ঝড়

ঝড়

খুব বেশি দিনের কথা নয়।

একদিনের মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রচণ্ড ঝড়ে শহর কলকাতার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় গাছগুলো শিকড় উপড়ে পথের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরদিন দেখে মনে হয়েছে যুদ্ধ-হত এক-একটা অতিকায় দানব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে অভিযোগ জানাচ্ছে। ভাঙা ডাল, ভেঁড়া তার আর উড়ন্ত টিনের চাল সরিয়ে চলাচলের পথ সুগম করতে এক সপ্তাহ লেগেছিল।

কিন্তু আমি সেদিনের কথাই বলছি। সেই প্রলয়-সন্ধ্যার কথা।

কাক চিল পটাপট মাটিতে আছাড় খেয়ে মরেছে। গাছ আর ভাঙা বাড়ি চাপ পড়ে অনেক লোক হতাহত হয়েছে। ট্রাম-বাস বন্ধ হওয়ায় বহু মেয়ে-পুরুষ পথে আটকে গেছে, আর ঘরে ফিরতে পারবে কিনা, সেই ত্রাস চোখ ঠেলে উঠেছে। যারা ভাগ্যক্রমে আগেই ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল তারা ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়েছে।

কিন্তু সেই সন্ধ্যাটাকে আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখি নি। কিছু শুনেছি, কিছু অনুমান করেছি। বাড়িতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে সকলে দুটো করে চোখ কপালে তুলে নিরীক্ষণ করেছে আমি সেই লোক কি না, আমার হাত-পাগুলো সব যথাযথ আছে কি না। আশঙ্কা কাটতে মা-ই প্রথম মুখব্যাদান করেছেন- তুই এর মধ্যে এলি কি করে, বিপদ-আপদ হয় নি তো? এদিকে যে কাণ্ড, ঠাকুর রক্ষা করেছেন

দুই এক কথায় সকলকে আশ্বস্ত করে কাণ্ড শোনার দিকে মন দিতে চেষ্টা করেছি। নিজেকে ভুলতে হলে, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হলে, অন্যের কথা মন দিয়ে শোনার মতো ওষুধ আর নেই। কিন্তু সে পারা বড় শক্ত। আমারও সহজ হচ্ছিল না।

ঝড় থেমে গেছে, তাই এরা ঝড়ের গল্প করতে পারছে। কার কত বড় ফাড়া গেল তার রোমাঞ্চকর বিবরণ কানে আসছে। বিপদ হতে পারত বই কি, খুব বিপদ হতে পারত।

কিন্তু আমার বুকের ঝড় এখনো থামে নি। দেহের সবগুলো স্নায়ুতে টান ধরে আছে। ওদের কথা শুনতে শুনতে সেগুলিকেই শিথিল করার চেষ্টা। সহজ হওয়ার চেষ্টা।

আমি তখন আকাশে ছিলাম।

একটা মালবাহী প্লেনে। যার পাইলট ক্যাপ্টেন সিং। যোগীন সিং। আর একটু বিস্তৃত করে বলা দরকার। কলকাতা থেকে কুচবিহার ট্রেনে প্রায় দুদিনের পথ, প্লেনে দেড় ঘণ্টার। খবরের কাগজের কাজে প্রায়ই তখন এদিকে আসতে হত। এই সূত্রে যোগীন সিংয়ের সঙ্গে আলাপ। মাসে চারবারও প্লেনে যাতায়াত করেছি। তাছাড়া দুই একবার আসাম বা বাগডোগরা থেকে ফেরার সময়ও যোগীন সিংয়ের প্লেন পেয়ে গেছি। ছোট একটা বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বপ্রধান পাইলট যোগীন সিং। গোড়ার জীবনে তিন বছর মিলিটারীতে ছিল। সেই সুবাদে ক্যাপ্টেন। মিলিটারীর ওপরঅলাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতে পার্মানেন্ট কমিশন পায় নি বা নেয় নি। প্রথম শর্তের মিয়াদ ফুরোতেই ছেড়ে এসেছে।

বনিবনা না হওয়ারই কথা। তার মেজাজের ওপর মেজাজ দেখানোর লোক থাকলে যোগীন সিংয়ের সেখানে টিকে থাকার কথা নয়। তার মতো পাইলট নিয়মিত সার্ভিসের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও অনায়াসে মোটা মাইনের কাজ জোটাতে পারত। মাসে দু-দশ বার ইংল্যাণ্ড আমেরিকা করতে পারত। কিন্তু সে কাজ করতে হলে নিয়মের বশ হতে হয়, মেজাজও কিছুটা খাটো করতে হয়।

যোগীন সিংয়ের সঙ্গে চেনা-যাত্রী হিসেবে আমার আলাপ বটে, কিন্তু হৃদ্যতার আরো একটু কারণ ছিল। বছর তিন চার আগে খবরের কাগজে একটা ফ্রী-ফাইটের ছবি ছাপা হয়েছিল সেটা আজ আর কারো মনে নেই বোধহয়। কলকাতার বাইরের এক অভিজাত হোটেলে বয়সের গরমে আর টাকার গরমে তিনটি ধনী সন্তান নিজেদের ভাষায় এক বিদেশী তরুণী মহিলার উদ্দেশে তরল টিকা-টিপ্পনী কাটছিল। মহিলা ভাষা না বুঝলেও তাকে নিয়েই কিছু হচ্ছে বুঝে ক্রুদ্ধ এবং আরক্ত হয়ে উঠছিলেন। যোগীন সিং মদ খাচ্ছিল আর ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল। উঠে গিয়ে প্রতিবাদ করতে ধনীর দুলালের তিনজনেই একসঙ্গে রুখে উঠল এবং মাতাল বলে কটুক্তি করে উঠল। একে তিনজন তারা, তায় স্বাস্থ্যও কারো খারাপ নয়! যোগীন সিং আর কিছু না বলে নিজের টেবিলে এসে মদের গেলাস খালি করল, তারপর উঠে চুপচাপ বাইরে চলে এল।

একটু বাদে চায়ের পাট শেষ করে আমি বাইরে এসে দেখি, যোগীন সিং নির্লিপ্ত মুখে হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতে নিস্পৃহ উক্তি করল–হ্যালো।

আমিও বললাম, হ্যালো।

আলাপ তখনো এর বেশি নয়। এরোড্রোম থেকে বেরিয়ে অনেক সময় এক হোটেলে এসে উঠলেও, লোকটাকে অত মদ খেতে দেখে, আমি তেমন বেশি কাছে ঘেঁষি না। কিন্তু সেদিন আমার সাংবাদিক চোখে কি যেন একটা সম্ভাবনার অস্বস্তি দেখা দিল। ট্যাক্সি ধরার অছিলায় আমিও দাঁড়ালাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। নি। ভিতরের মহিলাটি আগেই চলে গিয়েছিলেন। লোক তিনটিও একটু পরেই বেরুল। তারপর ফুটপাথের ওপরেই খণ্ড যুদ্ধ। দুজনের নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগল–তারা ফুটপাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তৃতীয় জন প্রাণ বাঁচিয়ে মোটরে উঠে চম্পট দিয়েছে।

আমি কিছুই করি নি। শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছি, আর ঠিক যে মুহূর্তটির ছবি তোলা। দরকার, সেই মুহূর্তের একটা ছবি তুলেছি। তারপর ঘটনার বিবরণ লিখে কাগজে পাঠিয়ে দিয়েছি।

এই থেকেই হৃদ্যতা। পরে যোগীন সিং হাসতে হাসতে বলেছে, তার উপকার করেছি আমি। সে অনেক জায়গা থেকে অনেক সাবাস পেয়েছে বলে নয়। লোকগুলোর টাকার জোর আছে, তারা কেস করত, অন্যভাবেও জব্দ করার চেষ্টা করত। কিন্তু খবরের কাগজে এভাবে ফলাও করে সব প্রকাশ হয়ে পড়াতে নিজেরাই গা ঢাকা দিয়ে আছে। খবরের কাগজ তার জোরালো সাক্ষীর কাজ করেছে।

আমি প্রীত হয়েছিলাম। কিন্তু এও জানি, যোগীন সিং কারো উপকারের পরোয়া না রেখেই যা করার করেছিল।

এরপর বাইরের এরোড্রোম থেকে বেরিয়ে সে যখন যে হোটেলে উঠেছে, আমাকেও সেখানেই টেনে নিয়ে গেছে। আমি বসে বসে তাকে অনেক মদ খেতে দেখেছি, কিন্তু মাতাল হতে দেখি নি। তাকে দেখলে বা কথাবার্তা বললে পাঞ্জাবী। বলবে না কেউ। দাড়ি-গোঁফের বালাই নেই, আমাদের মতোই পরিষ্কার বাংলা বলে। ছেলেবেলা থেকে বাংলাদেশেই মানুষ।

 যাক, বর্তমানের কথা বলি। কুচবিহার থেকে আমার ফেরার তাড়া ছিল। কিন্তু দুদিনের আগে প্লেনে সীট পাব, সে আশা ছিল না। ইতিমধ্যে যোগীন সিংয়ের প্লেন দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। সে আবার পরদিনই বিকেলে প্লেন নিয়ে ফিরছে জেনে, তাকে ধরলাম, নিয়ে যেতে হবে। যোগীন সিংও তক্ষুনি রাজী। তার এক টেলিফোনে ফেরার ব্যবস্থা হয়ে গেল। কারো আপত্তির প্রশ্ন ওঠে না, যোগীন সিং বলেছে যখন, মালের ওপর বসিয়ে নিয়ে গেলেও নিয়ে যাবেই জানি।–

পরদিন। দুপুর থেকে আকাশের অবস্থা ঘোরালো। কাগজেও ঝড়ের আভাস দিয়েছে। শাঁ শাঁ করে বাতাস বইছে, থমথমে মেঘের গুরু গুরু ডাকটা অন্যরকম।

যোগীন সিংকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই ওয়েদার, যাবে কি করে?

সে নির্ভাবনায় জবাব দিল, যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কলকাতায়?

মাথা নাড়লে। হাসলও একটু।

এ ধরনের হাসি আমি চিনি। বললাম–তাহলে তো বেশ জটিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে হচ্ছে, সময়ে না গেলে নিশ্চয় কোনো লেডির বিরাগ ভাজন হবার ভয় আছে?

যোগীন সিং আরো হেসে আরো বেশি মাথা ঝাঁকালে। আমার শোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সদাব্যস্ত যোগীন সিংয়ের প্রণয় কথা ফেঁদে বসার মেজাজ ছিল না। টুকটাক দু-চার কথা মাত্র জানা গেল। মহিলার নাম যশোধরা। ক্রিশ্চিয়ান। মস্ত ব্যবসায়ীর মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের বড় অবস্থার সময় যোগীন সিং ও-মেয়ের পাত্তা পায় নি। বাপের ব্যবসা লাটে উঠতে খানিকটা সুবিধে হয়েছে। তখনো যোগীন সিংয়ের টান দেখে–না, টান আরো বাড়তে দেখে, যশোধরা বুঝেছে যোগীন সিংয়ের লোভ তার বাবার টাকার ওপর নয়, লোভ তারই ওপর। সে অনেক ব্যাপার

যোগীন সিং হাসি মুখে স্বীকার করেছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করলে রক্ষা নেই সেটা সত্যি কথাই। মেয়ের যেমন মেজাজ তেমনি অভিমান, একবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করার ফলে সে কি কাণ্ড!

যোগীন সিং অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কাণ্ডবিস্তারে আগ্রহ দেখা গেল না। একটু বাদেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে ব্যস্ত পায়ে কোথায় চলে গেল। কিছু হয়ত মনে পড়ে থাকবে।

যথা সময়ে এয়ার অফিসে এসে হতাশ হলাম। এই আবহাওয়ায় প্লেন ছাড়বে। মনে হয় না। ঝোড়ো বাতাস ক্রমে বাড়ছে, আকাশের অবস্থা ভয়াবহ। এ সময় কুচবিহার থেকে ওই একটাই প্লেন ছাড়ার কথা। ছোট বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের মালবাহী প্লেন। ছাড়বে কি ছাড়বে না এ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। তবু ক্যাপ্টেন যোগীন সিং আসতে অফিস থেকে তাকে জানানো হল, সব জায়গারই ওয়েদার রিপোর্ট খারাপ –টেক অফ করা ঠিক হবে না।

যোগীন সিং কান দিলে না, নিঃশঙ্ক জবাব দিল–ও কিছু না, উপর দিয়ে চলে। যাব।

আমার ভয় ধরল একটু। এক ফাঁকে তাকে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম–এর মধ্যেই তুমি যাবে?

-তুমি থেকে যাও না, কাল যেও!

নিজের কাজে চলে গেল। দ্বিধা কাটিয়ে নিজেকে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করলাম। প্লেন যাবে, যোগীন সিং যাবে, এত মালপত্র যাবে, সঙ্গে যাত্রীও যাবে আরো–এর মধ্যে নিজের প্রাণটার জন্য এত ভাবতে লজ্জা করল। তাছাড়া সত্যিই বিপদের সম্ভাবনা। থাকলে যোগীন সিংই বা রওনা হতে চাইবে কেন?

প্লেন উঠল। আমরা চারজন মাত্র যাত্রী। এ ছাড়া পাইলট, কো-পাইলট এবং দু-চারজন ক্রু। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের, অর্থাৎ যাত্রীদের অবস্থা সঙিন। মালবাহী প্লেনের বসার আসনের ব্যবস্থা প্যাসেঞ্জার প্লেনের মতো নয়। মালের সঙ্গে খানিকটা মালের মতো হয়েই আসা। তবে কোমরে বাঁধার বেল্ট গোছের কিছু আছে। সামনেই মুহুর্মুহু লাল আলো জ্বলছে, ফ্যাসন ইওর বেল্ট-বেল্ট বেঁধে বসুন। কিন্তু ওই বেল্ট বাঁধা সত্ত্বেও স্থির হয়ে বসে থাকা অসম্ভব।

বাইরে ঝড় কতটা হচ্ছে টের পাচ্ছি না। কিন্তু ঝাঁকানি দোলানিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘড়ি দেখলাম। সময় অন্যায় আমরা কলকাতার ওপরে এসে পড়েছি। কিন্তু কিছুক্ষণের। মধ্যেই ভয় আর ত্রাসে শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। অনেক উঁচু দিয়ে প্লেনটা চক্রাকারে ঘুরছে। নীচে নামার এক একটা চেষ্টার মুখে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড-আমরা কে কোথায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছি ঠিক নেই। মনে হচ্ছে ঝড়ের মুখে কুটোর মতো এখুনি সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।

চোখের সামনে মৃত্যু দেখছি আমরা। মৃত্যু প্রতীক্ষা করছি। এরই মধ্যে ঝড়ের তাণ্ডব এড়িয়ে কোনোমতে প্লেন সম্ভবত অনেক উঁচুতে উঠে স্থির হল একটু। ভিতরে সকলে চিৎকার করে বলাবলি করতে লাগল, প্লেন আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, যেখান থেকে এসেছি সেইখানে, অথবা যে-কোনো দূর দূরান্তে যেখানে ঝড় নেই। আমিও একমত, কিন্তু জানাব কাকে?

জানাবার সুযোগ হল। কি কারণে মিনিট দুইয়ের জন্য কো-পাইলটের হাতে প্লেন ছেড়ে একবার ভিতরে এল ক্যাপ্টেন সিং। মনে হল, ভগবান আমাদের আরজি শোনাবার জন্যেই তাকে ভিতরে পাঠালেন। বিপদ সম্বন্ধে আমরা বেশি বুঝি, কি সে বেশি বোঝে সেই জ্ঞানও তখন আমাদের নেই। শুধু বাঁচতে চাই, বাঁচার আকুতি।

অন্য যাত্রীরা তাকে দেখেই চেঁচামেচি করে উঠল। তারা আশ্বাস চায়, বাঁচার আশ্বাস। প্লেন ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলল তারা। কিন্তু অনুভূতিশূন্য পালিশ-করা মূর্তি যোগীন সিংয়ের। কারো কথার জবাব দিলে না। ভিতরের একটা ছোট্ট খুপরির মধ্যে গিয়ে ঢুকল, আর দু মিনিট বাদেই বেরিয়ে এল।

এইবার তাকে দেখা মাত্র আমার ত্রাস আরো বেড়ে গেল। কারণ আমার মনে হল, ওখানে গিয়ে সে গলায় খানিকটা মদ ঢেলে এলো। সত্যি মিথ্যে জানি না। কিন্তু আমার তাই মনে হল, বিশ্বাস হল। রাগে ক্ষোভে আর ভয়ে দেহ অবশ। মনে হল, এক বদ্ধ পাগলের পাল্লায় পড়েছি আমরা। এই দুর্যোগ থেকে আর অব্যাহতি নেই, প্রাণের আশা নেই।

যোগীন সিং ভিতরে চলে গেল। কোথা দিয়ে কোথায় উড়ছি জানি না, তবে প্লেনের দাপাদাপি অপেক্ষাকৃত কম। ভাবতে চেষ্টা করলাম, হয়ত আমার অনুমান মিথ্যা, যোগীন সিং হয়ত কোনো কাজেই ওই খুপরির মধ্যে ঢুকেছিল। ডিউটির সময় মদ খাবেই বা কোন সাহসে। আশা করতে ভালো লাগল, আমরা হয়ত কোনো নিরাপদ স্থানেই ফিরে চলেছি। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। কোন দিকে চলেছি কিছু ঠাওর করা যাচ্ছে না।

অকস্মাৎ মিনিট কয়েকের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুর বিবরের মধ্যেই যেন ঢুকে পড়লাম আমরা। দেহের সব রক্ত প্রবল বেগে শিরশির করে উঠতে, বুঝলাম শাশা করে নীচের দিকে নামছে প্লেন। ঝড়ের সামান্য একটু বিরতির অপেক্ষায় ছিল যোগীন সিং। তারপরেই সব বোঝাবুঝির বাইরে আমরা।

দশ মিনিট গেছে, কি দশ ঘণ্টা গেছে, কি অনন্তকাল গেছে–কিছুই জানি না। একসময় সচেতন হয়ে দেখলাম প্লেন থেমে আছে, আর আমরা বেঁচে আছি। সেটা এমনই বিস্ময় যে চট করে বিশ্বাস হয় না।

দরজা খোলা হতে বাইরের দিকে চেয়ে আরো বিস্ময়। এরোড্রোমেই নেমেছি আমরা। ঝোড়ো হাওয়ায় তখনো দুপায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ানো শক্ত। এই বিপদ দেখেই ছোট একটা গাড়ি এসে আমাদের প্লেনের চত্বর থেকে তুলে নিয়ে অফিসে এনে ছেড়ে দিল।

সর্বাঙ্গ অবসন্ন। শান্তি। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে জীবনের আলোয় ফিরে আসার শান্তি। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ার মতো শান্তি।

কিন্তু যাব কী করে? এ প্যাসেঞ্জার প্লেন নয় যে কোম্পানির গাড়ি করে তাদের এয়ার অফিস পর্যন্ত অন্তত পৌঁছে দেবে। এদিকে প্লেন চলাচল সব বন্ধ, অন্য কোনো কোম্পানীর গাড়িও যাতায়াত করছে না। বাসও নেই। নির্জীবের মতো এরোড্রোমের রেস্তোরাঁয় ঢুকে এক কাপ কড়া কফি নিয়ে বসলাম। প্রাণে যখন বেঁচেছি, সমস্ত রাত এখানে কেটে গেলেও খুব আপত্তি নেই।

-হ্যালো।

যোগীন সিং। মুখ লাল, কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসির আভাসও একটু। যে লোকের খপ্পরে পড়ে প্রাণ যেতে বসেছিল, তাকে দেখেই আবার অন্য আশা জাগল। যোগীন সিংয়ের ছোট গাড়ি আছে একটা। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট

সাউথে, না এদিকেই?

–সাউথে। কেন?

 –আমাকে যতটা সম্ভব এগিয়ে দাও না, যাব কি করে?

 ঘড়ি দেখল। তারপর পিঠ চাপড়ে বলল–কাম অন–

একটি কেবিনের দিকে এগোল সে। কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে আমিও তার সঙ্গে কেবিনে গিয়ে ঢুকলাম। যোগীন সিং দুজনের খাবারের অর্ডার দিল। খাবার না আসা পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইল। কিছু ভাবছে মনে হল।

খাবার আসতে পরদা টেনে দিয়ে কিট থেকে মদের বোতল বার করল। আমি অবাক। প্রেয়সী সন্নিধানে যাবার আগেও এ বস্তু গলাধঃকরণ করতে পারে ভাবি নি।

খেতে খেতে ঈষৎ ব্যঙ্গস্বরে বলল, দুর্যোগে ওখানকার নিষেধ সত্ত্বেও প্লেন ছেড়েছি বলে আমার বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়া হবে শুনছি। ইডিয়েটস্!

ঈষৎ রক্তিম দেখালো মুখ। যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিলাম তা আর স্মরণ করতে ইচ্ছে করে না। তবু বললাম–এভাবে প্লেন না ছেড়ে আর একটু দেখে নিলেও তো পারতে।

–দেখতে গেলে আর প্লেন নিয়ে ওঠাই যেত না, সে আমি আকাশের অবস্থা। দেখেই বুঝেছিলাম। সে জন্যে পাঁচ মিনিট আগেই প্লেন স্টার্ট দিয়েছিলাম।

অর্থাৎ সব জেনেশুনেই সে প্লেন ছেড়েছে। এ রকম লোককে কিই বা বলি।

যোগীন সিং নিবিষ্ট মনে আহার করছে। আর মদ খাচ্ছে। যেভাবে খাচ্ছে, মনে হল ধীরে সুস্থে গোটা বোতলটাই শেষ করবে।

বললাম– এসে যখন এই বিপদ দেখলে তখনই বা প্লেন ফেরালে না কেন? সাঘাতিক কাণ্ড হতে পারত

বিরক্তির সুরে পাল্টা প্রশ্ন করল, ফিরব বলে প্লেন ছেড়েছিলাম? তোমাকে তো বলেছি আজ না এলেই নয়।

অর্থাৎ তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এক রমণী তার জন্য অপেক্ষা করছে, বা করবে। এদিকে নিশ্চিন্ত মনে সে পানাহারে মগ্ন। আমি হতভম্ভ। এই দুর্যোগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না রাখতে পারলে এক পাগল ভিন্ন আর কেউ রাগ করে না। বিশেষ করে যে লোককে আকাশ-পথে উড়ে আসতে হবে।

কিছু শোনার জন্যেই টিপ্পনীর সুরে বলতে ছাড়লাম না, এইদিনে না যেতে পারলেও কি তিনি বুঝতেন না?

মাথা নাড়ল। বুঝত না। বলল, বড় অবুঝ মেয়ে, বোঝাবুঝির মধ্যে নেই। একবার এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করে যে দুর্ভোগ হয়েছে, সে যদি জানতে পড়বি তো পড়, আজ আবার সেই দিন, সেই তারিখ।

ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে উঠেছি। কুচবিহারেও একবার বলেছিল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট না রাখতে পারলে রক্ষা নেই, মেয়ের যেমন মেজাজ তেমনি অভিমান–একবার সময়মতো যেতে না পারার ফলে কি কাণ্ডই না হয়েছিল। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সেই আসাই এলো বটে। কিন্তু এসে এখানে বসে মদ গিলছে। সত্যি কথা বলতে কি, যে মেয়ে যোগান সিংয়ের মতো বেপরোয়া লোককে এভাবে নাকে দড়ি বেঁধে টেনে আনতে পারে, তাকে একটিবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল

জিজ্ঞাসা করলাম, তা এসেও তুমি এখানে দেরি করছ কেন?

সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, সাড়ে আটটায় যাবার কথা।

এমনভাবে বলল, কেন ওই সময়ের দু-দশ মিনিট আগেও যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এমনও হতে পারে, নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট কোনো সময়ে ওদের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। হয়ত ঠিক সময়ে রমণীটি অভিসারে আসবেন।

ঘড়ি দেখলাম। সাতটা বাজতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি। জিজ্ঞাসা করলাম কথা না রাখতে পেরে একবার খুব মুশকিলে পড়েছিলে বুঝি?

-খুব। আজকের এই দিনেই

মদ খাচ্ছে বলেই হয়ত ওর চোখের পাতা ভারি ঠেকছিল। আর মদ খাচ্ছিল। বলেই হয়ত সেই মুশকিলের কথা সহজে জানা গেছে। কিন্তু মোটামুটি শোনার পরেও সেই মুশকিলটা এমন প্রাণ তুচ্ছ করে ছুটে আসার মতো মনে হয় নি আমার। যোগীন সিংয়ের মতে যশোধরার ব্যবসায়ী বাবা লোকটা আদৌ সুবিধের নয়। মেয়েকে টোপ করে মস্ত পয়সাঅলা জামাই গাঁথবার মতলব ছিল তার। ওই করে শেয়ারবাজারের ঘা সারাবে ভেবেছিল। কিন্তু মেয়ের জন্যেই তা হচ্ছিল না। মেয়ে ওদিকে বাপের কাছে একজন মস্ত মানুষ বানিয়ে রেখেছে যোগীন সিংকে। মস্ত টাকার মানুষ। নয় মানুষের মতো মস্ত মানুষ। তার এক গোঁ তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না।

নিরুপায় হয়ে বাপ তখন সামনাসামনি যোগীন সিংয়ের সঙ্গে একবার কথাবার্তা কয়ে বুঝে শুনে নিতে রাজি হয়েছিল। সেও অনেক দিন অনেক চেষ্টার পর মেয়ে বাপকে এই সাক্ষাৎকারে রাজি করাতে পেরেছিল। দিনক্ষণ ঠিক হল। কিন্তু এমন কাণ্ড, বলতে গেলে একরকম অকারণেই যোগীন সিং আসতে দেরী করল। এমন কিছু দেরী নয়, মিনিট বারো-চোদ্দ। ঘোড়েল বাপ ঘড়ি ধরে ঠিক দশটি মিনিট অপেক্ষা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল। যোগীন সিং গিয়ে দেখে যশোধরাও নেই। ব্যাপারটা শুনল তার মায়ের কাছে। বাপ বেরিয়ে যাওয়ার পর রাগে জ্বলতে জ্বলতে মেয়েও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

সম্ভব অসম্ভব অনেক জায়গায় যোগীন সিং খুঁজে বেড়াল তাকে। আর বাপটাকে মনে মনে ধরে আছড়ালো বারকতক। ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের বাড়িতে এলো দেখতে, যশোধরা সেখানে অপেক্ষা করছে কি না। এসে শুনল, টেলিফোনে খবর এসেছে। যশোধরা হাসপাতালে আছে। রাগে আর অভিমানে মেয়ে এমন গাড়ি চালিয়েছে যে সরাসরি অ্যাকসিডেন্ট।

হাসপাতালেও এই মেয়ে সহজে মুখ ফিরিয়ে তাকায় নি তার দিকে। যোগীন সিং অনেক ক্ষমা চেয়ে, অনেক নাক-কান মলে জীবনে আর কোনোদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করবে না প্রতিজ্ঞা করে তবে তার মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরেছিল।

মনে মনে বললাম, যেভাবে এসেছ জানতে পারলে আজও একবার নাক-কান। মলে তোমাকে আবার কিছু প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, অত মদ যে খাচ্ছে তাই বা ওর প্রেয়সী বরদাস্ত। করবে কি করে। কিন্তু তার আগে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সচকিত হলাম, সাতটা পঁয়ত্রিশ। এখন না উঠলে সে সাড়ে আটটায় পৌঁছবে কি করে? ঘড়ির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একটুও তাড়া দেখা গেল না। অস্ফুট জবাব দিল, সময় আছে। অন্যমনস্কর মতো আবারও কিছু ভাবছে মনে হল।

আরো ঠিক দশ মিনিট কাটল এইভাবে, আমি উসখুস করছি, অবাকও হচ্ছি। মদের নেশায় সময়ের গণ্ডগোল হয়ে গেল?

পৌনে আটটা।

এসো।

বোতলে আরো খানিকটা আছে, সেখানেই পড়ে থাকল। বড় বড় পা ফেলে। গাড়িতে এসে উঠল। পাশে আমি। পিছনে দেখলাম এক গোছ ফুল রয়েছে। এই দিনে ফুল কোথা থেকে সংগ্রহ হল ভেবে পেলাম না।

গাড়ি ছুটেছে।

হেড লাইটে রাস্তার অবস্থা দেখে আমার দুই চক্ষু স্থির। ঝোড়ো বাতাস আর নেই, বৃষ্টি পড়ছে। ভাঙা ডাল আর গাছের পাতায় সমস্ত রাস্তা ঢেকে গেছে। কোথাও মস্ত মস্ত টিনের চালা পড়ে আছে–তার ওপর দিয়েই মড় মড় শব্দে গাড়ি পার হতে টের পাচ্ছি বস্তুটা কি।

এ-রকম রাস্তায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটে দমদম এরোড্রাম থেকে দক্ষিণ কলকাতায় পৌঁছানোর সংকল্প শুনলেও লোকে পাগল বলবে। কিন্তু গাড়ির স্পীড দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি বাড়ছে।

এক সময় স্বাভাবিক ভাবেই বলতে চেষ্টা করলাম, যে রাস্তা, তোমার সাড়ে আটটায় পৌঁছনোর প্রশ্নই ওঠে না–

জবাব দিল না। কিন্তু গাড়িতে স্পীড আরো বেড়ে গেল।

রাজ্যের ভয় আমাকে গ্রাস করতে এলো। এবারে মনে হল, আমি যথার্থই এক পাগলের পাল্লায় পড়েছি। একবার প্রাণে বেঁচেছি, এবারে আর রক্ষা নেই। প্রায় এক বোতল মদ গিলে গাড়ি চালাচ্ছে। কি করছে একটুও হুঁশ নেই নিশ্চয়। ক্ষোভে দুঃখে নিজেরই হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল। একবার ওভাবে বেঁচে, আর চোখের সামনে। অত মদ খেতে দেখেও কেন আমি যেচে সঙ্গে এলাম! মৃত্যু না ঘনালে এমন মতি হবে কেন আমার?

বাধা পেয়ে গাড়ি এক-একবার বিষম লাফিয়ে উঠছে। সামনে মস্ত মস্ত এক-একটা ডাল, বা হয়ত একটা আস্ত গাছই পড়ে আছে। স্পীড না কমিয়ে খেলনার মতোই অপরিসর ফাঁক দিয়ে গাড়িটা পার করে আনছে যোগীন সিং।

শ্যামবাজার পেরিয়ে সার্কুলার রোড ধরে নক্ষত্ৰবেগে গাড়ি ছুটেছে। রাস্তায় জনমানব নেই, পুলিশ নেই, অন্তত আমি কিছুই দেখছি না। আমি শুধু দেখছি, সামনে মৃত্যু। মৃত্যু হাঁ করে আছে।

ডাক ছেড়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছে আমার। দুহাতে তাকে জাপটে ধরে থামাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার দিকে চেয়ে কিছুই করতে পারছি না। পাথরের মূর্তির মতো বসে গাড়ি চালাচ্ছে সে। ওকে বাধা দেওয়ার থেকেও যেন মৃত্যুর গহ্বরে গিয়ে ঢোকা সহজ।

আমি তারই প্রতীক্ষা করছি। চকিতে একবার মনে হলো লোকটা বোধহয় আত্মঘাতী হতে চায়। এই জন্যই অমন দুর্যোগে অনায়াসে প্লেন ছাড়তে পেরেছে, আর এই জন্যেই এই গাড়ি নিয়ে এমন পাগলা ছোটা ছুটেছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত অ্যাকসিডেন্ট হল না। গাড়ির গতি কমল। রাস্তার পাশে হঠাৎ এক জায়গায় ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। ঘড়িতে সাড়ে আটটা।

আমারও হুশ ফিরল যেন। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখি পার্ক স্ট্রীটের এক জায়গায় এসেছি। তারপর হঠাৎ এক ধাক্কা খেয়ে বিমূঢ় আমি। ফুলের গোছা নিয়ে যোগীন সিং এখানে কোথায় নামছে! আমার শরীরের রক্ত এবারে দ্বিগুণ শিরশির করে পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে।

এপাশে সাদা দেয়াল-ঘেরা বিস্তৃত সমাধি-ভূমি। দুর্যোগের অন্ধকারেও এখানকার সমাহিত সাদাটে পরিবেশ চোখে পড়ে।

 নিজের অগোচরেই মুখ দিয়ে কথা বেরুল, এখানে কোথায় যাচ্ছ?

ফুল হাতে যোগীন সিং থমকে দাঁড়াল একটু। শান্ত গভীর দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকালো। হঠাৎ আমার মনে হল, দুই চোখে কত জল জমাট বেঁধে আছে ঠিক নেই। ঝরছে না, শুধু চকচক করছে

বিড়বিড় করে বলল–এখানেই তো, হাসপাতাল থেকে সোজা নিয়ে এসেছিলাম তাকে, এখানেই আছে। বসো, বেশি দেরি হবে না–

শ্রান্ত পা দুটো টেনে টেনে সমাধিস্থানের দিকে এগিয়ে গেল সে।

 আমি নির্বাক, নিস্পন্দ।

ঝড়

ঝড়

ঝড়

একটা মেয়ে হাসি-হাসি মুখ করে একটা বিস্কুট খাচ্ছে–এই হল বিজ্ঞাপন। তা বদরী অনেকক্ষণ খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখল। খবরের কাগজ তার নয়, পাশে বসা পুলিনবিহারীর। পুলিন খুব খবরের কাগজ পড়ে। কেন পড়ে কে জানে! বদরী বিজ্ঞাপনটা দেখে ভাবল, তাকেও ওই বিস্কুট খেতে বলা হচ্ছে। বিজ্ঞাপন তো তাই বলে।

এই মেয়েটা যখন বিস্কুটটা খাচ্ছে, তখন তোমারও বাপু খাওয়া উচিত। কিন্তু কেন খাবে, বদরী এটাই বুঝতে পারে না। কোলে রাখা গামছাটা তুলে সে কপালের ঘাম মুছল। গরমটাও পড়েছে বাপ। একবারে কাঁঠাল পাকানো গরম। যেমন ভ্যাপসা, তেমনি চনচনে। রোদ্দুরের মুখে আবডাল দেওয়ার মতো ছেঁড়া কাঁথাকানির মতো একটু মেঘও নেই। আকাশ একেবারে নিকোনো উঠোন। মাটিতে কোদাল মারলে এখন ঠন করে শব্দ হয়।

বিস্কুট খাওয়ার বিজ্ঞাপনটা চাপা পড়েছে। পুলিনবিহারী পাতা ওলটাল। এবার একটা টিভির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। সেখানেও একটা মেয়েছেলে, টিভির ওপর হাতের ভর দিয়ে হেলে দাঁড়ানো, হাসি-হাসি মুখ। মেয়েছেলে ছাড়া দুনিয়ায় যেন কিছু হওয়ার জো নেই! বদরী একটা শ্বাস ফেলল।

পুলিনবিহারীর বয়স তেষট্টি, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, শক্ত গড়ন। গায়ে ঘেমো ময়লা একখানা পলিয়েস্টারের পাঞ্জাবি, আধময়লা ধুতি, চোখে চশমা। মাতব্বর লোক। একটা খবর একটু ঝুঁকেই পড়ছিল। জম্পেশ খবরই হবে। দুনিয়ায় খবরের অভাব কী? খবরের কাগজ হল কুচুটে মেয়েছেলের মতো, যত রাজ্যের গালগল্প ফেঁদে বসে মানুষের কাছে।

ট্রেন চলছে বটে, কিন্তু জানলা দিয়ে তেমন হাওয়া আসছে না। যা আসছে তা যেন কামারশালায় হাপরের ফু। জানলার ধারটা পাওয়া যায়নি। ওদিকে দুটো লোক। বাকি দুজন সে আর পুলিনবিহারী। তিনজনের সিটে চারজন। এটাই নিয়ম। ঠাসন্ত ভিড়। ওপরে পাখা-টাখা ছিল এককালে। কে খুলে নিয়ে গেছে।

বদরী আলালের ঘরের দুলাল নয়। গরমও সয়, শীতও সয়। তবে মাঠে-ঘাটে খোলামেলা থাকার একটা রকম আছে। এই যে খাঁচায় পোরা অবস্থা, এটা তার অভ্যেস নেই।

ট্রেনটা একটা আঘাটায় দাঁড়াল। তা এরকম দাঁড়ায়। পুলিনবিহারীর বাঁ-হাতে ঘড়ি। দেখে নিয়ে বলল, চারটেয় পৌঁছোতে পারলে ফেরার শেষ ট্রেনটা পেয়ে যাব।

ফিরতেই হবে। কচি মেয়েটাকে রেখে এসেছি।

আহা, অত উতলা হলে চলে? জলে তো আর ফেলে আসিসনি। পিসির কাছেই তো আছে। বিলাসী বুক দিয়ে আগলে রাখে।

না ফিরলে চিন্তা করবে। রাতে পিসির কাছে থাকতে চায় না। তার ওপর বিলাসীর যা গন্ধমাদন ঘুম। রাতে ভয় খেয়ে পিসিকে ডাকলেও উঠবে না।

ঘড়িটা আবার দেখে পুলিন বলল, আর চারটে স্টেশন। তারপরই নেমে পড়ব। মেরেকেটে তিন মাইল রাস্তা। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে। ফেরার শেষ ট্রেন সাড়ে নটায়।

যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে একজন বলল, নটা-কুড়ি, যাবেন কোথা?

মৌলবির বাজার।

অ। দূর আছে।

পুলিন পাঞ্জাবিটা তুলে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে পেট চুলকোল। চশমাটা ঘামে পিছলে নাকের ডগায় নেমে এসেছে। সামনের দুটো দাঁত নেই। বলল, আর দেরি না করলেই হল।

এদিককার ট্রেন এরকমই চলে। দাঁড়ায়, জিরোয়, ঘুমিয়েও পড়ে। ট্রেন নড়ছে না।

বদরীর একটা আঁকুপাঁকু লাগে। গরম, ঘাম, ভিড় সব সহ্য হয়, কিন্তু দেরিটা ভোগাবে। তেমনি দেরি হলে–বদরী ঠিক করেই রেখেছে–দাঁইহাট স্টেশন থেকেই ফিরতি ট্রেন ধরবে। বিলাসী শ্বশুরবাড়ি থেকে মোটে আসতে চায় না। সেখানে বিরাট সংসার। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনিয়েছে। কাল-ই তার রওনা হওয়ার কথা। তার মেয়ে নন্দরানির বয়স মোটে তিন। বিলাসীর তিনটে মেয়ে একটা ছেলে। দিনের বেলাটা নদু ওদের সঙ্গে বেশ থাকবে। তবে রাত হলে তার বাপকে চাই। মা-মরা মেয়ে, বাপের বড্ড নেই-আঁকড়া। বাপের দিক থেকে একটা একরকমের ভাবনা থাকে। আবার মেয়ের দিক থেকেও আর একরকমের ভাবনা আছে। এমন হতে পারে, মেয়ে বাপের কথা তেমন ভাবছে না। যেমনটা মেয়ে ভাবছে বলে মনে করছে, তেমনটা নয়।

পুলিনদা, কী হবে?

পুলিন একটা ময়লা রুমালে নাক মুছল। চশমাটা ফের নাকে বসিয়ে বলল, অত ভাবছিস কেন? খবরের কাগজটা ভাঁজ করে একটু হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করল পুলিন। পুলিনবিহারীর পিছুটান তেমন নেই। গাঁয়ের মাতব্বর হলে কী হয়, বাড়িতে বিরাট সংসারে তেমন পোঁছে না কেউ। ছেলেরা লায়েক হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, পুলিনবিহারীও নানা কাজে বারমুখো। যেখানে সেখানে দেহখানা রাখলেই হয়। দু-চার দিন তার খোঁজও হবে না।

পুলিন বলল, কাজটা আসল, না ফেরাটা আসল?

ভারি তো কাজ! বলে বদরী মুখ ফিরিয়ে নিল।

কে একজন বিড়ি ধরিয়েছে, তার ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে এদিকে। এই দমবন্ধ অবস্থায় বিড়ির গন্ধ যেন, আরও গরম করে দিল কামরাখানা। চারদিকে অনড় ভিড়। তবে গোলমালটা কম। গরমে হাঁফিয়ে গিয়ে লোকের আর কথা বলার মতো দম নেই। শুধু শালা, সুমুন্ধির পুত, রেল কোম্পানির ইয়ে করেছে, গোছের কয়েকটা কথা কানে এল।

গাড়ি একটা স্তিমিত ভোঁ দিয়ে অবশেষে ছাড়ল। পুলিন ঘড়ি দেখে বলল, হয়ে যাবে।

কী হয়ে যাবে?

সময় থাকবে হাতে। ভাবিসনি।

আরও চারটে স্টেশন, তার মধ্যে কত কী হয়ে যেতে পারে!

 পুলিন মুখটা কুঁচকে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। আজ রোদটাও উঠেছে।

চারদিকটা যেন স্টিলের বাসনের দোকান হয়ে আছে।

পরের স্টেশনটা কাছেই ছিল। থামতেই কিছু লোক নামায় কামরাটা কিছু হালকা হল। জানলার দিকের দুটো লোক উঠল বটে, কিন্তু বদরী ওদিকে এগোল না। তেরছা হয়ে রোদ পড়ছে জানলা দিয়ে।

ঝালমুড়ি, শসা আর দাঁতের মাজনে ফিরিওয়ালারা হেদিয়ে পড়ে নেমে গেছে। একটা বাচ্চা চা-ওয়ালা উঠে হাঁক মারছিল।

পুলিন বলল, চা খাবি?

ও বাবা, এ গরমে চা!

বিষে বিষক্ষয়।

আমার দরকার নেই। তুমি খাও।

পুলিন চা নিল। চুমুক মেরে বলল, আগে অটোরিকশা সব যেত। রাস্তাটা দু-বছর আগে এমন ভাঙল যে, আর কিছুই যায় না।

দেশের অবস্থা যে ক্ৰমে খারাপ হচ্ছে এটা জানে বদরী। তবে তাতে তার বিশেষ আসেও না, যায়ও না। সে উদয়াস্ত খেতে পড়ে থাকে। শরীরখানা পাত করে, তবে অন্ন জোটে বরাবর। এ ব্যবস্থার ভালোও নেই, মন্দও নেই। চলে যায়। খরা, বন্যা হলেই যা বিপদ।

পরের স্টেশনে দুড়দাড় লোক নামতে লাগল দেখে, বদরী একটু অবাক হল। পুলিন বলল, আজ হরিপুরের হাট। চৈত্র-সংক্রান্তির মেলাও বসেছে ক-দিন হল। হরিপুরের জন্যই ভিড়, নইলে এ ট্রেন ফাঁকা যায়।

বড্ডই ফাঁকা হয়ে গেল। গরমটাও যেন খানিক উড়ে গেল খোলা বাতাসে। পুলিন চায়ের ভাঁড়টা এতক্ষণ ফেলেনি, হাতে ধরেছিল। এবার সেটা জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোর কপালটা ভালো, বুঝলি! বিয়েটা যদি লেগে যায়, দেখবি কপাল খুলে যাবে।

ভালোর তো লক্ষণ দেখছি না। যাত্রাটাই খারাপ হল। ট্রেন যা লেট মারছে স্টেশন থেকেই না ফিরতে হয়। কথাটা গ্রাহ্য করল না পুলিন। বলল, স্বয়ং কাত্যায়নীর সংসার, বুঝলি তো? এক ছটাক বাড়িয়ে বলা নয়। এ-তল্লাটের সবাই জানে। অজাপুর থেকে বউ এল, তেরো বছর সবে বয়স। একেবারে লক্ষ্মীপ্রতিমা। গাঁয়ে ঢুকতেই দু-বছরের খরা কেটে বৃষ্টি নামল। গাছে গাছে ফলন। বউ যেখান দিয়ে যায় যেন লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়ে। ভাসুরকে ভাত দিতে গিয়ে বিপত্তি, ঘোমটা পড়ে গেল। দু-হাত জোড়া। কী করে? সবাই দেখতে পেল, বউ আর এক জোড়া হাত বের করে ঘোমটাটা তুলে দিল মাথায়।

ও গপ্পো আগে শুনেছি।

বলেছি নাকি তোকে?

তুমি বলোনি। অন্য এক বউ সম্পর্কে এরকম আর একজন কেউ বলেছিল।

ও যে এই বউয়ের-ই গল্প। পাঁচমুখে ছড়িয়েছে। এ তল্লাটে সবাই জানে।

তা নয় হল, কিন্তু সে তো পুরোনো কাসুন্দি। তোমার খুড়োর মেয়ে তো আর সে নয়।

ওরে ওনারা যে-পরিবারে আসেন, সেই পরিবারটাই জাতে উঠে যায় কিনা। ওর একটা ধারা থাকে।

কতকাল আগেকার কথা সব। ওর ধারা আর নেই গো পুলিনদা।

তা এক-দেড়শো বছর হবে। এমন কিছু বেশিদিনের কথা নয়। ধরো আমার বাবার বয়েস।

ধরলাম। কিন্তু তাতেও সুবিধে হচ্ছে না। যদি সেই ধারাই হবে, তাহলে আমাকে পাত্তর ঠাওরাচ্ছ কেন?

পুলিন গোঁফের ফাঁকে একটু হাসল, কেন তুই কি খারাপ পাত্তর? পনেরো বিঘে জমি, দু-বিঘে মাছের পুকুর, বাড়িতে অতগুলো ফলন্ত গাছের বাগান।

পাত্তরের আর কিছু লাগে-না বুঝি?

আর কী লাগে?

কেন, চরিত্তির, পেটে বিদ্যে, বংশগৌরব।

তোর কী চরিত্তির খারাপ? বিদ্যেও ধরা, বাংলাটা জানিস, ইংরিজিতে নাম-সই কম নাকি? হারাধন বিশ্বাসের নাতি–বংশই কি ফেলনা?

স্টেশনগুলো পটাপট পেরিয়ে এল তারা।

পুলিন একটু হুটোপাটা করে উঠল, ওরে নাম নাম। সামনের স্টেশনটাই। গাড়ি বিইয়ে এল।

নেমে পড়ল তারা। পুলিন ঘড়ি দেখে একগাল হেসে বলল, দেরি করেনি রে। চারটে বেজে পাঁচ মিনিট। হেসেখেলে সাড়ে-নটার গাড়ি পাব।

তোমার তিন মাইল যদি চার বা পাঁচে দাঁড়ায় তাহলে অন্য কথা।

ওরে না না। অত নয়।

উদোম মাঠের ভেতর দিয়ে পথ। পাকা না হলেও রাস্তাটা পাথরকুচির ছিল বটে। তবে বহুকাল সারানো হয়নি। ভেঙে-টেঙে একশা।

পুলিন বলল, এইবার রাস্তাটা স্যাংশন হয়েছে। সারানো হবে। সামনের বছর যখন জামাইষষ্ঠীতে আসবি, তখন পাকা রাস্তা দিয়ে অটোয় চেপে হাসতে হাসতে গোঁফে তা দিতে দিতে আসবি। বুঝলি?

গাছে এখন কাঁঠালের ফুলটিও আসেনি গো, গোঁফে তা দিয়ে হবে কী? দ্বিতীয়বার ছাদনাতলায় বসার ইচ্ছে নেই গো মোটে। তুমি ধরে নিয়ে এলে বলে আসা। নদুকে আমি সৎমায়ের হাতে দেব ভেবেছ নাকি?

আচ্ছা আচ্ছা, আগে দেখ তো। কাকা বলে ভাবিসনি যে বুড়ো। বাবার পিসির ছেলে। বয়েস আমার চেয়েও পাঁচ বছর কম। তারই দ্বিতীয়পক্ষের কনিষ্ঠা। পনেরো-ষোলোর বেশি হবে না।

সবই জানে বদরী। পুলিন একবার নয়, বহুবার বলেছে। বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। তাই বাঁচার জন্য আসা। একবার দেখে নাকচ করে দিলেই হবে। বিয়ে করতে বড়ো বয়েই গেছে বদরীর। মেয়েটার জন্য গাঁয়ের শোভাখুড়ির সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়ে আছে। বদরী যখন মাঠে যায়, খুড়ি এসে দেখে। বছর পাঁচেক বয়স হলে তখন আর খবরদারির তেমন দরকারও হবে না। পাঁচটা গাঁয়ের মেয়ের সঙ্গে খেলবে-ধুলবে, বড়ো হয়ে যাবে। বদরীর তখন ঝাড়া হাত-পা। বিয়ে আর নয়। ত্রিশ-বত্রিশ বয়স হল তার। আর দরকার কী বিয়ের?

পুলিনবিহারী আগডুম বাগড়ম, বলতে বলতে পথ হাঁটছে আগে আগে। পেছনে বদরী।

ঘরটাও পাওয়া গেছে পালটি। একেবারে যেন তোর জন্য পাঠিয়েছেন ভগবান।

বদরী জবাব দিচ্ছে না। হাঁ করলেই গলা বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, এমন গরম।

প্রথম গাঁ গোবিন্দপুর, দ্বিতীয় সোনাডাঙা, তিন নম্বর মৌলবির বাজার। আন্দাজ আছে বদরীর। তিন মাইলই হবে।

মৌলবির বাজার যেন মরুভূমির মধ্যে একখানা দ্বীপ বড় গাছপালা চারদিকে। ধূলিধূসর ভাবটা নেই।

কেন জানিস তো? সাতাশখানা পুকুর আছে, একখানা দিঘি। তার ওপর ইরিগেশনের খাল। এ-গাঁ একেবারে লক্ষ্মীমন্ত। হবে-না? স্বয়ং কাত্যায়নী লীলা করে গেছেন।

বদরীর একটু ভয় ভয় করছে। কেন কে জানে!

ঘাবড়াচ্ছিস নাকি?

না, ঘাবড়াব কেন?

মৌলবির বাজার যে লক্ষ্মীমন্ত গাঁ এটা মনে মনে স্বীকার করতে হল বদরীনাথকে। গাছপালা আছে। পাড়ায় পাড়ায় পুকুর। গাঁও বিশাল। মেলা লোকের বাস। রোজ বাজার বসে। হপ্তায় দু-দিন হাট।

পুলিনবিহারী দূর থেকে দেখাল, ওই যে শিবমন্দির দেখছিস, ওর পিছনেই বাড়ি।

বাড়িখানা পুরোনো হলেও ভালোই। পাকা দেয়াল, মেঝে, ওপরে টিনের চাল। মস্ত উঠোন, তিনটে ধানের গোলা, সবজি বাগান, নারকেল আর সুপুরির গাছ আছে।

পুলিনবিহারী হাঁক মারল, কই রে, কোথায় গেলি সব?

হাঁক-ডাকের দরকার ছিল না। দাওয়াতেই একধারে দুজন লোক বসে গ্যাঁজালি করছিল। রোগা কালোপানা একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও বাবা, ভাইপো যে!

এই কাকা, বুঝলি? এর-ই মেয়ে।

কাকার কপালে রসকলি, গলায় কন্ঠি, গায়ে গেঞ্জি, পরনে ধুতি। মুখখানায় ধূর্তামি আছে। বদরী ভালো করে দেখে নিল।

পুলিন বারান্দায় উঠে বলল, হাতে মোটেই সময় নেই। রাত সাড়ে নটায় ফিরতি ট্রেন। বুঝেছ তো?

সম্পর্কে খুড়ো হলেও বয়েসে কম। ফলে সম্পর্কটা ঘোরালো। খুড়ো কদম দাস বলল, আজই ফেরত যাবে কেন? চোত সংক্রান্তিতে মেলা বসিয়েছি এবার, দুটো দিন থেকে যাও।

ঘন ঘন মাথা নেড়ে পুলিনবিহারী বলল, না না, এই বদরীর জন্যই আসা। তা তার থাকার উপায় নেই কিনা।

বলেই গা থেকে জামা খুলে ফেলল পুলিনবিহারী। তার সারাগায়ে দগদগ করছে ঘামাচি। বলল, হাতপাখা দাও তো একটা। আর ডাব।

কদম দাস তাড়াতাড়ি ভেতর বাগে গেল। যে-লোকটা বসে এতক্ষণ কদমের সঙ্গে কথা বলছিল, সে এবার উঠে কাছে এসে বলল, এদিকটায় রোদ। ওদিকটায় ছায়া আছে।

বদরী এ-লোকটাকেও ভালো করে দেখল। বয়েস অল্পই। ছোঁকরা গোছের। ভারি বিনয়ী, নরমসরম ভাব।

পুলিন বলে উঠল, এক্রাম নাকি রে?

আজ্ঞে।

তোর মোকদ্দমার কী হল?

চলছে।

মোকদ্দমার কথায় পুলিনের আলাদা উৎসাহ আছে। মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারটা সে খুব পছন্দ করে। পাঞ্জাবিটা কাঁধে ফেলে বলল, ফাঁকে চল তো, শুনি ভালো করে।

বদরী দেখল, কথা কইতে কইতে তারা ফটক অবধি গিয়ে দাঁড়াল। কথা আর শেষ হয় না। মামলা মোকদ্দমার কথা শেষ হওয়ারও নয়।

কদম দাস সঙ্গে একটা রাখাল গোছের ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এল। রাখাল ছেলের দু-হাতে কাটা ডাব।

জলটুকু খেয়ে নাও ভাই। তারপর অন্য ব্যবস্থা হচ্ছে।

 ডাবটা হাতে নিয়ে বদরী বলল, এক ঘটি জলও দেবেন। বড্ড তেষ্টা।

হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরে পুটু, শিগগির গিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলে নিয়ে আয়।

রাখাল ছেলেটা দৌড়োল।

ও ভাইপো, ডাব খাবে না?

পুলিনবিহারী হাতটা তুলে বরাভয় দেখাল। কথা থামল না।

ডাবটা শেষ করে বদরী ঢকঢক করে ঘটির জলটাও মেরে দিল। ভেতরটা একবারে ঝামা হয়েছিল এতক্ষণ।

রাখাল ছেলেটা দুটো লোহার চেয়ার এনে বারান্দায় পেতে দিয়ে বলল, উঠে বসুন। দাওয়ার দড়িতে একটা মোটা চাদর ঝুলিয়ে ছায়ার ব্যবস্থাও হল। হাতপাখা চলে এল।

কিন্তু মুশকিল হল, পুলিনবিহারীকে নিয়ে। তার কথা আর শেষ হচ্ছে না। এক্রামকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরও তফাত হল। তারপর চোখের আড়াল।

কদম দাস বোধহয় ভেতর-বাড়িতে খবর করতে গিয়েছিল। হঠাৎ বদরী দেখতে পেল, ঘরের দরজায় কিছু মেয়েমানুষের ভিড় আর ঠেলাঠেলি। দু-চারটে কচিকাঁচাও আছে। বদরী আজ দাড়ি কামিয়ে গোঁফ হেঁটে এসেছে। গায়ে একখানা সবুজ পাঞ্জাবি, পরনে তাঁতের ধুতি। ঘামে একটু দুমড়ে দুমড়ে গেলেও, পোশাক খারাপ নয়। বদরী পেছনদিকে আর তাকাল না। হাতপাখায় বাতাস খেতে খেতে বে-আক্কেলে পুলিনবিহারীর চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করছিল মনে মনে। বিপদের মুখে ফেলে কোথায় যে। হাওয়া দিল। কান্ডজ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে। বদরীকে একটা লজ্জার অবস্থায় ফেলে এরকম চলে যাওয়াটা কী ভালো হল?

রাখাল ছেলেটা একখানা আগাম টুল মুখোমুখি পেতে দিয়ে চলে গেল। তাতে এসে বসলেন একজন রোগামতো বুড়োমানুষ। তার সাদা গোঁফ, গায়ে গেঞ্জি। গায়ের রং তামাটে। গলায় একটু চাপা কফের শব্দ হচ্ছে। মুখে একটু আপ্যায়নের হাসি।

বাবাজীবনের কথা খুব শুনেছি বিপিনের কাছে।

এসব কথার জবাবে কী বলতে হয়, তা বদরী জানে না। তার একবারই বিয়ে হয়েছিল। তাতে মেয়ে দেখার ঝামেলা ছিল না। মেয়ে দেখে রেখেছিল জেঠিমা। দিন ঠিক হলে সেইদিন খেত থেকে একটু সকাল সকাল ফিরে বরযাত্রীদের সঙ্গে রওনা হয়ে পড়েছিল। পাশের গাঁয়ের মেয়ে। ট্যাং ট্যাং বাজনা বাজিয়ে বিয়ে হয়ে। গিয়েছিল। ঝুটঝামেলা ছিল না। টানা পাঁচ বছর সংসার। এই বছর দেড়েক আগে বাসন্তীর কী যে রোগ হল ধরাই গেল না। পেটে ব্যথা বলে যখন তখন অজ্ঞান হয়ে যেত। ডাক্তার দেখে ওষুধও দিত। তারপর বাড়াবাড়ি হওয়ায় শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেল। তখন শেষ অবস্থা। ডাক্তার বলল, দেরি করে ফেলেছেন। অ্যাপেণ্ডিক্স বাস্ট করে গেছে। নইলে আজ এই ঘেমো দুপুরে এই রোদ ঠেঙিয়ে আসতে হত না।

বুড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এ-বংশের মেয়ে যে-সংসারে যায় সে-সংসারে সুখ একেবারে খুলে পড়ে, বুঝলে? স্বয়ং কাত্যায়নী এ-সংসারে এসেছিলেন তো। আমার প্রপিতামহের আমলে। বুঝলে? খুব রোখাচোখা পুরুষ ছিলেন, আবার দেবদ্বিজে ভক্তি ছিল খুব। তা আমার প্রপিতামহী এলেন, নামেও কাত্যায়নী, কাজেও কাত্যায়নী…

আজ্ঞে, সে-গল্প শুনেছি।

সবাই জানে কিনা। এ-বংশের খুব নাম। তা তোমার ক-টি ছেলেপুলে?

একটিই মেয়ে, তিন বছর বয়স।

ভালো হাতে পড়বে। সম্মা বলে ভাবতেও পারবে না কখনো।

খুব ঘামছে বদরী। আরও জনাকয় এসে আশপাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বেশ জাঁদরেল চেহারার মহিলা। লজ্জায় সংকোচে তাকাতে পারছিল না বদরী। এদিকে ভিড় হওয়াতে বাইরের হাওয়া আসতে পারছে না। গরম হচ্ছে।

জাঁদরেল মহিলাই হঠাৎ বললেন, ওরে খুবলো, বাতাস কর-না। কত দূর থেকে এসেছে। গরম হচ্ছে।

খুবলো একটা বছর পনেরো-ষোলোর ছেলে। পাখাটা নিয়ে টেনে বাতাস করতে লাগল। উৎসাহের চোটে দু-একবার ফটাস ফটাস করে পাখার চাঁটিও লাগিয়ে ফেলল মাথায়। মাথাটা একটু নামিয়ে নিল বদরী। এরা যে কার কে হয়, তা বুঝতে পারছে না সে। বোঝার অবশ্য বিশেষ দরকারও নেই। তার এখন লক্ষ্য হল রাত ন-টা কুড়ির শেষ ট্রেনটা ধরা। মেয়েটা বাপ ছাড়া থাকতে পারবে কি?

জরদগব অবস্থা। মেয়ে দেখতে এসেছে সে, উলটে তাকেই হাঁ করে দেখছে সবাই। মাথাই তুলতে পারছে না বদরীনাথ।

জাঁদরেল মহিলার হাতখানা দেখতে পাচ্ছিল বদরী। হাতে শাঁখা আছে, নোয়া আছে। সধবা। কার বউ কে জানে?

কদম দাস ব্যস্ত পায়ে এসে জাঁদরেল মহিলাকে বলল, তোমাদের হল? এরা সব রাতের ট্রেনে ফিরবে যে!

জাঁদরেল বলল, আহা, ফিরবে তো কী? দেরি আছে।

ছ-টা বেজে গেছে কিন্তু।

বদরীর হাতে ঘড়ি নেই। ছ-টা শুনে তার একটু চিন্তা হল। তিন মাইল রাস্তা অন্ধকারে হাঁটতে হবে। গাড়িটা পেলে হয়। পুলিনবিহারীর ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না তার। পুলিনের ফেরার ঠেকা নেই, তার আছে।

ভিড়ের ভেতর থেকে আর একটা শাঁখা-পরা কালো আর রোগা হাত এগিয়ে এল। হাতে একখানা কাঁসার রেকাব। তাতে মিষ্টি। সঙ্গে এক গ্লাস জল।

খাও বাবা।

খিদে আছে। রেকাবটা হাত বাড়িয়ে নিলও বদরী। কিন্তু এত জনার চোখের সামনে খায়-ই বা কী করে? এ তো বড়ো অসুবিধের মধ্যেই পড়া গেল।

সে বলল, পুলিনদা আসুক।

কদম ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, তাই তো! ভাইপোকে তো দেখছি না। গেল কোথা? ওরে ও পুটু, একটু রাস্তায় গিয়ে দেখ তো বাবা। বড়ো বে-আক্কেলে লোক। ডেকে আন।

ছোঁড়াটা দৌড়ে গেল।

বদরী বসে রইল চুপ করে। হাতপাখা চলছে, তবু ঘামছে। গামছাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এদের সামনে সেটা বের করা যাচ্ছে না। লজ্জা হচ্ছে।

পুলিন বেশিদূর যায়নি। এসে গেল। আগর ঠেলে ঢুকতে ঢুকতেই বলল, ওরে বাবা, উকিলের ওপর ছেড়ে দিলে, কী আর মামলা জেতা যায়? তদবির হল আসল কথা। উকিলের কী? দক্ষিণাটি নিয়ে কথা কয়ে ছেড়ে দেবে। পয়েন্ট দিতে হবে না?

ভিড় ঠেলে গন্ধমাদনের মতো বারান্দায় উঠে পুলিন বলল, এ, এ যে বাঁদর নাচের ভিড় লাগিয়েছিস তোরা। সর-সর, বাতাস আসতে দে।

তাকেও একটা রেকাব ধরানো হল। পুলিন খেতে খেতে বলল, এক্রামকে জোরালো কয়েকটা পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়েছি। খুব খুশি।

খাওয়া-দাওয়া মিটতেই কদম বলল, এবার যে একটু ঘুরে আসতে হচ্ছে। একটু গরম হবে ঘরে। কিন্তু বারান্দায় তো আর পাত্রী দেখানো যায় না।

পুলিন বলল, আহা, বাইরেই কী গরম কম নাকি? আয় রে বদরী। অত ভাবিস না, সাড়ে নটার ট্রেন ধরতে পারবি।

ঘরখানা একটু ঝুঝকো আঁধার। জানলা-দরজা বিশেষ বড়ো নয়। তা ছাড়া জানলার বাইরেই বড়ো বড়ো গাছ। একধারে বড়োচৌকি বেডকভার দিয়ে ঢাকা। চৌকির পায়ের ধারে বেঞ্চিতে মেলা ট্রাঙ্ক বাক্স থাক দিয়ে সাজানো।

একধারে একখানা কাঠের চেয়ার। অন্য ধারে কিছু ছিল না। রাখালছেলে পুটু বারান্দার চেয়ার দুটো তুলে এনে পাতল। ঘরে বেশ ভিড় জমে গেছে চারধারে। বসতেই খুবলো ফের পাখা চালাতে লাগল পেছন থেকে। পুলিন বলল, জোরে চালা বাবা। ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি। কই গো, আনো মেয়েকে। ওরে বাবা, গেরস্ত ঘরেই তো যাবে। বেশি সাজানো-গোছানোর দরকার নেই।

অন্দরমহলের দরজায় একটু ঠেলাঠেলি পড়ে গেল। মেয়ে আসছে। একটু কেমন ভয় ভয় করছিল বদরীর। মেয়ের চারখানা হাত বেরোবে না তো!

ভিড় ঠেলে যাকে আনা হচ্ছিল, তার দিকে বদরী চাইতেই পারল না। দেয়ালে একখানা পাখির বাঁধানো ছবি দেখছিল। হলুদ রঙের পাখি। কী পাখি কে জানে বাবা! সুতোর কাজ।

ওরে দেখ, দেখ। দেখে নে। অন্যদিকে চেয়ে আছিস যে?

বদরী মাথাটা প্রথমে নুইয়ে তারপর তুলল। সব মুখই কালো লেপাপোঁছা দেখাচ্ছিল। বাইরে এতক্ষণ বসেছিল বলে, চোখটাও ধাঁধানো। ঘরটাও অন্ধকার।

তবু তারমধ্যেই একজোড়া চোখে তার চোখ আটকাল। একজোড়া? নাকি তিনটে? মেয়ের কি তিনটে চোখ? যা-সব গল্প শুনেছে পুলিনের কাছে, হওয়া বিচিত্র কী?

তবে না। কপালে একটা লম্বাটে বড়োটিপ পরেছে বলে ওইরকম। মুখচোখের তেমন হদিশ পেল না। পেয়ে। হবেটাই বা কী? ফেরার পথে পুলিনকে শুধু একটা কথাই বলতে হবে, পছন্দ হয়নি।

হঠাৎ ঝাঁ করে, এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া কোথা থেকে যে এল কে বলবে? বদরীর মনটাই আজ নানা আলৌকিকের বাসা হয়ে আছে। সে একটু চমকে উঠল। এ কী রে বাবা, ঠাণ্ডা হাওয়া মারে কেন?

কে একজন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, ঝড় আসছে।

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা সিংহগর্জনের মতো মেঘ ডেকে উঠল। সেরেছে। এতক্ষণ লক্ষ করেনি বদরী। লক্ষ করবেই বা কীভাবে। যা ঘিরে ছিল সবাই মিলে।

পুলিনবিহারী পান চিবুচ্ছে। কোত্থেকে পেল কে জানে? তার খুড়োর বাড়ি পেতেই পারে। বলল, আসুক বাবা, আসতে দে। ঘামাচিগুলো মরে তাহলে।

দু-চারজন ছিটকে বেরিয়ে গেল। ঝড় এলে গেরস্তবাড়িতে কিছু সারা-তাড়া থাকে।

জাঁদরেল মহিলা বলল, ও কাতু, অমন মাথা নুইয়ে আছিস যে? মুখটা তোল। ভালো করে দেখুক। নইলে পছন্দ হবে কী করে?

নাঃ, মিঠে হাওয়াটা বন্ধ হল না। বরং বাড়ল। চোতের কালবোশেখি কত তাড়াতাড়ি আসে, তা বদরী আর পাঁচজন চাষির মতোই জানে। দম ফেলার সময়টুকু দেয় না। কড়াৎ কড়াৎ করে দুটো বাজ পড়ল, আর মুঠো মুঠো ধুলো উড়ে এল বাতাসে। ঝপঝপ জানলা-দরজা বন্ধ করছিল সবাই। একটা হুড়োহুড়ি।

পুলিন বলল, ওরে আসতে দে, আসতে দে। এ যে, সূচিভেদ্য করে ফেললি বাপ!

বাস্তবিকই, দরজা-জানলা বন্ধ হওয়ার পর, ঘরখানা জম্পেশ অন্ধকার হয়ে গেল হঠাৎ। বাইরে তুমুল গর্জন করে একটা বড়ো হাওয়ার ঝটকা, টিনের চালে মটমট শব্দ করে গেল। দু-নম্বর ঝটকায় দরজাটা উঠল মড়মড় করে। তারপর একেবারে হুহুংকারে কেঁপে উঠল চারদিক। বাইরে চেঁচামেচি, দৌড়োদৌড়ি, ঠাস ঠাস কপাট-জানলার শব্দ।

ঝড়ের গর্জনে ঘরের ভেতরকার কথাবার্তাও চাপা পড়ে গেল। কানে তালা ধরিয়ে বাজ পড়ল কোথাও। খুব কাছেই।

বদরীর অবশ্য ভয় নেই। প্রতিবারই খোলা মাঠে এই ঝড়ের সঙ্গে তার দু-চারবার দেখা হয়। ঘরে বসে সে শুধু শব্দটা শুনে তান্ডবটা কীরকম তা আন্দাজ করছিল। বেশি বাড়াবাড়ি হলে ট্রেনটা পিছলে যাবে।

আচমকাই ফের মনের ভুল? নাকি চোখের বিভ্রম! পরিষ্কার দেখল সে, একটা নয়, দুটো নয়, তিন তিনটে চোখ অন্ধকারে তিনটে পিদিমের শিখার মতো জ্বলছে। স্থির।

নাঃ, আজ তার মাথাটাই গেছে। কোথায় কী? ঘর যেমন কে তেমন অন্ধকার। তার মধ্যেই পুলিন টর্চ জ্বালাল। পাত্রীর চেয়ার ফাঁকা। উঠে গেছে কোন ফাঁকে। ঘরের ভিড়ও পাতলা হয়ে গেছে। সেই বুড়ো, জাঁদরেল মহিলা আর কদম দাস দাঁড়িয়ে।

পুলিন বলল, এ তো মুশকিল হল রে! যাবি কী করে?

পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি তো আয়ু নয়। থেমে যাবে। বদরী বলল।

সে যাবে। কিন্তু রাস্তাটার কী অবস্থা হবে জানিস?

একটু হাসল বদরী। সে হেলে চাষা, জলকাদা ভেঙে চাষ। এসব বাবু-ঘেঁষা কথা শুনলে মায়া হয়।

ঝড়ের তাড়স বাড়ল। বৃষ্টিটা এখনও শুরু হয়নি।

কদম দাস বলল, আমের বউলগুলো সব গেল।

পুলিন বলল, যায় যাক, তবু ঠাণ্ডা হোক। চাষবাস লাটে উঠতে বসেছিল।

তা বটে।

চালের টিন ধরে টানাটানি করছে ঝড় বাবাজীবন। ওপড়ায় আর কি!

কদম দাস উধ্বমুখে চেয়েছিল। চালের নীচে কাঠের পাটাতন। পাটাতনে রাজ্যের জিনিস।

এ-ঘরের না হলেও অন্য কোনো ঘরের টিন মড়াৎ করে উলটে গেল বটে। বিকট শব্দে সেটা আছড়ে পড়ল কোথাও। দুটো গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ হল পর পর।

সুপুরি আর জামগাছটা গেল। কদম দাস মুখ শুকনো করে বলল।

পুলিন টর্চটা নিবিয়ে বলল, অ বদরী।

বদরী বলল, ঘড়িটা দ্যাখো পুলিনদা।

ছ-টা বত্রিশ। টাইম দেখে হবেটা কী? ঝড় না থামলে তো নড়ার উপায় নেই।

এরপর খানিকক্ষণ কথাবার্তা বন্ধ। তারপর-ই বৃষ্টিটা এল। প্রথম চড়বড়ে কয়েকটা ফোঁটা। তারপর তুমুল। তারপর মুষলধারে।

বদরী চুপ করে বসে রইল। বাইরের ঝড়বৃষ্টি বা মেয়ের চিন্তা, শেষ ট্রেন কোনোটার কথাই ভাবছে না সে। ভাবছে, ভুল দেখল। কী দেখল সে? কাত্যায়নীর গপ্পো তো গপ্পোই। ওর কম অনেক রটনা হয়। তাহলে এরকমধারা হচ্ছে কেন?

বুড়ো মানুষটি হঠাৎ বলল, সুলক্ষণ।

পুলিন বলে, কীসের সুলক্ষণ?

এই কালবোশেখির কথাই বলছি।

অ।

কদম একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক, ফাঁড়াটা কেটেছে। গোয়ালঘরের একটা টিন গেছে। তা যাক।

বদরী বসে আছে চুপচাপ। তার যেন আর তাড়া নেই। গেলেও হয়, না গেলেও হয়।

তাড়াটা এল পুলিনের দিক থেকেই, ওরে ওঠ, সাতটা বাজে যে।

ঝড় থেমেছে। বৃষ্টিটাও ধরে এল। টিনের চালে এখন শুধু মিঠে রিমঝিম। বদরী উঠল।

কদম দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, চললেন তাহলে। কষ্ট পেয়ে গেলেন একটু। যেতেও কষ্ট আছে। জলকাদা। বদরী বলল, ও কিছু নয়।

দাওয়ায় পা দিয়েই বুঝল, সামনের অন্ধকারে মেলা লন্ডভন্ড কান্ড হয়ে আছে। গাছ পড়েছে, ডাল ভেঙেছে, মেলা চাল উড়ে গেছে। লোকজনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে খুব। আতঙ্কের গলা। টর্চ জ্বেলে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরোচ্ছে দুজন। চারদিকে বিশাল অন্ধকার মাঠ। ভেজা বাতাস বইছে। জলে-কাদায় পিছল পথ।

ও বদরী, কিছু বল।

কী বলব?

পছন্দ হল?

বদরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পছন্দ না হয়ে উপায় আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *