সম্পূর্ণতা
ঠিক পুরুষের মতো গলায় একজন বয়স্কা নার্স চেঁচিয়ে ডাকছিল।
–অমিতাভ গাঙ্গুলি কে? অমিতাভ গাঙ্গুলি? বাবার মুখ নোয়ানো। হাতের ওপর থুতনি রেখে বোধহয় চোখ বুজে আছে। ডান গালে স্টিকিং প্লাস্টারে সাঁটা তুলোর ঢিবি। ডাক শুনে মুখ তুলে শমীকের দিকে তাকাল। শমীক উঠে দু-পা এগিয়ে থতমত গলায় বলে–এই যে এখানে।
নার্স হাতের কাগজটার দিকে চোখ রেখেই বলে–ক্যানসার। থার্ড স্টেজ। কিছু করার নেই।
–তাহলে? শমীক প্রশ্ন করে।
উত্তর অবশ্য পায় না। নার্স পরের নাম ধরে ডাকছে–নওলকিশোর ওঝা—
বাবা ওঠে।
–কী বলল ?
শমীক যথার্থ বুদ্ধিমানের মতো বলে–কত ভুলভাল বলে ওরা! এর রোগ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।
–থার্ড স্টেজ না কী যেন বলছিল! বাবা ধীরে-ধীরে বলে।
–রোগটা প্রাইমারি স্টেজে আছে আর কি। ওষুধ পড়লেই সারবে।
হাসপাতালের বাইরে এসে শমীক বলে ট্যাক্সি নেব বাবা?
–ট্যাক্সি কেন আবার? তিন নম্বরে উঠে শেয়ালদা চলে যাব।
শেয়ালদার হোটেলে ফিরে বাবা তার প্যান্ট ক্রিজ ঠিক করে রেখে যত্নে ভাঁজ করল। হ্যাঙারে টাঙাল জামা। লুঙ্গি পরতে-পরতে বলল –থার্ড স্টেজ মানে কি প্রাইমারি স্টেজ?
–হ্যাঁ।
–তবে যে বলছিলি, ওরা ভুলভাল বলছিল।
শমীক অত বুদ্ধি রাখে না। তা ছাড়া, তার নিজেরও বুকের ভিতরে একটা কী যেন উথলে পড়ছে। তিনটে বোন বিয়ের বাকি। দুই ভাই ইস্কুলে পড়ে। তার নিজের বি . এ . পাশ করতে এখনও এক বছর। যদি আদৌ পাশ করে। এবং এই অবস্থায় বাবাজি বোধহয় চললেন।
দুই গাল রবারের মতো টেনে হাসল শমীক। বলল –না না। থার্ড স্টেজই বলেছে। তার মানে—
বাবা বিশ্বাস করেছে। কোঁচকানো কপাল হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল। বিছানায় পা তুলে। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে বলল –যদি প্রাইমারি স্টেজই হয় তবে হোটেলের টাকা গুনে এখানে থাকি কেন? আমাদের চা বাগানে ফিরে যাই চল। দরকার মতো জলপাইগুলি কি কুচবিহারে গিয়ে চিকিৎসা করালেই হবে।
–ডাক্তারকে বলে নিই।
–কালই বলো। আমি বরং শিয়ালদায় আজই খোঁজ নিই যদি পরশুর রিজার্ভেশন পাওয়া যায়।
–তাড়াহুড়োর কী আছে! এসেছি যখন ট্রিটমেন্টটা করিয়েই যাব। কলকাতার মতো ব্যবস্থা কি মফসসলে হবে?
বাবা ডান গালের তুলোটা একটু চেপে ধরল। শমীক জানে, তুলোয় ঢাকা আছে একটি ঘা। ঘায়ের ভিতর দিয়ে পচন। ক্রমশ গালের মাংস খসে খসে পড়বে। প্রথম ব্যাপারটা সন্দেহ। করেছিল একজন ডেন্টিস্ট। বাবার কষের অকেজো দাঁতটা উপড়ে ফেলে শমীককে আড়ালে ডেকে বলল –দাঁতটা তুলে বোধহয় ভালো করলাম না। দেয়ার ইজ সাম পিকিউলিয়ার সোর। একবার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাবেন।
শমীক জিগ্যেস করল–কেন?
সন্দেহ হচ্ছে ক্যানসার।
–জলপাইগুড়ির বড় ডাক্তারও সেই একই কথা বলে–কলকাতায় নিয়ে যান। না হলে সিওর হওয়া যাবে না।
গাঙ্গুটিয়া চা–বাগান থেকে শমীক তার বাবাকে নিয়ে কলকাতায় এসেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
আজ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। থার্ড স্টেজ মানে প্রাইমারি স্টেজ নয়। শমীক জানে। বাবা জানে না।
পরদিন বাবাকে হোটেলে রেখে একা হাসপাতালে গেল শমীক। বহু কষ্টে দেখা করল ডাক্তারের সঙ্গে। ডাক্তার সব শুনে হাসলেন।
–হাসপাতালে রেখে লাভ কী? সারাবার হলে নিশ্চয়ই রাখবার চেষ্টা করতাম। যে কয়দিন বাঁচেন আপনার বাবাকে আপনাদের কাছেই রাখুন। যা খেতে চান দিন, যা যা করতে চান সব করতে বলুন। মেক হিম হ্যাপি। হাসপাতালের লোনলিনেস আর ড্রাজারিতে শেষ কটা দিন কেন কষ্টের মধ্যে ফেলে রাখবেন? আমাদের কিছু করার নেই।
–আপনি সিওর যে এটা ক্যানসার?
ডাক্তার হাসলেন–ইচ্ছে করলে আপনি আর কাউকে কনসাল্ট করতে পারেন। ডক্টর মিত্রকে দেখান, আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। অবশ্য দেখানোটা সান্ত্বনামাত্র।
রাতে খাওয়ার সময় বাবা অনুযোগ করতে থাকে–এরা একেই বিচ্ছিরি খাবার দিচ্ছে, তাও তুই মাছটা ফেলে রাখছিস। ভাত তো কিছুই খেলি না। এখানে এসে সাতদিনে কত রোগা হয়ে গেছিস। ভালো করে খা।
–বাবা, কাল একজন স্পেশিয়ালিস্টের কাছে যাব।
–কেন?
–ডক্টর মিত্রের খুব নাম। দেখি কী হয়।
–প্রাইমারি স্টেজ যখন, অত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে?
–দেখানো ভালো।
–অসুখটা ওরা কী বলছে? নালি ঘা তো?
–তাই।
–ঘাবড়াচ্ছিস কেন?
বাবা তার গলা ভাত আর ঝোল দিয়ে চটকানো কাথের বাটিতে চুমুক দিয়ে বলে–কী খারাপ রান্না এদের। কিচ্ছু গেলা যায় না। তোর মা যে সেদ্ধ ঝোল রাঁধে তারও কেমন ভালো স্বাদ।
বাবা শমীকের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর আস্তে-আস্তে করে বলে–কাল তোকে রামদুলাল স্ট্রিটের সেই দোকানটায় নিয়ে যাব। কখনও তো খাসনি, দেখিস কেমন ভালো সন্দেশ করে ওরা! আমরা ছাত্রজীবনে দল বেঁধে গিয়ে খেয়ে আসতাম।
গতকাল নার্সটা চেঁচিয়ে বলেছিল ‘ক্যানসার’। বাবা কি সেটা শুনতে পায়নি? বায়োপসি কেন করানো হল, তাও কি বাবা জানে না? না কি সব জেনে বুঝে বাবাও অভিনয় করে যাচ্ছে।
পরদিন সন্ধেবেলা ডক্টর মিত্রর বিশাল বাইরের ঘরে বাপ-ব্যাটায় বসে আছে। ডাক্তার টেনিস খেলতে গেছেন। আসবেন। স্লিপে নাম লিখে বেয়ারার কাছে দিয়ে বসে অপেক্ষা করছে আরও দশ বারোজন লোক। বত্রিশ টাকা ফি দিতে পারে এমন কয়েকজন। শমীক বাইরে একবার সিগারেট খেতে বেরিয়েছিল। কী সুন্দর বাড়ি। সিনেমায় এ রকম দেখা যায়। সামনে লন, গাড়িবারান্দা, লবি। পেতলের ভাসে সব অদ্ভুত গাছ। লনের ঘাস এদেশের ঘাসই নয়। সিগারেট ধরিয়ে চারদিকটা দেখছিল। সফলতা একেই বলে। কত লোক কত বেশি সুখে আছে।
গায়ের ঘাম তখনও মরেনি, অল্পবয়সি সুন্দর চেহারার এবং হাস্যমুখ ডাক্তারটি চটপট পায়ে রুগির ঘরে ঢুকে ভিতর দিকে চেম্বারে চলে যেতে-যেতে একবার রুগিদের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে গেলেন। হাসিতে বরাভয় এবং আত্মবিশ্বাস। শমীকের বুকটা ভরে ওঠে। বাবাকে সে ঠিক জায়গাটিতে নিয়ে এসেছে। এ তো আর হাসপাতালের বাজারি ব্যাপার নয়। এখানে ঠিকমতো পরীক্ষা হবে, বিচক্ষণ ডাক্তার ঘা পরীক্ষা করেই হেসে উঠে বলবেন–আরে দূর! এ তো সেপটিক কেস।
ব্যাপারটা ঠিক সেরকম হল না! ডাক্তারের চিঠিটা পড়ে ডাক্তার মিত্র বাবাকে পরীক্ষা করলেন। বায়োপসির রিপোর্টটাও দেখলেন। মুখে হাসিটা ছিলই, আত্মবিশ্বাসও ছিল। বাবাকে বললেন–বয়স কত?
–পঞ্চান্ন।
–ছেলেমেয়ে?
–তিন ছেলে, তিন মেয়ে। মেয়েটি বড়।
ডাক্তার শমীকের দিকে তাকিয়ে হাসলেন কী করেন?
–পড়ি। বি . এ.।
–আর্টস! আমারও খুব ঝোঁক ছিল আর্টস পড়ার। আমার বাবা প্রায় জোর করে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন।
এই সব কথা বললেন ডাক্তার। একটা ছোট্ট চিঠি লিখে দিলেন হাসপাতালের ডাক্তারকে! বললেন–এটা ডক্টর সেনকে দেবেন। প্রেসক্রিপশন যা আছে তাই চলবে।
–কিছু করার নেই? খুব আস্তে, প্রায় ডাক্তারের কানে-কানে বলে শমীক।
ডাক্তার হাসলেন।
রাস্তায় একটা ল্যাম্পপোস্টের তলায় চিঠিটা খুলে দেখল শমীক। লেখা–ডিয়ার ডাঃ সেন, দি কেস ইজ হোপলেস। প্লিজ হেলপ দিস ম্যান। মিত্র।
বাবা শমীকের কাঁধের ওপর দিয়ে চিঠিটা দেখছিল কী লিখে দিল রে? হোপলেস! হোপলেস ব্যাপারটা কী?
চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে শমীক বলে–হোপলেস নয়। লিখেছে হেলপলেস। কলকাতায় আমরা তো কিছু জানি না, তাই লিখেছে। অসহায়।
–ও। বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বলে–বত্রিশ টাকা নিল, কোনও প্রেসক্রিপশন দিল না?
–ওই ওষুধই চলবে।
–আর বেশি ছোটাছুটি করিস না। হাসপাতাল, ডাক্তার, এত কিছু করছিস কেন?
–অসুখ–বিসুখে এ সব একটু করতেই হয়।
–আমার আর ভালো লাগছে না। যা হওয়ার হবে, চল বাগানে ফিরে যাই।
শমীক মাথা নেড়ে বলে–তাই হবে।
বাবা উজ্জ্বল মুখে বলে–ঠিক তো?
–কাল রিজার্ভেশনের চেষ্টা করব।
বাসরাস্তায় এসে বাবা বলে–এখন কোথায় যাবি?
–কোথায় আর যাব! হোটেলেই ফিরে যাই চল।
বাবা একটু হাসে। বলে–কাছেই গড়িয়াহাটা। চল একটু দোকানপসার ঘুরে যাই। সস্তায় গণ্ডায় যদি পাই তো সকলের জন্য একটু জামাকাপড় নিয়ে যাব। পুজোর তো দেরি নেই। কলকাতায় একটু সস্তা হয়।
–এখন থাক বাবা। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল!
–তোর জন্যই তো। খামোকা আজ বত্রিশটি টাকা দিলি।
–ভালো ডাক্তারকে দেখালে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
–চল, দোকানটোকান একটু দেখে যাই। গড়িয়াহাটের কাপড়ের দোকানের খুব নাম শুনি।
শমীক অগত্যা রাজি হয়। বাপ-ব্যাটায় হাঁটে গড়িয়াহাটার দিকে। বাবা গালের তুলোটা হাতের তেলোয় একটু চেপে ধরে রেখে বলে কলকাতায় এসে তো কেবল আমাকে নিয়েই হুড়যুদ্ধ করছিস। কাল বেরিয়ে একটু একা-একা ঘুরবি, সিনেমা থিয়েটার দেখবি। তোদের বয়সে কি কেবল রোগের চিন্তা ভালো লাগে! কাল বেরোস।
শমীক উত্তর দিল না।
পরদিন সকালে উঠে বাবা বলল –কলকাতায় যা শব্দ! রাতে ভালো ঘুম হয় না! বাগানে থাকতে থাকতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে নিশুতি নিঝুম না হলে চলে না। তার ওপর আবার ছারপোকা।
শমীক জামাকাপড় পরছিল। একবার রেলের বুকিং অফিসে যাবে।
বাবা শ্বাস ফেলে বলল –ঘায়ের ব্যথাটাও হচ্ছিল।
–বিশ্রাম নাও।
–একা ঘরে কি ভালো লাগবে?
–তবে কী করবে?
–একটু বেরোব ভাবছি। কলকাতা তো আর আমার অচেনা জায়গা নয়।
–শরীর খারাপ, একা বেরোনো কি ঠিক হবে? বাবা মাথা নেড়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে–শরীর কিছু খারাপ নয়। বেশ তো আছি। কাছেই যাব, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে। খগেন ওখানে থাকত।
–খগেনকাকা! তোমার বন্ধু তো!
ছেলের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাবা বলে–হ্যাঁ। এখনও আছে কি না কে জানে! বিশ বছর খবর জানি না। বেঁচেই নেই হয়তো। আমাদের তো এখন সব যাওয়ার বয়স। একে একে সব রওনা হয়ে পড়ব।
শমীক বলল –খগেনকাকার ওখানে যাবেই যদি তাহলে তৈরি হয়ে নাও। আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব।
বাবা একটু অবাক হয়ে বলে–তুই সঙ্গে যাবি?
–না হলে তুমি একা এই ভিড়ে যেতে পারবে নাকি?
বাবা একটু ইতস্তত করে বলে–চল।
মনে-মনে হাসে শমীক। খগেনকাকা বাবার কেমন বন্ধু তা সে জানে না। শুধু এইটুকু জানে, বাবা যৌবনবয়সে একটি মেয়েকে এস্রাজ শেখাত! সেই মেয়েটির প্রতি এক প্রগাঢ় দুর্বলতা জন্মেছিল। কিন্তু বাবা তাকে বিয়ে করতে পারেনি! বিয়ে করেছিল খগেনকাকা। সে ছিল বড়লোকের ছেলে। এ ঘটনা বাবা মাকে গল্প করেছিল। মায়ের কাছে তারা শুনেছে। খগেন নামটা শুনেই পূর্বাপর মনে পড়ে গেল।
সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে বাড়িটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। বিশাল বাড়ি! সিঁড়িতে এবং দেওয়ালের নীচের দিকে এখনও মার্বেল পাথর দেখা যায়। মস্ত দরজা হাঁ করে আছে। তবে বাড়ির শ্রী দেখলেই বোঝা যায় অবস্থা পড়তির দিকে। রং চটে গেছে, জানালা দরজার পাল্লা জীর্ণ, ভিতরের চিৎকার চেঁচামেচিতে বোঝা যায় যে দু-চারঘর ভাড়াটেও বসেছে।
একজন চাকর গোছের লোক তাদের ওপরে নিয়ে গেল। চিকফেলা বারান্দা, ডানদিকে ঘুরে দরদালান। দরদালানের প্রথম ঘরটায় তাদের বসিয়ে বলল বাবু এ সময়টায় থাকেন না। গিন্নিমাকে খবর দিচ্ছি।
বাবা একটু ইতস্তত করে বলে–খগেন বেরিয়ে গেছে?
–আজ্ঞে।
–তাহলে গিন্নিমাকেই বলো, অমিতাভ গাঙ্গুলি এসেছে। এক সময়ে তোমার গিন্নিমাকে আমি বাজনা শেখাতাম। বললে হয়তো চিনতে পারবে।
বলেই বাবা শমীকের দিকে চেয়ে হাসে। কুণ্ঠার সঙ্গে বলে–ছাত্রী ছিল।
শমীক সব জানে। তবু ভালোমানুষের মতো বলে–তাই নাকি।
বাবা শ্বাস ফেলে বলে–কতকালের কথা সব। খগেনটা সুদখোর ছিল। সুদেরই কারবার ওদের। কালোয়ারি ব্যাবসাও আছে বটে, তবে টাকা খাটানোটাই ছিল আসল।
এ ঘরটা বেশ বড়। পুরোনো আমলের বড় মেহগিনি টেবিল, আবলুশ কাঠের কালো চেস্ট অফ ড্রয়ার্স। সূক্ষ্ম সব ফুল লতাপাতা আর ময়ূরের কাজ করা বর্মা সেগুনের চেয়ার! চেস্ট অফ ডুয়ার্সের ওপরে একটা ঢাকনা দেওয়া বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় যে এটা এস্রাজ। পাশে একটা তবলা আর পেতলের ডুগি, গদি মোড়া হয়ে বিড়ের ওপর ঘুমোচ্ছে। বাবা এখনও গাঙ্গুটিয়ায় সন্ধের পর মাঝে-মাঝে এস্রাজ নিয়ে বসে। শমীক তবলা ঠোকে।
বাবা হঠাৎ আপন মনে মাথা নেড়ে বলল –চিনতে পারবে না বোধহয়!
–কে চিনতে পারবে না?
–কমলা। কতকালের কথা! বলে বাবা অপ্রতিভ মুখখানা ফিরিয়ে নেয়।
গালের তুলোটা হাতের তেলোয় চেপে ধরে। বলে–চেহারাও পালটে গেছে।
নীচের তলার ভাড়াটেদের গলার শব্দ হচ্ছে। কিন্তু ওপর তলাটা নিস্তব্ধ। সম্ভবত এ বাড়িতে লোকজন বেশি নেই। একটা ধূপধুনোর গন্ধ আসছিল। একবার একটু পুজোর ঘণ্টা নাড়ার শব্দ এল। বাপ-ব্যাটায় বসে থাকে মুখোমুখি। শমীক বাবার দিকে তাকায় তো বাবা চোখ সরিয়ে নিয়ে দেওয়ালের অস্পষ্ট পুরোনো অয়েলপেইন্টিং দেখতে থাকে। হঠাৎ আপনমনে বলে নেই—নেই করেও এখনও অনেক আছে। এ বাড়িটার ভ্যালুয়েশনই পাঁচ-সাত লাখ টাকা হবে। অথচ সুদের কারবারির নাকি ভালো হয় না। এরা তবে এত ভালো আছে কী করে?
শমীক একটু হতাশ হয়। পুরোনো প্রেমিকার বাড়িতে বসে আবার এ কীরকম বিষয়ী কথাবার্তা। একটু পরেই সে আসবে, কাঁপা বুক, স্মৃতি আর অধৈর্য নিয়ে বসে থাকার কথা এখন। তেষ্টা পাবে, কথা হারিয়ে যাবে, দৃষ্টি চঞ্চল হবে। এ সময়ে বাড়ির ভ্যালুয়েশনের কথা মনে আসবে কী করে?
বাবা শমীকের দিকে তাকিয়ে বলে–তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
হোক দেরি। শমীক দৃশ্যটা দেখতে চায়। বাবা যদি কণামাত্র খুশি হয়, যদি প্রেমিকাকে দেখে একটুমাত্র জীবনীশক্তি আহরণ করতে পারে, তবে শমীকের বুক ভরে যাবে। সে মুখে বলেনা। দেরি হচ্ছে না।
–রিজার্ভেশন যদি না পাস!
–পাব না ধরেই নিয়েছি। গাড়িতে যা ভিড়। না পেলে ব্ল্যাকে নেব।
–আবার গুচ্ছের টাকা নষ্ট। কাল কাপড়জামায় অনেক বেরিয়ে গেছে।
শমীক হাসল। আবার বিষয়ী কথা। মুখে বলে সে তো তোমার জন্যই। অত কিনতে কে বলেছিল?
বাবা অপ্রতিভ হাসে। শমীক দরজার দিকে পাশ ফিরে বসেছিল, বাবার দিকে চেয়ে। বাবার দরজার দিকে মুখ। হঠাৎ দেখল, বাবার মুখটা পালটে গেল। শরীরটায় একটু শিহরণ কি!
শমীক তাকিয়ে মহিলাকে দেখতে পায়। মাথায় অল্প ঘোমটা, ফরসা, সুগোল ভারী চেহারা, মুখখানা প্রতিমার মতো সুশ্রী। তার নিজের মায়ের মতোই বয়স হবে, তবে ইনি অনেক সুখী। মুখে একটু হাসি।
বাবা উঠে দাঁড়ায়। মহিলা এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন।
–চিনতে পেরেছ? বাবা জিগ্যেস করে।
–ওমা! চিনব না? এই ছেলে বুঝি।
–বড়জন!
–বসুন।
বাবা হাসে। মহিলাও বসেন একটু দূরে চেয়ারে। সাবধান গলায় বলেন–কবে আসা হল? গালে ওটা কী?
বাবা গালের তুলোয় হাত চেপে বলে-এর জন্যই আসা। একটা ঘায়ের মতো! ডাক্তার বলেছে, ভয়ের কিছু নয়।
–ঘা!
–দাঁত তুলে সেপটিক হয়ে গিয়েছিল।
–ও।
–তোমরা সব কেমন আছ? বহুকাল খবর বার্তা পাই না।
মহিলা হাসেন। বলেন–আপনি সেই চা বাগানে এখনও আছেন?
–হ্যাঁ। ওখানেই জীবন শেষ করে ফেললাম।
মহিলা একটা শ্বাস ফেললেন–জানি সবই।
বাবা একটা গলা খাঁকারি দেয়। বলে–খগেনের কেমন চলছে?
–ওই একরকম।
বাবা হেসে বলে–খুব বাবু মানুষ ছিল। সেই কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, আর বত্রিশজোড়া জুতো এখনও চালাচ্ছে? চুলে কলপ–টলপ দেয় না?
মহিলা মুখে আঁচল তুলে হাসি ঢাকেন। মৃদুস্বরে বলেন–কলপের দরকার হয় না। টাক পড়ে গেছে।
–পড়ারই কথা। বলে বাবা গম্ভীর হয়ে যায়। এস্রাজটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলে–এখনও বাজাও?
মহিলা মাথাটা নুইয়ে দেন। মাথা নাড়েন। না, বাজান না।
বাবা চুপ করে দেওয়ালের দিকে চেয়ে থাকে। হলঘর থেকে দেওয়াল ঘড়ির শব্দ আসে। চাকর মিষ্টির প্লেট রেখে যায়। গেলাসে জল। চা।
বাবা প্লেটের দিকে চেয়ে বলে–চিবোতে পারি না।
–কষ্ট হয়?
–হুঁ। আমার পথ্য লিকুইড।
–শরবত করে দিই?
–না।
মহিলা তবু উঠে যান। বোধহয় শরবতের ফরমাশ দিয়ে এসে আবার বসেন। ঘোমটা খসে গেছে। এখনও কী গহীন কালো চুলের রাশি!
–খগেনকে বোলো, আমি এসেছিলাম। কাল বা পরশু ফিরে যাব।
মহিলা চুপ করে থাকেন। শমীক একটা–দুটো মিষ্টি খায়। চা শেষ করে। তারপর উঠে বলে–বাবা, আমি আসি?
যাবে? বাবা তটস্থ হয়ে বলে–আমিই বা বসে থাকি কেন? খগেন যখন নেই!
মহিলা ঘোমটা আবার মাথায় তুলে শমীককে বলেন–তুমি এখন কোথায় যাবে বাবা?
–একটু কাজ ছিল।
–আমি ওঁকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। উনি একটু থাকুন এখানে, কেমন? বাবা অপ্রতিভ হয়। শমীক এটাই চাইছিল। তার সামনে জমবে না ওদের। তার পালানো। দরকার এখন। সে মহিলাকে একটা প্রণাম করে বলে–আচ্ছা। বাবার কোনও তাড়া নেই। সারাদিন তো একা।
মহিলা হাসলেন। বললেন–আমারও তাই। একা।
বলেই সামলে গেলেন। হেসে বললেন–ছেলেপুলে নেই তো।
খুব ধীরে শমীক দরদালানে বেরিয়ে আসে। বারান্দা পার হয়। সিঁড়ির মুখে চলে আসে। আর সেইখানে নিস্তব্ধ সিঁড়ির মুখে চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থাকে। কীসের জন্য যেন উন্মুখ ও উৎকর্ণ হয়ে থাকে। আর হঠাৎ শুনতে পায়, মৃদু একটা সুরের কেঁপে ওঠা। এস্রাজ বেজে উঠল।
নিশ্চিন্তে শমীক সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে।
.
দুপুরে যখন খেতে হোটেলে ফিরেছিল শমীক তখনও বাবা ফেরেনি। শমীক তাই বেরিয়ে পড়ল। মন ভালো ছিল না। এলোপাথাড়ি ঘুরল কেবল। বাবাজি চললেন। গাছের মতো, স্তম্ভের মতো বাবাজি আর থাকবেন না। তিনটে বোনের বিয়ে বাকি, ভাইরা এখনও নাবালক। কিন্তু সে সমস্যার চেয়ে বড় হচ্ছে শোক। সংসারের অপরিত্যাজ্য, অবিভাজ্য একজন থাকবে না। লোকটা তার প্রেমিকার বাড়িতে সকালে এস্রাজ বাজাতে বসেছিল। জানে না একটা কালো হাত নালি ঘা বেয়ে নেমে যাচ্ছে তার বুকের সুরের উৎসের দিকে। প্রাণঘড়ির কল টিপে বন্ধ করে দেবে। নার্সটা চেঁচিয়ে বলেছিল–ক্যানসার, থার্ড স্টেজ। কিছু করার নেই। সে কথা বাবা কি শোনেনি! কিংবা ডাক্তার মিত্রের লেখা চিঠিখানায় ‘হোপলেস’ শব্দটাও কি দেখেনি। নিশ্চিতভাবে! বড় অবাক লাগে। লোকটা নিশ্চিন্ত মনে এস্রাজ বাজাচ্ছিল আজ সকালেও।
ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। এসে দেখল, বাবা খুব নিবিষ্ট মনে সুটকেস গোছাচ্ছে! তাকে দেখে আনন্দিত স্বরে বলে–আয়। কোথায় ছিলি!
–ঘুরছিলাম। তুমি দুপুরে ফেরোনি?
–না। ছাড়ে নাকি! দুপুরে খাওয়াল। ঝোলভাত মেখে নরম করে দিল, ঘোল–টোল, শরবৎ, ফলের রস, কত কী!
শমীক হাসে। বলে–ভালো।
বাবার মুখে একটা রক্তাভা। একটু বুঝি হালকা পলকা তার মন। একটা হাওয়া এসে মনের। ওপরকার সব ধুলো উড়িয়ে নিয়ে গেছে। বলল –একটা রাগ শেখাচ্ছিলাম সেই কবে! পুরোটা তখনও তুলতে পারেনি, হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। আর শেখা হয়নি। আজ সারাদিন সেটা শিখিয়ে দিয়ে এলাম।
–ও।
–অসম্পূর্ণ একটা কাজ সম্পূর্ণ হল।
–খগেনকাকার সঙ্গে দেখা হয়নি?
বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বলে–না। সে নাকি অনেক রাতে ফেরে। আমি আর বসলাম। রাত হয়ে যাচ্ছিল।
–রিজার্ভেশন পেয়েছি বাবা। কালকের।
–পেয়েছ। বাঃ নিশ্চিন্ত! বলে বাবা খুব খুশি হয়। বলে—
সব দিক দিয়েই ভালো হল। কী বলিস!
–হ্যাঁ বাবা।
বাবা খুব একরকম উজ্জ্বল হাসে। বিছানার ওপর ছড়ানো নতুন কেনা শাড়ি, প্যান্ট আর পাটের কাপড়, টুকটাক নানান জিনিসের দিকে মমতাভরে তাকিয়ে থাকে বাবা। বলে–জিনিসগুলো খারাপ কিনিনি, না রে? সবাই খুশি হবে।
শমীক একটু দুষ্টুমি করে বলে–কিন্তু অত দামি জিনিস কিনেছ! অত দামি জামাকাপড় তো আমরা কখনও পরি না।
–তা হোক, তা হোক। বাবা খুশির গলায় বলে–আমার তো এটাই শেষ পুজোর বাজার। এবারটায় না হয় দামিই দিলাম।
বড় চমকে যায় শমীক। একদৃষ্টে বাবার দিকে চেয়ে থাকে। তবে কি বাবা জানে! জেনেও
বাবা স্বাভাবিক আছে? এত আনন্দ। অত খুশির মেজাজ। শমীক মনে-মনে বলে, তবে কি জানে বাবা?
বাবা তার দিকে চোখ তুলে চায়। বলে–একটা অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ হল, বুঝলে। কমলাকে রাগটা শিখিয়ে এলাম। মনটা বহুকাল ধরে ভার হয়ে ছিল।
বাবা চুপ করে হাসিমুখে ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। শমীক পরিষ্কার বুঝতে পারে, বাবার চোখ নিঃশব্দে তার প্রশ্নের জবাব দিল–জানি হে জানি!