৭-৯. ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা এখন কোলকাতায়। পরদিন সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে বাঁধানো বেঞ্চে বসে মুগ্ধ গলায় বললো জয়।

বহরমপুর থেকে ভোরে ট্রেনে উঠে দুপুরেই কলকাতা পৌঁছে গেছে ওরা। কাসেদ আলী ওদের সার্কুলার রোডের এক উঁচু পাঁচিলঘেরা বাড়িতে রেখে বিকেলে ফিরে গেছে। বলেছে, চারদিন পর ওদের নেয়ার জন্য ও নিবারণের বাড়িতে অপেক্ষা করবে। এখান থেকে ওদের বহরমপুরে নিবারণ দাসের বাড়ি পৌঁছে দেয়া হবে।

টুপুলরা যে বাড়িতে উঠেছে সেটার নাম সুভদ্রা ভিলা। নাজমুলের বিজনেস পার্টনার প্রতুল সাহার বাড়ি। নাজমুলের চিঠি পড়ে ওদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালো প্রতুল। প্যাকেট দুটো পেয়ে মনে হলো প্রতুল বুঝি বিশ্ব জয় করেছে। নাজমুলের বয়সী হবে, গায়ের রঙ শ্যামলা, রুক্ষ চেহারা, স্পোর্টসম্যানদের মত ছিপছিপে পেটা শরীর। হেসে বলেছে, তোমরা যখন নাজমুলের বন্ধু হতে পেরেছো আশা করি আমিও তোমাদের বন্ধু হতে পারবো। এটা তোমাদের নিজের বাড়ি মনে করবে। এ যাত্রা অবশ্য চারদিনের বেশি থাকতে পারছে না। তবু কলকাতার যা কিছু দেখার আছে সবই শ্যামল তোমাদের দেখিয়ে দেবে। এই বলে প্রতুল ওর ড্রাইভার শ্যামলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। বাইশ-তেইশ বছরের শ্যামল দেখতে একটু চালবাজ মনে হলেও কথা বললো খুব বিনয়ের সঙ্গে, দাদাবাবুরা কি এখন বেরোবেন, না কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন?

বিশ্রামের কি আছে? জয় বললো,প্রতুলদার যদি অসুবিধে না হয়…

আমার কোন অসুবিধে হবে না। ব্যস্ত গলায় প্রতুল বললো, আমার আরেকটা গাড়ি আছে, নিজে চালাই। শ্যামলকে রাখাই হয়েছে গেস্টদের জন্য। তোমরা যত খুশি বেড়াও। ইচ্ছে হলে বাইরে খেতে পারো। বাড়িতেও খেতে পারো। নাজমুলের মত আমিও ব্যাচেলার। ঠাকুরকে শুধু বলে দিও কখন কি খেতে চাও। আমাকে সব সময়। নাও পেতে পারো।

প্রতুলের আতিথেয়তায় মুগ্ধ দুই কিশোর-অতিথিকে সবার আগে শ্যামল চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। তারপর বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম দেখিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর সামনে এসে বসেছে।

তাজমহলের এই ক্ষুদে সংস্করণ দেখে দুচোখ ভরে গেছে টুপুল আর জয়ের। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সামনের ফোয়ারাগুলোতে নানা রঙের আলোর ধারা এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে গেছে ওদের। শ্যামল এরই ভেতর আগামী চারদিনের ভ্রমনসূচি তৈরি করে ফেলেছে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চত্বরে বসে বাদাম খেতে খেতে শ্যামল বললো, আজ রাতে তাহলে আমরা বাড়িতে খাচ্ছি না। পার্ক স্ট্রিটে পাঞ্জাবীদের একটা ফাইন রেষ্টুরেন্ট আছে। ওরা বলে ধাবা। টুপুলদাদা জয়দাদা নিশ্চয় পাঞ্জাবী খানা কখনো খাওনি?

ঢাকায় কোথায় পাবো পাঞ্জাবী ধাবা? হেসে বললো টুপুল। জয় মনে মনে মনে বললো, থাকলেও কি কিনে খাবার সামর্থ আছে আমাদের?

শ্যামল বললো, তোমাদের সিনেমা দেখতে ভালো লাগে?

লাগে না আবার! উত্তেজিত গলায় টুপুল বললো, ভিসিআর-এ বোম্বের অনেক হিন্দি ছবি দেখেছি।

সঞ্জয় দত্তের ছবি ভালো লাগে?

সঞ্জয় আমার ফেভারিট।

সঞ্জয়ের একটা নতুন ছবি রিলিজ হয়েছে। নাইট শোতে দেখবে ওটা?

নাইট শো কটায় শুরু হয়?

সাড়ে আটটায়। শেষ হতে হতে এগারোটা বেজে যাবে।

দেরিতে বাড়ি ফিররে প্রতুলদা যদি তেমার ওপর রাগ করেন?

দাদা কখনো আমার ওপর রাগ করেন না। তোমরা দাদার বিশেষ অতিথি, নাজমুল দাদার বন্ধু। তোমরা খুশি হলে দাদাও খুশি হবেন।

তাহলে নাইট শো দেখা যেতে পারে। জয় কি বলিস? তোর ঘুম পাবে না তো?

পাগল হয়েছিস? গদগদগলায় বললো জয়।

পাঞ্জাবীদের ধারায় তন্দুরি চিকেন, পনির মটর আর কাবাব দিয়ে রাতের খাবার সারলো ওরা তিনজন। তারপর প্যারাডাইস সিনেমায় সঞ্জয় দত্তের দারুণ এক ফাইটিং ছবি দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌনে বারোটা।

নিচের তলার ড্রইংরুমে অচেনা এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলো প্রতুল। ওদের সামনে ছোট টেবিলে মদের বোতল আর গ্লাস। টুপুলদের দেখে গলা তুলে প্রতুল বললো, হাই ফ্রেন্ডস, কেমন বেড়ালে?

মেনি থ্যাংকস প্রতুলদা! টুপুল উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, ছবি পর্যন্ত দেখা হয়ে গেছে।

প্রতুল হেসে বললো, ছবি দেখার আইডিয়াটা নিশ্চয় শ্যামলের।

আইডিয়া ওর হলে কি হবে–আমরা বোম্বের ছবি দারুণ পছন্দ করি।

শ্যামল আমার এক সত্তর বছরের কানাডিয়ান গেস্টকে সঞ্জয় দত্তের ফ্যান বানিয়ে ছেড়েছে। যাবার সময় ও সঞ্জয়ের যত ভিডিও ক্যাসেট বাজারে পেয়েছে সব কিনে নিয়ে গেছে। বলে হা হা করে হাসলো প্রতুল।

টুপুল আর জয় হাসিমুখে ওদের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। প্রতুলের বাড়িটাকে বাইরে থেকে বেশ পুরোনো মনে হলেও ভেতরে আরাম-আয়েশের সব ব্যবস্থাই আছে। দুপুরে কাজের ছেলে হরি ওদের ঘর, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং রুম, বাথরুম সব দেখিয়ে দিয়েছে। শ্বেত পাথরে বাঁধানো বিরাট বাথরুম। একপাশে বাথটাব, শাওয়ার, ঠাণ্ডা পানি, গরম পানি, দামী তোয়ালে, সাবান, কোলন সবই আছে। টুপুল তখনই জয়কে বলেছিলো, প্রতুলদারা কী বড়লোক দেখেছিস? জীবনেও এত সুন্দর বাথরুম দেখিনি।

সুভদ্রা ভিলাতে প্রতুল ছাড়া মানুষ মাত্র দুজন। একজন হরি, আরেকজন রাঁধুনি ঠাকুর। ড্রাইভার শ্যামল এ বাড়িতে থাকে না। হরিকে জিজ্ঞেস করেছিলো ওপরে কে থাকে। হরি গম্ভীর হয়ে বলেছে, দোতলায় বাবুর পূজোর ঘর। বাইরের কারো ওপরে যাওয়া বারণ। নিচের তলায় ড্রয়ং, ডাইনিং, কিচেন আর তিনটা শোবার ঘর। একটায় প্রতুল নিজে থাকে। হরি জিজ্ঞেস করেছিলো টুপুলরা আলাদা ঘরে থাকবে কি না। বড় বিছানা দেখে টুপুল বলেছে ওরা একসঙ্গে থাকবে। বড় বড় নির্জন ঘরগুলোতে একটা গা-ছমছমকরা ভাব আছে। আসবাবপত্র সব পুরোনো অথচ বোঝা যায় খুব দামী। নকশা করা দরজা-জানালায় ভারি ভেলভেটের পর্দা। সুদা ভিলার সব কিছুতেই বনেদিআনার ছাপ।পুরু জাজিম বিছানায় নরম কম্বলের ভেতর শুয়ে টুপুল বললো, নাজমুল ভাই-র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আমাদের কপাল খুলে গেছে।

জয় বললো, আমার জানা ছিলো না এতসব বড়লোকেরা বিপ্লবীদের দল করে।

দল হয়তো করে না, দলকে সাহায্য করে।

যাই বলিস, জাহাজের চাকরির চেয়ে বিপ্লবীদের জন্য কাজ করাটা অনেক আরামের মনে হচ্ছে।

বিপদের ঝুঁকির কথা ভুলে গেছিস বুঝি? বিডিআর-এর লোকটা যদি বোমার মশলার প্যাকেটটা খুঁজে পেতো, ধরে সোজা থানায় চালান করে দিতো।

ঠিক বলেছিস। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম– হাই তুলতে তুলতে বললো জয়।

জয়ের ঘুম পাচ্ছে দেখে টুপুল আর কোনো কথা বললো না। ভাবলো, কাল এক ফাঁকে স্বপ্নর সঙ্গে দেখা করে আসবে। ওকে দেখলে নিশ্চয় খুব অবাক হয়ে যাবে।

পরদিন সকাল দশটায় এলো শ্যামল। টুপুলরা ততক্ষণে নাশতা খেয়ে তৈরি হয়ে ড্রইংরুমে বসে আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ছিলো। প্রতুল নটার দিকে বেরিয়ে গেছে।

অমায়িক হেসে শ্যামল জিজ্ঞেস করলো, দাদাবাবুরা আজ কোথায় যাবে?

জয় বললো, যেখানে তুমি নিয়ে যাবে।

বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে যাবে, শিবপুরে?

কতক্ষণ লাগবে যেতে?

অফিসের সময় তো, ঘন্টা দেড়েক লাগবে।

টুপুল জানতে চাইলো–টালিগঞ্জের গলফ ক্লাব রোড এখন থেকে কত দূরে, শ্যামলদা?

পনেরো মিনিট লাগবে যেতে। ওখানে কি টুপুলদাদা?

আমার এক বন্ধু থাকে। ওর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার।

ঠিক আছে। আগে তাহলে টালিগঞ্জই চলো।

শ্যামল পনেরো মিনিট বলেছিলো, গলফ ক্লাব রোড যেতে পঁচিশ মিনিট লাগলো। হাজরা রোডের মোড়ে একটা ট্রামের ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রাফিকজ্যাম লেগে গেছে। শ্যামল বিরক্ত হয়ে বললো, এই ট্রামগুলো না তুললে কলকাতাকে ভদ্র করা যাবে না।

টুপুল বললো, আমার তো ট্রাম দেখতে মজাই লাগে।

জয় বললো, স্বপ্নার টেলিফোন নম্বরটা আনলে পারতি। ফোন করে জানা যেতো বাড়িতে আছে কি না।

টুপুল মুখ টিপে হেসে নিচু গলায় বললো, যেন কলকাতা আসার প্ল্যান করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।

জয় একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, তবু ভালো, বাড়ির নম্বরটা তোর মনে আছে।

তিরিশ নম্বর গলফ ক্লাব রোড খুঁজে বের করতে ওদের কোনো অসুবিধে হলো না। পুরোনো ধাঁচের একতলা বাড়ি। সামনে এক চিলতে বাগান। বুড়ো এক মালি বাগানে কাজ করেছিলো। গাড়ি থেকে নেমে টুপুল ওকে জিজ্ঞেস করলো, স্বপ্ন আছে?

মলি টুপুল আর জয়কে ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখলো। পেছনে ওদের গাড়ি দেখলো। মাথা নেড়ে আছে বলে ভেতরে চলে গেলো।

একটু পরেই স্বপ্ন বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। টুপুলের মনে হলো, ছবির চেয়ে অনেক ফর্সা দেখতে, ওদের চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক ছোট, ছবিতে চোখে চশমা ছিলো না।

চশমা পরা স্বপ্ন একটু অবাক হয়ে দরজা খুললো। ওর চেহারা দেখে মনে হলো চিনতে পারে নি। টুপুল মৃদু হেসে বললো, তুমি চশমা লাগালেও আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনেছি স্বপ্ন।

তুমি টুপুল না? ছুটে এসে ওর সঙ্গে হাত মেলালো স্বপ্ন। কলকাতা কবে এলে?

কাল এসছি। স্বপ্নার উচ্ছ্বাসে একটু অপ্রস্তুত হয়ে টুপুল বললো, এ আমার বন্ধু জয়। ভালো নাম জয়ন্ত কুমার সরকার।

গ্ল্যাড টু মিট ইউ। টুপুলের বন্ধু আমারও বন্ধু, বলে জয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টুপুলকে প্রশ্ন করলোকলকাতায় উঠেছো কোথায়? কদ্দিন থাকবে? এসো, ভেতরে এসো আগে। এই বলে স্বপ্ন ওদের দুজনকে ড্রইংরুমে নিয়ে বসালো।

স্বপ্নাকে যে রকম ভেবেছিলো, বাস্তবে ওকে আরো বেশি আন্তরিক মনে হলো টুপুলের। বললো, এখানে উঠেছি আমাদের এক বড় ভাইয়ের বন্ধু প্রতুলদার বাড়িতে। থাকবো চারদিন।

মাত্র চারদিন। স্বপ্না শুনে হতাশ হলো–ভাইয়ের বন্ধুর বাড়িতে থাকবে কেন, আমার এখানে চলে এসো। মা-বাবা খুব খুশি হবেন তোমাদের দেখলে।

ওরা কোথায় গেছেন?

আমাকে বাড়ি পাহারায় রেখে কৃষ্ণনগর গেছেন দিদিকে দেখতে। দিদির ছেলে হয়েছে। বাবা-মা কাল ফিরবেন। তোমরা আজই এখানে চলে এসো।

টুপুল মৃদু হেসে বললো, এবার ওখানেই থাকি স্বপ্ন। প্রতুলদা শুনলে মন খারাপ করবেন। পরের বার তোমাদের বাড়িতে উঠবো।

কথা দিচ্ছো তো? জয় তুমি সাক্ষী।

কথা দিলাম। হেসে বললো টুপুল।

এবার বলো, কলকাতায় কী প্রোগ্রাম? একদিন কলকাতায় থাকবে, না বাইরের কোথাও যাবে?

আছি মাত্র তিনদিন। এর ভেতর বাইরে আর কোথায় যাবো!

তাই তো! ভাবছিলাম সময় থাকলে দীঘা থেকে ঘুরে আসা যেতো। সমুদ্রের তীরে চমৎকার জায়গা।

পরের বার যাওয়া যাবে। এই বেলা আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখবো বলে বেরিয়েছিলাম। তুমি যাবে?

নিশ্চয়ই যাবো। এক্ষুণি যাবে? চা-টা খাবে না? নাকি চাও পরের বার এসে খাবে?

স্বপ্নার কথায় টুপুল আর জয় একসঙ্গে হেসে উঠলো। টুপুল বললো, শুধু চা খেতে পারি, টা নয়। গাড়িতে শ্যামলদা আছে, ডাকবো ওকে?

নিশ্চয়ই ডাকবে। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর তৈরি হয়ে আসছি।

জয় উঠে শ্যামলকে ডাকতে গেলো। দরজায় নেমপ্লেট–এ জাস্টিস আর. মিত্র নাম দেখে শ্যামল ইতস্তত করছিলো–আমি গাড়িতে বেশ আছি। তোমরা গল্প কর না।

স্বপ্না বলেছে তোমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। এই বলে জয় ওর হাত ধরে ড্রইংরুমে নিয়ে এলো।

শ্যামল একটু জড়সড় হয়ে তাকিয়ে দেখলো চারপাশে। টুপুল আর জয় ওর সঙ্গে বন্ধুর মত মিশেছে, তার মানে এই নয় যে হাইকোর্টের একজন জাস্টিসের মেয়েও ওর মতো একজন ড্রাইভারকে এতটা প্রশ্রয় দেবে।

পাঁচ মিনিট পর একজন বেয়ারা চার কাপ চা আর এক প্লেট কচুরি দিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নাও ঝলমলে পোশাক পরে ঘরে ঢুকলো। টুপুল মুগ্ধ হয়ে বললো, তোমাকে বোম্বের ছবির হিরোইনদের মত লাগছে স্বপ্না।

স্বপ্না লাজুক হেসে বললো, থ্যাংকস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। কই শুরু করো। শ্যামলদা, তুমিও নাও।

স্বপ্নার এক কথাতেই ওর সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেলো শ্যামলের। খুশিতে ও দুটো কচুরি খেয়ে ফেললো। স্বপ্না টুপুল, আর জয় অবশ্য শুধু চা খেলো। চা শেষ করে শ্যামল বললো, চলো ওঠা যাক।

স্বপ্না জানতে চাইল–দুটোর মধ্যে ফেরা যাবে তো শ্যামলদা? বাড়িতে বলে দিয়েছি ফিরে এসে লাঞ্চ করবো।

শ্যামল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে টুপুল আর জয়কে দেখলো। টুপুলের চোখের ইশারা পেয়ে নিরীহ গলায় বললো, দাদাবাবুরা ঠিক করেছে আজ দুপুরে মাদ্রাজী খাবার চোখ দেখবে।

তাই বুঝি! তাহলে কি লাঞ্চটাও পরের বার হবে?

ঠিক ধরেছো। গলা খুলে হাসলো টুপুল আর জয়।

গাড়িতে উঠতে উঠতে স্বপ্না বললো, মা এলে টের পাবে পরের বার বলার মজা।

টুপুল বললো, আজ লাঞ্চ খাওয়ার সময় হবে না বলে এ কথা তো বলিনি, রাতে খেতে অসুবিধা আছে!

ঠিক আছে।হেসে বললো স্বপ্না, কথার যেন নড়চড় না হয়।

জয় শ্যামলের পাশে বসলো। টুপুল আর স্বপ্না বসলো পেছনে। গাড়ি ছাড়তেই স্বপ্নার সঙ্গে ওদের পুরোনো সব চিঠির প্রসঙ্গ নিয়ে গল্পে ডুবে গেলো টুপুল। জয়ের অভিমান হলো নতুন বান্ধবী পেয়ে টুপুল ওকে পাত্তা দিচ্ছে না বলে। ভাবলো, কলকাতায় ওর যদি একটা পত্রবন্ধু থাকতো তাহলে ঠিক ওর কাছে চলে যেতো।

বারোটার দিকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে এসে গাড়ি থামালো শ্যামল। টুপুলরা লক্ষ্য না করলেও ওর চোখে পড়েছে লাল একটা মারুতি ওদের অনেকক্ষণ ধরে ফলো করছে। কয়েকবারই কৌশলে রাস্তা পাল্টে শ্যামল পরখ করে দেখেছে খসানো যায় কিনা না। না পেরে বলতে বাধ্য হয়েছে, পেছনের লাল মারুতিটাকে সুবিধের মনে হচ্ছে না।

টুপুল ঝট করে একবার পেছনটা দেখে নিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলে–কেন, কি হয়েছে?

হাওড়া ব্রিজ ক্রস করার পর থেকে ফলো করছে।

তুমি কি ঠিক জানো আমাদেরই ফলো করছে?

কয়েকবার খসাতে চাইলুম। পারলুম না।

তুমি যেভাবে চালাচ্ছ সেভাবে চালিয়ে যাও। পেছনের গাড়িতে ওরা দুজন। আমরা চারজন। বোটানিক্যাল গার্ডেনে জায়গা মতো গাড়ি থামাবে।

জয় চাপা গলায় বললো, ওদের কাছে যদি আর্মস থাকে?

হিন্দি সিনেমা দেখে তোর মাথা পচে গেছে। আমরা কি কোটিপতি বাপের ছেলে যে আমাদের কিডন্যাপ করবে?

ফলো যখন করছে, মতলব নিশ্চয় ভালো নয়। জয়ের ভয়কে উড়িয়ে দিতে চাইলো না স্বপ্না।

ফলো করার ব্যাপারটা শ্যামলদার বোঝার ভুল হতে পারে।

শ্যামল বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢোকার ফটকে গাড়ি থামালো। টুপুল সবার আগে। নামলো। তারপর জয়। ধুলো উড়িয়ে লাল মারুতিটা ওদের পাশ দিয়ে স্পীড এতটুকুনা কমিয়ে চলে গেলো। টুপুল হেসে বললো, দেখলে তো শ্যামলদা, তোমার ধারণা যে ঠিক নয়!

নিজের ধারণা সম্পর্কে শ্যামলের যথেষ্ট আস্থা আছে। খবরটা জায়গা মতো পৌঁছাতে হবে। টুপুলের কথার জবাব না দিয়ে চিন্তিত মনে ও বোটানিক্যালে ঢুকলো।

.

০৭.

তুই ঠিক বলছিস তো শ্যামল? দেখতে ভুল হয় নি তো?

শ্যামলের আশঙ্কার কথা শুনে প্রতুল হাতে ধরা মদের গ্লাসে চুমুক দিতে ভুলে গেলো। ওর বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে শ্যামল অবিচল গলায় বললো, এতটুকু ভুল হয় নি দাদাবাবু। আমি হলফ করে বলতে পারি ওটা আগরওয়ালাদের গাড়ি। ওদের ড্রাইভার শিউনন্দনকে আমি ভালোভাবে চিনি।

আগরওয়ালার সাহস এত বেড়েছে? আপনমনে কথাটা বলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো প্রতুল।

দুপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখে কিড স্ট্রীটের বিখ্যাত এক মাদ্রাজী রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে টুপুলরা মেট্রোতে দারুণ এক মজার ছবি হোম অ্যালোনে দেখেছে। তারপর স্বপ্না ওদের জোর করে বাড়িতে এনেছে গল্প করবে বলে। ঢাকার গল্প শোনার ভারি শখ ওর। নাকি ওদের আদিবাড়ি ছিলো বিক্রমপুরে।

টুপুলরা রাতের খাবার স্বপ্নাদের বাড়িতে খাবে। শ্যামল চলে এসেছে। বলেছে দশটায় এসে ওদের নিয়ে যাবে। গাড়ির ঘটনাটা প্রতুলকে জানাবার জন্য ও দুপুর থেকে ছটফট করছিলো।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কি যেন ভাবলো প্রতুল। তারপর শ্যামলকে বললো, ছোঁড়া দুটো কি কিছু সন্দ করেছে?

না দাদাবাবু। উল্টে বললো, আমারই দেখার ভুল।

ভালো হয়েছে। ও দুটোকে আনতে যাবি কখন?

দশটায় যেতে বলেছে।

তুই তাহলে জানকিরামের বাড়ি চলে যা। ফোন করবো না, পাজিগুলো হয়তো ফোনে আড়িপাতার ব্যবস্থাও করেছে। জানকিরামকে বলবি তোর সঙ্গে এক্ষুণি চলে আসতে।

গতরাতে যে লোকটার সঙ্গে প্রতুল বসে মদ খাচ্ছিলো সে-ই জানকিরাম। নাজমুলের মতো আরেক পার্টনার। ওর বাড়ি ওয়েলেসলি স্ট্রীটে। ঠিক পঁচিশ মিনিট লাগলো ওর আসতে।

এতনা জরুরি এত্তেলা কেনো প্রতুল বাবু? কুছ গরবড় হয় নাই তো? সোফায় বসতে বসতে জানতে চাইলো জানকিরাম।

আগরওয়ালারা ছোঁড়া দুটোর পেছনে কেন লেগেছে আমাকে জানতে হবে। কি চায় ওরা? এই বলে প্রতুল গ্লাসে মদ ঢেলে এগিয়ে দিলো জানকিরামের দিকে।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে জানকিরাম শান্ত গলায় বললো, আজ সকালে হরিপ্রসাদ আগরওয়ালার সাথে আমার কথা হয়েছে। ওর মেজাজ খুব খারাপ আছে। বললো, এটা ওদের পুরানা সার্কিট। এখানে ধান্ধা করতে হলে ওদের কমিশন দিতে হবে। আমি বোলোম মাল এসেছে সাড়ে সাত লাখ ডলারের। পাঁচ লাখ দিতে হবে ঢাকার পার্টিকে। বিজেপি-র ফান্ডে দো লাখ, থাকে পঁচাস হাজার।এর থেকে কমিশন আর কত হবে?

আগরওয়ালা কি বললো?

বললো নাফা পঁচাস হাজার হোক আর পঁচাস লাখ হোক ওদের সাড়ে তিন পারসেন্ট দিতে হবে।

বিজেপি-র হাইকমান্ড যদি জানে, ও এখানে ব্যবসা করতে পারবে?

ও জানে ওয়েস্ট বেঙ্গলে বিজেপি কখনো সুবিধে করতে পারবে না। তাই ও এখন কংগ্রেসের সাথেও লিঙ্ক রাখছে।

ভালো, বিদ্রূপ করে হাসলো প্রতুল–বিজেপির পেছনে লাগতে যাওয়ার মজা ওকে ভালো মতোই টের পাওয়াবো।

ও কিন্তু বিজেপি হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। বোললো, আগলা মাহিনা ওর সাথে দিল্লীতে আদভানিজির মোলাকাত হোবে।

বিজেপি-র নেতা আদভানির কথা শুনে প্রতুল একটু গুটিয়ে গেলো। এখনো হাইকমান্ড পর্যন্ত ও পৌঁছতে পারেনি। চিন্তিত গলায় বললো, সত্যি সত্যি যোগাযোগ আছে, না গপ্পো দিয়েছে?

পাতা লাগাতে হোবে। এখুনি বোলতে পারছি না।

বাংলাদেশের ছোঁড়া দুটোর পেছনে লেগেছে কেন?

হোতে পারে ঢাকার সাথে ও ডাইরেক্ট কন্ট্রাক্ট করতে চায়। বাংলাদেশের কন্ট্রাক্ট আর কিভাবে পাবে?

ছোঁড়া দুটো এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। আপনমনে বললো প্রতুল।

জানকিরাম কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ গ্লাস খালি করলো। প্রতুল আবার ওর গ্লাস ভরে দিলো। আগরওয়ালার ব্যাপারে ওরা দুজনই চিন্তিত ছিলো। এতকাল বাংলাদেশের পার্টির সঙ্গে হেরোইনের ব্যবসাটা নির্বিঘ্নেই চলছিলো। কিছুদিন আগে ওদের দলের দুজন নেতা এসে দিল্লীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে গেছে। দিল্লীর নেতারা জানে বাংলাদেশে ওরা ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশটাকে আবার পাকিস্তান বানিয়ে ফেলবে। হিন্দুদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে। বিজেপি-র এতে খুব লাভ হবে। তারাও একইভাবে মুসলমানগুলোকে তাড়াবার অজুহাত পাবে। বাইরে এরা দুপক্ষই ভান করে একদল আরেক দলকে দুচোখে দেখতে পারে না, গোপনে ওরা ঠিকই হরিহর একাত্মা।

ওদের দুজনকে নিয়ে কারা কি চক্রান্ত করছে টুপুল আর জয়ের তা জানার কথা নয়। স্বপ্নাদের বাড়িতে ভিসিআর–এ এক ওয়েস্টার্ন ছবি দেখতে দেখতে ওরা জমিয়ে গল্প করছিলো। নটার সময় ছবি দেখা শেষ হলো, আর্দালি বিলেতি কায়দায় ডাইনিং রুমে ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।

ডাইনিং রুমে ঢুকে খাবার টেবিলে আয়োজন দেখে আঁতকে উঠলো টুপুল-এত খাবার কে খাবে? আমাদের কি রাক্ষস ভেবেছো?

লাজুক হেসে স্বপ্না বললো, তোমরা কি পছন্দ কর জানি না তো। তাই দুপুরে বলে গিয়েছিলাম মাছ, মাংস, সজি সবই রান্না করতে।

খেতে বসে টুপুল আর জয় দুজনেরই মনে হলো এত ভালো খাবার ওরা জীবনেও চোখে দেখেনি। বাড়ির অবস্থা ওদের কারোই ভালো নয়। জয়দের অবস্থা টুপুলদের চেয়েও খারাপ। এতগুলো ভাইবোনের সংসারে অভাব লেগেই আছে। ভাবলো, ফিরে গিয়ে নাজমুলকে চাকরির ব্যাপারে বলতে হবে। বিপ্লবীদের সাহায্য করার সময় পরেও পাওয়া যাবে। আপাতত কিছুদিন চাকরি করে বাবার ঘাড়ের ভারি বোঝাটা হালকা করা দরকার।

খেতে বসেও স্বপ্নার গল্প আর ফুরোয় না। ওদের কার কি ভালো লাগে, ভবিষ্যতে কে কি হবে সবই জানা হয়ে গেছে। স্বপ্না গত বছর আমেরিকা গিয়েছিলো ওর বড় ভাই-র কাছে। সেসব গল্পও বলা হয়ে গেছে। খেয়ে উঠতে উঠতে সাড়ে নটা বেড়ে গেলো।

ড্রইংরুমে বসে স্বপ্না বললো, মাইকেল জ্যাকসনের নতুন প্রোগ্রামটা দেখ, গত বছর এনেছি।

মাইকেল জ্যাকসন ওদের ভালো না লাগলেও স্বপ্নার উৎসাহ দেখে আপত্তি করলো না। পাঁচ মিনিটও দেখা হয় নি, তখনই বাইরে গাড়ির হর্ন বাজলো।

একটু পরে আর্দালি এসে বললো, টুপুল বাবুদের গাড়ি এসেছে। স্বপ্না অবাক হয়ে বললো, কি ব্যাপার, তোমাদের গাড়ি তত দশটায় আসার কথা।

টুপুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, কি জানি, শ্যামলদা বোধহয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়।

ওরা তিনজন বাইরে এসে দেখলো, গাড়ি ওদের সাদা অ্যাম্বাসাডারই তবে ড্রাইভার শ্যামল নয়, ওর বয়সী আরেকজন।

৬০

টুপুলদের বেরোতে দেখে ড্রাইভার নেমে এসে বললো, শ্যামলকে দাদাবাবু জরুরি কাজে এক জায়গায় পাঠিয়েছেন। আমি অফিসের ড্রাইভার। দাদাবাবু বলেছেন আপনাদের যেন নিয়ে যাই।

তাড়াতাড়ি গাড়ি আসাটা স্বপ্নার মোটেও ভালো লাগেনি। বললো, শ্যমলদাকে তো বলা হয়েছিল দশটায় আসতে।

ড্রাইভার কুণ্ঠিত গলায় বললো, শ্যামল আমাকেও তাই বলেছিলো। দশটায় আবার দাদাবাবুকে তুলতে হবে গড়িয়া থেকে, তাই একটু আগে এসে গেলাম।

টুপুল বললো, ঠিক আছে স্বপ্না। আজ বরং যাই। কাল সকালে ফোনে কথা বলবো। আমাদের নম্বর তো রইলো।

স্বপ্না বললো, রাতেও ফোন করতে পারি। টুপুল হেসে বললো, অসুবিধা নেই। আমাদের বেডরুমে টেলিফোনের এক্সটেনশন আছে।

স্বপ্নার সঙ্গে হাত মিলিয়ে টুপুল আর জয় গাড়িতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে শুরু করলো। টুপুল হঠাৎ খেয়াল করলো, কাল থেকে যে গাড়িতে ওরা চলাফেরা করছে এটা সেই গাড়ি নয়। ভাবলো, প্রতুলদা যেরকম বড়লোক কয়েকটা গাড়ি থাকা বিচিত্র কিছু নয়।

টুপুলরা কলকাতার রাস্তাঘাট কিছু চেনে না বলে বুঝতে পারলো যে না ওরা গড়িয়ার দিকে না গিয়ে আনোয়ার শাহ রোডে ঢুকেছে। ড্রাইভারও জানে তার কিশোর যাত্রীদের পক্ষ থেকে বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিশ্চিন্ত মনে গাড়ি চালিয়ে নির্বিঘ্নে এসে ঢুকলো উঁচু পাঁচিলঘেরা এক এক দুর্ভেদ্য বাড়ির ভেতর।

দোতলার ঝুলবারান্দার নিচে গাড়ি রেখে ড্রাইভার পেছনের দরজা খুলে ওদের ডাকলো,–দাদাবাবুরা আসুন, প্রতুল দাদাবাবু আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

টুপুলদের ঘুণাক্ষরেও মনে হয় নি তারা শত্রুপুরিতে আটকা পড়ে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিন্তমনে ড্রাইভারকে অনুসরণ করে ভেতরে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো গৃহস্বামীর অবস্থা প্রতুলদের চেয়ে ভালো বৈ খারাপ নয়। আসবাবপত্র, জানালার পর্দা সবকিছু সুভদ্রা ভিলার চেয়ে অনেক দামী। দেয়ালে পুরোনো দিনের দুর্লভ পেইন্টিং, শোকেসে এন্টিক, মেঝেতে পুরু কার্পেটের ওপর খানতিনেক রয়েল বেঙ্গলের মুওয়ালা চামড়া বিছানো–সব মিলিয়ে এক রাজকীয় পরিবেশ।

যে সোফায় ওরা বসেছিলো তার গদিগুলো এত নরম যে ওদের মনে হচ্ছিলো একতাল মাখনের ভেতর ডুবে গেছে। মিনিট পাঁচেক পরে ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের এক যুবক ঘরে ঢুকলো। ধুতি পাঞ্জাবী পরা, ওপরে দামী কাশ্মিরী শাল, মুখে মোটা চুরুট, চুলগুলো কদমছাট, ফরসা ভারিক্কি চেহারা, কপালে চন্দনের ফোঁটা। গম্ভীর মুখে বললো, তোমরা তাহলে বাংলাদেশ থেকে এসেছো?

জেরার ধরণটা ভালো না লাগলেও টুপুল গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো। আমার নাম হরিপ্রসাদ আগরওয়ালা। তিনপুরুষ ধরে কলকাতায় আছি। তোমরা তো একেবারে বাচ্চা মনে হচ্ছে। এ লাইনে কদ্দিন ধরে আছো?

এ লাইন মানে কি? অবাক হয়ে টুপুল বললো, প্রতুলদা কোথায়?

প্রতুল বাবুকে এখানে পাবে না। আমি তোমাদের এনেছি কিছু কথা জানবার জন্য।

তার মানে? টুপুল রেগে গিয়ে বললো, আপনি আমাদের মিথ্যে কথা বলে ধরে এনেছেন? আপনার কোনো কথার জবাব দেবো না। আমরা এক্ষুণি প্রতুলদার কাছে যাবো।

টুপুল আর জয় যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো। হরিপ্রসাদ ঠাণ্ডা গলায় বললো, আমার কথার জবাব না দিয়ে এখান থেকে এক পা নড়লে মাথার খুলি উড়ে যাবে।

চমকে উঠে ওরা চারপাশে তাকিয়ে দেখলো ঘরের দরজার কাছে দুজন ওদের দিকে স্টেনগান তাক করে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত টুপুল আর জয়ও ওদের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

হরিপ্রসাদের ঠোঁটে হাসির রেখা। কয়েকবার মাথা নাড়লো। টুপুল ধপ করে আবার সোফায় বসলো। ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলো, আপনি আসলে কে?

নাম তো বলেছি। হরিপ্রসাদের ঠোঁটের ফাঁকের বাঁকা হাসি আরও স্পষ্ট হলো–তোমরা যে ধান্ধায় আছে, আমিও একই ধান্ধায় আছি।

ধান্ধা মানে কি? আমরা কি ধান্ধা করছি?

তোমরা ড্রাগস-এর ব্যবসা করছো! বাংলাদেশে থেকে হেরোইন এনে প্রতুলকে দিয়েছে ইউরোপে পাচার করার জন্য।

হরিপ্রসাদের কথা শুনে টুপুল আর জয়ের শরীরে যেন হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। অসহায় গলায় জয় বললো, আপনি এসব কি আবোল-তাবোল বলছেন? আমরা কক্ষনো এমন নোংরা কাজ করতে পারি না!

পেরেছো। ঠাণ্ডা গলায় হরিপ্রসাদ বললো, তোমরা খুবই সাকসেসফুলি তোমাদের দায়িত্ব পালন করেছে। নাও, ধানাই-পানাই রেখে কাজের কথায় এসো।

তোমাদের দিয়ে আমি নাজমুলের কাছে একটা প্রপোজাল পাঠাতে চাই। প্রতুল আমাকে যে কমিশন দেবে সেটা আমি নাজমুলকে দেবো। মালটা আমার হাতে আসতে হবে। পেমেন্ট হবে ডলারে।

হরিপ্রসাদের কথায় একেবারে ভেঙে পড়লো টুপুল-ফির গড সেক, আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করুন। আমরা এসব হেরোইনের বিন্দুবিসর্গ জানি না।

মিথ্যে বলছো। হরিপ্রসাদের গলায় উত্তেজনার কোনো চিহ্ন নেই–তোমরা কি ঢাকা থেকে হেরোইনের দুটো প্যাকেট এনে প্রতুল সাহাকে দাওনি? তোমরা কি নাজমুলের গ্রুপের হয়ে কাজ করছে না?

হরিপ্রসাদের কথা শুনে টুপুল আর জয় দুজনই গভীর সমুদ্রে পড়ে গিয়ে খাবি খেতে লাগলো। নাজমুল বলেছে সংগঠন এবং তৎপরতা সবই গোপন রাখতে। অথচ এখন অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে সত্যি কথা না বললে ওদের হেরোইন ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এর চেয়ে নোংরা ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে পুরো পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো ওরা। একটু ইতস্তত করে টুপুল বললো, মনে হচ্ছে আপনি আমাদের কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু বলছি, আপনার ধারণা ঠিক নয়। এইটুকু ভূমিকা করে টুপুল ওদের বাড়ি ছেড়ে আসার পর থেকে কিভাবে ওরা কলকাতা এসেছে সব কথা হরিপ্রসাদকে খুলে বললো।

টুপুলের কথা শুনতে শুনতেই হরিপ্রসাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। ওর কথা শেষ হওয়ার পর কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনোটাই করছি না। তবে তোমাদের কথা যদি সত্যিও হয় এটুকু বলতে পারি যে তোমরা যেখানে নেমেছে সেখান থেকে পেছনে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তোমাদের নসিব জড়িয়ে গেছে নাজমুলের কারবারের সঙ্গে। আমিও একই ধান্ধা করি বলে বলতে পারি এই পরিস্থিতি যদি তোমরা মেনে নাও তবেই প্রাণে বাঁচতে পারবে।

–এই বলে হরিপ্রসাদ হাসলো। ভয় পাওয়া ছেলে দুটোর চেহারা ভালো করে জরিপ করলো, আমি তদন্ত করে দেখতে চাই তোমরা কতটুকু সত্যি কথা বলেছে। আপাতত তোমরা এখানেই থাকবে।

আমাদের আপনি বন্দী করে রাখবেন? প্রশ্ন করলো জয়।

ঠিক বন্দী নয়। বাড়ির ভেতরে থাকবে। টিভি দেখ, ভিসিআর দেখ, গেমস আছে–খেলতেও পারো। শুধু বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না।

আমাদের জামাকাপড় সব প্রতুলদের বাড়িতে।

এখানে ওসবের অভাব হবে না।

জয় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আপনি আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা দেশে ফিরে যাবো।

তার কোনো উপায় নেই। নাজমুলের কন্টাক্ট আমার চাই। সেটা একমাত্র তোমরাই করে দিতে পারো। প্রতুল জানতে পারলে তোমাদের খুন করবে। আমি তোমাদের ভালোর জন্যেই থাকতে বলছি। এই বলে হরিপ্রসাদ গলা তুলে ডাকলোতেওয়ারি।

বোলিয়ে সরকার। মাঝবয়সী এক আর্দালি ঘরে ঢুকলো।

ইনলোগকো গেস্টরুম দিখাও। কোই তকলিফ না হোনা চাহিয়ে। পান্ডে আওর লছমন কো বোলো মুঝসে মিলনে।

তেওয়ারি ওদেরকে চলিয়ে বাবুজি বলে ভেতরে গেস্টরুমে নিয়ে গেলো। প্রতুলের চেয়ে হরিপ্রসাদ যে অনেক বেশি ধনী এ ঘরে এসেও ওরা টের পেলো। তেওয়ারী ওদের বাথরুম আর ওয়ার্ডরোব দেখিয়ে চলে গেলো। ওয়ার্ডরোবে স্লিপিং স্যুট থেকে শুরু করে নতুন প্যান্ট শার্ট সবই আছে। ঘরের এক কোণে রঙিন টিভি, ভিসিআর প্রচুর ক্যাসেটসহ আরাম আর প্রাচুর্যের বহু উপকরণ রয়েছে এখানে সেখানে। ওসব কিছুই টুপুল আর জয়ের মন স্পর্শ করলো না। হতভম্ব হয়ে ওরা ভাবছিলো হরিপ্রসাদ যা বলেছে তা কি সত্যি? ওরা কি সত্যি সত্যি হেরোইন চোরাচালানিদের খপ্পরে পড়েছে?

যেভাবেই হোক আগরওয়ালাদের খপ্পর থেকে ছোঁড়া দুটোকে উদ্ধার করতে হবে। শক্ত গলায় কথাটা বললো প্রতুল সাহা।

ওর পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছে জানকিরাম। রাত তখন সাড়ে দশটা। সন্ধ্যায় সুভদ্রা ভিলায় আসার পর থেকে জানকিরাম সমানে মদ খাচ্ছে। নাকি বেশি খেলে ওর মাথা খোলে। স্বপ্নাদের বাড়িতে শ্যামল ঠিক দশটায় গিয়ে যে খবর শুনেছে তাতে ওর মাথা ঘুরে গিয়েছিলো। স্বপ্না উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, একটু আগে প্রতুলদা ওদের নেয়ার জন্যে গাড়ি পাঠান নি? নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে কাষ্ঠ হেসে শ্যামল বলেছে। তাহলে দাদাবাবুই কেদারকে পাঠিয়েছেন। আমি অন্য এক কাজে গিয়ে আটকে গিয়েছিলুম। ভাবলুম যদি কেদার না এসে থাকে–এদিকটা হয়েই যাই।

ঠিক আছে। কাল ওদের পৌঁছে দেবো। নিজেকে স্বপ্নার জেরা থেকে উদ্বার করে শ্যামল কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচেছে। আগরওয়ালাই যে টুপুলদের অপহরণ করেছে এটা বুঝতে ওর এতটুকু অসুবধে হয়নি। তবে কথাটা অন্য কেউ জানলেই পুলিস এসে নাক গলাবে। এটা প্রতুল কখনো পছন্দ করবে না।

শ্যামলের ধারণার সঙ্গে প্রতুল একমত হলো। জানকিরাম বললো, ছোকরা দুটার জান খতরেমে আছে। ওরা যদি সাচ বাত না বাতায় হরিপ্রসাদ ওদের খুন করবে।

কি সাচ বাত বলবে? ওরা কিছু জানে যে বলতে যাবে?

নাজমুলের কাছে কিভাবে পঁহুছাতে হোবে এ বাত তারা জরুর জানে।

তাতে কি হলো? হাইকমান্ডের হুকুম ছাড়া নাজমুল অন্য কারো সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে না।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেনো দিল্লীর হাইকমান্ডের সাথে আগরওয়ালাদের জানপহেচান আছে?

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো প্রতুল। জানকিরামও কোনো কথা না বলে মদ গিলতে লাগলো। রাত সোয়া এগারোটায় হরিপ্রসাদের ফোন এলো প্রতুলের কাছে। ভূমিকা না করে হরিপ্রসাদ বললো, ছেলে দুটোর জন্য আপনি পেরেশান হবেন না। ওরা আমার হেফাজতে ভালো থাকবে। আপনি আমাদের কমিশন দেয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি জানি মাল পুরা তিন কেজি আছে।

বলেছে বুঝি ওই হারামজাদা দুটো–রাগ চেপে রাখতে পারলো না প্রতুল।

ওরা যা জানে আপনি তাও জানেন না? উপহাসের গলায় হরিপ্রসাদ বলল, ওরা ছাড়াও আমার বহু সোর্স আছে যা আপনার নেই।

ছোঁড়া দুটোকে ফেরত পাঠালে আমি আপনার কমিশন পাঠিয়ে দেবো।

ওদের না পাঠালে কি হয়?

নাজমুল আমাকে বেঈমান ভাববে। আমাদের চুক্তি সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই ভালোভাবে জানেন।

জানি। আমরা চাই নতুন করে আমাদের সঙ্গে চুক্তি হোক।

হরিপ্রসাদজী, এটা আপনি কক্ষণো করতে পারেন না। আমাদের কারবারের কতগুলো নিয়ম আছে।

নিয়ম আপনি ভেঙেছেন আমার সারকিটে ঢুকে।

ছোঁড়া দুটোকে আপনি তাহলে ফেরত দেবেন না?

কমিশন আগে পাঠান, ভেবে দেখি।

ঠিক আছে–বলে খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখলো প্রতুল। শক্ত গলায় জানকিরামকে বললো, বিহারীলালকে খবর দাও আজ রাতেই। আগামী চব্বিশ ঘন্টার ভেতর ছেঁড়া দুটোকে খুন করতে হবে। আমি চাই না হরিপ্রসাদ কোনো অবস্থায় ঢাকার কন্টাক্ট পাক।

.

০৮.

স্বপ্নাকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে সুভদ্রা ভিলা যেতে যেতে শ্যামল মনে মনে নিজের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করছিলো ওর ধারনা ছিলো পরদিন সকালে টুপুলরা যোগাযোগ না করলে স্বপ্না ওদের খোঁজ নিতে পারে যদি ওর কাছে সুভদ্রা ভিলার ঠিকানা বা ফোন নম্বর থাকে। শ্যামল চলে যাওয়ার পর স্বপ্নার মনের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি আর সন্দেহ দানা বাঁধছিলো। দুই ড্রাইভারের কথা কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে। শ্যামল না এলে এ নিয়ে ভাববার কিছু ছিলো না। টুপুলরা চলে গেছে শুনে শ্যামলের মুখে ক্ষণিকের জন্য ভাবান্তর হয়েছিলো, সেটা স্বপ্নার নজর এড়ায় নি।

বিছানায় শুয়ে ওর প্রিয় হার্ডি সিক্স-এর নতুন বইটা পড়তে গিয়ে স্বপ্না কিছুতেই মন বসাতে পারলো না। ওদের বসার ঘরের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকে যখন বারোটার ঘন্টা বাজলো তখন উঠে গিয়ে সুভদ্রা ভিলার নম্বরে ডায়াল করলো। টুপুলকে ও বলেছিলো রাতে ফোন করতে পারে।

তিনবার রিং হওয়ার পর প্রতুল রিসিভার তুললো। অপর প্রান্ত থেকে স্বপ্না বললো, আমি টুপুলের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

আপনি কে? অবাক হয়ে জানতে চাইলে প্রতুল।

আমি ওর বন্ধু স্বপ্না।

টুপুল নেই। শান্ত গলায় বললো প্রতুল।

সে কি! টুপুল আর জয় এখনো বাড়ি ফেরে নি?

ফিরেছে। তারপর আবার দাদাবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছে।

কোথায় গেছে? কখন ফিরবে?

দাদাবাবুদের বাগানবাড়ি গেছে দমদমে, পরশু ফিরতে পারে।

ওরা যে বললো, কাল সকালে আমাদের বাড়িতে আসবে?

আসতে পারে। আবার যদি দাদাবাবুর সঙ্গে শিকারে যায় নাও আসতে পারে।

আপনি কে?

এ বাড়িতে কাজ করি–বলে রিসিভার রেখে দিলো প্রতুল। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললো, বজ্জাত ঘোড়াগুলো আসতে না আসতেই বন্ধু জুটিয়ে বসে আছে।

মিনিট দশেক আগে প্রতুলের কাছে জানকিরামের ফোন এসেছিলো। বললো, বিহারীলাল জোড়া খুনের জন্য পুরো দুলাখ নেবে। প্রতুল বলেছে, গো অ্যাহেড।

স্বপ্নার সঙ্গে কথা বলার পর প্রতুল ঠিক করলো পরের বার ফোন করলে সোজা বলে দেবে ঢাকা থেকে জরুরি খবর আসায় ওরা দেশে ফিরে গেছে।

প্রতুলের সঙ্গে কথা বলার পরও স্বপ্না নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। ঘরে গিয়ে মাথার কাছের টেবিল লাইটটা হার্ডি সিক্স পড়তে গিয়ে ভাবলো, বলেছে একদিন অপেক্ষা করতে। দেখা যাক কি হয়। এমনও তো হতে পারে কাল সকলে ওরা ঠিকই এসে হাজির হলো। এখন এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তখন আবার লজ্জায় পড়তে হবে।

হরিপ্রসাদের বাড়ির অবস্থা অনেকটা প্রতুলের মতোই। বাড়িতে কোনো মহিলা নেই। হরিপ্রসাদ আর লালু প্রসাদ দুই ভাই থাকে দোতালার দুপ্রান্তের দুটো কামরায়। রাতে নিচের তলায় বাইরের ঘরে আর্দালি তেওয়ারি ঘুমায়। অন্য সব কাজের লোক থাকে মূল বাড়ির একপাশে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। গেটে দুজন দারোয়ান থাকে সব সময়। আটঘন্টা পর পর ওদের ডিউটি বদল হয়। এ ছাড়া গোটা দুই অ্যালসেশিয়ানও রাতে ছাড়া থাকে। বাড়ির চারপাশে সারারাত চক্কর দেয় আর মাঝে মাঝে গরগর করে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। ও দুটোর কথা তেওয়ারি বলে গেছে টুপুলদের বাবুজিরা রাতে ভুল করেও বাড়ির বাইরে পা রাখবে না। নিকি-মিকি বহুৎ খতরনাক কুত্তা আছে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

রাত তখন আড়াইটা। বাড়ির সবাই ঘুমে ডুবে গেলেও টুপুল আর জয়ের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। সারাক্ষণ ওদের মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে–যে করেই হোক পালাতে হবে।

ঘরের ভেতরের লাইট নিভিয়ে দিয়েছিলো তেওয়ারি। করিডোরে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। বাড়ির বাইরে প্রচুর আলো। বাগানে গার্ডেন লাইট ছাড়াও গেট-এর দুপাশে জোরালো মার্কারি লাইট জ্বলছে। দুই পাহারাদারের নজর এড়িয়ে একটা ছুঁচোও ভেতরে ঢুকতে পারবে না।

টুপুল আর জয় পাশাপাশি দুটো সিঙ্গেল খাটে শুয়েছিলো। রাস্তায় একটা কুকুর শীতে কাঁপা নেড়ি ডাক ছাড়তেই বাড়ির ভেতর থেকে অ্যালসেশিয়ানের মৃদু গর্জন শোনা গেলো। তারপর সবকিছু চুপচাপ। টুপুল চাপা গলায় বললো, জয় ঘুমিয়েছিস?

না। কান্না ভেজা গলায় জবাব দিলো জয়।

টুপুল লক্ষ্য করেছে জয় অল্পেই নার্ভাস হয়ে যায়। এ নিয়ে কোনো কথা না বলে আগের চেয়ে আরো আস্তে বললো, বসার ঘরে একটা টেলিফোন আছে, লক্ষ্য করেছিস?

তাতে কি?

স্বপ্নাকে টেলিফোনে পাওয়া যায় কিনা দেখি।

তেওয়ারি টের পেলে খুন করবে।

চল না গিয়ে দেখি । তুই দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিবি । কাউকে আসতে দেখলে আমাকে বলবি–পেয়েছিস?

কি পাবি তুই?

আমার কলমটা খুঁজবো সেখানে।–এই বলে নিঃশ্বব্দে উঠে বসলো টুপুল। পা টিপে টিপে খুব সাবধানে ওরা দরজা খুললো। মাথাটা সামান্য বের করে দেখলো–কোথাও কেউ পাহারা দিচ্ছে না। কোনোরকম শব্দ না করে ওরা বসার ঘরে এলো। এক টুকরো কাগজে স্বপ্না ওর ফোন নম্বর লিখে দিয়েছিলো। শোয়ার আগে বাথরুমে ঢুকে নম্বরটা মুখস্থ করে কাগজটা কমোডে ফেলে ফ্লাস ঠেলে দিয়েছে টুপুল।

টেলিফোনের ওপর ছোট একটা কুশন চাপা দিয়ে ডায়াল ঘোরালো টুপুল, যাতে ডায়ালের শব্দ বাইরে না যায়। পাঁচবার রিং হওয়ার পর ওপাশে রিসিভার তুললো স্বপ্না। হ্যালো বলতেই টুপুল চাপা গলায় দ্রুত বললো, আমি টুপুল, মন দিয়ে শোনো স্বপ্না। আমাদের দুজনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। একটা বাড়িতে আটকে রেখেছে।

কেন কিডন্যাপ করেছে? উত্তেজিত গলায় স্বপ্না বললো, আমি অনেক আগেই সন্দেহ করেছিলাম যখন শ্যামল এসে আবোল-তাবোল বললো।

আমাদের নিয়ে ভয়ানক এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে স্বপ্না।

বাড়ির ঠিকানা বা লোকেশন বলতে পারবে?

কিছুই বলতে পারবো না এ বাড়িতে না ঢোকা পর্যন্ত বুঝতেই পারি নি যে ওরা কিডন্যাপ করেছে। এবাড়িটা তোমাদের বাড়ি থেকে গাড়িতে দশ বারো মিনিট দূরে।

কারা কিডন্যাপ করেছে? ছেলেধরা গুণ্ডা?

না, বিরাট বড়লোক। হেরোইনের ব্যবসা করে।

ওরা কেন কিডন্যাপ করলো?

বিরাট ষড়যন্ত্র। দেখা হলে বলবো।

কাল রাতে ফোন করতে পারবে?

যদি এখানে থাকি তাহলে বোধহয় পারবো।

যেভাবে তোক থাকো। দিনের বেলা চারপাশটা দেখে ফোনে লোকেশনটা আমাকে বলবে। বাড়িটাকে যেন চেনা যায়। টেলিফোনে একবার দেখো তো নম্বরটা কোথাও আছে কিনা।

বসার ঘরে কোন আলো ছিলো না। বাগানের খানিকটা আলো জানালা গলিয়ে মেঝের ওপর পড়ে ঘরের অন্ধকারটা খানিকটা ফ্যাকাসে হয়েছিলো। ভালো করে রিসিভার রাখার জায়গা আর সামনে পেছনে টেলিফোন সেট ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলো টুপুল। কোথাও কোন নম্বর নেই। হতাশ হয়ে কথাটা স্বপ্নাকে জানালো।

জয় দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। ওর চোখ ছিলো করিডোরের শেষ মাথায় দোতলার সিঁড়ির কাছে। হঠাৎ ওর মনে হলো দোতলায় খুট করে দরজা খোেলার শব্দ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় বললো, টুপুল কুইক।

রাখছি। বলে টুপুল রিসিভারটা জায়গামত রেখে জয়কে নিয়ে ছুটে এসে ওদের ঘরে ঢুকলো। তখনই শুনলো দোতলার কাঠের সিঁড়িতে স্লিপারের আওয়াজ তুলে কে নামছে। মুহূর্তের ভেতর দুজন খাটে উঠে কম্বলের তলায় ঢুকলো।

দুজনই শুয়েছিলো দরজার দিকে পিঠ করে। টের পেলো, সামান্য শব্দ করে কেউ যেন ওদের দরজা খুলছে। না তাকিয়েও ওরা বুঝতে পারলো হরিপ্রসাদ ওদের ঘরে ঢুকেছে। ওরা দুজন চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে রইলো। উত্তেজনায় জয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

হরিপ্রসাদ পা টিপে ওয়ার্ডরোবের কাছে এলো। ওদের দুজনের প্যান্ট শার্ট ওয়ার্ডোবের পাশে দেয়াল আলমারিতে রাখা ছিলো। টুপুল ওর চোখের পাতা এক সুতো ফাঁক করে দেখলো হরিপ্রসাদ ওদের প্যান্ট শার্টের পকেট হাতাচ্ছে। ওর প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে একটুররা কাগজ বের করে হাতে পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে দেখলো। টুপুল বুঝলো ওটা ওর ইটালীর পত্রবন্ধুর ঠিকানা। হরিপ্রসাদ সন্তষ্ট হয়ে ঠিকানাটা ওর নিজের পকেটে রাখলো। ওর ঠোঁটে আত্মতৃপ্তির হাসি। ওর সন্দেহ যে অমূলক নয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলো। ইটালীর ঠিকানা দেখে ওর ধারণা বদ্ধমূল হলো এদের সঙ্গে নিশ্চয় মাফিয়াদেরও যোগাযোগ আছে।

হরিপ্রসাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই টুপুলের দুশ্চিন্তা অনেকটা দূর হলো। স্বপ্নার সঙ্গে ফোনে কি কথা হয়েছে জয়কে বললো। তারপর ভাবলো কালকের দিনটা এ বাড়িতে থাকার জন্য ওরা কি কি করতে পারে। রাত তিনটার দিকে ঘুমে ওর চোখ বুজে এলো। জয় অবশ্য হরিপ্রসাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

সকালে ওদের দুজনের নাশতা ঘরেই দিয়ে গেলো তেওয়ারি। চারখানা করে টোস্ট, মাখন আর ডিমপোচ। নাশতা শেষ হলে দুকাপ চা নিয়ে আবার ঘরে ঢুকলো তেওয়ারি। বললো, চায়ে পিনে কা বাদ ছোটে সরকার সে মিলো।

তেওয়ারি বেরিয়ে যেতেই টুপুল বললো, শোন, তোর আজ পেট খারাপ। রাতে আর সকালে চার বার বাথরুমে। গেছিস। ভীষণ দুর্বল বোধ করছিস। এসব কথা হরিপ্রসাদকে বলতে হবে।

বললে কি হবে? অবাক হয়ে জানতে চাইলো জয়।

আজকের দিনটা আমাদের এ বাড়িতে থাকতে হবে। ক্রিম মেখে মুখটা অত চকচকে করেছিস কেন? বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে ধুয়ে-মুছে শুকনো শুকনো করে ফেল।

জয় বাথরুমে যেতে মনে মনে গজ গজ করলো–সবটাতেই মাতব্বরি। নিজের পেট খারাপ হতে কি ক্ষতি ছিলো? যত চোটপাট আমার ওপর! পরশু থেকে স্বপ্নার সঙ্গে টুপুলের এত মাখামাখি ওর মোটেই ভালো লাগছিলো না। যেন জয় নয়, স্বপ্নাই ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এমন হবে জানলে ও কক্ষণো টুপুলের সঙ্গে আসতো না।

বাথরুম থেকে শুকনো মুখে বেরোনোর পর টুপুল ওকে ভালো করে দেখে বললো, এবার ঠিক হয়েছে, চল।

হরিপ্রসাদ বসার ঘরে বসে সেদিনের স্টেটসম্যান পত্রিকা পড়ছিলো। ওদের ইশারায় বসতে বললো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শেয়ার বাজারের সংবাদ পড়লো। তারপর বললো, তোমরা কি ঠিক করলে? এখনো কি প্রতুল সাহার কাছে ফিরে যেতে চাও?

টুপুল স্লানমুখে বললো, আপনি যা বলবেন তাই করবো। আমাদের দেশে ফিরে যেতে দিন।

এই তো গুড বয়ের মত কথা। আমার কাজ খুবই সামান্য। তোমাদের সঙ্গে আমার একজন লোক যাবে। ওকে শুধু নাজমুলের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। বাকি কাজ ওই করবে। তারপর তোমরা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে।

কখন যেতে হবে?

আজ দুপুরের ট্রেনে। প্রতুল সাহা তোমাদের খুন করার জন্য তোক ভাড়া করেছে। যত তাড়াতাড়ি কলকাতা থেকে বেরিয়ে যেতে পারো তত ভালো।

আজ কিভাবে যাবো? মুখ কালো করে টুপুল বললো, জয় অসুস্থ, সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারছিলো না।

কি অসুখ? বিরক্তিভরা গলায় জানতে চাইলো হরিপ্রসাদ।

ভীষণ দাস্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ছবার বাথরুমে গেছি। চি চি করে জয় বললো, মনে হচ্ছে কলেরা। দাঁড়ালেই মাথা ঘুরছে। হাঁটতে পারছি না।

তাহলে তো ডাক্তার ডাকতে হয়। হরিপ্রসাদ গলা তুলে তেওয়ারিকে ডাকলো।

সঙ্গে সঙ্গে জ্বী সরকার, বলে তেওয়ারি হাজির।

ডাগদর সাবকো জলদী আনে বোলো৷ এই বলে হরিপ্রসাদ বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে গেলো।

তেওয়ারির টেলিফোন পেয়ে পনেরো মিনিটের ভেতর কালো পেটমোটা ব্যাগ হাতে আধবুড়ো ডাক্তার এসে হাজির হলো। টুপুলরা আর ঘর থেকে বেরোয় নি।

টুপুল আর জয়কে চশমার ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে দেখে ডাক্তার ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চাইলো, কার অসুখ!

শুকনো মুখে মিন মিন করে জয় বললো, আমার।

কি অসুখ?

গত বছর জয়ের ছোট বোনের ডায়রিয়া হয়েছিলো। ওকে নিয়ে জয়কেই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জয় ওর পেটের অসুখের বিবরণ দিলো।

জয়কে সোফায় শুইয়ে ওর পেট টিপে দেখলো ডাক্তার। তারপর বুক আর জিভ দেখলো। গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, সকালে কি খাওয়া হয়েছে?

একখানা টোস্ট আর চা।

চা-টা খাওয়া চলবে না। দুপুরে লেবু কচলে একটুখানি জল আর লবণ দিয়ে শুধু ভাত। বেশি করে স্যালাইন ওয়াটার খাবে। প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছি।

হরিপ্রসাদ ঘরে ঢুকে বিরক্ত গলায় জানতে চাইলো, কি হয়েছে ডাক্তার?

ডায়রিয়া। গুরুপাক কিছু খেয়েছিলো কাল, অনেক সময় টেনশন থেকেও হয়।

পরীক্ষার আগে আমাদেরও হতো। বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলো ডাক্তার।

ডাক্তারের রসিকতা হরিপ্রসাদের ভালো লাগার কথা নয়। শক্ত গলায় বললো, সারবে কখন?

একটা ওষুধ দিচ্ছি। আশা করছি আজকের দিনটা বিশ্রাম নিলে কাল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।

তেওয়ারি ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে প্রেসক্রিপশন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

হরিপ্রসাদ গম্ভীর হয়ে বললো, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। কাল ভোরেই রওনা হবে।

টুপুল আর জয় ঘরে এসে বিছানায় গিয়ে উঠলো। জয় মুখ টিপে হেসে বললো, তুই আবার শুতে যাচ্ছিস কেন? তোর তো পেট খারাপ হয় নি?

হতে পারে। গম্ভীর হওয়ার ভান করলো টুপুল–ডায়রিয়া রোগটা ছোঁয়াচে।

গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো জয়। টুপুলেরও ঘুম পাচ্ছিলো। ঘুমোলে চলবে না। আসল কাজ এখনো বাকি।

বারোটা নাগাদ হরিপ্রসাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাবার সময় ওদের ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখে গেছে জয় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর টুপুল বিছানায় শুয়ে প্রচ্ছদে অমিতাভ বচ্চনের ছবিওয়ালা আনন্দলোক পড়ছে।

যেতে যেতে হরিপ্রসাদ ভাবলো, ছেলে দুটো বেশ নিরীহ প্রকৃতির। তেমন চালাক চতুর হলে নিশ্চয় পালাবার চেষ্টা করতো। যদিও তাতে সফল হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তবু ছেলেদুটোর স্বভাব-চরিত্র কিছুটা বোঝা যেতো। মনে হচ্ছে ওরা দেশে ফিরতে পারলেই খুশি।

হরিপ্রসাদ অবশ্য জানে দেশে ঠিকমতো ফিরলেও নজমুলে খপ্পর থেকে ওদের মুক্তি নেই। কারণ ওর আসল পরিচয় এরা জেনে গেছে। যদি দলে থাকতে না চায় ওর গ্রুপ এদের মেরে ফেলবে। এ নিয়ে অবশ্য হরিপ্রসাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ওর দরকার ছেলে দুটোকে দিয়ে নাজমুলের কাছে পৌঁছানো। ওর অফার পেলে নাজমুল যে প্রতুল সাহাদের সঙ্গে কোনো লেনদেন করবে না এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত।

হরিপ্রসাদ বেরিয়ে যাচ্ছে এটা টুপুল ঠিকই টের পেয়েছিলো। গাড়ির শব্দ গেটের বাইরে মিলিয়ে যাওয়ার পরও সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকলো। সকাল থেকে লক্ষ্য করেছে, জায়গাটা বেশ নির্জন। মাঝে মাঝে একটা-দুটো গাড়ির শব্দ আর ক্লান্ত ফেরিওয়ালার ডাক ছাড়া তেমন কোনো শব্দ নেই। বাড়ির চারপাশে অনেক গাছ। দুটো ঘুঘুর উদাস করা ডাক শুনেছে কিছুক্ষণ আগে। হরিপ্রসাদের বাড়ির ভেতরও লোকজনের কোনো সাড়া নেই।

জয় তখনও ঘুমোচ্ছে। ওকে না ডেকে টুপুল একাই উঠে বসলো। এ ঘরের দুটো বড় বড় জানালা। দুটোতেই ভারি পর্দা টানা। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর একবার পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল । তেওয়ারি নাশতা দিতে এসে ওদের কোনো কথা না বলে পর্দা টেনে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। ওরা বুঝে নিয়েছে পর্দা টানাই থাকবে।

খুব সাবধানে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দেখতে চাইলো টুপুল আশেপাশে কিছু দেখা যায় কিনা। জানালার বাইরে শুধু আকাশ আর গাছ। উঁচু দেয়ালে কিনার ঘেঁষে ঘন সবুজ দেবদারু গাছের আরো উঁচু দেয়াল। ওপাশে ঘরবাড়ি আছে কিনা বোঝার কোনো উপায় নেই। হতাশ হয়ে পাশের জানালার পর্দা সরালো। আগের মতই দৃশ্য, না, সামান্য পার্থক্য আছে। ডানপাশে দেবদারুর ফাঁক দিয়ে কিছুটা দূরে উঁচু ওভারহেড পানির ট্যাঙ্ক নজরে পড়লো, লোহার বানানো, কালো রঙ করা। কিছু না থাকার চেয়ে এটাও কম নয়।

একবার ছাদে গিয়ে দেখলে হয়! কথাটা মনে হতেই দরজা খুলে পা টিপে টিপে করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো টুপুল। ছাদে উঠলে নিশ্চয় চারপাশটা ভালোভাবে দেখা যাবে। রাস্তার কোনো দোকানের সাইনবোর্ড থেকে পাড়াটার নামও জানা যেতে পারে। উৎসাহ আর উত্তেজনায় টুপুলের বুকের ভেতর চিব ঢিব করছিলো।

দোতালায় উঠেই পাশে ছাদে ওঠার সিঁড়ি চোখে পড়লো ওর। সিঁড়ির ওপরের খোলা দরজা টুপুলকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। ছাদের সিঁড়িতে পা রাখতেই পেছনে ধমকের গলা ওর পিঠে চাবুক বসালোওদিকে কোথায় যাচ্ছো? তোমাদের ঘর থেকে বেরোতে বারণ করা হয় নি? যাও ঘরে।

কেয়ারটেকার দুবের ধমক খেয়ে টুপুল মুখ কালো করে ঘরে এসে ঢুকলো। রাতে টেলিফোনে স্বপ্নাকে কিছুই বলতে পারবে না–কথাটা মনে হতেই ওর বুকের ভেতর কান্না গুমরে উঠলো।

.

০৯.

রাত বারোটার পর থেকে স্বপ্না ওদের ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছিলো টুপুলের টেলিফোনের জন্য। ওর হাতে ধরা হার্ডি সিক্স-এর বইটা, মন ছিলো টেলিফোনের দিকে। ওর বাবা জাস্টিস রণেন মিত্র সোফার এক কোণে বসে টাইম ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। স্বপ্নার বাবা-মা বিকেলে ফিরেছেন কৃষ্ণনগর থেকে। টুপুলদের সঙ্গে ওর দেখা হওয়া থেকে শুরু করে ওদের বিপদের কথা বাবাকে সব খুলে বলেছে স্বপ্না। সবশেষে জানতে চেয়েছে, এখন আমরা কি করবো বাবা?

জাস্টিস মিত্র কিছুক্ষণ ভাবলেন পুরো বিষয়টা নিয়ে। তারপর মৃদু হেসে বললেন, তুমি রাতে ওর টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করবে। আমি তোমার সুকুমার কাকুকে ঘটনাটা জানিয়ে দিচ্ছি।

যদি ওরা রাতে টেলিফোন করতে না পারে? যদি ওদের অন্য কোথাও সরিয়ে দেয়?

তাহলে খুঁজে বের করা কঠিন হবে–চিন্তিত গলায় বললেন জাস্টিস মিত্র। তবে তোমার কাছে যখন ওদের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ঠিকানা আছে সেখানে হানা দিলে সুকুমাররা নিশ্চয় কোনো-না-কোনো তথ্য পাবে।

সুকুমার বসু কলকাতার পুলিশ কমিশনার, স্বপ্নার বাবার খুড়তুতো ভাই, প্রায়ই বেড়াতে আসেন এ বাড়িতে।

স্বপ্না জানতো, বাবাকে বললে তিনি একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় করবেন। বাবার সঙ্গে সুকুমার কাকুর কি কথা হয়েছে ও শোনেনি। শোনার মতো হলে ওকে ঠিকই বলা হতো। বাবা আর সুকুমার কাকু দায়িত্ব নেয়াতে স্বপ্নার উদ্বেগের বোঝা কিছুটা হালকা হলো। তবু দুশ্চিন্তা থেকেই গেলো–যদি টুপুলদের অন্য কোথাও সরিয়ে দেয়, তখন কি হবে!

গত রাতে টেলিফোন এসেছিল তিনটার দিকে। আজও কি রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? স্বপ্না যদি নিশ্চিন্ত হতো টুপুল টেলিফোন করবেই তাহলে সারারাত জেগে থাকতেও বরং খারাপ লাগতো না। অনিশ্চয়তার কারণে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও ক্রমশঃ অস্থির হয়ে উঠছিলো। জাস্টিস মিত্র পত্রিকা পড়লেও মেয়ের অস্থিরতা তাঁর নজর এড়ায়নি। এক ঘন্টার ভেতর স্বপ্না দুবার উঠে খাবার ঘরে গেছে পানি খেতে, কিছুক্ষণ বাইরের বারান্দায় পায়চারি করেছে, কখনো বসে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে আনমনেসবই তিনি লক্ষ্য করেছেন। নরম গলায় স্বপ্নাকে বললেন, তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন? টেলিফোন না এলেও আমরা তোর বন্ধুদের খুঁজে বের করবো।

বদমাশগুলো যদি টুপুল আর জয়কে মেরে ফেলে?

মনে হয় না। মারার ইচ্ছে থাকলে প্রথমেই মারতো। বাঁচিয়ে যখন রেখেছে নিশ্চয় কোন মতলব আছে।

তোমার কি ধারণা ওরা ও বাড়িতেই আছে?

তাই তো মনে হয়।

সরিয়ে যে ফেলে নি সিওর হচ্ছে কিভাবে?

খুব ছোট ছেলে তো নয়। ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নেয়ার অনেক ঝামেলা।

বাবার কথা শুনে স্বপ্নার উদ্বেগ কিছুটা কমলো। দেয়ালঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো একটা চল্লিশ। বললো, বাবা তুমি কফি খাবে?

তোর খেতে ইচ্ছে করলে আমিও খেতে পারি।

স্বপ্না মৃদু হেসে ডাইনিং রুমে গেলো। টেবিলের ওপর ফ্ল্যাস্কে গরম পানি রেখে গেছেন মা। বলেছেন চা কফি খেতে ইচ্ছে করলে বানিয়ে খেতে। ওর ভীষণ মাথা ধরেছে বলে শুয়ে পড়েছেন। স্বপ্নার বন্ধুদের জন্য তিনিও কম চিন্তিত ছিলেন না।

রাত দুটো দশ মিনিটে টুপুলের টেলিফোন এলো। একবার রিং রাজতেই স্বপ্না ছুটে গিয়ে রিসিভার তুললো। টুপুল হতাশাভরা গলায় বললো, আমাদের ঘর থেকে বেরোতে দেয় নি, স্বপ্না। বাড়ির লোকেশানটা কোথায় কিছুই বুঝতে পারছি না।

কাছাকাছি ট্রাম রাস্তা আছে? শব্দ শুনেছো?

না ট্রামের শব্দ শুনি নি। পুর্বদিকে কালো রঙের বড় একটা ওভারহেড ট্যাঙ্ক আছে। এ ছাড়া আশেপাশে উঁচু কিছু চোখে পড়ে নি।

বাড়িটা কি রকম?

পুরোনো ধাঁচের । দোতালা। চারপাশে বাগান। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের ওপর রূপোলি রঙের কাঁটাতারের ঘেরা, চারদিকে দেবদারু গাছের ঘন সারি বাড়িটাকে আশেপাশের এলাকা থেকে আড়াল করে রেখেছে।

আর কিছু বলতে পারবে?

বাড়ির বাইরের রঙ লাইট গ্রীন, জানালা-দরজা ক্রিম কালারের।

বাউন্ডারি ওয়ালের রঙ কি?

ভেতরের দিকটা ক্রিম, বাইরেরটা বলতে পারছি না। যে আমাদের আটকে রেখেছে। তার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তার নাম হরিপ্রসাদ আগরওয়ালা। টুপুল এতক্ষণ চাপা গলায় কথা বলছিলো। হঠাৎ গলার স্বর পরিবর্তন করে স্বাভাবিকভাবে বললো, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না স্বপ্না। বাড়ি গিয়েই লিখবো। রাখি তাহলে।

ওপাশ থেকে রিসিভার নামিয়ে রাখতেই স্বপ্না বুঝলো ফোন করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। টুপুল ফোনে কি বলেছে বাবাকে বললো। জাস্টিস মিত্র বললেন, তুমি এবার ঘুমোতে যেতে পারো। আশা করি কাল সকালেই তোমার বন্ধুদের উদ্ধার করতে পারবো।

বাবার কথার কোন প্রতিবাদ না করে স্বপ্না ওর ঘরে গিয়ে কম্বলের তলায় ঢুকলো। টুপুল যে ধরা পড়ে গেলো–ওকে কি ওরা মারধোর করবে? ঘুমোনোর আগে পর্যন্ত কথাটা সারাক্ষণ ওর মাথায় ঘুরপাক খেলো।

স্বপ্নাকে টেলিফোন করার জন্য ঘর থেকে একাই বেরিয়েছিলো টুপুল। জয়ের শরীর খারাপ বলা হয়েছে, ওকে বাইরে দেখলে বুঝে ফেলবে যে ও আসলে অসুস্থ নয়। টেলিফোনে স্বপ্নাকে হরিপ্রসাদের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখলো সে এদিকেই আসছে। নিশ্চয় আগে ওদের ঘরে উঁকি মেরে দেখেছে ও যে বিছানায় নেই।

শেষের কথাগুলো হরিপ্রসাদকে শোনাবার জন্য জোরেই বলেছিলো। তারপর যেন ওকে এইমাত্র দেখেছে–তড়িঘড়ি রিসিভার রেখে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলো।

কাকে ফোন করেছে। কাটা কাটা প্রশ্ন হরিপ্রসাদের।

আমার বন্ধু স্বপ্না। ভয়–পাওয়া গলায় জবাব দিলো টুপুল।

কি বলেছো ওকে?

বলেছি কাল আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। জয় অসুস্থ বলে আজ ওর সঙ্গে দেখা করতে পারি নি। দেশে গিয়ে ওকে চিঠি লিখবো।

বন্ধুকে টেলিফোন করবে, লুকিয়ে এত রাতে কেন?

জয় অসুস্থ বলে মনে ছিলো না। স্বপ্নাকে ফোন না করলে ও চিন্তিত হতে পারে সেজন্য..

তুমি কথা লুকোচ্ছো পাজি ছেলে। কাছে এসে হরিপ্রসাদ ঠাস করে চড় মারলো টুপুলের গালে। সঙ্গে সঙ্গে ওর ফর্সা গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ ফুটে উঠলো, যন্ত্রণায় চোখ থেকে পানি বেরিয়ে এলো।

আমি কোনো কথা লুকোই নি। বিশ্বাস না হলে নম্বর দিচ্ছি, আপনি ওকে টেলিফোন করুন।

আমি কেন ওকে ফোন করবো কমবখত? এই বলে হরিপ্রসাদ টুপুলের চুলের ঝুটি ধরে হিড় হিড় করে ওকে টেনে নিয়ে ওদের ঘরে ঢোকালো। ফের যদি ঘর থেকে বেরোতে দেখি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।

টুপুলকে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে হরিপ্রসাদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। টুপুল টের পেলো বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিছানায় শুয়ে রাগে, অপমানে, হতাশায় টুপুল হু হু করে কেঁদে উঠলো। ওর কান্নার শব্দে জয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। ছুটে এসে টুপুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলো–কি হয়েছে টুপুল, এভাবে কাঁদছিস কেন?

শুয়োরের বাচ্চা হরিপ্রসাদ আমাকে চড় মেরেছে। স্বপ্নাকে ফোন করেছি, ও দেখে ফেলেছে। কান্না চেপে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো টুপুল।

জয় সান্তনার গলায় বললো, তুই কি ভেবেছিস আমরা এই বদমাশদের ছেড়ে দেবো? কাল যখন আমাদের নিয়ে বাইরে যাবে, পুলিশ দেখলেই চিৎকার করে বলবো আমাদের কিডন্যাপ করেছে। থানায় গিয়ে হরিপ্রসাদ, প্রতুল সব কটাকে ধরিয়ে দেবো।

থানার লোকেরা কি আমাদের ছেড়ে দেবে? টুপুল ভেজা গলায় বললো, ভুলে যাচ্ছিস কেন আমরাই ওদের হেরোইন বয়ে এনেছি। তার ওপর ইন্ডিয়া এসেছি বিনা পাসপোর্টে।

তাতে কি হয়েছে? এত বড় একটা গ্যাং ধরিয়ে দিচ্ছি, এটা কম কি! স্বপ্নার বাবা হাইকোর্টের জাস্টিস। তিনি নিশ্চয় আমাদের সাহায্য করবেন।

জয়ের কথায় মোটেই ভরসা পেলো না টুপুল। পুলিশকে বললেই কি ওরা হরিপ্রসাদ আর প্রতুলকে অ্যারেস্ট করবে? হেরোইন কি ওদের কাছে আছে? কিভাবে প্রমাণ করবে এদের মত গণ্যমান্য লোক হেরোইনের ব্যবসা করে? পুলিশ ওদের কিছুই করতে পারবে, বরং বিনা পাসপোর্টে ইন্ডিয়া আসার জন্য টুপুলদেরই জেলে ঢুকিয়ে দেবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এমন দুর্গতি হবে জানলে জীবনেও ওরা পালাবার নাম করতো না।

শেষ রাতের দিকে টুপুল আর জয় ঘুমিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পরই ওদের কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলো হুইসেল আর বন্দুকের গুলীর শব্দে। পর পর তিনবার বন্দুকের শব্দ শুনে ওরা ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো। করিডোর ভারি বুটজুতো পরে কয়েকজনকে দৌড়ে যেতে শুনলো। টুপুল উত্তেজিত গলায় বললো, পুলিশ রেইড করেছে।

জয় বললো, এখন বের হওয়া চলবে না। শয়তানগুলো আগে সব কটা ধরা পড়ুক।

ওর কথা শেষ না হতেই আবার বন্দুকের শব্দ শুনলো, বাইরে মাইকের শব্দ হলো–সবাই হাত তুলে বেরিয়ে এসো, আগারওয়ালারা ধরা পড়েছে।

টুপুলদের ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। হাতে পিস্তল হাতে ছুটে এলো দশাসই শরীরের কেয়ারটেকার দুবে। ভেতরে ঢুকে পিস্তল উঁচিয়ে বললো, মাথার ওপর হাত তুলে এক পা এক পা করে ঘর থেকে বেরোও শয়তানরা। বেশি চালাকি করতে চাইলে মাথার খুলি উড়ে যাবে।

টুপুল আর জয় হতভম্ব হয়ে মাথার ওপর হাত তুললো। তারপর দুবের কথামতো ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরোলো। বাইরে তখন সূর্য না উঠলেও আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। পুবের আকাশে সিঁদুরের ছোপ লেগেছে। গাড়ি বারান্দার নিচে এসে দুবে চিৎকার করে বললো, কেউ আমাকে বাধা দিলে এই ছেলে দুটোর মাথার খুলি উড়ে যাবে।

বাগানের লনে কয়েকজন পুলিশসহ দুজন মাঝবয়সী অফিসার ছিলেন। একজন রিভলবার তুলতেই বয়স্ক অফিসার ইশারায় বাঁধা দিলেন। দুবে সেটা লক্ষ্য করলো। টুপুলদের কিছুই করার নেই। অসহায় ভঙ্গিতে দুহাত ওপরে তুলে ওরা গেট-এর দিকে এগিয়ে গেলো। দুবের ঠোঁটের ফাঁকে বিজয়ীর হাসি।

গেটের কাছে জিপে আগওয়ালারা দুই ভাই বসেছিল। দুবে জিপের কাছে এসে ড্রাইভারকে বললো, চাবি রেখে এক্ষুণি নেমে পড়ো।

আগাওয়ালদের চেহারা থেকে হতাশার কালো মেঘ সরে গেলো। ওয়েল ডান দুবে বলে হরিপ্রসাদ ধাক্কা মেরে ড্রাইভারকে জিপ থেকে ফেলে দিলো। তারপর নিজেই ইঞ্জিনে স্টার্ট দিলো।

ঠিক তখনই গুলীর শব্দ হলো। দুবের হাত থেকে পিস্তল ছিটকে পড়লো। আই বাপ বলে রক্তাক্ত হাত চেপে ধরে দুবে মাটিতে গড়াগড়ি খেলো। তীব্র গতিতে একটা জিপ এসে হরিপ্রসাদের জিপের সামনে এসে দাঁড়ালো।

লনে যে দুজন বয়স্ক পুলিশ অফিসার ছিলেন তারা এসে আগরওয়ালাদের দুই ভাই আর দুবেকে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। জীপ থেকে একজন তরুণ অফিসার নেমে টুপুলদের কাছে এসে বললো, তোমরা নিশ্চয় জয় আর টুপুল। আমার সঙ্গে এসো।

ঢোক গিলে জানতে চাইলো টুপুল–কোথায়?

হাসি মুখে অফিসার জানালো–জাস্টিস মিত্র-র বাড়িতে। কমিশনার এস. বোসও তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আনন্দে আত্মহারা হয়ে টুপুল আর জয় একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হাতকড়া পরানো হরিপ্রসাদের কাছে গিয়ে ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মেরে টুপুল বললো, এটা তোমরা পাওনা ছিলো কমবখত। জয় আরেকটা চড় মেরে বললো, এটা হচ্ছে বোনাস।

স্বপ্নাদের বাড়িতে নাশতা খেতে খেতে টুপুল বললো, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তো বাড়ির লোকেশন সম্পর্কে কিছুই বলতে পারি নি। পুলিশ খবর পেলো কি করে?

জাস্টিস মিত্র মৃদু হেসে বললেন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে বলা হয়েছিলো, আমার বাড়িতে মাঝরাতে যে কলটা আসবে ওটা ডিটেক্ট করতে। তুমি যখন টেলিফোন করলে এক্সচেঞ্জওয়ালারা বুঝে ফেললো ওটা আগরওয়ালার বাড়ি থেকে হচ্ছে। আনোয়ার শাহ রোডে ওদের বাড়ি কে না চেনে?

আমাদের কিডন্যাপ করাটা তো বড় অপরাধ নয়। ওদের আসল কারবার তো হেরোইনের। সেটাই প্রমাণ করা গেলো না।

কে বললো গেলো না? মোটাসোটা পুলিশ কমিশনার বোস হাতে-ধরা পাইপে লম্বা টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বললেন, তোমার টেলিফোনের পর হরিপ্রসাদ প্রতুল সাহাকে ফোন করে বলেছে ও হেরোইনের কমিশনের টাকা পাঠায় নি বলে তোমাদের দুজনকে ফেরত পাঠাতে পারছে না। যদি দুঘন্টার মধ্যে ও টাকা পাঠায়, ওর অনুরোধ বিবেচনা করবে।

প্রতুল সাহা কি ধরা পড়েছে?

শুধু ধরা পড়া নয়। ওর বাড়িতে সোনার খনি পাওয়া গেছে। হা হা করে হাসলেন কমিশনার।

সোনার খনি মানে? টুপুল আর জয়ের চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেলো।

খনি মানে তাল তাল সোনা। কম করে হলেও টন খানেক হবে। সবই হেরোইন বেচা সোনা।

জয় এবার আসল কথা পাড়লো। স্বপ্নার বাবাকে বললো, আমরা তো বিনা পাসপোর্টে ইন্ডিয়া এসেছি। তার কি হবে?

তোমাদের আমি চৌদ্দ বছরের জেল আর চৌদ্দবার ফাঁসি দেবো। গম্ভীর গলায় বললেন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ কমিশনার বোস।

এ্যাঁ। টুপুল আর জয়ের মুখ সাদা হয়ে গেলো। স্বপ্না যে ওঁর কথায় মুখ টিপে হাসছিলো সেটা ওদের নজরে পড়লো না।

জাস্টিস মিত্র মৃদু হেসে বললেন, আমি বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। আজই তোমাদের পাসপোর্ট ভিসা রেডি হয়ে যাবে।

আসলে তোমরা পাসপোর্ট নিয়েই এসেছিলে। কমিশনার বোস বললেন, মনে করো ওটা হারিয়ে ফেলেছে। তাই নতুন করতে হচ্ছে।

স্বপ্না বললো, এভাবে না হলে তোমরা ঝামেলায় পড়বে।

পরদিন কোলকাতার সব কাগজে দুই বাংলাদেশী তরুণের দুঃসাহসিক অভিযানের বিবরণ ছাপা হলো, যাদের সাহায্যে কোলকাতার পুলিশ দুই দুর্ধর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আর তাদের চক্রকে গ্রেফতার করেছে। কয়েকটা পত্রিকায় জয় আর টুপুলের ছবিও বেরিয়েছে।

বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার জানালেন, রাজশাহী সার্কিট হাউস থেকে নাজমুল আবেদিনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। টুপুলদের ও মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে বিপ্লবী নেতা বলে। আসলে ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের খুনীদের দলের এক বড় পাণ্ডা, গোপনে হেরোইন ব্যবসা করতো।

সাতদিন পর ডেপুটি হাই কমিশনারের সার্কাস এভিনিউর বাড়িতে চমৎকার এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছিলো। জয় আর টুপুল স্বর্ণ উদ্ধারের কমিশন পেয়ে তখন অনেক টাকার মালিক। হাই কমিশনার বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে জয়ের বাবা-মা, টুপুলের বাবা আর ওদের স্কুলের হেডমাস্টার ব্রাদার মার্টিনকে কলকাতা এনেছেন। যেদিন পার্টি সেদিন বিকেলের ফ্লাইটেই এসেছেন ওঁরা সবাই।

ব্রাদার মার্টিন তার স্কুল টিমের দুই কৃতি ফুটবলারকে বুকে জড়িয়ে ধরে চাপা গলায় বললেন, সব শুনছি। সবই ঠিক আছে। মাঝে মধ্যে বাড়ি থেইক্যা পলাইয়া যাওনও ভালো। তয় পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া মোটেই ভালো না।

জয় আর টুপুল দুজনই বললো, আমরা আর কখনও দশের নিচে নামবো না।