হাওয়া বদলের চিঠি
বুধুয়াকে তোমার মনে আছে কিনা জানি না। মনে না থাকার কথা নয়, বছরখানেক আগে সে আমাদের কলকাতার বাসায় চাকরি করত। গোলগাল গাল, গোপাল গোপাল চেহারা, মাত্র দু মাস চাকরি করেছিল আমাদের বাসায়, শেষে, মায়ের জন্য মন কেমন করছে বলে কেঁদে–কেটে চলে গেল। যে দু-মাস ছিল তাইতেই বড় ভালো লেগেছিল বুধুয়াকে, তুমি ওকে অকর্মা মনে করতে বটে, কিন্তু আমি ওকে পুষ্যি নিতেও রাজি ছিলুম। তুমি ভুলে গেছ কি? কাল হঠাৎ সেই বুধুয়া এসে হাজির। এখানে দেওঘরের কাছাকাছিই যে ওর বাড়ি তা আমার মনেও ছিল না, হঠাৎ দেখে চিনতেও পারিনি, এখন ওর বাড়ের বয়স–তাই মাথায় একটু লম্বা হয়েছে, একটু রোগাও, শুধু মুখের মিষ্টি হাসিটুকু এখনও কি করে যেন শুদ্ধ রেখেছে। আমি যে এসেছি তা জানত না, একদিন বিকেলে যখন বেড়াচ্ছিলুম তখন নাকি দেখেছে আমাকে। তখন ভয়ে এসে কথা বলেনি; খোঁজখবর নিয়ে তবে বাসায় এসেছে। বুদ্ধি দ্যাখো, একেবারে শুধুহাতে আসেনি, বৈদ্যনাথের পূজা দিয়ে প্রসাদি প্যাঁড়া এনেছে কিছু আর শালপাতার ঠোঙায় এনেছে ওর মায়ের হাতের তৈরি করা করমচার আচার। জিগ্যেস করলুম, প্যাঁড়া আনলি যদি তবে প্রসাদি আনলি কেন? অনেকক্ষণ লাজুক মুখে হেসে মাথা নীচু করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায় যে, এমনি আনলে যদি আমি না নিতে চাই সেই ভয়ে প্রসাদ করে এনেছে–প্রসাদ তো আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। কেমন মাথা খেলিয়েছে দেখেছ? শমীক আর খুকু কেমন আছে জানতে চাইল। যখন জিগ্যেস করল দেওঘরে কেন এসেছি, তখন একটু মুশকিলে পড়লুমকী জবাব দিই! তখন ও নিজেই বলল , যে আমার চাকর হরিয়ার কাছে নাকি শুনেছে যে আমার অসুখ। আমি ওকে বোঝালুম যে সে তেমন কিছু নয়, একদিন অফিস যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলুম রাস্তায়, তাই দেখেশুনে ডাক্তার বলেছে একটু ঘুরে আসতে, ও চুপ করে শুনল তারপর ব্যথিত মুখে বসে রইল। তখন আমিই ওকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানা কথা জিগ্যেস করলুম। সিনেমা হলের কাছে পান সিগারেটের দোকান দিয়েছে দোকান ভালো চলে, আর শহরের একটু দূরেই ওর গ্রাম–সেখানে খেতি–গৃহস্থি দেখাশোনা করে ওর মা আর ভাই। খুব লাজুক মুখে জানাল যে, কলকাতায় আমাদের বাসায় থাকবার সময় সে বলেছিল বিয়ে করেনি সেটা মিথ্যে কথা। বিয়ে করেছে দশ বছর বয়সে, এখন পনেরো কিন্তু এখনও গাওনা হয়নি। আরও নানা কথা বলল , বারান্দায় মেঝের ওপর আমার পায়ের কাছটিতে বসে, আমি ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলুম। অধিকাংশই ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা, বারবার বলল বুড়ো হলে ও কোনও আশ্রমটাশ্রমে গিয়ে থাকবে, সংসারে নাকি ওর খুব একটা স্পৃহা নেই। ওর চেহারার মধ্যে এমন একটা সরল সত্যনিষ্ঠার ছাপ আছে যে কথাগুলোকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তুমি সঙ্গে আসোনি কেন সেকথাও জিগ্যেস করল, আরও বলল , আমার কোনও কাজকর্ম করে দেওয়ার থাকলে ও করে দেবে। এ সময়ে বাজার করে হরিয়া ফিরে এলে, তখন আমাকে ছেড়ে দুজনে দেশওয়ালি ভাষায় নিজেদের মধ্যে খানিক গল্প করল। যাওয়ার সময় বলে গেল যে ওর গ্রামে একজন গুণী লোক আছে যে ঝাড়ফুঁক করে, টোটকা ওষুধ দেয়। অনেকের রোগ সে নাকি সারিয়েছে। যদি আমার আপত্তি না থাকে তবে সে একবার সেই গুণীকে ডেকে এনে দেখাবে।
আমি হেসে বললুম–আনিস লোকটাকে আলাপ করে দেখব। রোগ কিছু নেই, তবু এখানে এসে নতুন ধরনের লোকের সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বুধুয়ার বোধহয় ধারণা আমার অসুখটা শক্ত ধরনের তাই সে যাওয়ার সময় মাথা ঝাঁকিয়ে বারবার ভরসা দিয়ে বলে গেল যে অনেক শক্ত রোগ সেই গুণী সারিয়েছে।
বুধুয়া চলে গেলে অনেকক্ষণ একা-একা বসে ভাবলুম। বুধুয়ার ধারণা যে ভুল তা মনে হচ্ছিল। কখনও বলিনি তোমাকে, যেদিন অফিসে যেতে গিয়ে বাসের মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেলুম। সেদিনটায় প্রথমে মনে হয়েছিল নিশ্চিত এটা করোনারি অ্যাটাক। জ্ঞান ফিরে এলে মনে হয়েছিল আমি হয়তো তিন-চারদিন বা আরও বেশি দিন অজ্ঞান হয়েছিলুম। ক্রমে বুঝতে পারলুম যে এটা ব্লাডপ্রেসার, এবং মাত্র ঘণ্টা দেড়েক আমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলুম তখন আমার ভয় কেটে যাওয়া উচিত ছিল। ডাক্তারও অভয় দিচ্ছিল–আমার বয়স মাত্র তেতাল্লিশ, স্বাস্থ্য ভালো–ভয় কী? এখনও একটা জীবন সামনে পড়ে আছে। কিন্তু কেন জানি না ওর পর থেকেই মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেল। আগে তো কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি রাস্তায়, ট্রামে–বাসে সব লোক দিব্যি চলাফেরা করছে, মাঝখান থেকে হঠাৎ আমিই অজ্ঞান হয়ে গেলাম কেন? এইসব ভেবে ভেবে কয়েকদিন নিজেকে খুব দুর্বল আর অসহায় মনে হতে লাগল। এতকাল কখনও খুব গুরুত্ব দিয়ে বয়স হয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি, মরার কথা ভাবিনি। এবার ভাবতে লাগলুম। ভেবে দেখলুম দুটোর কোনওটাকেই তো আমি এড়াতে পারব না। কলকাতায় হাঁপ ধরে গেল। মনে হল। বহুকাল কলকাতার বাইরে যাইনি, এতদিন একজায়গায় থেকে মনটা নিস্তেজ, আর নানা বাজে ভাবনার বাসা হয়ে উঠেছে। তাই তোমাকে একদিন বলেছিলাম–চলো বাইরে কোথাও থেকে দু-চারদিন বেড়িয়ে আসি। তুমি অবাক হয়ে বললে–ও মা! ভূতের মুখে রামনাম! এতদিন তো উলটো গেয়েছ। শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়েছিলুম। বাস্তবিক অফিসে আমার ছুটি জমে–জমে পচে গেল, বেড়িয়ে আসা দূরের কথা, একদিন ছুটি নিয়ে বসে থাকতেও ইচ্ছে হয়নি। বেড়াতেই বা কোথায় যাব! কিন্তু কলকাতা কয়েকদিনেই অসহ্য হয়ে গেল। দু-একদিন শমীক আর খুকুকে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে গেলুম–ওরাও বাবার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক। কিন্তু এভাবেও আমার বিষণ্ণতা কাটল না। মনে হল দূরে কোথাও যাওয়া একান্ত দরকার, আর যেতে হবে একলা। একলা হলেই নিজের মনটাকে সুবিধে মতো পাওয়া যাবে, তখন দেখা যাবে তার কোথায় কোন কাঁটাটা বিঁধে আছে। শুধু তোমাকে নিয়ে আসা যায় না, তাহলে শমীক আর খুকুকে কে দেখবে? ওদের নিয়ে এলে আবার স্কুল কামাই হয়। একা আসতে প্রথমটায় খারাপ লাগছিল, এখানে এসে কয়েকদিন ভীষণ মনখারাপ লাগল–আগের চিঠিতে সেসব জানাইনি। এমনকী তিনদিন পর একদিন ফিরে যাওয়ার জন্য সব বাঁধাছাঁদা করে ট্রেনে পর্যন্ত উঠে পড়েছিলুম। মধুপুরে ট্রেন থামতে মনে হল বড় নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা–তা ছাড়া সন্দেহ হল কলকাতায় গেলেই সেই বিশ্রী ভাবনাগুলো আবার ঘাড়ে চেপে বসবে। মধুপুরেই নেমে পড়া গেল, কিন্তু দেওঘরেও ফিরতে ইচ্ছে হল; ওখানে না থেকে হরিয়াকে দেওঘরে ফেরত পাঠিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লুম। সাতদিন ধরে নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। কোনও লক্ষ স্থির ছিল না, সহযাত্রীদের কাছে যে জায়গার নাম শুনেছি সে জায়গারই টিকিট কেটেছি পরদিন। ভালো করে খাওয়া হয়নি, শোয়া হয়নি, গালে দাড়ি বেড়ে গেছে, শরীর পথের ধকলে দুর্বল তবু ওই সাতদিনে মনের জড়তা কেটে গেল, তাজা লাগল নিজেকে, দেওঘর ফিরেছি দিন চারেক হল। এখন আর খারাপ লাগছিল না। তোমাদের কথা খুব একটা মনে পড়ছিল না।
শুধু বুধুয়া এসে মনটা খারাপ করে দিয়ে গেল। সেই যে ওকে কবে একটু ভালোবেসেছিলুম, ও আসায় সেই ভালোবাসার জায়গায় আবার হাত পড়ে গেল। কাল থেকে আবার তোমাদের কথা তাই ভীষণ মনে পড়ছে। বুধুয়া না এলে এটা হত না। বুধুয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারটার সম্পর্ক হয়তো তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। আমিও পারছি না, কেবল মনে হচ্ছে কী রকম অস্পষ্ট একটা যোগাযোগ হয়েছিল।
.
আজ তোমাকে কোনও চিঠি লিখবার কথা ছিল না। এই তো তিনদিন হয় তোমাকে চিঠি লিখেছি, এখনও জবাব দাওনি, কিংবা হয়তো তোমার চিঠিও এখন মাঝপথে। তবু লিখতে বসেছি, মনে হচ্ছে তোমাকে কী একটা বিষয় যেন জানাবার আছে, যা রহস্যময় যা অস্পষ্ট। ভয় পেও না-এ তেমন কিছু নয়। আজ বিকেল থেকে মনটা ডানা মেলেছে, উড়ছে, কোনও ঠাঁই ছুঁতে চাইছে না। বিকেলে আকাশ ঘনঘোর করে এল, বেড়াতে গিয়েছিলুম মেঘ দেখে বৃষ্টি আসবার আগেই ঘরে ফিরে এলুম, তারপর ইজিচেয়ারে রোজকার মতো না বসে দরজার চৌকাঠের পাশটিতে বসে রইলুম চুপ করে। বৃষ্টি এল। ঘন মেঘের স্নিগ্ধ ছায়া পড়েছে চারধারে, বর্ষার ব্যাং ডাকছে, ঝরঝর জলের শব্দ হয়ে যেতে লাগল। আর কোনও শব্দ নেই। সামনে বাগানে ফুলগাছগুলো, পাতাবাহারের গাছগুলো অঝোর জলধারায় ভিজে যাচ্ছিল। আমার ছোট্ট বাগানটায় গভীর ভালোবাসার খেলা চলছিল। দেখতে-দেখতে কেমন করে যেন বাগানের গাছপালা, ফুল, লতা–পাতার মতো আমিও আকণ্ঠ পান করছিলুম সেই বৃষ্টির জীবনীশক্তি। মন ভরে যাচ্ছিল। ঠিক হয়তো বোঝাতে পারব না, কিন্তু সেই অবিরাম জলধারার দিকে চেয়ে থেকে মনে হচ্ছিল আমার হয়তো উদ্ভিদের মতোই শাখা, কাণ্ড বা শিকড় গোছের কোনও গোপন প্রত্যঙ্গ আছে যা দিয়ে আমি বৃষ্টি থেকে সেই জীবনীশক্তি আহরণ করেছিলুম। ক্রমে রাত হয়ে এলে যখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না তখন ঘরে এসে এইমাত্র বসলুম ছোট বাতিটি জ্বালিয়ে তোমাকে চিঠি লিখব বলে।
এখনও জলের ঝরে পড়বার শব্দ, ব্যাঙের অবিরাম ডাক শুনতে পাচ্ছি। তুমি হয়তো ঠিক বুঝতে চাইবে না, কিন্তু এখানে আসবার পর যত বার রাত্রিতে বৃষ্টির শব্দ শুনেছি আমি, ততবার মনে হয়েছে যে আমার একটা পূর্বজন্ম ছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না যে, এজন্মেই আমার শুরু ও শেষ। রহস্যের কথা যে বলেছিলুম তা এই। বোধহয় এইসব অনুভুতির কোনও মূল্যও নেই। না থাক, তবু আমার কাছে আজ বৃষ্টি যে প্রিয়, ঘাস, ফুল, মাটি যে প্রিয়, তার কারণ হয়ে থাক এই রহস্যময় অনুভূতিগুলি। আমি কখনও এ রহস্যের অবসান চাইব না।
দ্যাখো, বৃষ্টি এসেছে বলেই আমার বাগানের গাছগুলোর ওরকম আনন্দ, তারা বাহু মেলে শিকড় ছেঁড়া কাঁপনে কাঁপছে। এই যে ব্যাঙের ডাক, জলের শব্দ শুনছি তাতেও কেমন এক আনন্দের সুর লেগেছে। মনে হয় আবহমান কাল থেকে আমাদের এই বৃক্ষলতাগুল্ম, ওই আপাততুচ্ছ ব্যাঙগুলো এই বৃষ্টিকে পৃথিবীতে ডেকে আনছে। তাই বৃষ্টির ভিতরে কেমন একটা ভালোবাসার গন্ধ হয়েছে। এ না হলে ও হয় না, ও না হলে এ হয় না, ভেবে দেখলে, আমরা সবাই যেন এরকম একটা টানক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছি।
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে চিঠিটার সুর কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। এভাবে কেউ বউকে চিঠি লেখে? কী করে জানব। বারবার তুমি আমার হাতের কাছেই ছিলে, চিঠি লেখবার দরকার হয়নি তো কখনও। মনে হচ্ছে চিঠির শেষে ঘর–সংসারের কথা কিছু লেখা দরকার। তুমি কেমন আছ আমাকে ছেড়ে তা জানতে ইচ্ছে করছে। শমীক আর খুকু বরাবর আমাকে একটু গম্ভীর বলে জানে, বড় একটা কাছে ঘেঁষে না। ভাবছি এবার ফিরে গিয়ে ওদের সঙ্গে একটু বেশি করে মিশব। কী বলে?
.
তোমার একজোড়া চিঠি পেলুম আজ। দ্বিতীয়টা এক্সপ্রেসে এসে প্রথমটাকে ধরেছে। বুঝতে পারছি আমার চিঠি পেয়ে একটু অস্থির হয়েছ। আরও বোঝা যাচ্ছে যে আমার শরীরের জন্য তোমার উৎকণ্ঠা তেমন নেই, যতটা আমার মানসিক অবস্থার জন্য আছে। সন্দেহ হচ্ছে কি যে আমার মাথায় কেমন যেন একটু…? সন্দেহ মাঝে-মাঝে আমারও হয়। এতকাল সেই বাসে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার কাছে সবটাই ছিল একটা খেলার মাঠের মতো–যেখানে
দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট দিনের আলোয় আমার প্রতিপক্ষ সব খেলোয়াড়কেই দেখতে পাচ্ছি, সহযোগীদেরও চিনে নিচ্ছি। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসবার পর থেকে দেখছি দিনের আলোয় সেই মাঠ যতটা স্পষ্ট মনে হয়েছিল এখন আর ততটা নয়। সেই মাঠে যেন এক নিস্তেজ শেষবেলার আলো পড়েছে, বহুদুর প্রায় সীমারেখাহীন হয়ে বিস্তৃত হয়েছে সেই মাঠ, দূরে–দুরে অস্পষ্ট চেহারা নিয়ে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে তাদের চেনা যাচ্ছে না। সব কেমন যেন পালটে গেল।
তুমি ঠাট্টার ছলে প্রশ্ন করেছ আমি কবি হয়ে যাচ্ছি কিনা। তুমি তো গোঁড়া ঈশ্বরবিশ্বাসী, তুমি কি বিশ্বাস করো না যে, ঈশ্বর সবকিছুর এবং এমনকী নিজেরও সৃষ্টিকর্তা? তাঁর চেয়ে বেশি। কল্পনাপ্রবণ প্রকাশক্ষমতা আর কার থাকতে পারে, তাঁর চেয়ে বড় কবি কে? আর যেহেতু তাঁর। সেই আনন্দময় কবিসত্তা থেকে আমাদের আত্মার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমাদের জনমত রয়েছে, সেই হেতু আমাদের সকলেরই কিছু পরিমাণে কবি হওয়া বাধ্যতামূলক। কোন মানুষ, কোন বৃক্ষ, কোন পশু কবি নয়? আমার মাঝে-মাঝে মনে হয় কী জানো? আমি যে ইজিচেয়ারে শুয়ে নানা কথা ভাবলুম আমার সেইসব চিন্তাভাবনার ঢেউ ইজিচেয়ারটা ধরে রেখেছিল–ঠিক টেপরেকর্ডারের মতো। অন্য কেউ যখন এসে সেই ইজিচেয়ারে বসবে তখন ইজিচেয়ারটা সেই ঢেউগুলি বিকিরণ করবে তার বোধ ও বুদ্ধির ভিতর। চমকে উঠো না। ইজিচেয়ারটাকে ওরকম ভাবতে যদি অস্বস্তি হয় তবে সে জায়গায় বাতাস, মাটি, জল কিংবা শূন্যতা ভেবে নিতে পারো। যেমন এই ধরনের কোনও মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যদি আমার গভীর ও গোপন ভাবনা-চিন্তা ও বোধ অন্যের ভিতরে সঞ্চারিত হত। যদি আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলি এভাবে ভাষায় প্রকাশ করতে না হত আমরা কাউকে কবি বলতুম না, বুঝতুম যে এক ভয়ঙ্কর, উন্মত্ত ও দুর্বার কল্পনাশক্তি থেকে আমাদের সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা সকলেই কিছু কিছু কবি। কাল রাত্রেও অনিদ্রা পেয়ে বসেছিল, মাঝে-মাঝে ওইটাই বড় যন্ত্রণা দেয়। কেমন পিপাসা, ভয়, উল্কণ্ঠার এক সংমিশ্রণে শুয়ে ছিলুম গভীর রাত অবধি। তখন বৃষ্টি থেমে জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাইরে শুনলুম কুকুর কাঁদছে চাঁদের দিকে চেয়ে থেকে। শিউরে উঠে একবার হরিয়াকে ডাকতে গেলুম, কিন্তু ডাকা হল না। চোখ বুজে আমি শুনতে পেলুম কুকুরের সেই কান্নার সাথে ডানা। ঝাঁপটানোর প্রাণপণ শব্দ উঠছে। অনেকক্ষণ চোখ বুজে রইলুম–বোধ হল সবটাই মনের ভুল–কেউ কাঁদছে না, কেউই উড়ে যেতে চাইছে না। তারপর ক্রমে আস্তে-আস্তে বুঝতে পারছিলুম অকারণ চোখের জলে চোখ ভরে আসছে। যেন আমি আর ঘরে নেই, নিশিরাতের পরী আমাকে উড়িয়ে এনেছে, শুইয়ে দিয়ে গেছে শিশিরে ভেজা মাঠের ওপর স্নান জ্যোৎস্নার ভিতরে। চোখ চেয়ে দেখব দুটো সাদা হাঁস মলিন জ্যোৎস্নাকে গায়ে মেখে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সীমারেখা ছেড়ে দূর–নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে, কিংবা আরও দুরে, যার কোনও সীমারেখা নেই এমন সমুদ্রের সন্ধানে তারা চলেছে–আর কখনও ফিরে আসবে না। হাঁসের ঘর ভেঙে রক্তমাখা মুখে, গায়ের। পালক ঝেড়ে কুকুরটা তাই এসেছে মাঠে দূরতম সেইসব হাঁসের সন্ধানে, তারপর চাঁদ ও শূন্যতা দেখে কাঁদছে। আমার চোখের ওপর গভীর স্বপ্নের সেই খেলা চলল অনেকক্ষণ।
জানি এ চিঠি পেলে তুমি হয়তো আরও অস্থির হয়ে পড়বে। কিন্তু আর তোমার মতো বিশ্বস্ত কেউ নেই যাকে এসব লেখা যায়। সবকিছুই ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিল আমাদের, তাই আমিও চাই আমার অস্থিরতার এইটুকু তোমার ভিতরে সঞ্চারিত হোক।
.
আজ সকালে চিঠিটা শেষ করিনি, ভেবেছিলাম বিকেলে করব। তাই করছি। আজ বিকেলে বুধুয়া এসেছিল তার সেই গুণীকে নিয়ে। গুণীকে যেমন কল্পনা করেছিলুম তেমন নয়, অর্থাৎ তার একহাতে ঝাঁটা অন্যহাতে সর্ষেপোড়া নেই এবং চোখ রক্তবর্ণও নয়। নিরীহ ভালোমানুষের মতো চেহারা, কথাবার্তায় মনে হয় বেশ কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে। বয়সও তার অল্প, বোধহয় তিরিশ। ‘আপনি’ বা ‘তুমি’ কোনটা বলব তা নিয়ে একটু গোলে পড়লুম, শেষে ‘আপনি’ই বলতে লাগলুম। সে একসময়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল –আপনার অসুখটা তো মনের।
বললুম, কী করে বুঝলেন?
হেসে বলল –বোঝা যায়। আপনার চোখ সে কথাই বলছে। তারপর আবার খানিক চেয়ে থেকে বলল –আপনার ছেলেমেয়ে দুটি এবং আপনার স্ত্রী আপনাকে খুবই ভালোবাসে, কিন্তু আমার মনে হয় তারা আপনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারে না।
বোঝো কাণ্ড! তোমরা তো নিশ্চিন্তে আছ, কিন্তু এদিকে তোমাদের মনের কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। একটু চমকে উঠেছিলুম, তবু হাসিমুখে জিগ্যেস করি–আমার দুই ছেলেমেয়ে আর। একটি স্ত্রী কী করে বুঝলেন? মন্ত্রবলে নাকি?
আবার হাসল–না, বুধুয়া বলছিল আমাকে।
মনে মনেই হো–হো করে হাসলাম। এরা কি তোমাকে বন্ধ্যা মনে করে? বুধুয়া চলে আসার পরও তো এক বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে যদি আর একটি হত সে কি হিসাবের বাইরে থাকত। নাঃ, পৃথিবীতে হঠযোগ, মন্ত্র–তন্ত্র এসব কিছুই নেই দেখছি। না থাকলে তো আমারই মুশকিল, কেননা আমাকে অবিলম্বে এই ধরনের একটা আশ্রয় পেতেই হবে, নইলে সেই পুরোনো ভাবনা, চিন্তাগুলো আবার এসে জাপটে ধরবে।
গুণী বলল –বুধুয়া আপনার কথা সবই বলেছে আমাকে। ও আপনাকে খুব ভালোবাসে। বুধুয়া লজ্জায় মুখ লুকোল, আমি একটু হাসলুম, কিছু বললুম না। গুণী খানিকক্ষণ আবার চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল –মনের যে অশান্তি রয়েছে তা সাধারণত কামনাবাসনা থেকে আসে। আপনি বড় বেশি চান।
মিথ্যে বলব না, এসব পুরোনো কথায় একটু বিরক্ত হয়েছিলুম। বললুম–কামনা-বাসনা ছাড়া মানুষ হয় না।
সে তেমনি শান্ত গলায় বলল –কিন্তু আপনি চান আরও বেশি। আপনি সুখের চেয়েও বেশি কিছু চান, সে হল শক্তি শান্তি সন্তোষ। এটাই পাওয়া সবচেয়ে কঠিন, এ চাওয়াই সবচেয়ে বড় চাওয়া।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলুম।
সে বলল –আপনি ঈশ্বরে মন দিন। তাঁর দয়া পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি দয়া করেন।
হেসে বলি–ঈশ্বরের দয়াকে বিশ্বাস কী করে করব? ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই যে!
সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল –আপনার প্রিয়জন আছেন জানি, কিন্তু আপনি তাঁদের কতটা ভালোবাসেন? তাঁদের জন্য প্রাণ দিতে পারেন?
একটু হকচকিয়ে গিয়ে থমকে একটু ভেবে বললুম–বোবাধহয় পারি। তোমাদের তিনজনের মুখ ভেবে নিয়ে পারি’ বলতে ভালোই লাগছিল–যেন সত্যিই পারি।
লোকটা একবার একটু ধোঁয়াটেভাবে বলল –ভালো করে ভেবে দেখবেন। যদি সত্যিই পারেন, এবং ভালোবাসার জন্যেই পারেন তবে আপনি সব অশান্তি কাটিয়ে উঠবেন!
এরপর ওরা চলে গেল। সাইকোথেরাপির এই গ্রাম্য চেষ্টা দেখে খুব হাসলুম নিজেই।
এবার চিঠি শেষ করি। খুকুকে বোলো ওর কাঁচা হাতের লেখা চিঠিটা পেয়েছি। কিন্তু ওর ভাষাটাও তোমার বলে মনে হল, সে লিখেছে ‘বাপি, তুমি অত ভেবো না।’ তুমি ওদের কিছু বোলো না, দোহাই, ওরা যা চায় তাই লিখুক। আমি ওদের মনটাকে স্পষ্ট ধরতে চাই।
.
ধারোয়া নদীর ধার তুমি তো দ্যাখোনি! কী সুন্দর! উপত্যকার মতো বহুদুর পর্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে। মাটি শুকনো, গেরুয়া রঙের। কোথাও মাটি রক্তের মতো লাল। মস্ত পাথরের চাঁই। মাটিতে গাঁথা। বিকেলের দিকটায় অসহ্য নির্জনতা। হাঁটছি তো হাঁটছিই। শেষবেলার আলোয় আমার মস্ত ছায়াটা কত দীর্ঘ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ছায়াটার পিছু পিছু হাঁটছিলাম। যদি আমার ছায়াটার কোনও ইচ্ছাশক্তি থেকে থাকে, যদি থাকে নিজস্ব সত্তা তো নিয়ে যাক আমায় যেখানে তার খুশি। এও এক খেলা। ছায়াটা সব বন্ধুরতা অবলীলায় পার হয়। মস্ত পাথরের চাঙড়, গর্ত, গাছপালা কিছুই তাকে বাধা দিতে পারে না। শরীরী পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। শরীরটা যে মস্ত বাধা।
এলোপাথারি হাঁটতে-হাঁটতে হাঁফ ধরে গেল। নদীর ধার পর্যন্ত পৌঁছোতে সন্ধে লেগে গেল প্রায়। নদীর ধারে চুপটি করে বসে রইলাম। একটুখানি আলো আর বাকি আছে মাত্র। খুব একটুখানি। চারধারের গাছপালা, মাঠ, নদীর জল তৃষ্ণার্তের মতো সেই শেষ আলোটুকু শুষে নিচ্ছে। দেখতে-দেখতে পৃথিবীকে বড্ড অনিত্য বলে মনে হয়। দিনটা যে গেল, এইভাবে রোজ যায়। থাকে না তো। একটা স্থির সূর্য যদি কেউ আকাশে লাগিয়ে রাখত, তবে কি আমাদের দিন যেত না? বয়স বাড়ত না। যেমন ছিলাম সবাই, তেমনি চিরকাল থেকে যেতাম! ওই যে গতিময় ধারোয়ার জল বয়ে যাচ্ছে, ওর মধ্যেও সেই অনিত্যতার কথা। বয়ে যাচ্ছে। আজ যে এক কোষ জল বয়ে গেল, সে গেল চিরকালের মতোই। ধারোয়া বেয়ে সে আর কোনওদিনই যাবে না এক গতিপথে।
মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অস্থিরতা ছিল না। প্রকাণ্ড আকাশের তলায়। ধারোয়ার মস্ত উপত্যকায় বসে থেকে একরকমের মহৎ বিষণ্ণতা টের পাচ্ছিলাম। চলে যাওয়াটাই অমোঘ।
নদীর ধার ধরে একটা লোক উঠে এল। ঝোপে ঝাড়ে কী যেন খুঁজছে। কোনও বুনন লতাপাতা হবে। তার গায়ে একটা হাফহাতা পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি, বেশ তেজস্বী চেহারা। দেহাতিই হবে।
সেই ভেবে লোকটাকে ডেকে বললুম–ক্যায়া ঢ়ুঁড় রহে হৈ জী?
লোকটা একপলক তাকিয়ে একটু হাসল। কাছে এসে বলল –আপনাকে দেখেছি এখানে কয়েকদিন। বাঙালি তো?
বললুম–আজ্ঞে। আপনি এখানেই থাকেন?
–বহুদিন হয়ে গেল। ছেচল্লিশ সালের পর থেকেই।
বসল। অনেকক্ষণ দু-পক্ষের পরিচয় হল। বেশ লোকটা। পঞ্চাশের ওপর বয়স, কিন্তু সেটা উনি না বললে কিছুতেই বুঝতে পারতুম না, একদম ছেলেমানুষি চেহারা। চাউনিতে এখনও বেশ একটা জীবনীশক্তি। কথায় কথায় বললেন–বয়েস কমানোর ওষুধ জানি না। সারাদিন খাঁটি, ঘুরি, ঘুমোই মাত্র চারঘণ্টা। আহার, নিরামিষ ডালভাত স্বপাকে।
লোকটা ধার্মিক। তাঁর ইষ্টদেবের আশ্রমে থাকেন। তাঁর কাজে জীবন উৎসর্গ করেছেন। একসময়ে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, নিজের গাড়িটাড়ি ছিল, লম্বা বেতন পেতেন। সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন, কোনও ক্ষোভ নেই।
জিগ্যেস করলুম–ঘর সংসারের কথা ভাবেন না? চলে কীসে?
উনি বললেন–সংসারের সবাই তো এখানেই, ভাবব কেন? ভাবছ তুমি চলবে কীসে, ভাববার তুমি কে? ভাববার যিনি, ভাবছেন তিনি, ভাবো তুমি তাঁকে। এই ছোট্ট ছড়াটা বলে হাসলেন।
রাত হয়ে গিয়েছিল, উনি অন্ধকার রাস্তায় আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন, আমি ডেকে একটু বসালাম। উনি চা খান না, অন্যের বাড়িতে আহার্য গ্রহণ করেন না। কী দিয়ে আপ্যায়ন করি! ভারী কাঠখোট্টা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে, এ লোকটা।
যাওয়ার আগে লোকটা হঠাৎ বলল –কোনও অসুবিধে নেই তো?
–না, না। বেশ আছি।
লোকটা চারদিক ঘুরে-ঘুরে ঘরদোর দেখল। বলল –আপনি মশাই ঘোরতর স্ত্রৈণ লোক তো, স্ত্রীকে ছেড়ে একা এখানে এসেছেন কেন?
প্রশ্নটা চেপে গিয়ে বললাম–কী করে বুঝলেন যে আমি স্ত্রৈণ?
–ঘরদোরের অবস্থা দেখে, ছাড়া জামাকাপড় গুছিয়ে রাখার অভ্যাস নেই, বিছানায় ঢাকনা দেননি, গেঞ্জি কাঁচা নয়। লক্ষণ দেখলে চেনা যায়। বোধহয় আপনি একটু ভাবুক মানুষও। বলে তিনি চকচকে চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আবার ছড়া বললেন–অর্জনে পটু, সাশ্রয়ী। কাজে, সুন্দরে সমাপন, এই দেখেই বুঝবি রে তার যোগ্যতা কেমন।
বেশ লাগল লোকটাকে, এখানে আমার পর থেকে কেমন একটি দুটি সহজ দার্শনিকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। শিখছি। কলকাতায় এরকম মানুষ বড় একটা পাইনা।
.
আমার পালে মৃত্যুর হাওয়া লেগেছে। তরতর করে ভাঁটিয়ে যাচ্ছে নৌকা। কাল বিকেলে একটা মৃত্যু দেখলুম।
আমার উঠোনের ধারে একটু বারান্দা আছে। তার কোলে একটা তারাফুলের মরা ঝোঁপ। একটা মাকড়সা জাল ফেঁদে বসে থাকে, রোজ দেখি। পোকামাকড় পড়লেই জাল নড়ে ওঠে। মাকড়সাটা জালের কাঁপুনি টের পায়। তারপর নির্ভুল লম্বা-লম্বা আটটা পায়ে দুলে–দুলে হেঁটে এসে পোকা ধরে। বিকেলে ওই বারান্দায় বসে মাকড়সার জালটা দেখছিলুম। হরিয়া একবাটি মুড়ি তেল দিয়ে মেখে দিয়ে গেছে, বসে খাচ্ছি। হঠাৎ ভাবলুম, মাকড়সাটাকে নিয়ে একটু খেলা করি। একটা মুড়ির দানা তার জালে ছুঁড়ে দিলুম, মুড়িটা আঠালো জালে পড়ে আটকে গেল। কাঁপুনি টের পেল মাকড়সা। একটু চুপ করে থেকে লম্বা পায়ে ধীরে হেঁটে এল। শুকল, দেখল। তারপর একটা লাথি মেরে মুড়ির দানাটা ফেলে দিল জাল থেকে। আবার ফিরে গেল জালের মাঝখানটিতে, ধৈর্য ধরে রইল জেলেদের মতো। আবার মুড়ি ছুঁড়ে মারলুম। আবার উঠে এল। দেখল, কল, লাথি মেরে মুড়ি ফেলে দিয়ে জালটাকে পরিষ্কার করে চলে গেল। বার বার এই কাণ্ড। বেশ খেলাটা। মাকড়সারা যে মুড়ি টুড়ি খায় না তা বুঝতে পারলুম কাল, খায় না কেন বলো তো?
সে যাকগে, অনেকক্ষণ ধরে মাকড়সার জালে মুড়ি ছুড়বার খেলা খেলে ক্লান্ত লাগছিল। হঠাৎ ইচ্ছে হল দেখি, রক্তমাংসের গন্ধ পেলে খায় কিনা। উঠোনের একধারে বিশাল হিংস্র চেহারার পিপড়ে দেখেছি। তাদের মস্ত মাথা, মিশমিশে কালো। তখনও দু-একটা ঘোরাফেরা করছিল উঠোনে। রান্নাঘর থেকে চিমটে এনে তাদের একটাকে ধরে জালে ছেড়ে দিলুম। মুড়ি খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, বেড়াতে যাব, তাই আর ফলাফলের অপেক্ষা করিনি। ফিরে এসে দেখি মস্ত পিঁপড়েটা জালের কেন্দ্রে মাকড়সাটার খুব কাছেই মরে আটকে আছে। শরীরটা অর্ধেক খাওয়া।
মনটা সেই থেকে খারাপ। কেবলই ভাবছি, এ পাপ আমাকে কি স্পর্শ করবে?
পালে মৃত্যুর হাওয়া লেগেছে, নৌকো ভাঁটিয়ে যাচ্ছে। উজানেরও হাওয়া আছে, বাইলে উজানেও যাওয়া যায়। আমি পারছি না। এবার চিঠিতে লিখেছ আমাকে ফিরে যেতে। ভুলে যাও কেন যে আমি হাওয়া বদল করতে এসেছি। এখনও হাওয়া বদল শেষ হয়নি তো। মৃত্যুর হাওয়ার বদলে জীবনের হাওয়া লাগুক।
আজ ঘুম পাচ্ছে। এ চিঠিটা আবার কাল শেষ করব।
.
ঘুম থেকে উঠেই দেখি, কী সুন্দর ভোরের আলোটি। দিন আসছে, তারই আবাহনে আকাশ মর্ত জুড়ে কী মহা আয়োজন! আকাশে মেঘ ছিল না, ধুলো–ধোঁয়া ছিল না, গাছগাছালি শান্ত, বাতাস মৃদু। রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি যেন পিঁপড়েদের জগতে চলে যাচ্ছি। লক্ষ পিঁপড়ে আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন? কিন্তু ভোরে ঘুম ভাঙল কুটুস একটা কামড়ে। উঠে দেখলুম। পিঁপড়ে নয়, বড্ড ছারপোকা।
বেশ লাগছিল ভোরটা। কী বলব, এত সুন্দর দৃশ্যটা একা দেখছি। মনটা খাঁ–খাঁ করছে। কাকে যেন ডেকে দেখালে ভালো হত। আমরা একা কিছু উপভোগ করতে পারি না। ভালো লাগে না। বেঁচে থাকতে গেলে একজন প্রিয় মানুষ চাই। সে কি তুমি? বুঝতে পারি না। কিন্তু কাউকে বড্ড দরকার এক-বুক কথা জমে আছে।
মাকড়সার ক্ষুধা কী ভয়ঙ্কর! আজ দেখি, আধ–খাওয়া পিঁপড়েটার দেহাবশেষ নেই। মনটা বড় অস্থির লাগছে, কী করলুম! এই নিষ্ঠুরতা কি আমাকে মানায়!
দুপুরে জানালার পাশে জারুল গাছের ছায়া কোলে করে বসে আছি। কী একা, কী গভীর চারদিক। মনে হচ্ছে, আমার কে আছে! আমার কে আছে!
কোল জুড়ে জারুলের ছায়া, জীবনে যা কিছু জড়ো করেছি দু-হাতে, সবই আঁকড়ে ধরে আছি, সেসব কি ছায়ার মতো?
অথচ পৃথিবী কী গভীর। কত কোটি বছরের জীবনযাপনের সব চিহ্ন নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে তার প্রাচীনতার ঘ্রাণ। সব প্রাচীন সময়, সব প্রাচীন বাতাস আজও রয়ে গেছে। আমার চারধারে। এসব থেকেই জন্মেছি, এসবেই লয় পাবো। কোলে জারুলের ছায়া পড়ে, আলো দোলে। কিছুই ক্ষণিক নয়। সবকিছুই জন্মেছিল পৃথিবীর সঙ্গে।
জলে চোখ ভেসে গেল। স্মৃতিভ্রংশের মতো বসে থাকি। কোথা থেকেই বা এসেছি। ফিরে যাবই বা কোথায়!
সেই হাফহাতা পাঞ্জাবি পরা মানুষটা আসবে। উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছি। আমরা দুজনে উপত্যকা পেরিয়ে যাব। ওদিকে একটা ঘাসজমি, তারপর গাছগাছালি। যাব। ফিরব কি? কে জানে? ভেবো না। পৃথিবীতে কেউই খুব জরুরি নয়। যে যতই জরুরি ভাবুক নিজেকে, বা প্রিয়জনকে, তবু দেখো, তাকে ছাড়াও চলে যায়। কিছু অসুবিধে নেই। ছুটি দেবে? একবার দেখি হাওয়াটা পালটাতে পারি কিনা!