পরপুরুষ
করালী গরু খুঁজতে বেরিয়েছিল। আর তারক বেরিয়েছিল বউ খুঁজতে।
কালীপুরের হাটে সাঁঝের বেলায় দুজনে দেখা।
বাঁ-চোখে ছানি এসেছে, ভালো ঠাহর হয় না। তবু তারককে চিনতে পেরে করালী বলল , তারক নাকি?
আর বলো কেন দাদা। মাগি সকালে থেকে হাওয়া।
ঝগড়া করেছিস?
সে আর কোনদিন না হচ্ছে! আজ আবার বাগান থেকে মস্ত মানকচুটা তুলে নিয়ে বেরিয়েছে। আমি ভাবলুম কচু বেচতে যদি হাটে এসে থাকে।
বাঁধা বউ, ঠিক ফিরে যাবে। আমার তো তা নয়। গরু বলে কথা, অবোলা জীব। হাটে যদি হাতবদল হয় তো মস্ত লোকসান।
গো–হাটা ঘুরে দেখেছ?
তা আর দেখিনি! পেলুম না।
ভেবোনা। গরুও ফিরবে। চল, পরানের দোকানে বসি।
পরাণ তাড়ির কলসি সাজিয়ে বসে, একখানা বারকোশে ভাঁড় আর কাঁচের গেলাস সাজানো। আশেপাশে খদ্দেররা সব উবু হয়ে বসে ঢকঢক গিলছে। দুজনে সেখানে সেঁটে গেল।
কালীপুরের হাট একখানা হাটের মতো হাটই বটে। দশটা গাঁ যেন ভেঙে পড়ে। জিনিস যেমন সরেস দামও মোলায়েম। এই সন্ধের পরও হ্যাজাক, কারবাইড, টেমি জ্বেলে বিকিকিনি চলছে রমরম করে। হাটেবাজারে এলে মনটা ভালো থাকে তারকের। পেটে তাড়ি টাড়ি গেলে তো আরও তর হয়ে যায়। তবে কিনা বউটা সকালবেলায় পালিয়ে যাওয়ায় আজ সারাদিন হরিমটর গেছে। রান্নাটা আসে না তারকের। ছেলেবেলায় এই কালীপুরের হাটেই এক জ্যোতিষী তার মাকে বলেছিল, বাপু, তোমার ছেলের কিন্তু অগ্নিভয় আছে। আগুন থেকে সাবধানে রেখো। তাই মা তাকে গা ছুঁইয়ে বাক্যি নিয়েছিল, আগুনের কাছে যাবে না। মায়ের কথা ভাবতেই চোখটা জ্বালা করল। মা মরে গিয়ে ইস্তক কিছু ফাঁকা হয়ে গেছে যেন। দুপুরে গড়াননা বেলায় মুকুন্দর দোকানে চারটি মুড়ি–বাতাসা চিবিয়েছিল। এখন খিদেটা চাগাড় মারছে।
করালী যেন মনের কথা টের পেয়েই বলল , নন্দকিশোরের মোচার চপ খাবি?
খুব খাব।
পয়সা দিচ্ছি, যা নিয়ে আয়।
নন্দকিশোরের মোচার চপের খুব নামডাক। সারা দিনে দোকানে যেন পাকা কাঁঠালে মাছির মতো ভিড়। এখন সন্ধেবেলায় ভিড় একটু পাতলা হয়েছে। সারা দিনে না হোক কয়েক হাজার টাকার মাল বিক্রি করে নন্দকিশোরের হ্যাদানো চেহারা। চারটে কর্মচারীও নেতিয়ে পড়েছে যেন।
নন্দকিশোর মাথা নেড়ে বলল , মোচা কখন ফুরিয়ে গেছে। ফুলুরি হবে। তবে গরম নয়।
আহা একটু গরম করে দিলেই তো হয়।
উনুন ঝিমিয়ে পড়েছে বাপু। এখন আঁচ তুলতে গেলে কয়লা দিতে হবে। শেষ হাটে আর আঁচ তুলে লোকসান দেব নাকি দু-টাকার ফুলুরির জন্য?
তা বটে। তারক এধার-ওধার খুঁজে দেখল। শেষে মুকুন্দ দলুইয়ের দোকানে গরম চপ পেয়ে নিয়ে এল।
খালি পেটে ঢুকে চপ যেন নৃত্য করতে লাগল। তার ওপর তাড়ি গিয়ে যেন গান ধরে ফেলল। ভিতরে যখন নাচগান চলছে তখন তারক বলল , কালীপুরের হাট বড় ভালো জায়গা, কী বলো কারালীদা!
জিবে একটা মারাত্মক কাঁচালঙ্কার ঘষটানি খেয়ে শিসোচ্ছিল করালী। এক গাল তাড়িতে জলন্ত জিবটা খানিক ভিজিয়ে রেখে ঢোঁক গিলে বলল , সেই কোমরে ঘুনসি–পরা বয়সে বাপের হাত ধরে আসতুম, তখন একরকম ছিল। এখন অন্যরকম।
তারকের বাঁ-পাশে একজন দাঁত উঁচু লোক তখন থেকে দুখানা সস্তা গন্ধ সাবান বাঁ-হাতে ধরে বসে আছে। ডান হাতে গেলাসে চুমুক দিচ্ছে আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাবান দু-খানা দেখছে বারবার।
পেটের মধ্যে নৃত্যগীত চলছে, মেজাজটা একটু ঢিলে হয়েছে তারকের। লোকটার দিকে চেয়ে বলল , সাবান বুঝি বউয়ের জন্য?
লোকটা উদাস হয়ে বলল , বউ কোথা? ঘাড়ের ওপর দু-দুটো ধুমসি বোন, মা-বাপ। মুকুন্দ বিশ্বেস সাফ বলে দিয়েছে, আগে পরিবার থেকে আলগা হও, তারপর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব।
তা আলগা হতে বাধা কী? হলেই হয়। আজকাল সবাই হচ্ছে।
ভয়ও আছে। মুকুন্দ বিশ্বেসের ছেলের সঙ্গে তার ঝগড়া। মেয়ের বিয়ে দিয়েই মুকুন্দ আর তার বউ আমার ঘাড়ে চাপবার মতলব করছে।
ও বাবা! সেও তো গন্ধমাদন।
তাই আর বিয়েটা হয়ে উঠছেনা।
করো কী?
ভ্যানরিকশা চালাই। নয়াপুর থেকে কেশব হালদারের মাল নিয়ে এসেছি। হাটের পর ফের মাল নিয়ে ফেরা। আর সাবানের কথা বলছ! সে কি আর শখ করে কেনা! লটারিতে পেলুম।
বাঃ। লটারি মেরেছ, এ তো সুখের কথা।
ছাই। ওই যে লোহার রিং ছুঁড়ে– ছুঁড়ে জিনিসের ওপর ফেলতে হয়। রিং-এর মধ্যিখানে যা পড়বে তা পাবে। ফি বার দু-টাকা করে। তিরিশখানা টাকা গচ্চা গেল। তার মধ্যে একবার এই সাবান দু-খানা উঠল। যাচাই করে দেখেছি, এ সাবান চার টাকা পঞ্চাশ পয়সায় বিকোয়।
লটারি মানেই তো তাইরে ভাই। তুমিই যদি সব জিতে যাও তাহলে লটারিওয়ালার থাকবে কী?
দাঁত–উঁচু লোকটা এক চুমুক খেয়ে বলল , সবারই সব হয়, শুধু এই ভ্যানগাড়িওয়ালারই কিছু হয় না, বুঝলে! মা একখানা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছিল, ট্যাঁকে আছে এখনও। সেসব আর নেওয়া হবে না। ক’টা বাজে বলল তো!
তারকের হাতে ঘড়ি নেই। আন্দাজে বলল , তা ধরো সাতটা সাড়ে-সাতটা হবে।
উরেব্বাস রে! কেশব হালদার মাল গোটাতে লেগেছে। যাই।
করালী শিসোচ্ছিল।
উঠবে নাকি গোকরালীদা।
করালী একটা হাই তুলে বলল , গরুটার কথাই ভাবছিলুম।
কী ভাবলে?
বাঁজা গরু। পুষতে খরচ আবার বেচতেও মন চায় না। কিনবেই বা কে বল!
তাই বলো, বাঁজা গরু। তা গেছে আপদই গেছে। ভাবনার কী?
আছে রে আছে। আমার ছোট মেয়ে পদীর বড় ভাব গরুটার সঙ্গে।
পাল খাইয়েছ?
কিছু বাকি রাখিনি। আর দুটো গরু বিয়োয়, দুধও দেয়। এটাই দেয় না।
এত বড় হাটে বউ খোঁজা মানে খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার শামিল। এসে থাকলেও এত রাত অবধি তো আর হাটের মাটি কামড়ে সে নেই। বউ যদি রাতে না ফেরে তাহলে রাতেও হরিমটর। তারক ভাবছিল আরও কয়েকখানা চপ সাঁটিয়ে নেবে কি না। তারপর এক ঘটি জল খেয়ে নিলেই হল। কিন্তু পয়সার নেশাটা চৌপাট হয়ে গেলে মুশকিল।
২.
পুরুষমানুষ আর মেয়েমানুষের সম্পর্ক নাকি চিড়েন। আ মোলো। সম্পর্কের আবার চিড়েতন, হরতন, ইস্কাপন, রুইতন হয় নাকি? হলেও বাপু, যমুনা কি সেসব বোঝে! তবে কিনা নরেনবাবু ভ ভদ্রলোক, মেলা জানেশোনে। নরেনবাবুর কথা তো আর ফ্যালনা নয়।
একদিন জিগ্যেস করেছিল, চিড়েতনটা আবার কী, বলো তো বাবু?
নরেনবাবু হেসেটেসে বলল , এই ধর তুই আর আমি। আমিও কারও কেউ নই, তুইও কারও কেউ নোস। যেমন জলের মাছ, কে কার মা-বাপ জানে ওরা? তবু তো ডিম ছাড়ছে, বাচ্চা বিয়োচ্ছে। ব্যাপারটা ওরকমই আর কি। চিরন্তন মানে হচ্ছে আদি সম্পর্ক বুঝলি না?
যমুনা বুঝি–বুঝি করেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না। তবে এটা ঠাহর হল যে, ওই চিড়েতনের মধ্যেই প্যাঁচটা আছে।
প্যাঁচ বুঝতে যমুনার কেন–কোনও মেয়েমানুষেরই দেরি হয় না। যমুনার এই সতেরো বছর বয়স হল। এক বছর হল পুরুষমানুষ ঘাঁটছে। পুরুষটা হল তার বর তারক। একদিন মিটমিট করে হেসে বলেছিল, বাবুর বাড়িতে কাজে যাস, তা কখনও পিট–ঠিট চুলকে দিতে বললে দিস। নরেনবাবুর মেলা পয়সা। পাঁচ বুঝতে যমুনার দেরি হয় না।
আর একদিন বলল , আহা, বাবুর বউটা বোবা, পীরিতের কথাটথা কইতে পারে না। পুরুষমানুষ একটু ওসব শুনতে–টুনতে চায়।
প্যাঁচ। যমুনা বুঝতে পারে। চিড়েতনটা বুঝতেও তার অসুবিধে হয়নি।
নরেনবাবুর বউ মলয়া বোবা–কালা। তবে সে পয়সাওলা নিতাই রায়ের মেয়ে। নিতাই রায় পঞ্চাশ হাজার টাকায় নরেনবাবুকে কিনেছে। এ কথা সবাই জানে। নগদ ছাড়াও বাড়িঘর ঠিকঠাক করে দেওয়া, মেয়ের নামে জমিজমা লিখে দেওয়া তো আছেই। নরেনবাবুকে তাই আর কিছু করতে হয় না। শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটছিল। তবে বেকার জামাই বলে লোকে টিটকিরি না দেয় সেজন্য ইদানীং নয়নপুরের বাজারে একখানা ওষুধের দোকানও করে দিয়েছে। নিতাই রায়। গাঁয়ের দোকান, সেখানে ওষুধ ছাড়াও নানা জিনিস রাখতে হয়। তা নরেন হল বাবু মানুষ। সকালের দিকে শ্রীপতি নামে এক কর্মচারী দোকান দেখে, সন্ধেবেলা নরেনবাবু গিয়ে। ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে আসে। সেখানে কিছু ইয়ারবন্ধুও জোটে এসে। শোনা যাচ্ছে, নরেনবাবুর গদাইলস্করি চালে সুবিধে হয়েছে শ্রীপতির। সে দু-হাতে লুটে নিচ্ছে। তারকের তাই ইচ্ছে, শ্রীপতিকে সরিয়ে চাকরিটা সে বাগায়।
সোজাসাপটা ব্যাপার। এতে কোনও প্যাঁচ নেই। মানুষ কত কী চায়, আর চাইবেই তো! নেই বলেই চায়। কিন্তু চাইলেই তো হল না। দিচ্ছে কে? আর তখনই প্যাঁচটা লাগে।
মলয়ার দুটো মেয়ে। একটা সাড়ে তিন বছরের, একটা দু-বছরের। তারা কেউ বোবা–কালা নয়। বড়টা পাড়ার খেলুড়িদের সঙ্গে খেলতে শিখেছে, আর ছোেটটা সারা বাড়িতে গুটগুট করে হেঁটে বেড়ায়। এ দুটো মেয়ে হচ্ছে মলয়ার জান। যখন আদর করে তখন খ্যাপাটে হয়ে যায়। আর সারা দিনে মাঝে-মাঝেই মেয়েদের আঁ–আঁ করে ডাকে। মেয়ে দুটো মায়ের ডাক ঠিক বুঝতে পেরে ছুটে আসে। মেয়ে দুটোর দেখাশোনা করত উড়নচণ্ডী পটলী। ছোট মেয়েটা তখন সবে হামা দেয়। পটলী তাকে বারান্দায় ছেড়ে দিয়ে উঠোনে দিব্যি এক্কা–দোক্কা খেলছিল। মেয়েটা গড়িয়ে পড়ে হাঁ করে এমন টান ধরল যে দম বুঝি ফিরে পায় না। মাথা ফুলে ঢোল। শোনার কথাই নয় মলয়ার। তবু মায়ের মন বলে কথা। কোথা থেকে পাখির মতো উড়ে এসে মেয়ে বুকে তুলে নিল। তারপর সে কী তার ভয়ঙ্কর চোখ আর ভৈরবী মূর্তি। পটলী না পালালে বোধহয় খুনই হয়ে যেত মলয়ার হাতে। বোবাদের রাগ বোধহয় বেশিই হয়। কথা দিয়ে দুরমুশ করতে পারে না, গালাগাল দিয়ে বুক হালকা করতে পারে না, তাই ভিতরে ভিতরে পোষা রাগ গুমরে ওঠে।
পটলীর জায়গায় এখন যমুনা। মেয়েদের দেখে শোনে, ধান শুকোয়, উেঁকি কোটে, গেরস্ত বাড়িতে তো কাজের আকাল নেই। আবার ছুটে গিয়ে ঘরের অকালকুষ্মাণ্ড ওই তারকের জন্যও বেঁধে রেখে আসতে হয়। তা বলে খারাপ ছিল না যমুনা। খাটনিকে তো তার ভয় নেই, চিরকাল গতরে খেটেই বড়টি হল। কিন্তু ভয়টা অন্য জায়গায়। সে হল ওই মলয়া। বোবা কালা হলে কী হয়, যমুনার বিশ্বাস, মলয়া অনেক কিছু টের পায়। শুনতে না পেলেও টের পায়। মাঝে-মাঝে কেমন যেন বড়-বড় চোখ করে তার দিকে অপলক চেয়ে থাকে। একটু ভয়-ভয় করে যমুনার।
নরেনবাবু ধীরে-ধীরে এগোচ্ছে। একদিন বলল , নারী আর নদীতে কোনও তফাত নেই, বুঝলি মেয়েছেলে হল বওতা জল, ডুব দিয়ে উঠে পড়ো। নদী কি তাতে অশুদ্ধ হল? এই যে গঙ্গায় কত পাপী–তাপী ডুব দেয়, গঙ্গা কি তাতে ময়লা হয় রে!
আগে যমুনা শুধু শুনত, কিছু বলত না। আজকাল বলে। সে ফস করে বলে ফেলল, তোমার কি কোনও কাজ নেই বাবু? সকালের দিকটায় দোকানে গিয়ে বসলেও তো পারো। শ্রীপতি তো শুনি দোকান ফাঁক করে দিচ্ছে।
নরেনবাবু একটা ফুঃ শব্দ করে বলল , দিক না, তাতে আমার কী? দোকান শ্বশুরের, শ্রীপতিও তার লোক। সে বুঝবে। আমার ওতে মাথা গলানোর কী? আমি খাব–দাব ফুর্তি করব। বোবা কালা বিয়ে করেছি কি মাগনা?
শ্বশুর কি আর চিরকাল থাকবে? দোকান তো তোমারই হবে একদিন।
আমার নয় রে, আমার নয়। দোকান ওই বোবা–কালার নামে। ও আমি চাইও না। দু টাকার জিনিস চার টাকায় বিক্রি করে পয়সা কামানোর ধাতই আমার নয়। আমাকে কি তাই বুঝলি?
আর-একদিন আরও একটু এগোল নরেনবাবু। কথা নয়, একখানা তাঁতের শাড়ি দিয়ে বলল , কাল সকালে পরে আসিস। তোকে মানাবে। এসে একটু ঘোরাফেরা করিস চোখের সামনে।
খুশি হল তারকও। বলল , বাঃ-বাঃ, এই তো কাজ এগোচ্ছে।
তার মানে?
নরেনটা তো ভিতুর ডিম। ভাবছিলুম আর বুঝি এগোবে না।
কী বলতে চাও তুমি বলো তো!
দোষ ধরিসনি। একটু মাখামাখি করলে যদি কাজ হয় তো ভালোই।
তাই যদি হবে তাহলে তো বাজারে গিয়ে নাম লেখালেই পারতুম।
চটিস কেন? পেটের দায় বলে কথা। শ্রীপতি শালা তো শুনছি, কৈলাসপুরে চার কাটা জমি কিনে ফেলেছে।
তাতে তোমার কী?
জ্বলুনি হয়, বুঝলি, বুকের মাঝখানটায় বড্ড জ্বলুনি হয়। ঘরামির কাজ করে করে হাতে কড়া পড়ে গেল, সুখের মুখ দেখলাম না। প্রথমটায় বাধোবাধো ঠেকলেও পরে দেখবি ব্যাপারটা কিছুই না। আমিও যা, ওই নরেনবাবুও তা।
তোমার মুখে পোকা পড়বে।
ওরে শোন, ও চাকরির মতো সুখের চাকরি নেই। মালিক চোখ বুজে থাকে, হিসেব চায় না। এমনটা আর কোথায় পাবি?
এই টানা পোড়েনের মধ্যে দিন কাটছিল যমুনার। একদিন বিকেলে ভিতরের বারান্দায় বসে মলয়ার চুল বাঁধছিল যমুনা। বেশ চুল মেয়েটার। দেখতেও খারাপ নয় কিছু। মায়াও হয়। খোঁপায়। কাঁটা গুঁজে হাত–আয়নাটা মলয়ার হাতে যখন ধরিয়ে দিল তখন হঠাৎ আয়নাটা ফেলে ঘুরে বসল মলয়া। সেই বড়-বড় চোখ। দু-হাতের হঠাৎ যমুনার দু-কাঁধ খিমচে ধরে ঝাঁকায় আর বলে, আঁ আঁ–আঁ–আঁ–আঁ…
ভয়ে আত্মারাম, ডানা ঝাঁপটাচ্ছিল বুকে। কী জোর মেয়েটার গায়ে!
কী করছ বউদি, কী করছ? আমি তো কিছু করিনি।
মলয়া ঝাঁকানি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল তার চোখের দিকে। তারপর সাপে ব্যাং ধরলে ব্যাং যেমন শব্দ করে তেমনি এক অবোধ শব্দ বেরোতে লাগল তার গলা থেকে। আর দু চোখে জলের ধারা।
নরেনবাবু পরদিনই বলল , শহরে বেড়াতে যাবি দু-দিনের জন্য? শুধু তুই আর আমি। একটু ফুর্তি করে আসি চল।
ফুঁসে উঠতে পারল না যমুনা। তার কি সেই জোর আছে? জোর হল স্বামীর জোর। তার তো সেখানেই লবডঙ্কা। যমুনা সুতরাং অন্য পন্থা ধরে বলল , তোমার শ্বশুরকে যদি বলে দিই তাহলে কী হয়?
ও বাবা! এ যে আমার শ্বশুর দেখায়! কেন রে, শ্বশুরের কাছে কি টিকিখানাও বাঁধা রেখেছি? নিতাই রায়ই বা কম কীসে? পটলডাঙায় তার বসন্তকুমারীর ঘরে যাতায়াত কে না জানে? কী করবে সে আমার? তুই বড্ড বোকা মেয়েছেলে তো!
শোনো বাবু, বউদি কিন্তু সব টের পায়।
সোহাগের কথা আর বলিসনি। টের পায় তো পায়। কী করবে সে?
যমুনার ভাবনা হল। নরেনবাবুর সাহস বড়ই বেড়েছে, এবার তার বিপদ।
শুনে খ্যাঁক করে উঠল তারক, বিপদ আবার কী? তোকে তো কতবার বলেছি, ওতে কিছু হয়। তোর আমিও রইলুম। কখনও কলঙ্ক রটিয়ে তোকে বিপদে ফেলব না। নরেনবাবুর সঙ্গে আমার পষ্টাপষ্টি কথা হয়ে গেছে।
কী কথা?
সামনের মাসে চাকরিতে জয়েন দেব।
নরেনবাবু অন্য মেয়েমানুষ দেখে নেয় না কেন?
যার যাকে পছন্দ। তোকে চোখে লেগেছে। ও বড় সর্বনেশে ব্যাপার। যাকে চোখে লাগে তার জন্য পুরুষমানুষ সব করতে পারে।
আমি কালই বাপের বাড়ি যাচ্ছি। লাথি–ঝাঁটা খাই, শুকিয়ে মরি, তাও ভালো। তবু নষ্ট হব না।
বিপদে ফেললি দেখছি। বলি, আমার মতো একটা মনিষ্যিকে যদি তোর সব দিয়ে থাকতে পারিস তবে নরেনবাবু দোষটা কী করল? সে দেখতে আমার চেয়ে ঢের ভালো। ফরসা চোখমুখে শ্রী–ছাঁদ আছে। আমি তার পাশে কী বল তো!
তুমি আমার স্বামী।
ওই তো তোর দোষ। স্বামীর মতো স্বামী হলেও না হয় বুঝতুম।
তুমি খারাপ লোক নও। তোমাকে লোভে পেয়েছে।
তোর মাথাটাই বিগড়েছে। আমি খারাপ নই? খুব খারাপ। কেউ আজ অবধি আমাকে ভালো। বলেনি।
আমি বলছি। ভালো করে ভেবে দ্যাখো।
নরেনবাবু তোকে চায়। এমনকী এ কথাও বলেছে, সে তোকে বিয়ে করতেও রাজি।
বিয়ে! বলে এমন অবাক হয়ে তাকাল যমুনা যেন ভূত দেখছে।
ভয় পাসনি। তোর একটু ধর্মভয় আছে আমি জানি। আমি সাফ বলে দিয়েছি, বিয়ে–টিয়ে নয় মশাই। আম বউ ছাড়ছি না। দু-দিন চার-দিন বড় জোর।
তোমার একটু বাধল না বলতে? নরকে যাবে যে!
সে দেরি আছে। নরকে মেলা লোকই যাবে। কলিকালে কি নরকযাত্রীর অভাব রে! আগে এ জন্মে কিছু জুত করে নিই। নরক তো আছেই কপালে।
যমুনা রাগ করে বলল , দেখ, আমি সাবিত্রী বেউলো নই, তবে যা বুঝেছি তাই বুঝেছি। আমাকে দিয়ে ওকাজ হবে না।
তুই বোকাও বটে রে! নরেনবাবুর কী মেয়েছেলের অভাব? তোর কত বড় ভাগ্য যে এত মেয়েছেলে থাকতে তুই–ই ও শালার চোখে পড়েছিস। আমি বলি, সময় থাকতে এসব ভাঙিয়ে নে। রূপ–যৌবন সব ভাঙিয়ে মা লক্ষ্মীকে ঘরে এনে তোল আগে।
মা–লক্ষ্মী এমন ঘরে লাথি মারতেও আসবে না। মনটা ঠিক করে ফেলেছিল যমুনা। এখানে থাকলে যে তার আর পরকাল বলে কিছু থাকবে তাও বুঝেছে। কিন্তু যায় কোথা? বাপের বাড়ি বলতে তুলসীপোঁতা গাঁয়ে একখানা ঝুপড়ি। এণ্ডি–গেণ্ডি অনেক ভাইবোনের সংসার। তার বাবা দাদ আর হাজার মলম বিক্রি করে, মা বেচে ঘুঁটে।
৩.
বাঁশঝাড়ের মধ্যে একটা তোলপাড় হচ্ছিল। ভোঁস–ভোঁস শ্বাসের শব্দ, সেইসঙ্গে কে যেন আঁ দাঁড় পাঁ দাঁড় ভাঙচে।
তারক ভয় খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, ও কী গো?
করালী চাপা গলায় বলল , চুপ!
কান খাড়া করে শুনছিল করালী। বাঁশবনের মধ্যে দুটো চোখ চকচক করে উঠল হঠাৎ।
আহ্লাদের গলায় করালী বলল , ওরে পাজি মাগি, এখেনে সেঁধিয়ে রয়েছিস! আয় আয় বলছি শিগগির।
বাঁশবনে প্রলয়ের শব্দ তুলে আর ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলতে–ফেলতে গরুটা বেরিয়ে এল। গরু না হাতি বোঝা ভার। বিশাল চেহারা।
উরেব্বাস রে! এই তোমার গোরু?
গরুটা করালীর গা–ঘেঁষে দাঁড়াল, তার গলা এক হাতে জড়িয়ে ধরে করালী বলল , আহা, বাঁজা বলেই ওর মনে সুখ নেই কিনা। মনের দুঃখে মাঝে-মাঝে বনবাসে যায়। ফিরেও আসে। চ’ চ’ পা চালিয়ে চ’। মেয়েটা এতক্ষণে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে।
তারক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল , তুমি কপালওলা মানুষ, গরুটা দিব্যি পেয়ে গেলে। এখন আমার বউ কোথা পাই বলতে পারো? আমার কপাল তো আর তোমার মতো নয়।
পাবি–পাবি। বাঁধা বউ যাবে কোথায়? মারধর করিস নাকি?
আরে না। সেসব নয়, নরম–সরম আছে, গায়ে হাত তোলার দরকার হয় না। তবে গোঁ আছে। খুব। যেটা না বলবে সেটাকে হ্যাঁ করায় কার সাধ্যি।
রথতলার কাছ বরাবর করালী বাঁয়ের রাস্তা ধরল, তারক ডাইনে।
সামনেই মলয়া ফার্মেসি। আলো জ্বলছে। দিব্যি পাকা ঘর। দোকানও বড়সড়োই। আজ নরেনবাবু নেই। শ্রীপতি একা বসে মাছি তাড়াচ্ছে।
তাকে দেখে শ্রীপতি বিশেষ খুশি হল না। হওয়ার কথাও নয়। মুখটা আঁশটে করে বলল , বাবু নেই।
আসেনি আজ?
না। সকাল থেকেই পাত্তা নেই। বাড়ি থেকেও লোক এসে খুঁজে গেছে।
অ্যাঁ। তবে তো—
শ্রীপতি চেয়ে আছে। বুকটা ধকধক করছিল তারকের। তাড়ির নেশাটা কেটে যাওয়ার উপক্রম।
গেল কোথায় নরেনবাবু?
শ্রীপতি ঠোঁট উলটে বলল , তা কে জানে। বলে যায়নি কিছু। বাড়ির লোকও খুঁজছে।
দুইয়ে–দুইয়ে তবে কি চারই হল? যমুনা আর নরেনবাবু যদি একসঙ্গেই হাওয়া হয়ে থাকে তো শ্রীপতির জায়গায় সামনের মাসে সে-ই জয়েন দেবে।
তারক বসে গেল।
দোকানে বিক্রিবাটা কেমন হে?
বিক্রি কোথায়? ওষুধের স্টকই নেই।
নেই কেন?
ওষুধ কি মাগনা আসবে? টাকাটা দেবে কে?
কেন, নিতাইবাবু দেবে।
দিচ্ছে কোথায়? অন্য সব কারবারে টাকা আটকে আছে। দোকান চলছে, নমোনমো করে।
ইয়ে–তা উপরি–টুপরি কেমন?
উপরি! সেটা আবার কী? মাসমাইনেরই দেখা নেই তো উপরি।
তারক মৃদু-মৃদু হাসছিল। শ্রীপতি তো আর পাঁঠা নয় যে তার কাছে কবুল করবে।
নরেনবাবু বাড়িতে কিছু বলে যায়নি?
তা কে জানে। ঠসা–বোবা বউ, তাকে বলাও যা না-বলাও তা।
তারক উঠে পড়ল। নাঃ, এতদিনে যমুনার তাহলে সুমতি হয়েছে। নরেনবাবুর সঙ্গেই যদি গিয়ে থাকে–গেছেই–তাহলে তোমার দিয়া কেল্লা। ওষুধের দোকান মানে কাঁচা পয়সা।
ঘরে ফিরে টেমি জ্বেলে বসে-বসে খানিক ভাবল তারক। খবর নিয়েছে, শ্রীপতির মাইনে মাসে তিনশো টাকা। কম কীসের? বসা চাকরি। তার ওপর উপরি তো আছেই।
মনটা বেশ ভালোই লাগছে তারকের। সে টেমি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। কত রাত হবে কে জানে, হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙল তারকের। কোথা থেকে চেঁচামেচিটা আসছে তা প্রথমে ঠাহর হল না। কারও বিপদ আপদ হল নাকি?
দরজা খুলে বেরিয়ে এল তারক। মনে হল পুরো গাঁ–ই চেঁচাচ্ছে। মেয়েপুরুষের গলা শোনা যাচ্ছে।
ডাকাত! ডাকাত!
তারক লাফ দিয়ে উঠোনে নামল। তারপর নরেনবাবুর বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। গণ্ডগোলটা ওখানেই হচ্ছে যেন!
নরেনবাবুদের পুরোনো ভাঙা বাড়ি সারিয়ে দালান তুলে দিয়েছে নিতাই রায়। বেশ বড়সড়ো বাড়ি। উঠোনে ধানের মরাই, টিপকল, পিছনে গোয়াল, পেঁকিঘর। বাড়িটা হাতের তেলোর মতোই চেনে তারক।
চেঁচালেও পাড়ার লোক কেউ বেরোয়নি ভয়ে। বাইরের উঠোনে মশাল হাতে কালিঝুলি মাখা একটা লোক দাঁড়িয়ে। হাতে একখানা বড়সড় ছোরা চকচক করছে। আর ভাঙা দরজা দিয়ে আর দুজন টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনছে নরেনবাবুর বোবা–কালা বউটাকে। বউটার শাড়ি খুলে লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে ঘর অবধি। তার মুখে কথা নেই, কেবল আঁ–আঁ চিৎকার।
তারক চেঁচিয়ে বলল , ডাকাতি করছ করো, বউটাকে ওরকম করছ কেন হে? অ্যাাঁ, ওকে ছেড়ে দাও। বোবা–কালা মানুষ।
উঠোনের ছোরা হাতে লোকটা একবার তার দিকে ফিরে দেখে একটা হাঁক মারল, ভাগ শালা শুয়োরের বাচ্চা। পেট ফাঁসিয়ে দেব…
তারক থমকে গেল। হচ্ছেটা কী? ডাকাতি করবি কর। কিন্তু মেয়েছেলেটাকে টেনে বের করছিস কেন? অবোলা মানুষ।
হঠাৎ ঝাঁক করে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল তারকের। এ শালারা ভাড়াটে খুনে নয় তো?
চুলের মুঠি ধরে হেঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে মলয়াকে। একজন খেটে মোটা একটা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে অমানুষিক জোরে। হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার কথা।
আঁ-আঁ-আঁ-আঁ চিৎকারটা চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে সাইরেনের মতো। সেই চিৎকারে মড়া মানুষও শিউরে উঠবে। মশালের আলোয় তারক দেখতে পেল, মলয়ার মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে।
উঠোনের লোকটা ছোরা হাতে এগিয়ে যাচ্ছিল মলয়ার দিকে।
তারক জন্মে মারদাঙ্গা করেনি। সে ভিতু মানুষ। কিন্তু আজ মাথাটা যেন বড্ড তেতে গেল হঠাৎ। চারদিকে ঢেলা আর ইটের অভাব নেই। পুরোনো বাড়ির ভাঙা টুকরো চারদিকে ছড়ানো। তারক একখান ইটের টুকরো তুলে খানিক দৌড় দিয়ে টিপ করে মারল। একটা, দুটো, তিনটে…
মার শালাকে! মার শালাকে…বলে চেঁচাচ্ছিল তারক।
তার পয়লা ইটেই ছোরাওলা মাথা চেপে বসে পড়েছিল। আর ইটগুলো লাগল কি না কে জানে, তবে তোকগুলো ভড়কে ছিটকে গেল এদিক-ওদিক। তারক লাফ দিয়ে গিয়ে উঠোনে ঢুকল।
সামনে একটা ঘেঁটে লাঠি পড়েছিল। সেইটে তুলে নিল সে। তারপর বসা ডাকাতটা উঠতে যেতেই পাগলের মতো মারতে লাগল তাকে।
কে একজন চেঁচাল, পালা–পালা…লোক আসছে…
ডাকাতের জান বলে কথা। অত পিটুনি খেয়েও লোকটা হঠাৎ উঠে প্রাণভয়ে দৌড় লাগাল। কে কোথায় গেল কে জানে। তবে মেয়েটা বেঁচে গেল এ যাত্রা।
গাঁয়ের লোক বোধহয় তারকের সাহস দেখেই বেরিয়ে এল এতক্ষণে। লহমায় লাঠিসোঁটাধারী পুরুষ আর মেয়েছেলেতে উঠোন ভরতি। মেয়েদের কারও হাতে বঁটি অবধি। চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়।
মলয়াকে ধরে তুলতে হল। বোবা মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে, চোখে ভূতুড়ে দৃষ্টি। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। তারক পাঁজাকোলে করে তাকে ঘরে এনে শোওয়াল বিছানায়। মেয়ে দুটো চেঁচিয়ে কাঁদছে।
নরেনবাবু কোথায়? নরেনবাবু কি খাটের নীচে নাকি? নাকি পালিয়ে গেছেন? এসব নানা জন জিগ্যেস করতে লাগল।
একজন মুনিশ এগিয়ে এসে বলল , বাবু আজ সাতসকালেই একটু শহরে গেছেন। আজ ফিরবেন না।
তারকের গা জ্বালা করছিল হঠাৎ। নরেনশালাই মলয়াকে খুন করতে লোক লাগায়নি তো। শালার যে যমুনার ওপর দারুণ লোভ। তারকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব অবধি দিয়ে রেখেছে।
মাথাটা বড্ড গরম হচ্ছিল তারকের। সবাই এসে পিঠ চাপড়ে যত তার বীরত্বের প্রশংসা করছিল আর ততই তারকের গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল রাগে। ব্যাপারটা তার কাছে। পরিষ্কার। ডাকাতি নয়, ডাকাতরা অকারণে খুন করে না। এরা খুন করতেই এসেছিল।
তপন হালদারের ছেলে মিতুল মোটরবাইকে করে কালীপুর থেকে মন্মথ ডাক্তারকে নিয়ে এল। গাঁয়ে হোমিওপ্যাথি জগন্নাথ কী সব ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিল মলয়াকে। যাই হোক বউটার চোট তেমন মাত্রাছাড়া নয়। মন্মথ ডাক্তার দেখেটেখে বলল , হাড়–টাড় ভাঙেনি। তবে ভোগান্তি আছে।
তারক ভিড়ের বাইরে উঠোনের এক ধারে এসে দাঁড়িয়ে ওপরে চেয়ে আকাশটা দেখল। সে অমানুষ ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও ঢের অমানুষ তো পৃথিবীতে আছে দেখা যাচ্ছে।
কালীপুর থানা থেকে পুলিশও এসে পড়ল জিপে করে। জবানবন্দি দিতে দিতে রাত প্রায় ভোর। তারপর তার বাড়িমুখো রওনা হল। মনটা খারাপ লাগছে। বউটা এঁটো হয়ে পড়ল!
বাঁশঝাড় পেরনোর সময়ে কে যেন বলে উঠল, আমি তো জানতুম তুমি খারাপ লোক নও।
তারক হাঁ।
কে? কে?
আমি।
অন্ধকারেও কি আর চিনতে ভুল হয়?
তুই! তুই নরেনবাবুর সঙ্গে যাসনি?
তোমার কি মুখে কিছু আটকায় না? তার আগে গলায় দড়ি দেব।
তাহলে কোথায় ছিলি?
কোথায় আবার! বউদি লুকিয়ে রেখেছিল নতুন গোয়ালঘরে। ডাকাত যখন পড়ল তখন বেরিয়ে এসে কাণ্ড দেখে খড়ের গাদার পিছনে লুকিয়ে পড়ি। তুমি না এলে আজ কী যে হত!
নরেনবাবু তাহলে কার সঙ্গে গেল?
তার আমি কী জানি! নিয়ে যেতে চেয়েছিল বলেই তো পালিয়েছিলুম।
ও শালা মহা হারামি। একবার ভেবেছিলুম পুলিশকে বলে দিই, খুনটা ও শালাই করাচ্ছিল।
না-না, ওসব বলার দরকার নেই। আমাদের তো এ গাঁয়েই থাকতে হবে। আমরা গরিব
মানুষ।
হুঁ।
আর আমাকে বেচতে চাইবে না তো!
তারক একটু হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে যমুনার একটা হাত ধরে বলল , সেই তারকটা ভেগে গেছে। এখন যে–তারকের হাত ধরে হাঁটছিস সেটা একটা পরপুরুষ।
তারকের হাতে একটা জোর চিমটি কাটল যমুনা।