেছেন। আর এগোতে চাইছেন না। অবশ্য গোপন করার মতো কিছু থাকলে আমিও আর জানতে চাইব না।

যে-ঘটনা সবাই জানে, যা নিয়ে খবরের কাগজ এবং টিভিতে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা হয়েছে তার আবার। গোপনীয়তা কীসের? এখন অবশ্য সবাই ভুলেও গেছে। ঘটনাটা পাঁচ বছর আগেকার। মাস মেমরি পুরোনো কথা মনে রাখতে পারে না।

তা তো ঠিকই। গোপন করার মতো কিছু না থাকলে আমি এর শেষটা জানতে চাই।

খুনি কে, তা তো?

হ্যাঁ।

আমার মেয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে যা বলেছিল তা হল এই যে, সেদিন সে স্কুলে যায়নি। প্রাক্তন হেডমিস্ট্রেস মারা যাওয়ায় স্কুল বন্ধ ছিল। দুপুর একটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে সে গিয়ে দরজা। খোলে। যে-লোকটা ঘরে ঢোকে সে বেশ লম্বা-চওড়া, সবুজ শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা, চাপ-দাড়ি আছে, ডান হাতে বালা। লোকটা তার এবং আমাদেরও চেনা। নাম সংগ্রাম সিংহ। মাঝে মাঝে লোকটা তাদের বাড়িতে আসত। তার বাড়ি কোথায় তা সে জানে না। তবে সে তাকে কাকু বলে ডাকত। মায়ের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব ছিল বেশি। সেদিন বাড়িতে এসে সংগ্রাম সিংহ নাকি তার মাকে সিনেমায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। মা যেতে চায়নি। এ-নিয়ে দুজনের মধ্যে একটু মান-অভিমান-মতো হয়। অবশ্য তখন সে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল। দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিল, সংগ্রামের সঙ্গে তার মায়ের কথাবার্তা ক্রমে ঝগড়ার পর্যায়ে যাচ্ছে। আর তারপরেই তার মায়ের আর্তনাদ। সে ছুটে এসে দেখে সংগ্রাম সিংহ সদর দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে, আর তার মা পড়ে আছে মেঝের ওপর।

এই সংগ্রাম সিংহ লোকটা কে?

আমি জানি না।

তাহলে আপনার চেনা লোক হল কী করে?

আমি আমার মেয়ের জবানিটা বলছি, কথাগুলো আমার নয়, আমার মেয়ের।

বুঝতে পারলাম না। সংগ্রাম সিংহ কি তাহলে–?

আমার স্ত্রীর গোপন প্রেমিক কি না? বোধহয় না। আমার স্ত্রীর কোনো প্রেমিক ছিল বলে আমার জানা নেই।

সংগ্রাম সিংহকে জেরা করে কিছু জানা যায়নি?

পুলিশ তাকে খুঁজে পায়নি।

অ্যাবসকণ্ডি?

হবে হয়তো, আমি জানি না।

কী করত লোকটা?

আমার মেয়ের ভার্সন অনুযায়ী সংগ্রাম সিংহ একজন ব্যবসায়ী। বড়োবাজারের দিকে কোথাও তার বাবার আড়ত আছে।

তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না কেন?

কয়েকজনকে সন্দেহবশত ধরা হয়েছিল। তবে আমার মেয়ে তাদের আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। ডাক্তার বলেছিল, ওর মেমরি এখনও অর্ডারে নেই।

আপনাকেও নিশ্চয়ই সংগ্রাম সিংহ সম্পর্কে জেরা করা হয়?

হ্যাঁ। আমি আমার মেয়ের কথারই পুনরাবৃত্তি করে যাই। একথাও বলি যে, আমি তাকে আমার স্ত্রীর বন্ধু। হিসেবেই একটু-আধটু চিনতাম। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা নেই।

ফোন নম্বর-টম্বর?

হ্যাঁ। আমার স্ত্রীর ফোনবুকে সংগ্রাম সিংহের মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। কিন্তু সেই নম্বরের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

ধরা গেল না তাহলে?

পুলিশ ধরতে না পারলেও আমি ধরেছি।

আপনি! কীরকম?

ছাড়া পাওয়ার পর আমি একদিন আমার মেয়ে স্কুলে যাওয়ার পর তার ঘরে একটা বই খুঁজে পাই। ইংরিজি গোয়েন্দা গল্প। বইটায় একটা বিশেষ পেজমার্ক দেখে সন্দেহ হয়েছিল। সেই জায়গাটা খুলে দেখি, সেখানেও একটি চোদ্দো বছরের মেয়েকে তার মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে জেরা করা হচ্ছে আর মেয়েটা একটা কাল্পনিক আততায়ীর বিবরণ দিয়ে যাচ্ছে। এবং সেখানেও সে তার বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।

তার মানে সংগ্রাম একটা ফিকটিশাস ব্যাপার?

হতে পারে।

তাহলে খুনটা কে করল?

আবার বলছি, আমার স্ত্রীর মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাই, আমার মেয়ের কথা। আমার মেয়ে অত্যন্ত ইনোভেটিভ, স্টাবোর্ন এবং যাকে ভালোবাসে তাকে রক্ষা করার জন্য সব কিছু করতে পারে। তার বয়স এখন উনিশ, সে বুদ্ধিমতী, সুলক্ষণা।

তার নাম পূর্ণা। পূর্ণা রায়।

মাই গড। আপনি পূর্ণার বাবা?

হ্যাঁ, পূর্ণা আমাকে বলেছিল, আমি ওকে আমার কথা কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু আমি চাই তুমি ওকে বলো। আমি আপনাকে বললাম।

বুঝতে পারছি। পূর্ণা দুষ্ট আছে।

ধন্যবাদ। আপনি অনুমতি দিলে আমি এবার উঠব।

শুনুন, দয়া করে আপনি-আজ্ঞে করবেন না। সেটা ভালো শোনাবে না।

তথাস্তু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *