বাঘ
এইখান দিয়ে একটু আগে একটা বাঘ হেঁটে গেছে। নরম মাটিতে এখনও টাটকা পায়ের দাগ। বাতাস শুকলে একটু বোঁটকা গন্ধও। বাঘটা শুধু যে বেড়াতে বেরিয়েছিল, এমন নয়। ফেরার পথে বাজারও করে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ বুড়ো হরিচরণের একটা বাছুরও নিয়ে গেছে মাঠ থেকে। তাই কাদা মাটিতে বড়-বড় রক্তের চাপ পড়ে আছে। জেলির মতো জমে গেছে। হ্যাট মাথায় কয়েকজন হাফ প্যান্টপরা শিকারি ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝোপে ঝাড়ে। বিটাররা নদীর ধারের জঙ্গলের ওপাশ থেকে টিন, ঘণ্টা আর যা পেয়েছে সব বাজাতে-বাজাতে আসছে। একজন পাইপ মুখে। শিকারি বন্দুকটা ধাঁ করে মাঝখানটায় ভেঙে কার্তুজ পরীক্ষা করে নিল, তারপর ফড়াক করে আবার সোজা করল বন্দুক। সবাই তৈরি।
বাঘটা সেবার বেরোয়নি। কিন্তু বহুকাল আগের দেখা এই দৃশ্যটা আজও ভুলতে পারে না জোনাকিকুমার।
বাঘটা বেরোয়নি বলে কি আজও এইরকম অপেক্ষা করছে সে?
মাঝদুপুরে আজ বৃষ্টি নামল। তারপরই হঠাৎ থেমে গেল। আবার নামল, আবার থেমে গেল। বৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে তাল রেখে জোনাকিকুমারও এক-একবার এক-একটা বাড়ির সদরে বা লবিতে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবং এইভাবে সে ময়দানের কাছে একটা আঠারো তলা অফিস বিল্ডিংয়ে পৌঁছেছে সীতানাথের সঙ্গে দেখা করবে বলে। দেখা হল না। সীতানাথ তেরোতলায় বসে। শুনল সে আজ ফুটবল খেলা দেখতে গেছে। জোনাকি একটু হতাশ আর নিঃসঙ্গ বোধ করে। সীতানাথকে পেলে কদমের মেস-এ গিয়ে তাস পেটানো যেত। হল না। কিন্তু তেরোতলা থেকে একঝলক ময়দান দেখে সে বড় অবাক হয়ে গেল। এ-বাড়িতে সীতানাথের অফিস সদ্য উঠে এসেছে, এই প্রথম সীতানাথের অফিসে এসেছে জোনাকি। তেরোতলা থেকে ময়দান সে আর কখনও দেখেনি। কী আশ্চর্য সবুজ! বিশ্বাস হয় না। কলকাতা নয়, ঠিক বিলেত বলে মনে হয়। ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালটা পর্যন্ত চেনা বলে মনে হয় না। নীচে চৌরঙ্গির রাস্তা, টিকিওলা ট্রাম যাচ্ছে, ভোঁতা ডবলডেকার গাড়ি—সবই অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। ছিমছাম এক ইউরোপের শহর যেন। ময়দান এত সুন্দর জানা ছিল না তো!
জোনাকি আবার লিফটে নেমে এল। আগাগোড়া বাড়িটা এয়ারকন্ডিশন করা, ভেজা গায়ে শীত করছিল। বেরোবার মুখে দেখল, ফের বৃষ্টি নেমেছে। নামুক। জোনাকির কোথাও যাওয়ার নেই। এ ব্যাপারটা সে আজকাল মাঝে-মাঝে টের পায়। কোথাও যাওয়ার নেই। এত কম লোকের সঙ্গে তার চেনাশোনা।
বছর দুই আগে তার একজন সুন্দরী প্রেমিকা ছিল, তিতির। দু-বছর আগে তিতিরের কাছে যাওয়ার ছিল। তখন ভোরে ঘুম ভাঙতেই মনে হত—তিতির। অফিস ছুটি হলেও মনে হত— তিতির। ছুটির দিন কাছে এলেই মন বলত—তিতির। তখন যাওয়ার জায়গা ছিল। দু-বছর আগে তিতিরের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকেই জোনাকির জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে।
খুব মনোযোগ দিয়ে কর্তব্যনিষ্ঠ বৃষ্টি পড়ছে। গাছপালা, মানুষজন, চাষ-আবাদ সবই দেখতে হয় বৃষ্টিকেই। শেষ বর্ষায় সে তাই বকেয়া কাজ মিটিয়ে দিচ্ছে। সবাই দাঁড়িয়ে অফিসের মুখটায়। তার মধ্যে জোনাকিও। তার কোনও জায়গার কথা মনে পড়ছে না, বৃষ্টির পর যেখানে গিয়ে খানিকক্ষণ সময় কাটানো যায়। তাই সে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। বিটাররা বাজনা বাজাচ্ছে, শিকারিরা বন্দুক হাতে তৈরি। বাঘটা কি বেরোবে?
তা জীবনে মাঝে-মাঝে বাঘ বেরোয়। জোনাকিরও বেরিয়েছিল। যে মফসসল শহরে সে বাঘ দেখতে শহরতলি ছাড়িয়ে নদীর ধারের গাঁয়ে গিয়েছিল, সেই শহরের একটা ইস্কুল থেকে সে স্কুল ফাইনালে দশম স্থান অধিকার করে। পড়াশুনোয় অবশ্য বারবরই ভালো ছিল সে, ফার্স্ট হত ক্লাসে। পরীক্ষাও ভালোই দিয়েছিল। কিন্তু তা বলে দশম? নিজেই সে বড় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এবং সেই ঘটনার পর সবাই জোনাকির দিকে তাকাল ভালো করে। দারুণ জিনিস আছে তো। ছেলেটার মধ্যে।
আর সেইটেই ছিল জোনাকির অস্বস্তির কারণ। তার ভিতরে যে তেমন কিছু নেই এটা সে হাড়ে-হাড়ে টের পেত। মুশকিল হল, একবার দশম হয়ে গেলে পরে আর রেজাল্ট খারাপ করা যায় না, লোকে হাসবে! তাই জোনাকি খুব খেটে আইএস-সি দিল। ফার্স্ট ডিভিশনটাও হল না। তারপর থেকে সে হাঁফ ছেড়ে সাদামাটা হয়ে গেল। বিএস-সিতে পিওর ম্যাথমেটিকসে সেকেন্ড ক্লাস অনার্স পেল, এমএস-সি পড়ল না। চাকরি পেয়ে করতে লাগল।
সেই টেনথ হওয়ার কথা ভাবলে আজকাল ভারী লজ্জা করে। কেন যে সে টেনথ হতে গেল! ওই একবার টেনথ হওয়ার ফলে সবাই পরবর্তী জোনাকিকে দেখে দুঃখ করে। বলে তোমার ব্রিলিয়ান্ট ক্যারিয়ার হওয়ার কথা ছিল হে জোনাকি, এ তুমি কী হলে? এরকম দুঃখ মাঝে-মাঝে জোনাকিরও হয়।
কেউ-কেউ বলে সায়েন্স না পড়ে আর্টস পড়লেই জোনাকি ভালো করত। কিন্তু তা জোনাকির মনে হয় না। সে তো সেই আইএস-সি পড়ার সময় থেকেই বিস্তর খোঁজখবর রাখত। ই ইজ ইকুয়াল টু এমসি স্কোয়ার, আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত ইকুয়েশন পর্যন্ত জানা ছিল তার। এনার্জি ইজ ইকুয়াল টু মাস টাইমস দি স্পিড অফ লাইট স্কোয়ারড। ক’জন জানত তা? বিএস-সি বই থেকে সে অঙ্ক কষত ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে। তবু পারা গেল না। আসলে বোধহয় জীবনে ওই একটাই ভুল করেছিল সে, স্কুল ফাইনালে দশম হয়ে। সেটা না হলে আজ কারও দুঃখ থাকত না। তার নিজেরও না।
যে চোখ বাঁধা ম্যাজিসিয়ান এতক্ষণ এলোপাতাড়ি তীর ছুড়ছিল মাটিতে, সে এবার তার খেলা থামিয়েছে। বৃষ্টি ধরল। না ধরলেও ক্ষতি ছিল না। জোনাকির কোথাও যাওয়ার নেই।
বেরোবার মুখে একজন বয়স্ক লোক পাশাপাশি হেঁটে আসছিল। বলল—এরকম বৃষ্টির কোনও মানে হয়? বলুন তো?
জোনাকির মনে হয় মুখটা চেনা-চেনা। সে বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ।
লোকটা তার দিকে চেয়ে একটা চেনা-হাসি দিয়ে বলে—সীতানাথকে খুঁজতে এসেছিলেন? ওর ভীষণ ফুটবলের নেশা।
জোনাকি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে বলে—আপনি কি ওর অফিসে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। দেখেছেন আমাকে, মনে নেই বোধহয়। কিন্তু আপনাকে আমি চিনি, সীতানাথের কাছে মাঝে-মাঝে পুরোনো অফিসে আসতেন। তখন থেকেই চিনি। আপনি তো জোনাকি সেনগুপ্ত স্কুল ফাইনালে
—আজ্ঞে হ্যাঁ। জোনাকি তাড়াতাড়ি বলে লোকটাকে কথা শেষ করতে দেয় না।
–সীতানাথকে তো পেলেন না, এখন কোনদিকে যাবেন?
—ভাবছি। বলে জোনাকি।
—ভাবাভাবির আর কী? চলুন আমার বাসায় চলুন।
জোনাকি অবাক, বলে—আপনার বাসায়? লোকটা অমায়িক হেসে বলে বেশিদূর নয়। বেকবাগান। আমার ছেলেমেয়েরা কখনও স্ট্যান্ড করা ছাত্র দেখেনি। আপনাকে দেখলে খুব ইমপেটাস পাবে। চলুন না, সবাই খুব খুশি হব আমরা।
হঠাৎ জোনাকি রাজি হয়ে গেল, বলল—চলুন।
.
দুই
তিতিরের মাথায় নানারকম রান্নার পোকা ঘুরে বেড়ায়। যেমন আজ সন্ধেবেলা তিতির একটা অদ্ভুত রান্না করল, ডিমের সঙ্গে বেগুন দিয়ে ওমলেট। তার নাম দিল—ডিমবেগ। পাতলা করে কাটা বেগুনের চাক ফেটানো ডিমে ভিজিয়ে ডোবা তেলে ভাজা। মন্দ নয় খেতে, একটা চেখে দেখল তিতির। তেলটা বড্ড বেশি লাগে।
ভেবে একটু ভ্রূ কোঁচকায় তিতির। বেশি তেলের ব্যাপারটা তাকে খোঁচা দেয়। বাস্তবিক, এই তেল-টেল নিয়ে ভাবতে তার একদম ভালো লাগে না। ভাবার অবশ্য দরকার নেই। তার সংসারে অভাবের ছিটেফোঁটাও নেই, বরং সবই অঢেল আছে। আসছেও। কিন্তু তবু বেশি তেল লাগার ব্যাপারটা তাকে তার বাপের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানে এখনও তার আত্মীয়রা তেল, চাল ইত্যাদির ব্যাপারে বড় সতর্ক। সেই মানসিকতা আজও একটু রয়ে গেছে তিতিরের।
ফেটানো ডিম আর বেগুনের চাক সরিয়ে রেখে রান্না করার লোক চিত্তর দিকে তিতির তাকাল। সে রান্না করছে বলে চিত্ত এতক্ষণ সরে দাঁড়িয়ে অন্য কাজ সেরে নিচ্ছিল।
তিতির বলল—খাওয়ার সময় ওগুলো ভেজে দিও।
চিত্ত ঘাড় নাড়ে। তিতির চলে আসে।
কী বিশাল এই ফ্ল্যাটবাড়িটা! হাঁটলে যেন জায়গা ফুরোয় না। এক লাখের কাছাকাছি দাম পড়ল ফ্ল্যাটটার। তার ওপরে মেইনটেনেন্স চার্জও অনেক পড়ে যায় প্রতি মাসে। এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। তবু হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় কতগুলো টাকা!
এ-দেওয়াল ও-দেওয়াল জুড়ে জানলা। খুলে দিলে ঘরটা বারান্দা হয়ে যায়। সাত তলার ওপর থেকে নীচের দিকে তাকায় তিতির। এত ওপরে থেকে অভ্যাস নেই তো। মাথা ঘোরে। জানলাগুলোয় কেন যে ছাই গ্রিল দেয়নি ওরা! অমিতও অবশ্য গ্রিল লাগাতে রাজি নয়, বলে— গ্রিল দিলে খাঁচার মতো হয়ে যাবে। কিন্তু তিতিরের ভয় করে। আকাশটা যেন হাত বাড়িয়ে রয়েছে। একতলা পর্যন্ত বিশাল শূন্যের ব্যবধান যেন ক্রমাগত জানলা দিয়ে তাকে ডাকে— এসো, লাফিয়ে পড়ো।
তিতির সরে আসে। লাফিয়ে পড়ার কোনও কারণ নেই। তার জীবনে কোনও দুঃখ আছে?
অমিত দ্বিতীয়বার আমেরিকা থেকে ফেরার সময়ে একটা মস্ত টেলিভিশন সেট নিয়ে এসেছে। সামনের ঘরে সেটা রাখা, ওপরে পুতুল, ফুলদানি। এখনও অবশ্য টেলিভিশনের পরদা অন্ধকার। কলকাতায় টিভি চালু হলে তারা দেখবে সেই আশায় আগে থেকে এনে রেখেছে। অমিত। বিদেশ থেকে আনা কত কী তাদের ঘরে!
তিতিরের মুখখানা ছিল সুন্দর। বয়সকালে শরীরটা দেখনসই হয়েছিল। তার জোরেই না অসম্ভব ভালো পাত্র জুটে গেল তার! তিতির আয়না দেখল না, কিন্তু টিভি সেটের সামনে একটা গদির হেলানো চেয়ারে বসে নিজের মুখখানার কথা, সৌন্দর্যের কথা ভাবতে লাগল।
দু-বছর হয়ে গেল, অমিত এখনও ছেলেপুলে চাইছে না। কিন্তু পুরুষমানুষের ছেলেপুলের ঝোঁক থাকেই। কবে বলবে—তিতির এবার ছেলে দাও।
যতদিন তা না চায় অমিত, ততদিন তিতির বেশ আছে।
না, খুব ভালো অবশ্য নেইও তিতির। ওই যে শিকহীন গ্রিলহীন মস্ত জানলাগুলি, ও গুলোকেই ভীষণ ভয় তার। দিনের বেলায় রোদভরা আকাশ, রাতে আকাশভরা জ্যোৎস্না বা অন্ধকার, নক্ষত্ররাশি, হাওয়া সব কেমন হুহু করে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে! ঘরটা যেন বাহির হয়ে যায়! একা থাকে তিতির। ওপরের ফ্ল্যাটে বা পাশের ফ্ল্যাটে কোনও শব্দই হয় না, কারও গলার স্বর কানে আসে না, নীচের রাস্তাটাও নির্জন—সেখান থেকে এত ওপরে কোনও শব্দ উঠে আসে না। আর এই গভীর নিস্তব্ধতায় ওই খোলা জানলা দিয়ে হাতির মতো ঢুকে আসে বাইরেটা। ভীষণ হুহু করে ঘরদোর। হাতিটা তার গুঁড় দিয়ে সব উলটেপালটে দেখে, এঘর ওঘর খুঁজে বেড়ায়, বলে—খুব সুখী তুমি তিতির।
সুখীই তিতির। শুধু ওই খোলা জানলাগুলোই তাকে দুঃখ দেয়। আগে ছেলেপুলে হোক, তখন অমিতকে বলবে গ্রিল দিতে। ছোট খোকা হামাগুড়ি দেবে, হাঁটতে শিখবে, ডিং মেরে জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি দেবে—মাগো তখন যদি পড়ে যায়? খোকার জন্য তখন ঠিকই গ্রিল দিতে রাজি হবে অমিত। কিন্তু এসব বাড়িতে গ্রিল দেওয়ার নিয়ম আছে কি না কে জানে! হয়তো কোম্পানি থেকে বলে দেবে যে, গ্রিল-ট্রিল চলবে না, তাতে বাড়ির সৌন্দর্য থাকে না। তখন ওই বাইরের হাতিটা চিড়িয়াখানার হাতির মতো জানলার ওপাশে আটকে থেকে শুড় দুলিয়ে বলবে— খুব সুখী তুমি তিতির!
তিতির উত্তর দেবে–হ্যাঁ হাতিভাই, আমি খুব সুখী। তুমি মাঝে-মাঝে এসে আমাকে দেখে যেও।
বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসে না। না আসাই স্বাভাবিক। ওরা আসতে ভয় পায়। সংকোচ বোধ করে। বড় বড়লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে যে তিতিরের। সবসুদ্ধ তিন বোন তারা। তিতির ছোট। বড় দুই দিদির ভালোই বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু তারা এখন সূর্যের পাশে মাটির পিদিম হয়ে। গেছে।
এসব ভাবতে বুকে একটু দুঃখ আর একটু সুখ, দুটি ঢেউ ভাঙে।
টুং করে কলিং বেল-এ পিয়ানোর একটা রিডের শব্দ ওঠে। রোজ এরকম শব্দ। দরজায় একটা কাচের চৌখুপি আছে। সেইটি দিয়ে দরজা খোলার আগে দেখে নেয় তিতির। হ্যাঁ, অমিত।
অমিত ঘরে আসে। আগে আগে দরজার কাছেই সর্বাঙ্গ দিয়ে চেপে ধরত তিতিরকে, মুখের সর্বত্র চুমু খেয়ে নিত। আজকাল খায় না। অত কী? রোজ তো খাচ্ছেই অন্য সময়ে।
অমিত ঘরে ঢুকে বলে—আজও?
তিতির চমকে বলে—কী?
—তুমি ম্লানমুখী।
তিতির লজ্জা পেয়ে বলে—না। জানো, আমি না ওই জানলাগুলোর কথা ভাবছিলাম। বড্ড ভীষণ ফাঁকা।
—ওঃ! আমি ভাবি, বুঝি তিতির তার কোনও পুরোনো প্রেমিকের কথা ভাবছে।
তিতির রাগ করে বলে—ভাবছি তো! সে এসে ওই জানলা দিয়ে ডাকে। একদিন ঠিক ঝাঁপ দেব।
অমিত একটু বেঁটে, কালো, একটু মোটাও। ইদানীং মেদ কমানোর জন্য স্লিমিং কোর্স নিচ্ছে। অফিসের পর সেখানে যায়। আলু মিষ্টি খায় না। কত খাবার বানায় তিতির। ও খায় না। কেবল একটুআধটু ড্রিঙ্ক করে। ওর বেহিসেবি হলে চলে না। কত কাজ ওর!
—আজ একটা নতুন খাবার করলাম মাথা খাঁটিয়ে।
–কী?
–ডিমবেগ। খেতে বসে দেখবে, আগে বলব না, কী দিয়ে তৈরি হয়েছে।
অমিত হেসে বলে—তোমার সেই নিরামিষ ডিমের কারিটা যেন কী দিয়ে করেছিলে?
—কেন, খারাপ হয়েছিল? ডিমের বাইরের সাদাটা করেছিলাম ছানা দিয়ে, আর ডালসেদ্ধ দিয়ে কুসুম।
—বেশ হয়েছিল। তবে কিনা ওসব বেশি খেলে আমার আবার না ফ্যাট বাড়ে।
—তা বলে না খেয়ে শরীর দুর্বল করে ফেলবে নাকি? ওসব চলবে না। ঘরভরতি এত খাবার, খায় কে বলো তো?
.
তিন
ভদ্রলোকের নাম শচীন দাশগুপ্ত। ছেলেমেয়েদের সামনে জোনাকিকে দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন—এই ইনি স্কুল ফাইনালে–
জোনাকি লজ্জা পায় আজও। বাঘটা একবার বেরিয়েছিল, তারপর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জোনাকিকে শচীনবাবু তাঁর ঘরের সবচেয়ে ভালো চেয়ারে বসালেন, এমনভাবে বসালেন যাতে মুখে ভালোভাবে আলো পড়ে। তাঁর চার-পাঁচজন ধেড়ে-ধেড়ে ছেলেমেয়ে হাঁ করে দেখছিল, গিন্নিও এলেন। এক বুড়ো আত্মীয় কেউ এসেছেন, তিনি বাক্যহারা। স্ট্যান্ড করা ছেলে। ইয়ার্কি নয়।
কেবল জোনাকিই জানে—এটা কত বড় ইয়ার্কি। তবু খারাপ লাগে না। শচীনবাবুর বড় মেয়েটি যুবতী। সে বেশ চেয়ে থাকতে জানে। জোনাকির খারাপ লাগছিল না।
বুড়ো আত্মীয়টি জিগ্যেস করেন— কী করেন?
—চাকরি।
—আ হা, চাকরি করেন কেন? ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা এডুকেশন লাইনে থাকলে ছাত্ররা কত কী শিখতে পারে! বড় চাকরির লোভে কত ভালো ছেলে নিজেকে নষ্ট করে, দেশও বঞ্চিত হয়।
—আমি বড় চাকরি করি না। সামান্য কেরানি।
—সে কী? বলে শচীনবাবুর আত্মীয় চেয়ে থাকেন।
শচীনবাবু একটু মলম লাগানের চেষ্টা করে বলেন—তাতে কী? উনি টেনথ হয়েছিলেন সেটা কি তা বলে মুছে গেছে? বোর্ডের খাতায় তো আর নামটা মুছে ফেলেনি। যাকে বলে দশজনের একজন।
—তা বটে। বলে আত্মীয়টি নিজেকেই সান্ত্বনা দিলেন বোধহয়।
জোনাকির লজ্জা করছিল। পরিষ্কার বুঝতে পারল, শচীনবাবুর মেজো ছেলে তার মায়ের কাছে পয়সা নিয়ে দোকানে গেল খাবার আনতে। শচীনবাবুর বড় মেয়ে জোনাকিকে একটুও অপছন্দ করছে না। কেবল আত্মীয়টি উঠে বললেন—চলি। রাত হল। কেউ তাকে থাকতে বলল না।
কথাবার্তা তেমন কিছু হল না। কী করে হবে, এদের সঙ্গে যে মোটেই পরিচয় নেই। তা ছাড়া টেনথ হওয়া ছেলে। মুখ ফসকে বেশি কথা বলা ভালোও দেখাবে না। মিষ্টি খেয়ে উঠে পড়ল জোনাকি।
শচীনবাবু আর তাঁর স্ত্রী বললেন—আবার আসবেন। খুব ভালো লাগল।
শচীনবাবুর বড় মেয়ে নিমি আলাদা করে বলল—আসবেন কিন্তু। আগে খবর দেবেন, আমার বন্ধুরাও আসবে দেখতে।
জোনাকির বড় লজ্জা করছিল। বাঘটা মোটে একবার–
বেরিয়ে এসে জোনাকি দেখল, এখনও মোটেই রাত হয়নি। বাড়ি গিয়ে কিছু করার নেই। বাবা সাত সকালে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মা বড়মেয়ের বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করছে। সাঁঝ ঘুমোনী ছোট বোনটা বিবিধ-ভারতী চালিয়ে শুয়ে আছে। বড্ড ছোট বাসা।
ওই বাসায় তিতিরকে মানাত না। তার চেয়ে বরং শচীনবাবুর বড় মেয়েকে বেশ মানায়। ভাবতেই হঠাৎ চমকে ওঠে জোনাকি। তাই তো! শচীনবাবুরা দাশগুপ্ত না! পালটি ঘর। তবে কি শচীনবাবু ভেবে-চিন্তে প্ল্যান মাফিক জোনাকিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে? আশ্চর্য নয়। হয়তো অফিসের গেট-এ তাকে দেখেই শচীনবাবুর মাথায় কল্পনাটা খেলে থাকবে। কেরানি হোক আর যা-ই হোক, এক সময়ের টেনথ হওয়া ছেলে তো!
ভাবতেও জোনাকির লজ্জা করছিল। এ হয় না। ওই টেনথ হওয়ার জন্যই এক সময়ে তিতিরও তাকে পছন্দ করেছিল। পরে, ভুল বুঝতে পারে। বাঘটা একবারই
খুব একটা সুন্দর রাস্তা দিয়ে এখন হাঁটছে জোনাকি। এসব রাস্তায় তো বড় একটা আসা হয়। চারদিকে বিশাল বিশাল নির্জন সব অ্যাপার্টমেন্ট হাউস উঠেছে, আরও কিছু বাড়ির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। হুশ করে একটা দুটো মোটরগাড়ি চলে যায়। আর কোনও শব্দ নেই। কারা থাকে এখানে? শিকারি, না বাঘ?
বৃষ্টি এল। উপায় কী, জোনাকি দৌড়ে গিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় উঠে পড়ল। আসলে দরজাও ঠিক নয়, মস্ত গ্যারেজ ঘরের ফাঁকা জায়গা। দারোয়ান বসে বৃষ্টি দেখছে আর খইনির থুতু ফেলছে। তার দিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। জোনাকি দাঁড়িয়ে অজস্র ঝিকিয়ে ওঠা অস্ত্রের মতো বৃষ্টির ধার দেখে। কিছু করার নেই। তবে অপেক্ষা করতে তার মন্দ লাগে না। কোথাও তো যাওয়ার নেই। সেই দু-বছর আগে, যখন তিতির ছিল, তখন যাওয়ার জায়গা ছিল। তিতিরই তো একটা জায়গা। কত সুন্দর সব দৃশ্য ছিল তিতিরের নানা ভঙ্গির মধ্যে লুকিয়ে।
সেই ভীতু বাঘটা কেন কোনওদিনই বেরিয়ে এল না? কেন গভীর জঙ্গলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে রইল চুপ করে? ওইভাবেই লুকিয়ে বসে রইল চুপ করে? ওইভাবেই লুকিয়ে থেকে সে কি মরে গিয়েছিল একদিন? কেন গর্জন করে বেরিয়ে আসেনি? সত্য বটে শিকারিরা ছিল, তাদের হাতে ছিল কার্তুজ-ভরা রাইফেল। কিন্তু এও তো সত্য যে ছিল অবারিত মাঠ, বিশাল পৃথিবীর মুক্তিও। সে উত্তাল গতিতে বেরিয়ে ছুটে চলে যেতে পারত, সেই মুক্তির দিকে। শিকারির গুলি কি সব বাঘের গায়ে লাগে। লাগলেই বা কী, তবু তো বুঝতে পারত, তার মৃত্যুও কারও-কারও প্রয়োজন! তাই অত শিকারির আনাগোনা, অত সতর্ক দৃষ্টি অত ক্যানেস্তারা পেটানো। কত গুরুত্ব তার!
একটা গাড়ি কেমন চমৎকার সবুজ। কী বিশাল তার চ্যাপটা আর সবুজ দেহখানি। গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকল। একজন লোক নেমে চলে গেল লিফটের দিকে। ফিরেও তাকাল না। হতে পারত জোনাকিও ওরকম। যদি কেবলমাত্র দশম হওয়াটুকু বজায় রাখতে পারত সে। কেন পারেনি, তা আর একবার ভাববার চেষ্টা করল সে। ভেবে দেখল, পারেনি বলেই পারেনি। বড় বেশি সচেতন হয়ে গিয়েছিল নিজের সম্পর্কে। মফসসলের স্কুলে এক গরিবের ছেলের অতটা হওয়ার কথা নয় তো! বড্ড বেশি পড়ত, তাতেই মাথা গুলিয়ে গিয়ছিল বোধহয়। কিংবা কী যে হয়েছিল এতদিন পর তা আর মনে পড়ে না।
যদি হত তবে জোনাকিকুমার আজ এরকম একটা মস্ত ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতে পারত, গাড়ি চালাত। তার বউ হত তিতির বা ওরকমই কেউ। খুব সুন্দর। এই বৃষ্টি বাদলার পৃথিবীতে কেবলই পথ ছেড়ে উঠে এসে পরের দরজায় দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে বৃষ্টি দেখতে হত না। বেশ সুখেই থাকত এক সফল জোনাকিকুমার। নিমির মতো হাঘরে মেয়েরা তাদের তুচ্ছ ঘর-সংসারে। তাকে ডাক দেওয়ার সাহসই পেত না।
এত বৃষ্টি! ঝড়ের হাওয়ার সমুদ্র থেকে উঠে আসে মেঘ। পরতে-পরতে আকাশ ঢেকে দিচ্ছে। রাস্তায় প্রতিহত জলকণা উঠে চারদিক ঝাপসা করে দেয়। চেনা পথ ধুয়ে যায় বৃষ্টিতে, ঘরে ফেরার দিকচিহ্ন উড়িয়ে নিয়ে যায় ঝড়। আজও মনে হয়, এই দুর্যোগেও কোথাও যাওয়ার নেই জোনাকির। এই তো বেশ দাঁড়িয়ে আছে। কেটে যাচ্ছে আসলে খানিকটা সময়। জোনাকির সময়ের অভাব নেই। সে যদি সফল জোনাকি হত তো থাকত। কত ব্যস্ততা, কত টেলিফোন, কত নানাজনের ডাক। সেসব নেই জোনাকির। মস্ত বাড়ির তলায় নীচু গ্যারাজ ঘরে এই কেমন ছোট্টটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি পড়ছে। অনেকগুলো গাড়ি চলে এল গ্যারেজ ঘরে। কত গাড়ি! দারোয়ান উঠে আলো নেভাচ্ছে। এরপর দরজা বন্ধ করবে। তার আগে হয়তো বা চলে যেতে বলবে জোনাকিকে। সে বড় অপমান। এ-বাড়িতে তার ঘর নেই ঠিকই, কিন্তু তা বলে কোনও জায়গা থেকে কেউ চলে যেতে বললে আজও অপমান বোধ করে সে।
জোনাকি তাই বৃষ্টিতেই নেমে এল। কী প্রবল ধারা। গায়ে ছ্যাক করে শীতের ছোঁয়া লাগল প্রথমে। তার ফাঁকা মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা ডুগডুগ করে বেড়ে উঠল। লক্ষ আঙুল দিয়ে বৃষ্টি তাকে। চিহ্নিত করে বলতে থাকে—ছিঃছিঃছিঃছিঃ!
কোথাও যাওয়ার নেই। তবু যাওয়া থেকেই যায় মানুষের। কেন যে যায়! থেমে পড়লেই তো হয় মাঝপথে! কেন কেবল যেতেই হবে?
রাস্তায় লোকজন নেই। একা জোনাকি হেঁটে চলেছে। চোখ অন্ধ ও শ্রবন বধির করে দিয়ে অনন্ত বৃষ্টিপাত হয়ে যেতে থাকে। পোশাক চুপসে যায়। কাঁপুনি উঠে আসে শরীরে। ভিজে ভিজে হাঁটে জোনাকি। চারদিকে মেঘ ডাকছে। একটা বজ্রপাতের শব্দ হয়। জোনাকি একবার বলে— জানোনা তো, তুচ্ছ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কীরকম আনন্দ আছে!
কাকে বলে কে জানে!
.
চার
—ওগো শোনো, কী ভীষণ ঝড় উঠল। তিতির ভয়ের গলায় বলে।
তাকে বুকে টেনে নিয়ে অমিত বলে—ঝড়! তাতে কী? এ-বাড়িতে কোনও ভয় নেই তো তিতির!
–বড্ড হাওয়ার শব্দ হচ্ছে যে!
—এত ওপরে একটু বেশি হাওয়া তো লাগবেই। কিছু ভয় নেই। আমার তো ইচ্ছে করে এই ঝড়ের মধ্যে বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়ে পড়ি। খোলা হাওয়া বৃষ্টির জল আমাকে ধুয়ে মুছে দিক।
—আহা।
—সত্যিই। খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু তুমি তো যেতে দেবে না।
—দেব না-ই তো!
—জানি। বড্ড রুটিন হয়ে গেছে জীবনটা।
রুটিন না হলে চলে? তোমার কত কাজ! তিতির ওকে একটু আদর করে বলে। একটু ড্রিঙ্ক করেছিল অমিত। বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু তিতিরের আর ঘুম আসে না। সে উঠে এয়ারকুলার বন্ধ করে দিল। ঠান্ডা লাগছে।
একটু ধূসর পরদায় জানলাগুলো ঢাকা। পরদা নড়ছে না। কিন্তু বাইরে হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে ঝোড়ো বাতাস। কাচের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা এসে অবিরল টোকা দেয় গোপন প্রেমিকের মতো। তিতিরকে ডাকে।
উঠতেই হয় তিতিরকে। একটা বাজ পড়ল কোথায়। বাড়িটা তার অজস্র কাচের শার্সি নিয়ে ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। ঘুম আসবে না। এরকম ঝড়বৃষ্টির রাতেই ভালো ঘুম আসে লোকের, কিন্তু তার আসবে না।
তিতির পরদাটি সরিয়ে দেখে, কলকল করে জলস্রোত নেমে যাচ্ছে শার্সি বেয়ে। নীচে একটা ডাইনির শহরযত না তার আলো তত বেশি ভূতুড়ে অন্ধকার। বাড়ি-ঘর সব যেন নুয়ে গেছে, গাছপালা হয়ে গেছে কাল্পনিক গাছের ছবির মতো, আলোগুলো বৃষ্টিতে দিপদিপ করে। এত উঁচু থেকে সবই মনে হয় বড় দূরের। মাঝখানে শূন্য। আর এই গভীর রাত্রে শার্সি ভেদ করে সেই শূন্যটা ঘরের মধ্যে চলে আসতে থাকে।
বাতি জ্বেলে টিভি সেটটার মুখোমুখি বসে এসে তিতির। হাই তোলে। অমিতের জন্য একটা সোয়েটার বুনছিল, সেইটে নিয়ে বসে।
হাতিটা ভেজা গায়ে সামনে দাঁড়ানো, বলে—খুব সুখে আছ তুমি তিতির।
—হ্যাঁ হাতিভাই। কেবল ওই জানলার গরাদ লাগানো বাকি। সেটা হয়ে গেলে আর কী চাই!
—সেটা লাগাতে খুব বেশি দেরি কোরো না তিতির। কী জানি, কবে তোমাকে আমি চুরি করে নিয়ে যাই জানলা দিয়ে।
—ও কথা বোলো না হাতিভাই। আমি তো কোনও পাপ করিনি যে মরব। বরং এত সুখে থেকেও আমি কখনও আর দশজনের কথা ভুলি না। গত রবিবারে আমরা আমাদের ক্লাবের পক্ষ থেকে ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিয়ে এলাম। শিরাতে চুঁচ ফুটিয়ে কত রক্ত বের করে নিল বলো তো! অনাথ আতুরদের জন্য যে ফান্ড খোলা হয়েছে তাতে আমরা প্রতি মাসে অনেক টাকা দিই, মাঝে-মাঝে কালেকশনে বেরোই। মূক-বধিরদের জন্য অন্ধদের জন্য, আমরা সব সময়েই ব্যথিত। যা পারি, যতখানি পারি করি। সুখী বলেই স্বার্থপর ভেবোনা আমাদের।
হাই উঠছে। ঘুমে ঢুলে আসছে চোখ। তবু ঘুমোতে গেলেই কী একটা হয়। এই ঝড় জলের রাতটা তার দুর্যোগ নিয়ে কেবলই ঢুকে আসে ফ্ল্যাটে। কেন যে এত বড় জানলা করেছে এ বাড়িতে। কোনও মানে হয় না। আকাশ ঢুকে পড়ে, বাতাস ঢুকে পড়ে। শূন্যতাও বেড়াতে আসে নির্লজ্জ প্রতিবেশীর মতো, এসে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তিতিরের সুখ-দুঃখের খতিয়ান নিয়ে যায়, বিশ্রী। অমিত কিছুতেই তিতিরের একটা কথা শুনতে চায় না। ও কি বোঝে না যে জানলায় একটা প্রতিরোধ দরকার! ভীষণ দরকার!
টিভি-র পরদাটা ঢালু, তার আলোহীন কাচে কোনও ছবি দেখা যায় না। কবে যে কলকাতায়। টিভি চালু হবে! শোনা যাচ্ছে, ওয়ার্ল্ড টেবিল টেনিস দেখাবে এবার। তাহলে কিছুদিনের জন্য বাঁচা যায়। স্নেহভরে একবার চমৎকার সেটটার দিকে চেয়ে থাকে তিতির।
হাতিটা এখনও যায়নি বুঝি! তিতিরকে ডেকে বলল-বলো তো সুখ কাকে বলে!
—সুখ! বলে তিতির ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। বলে কী জানি বাবা! তোমার সব শক্ত-শক্ত প্রশ্ন। তবে মনে হয়, যার কখনও পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে না, যে কখনও অতীত নিয়ে ভাবে না, অনুতপ্ত বা দুঃখিত হয় না, যে কেবল প্রতিটি বয়ে যাওয়া মুহূর্তকে অনুভব করে সেই সুখী।
উঠে ফের বাতি নিভিয়ে দেয় তিতির। বাইরে যে আজ কী প্রলয়কাণ্ড হচ্ছে! মাগো, গরিব দুঃখীদের বড় কষ্ট।
—তোমার কিছু মনে পড়ে না তিতির?
হাতিটা তবে এখনও যায়নি! তিতির ভ্রূ কুঁচকে বলে—ওঃ! হ্যাঁ চেষ্টা করলে আবছা সব মনে পড়ে। মনে পড়লে ভীষণ হাসি পায়।
–কীরকম?
—এই ধরো না, আমি একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করতাম। সে স্কুল ফাইনালে টেনথ হয়েছিল। তারপর আর কিছু হয়নি। মনে পড়ে খুব একটা প্রেম হয়েছিল। ভারী মজার নাম ছিল তার জোনাকি!
অন্ধকার হাতড়ে-হাতড়ে শোওয়ার ঘরের দিকে চলেছে তিতির। আর একা-একা খুব হাসছে। এত হাসি পায়। জোনাকি! কী নাম বাবা।
শাওয়ার ঘরে এসে একটু চমকে যায় তিতির। পরদাটা সরানো। মস্ত জানলা কে অমন। আদুড় করে দিল? বাইরে একটা ধূসর পাগলা ঝড়। মুহুর্মুহু কাচের শার্সিতে করাঘাত করছে এসে এক মহাশূন্য। বাতাস আকাশ। শার্সি জুড়ে এক বিশাল পরদার টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে এক মহাজগতের মহাপ্রলয়।
শিউরে ওঠে তিতির। ও মা! জানলার একটা ধারের ছোট্ট একটা পাল্লা কে কখন খুলে দিল। বৃষ্টির প্রবল ছাঁট আসছে, বাতাস ঘুর্ণির মতো পরদাটাকে ওড়াচ্ছে কোণের দিকটায়। তিতির জানলার কাছে দৌড়ে গেল। কিন্তু পাল্লার কাছে পৌঁছাতে পারল না। সেই আদিম পাগল ঝড়টা তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল—সরে যাও, সরে যাও, আমি তোমার ঘর তল্লাশি করতে এসেছি।
তিতির ভয় পেয়ে সরে আসে।
বিছানায় একটা হালকা চাদর গায়ে চাপা দিয়ে শুতে গিয়েই ফের ভীষণ চমকে ওঠে। অমিত কোথায় গেল?
—ওগো! বলে ভয়ার্ত তিতির উঠে বসে। কোনও উত্তর আসে না। বাইরে হোহো করে হেসে ওঠে বাতাস। আকাশ বাঘের মতো ডেকে ওঠে শিকার খুঁজে পেয়ে।
—কোথায় গেলে তুমি?
অন্ধের মতো তিতির উঠে অন্ধকার ঘরে ঘুরতে থাকে। ঘরের একধারটা ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টিতে, বাতাসে। ওই রন্ধ্রপথে বারবার বাহির চলে আসে ঘরের মধ্যে। ঘরটাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় বাইরে। আব্রু নষ্ট করে। অমিতকেও কি নিয়ে গেল?
ককিয়ে কেঁদে ওঠে তিতির। ও একটু আগেই বলেছিল, ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ওর চলে যেতে ভালো লাগে। তিতির ভীষণ চিৎকার করে বলে—এত তাড়াতাড়ি আমার সব কেড়ে নিও না। ওগো, কে তুমি বারবার আসো ঘরের মধ্যে? দয়া করো।
মস্ত ঘরের এককোণে একটু ছোট্ট দেশলাই কাঠির তিনকোণা আগুন জ্বলে ওঠে। অমিত বলে —তিতির, আমিও তোমাকে খুঁজছি। এয়ারকুলারটা বন্ধ করে দিয়েছ, দমবন্ধ লাগছিল, তাই একটা পাল্লা খুলে দিয়ে বসে আছি।
—ডাকোনি তো! তিতির চোখ মুখে, কান্না গিলে হেসে ফেলে।
অমিত চুপ করে থাকে। তারপর বলে–সবসময়ে ডাকতে নেই তিতির। মানুষের মাঝে মাঝে একদম একা হওয়া দরকার। আমিও দেখোনা, একা বসে ঝড় দেখছি কখন থেকে!
তিতির কাছে গিয়ে বলে—কেন গো?
—ওঃ তিতির। কী প্রকাণ্ড এই আকাশ, কী বিরাট শূন্যতা চারদিকে। আর কী ভয়ংকর শক্তিমান ঝড়। এ-সব দেখলে নিজেকে তুচ্ছ লাগে বড়। মাঝে-মাঝে, নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে কী যে আনন্দ হয়!