তৃতীয় পক্ষ
একদম আনকোরা, টাটকা, নতুন বউকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল কনিষ্ক গুপ্ত। বউয়ের নাম শম্পা। শম্পার সঙ্গে বিয়ের আগে কখনও দেখা হয়নি গুপ্তর। প্রেম-ট্রেমের প্রশ্নই ওঠে না, এমনকী বিয়ের আগে শম্পাকে চোখেও দেখেনি। একটা ফটোগ্রাফ অবশ্য পাঠিয়েছিল ওরা কিন্তু সেটাও স্পর্শ করেনি।
বিয়ের আগে গুপ্তর একটা প্রেম কেঁচে যায়। সে বিয়ে করতে চেয়েছিল মলি নামে এক স্কুল শিক্ষিকাকে। মলি দেখতে-শুনতে যাই হোক, স্বভাব যেমন ধারাই হয়ে যাক না কেন, গুপ্ত তাকে ভালোবাসত। মলিরও গুপ্তর প্রতি ভালোবাসার অভাব দেখা যায়নি কখনও।
কিন্তু ঠিক মাসছয়েক আগে এক বিকেলে ভিক্টোরিয়ার বাগানে বসে মলি গুপ্তকে একটা সদ্য চেনা চৌকস ছেলের বিবরণ দিয়েছিল, ছেলেটা নাকি দুর্দান্ত স্মার্ট, আইএএস দিয়েছে এবং নির্ভুল ইংরেজি গড়গড় করে বলতে পারে। গুপ্ত এর কোনওটাই পারে না। সে একটা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক, কিন্তু অধ্যাপনায় তার একদম সুনাম নেই। বরং ছাত্ররা তার ক্লাস কামাই করে, একবার তার বিরুদ্ধে জয়েন্ট পিটিশনও দিয়েছিল অধ্যক্ষের কাছে।
তাই মলির মুখে এক অচেনা ছেলের চৌকসের বিবরণ শুনে সে একটু নার্ভাস হয়ে যায়। প্রেমের ক্ষেত্রে কোনওরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার পছন্দ নয়। কারণ বরাবর গুপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গেছে।
ইস্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ার সময়ে একবার সে ইস্কুল-স্পোর্টসে নাম দেয়। একশো মিটার দৌড়ে শুরুতে সে বেশ এগিয়ে গিয়েছিল, অন্তত সেকেন্ড প্রাইজটা পেতই। হঠাৎ নিজের এই আশু সাফল্য টের পেল সে। বুঝল, সে সেকেন্ড হতে চলেছে। দৌড় শেষে ফিতেটাও খুব কাছে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু যেই ব্যাপারটা সে টের পেল অমনি তার দুই হাঁটুর একটা হঠাৎ কেন যে আর একটাকে খটাং করে ধাক্কা মারল কে জানে! সেখানেই শেষ নয়। শোধ নিতে অন্য হাঁটুটাও এ হাঁটুকে দিল গুতিয়ে। কনিষ্ক গুপ্ত ফিতে ছুঁতে পারল না, দৌড় শেষের কয়েক গজ দূরে নিজের দুই হাঁটুর হাঙ্গামায় জড়িয়ে বস্তার মতো পড়ে গড়াগড়ি খেল।
আর-একবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় চোদ্দোশো সাল আবৃত্তি করার সময়ে সে এত চমৎকারভাবে কবিতাটির অন্তনিহিত ব্যথা ও বেদনাকে কণ্ঠস্বরে প্রক্ষেপ করেছিল সে নিজেই বুঝেছিল, প্রতিযোগিতায় তার ধারেকাছে কেউ আসতে পারবে না। শ্রোতারাও শুনছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কবিতার শেষ কয়েকটা লাইনে এসে কনিষ্ক যখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে এক সেট রবীন্দ্র-রচনাবলীর প্রথম পুরস্কারটি তার হাতের নাগালে তখনই হঠাৎ কোথা থেকে এক ভূতুড়ে বিভ্রম এসে তার মাথার ভিতরে জল ঘোলা করে দেয়। শেষ দুটি লাইন একদম মনে পড়ল না। বারকয়েক তোতলাল সে। তারপর নমস্কার করে লজ্জায় রাঙা মুখ নিয়ে উৎসাহের আড়ালে চলে এল। একটা সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছিল সেবার।
বড় হওয়ার পর একবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে রেসের মাঠে গিয়েছিল কনিষ্ক। রেসের কিছুই তার জানা নেই, মহা আনাড়ি যাকে বলে। সে তাই ঠিক করল সবক’টা রেসের দু-নম্বর ঘোড়ার ওপর একটা করে বাজি খেলবে।
প্রথম তিনটে রেসে খেললও দু-নম্বর ঘোড়ায়। তিনটেতেই দু-নম্বর ঘোড়া হেরে গেল। তখন এক বন্ধু বলল কি আনাড়ির মতো পয়সা নষ্ট করেছিস? দেখেশুনে বাছাই ঘোড়ার ওপর খেল!
একটু দ্বিধায় পড়ে গেল কনিষ্ক। তখন প্রায় পনেরো টাকার মতো লস চলছে। এই দ্বিধাই তার কাল হল। পরের চারটে রেসে সে বাছাই ফেবারিট ঘোড়াগুলোর ওপর বাজি ধরতে লাগল। সবক’টাতেই হার। কিন্তু শেষ চারটে রেসে প্রতিবার জিতল দু-নম্বর ঘোড়া।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতাকে তাই বড় ভয় পায় কনিষ্ক গুপ্ত। মলির মুখে সেই অচেনা পুরুষটির প্রশংসা শুনে সে মনে-মনে খুব অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। এতকাল মলিকে নিয়ে তার কোনও ভাবনা ছিল না। খুব সহজ ছিল সম্পর্ক।
ব্যাপারটা ভালো করে বোঝাবার জন্য সে পরদিন নিজে থেকেই সেই ছেলেটির প্রসঙ্গ তুলে বলল—মলি, কাল তুমি সুব্রত নামে ছেলেটির কথা বলছিলে তার কথা শুনতে আমার বেশ লাগছিল। কেমন দেখতে বলো তো?
মেয়েরা গন্ধ পায়। মলি একবার সচকিত হয়ে কনিষ্কের দিকে তাকাল। আর মলির সেই সচকিত ভাবটুকু দেখে কনিষ্কও বেশ সচকিত হয়ে ওঠে। মানুষের দুর্বল গোপনীয় কোনও বিষয়ে স্পর্শ হলে মানুষ ওইরকম চমকে ওঠে। কেমন করে। কিন্তু মলির সে ভাবটা বেশিক্ষণ রইল না। আসলে সুব্রতর চালচলনে সে এত বেশি মুগ্ধ হয়েছে যে-সে কথা কাউকে না বলেই বা সে থাকে কী করে?
মলি বলল—দেখতে? ধরো ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে, রং একটু কালো হলেও মুখখানা ভীষণ চালাক। এত সুন্দর হাসে!
কনিষ্ক নিজে পাঁচ ফুট পাঁচ। রোগা, ফ্যাকাশে এবং ভাবুক ধরনের চেহারা। সে আবার ভীষণ অন্যমনস্কও। প্রায় সময়েই এক কথার আর-এক উত্তর দেয়। মনে-মনে নিজের পাশে সুব্রতকে কল্পনা করে সে ঘুমিয়ে গেল।
মলির সঙ্গে সেই থেকে সম্পর্কটা আর স্বাভাবিক রইল না। মাঝখানে এক অচেনা সুব্রত এসে পরদা ফেলে দিল।
পরের এক মাস কনিষ্ক নানা জ্বলুনিতে জ্বলে গেল মনে-মনে। মলি তখন প্রায় সময়েই সুব্রতর সঙ্গে প্রোগ্রাম করে। তবে সে একথা বলত—দ্যাখো, হিংসে কোরো না যেন। কোনও পুরুষই তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয় আমার কাছে।
কিন্তু কনিষ্ক সে কথা মানে কী করে? সে যে অনবরত হীনমন্যতায় ভুগছে।
তাই একদিন সে তার পরিষ্কার গোটা-গোটা হস্তাক্ষরে চিঠি লিখে মলিকে জানিয়ে দিল আমাদের আর বেশিদূর এগোনো ঠিক নয় মলি। এখানেই দাঁড়ি টেনে দেওয়া উচিত।
চিঠি লিখে সে দু-মাসের ছুটি নিয়ে বাইরে গেল বেড়াতে। এতদিনে বাড়ির লোকেরা তার বিয়ে ঠিক করল। মাত্র পনেরো দিন আগে সে সম্পূর্ণ অদেখা, অচেনা, অজানা শম্পাকে বিয়ে করেছে। বলতে কি, শম্পার সঙ্গে তার প্রথম দেখা শুভ দৃষ্টির সময়ে। ভালো করে তাকায়নি কনিষ্ক। তার মনে তখন এক বিদ্রোহ ভাব। সমস্ত পৃথিবীর প্রতি বিতৃষ্ণা, বিরাগ, ভয়।
গত পনেরো দিন সে যে শম্পার সঙ্গে খুব ভালো করে মিশেছে তা বলা যায় না। কথাবার্তা হয়েছে, পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়েছে, প্রাণপণে ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে মেয়েটির প্রতি। কিন্তু তা বলে তার মনে হতাশা ও সন্দেহের ভাবটি যায়নি। কেবলই মনে হয়, পৃথিবীর সর্বত্র তার চেয়ে বহুগুণে যোগ্যতর লোকেরা ছড়িয়ে আছে। সে একটা হেরো লোক। নিজের সম্পর্কে এইসব জরুরি চিন্তা তাকে এত বেশি ব্যস্ত রেখেছিল যে তার কাম তিরোহিত হয়, আগ্রহ কমে যেতে থাকে, শম্পা দেখতে কেমন তাও সে বিচার করে দেখেনি।
কনিষ্কর মা আজ সকালে তাকে ডেকে বললেন—খোকা, বউমা, কেন লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঁদে রে? তোর কি বউ পছন্দ হয়নি?
কনিষ্ক মুশকিলে পড়ে বলে, তা নয়। আমি তো ভালো ব্যবহারই করি।
—শুধু ভালো ব্যবহারেই কি সব মিটে যায় বাবা? পুরোনো কথা ভুলে এবার নতুন করে সব শুরু করে দাও। যাকে ঘরে এনেছ তার দিকটা এবার দ্যাখো। বউ তো ক্রীতদাসী নয়, তার মনের দিকে নজর দিতে হবে।
–কী করব মা? আমার হইচই ভালো লাগে না।
হইচই করতে হবে না, আজ বিকেলে বউমাকে নিয়ে বেড়াতে যা। দ্বিরাগমন সেরে আসবার পর দুজন মিলে তো কোথাও গেলি না দেখলাম।
অনেক ভেবেচিন্তে প্রস্তাবটা গ্রহণ করল কনিষ্ক। আসলে মলি বা সুব্রতর কথা ভাবার কোনও মানেই হয় না। কেন না এই নতুন অবস্থায় সে আর পুরোনো সম্পর্কের মধ্যে ফিরে যেতে পারে না।
সিনেমা দেখার কথা ছিল, কিন্তু টিকিটি পাওয়া যায়নি। তাই নিছক ঘুরে বেড়ানোর জন্যই দুজনে বেরিয়েছে। কথা আছে, আজ রাতে বড় কোনও রেস্টুরেন্টে দুজনে রাতের খাওয়া সেরে একেবারে বাড়ি ফিরবে।
কনিষ্ক ট্যাক্সি নিয়েছিল। টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে খানিক দূর আসতেই শম্পা বলল, শোনো, ট্যাক্সিটা এবার ছেড়ে দাও।
-কেন?
—ট্যাক্সি করে আমাদের মতো লোক বেড়াতে যায় না। মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনে ট্যাক্সি নেয়। বেরানোর জন্য ট্যাক্সি ভালো নয়।
—তবে কীসে যাবে? ট্রামে বাসে যা ভিড়!
—হোক। তবু ভিড় ভালো। কত মানুষ দেখা যায়।
কনিষ্ক নড়েচড়ে বলে, তুমি কি ভিড় পছন্দ করো? আমি করি না।
—ভিড় নয়, তবে মানুষ পছন্দ করি। ট্যাক্সির ভিতরে নিঝুম হয়ে বসে থাকাটা ভারী একঘেয়ে। কিছু দেখা যায় না, শোনা যায় না।
কনিষ্ক রাসবিহারীর মোড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
হাঁটতে-হাঁটতে শম্পা বলল, তোমাকে কিছু জিগ্যেস করতে শাশুড়ি মা আমাকে বারণ করেছেন। কিন্তু আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে।
–কী?
—তুমি এত অহংকারী কেন?
—আমি অহংকারী?
–নয়?
কনিষ্ক অবাক হয়ে বলে—মোটেই নয় শম্পা। বরং আমি ঠিক উলটোটাই সব সময়ে ভাবি। আমার মনে হয়, আমি বড় অপদার্থ পুরুষ।
—সে কী! কেন?
—আমি তো তেমন স্মার্ট নই। লম্বা চওড়া নই। আমার ভিতরে হাজার রকমের ডেফিসিয়েন্সি।
শম্পা খুব খিলিখিলিয়ে হাসে। বলে—তাই নাকি! তাহলে তো তোমাকে বিয়ে করাটা মস্ত ভুল হল!
—হলই তো।
—শোনো। ভাবতে গেলে, আমারও হাজারটা ডেফিসিয়েন্সি। নিজের দোষ কোলে করে বসে থাকলে তো জীবনটাই তেতো হয়ে গেল।
শীতকালের বেলা। ক্রিসমাসের ছুটি চলছে। হাজারটা লোক বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। অপরাহ্নের কোমল কবোষ্ণ রোদে আর ছায়ায় অপরূপ হয়ে আছে পথঘাট।
এই আলোয় আজ কনিষ্ক শম্পার মুখশ্রী খুব অকপট চোখে দেখল। তুলনা করে নম্বর দিলে। মলি আর শম্পা প্রায় সমান-সমান নম্বর পাবে। শম্পার তুলনায় মলি কিছু লম্বা ছিল, কিন্তু সেই রকম আবার মলির চেয়ে শম্পা ফরসা। মলির শরীরে কিছু বাড়তি মেদ ছিল বলে পেটে ভাঁজ পড়ত। শম্পার সেসব নেই। মলির মুখখানা ছিল গোল ধরনের। শম্পার মুখ লম্বাটে, লাবণ্য শম্পারই বেশি কারণ সে বয়সে মলির চেয়ে কম করে পাঁচ বছরের ছোট। বিএ পরীক্ষা দিয়েই। তার বিয়ে হয়েছে।
কনিষ্কর কথাটা ভালো লাগল। নিজের দোষ কোলে করে বসে থাকাটা কাজের কথা নয়।
সে বলে, আমাকে তোমার কেমন লাগে?
—আগে বলো, আমাকে তোমার কেমন?
–শোনো শম্পা, তোমাকে কেমন লাগে তা আমি এখনও ভেবেই দেখিনি।
আচমকা শম্পা বলে—মলিকে তোমার কেমন লাগত?
কনিষ্ক থমকে যায়। অনেকক্ষণ বাদে বলে, তুমি জানলে কী করে?
–তোমার মা বলেছেন।
—মা?
—মা সব বলে দিয়েছেন আমাকে। আরও বলেছেন, আমি যেন এসব তোমাকে জিগ্যেস না করি।
শ্বাস ফেলে কনিষ্ক বলে, জিগ্যেস করে ভালোই করেছ। মলিকে আমার ভালোই লাগত। শুধু শেষদিকে—
শম্পার মুখখানা ভার হয়ে গেল। কনিষ্কর মুখচোখও লাল দেখাচ্ছে। সে বড় অস্বস্তি বোধ করে বলে, এসব কথা কী ভালো?
শম্পা বলে ভালো নয়। কিন্তু আমাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যদি তৃতীয় কোনও লোক নাক গলায় তবে সেই তৃতীয় লোকটাকে জেনে রাখা দরকার।
অবাক হয়ে কনিষ্ক বলে—তুমি তো ভীষণ বুদ্ধিমতী। এত গুছিয়ে কথা বলো কী করে? মাথায় আসে?
শম্পার ভার মুখ হালকা হয়ে গেল। হেসে বলে—যাঃ।
—সত্যি বলছি, তুমি খুব ভালো কথা বলতে পারো। আমি পারি না।
শম্পা বলে, বাপের বাড়িতে আমাকে সবাই কটকটি বলে ডাকত। আমি নাকি ভীষণ কটকট করে কথা বলি।
হাঁটতে-হাঁটতে ওরা দেশপ্রিয় পার্ক বরাবর এসে গেল। গলার স্কার্ফটি ভালো করে জড়িয়ে শম্পা বলে—একটু চা খেতে পারলে বেশ হত। আজ যা শীত।
কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট। কিন্তু আজ ছুটির দিন সেখানে বেশ ভিড়। বসার জায়গা নেই।
কনিষ্ক বলে—আর একটু হাঁটি চলো। পোস্ট অফিস ছাড়িয়ে একটু এগোলে বোধহয় গাছতলায় একটা দেশওয়ালি চায়ের দোকান পাওয়া যাবে।
তাই হল। গাছতলার দোকানদার দু-ভাঁড় চা বড় যত্নে এগিয়ে দেয়। শম্পা আর কনিষ্ক দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে চুমুক দেয়।
কনিষ্ক বলে—কেমন?
–বেশ গো।
কনিষ্ক খুশি হয়ে পয়সা মিটিয়ে দেয়। বলেখিদে পেয়েছে নাকি? কিছু খাবে?
—কে খাওয়াবে? আমার তো পোড়া কপাল, কেউ পছন্দ করে না।
কনিষ্ক হেসে বলে–কটকটি, এবার কিন্তু কথা ফেইল করলে।
-কেন?
—যে চা খাওয়াল সেই খাবার খাওয়াতে পারে। আর কে খাওয়াবে?
—মলির সঙ্গে তোমার ঝগড়া হল কেন? হঠাৎ শম্পা প্রশ্ন করে।
–ঝগড়া! না, ঝগড়া হয়নি তো। ও একটা ছেলের খুব প্রশংসা করত। সেটা আমার সহ্য হত না।
—ওমা! তাই নাকি? এসব তো মা আমাকে বলেনি!
—মা জানবে কী করে? কনিষ্ক গুপ্ত বলে—মা শুধু জানত, মলির সঙ্গে আমার ভাব।
—এখন তুমি মলির কথা খুব ভাবো না? ভাববা, আমার মতো একটা বিচ্ছিরি মেয়ের সঙ্গে কেমন হট করে বিয়ে হয়ে গেল। সারাটা জীবন কেমন ব্যর্থতায় কাটবে।
কনিষ্ক খুব হতাশার ভাব করে বলে, কতগুলো ভাবনা আছে যা তাড়ানো যায় না। বিরহ ভোলা যায়, কিন্তু অপমান কি সহজে ভোলে মানুষ? কিংবা ঈর্ষা? হীনমন্যতা?
শম্পা মুখখানা করুণ করে বলে, আমাকে একটা কথা বলতে দেবে? ধরো আজ তোমার কাছে আমার খুব একটা দাম নেই। তুমি ভালোবাসতে পারছ না আমাকে। অথচ আমি তোমার কাছে কত সহজলভ্য। কিন্তু দ্যাখো, সুজন নামে একটা ছেলে আছে। তার কাছে শম্পাই হল আকাশ-পাতাল জোড়া চিন্তা। শম্পার জন্য কী জানি সে হয়তো আত্মহত্যার কথা ভাবে। পৃথিবীতে শম্পা ছাড়া বেঁচে থাকা কত কষ্টের সে জানে একমাত্র সুজন। তুমি তো কখনও জানবে না, বুঝবে না। পৃথিবীটা ঠিক এরকম নিষ্ঠুর।
চোয়াল কঠিন করে কনিষ্ক বলে, সুজন কে?
—সে একটা ছেলে। আমাকে ভালোবাসত। কোনওদিন তাকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু আজ অনাদরের মাঝখানে থেকে তার কথা খুব মনে হয়।
কনিষ্ক স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে।
. সেই রাতে শম্পা আর কনিষ্কর ভালোবাসার মাঝখানে অনেকবার মলি এসে হানা দিল, এল সুজনও। দুজনে এসে এক অদৃশ্য প্রজাপতির দুটি ডানার মতো কাঁপতে লাগল। তাতে বড় সুন্দর হল কনিষ্ক ও শম্পার ভালোবাসার নিরালা ঘরটি।