কথা
তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে টুপু।
এ কথা প্রায়ই টুপুকে বলার জন্য যায় কুশল। বলা হয় না। কী করে হবে? টুপু যে বড্ড ব্যস্ত।
কুশল কলকাতায় এসেছে চার বছর। একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং শেখানোর স্কুল থেকে সে লেদ মেশিনের কাজ শিখেছিল। তার বেশি আর কী করার ছিল তার? গাঁয়ে তার বাবা মারা গেছে, কিন্তু চাষবাসের জমি আর অল্প-অল্প কিছু জীবনবিমার টাকা পেয়েছিল। তাও ভাগীদার অনেক। বিধবা মা আছে, এক দাদা আর-এক ভাই আছে, ছোট একটা বোনও। দাদা চাষবাসও দ্যাখে, সেই থেকেই সংসার চলে। কুশল কলকাতায় এসেছিল ভাগ্যের অন্বেষণে। তেমন কিছু হয়নি তার। তবে মাথাটা পরিষ্কার বলে সে মেশিনের কাজ খুব তাড়াতাড়ি শিখে নেয়। কিন্তু কাজ পাবে কোথায়? মূলধনও নেই যে ব্যাবসা করবে। সেই ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের মালিক সুধীর ভদ্র তখন তাকে ডেকে বলে—তোমার তো বেশ পাকা মাথা, কাজ না পেলে আমার এখানেই শেখাতে লেগে যাও বাপু, হাতখরচ পাবে, থাকার জায়গাও দেব।
এক অনিচ্ছুক মামাবাড়িতে প্রায় জোর করে থাকত কুশল। তারা তাড়াতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কুশল বড় মিষ্টভাষী আর সৎ চরিত্রের বলে একেবারে ঘাড় ধাক্কা দিতে পারছিল না। কিন্তু কুশলের বড় লজ্জা করত। থাকার জায়গা পেয়ে সে এবার উঠে এল হ্যারিসন রোডের স্কুলের বাড়িতেই।
তো এই হচ্ছে কুশলের অবস্থা। একশো টাকার কাছাকাছি তার রোজগার। থাকার জায়গার ভাড়া লাগে না, নিজে বেঁধে খায়। কষ্টে তার চলে যায়। তবে কুশল সবসময়েই জীবনের আলোকিত দিকগুলোই দেখতে পায়। যেন জগৎ সংসারকে দুভাগ করে একটা সৌভাগ্যের আলো আর দুর্ভাগ্যের অন্ধকার পাশাপাশি রয়েছে। অন্ধকারে যারা আছে তারা আলোর দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে, আবার আলো থেকে অন্ধকারেও কাউকে-কাউকে চলে আসতে হয়। কুশল তাই কখনও হাল ছাড়ে না। কিছু হবে, কিছু একটা হবে। হবেই।
তাই এই অন্ধকারের জীবনে ফুলগন্ধের মতো, জ্যোৎস্নার মতো একটাই আনন্দ আছে। সে হল টুপু।
তাদের গাঁয়ের পুরুতবাড়ির মেয়ে ছিল। বড় সুন্দর দেখতে। কত ছোট্ট ছিল। টুপু এখন কলকাতায় এসে খুব অন্যরকম হয়ে গেছে। খুব অল্প আয়াসেই টুপু তার দুর্ভাগ্য জয় করে আলোর দিকে চলে গেছে। সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে তার খুব নামডাক। তার অনেক ভক্ত, অনেক চাহিদা।
কুশলের তাতে কিছু যায় আসে না। সে মাঝে-মাঝে টুপুদের হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে যায়। টুপুর মা আছে, বাবা আছে, একটা ভাইও আছে। তারা এখন সব বড়লোকের মতো থাকে। ছোট্ট বাগান ঘেরা তিনতলা বাড়ি, গেটে দারোয়ান, শিকলে বাঁধা কুকুর, হুট বলতে ঢোকা যায় না।
তবু কুশল ঠিকই ঢোকে। আর আটকায় না। ওরা যে তাকে অনাদর করে তা নয়, উপেক্ষাও করে না। আবার খুব একটা আদর অ্যাপায়নও নেই।
যেমন ওর বাবা বলে—ওঃ কুশল! কী খবর?
মা বলে—কী বাবা, কেমন! খবর সব ভালো?
তার পরই আর তেমন কথাটথা হয় না।
কুশল দেখতে খুব সুন্দর নয়, আবার খারাপও নয়। সিনেমার নায়ক হিসেবে তাকে মানায় না ঠিকই, কিন্তু রাস্তায় ঘাটে দু-চারজন তার দিকে তাকিয়ে দেখে। মেশিন চালিয়ে তার চেহারা মেদহীন এবং পোক্ত। মুখশ্রীতে বুদ্ধি এবং অসম্ভব ভালোমানুষির ছাপ আছে। সুধীরবাবু টাকাপয়সার বিষয়ে চোখ বুজে তাকে বিশ্বাস করেন।
টুপুর সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়। বেশিরভাগ সময়েই তাকে বাইরে থাকতে হয়, নয়তো বাড়িতে ঘুমোয়, নয়তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করে। তবু দেখা হলে সে-ই সবচেয়ে আন্তরিক ব্যবহার করে। বলে—কুশলদা, আজ বাড়িতে খেয়ে যেও। তোমার দাদা কী করছে এখন? মা কেমন আছে? পুন্তিকে অনেককাল দেখি না। তার তো বিয়ের বয়স হল।
পুন্তি কুশলের ছোটবোনের নাম। এসব টুপুর মুখে শুনতে বড় ভালো লাগে।
কুশল বড় লাজুক। টুপুর সুন্দর মুখখানার দিকে ভালো করে চাইতে পারে না। মাথা নত করে বলে—আমরা বড় গরিব হয়ে গেছি টুপু।
টুপু বলে—আহা, কী কথা। গরিব হওয়া কি অপরাধ নাকি! এই বলে সান্ত্বনা দেয় টুপু। কখনও বলে তোমার যদি টাকার দরকার হয় তো নিও কুশলদা, লজ্জা কোরো না।
—না, না, টাকার দরকার নয় টুপু। এই মাঝে-মাঝে তোমাদের দেখে যাই শুধু। বেশ লাগে।
—দেখে যেও। আমাদেরও ভালো লাগে। তুমি যেন কী করো কুশলদা?
—একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্নে ইনস্ট্রাকটর।
—ও বাবা, সে তো ভালো চাকরি! বলে টুপু ভ্রূ তোলে।
মিথ্যে কথা বা ফাঁপানো কথা কুশলের মুখে আসে না। তাই সে টুপুর ভুল ধারণা ভাঙার জন্য তাড়াতাড়ি বলে—না, না, সে খুব ছোট্ট একটা কারিগরি স্কুল, আর ইনস্ট্রাকটর বলতে
কিন্তু অত কথা শোনার সময় টুপুর প্রায়ই হয় না। হয়তো চাকর এসে খবর দেয় যে গাড়ি তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। কিংবা ছুকরি একটা সেক্রেটারি এসে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আসল কথাটাই বলা হয় না।
অবশ্য কথাটা যে কী তা আজও ভালো জানে না কুশল। কেবল তার মন বলে—তোমার সঙ্গে আমার যে অনেক কথা ছিল টুপু।
.
দুই
একবছর আর তেমন অবসর পেল না কুশল। সুধীরবাবুর স্কুল থেকে একটা পুরোনো মেশিন কিস্তিবন্দিতে কিনে নিয়েছিল সে। হাওড়ায় একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করে ব্যাবসা শুরু করেছিল। লাভ-লাভের দিকে তাকায়নি, ভূতের মতো খেটে সে সুধীরবাবুর টাকা শোধ করে দিল সময়ের আগেই। আরও একটা মেশিন কিনল। আরও একটা।
ব্যাবসা শুরু করলে বহু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায়। সেইরকম এক যোগাযোগে সে এক কালোয়ারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। কিছু টাকা লাগায় তার লোহার কারবারে, বেশ কিছু লাভ পেয়ে যায়। একবছরের মধ্যে তার গা থেকে হাঘরের ভাবটা ঝরে গেল।
টুপুর বাড়িতে একদিন মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে দেখা করতে গেল।
টুপুর বাবা ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তার মা খুব বিষণ্ণ মুখে একটু খবরাখবর নিলেন। বললেন বাবা, আর তো দেখি খোঁজ নাও না!
—সময় পাই না পিসি। বড্ড কাজ। অভাব দূর করার চেষ্টা বড় মারাত্মক, হাড়মজ্জা শুষে নেয়।
—সে তো জানি বাবা। তবু বলি, অভাবই ভালো। প্রাচুর্য মানুষকে বড় অমানুষ করে দেয়। কথাটার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু পরিষ্কার বুঝল না কুশল।
—সুখে থেকো, সৎ থেকো। এই বলেন টুপুর মা।
টুপুর সঙ্গে দেখা হল না। সে ঘুমোচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত।
সেই কথাটা আজও টুপুকে বলা হয়নি। কী কথা তা অবশ্য সে নিজেও জানে না। হয়তো সে বলতে চায়—তুমি খুব সুন্দর টুপু। কিংবা—আমি তোমাকে ভালোবাসি টুপু।
বলেই বা কী হবে? এসব তো কত লোকেই টুপুকে বলে। তবু বলতে ইচ্ছে করে কুশলের।
লোহার ব্যাবসা খুব ভালো লাগছিল না তার। একেই অংশীদারি তার পছন্দ নয়, তার ওপর আয় এক জায়গায় উঠে আটকে যায়। তাই সে মূলধন তুলে নিয়ে লিলুয়ায় নিজের মতো ছোট্ট ঢালাইয়ের কাজ শুরু করল। লোহার বড় টানাটানি বাজারে। মাল দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। টাকাও আসে। তবু ঠিক খুশি হতে পারে না সে। একটা কাটিং মেশিন নিলামে কিনল। পাঁচ রকম ব্যাবসার কাজে টাকা ঢালতে লাগল। বড় ভাই চাষবাস নিয়ে রইল বটে, কিন্তু ছোট ভাইটাকে আনিয়ে নেয় কুশল। দুই ভাই মিলে সাংঘাতিক খাটে।
টুপুর বাড়িতে যেতে সেদিন দেখা হয়ে গেল।
—আরে কুশলদা, কেমন আছ? তোমাকে খুব অন্যরকম দেখাচ্ছে।
না-না। দাড়ি কামিয়েছি তো, তাই।
—তার চেয়ে কিছু বেশি। বলে টুপু হাসে—তোমার উন্নতি হচ্ছে বোধহয়। চেহারায় ছাপ পড়েছে।
কুশল বলে—তোমার চেহারা একটু খারাপ দেখছি টুপু। কী হয়েছে?
–কী হবে? বড্ড ডায়েটিং করতে হয়। খাটুনিও তো খুব!
—আজকাল তোমার ছবি বড় একটা দেখি না তো।
–হচ্ছে। অনেক হচ্ছে। এই বলে টুপু খুব অস্থিরতা আর চঞ্চলতার সঙ্গে একটা সিগারেট ধরায়।
ভীষণ অবাক হয় কুশল। চেয়ে থাকে।
—কিছু মনে কোরো না কুশলদা। নার্ভের জন্য খাই। আমার নার্ভ বচ্চ সেনসিটিভ, ধোঁয়ায় একটু শান্ত থাকে।
—বেশি খেও না। দমের ক্ষতি হয়। খুব ভালো আর শান্ত গলায় কুশল বলে।
—বেশি না। মাঝে-মাঝে খাই, নেশা-টেশা নেই।
আসলে নেশাই। কুশল সেটা টের পায়।
টুপুর মা দেখা হতে অনেকক্ষণ অন্য কথা বলে তারপর বলেন—বাবা, পেটের মেয়ে, পণ্ডিত বংশের সন্তান, বলতে নেই টুপু আজকাল মদও খায়। ভীষণ মাতলামি করে। কাউকে বোলো না।
অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে কুশল বলে—পিসি, খায় তো খাক। তুমি বেশি ঝগড়া-টগড়া কোরো এ নিয়ে। ওর কাজের স্ট্রেন তো হয়, তাই খায়। ওকে রেস্টোরেটিভ বলে, মদ-খাওয়ায়।
—তুমি বাবা, সব কিছুর ভালো দ্যাখো। আমি দেখি না। ছেলেটাও সিনেমার লাইনে ঢুকবে ঢুকবে করছে। বারণ করি, শোনে না।
কুশল আবার ভেবে বলে—টুপুর বুঝি আর তেমন চাহিদা হচ্ছে না পিসি? আজকাল ওকে নিয়ে ছবি হয় না তো।
—হয় না তো কী করবে! জীবনে ওঠা-পড়া আছেই। আমি বলি, এবার ভালো আর সৎ দেখে পাত্র খুঁজে বিয়ে করে ফেলুক। সিনেমার নটী সাজা ঢের হল। ওদের বামুন-পণ্ডিতের বংশের রক্তে কি ওসব সয়!
ভাবতে-ভাবতে কুশল চলে আসে।
স্কুলে থাকতে কবিতা পড়েছিল, সন্ন্যাসী উপগুপ্তর সঙ্গে বাসবদত্তার প্রেম হয়েছিল বুঝি! তো টুপুর সঙ্গে একদিন কি তার সেরকমই হবে?
হতেও পারে।
তিন বছরের মাথায় কুশল দেখল, তার অনেক টাকা। শুধু হয়েছে নয় আসছেও।
ঢালাইয়ের কারখানার জায়গা বদল হয়েছে। ছোট্ট কিন্তু বেশ ভালো একটা ফাউন্ড্রি খুলে। ফেলেছে দুই ভাই। দেশের বাড়ি মস্তবড় করে করেছে। পুকুর কাটা হয়েছে। চাষের জমিও কিনেছে অনেক। দাদা সেসব দেখাশোনা করছে। কাজের সুবিধের জন্য একটা গাড়ি কিনে ফেলেছে কুশল।
সেই গাড়িতে একদিন গেল টুপুর বাড়ি।
টুপু সব দেখে বলল—কুশলদা, তুমি সত্যিই উন্নতি করেছ।
—আরে না, না। কোম্পানির গাড়ি।
—ওই হল। কোম্পানি তো তোমারই।
কুশল লজ্জা পায়। বড়লোকি দেখাতে সে তো আসে না। সে আসে টুপুকে একটা কথা বলবে। বলে।
আজও বলা হয়নি।
.
তিন
টুপু একজন প্রডিউসারকে বিয়ে করল, কুশল খবর পায় এক পত্রিকায়।
গিয়ে দেখে মা খুব খুশি নয়।
বললেন—দোজবরে বাবা, আগের বউকে বিদেয় করেছে। তা টুপুকেই কি রাখবে। বড় ভয় করে। বড়লোকি বিয়ে আমার একদম পছন্দ নয়। বিয়ে ওরা করে না। আসল বিয়ে হয় মধ্যবিত্ত পরিবারে।
পিসি বলেছিল অদ্ভুত।
ওরা হানিমুন করতে জাপান না কোথায় গিয়েছিল। ঠিক তিন মাস বাদে ফিরে এসেই টুপু তার বরকে ডিভোর্স করে।
খবর পেয়ে ছুটে গেল কুশল।
–কী হল টুপু? বিয়ে ভেঙে দিলে?
—দিলাম। ওর হৃদয় নেই।
—আগে জানতে না?
–জানতাম। তবু ঢুকে দেখলাম আছে কি না।
—ঢুকতে গেলে কেন টুপু? শরীরটা খামোখা এঁটো করলে।
মুখ ফসকা কথা। কুশল জিভ কাটল।
কিন্তু টুপু রাগ করল না। খুব অন্যমনস্ক হয়ে বলল—ঠিক বলেছ। এঁটো হয়ে এলাম। তবে অনেক টাকা পেয়েছি।
কুশল বলল—ভালো। টাকাগুলো রেখো। অসময়ে টাকা মানুষকে খুব দেখে। টুপু এই প্রথম কাঁদল কুশলের সামনে।
বলল টাকা আর নাম আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে কুশলদা। তুমি তো উন্নতি করেছ, আমি যদি কখনও রাস্তার ভিখিরি হয়ে যাই তো কিছু ভিক্ষে দিও।
–ছিঃ টুপু, ওকথা বোলো না। টাকা রেখো। আর দরকার হলে নিও আমার কাছ থেকে। লজ্জা কোরো না।
–বড় লজ্জা কুশলদা। বড় লজ্জা।
আলোর পৃথিবী এগিয়ে আসছে।
কুশল বুঝতে পারে, সে নিজে সৌভাগ্যের আলোর চৌকাঠে পা রেখেছে, কিন্তু টুপুর সঙ্গে সেখানে দেখা হওয়ার নয়। কারণ টুপু আলোর জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়ে চলে আসছে দুর্ভাগ্যের অন্ধকার জগতে, সে-ও সেই যাত্রাপথে অন্ধকারের চৌকাঠে পা রেখেছে, ঠিক এই সীমানায় তাদের প্রথম পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা।
আজও বলতে পারল না কুশল। কিন্তু মন বলল—তোমার সঙ্গে আমার যে একটা খুব গোপন কথা আছে টুপু।
আজকাল কুশলের সময় বড় কম। কলকাতার ব্রাবোর্ন রোডে তার নতুন শোরুম আর সেলস অফিস চালু হল। তার ওপর আবার জাপানি একটা কোম্পানির সঙ্গে কোলাবরেশনে চাষের যন্ত্র লাঙল তৈরি করবে বলে সে গেল জাপান। ওই পথে দূর-প্রাচ্যের সব দেশ দেখে এল। কারখানা খোলার জায়গা পেল কলকাতার কাছেই। বড্ড পরিশ্রম গেল ক’দিন। বয়সও তো প্রায় সাঁইত্রিশ আটত্রিশ হয়ে গেল। এখন শরীর না হোক মনটা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মা বিয়ের তাগাদা দেয়। কুশল রাজি হয় না। ছোট বোনের বিয়ে দিল বড়লোকের বাড়িতে। সেই বিয়েটা আসলে একটা
অলিখিত চুক্তি। আত্মীয়তার সূত্রে যাদের পেল তারা সমাজের ওপরতলার ভালো সব। যোগাযোগের মধ্যমণি। এইসব বুদ্ধি এখন মাথায় খুব খেলে কুশলের।
কিন্তু তবু ক্লান্তি তো ছাড়ে না। যোধপুরের প্রকাণ্ড বাড়িতে ফিরে যখন কখনও অবসর কাটায় তখন বড় একা আর ক্লান্ত লাগে। মেয়েলি স্পর্শ জীবনে বড় দরকার। মেয়েরা হল পুরুষের বিশ্রাম, একটু সৌন্দর্য, আশ্রয়।
কিন্তু বিয়ে করবে কী করে কুশল? সেই কথাটা যে আজও টুপুকে বলা হয়নি। তাই সে ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। অনেকদিন ধরেই এক সরকারি হর্তাকর্তা তাঁর মেয়েকে কুশলের ঘরে দেওয়ার জন্য অস্থির। কুশল তাঁকে তাই বিমুখ করল না। নিজে বিয়ে না করে ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিল।
আজও বড় লাজুক কুশল, এখনও যতদূর সম্ভব সৎ ও সচ্চরিত্র। এখনও তার চেহারায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অসম্ভব ভালোমানুষির ছাপ রয়ে গেছে।
খুব সকালবেলায় একদিন একটা পুরোনো গাড়িতে টুপু এসে তার বাড়ির সামনে নামল। খুবই কুণ্ঠিত আর লজ্জিত ভঙ্গিতে এল ভিতরে।
বলল—তুমি কী ভীষণ বড়লোক হয়ে গেছ! কী করে হলে?
লজ্জিত কুশল বলে শোনো টুপু, ওসব কথা বোলো না। মেয়েরা টাকাপয়সার কথা বললে আমার ভালো লাগে না।
টুপু শ্বাস ফেলে বলে—আমার খবর জানো?
–জানি টুপু, তুমি আজকাল একদম কন্ট্রাক্ট পাচ্ছ না। খবর নিয়ে জেনেছি, তুমি অনেক টাকা চাও বলে কেউ তোমাকে ছবিতে নেয় না! তার ওপর তুমি শুটিংয়েও যাও না ঠিকমতো।
টুপু শ্বাস ফেলে বলে—আরও আছে। আমি নাকি নতুন নায়কদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছি। প্রায়ই নাকি ইউনিট থেকে তাদের কাউকে নিয়ে ইচ্ছেমতো চলে যাই ফুর্তি করতে। এসব শোনোনি?
—শুনেছি।
বোগাস এর কিছুই সত্যি নয় কুশলদা। এখন আমি ঘর থেকে মোটেই বেরোই না। অন্ধকারে বসে-বসে কাঁদি।
—কেন কাঁদো টুপু। তোমার দুঃখ কী?
—বোঝো না? মানুষ যখন গুরুত্ব হারায়, যখন নিজের ধর্ম থেকে, ভিত থেকে নড়ে যায় তখন যে দুঃখ তার তুলনা নেই।
—বাজে কথা টুপু। তুমি গরিব বামুনের মেয়ে। তোমার ধর্ম বলো, ভিত বলো, গুরুত্ব বলো, তার কিছুই তো তুমি পাওনি। যা পেয়েছিলে, যে অর্থ যশ ও গুরুত্ব, তা তোমার পাওনা জিনিস ছিল না। একটু ভেবে দ্যাখো।
—তবে কী আমার পাওনা ছিল?
কুশল ভেবে বলে—বোধহয় ভালোবাসার মানুষের জন্য কষ্ট করার তৃপ্তিই মানুষের সবচেয়ে বড় পাওনা।
—ও বাবা, তুমি খুব কথা শিখেছ আজকাল। শিখবেই, বড়লোক হয়েছ তো। বড়লোকদের সব কথা বলবার অধিকার আছে।
কুশল যন্ত্রণায় কাতর স্বরে বলে—না টুপু। আমাকে বড়লোক বোলো না। আমি চেষ্টা করেছি মাত্র। চেষ্টাই মানুষের জীবন। বিষয়ের পরিবর্তনে মনের পরিবর্তন কি সবার হয়?
—আমি অত বুঝি না কুশলদা। আমি বলতে এসেছি আমি একটা ছবি প্রডিউস করব। টাকা দাও। শেষবার একটা চেষ্টা করে দেখি।
—দেব। কুশল বিনা দ্বিধায় বলে।
.
চার
উপগুপ্ত আর বাসবদত্তার কবিতাটার শেষে যা ছিল, তাই বুঝি ঘনিয়ে আসে। ছবিটা একদম চলল না। কুশল জানত, তাই টাকাটাকে খরচের খাতায় ধরে রেখেছিল।
প্রেস শো-তে তার পাশেই বসে ছিল টুপু। বলল—চলবে না, না গো কুশলদা?
কুশল খুব দুঃখিত মনে মৃদুস্বরে বলে—বোধহয় না।
—কেন কুশলদা? আমি তো আমার সর্বস্ব দিয়ে অভিনয় করেছি, গল্পটাও ভালো ছিল। সবই চেষ্টা করেছি।
কুশল তেমনি মৃদুস্বরে বলে—টুপু, কেন এত করলে? এর চেয়ে অনেক কম কষ্টে সুখী হওয়া যেত জীবনে।
বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে টুপু একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে এখন। একা-একা। মা আর ভাই আলাদা থাকে। তাদের সঙ্গে বনিবনা হয় না টুপুর।
তার সেই অ্যাপার্টমেন্টে বিরাট পার্টি দিয়েছে টুপু তার জন্মদিনে। কুশলকেও নিমন্ত্রণ করেছে। কুশল সময় পায় না, তবু সময় করে গেল পার্টিতে।
গিয়ে দেখে, ফ্ল্যাটটা একদম ফাঁকা। রাশি-রাশি খাবার সাজানো টেবিলে, ঘরদোরে প্রচুর আলো, সাজগোজ। তবু কেউ নেই। এমনকী একটা বুড়ি ঝি ছাড়া অন্য কাজের লোকও কেউ নেই। টুপু একটা সাদা খোলের তাঁতের শাড়ি পরে এলোচুলে জানলার ধারে বই পড়ছে। মুখটা ম্লান, কিন্তু প্রসাধনহীন বলে তার সেই কৈশোরের কমনীয়তাটুকু ফুটে আছে।
কুশল অবাক হয়ে বলে—কী হল, লোকজন সব কই?
টুপু বই বন্ধ করে হেসে উঠে আসে, বলে—লোকজন! তারা আবার কারা? কাউকে বলিনি তো? শুধু তোমাকে।
—তাহলে এত আয়োজন দেখছি কেন?
টুপু অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে কুশলের মুখের দিকে। তারপর খুব গভীর একটা শ্বাস ফেলে বলে —শোনো, আমি জীবনে দেদার পার্টি দিয়েছি। পার্টির শেষে যখন সবাই চলে যায়, তখন এঁটো বাসন, শূন্য মদের বোতল, ভাঙা কাচ, দলিত ফল সব পড়ে থাকে। ঘরটা বীভৎস লাগে। মনে হয় পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে। তাই আজ কাউকে বলিনি।
—আমাকে যে বললে!
—তুমি! ওঃ, তোমার কথা আলাদা। আজ আমরা দুজনে পার্টি করব। আর আমাদের চারিদিকে শূন্য চেয়ার, ফাঁকা ঘর, আর নির্জনতা থাকবে। কুশলদা, তোমার একার জন্যই আজ পঞ্চাশজনের আয়োজন। তুমি সব এঁটো করে, নষ্ট করে যাও। আমি দেখি।
—পাগল। কুশল বলে।
—আমি পুরুষকে লজ্জা পেতে বহুকাল ভুলে গেছি। কিন্তু জানো আবার আমার খুব ইচ্ছে করে লজ্জা করতে। আমাকে একটু লজ্জা দাও কুশলদা।
—পাগল! কুশল হেভরে বলে।
—শোনো, তুমি ভাবছ আমি মদ খেয়েছি। না গো, এই দ্যাখো, শঁকে দ্যাখো মুখ। বহুদিন হল ছেড়ে দিয়েছি। এই বলে ছোট্ট সুন্দর মুখখানা হাঁ করে কাছে এগিয়ে আনে টুপু।
কুশল ওর মুখের বাতাস কল। কী সুন্দর গন্ধ! ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে।
টুপু শ্বাস ফেলে মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল—আজ আমার জন্মদিন কুশলদা। তুমি আমাকে কী দেবে?
সোনার একটা গয়না এনেছে কুশল! কিন্তু সেটা বের করল না। একটু ভাবল। তারপর বলল —টুপু, বহুকাল হয় তোমাকে একটা কথা বলার চেষ্ট করেছি। আজ তোমাকে সেই কথাটা বলি বরং। সেইটেই জন্মদিনের উপহার বলে নিও।
–কথা! বলে টুপু হাঁ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ বলে—এতদিন বলেনি কেন?
—সময় হয়নি। কথারও সময় আছে টুপু।
টুপু হেসে মাথা নীচু করে লজ্জায়। তারপর অল্প একটু শ্বাসকষ্টের সঙ্গে বলে—আজ বুঝি সময় হয়েছে?
—হ্যাঁ। খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এবার বলি। টুপু…
টুপু দু-হাতে কান চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে—পায়ে পড়ি, বোলো না, বোলো না তো! বললেই ফুরিয়ে যাবে।
—বলব না? কুশল অবাক।
টুপু স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে হাসল। বলল—সারা জীবন ধরে ওই কথাটা একটু-একটু করে বোলো। কথা দিয়ে নয়, অন্যরকম ভাবে।
Happy endings are rare in short stories by sirshendu Mukhopadhyay.