৩-৪. চট্টগ্রামের উল্টো দিকের ট্রেনে

মাঝরাতে টুপুল আর জয় যখন শুনলো ভুলে তারা চট্টগ্রামের উল্টো দিকের ট্রেনে চেপে জগন্নাথগঞ্জ এসে পড়েছে তখন তারা কিছুক্ষণের জন্যে হতবাক হয়ে গেলো। ট্রেনের কামরায় যাত্রী বেশি ছিলো না। সবার শেষে এক বুড়ো ভদ্রলোক নামলেন বগলে বেডিং আর টিনের স্যুটকেস হাতে। নামার সময় তিনি একগাল হেসে বললেন, তোমরা কি ফেরি পার হবে? মেল ট্রেন এসে গেলে স্টিমারে বসার জায়গা পাবে না। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন টুপুলরা স্টিমারে যমুনা পার হয়ে সিরাজগঞ্জ যাবে।

বুড়ো নেমে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর যাত্রীদের কোলাহল যখন মিলিয়ে গেলো টুপুল জয়কে জিজ্ঞেস করলো, এখন কি করবি?

জয় বললো, যশোরে আমার এক বোনের বিয়ে হয়েছে। ওদের বাড়ি গিয়ে কদিন থাকা যায়।

আমাদের না চিটাগাং যাওয়ার কথা! জাহাজে চাকরি নিয়ে দেশে দেশে ঘুরবো!

বাড়ি যাবো না ঠিক করেছি যখন তখন চিটাগাং যশোর দুই-ই আমার কাছে সমান। তাছাড়া তুই চিটাগাং গেলেই যে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পাবি তার কোন ঠিক আছে?

তোর বোন যদি বাড়িতে খবর দেয়?

বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি যেতে দশ-বারো দিন লাগে। তাছাড়া ওদের বলার দরকার কি যে আমরা পালিয়ে এসেছি! বলবো পরীক্ষা শেষ, বেড়াতে বেরিয়েছি। গত বার যাবার সময় জামাইবাবু বারবার বলেছে যেতে।

বেড়াতে যাবো এভাবে ছন্নছাড়ার মতো?

সিরাজগঞ্জ গিয়ে দুটো প্যান্ট শার্ট আর বাকি সব জিনিস কিনে নেবো। বাজেট তো করাই আছে?

ভাগ্যিস পথে কোন টিকেট চেকার এ কামরায় আসেনি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো টুপুল।

চল তাহলে, স্টিমারে গিয়ে জায়গা নিতে হবে।

ট্রেনের কামরায় জানালা-দরজা সব বন্ধ ছিলো বলে ওরা পৌষের শীতের দাপট টের পায়নি। চারদিক ফকা নির্জন স্টেশনে নামতেই ঠাণ্ডা বাতাস ওদের হাড়ে কামড় বসালো। ঢাকার কুয়াশায়র চেয়ে অনেক বেশি শীত উত্তরের এসব এলাকায়। ওদের দুজনের গায়েই উলের পুরো হাতার সোয়েটার ছিলো। পরনে গরম প্যান্ট আর পায়ে জুতো-মুজোও ছিলো। তবু ওদের মনে হলো ওভারকোট কিংবা মোটা উলের চাদর ছাড়া এ শীত কাবু করা যাবে না।

কিছুদূর হেঁটে স্টিমার ঘাটে এসে মনে হলো শীতের দাপট যেন আরও বেড়েছে। লোকজন লোমওয়ালা বানরটুপি আর হাতমুজো পরে মোটা চাদর আর কম্বলে গা মুড়ে স্টিমারের ডেক-এ বসে আছে। ঘাটের কুলিরা পর্যন্ত তিন-চারটা জামা আর সোয়েটার পরেছে। আগে স্টিমারে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে টুপুল বললো, ওপরে বসা যাবে না। নিচে ইঞ্জিনঘরের কাছে গিয়ে বসলে শীত কম লাগবে।

জয় কোনো কথা না বলে টুপুলকে অনুসরণ করলো। ডেকের ওপর যাত্রী বেশি ছিলো না। ওরা ভেবেছিলো নিচের তলা বুঝি ফাঁকা পাবে। ভেতরে ঢুকে স্টিমারের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত এক চক্কর দিয়েও বসার জায়গা পেলো না। কোথাও লোকজনের ভিড় তেমন নেই। তবে এক একজন লেপ কম্বল বিছিয়ে তিন-চারজনের জায়গা দখল করে শুয়ে-বসে থাকার জন্য জায়গার অভাব দেখা দিয়েছিলো ।

জয় কাষ্ঠ হেসে বললো, মনে হচ্ছে ডেকে বসে বাকি রাত শীতের কামড় খেয়ে কাটাতে হবে।

টুপুল বললো, কাউকে বলে দেখি বসার জায়গা দেয় কি না।

কাকে বলবি? বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে মেয়েছেলে রয়েছে।

ইঞ্জিনের পাশে এক ভদ্রলোক মনে হলো একা আছেন।

বললে যদি খেঁকিয়ে ওঠে? এমনিতে সঙ্গে টিকেট নেই।

চেহারা দেখে তো ভালোই মনে হলো। চল না বলে দেখি।

টুপুলের পেছন পেছন জয় আবার এগিয়ে গেলো ইঞ্জিনের দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করলো, লোকটা যেন রাজি হয়। ডেকে বসে বিনা কম্বলে রাত কাটাতে হলে নির্ঘাত মারা পড়বে।

ভদ্রলোকের বয়স তিরিশের কোটায়। গায়ের রঙ ফর্সা, ধারালো বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, মনে হয় কোন বিদেশি কোম্পানীর এক্সিকিউটিভ, যাকে স্টিমারের কেবিনে ভালো মানাতো। টুপুল বিনয়ের সঙ্গে বললো, স্যার আমরা কোথাও বসার জায়গা পাচ্ছি না। দয়া করে যদি আপনার বিছানাটা একটু সরাতেন–আমরা বসতে পারতাম।

ভদ্রলোক একটা নোটবইতে কি যেন লিখছিলেন। টুপুলের কথা শুনে চোখ তুলে তাকালেন। দুটি নিষ্পাপ মুখ, পেটানো শরীর, মনে হয় স্পোর্টসম্যান–দেখে ওর ভালো লেগে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা চিন্তাও ঝলসে উঠলো। হেসে বললো, বিছানা সরাতে হবে কেন, ওপরেই বসো। তুমি বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো?

নরম কম্বলের বিছানায় ভদ্রলোকের দুপাশে বসে টুপুল আর জয় বিনয়ে বিগলিত হলো–অবশ্যই আমাদের তুমি বলবেন। বয়সে স্যার আমরা আপনার অনেক ছোট।

নরম হেসে ভদ্রলোক বললো, আমি খুশি হবো আমাকে স্যার না ডেকে যদি নাজমুল ভাই বলো। আমার নাম নাজমুল আবেদিন খান। এই বলে হাত বাড়িয়ে দিলো।

টুপুল প্রথমে নিজের নাম বলে হাত মিলিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুবই খুশি হয়েছি।

জয়ও নিজের নাম বলে সদ্য-পাওয়া নাজমুল ভাই-র সঙ্গে হাত মেলালো।

তোমরা কি ঢাকা থেকে আসছো?

টুপুল আর জয় মাথা নেড়ে সায় জানালো। নাজমুল আবার প্রশ্ন করলো, কোথায় থাকো তোমরা?

এবার ক্লাস টেন-এ উঠেছি।

কোন স্কুল? কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সত্যি কথা বলবে না এটা টুপুলরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলো। কিন্তু নাজমুল আবেদিনকে প্রথম দেখাতেই ওদের এত ভালো লেগে গিয়েছিলো যে স্কুলের আসল নামটা বলে ফেললো। ভদ্রলোকের গলায় নির্দোষ কৌতূহল ছাড়া আর কিছু ছিলো না।

ওদের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মিষ্টি হেসে নাজমুল বললো, তোমরা যে জয়ের বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছো নিশ্চয় তোমাদের বাড়ির কেউ জানে না!

টুপুল আর জয়ের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, ঢোক গিলে টুপুল বললো, আপনি কিভাবে বুঝলেন?

তোমাদের সঙ্গে কোন লাগেজ না দেখে অনুমান করেছি।

কিছুক্ষণের জন্য ওরা হতভম্ব হয়ে গেলো। নাজমুলের মিটিমিটি হাসি দেখে মনে হচ্ছে সে ওদের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর জানে। জয় চাপা গলায় বললো, আপনি কি গোয়েন্দার কাজ করেন নাজমুল ভাই?

হা-হা করে গলা খুলে হাসলো নাজমুল আবেদিন–আরে না, গোয়েন্দাগিরি করবো কেন? আমি ইম্পোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা করি।

কারো সঙ্গে লাগেজ না থাকলে ধরেই নিতে হবে। সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে? জানতে চাইলো টুপুল।

না, না, লাগেজ না থাকলেই তাকে বাড়ি-পালানো বলতে যাবো কেন? তোমরা ঢাকা থেকে যশোর যাচ্ছো বোনের শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে ব্যাগ-স্যুটকেস নেই–কুটুম্ববাড়িতে কেউ নিশ্চয় একবস্ত্রে বেড়াতে যায় না!

তার মানে ব্যাগ-স্যুটকেস থাকলে আপনি বুঝতে পারতেন না আমরা বাড়ি থেকে পালিয়েছি কি না।

তা পারতাম না। তবে ব্যাগ-সুটকেস গুছিয়ে বেরোবার সময় বাড়ির লোকজন নিশ্চয় জানতে পারতো। তখন আর সেটাকে পালানো বলা যেতো না।

জয় করুণ গলায় বললো, আপনি নিশ্চয় আমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবেন না নাজমুল ভাই? আমরা বাড়ি থেকে পালালেও সত্যি বলছি দিদির বাড়িতেই যাচ্ছি।

টুপুল যোগ করলোআমাদের সঙ্গে সামান্য কিছু টাকা আছে। সিরাজগঞ্জে নেমে শার্ট প্যান্ট আর একটা ব্যাগ কিনে নেবো।

নাজমুল মিষ্টি হেসে বললো, তোমরা যদি আমাকে বন্ধু ভেবে থাকো তাহলে নিশ্চয় পুলিশে খবর দেবো না।

বিস্ময় আর আনন্দে অভিভূত হয়ে টুপুল বললো, আপনার মত বন্ধু পাওয়া মস্ত বড় ভাগ্যের ব্যাপার!

জয় বললো, আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।

নাজমুল দুহাতে জয় আর টুপুলকে কাছে টেনে বললে, এখন থেকে আমরা বন্ধু। কেউ কাউকে অবিশ্বাস করবো না। এবার বলো, বাড়ি থেকে পালিয়েছো কেন?

পরীক্ষার ফল বেরোনো থেকে শুরু করে সারাদিন যা যা ঘটেছে সব কথা নাজমুলকে খুলে বললো টুপুল।

সহানুভূতির গলায় নাজমুল বললো, তোমরা যে বাড়ি থেকে পালিয়েছে বাড়িতে মা কান্নাকাটি করবেন না?

টুপুল ম্লান হেসে বললো, আমার মা থাকলে তো কাদবেন। লেখাপড়ায় ভালো নই বলে ভাইয়া যখন তখন মারে। বাবাও ওকে কিছু বলে না। ভাইয়া বলে আমি নাকি বংশের কলঙ্ক।

তোমারও কি মা নেই। আমাদের এগারো ভাই-বোন। বাবার কথার ওপর কারো কথা বলার সাধ্য নেই। বাবা বলেছেন, পরীক্ষার পনেরোর ভেতর না থাকলে যেন কখনও বাড়িমুখো না হই।

ওটা রাগের কথা। সত্যি সত্যি এমন কথা কোনো বাবা বলতে পারেন না।

আমার বাবা পারেন। তিনি যা বলেন তাই করেন।

পাশের জানালা দিয়ে নদী থেকে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস উঠে এসে ওদের গায়ে কাঁপন ধরিয়ে বয়ে গেলো। নাজমুলের গায়ে পর্যাপ্ত গরম কাপড় থাকার জন্য নিজে টের না পেলেও ওদের কাঁপুনি অনুভব করলো । উঠে বেঞ্চের তলা থেকে বড় একটা স্যুটকেস টেনে নিয়ে তালা খুলে ভেতর থেকে একটা কম্বল বের করে বললো, তোমরা এটা গায়ে জড়িয়ে বসো, শীত লাগবে না।

টুপুল বিব্রত গলায় বললো, এখানে আর তেমন শীত কই?

স্টিমার ছাড়লে টের পাবে শীত কাকে বলে।

জয় বললো, আপনার শীত লাগবে না?

আমার গায়ে যে কোট দেখছো এটা ইউরোপের শীতকেও বুড়ো আঙুল দেখায়।

একটু ইতস্তত করে টুপুল বললো, আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি খুব বড়লোক। আপনি কেবিনে না গিয়ে সবার সঙ্গে সেকেন্ড ক্লাসে কেন যাচ্ছেন?

মৃদু হেসে নাজমুল বললো, খুব বড়লোক না হলেও আমাকে অবস্থাপন্ন বলতে পারো। তবে টাকা থাকলেই দেখাতে হবে–এটাকে আমি বলি ছোটলোকিপনা। আমার পছন্দ সাধারণ মানুষের সঙ্গে চুপচাপ বসে তাদের সুখ-দুঃখের কথা শোনা।

আপনি অদ্ভুত মানুষ নাজমুল ভাই।

ভালো অর্থে, না খারাপ অর্থে?

অবশ্যই ভালো অর্থে। আপনি কেবিনে গেলে কি আর আপনার ধারে-কাছে ভিড়তে পারতাম!

নাজমুল গলা খুলে হাসলো–তাহলেই দেখ সেকেন্ড ক্লাসে থাকাতেই তোমাদের মত চমৎকার দুটো বন্ধু পেয়ে গেলাম।

নাজমুলের আন্তরিকতায় জয় আর টুপুল একেবারে গলে গেলো। অল্প সময়ে মানুষকে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে নাজমুলের। কাছে বসতে দিয়ে হেসে দুটো কথা বলে, একটুখানি কম্বলের উষ্ণতা দিয়ে ওদের যেন কিনে ফেলেছে সামান্য পরিচয়ের প্রায়-অচেনা এই মানুষটি।

হাতের ঘড়ি দেখে নাজমুল বললো, রাত দেড়টা বাজে। তোমাদের ঘুম পাচ্ছে না?

ট্রেনে লম্বা ঘুম দিয়েছি। টুপুল বললো, আপনি কি ঘুমোবেন।

মিষ্টি হেসে নাজমুল বললো, আমার ভালো লাগছে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে।

জয় বললো, তাহলে আপনার নিজের কথা বলুন নাজমুল ভাই।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে নাজমুল বললো, তোমাদের দুজনকে আমার ভালো লেগেছে কেন জানো?

কেন? একসঙ্গে জানতে চাইলো টুপুল আর জয়।

আমিও তোমাদের মতো ঘর-পালানো ছেলে। নাজমুলের ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি।

সব কথা শুনতে চাই নাজমুল ভাই।

শুরু থেকে বলতে হবে কেন, কখন, কিভাবে পালালেন?

শোনো তাহলে। কোটের ভেতরের পকেট থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরালো নাজমুল। লম্বা এক টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বললো, আমি পালিয়েছি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে।

কেন পালালেন?

পরীক্ষা দেয়ার পরই বুঝে গিয়েছিলাম পাশ করতে পারবো না। চিটাগাং-এ বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে মায়ের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জয়দের মতো আমাদের পরিবারও কম বড় ছিলো না। আমরা আট ভাইবোন আমি সবার ছোট। মা বেশির ভাগ সময় হাসপাতালে থাকতেন। বাবাও ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসার কাজে। বখে যাওয়ার সব রকম সুযোগই ছিলো আমার। যে জন্য রেজাল্ট খারাপ হয়েছিলো। ইন্টারমিডিয়েট দেয়ার পর মনে হলো বাপের অনেক টাকা উড়িয়েছি। এবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেখি কিছু করতে পারি কি না। টুপুলের মতো আমার বড় ভাইরাও আমাকে বলতো ফ্যামিলির ব্ল্যাকশিপ, বংশের কলঙ্ক। কাউকেই আমি কেয়ার করতাম না। সেজো ভাইটা একবার একটা চড় মেরেছিলো। আমিও পাল্টা মেরেছি। তারপর থেকে আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কারো হয়নি।

নাজমুলের কথা শুনে টুপুল ভাবলো, ও মিছেমিছি হাবুলের মার খাচ্ছে। গায়ের জোরে এখন আর হাবুল ওর সঙ্গে পারবে না। এবার থেকে মারের জবাব দিতে হবে।

একটু থেমে সিগারেটে দুটো টান দিয়ে রিং-এর মত গোল করে ধোয়া ছেড়ে নাজমুল বললো, চিটাগাং গিয়ে এক ক্লিয়ারিং এজেন্টের ওখানে কেরানীর চাকরি নিলাম। মাস ছয়েক পর এক ইটালিয়ান জাহাজের বুড়ো ক্যাপ্টেনের নজরে পড়ে গেলাম। চেহারাটা নেহাৎ খারাপ ছিলো না। তাছাড়া স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার জন্যে ইংরেজিও ভালো বলতে পারতাম। ক্যাপ্টেন জাভাত্তিনি বললো আমার মতো নাকি ওর একটা ছেলে ছিলো। মাফিয়ারা মেরে ফেলেছে। আমাকে ওর জাহাজে চাকরি অফার করলো। শোনামাত্র আমি লুফে নিলাম। এরপর আট বছর ধরে জাভাক্তিনির সঙ্গে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বন্দর থেকে বন্দরে ঘুরেছি। জাভাত্তিনি আমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো। ছ বছর না পেরোতেই আমাকে সেকেন্ড অফিসর বানিয়ে দিয়েছিলো। আট বছরের মাথায় জাহাজেই মারা গেলো জাভাত্তিনি। আমি ওর কামরায় ঘুমোতাম। হঠাৎ মাঝরাতে উঠে বললো, ডাক্তার ডাকো, বুকে খুব ব্যথা হচ্ছে। ছুটে গেলাম ডাক্তারের কাছে। এসে দেখি সব শেষ। জাভাত্তিনির শেষ। ইচ্ছামতো সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়া হলো ওর লাশ। তারপর আর জাহাজের চাকরি ভালো লাগলো না। সব ছেড়ে দেশে ফিরে এলাম।

বাড়ির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি? জানতে চাইলো টুপুল।

জাহাজে চাকরি নেয়ার পর মার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ রেখেছিলাম। দুবছরের মাথায় বাবা মারা গেলেন। তার আটমাস পর মা। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছি দেড়মাস পর। তারপর থেকে বাড়ির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখিনি। জাহাজের চাকড়ি ছাড়লেও সমুদ্র আমাকে সব সময় ডাকে। এখনও সময় পেলেই জাহাজে উঠে বসি। পুরোনো বন্দরে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে আসি।

জয় প্রশ্ন করলো, আপনি বিয়ে করেননি?

না। মৃদু হেসে নাজমুল বললো, ঘর সংসার করা আমার স্বভাবে নেই। সমুদ্র যাদের ডাকে তারা কখনো সংসারী হতে পারে না।

ডিসেম্বরের শীতের গভীর রাতে যমুনার বুকে স্টিমারে বসে সদ্য পরিচিত এই সুদর্শন মানুষটি টুপুল আর জয়ের সামনে নানা রঙে বোনা এক স্বপ্নের জগতের অবিশ্বাস্য ছবি মেলে ধরলো। ওরা দুজনই ওদের রক্তের ভেতর অনুভব করলো সমুদ্রেক ডাক। মনে হলো ওরা যমুনা নদীর তীরে বাঁধা কোনো স্টিমারে নয়, গভীর আটলান্টিকের বুক চিরে ভেসে যাওয়া কোনো জাহাজে বসে আছে আলো-ঝলমলে বন্দরের অপেক্ষায়।

দুই কিশোরের নিষ্পাপ চোখে মুগ্ধ বিস্ময় নাজমুলও লক্ষ্য করলো। নরম গলায় বললো, তোমরা কি সত্যিই জাহাজে কাজ পেতে চাও?

জাহাজ আমাদের স্বপ্ন নাজমুল ভাই। ফিসফিস করে বললো টুপুল।

কতদিন আমরা গল্প করেছি অচেনা সব বন্দরে ঘোরার। জয়ের গলায় চাপা উত্তেজনা।

নাজমুল মৃদু হাসলো–ঠিক আছে, তোমাদের আমি জাহাজে চাকরি জোগাড় করে দেবো। তবে সময় লাগবে।

কতদিন? ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো টুপুল।

ধরো ছ-সাত মাস।

এ কদিন আমরা কোথায় পালিয়ে থাকবো?

আমার কাছে থাকবে। না, না কোনো দয়া দেখাচ্ছি না। তোমরা চিটাগাং আমার ফার্মে কাজ করবে। পরে এটা তোমাদের অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজে লাগবে। একটু থেমে নাজমুল বললো, আর কোন কথা নয়, রাত তিনটা বাজে। এখন ঘুম। বাকি কথা কাল হবে।

.

০৪.

পরদিন বিকেলে রাজশাহী সার্কিট হাউসের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে টুপুল আর জয় আরেক নাজমুল আবেদিনের সঙ্গে পরিচিত হলো। সিরাজগঞ্জ থেকে ওরা দুপুরে এসে পৌঁছেছে রাজশাহী। সার্কিট হাউসে ওঠার আগে নাজমুল ওদের নিয়ে গেছে সাহেব বাজারে। ওদের পছন্দ মতো দুটো করে জিন্স-এর প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট আর যা কিছু দরকার সব কিনে দিয়েছে। এমনকি দুটো ব্যাগ পর্যন্ত। আড়াইটার সময় ওরা ক্লান্ত ট্যুরিস্ট-এর মতো সার্কিট হাউসে এসে উঠেছে।

নাজমুল যে একজন গণ্যমান্য কেউ-এখানে এসেই ওরা টের পেয়ে গেলো। আগে থেকেই ঘর বুক করা ছিলো। ওদের জন্য আরেকটা ঘর নেয়া হলো। দারোয়ান, আর্দালি সবাই চেনে ওকে। টেবিলে খানা লাগাতে বলে টেলিফোনে রাজশাহীর ডিসির সঙ্গে কথা বললো। মনে হলো ডিসি তার পুরানো বন্ধু। কথা শেষ করে টুপুলদের কৌতূহলের জবাব দিলো হাসান আর আমি স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি। ও এবছরই ডিসি হয়ে রাজশাহী এসেছে। ওর বাড়িতে উঠিনি দেখে মন খারাপ করেছে। একা থাকলে যেতাম, তোমরা সঙ্গে–এটাই ভালো।

টুপুল বিব্রত গলায় বললো, আমাদের জন্য আপনার বন্ধুর মন খারাপ হলো!

আরে না। কারো বাড়িতে ওঠা এমনিতেই আমার ভালো লাগে না। সেই পুরোনো কথা–এখনো বিয়ে করেনি কেন, হাতে ভালো মেয়ে আছে-এসব শুনতে শুনতে বিরক্ত লাগে। বাড়ির বাইরে এখানে কেমন স্বাধীন মনে হচ্ছে না! যা ইচ্ছে করো, কেউ কিছু মনে করবে না।

নাজমুলকে ওরা দুজন যত দেখছিল ততই মুগ্ধ হচ্ছিলো। পৃথিবীতে এত ভালো লোক কি থাকতে পারে! দুপুরে খাবার টেবিলে নাজমুল নিজ হাতে ওদের প্লেটে এক টুকরোর বদলে দুটুকরো রুই মাছের পেটি তুলে দিলো, মুরগির মাংসও তাই। ওদের কোনো কথা শুনলো না। বললো, জানি তো পয়সা বাঁচাবার জন্য কাল রাতে তোমরা কিছুই খাওনি।

জয় বিগলিত গলায় বললো, আপনার দেখা না পেলে আজ দুপুরেও আধপেটা খেয়ে থাকতে হতো।

টুপুল বললো, আপনি আমাদের জন্য এত করছেন অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না।

নাজমুল কিছুটা আহত হলো-তোমরা এভাবে বলছো কেন? আমরা না বন্ধু! বন্ধুর জন্য বন্ধু করবে না তো আর কে করবে?

না, আমি বলছিলাম শুধু আপনিই করে যাচ্ছেন।

ঠিক আছে, যখন তোমাদের করার সুযোগ হবে তখন করবে।

খাওয়া শেষ করে নিজেদের ঘরে এসে টুপুল বললো, নাজমুল ভাই-র মত একজন বন্ধুর জন্য জানও দেয়া যায়।

ঠিক বলেছিস। ওর সঙ্গে একমত হলো জয়।

বিকেলে চা খেতে খেতে নাজমুল বললো, আমি তোমাদের একটা প্রস্তাব দিতে চাই। ভেবে দেখতে পারো গ্রহণ করবে কি না।

কি প্রস্তাব নাজমুল ভাই? জানতে চাইলো জয়।

একশবার গ্রহণ করবো। জানার আগেই রায় দিলো টুপুল।

একটু ইতস্তত করে নাজমুল বললো, তোমাদের কি বিপ্লবীদের গোপন রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?

আপনি কি নকশালদের কথা বলছেন? টুপুলদের ক্লাসের রনি ওর এক চাচার কথা বলেছিলো, নাকি নকশাল ছিলো। গোপন রাজনৈতিক দল করতো। পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে। নকশালদের কথা রনির কাছ থেকে ওরা প্রথম জেনেছিলো।

টুপুলের মুখে নকশাল শব্দটা শুনে নাজমুল অবাক হলো–ওদের কথা তুমি কিভাবে জানো?

রনির চাচার কথা শুনে তিনি মৃদু হেসে বললেন, তুমি ঠিক বলেছো। দেশকে ভালোবাসলে ওদের মতো জীবন দিতেও জানতে হয়।

জয় প্রশ্ন করলো, আপনিও কি নকশাল নাজমুল ভাই?

আমি সরাসরি ওদের সঙ্গে যুক্ত নই। তবে বিপ্লবীদের সাহায্য করি। যদিও ওদের ভেতর অনেক দল।

কিভাবে সাহায্য করেন?

ওদের টাকা দিয়ে সাহায্য করি। কখনো অস্ত্রও জোগাড় করে দিতে হয়।

অস্ত্র কেন?

অস্ত্র দিয়ে ওরা দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তো পুলিশ আর আর্মি আছে।

আমাদের মতো দেশে পুলিশ আর আর্মি কখনো সাধারণ মানুষের বন্ধু নয়। তোমরা কি জানো না আমাদের দেশের মানুষ এত গরিব কেন?

ক্লাসে বাংলার নলিনী স্যার একদিন যেভাবে বলেছিলেন টুপুল সেভাবে বললো, আমাদের দেশটা ছোট, মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। মানুষ বেশি বলে ফসল যা হয় তা দিয়ে সবার হয় না। আমাদের দেশের মানুষরা বেশি পরিশ্রমও করতে চায় না, বেশির ভাগই অলস। তাছাড়া আমাদের দেশে তেমন কোনো খনিজ সম্পদ নেই যা বিক্রি করে আমরা ধনী হতে পারি।

টুপুলের কথা শুনে নাজমুল যেন একটু বিরক্ত হলো-তোমাদের মিশনারি স্কুলগুলোতে এভাবেই উল্টোপাল্টা শিক্ষা দেয়া হয়। শোন, পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও কিছু লোক বেশি ধনী বলে, বেশির ভাগ সম্পদ নিজেদের দখলে রেখেছে বলে অন্যরা বঞ্চিত হয়ে গরিব হয়েছে। ধনীরা নানাভাবে গরিবদের শোষণ করে। কলে কারখানায় মালিকরা মজুরদের শোষণ করে, গ্রামে জোতদার মহাজনরা কৃষকদের শোষণ করে। আমাদের কৃষক-শ্রমিকরা কম পরিশ্রম করে না। কিন্তু তারা কখনো পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি পায় না। দেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ এভাবে শোষিত হচ্ছে। শোষণ যারা করছে তারা দশভাগেরও কম। দুঃখের বিষয় দেশের সরকার, থানা, পুলিশ, আর্মি সব এই লুটেরা শোষকদের দলে। এরাই দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।

আপনি তাহলে বলছেন এদের মেরে ফেললে মানুষ আর গরিব থাকবে না?

ঠিক ধরেছো। ওদের মেরে ফেলতে পারলে দেশে সৎলোকের শাসন কায়েম হবে।

নকশালরা তাহলে দেশের মানুষের ভালোর জন্যে কাজ করছে?

চায়ে চমুক দিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো নাজমুল।

আমরাও কি ওদের জন্য কাজ করবো?

তোমরা যদি দেশকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো তাহলে আমি বলবো তোমাদেরও উচিত ওদের সাহায্য করা।

কিভাবে সাহায্য করবো?

নানাভাবে করতে পারো। তবে এ কাজে অনেক বিপদ। পুলিশ ওদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। যদি পুলিশ টের পায় ওদের সঙ্গে তোমাদের কোনোরকম যোগাযোগ আছে। তাহলে তোমাদেরও মেরে ফেলবে।

আপনি আমাদের জন্য এত কিছু করেছেন, আমরা আপনার জন্য এতটুকু বিপদ মাথায় নিতে পারবো না?

জয়ের কথায় মিষ্টি হাসলো নাজমুল-কাজটা আমার নয়, দেশের। এতক্ষণে প্রমাণ হলো তোমরা সত্যিকারের বন্ধু। দেশকে তোমরা সত্যিই ভালোবাসো।

আমাদের কি করতে হবে? কিছু করার জন্য তর সইছিলো না টুপুল আর জয়ের।

নাজমুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, তোমরা আপাতত চিঠি আনা–নেয়ার কাজ করতে পারো।

এটা আর এমন কি কাজ! একটু হতাশ হলো টুপুল।

বিপদের যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। একটা প্যাকেট আর চিঠি কলকাতার এক কমরেডকে পৌঁছে দিতে হবে। পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে যাওয়া চলবে না। যেতে হবে গোপন পথে, যাতে বর্ডারের পুলিশ বিডিআর কেউ টের না পায়।

টুপুল উত্তেজিত হয়ে বললো, কাল আমরা কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম।

আগে কখনো গিয়েছো?

না, তবে আমার এক পেনফ্রেন্ড আছে।

পেনফ্রেন্ড লাগবে না। থাকার ব্যবস্থা ওরাই করবে। চিঠির জবাবের জন্য তিন চারদিন কলতায় থাকতে হতে পারে।

কবে যেতে হবে বলুন?

হয়তো কাল। সন্ধ্যের পর আমার কাছে একজন আসবে। তার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবো কখন কিভাবে যাবে।

দারুণ লাগছে। গদগদ হয়ে বললো জয়।

নাজমুল ওদের দুজনের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলো। মনে হলো তার নির্বাচন ভুল হয় নি। একটু গম্ভীর হয়ে বললো, তোমাদের একটা কথা বলবো, সব সময় মনে রাখবে। যাদের জন্য কাজ করছি তাদের দল গোপন। সমস্ত কাজকর্ম গোপনে করতে হয়। কেউ ঘুণাক্ষরেও যেন কিছু জানতে না পারে। কারো সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবে না। আর কোনো ব্যাপারে বেশি কৌতূহল দেখাবে না। তোমাদের যতটুকু বলা হবে ততটুকু করবে। যতটুকু জানানো হবে তার বেশি জানার চেষ্টা কোরো না।

নাজমুলের কথা শুনে টুপুলরা রোমাঞ্চিত হলো। পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার দুঃখ মন থেকে কর্পূরের মত উড়ে গেলো। মনে হলো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে যাচ্ছে ওরা, যা এতকাল শুধুমাত্র বড়দের বলে মনে হতো।

শীতের বিকেল অল্প কিছুক্ষণের ভেতর ফুরিয়ে গেলো। পাঁচটা না বাজতেই সার্কিট হাউসের সবুজ লনে কে যেন কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দিলো। নাজমুল বললেন, আমার কাছে যে লোক আসবে তাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে। তোমরা বরং এক কাজ কর। আসার সময় সাহেব বাজারের অলকা সিনেমায় দেখেছি গান্স অব নাভারন চলছে। যুদ্ধের ছবি, দেখে এসো, ভালো লাগবে।

টুপুল-জয়ের মুখে হাসি ধরে না। সার্কিট হাউজের বুড়ো আর্দালি জোনাবালিকে ডেকে নাজমুল বললো আমার ভাই দুটোকে অলকা হলে নিয়ে গিয়ে দুটো ব্যালকনির টিকেট কিনে বসিয়ে দিয়ে এসো।

টুপুল বললো, জোনাবালি কেন, আমরা ওকে ছাড়াই যেতে পারবো।

নাজমুল বললো, জানি পারবে। এখন জোনাবালি যাক। ফেরার সময় থাকবে না।

টুপুল আর জয় চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ সার্কিট হাউসের বারান্দায় একা বসেছিল নাজমুল। বুকের ভেতর একটু খচ খচ করছিলো–দুটো নিষ্পাপ ছেলেকে এরকম বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া কি উচিৎ হচ্ছে? ওদের পুরোনো ছেলেটি কদিন আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পড়তে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ঢাকা থেকে আসার পথে নাজমুল ইচ্ছে করেই ট্রেনে–স্টিমারে সেকেন্ড ক্লাসে বসেছে যদি পছন্দমতো কাউকে চোখে পড়ে। আগের ছেলেটাকেও সে এভাবেই পেয়েছিলো। আগেরটার বাপ-মা কেউ নেই, সত্মার অত্যাচারে বাড়ি ছেড়েছে। এদের তো সবই আছে।

এসব কথা ভাবতে গিয়ে একসময় নিজের ওপরই বিরক্ত হলো নাজমুল। এত বছর ধরে ভয়ঙ্কর সব বিপদজনক কাজের ভেতর থাকার পরও ধরনের ভাবালুতা ওকে মানায় না। ছেলে দুটোর কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়ার জন্য ঘরে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতল বের করলো। টুপুলদের সিনেমা হলে বসিয়ে জোনাবালি ততক্ষণে ফিরে এসেছে। নাজমুল ওকে বললো, তিনটা গ্লাস, পানির বোতল আর বরফ দিয়ে যেতে।

এসব কাজে জোনাবালি খুবই দক্ষ। বললো, স্যার পটেটো ফ্রাই করে দেবো?

নাজমুল তখনও টুপুলদের কথা ভাবছিলো। নির্লিপ্ত গলায় বললো, দিতে পারো।

জোনাবালি গ্লাস, বরফ আর পানির বোতল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নাজমুলের দুজন মেহমান এলো। একজন মাঝবয়েসী, একটু মোটা, গায়ের রং কালো, ভারিক্কি চেহারা যেন কোনো স্কুলের বদরাগী হেডমাস্টার। আরেকজন কমবয়সী পায়জামা পাঞ্জাবী পরা, গায়ে চাদর, ফর্সা, রোগা দেখতে, গালে চাপদাড়ি, চোখে চশমা, মনে হয় কবি-সাহিত্যিক জাতীয় কিছু। নাজমুল ততক্ষণে গ্লাসে হুইস্কি ঢালা শুরু করেছে। চেয়ারে বসেই স্বাভাবিক গলায় ওদের বললো, এসো, আক্কাস, সাজ্জাদ, নতুন কোনো ঝামেলা হয় নি তো?

মাঝবয়সীর নাম সাজ্জাদ। সামনের চেয়ারে বসে ভারি গলায় বললো, না বস, সব ঠিক আছে।

নিজের গ্লাসে পানি আর বরফ মেশাতে মেশাতে নাজমুল বললো, আক্কাস, নিজেদেরটা ঢেলে নাও। আমাদের বৈঠক নটার ভেতর শেষ করতে হবে।

রোগা আক্কাস মিহি গলায় বললো, কেন বস, আর কেউ আসবে নাকি?

গ্লাসে চুমুক দিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সায় জানালো নাজমুল–পথে আসার সময় দুটো ভালো শিকার পেয়েছি। টোপ গিলেছে, আমার সঙ্গেই আছে।

সঙ্গে আছে শুনে সাজ্জাদ সতর্ক হয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। চাপা গলায় জানতে চাইলো–কোথায় বস?

তোমাদের সঙ্গে যেন দেখা না হয় সে জন্যে সিনেমা দেখতে পাঠিয়েছি।

আক্কাস সাবধানী গলায় বললো, সিনেমার টিকেট না পেয়ে একটু পরে এসে আবার হাজির হবে না তো?

না। নাজমুল হুইস্কির গ্লাসে আরেক চুমুক দিয়ে বললো, জোনাবালিকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়েছিলাম। টিকেট কেটে, হলে ঢুকিয়ে তারপর এসেছে।

কেমন শিকার বস? জানতে চাইলো সাজ্জাদ, চালাক চতুর আছে তো? বিশ্বাস করা যাবে?

খাঁটি মাল। ভালোভাবে যাচাই করেছি। বাড়ি থেকে পালিয়েছে, পুলিশে ধরা পড়ার ভয় আছে। আবার জাহাজে চাকরি করার লোভও আছে। আমার গল্প শুনে মুগ্ধ। ভালো গিলেছে দেশপ্রেমের টোপটা। দেশসেবার জন্য মুখিয়ে আছে।

নাজমুলের কথা শুনে ওর সঙ্গীরা নিরবে হাসলো। জোনাবালি এসে এক প্লেট আলু ভাজা দিয়ে গেলো। সাজ্জাদ বললো, ইউনিভার্সিটিতে মৈত্রী ইউনিয়ন আর লীগের ছেলেরা ঝামেলা বাধাচ্ছে। আমাদের দুটো ছেলেকে হল থেকে বের করে দিয়েছে।

আক্কাস আলু ভাজা চিবোতে চিবোতে বললো,চিটাগাং থেকে যে আমাদের সাথীদের আসার কথা ছিলো এখনও তো এলো না। এখানে গুলির দাম বেড়ে গেছে।

চিটাগাং-এর প্রায় ডবল।

গুলি–ফুলির দরকার কি? শান্ত গলায় নাজমুল বললো, যেগুলো বাড়াবাড়ি করছে ধরে হাত আর পায়ের রগ কেটে দাও। চিরদিনের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

চিটাগাং-এর সাথীরা এলেই ভার্সিটিতে অপারেশন শুরু হবে।

প্ল্যানে যেন গতবারের মতো কোনো খুঁত না থাকে। গম্ভীর গলায় সঙ্গীদের মনে করিয়ে দিলো নাজমুল–অপারেশন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দু-একটা ছেলেকে সাবধানে স্ট্যাব করবে। তারপর ওদের সবকটাকে আসামী বানিয়ে থানায় কেস দেবে। মৈত্রীর হারামিটাকে এক নম্বর আসামী বানাবে।

মাথা নেড়ে সায় জানালো সাজ্জাদ আর আক্কাস। নিজের গ্লাস খালি হওয়ার পর নাজমুল ধীরে সুস্থে আরেক গ্লাস হুইস্কি তৈরি করলো। লম্বা চুমুক দিয়ে সাজ্জাদকে প্রশ্ন করলো, থানাওয়ালাদের পেমেন্ট ঠিক মতো করা হচ্ছে তো?

সাজ্জাদ সায় জানালো–এসব নিয়ে আপনি পেরেশান হবেন না। আমাদের সমস্ত পেমেন্ট সাত তারিখের মধ্যে ক্লিয়ার হয়ে যায়।

নওগাঁতে যে দুটো নতুন ইউনিট করার কথা ছিলো, হয়েছে?

আক্কাস মিহি গলায় জবাব দিলো–একটা হয়েছে।

নাজমুলের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়লো–একটা কেন?

ওখানে বস নকশালরা খুব উৎপাত করছে। আত্রাইতে ঢোকাই যাচ্ছে না।

এ্যাদ্দিন পর নকশাল কোত্থেকে এলো?

আগে থেকেই ছিলো বস। মহা হারামি। সব কটার কাছে আর্মস আছে।

আমাদের সামনে যাওয়ার দরকার নেই। ওদের পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দাও।

পুলিশ ওদের ভয় পায় বস।

টাকা ঢালো গর্দভ। টাকা দিয়ে কাজ হাসিল না হলে ভয় দেখাও। টাকার লোভ আর জানের ভয় দুটোই পুলিশের লোকদের বেশি থাকে।

ঠিক আছে বস।

কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে কি যেন ভাবলো নাজমুল। ওর গ্লাস খালি হওয়ার পর সাজ্জাদ আবার ভরে দিলো । নাজমুল যখন চুপচাপ থাকে সাজ্জাদ আর আক্কাস তখন ভয়ে তটস্থ থাকে। দলের সবাই বলে নাজমুলের কম্পিউটার ব্রেন। শত্রুপক্ষ এক চাল দিলে ও পরের দশ চাল ভেবে রাখে। প্রতিপক্ষ কিভাবে এগোলে ও কিভাবে এগোবে এসব ওর নখদর্পণে। নইলে এত অল্প বয়সে ও দলের হাই কমান্ডের এতখানি গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে পারতো ন।

ওদের দলের দুটো ভাগ আছে। একভাগ প্রকাশ্যে থাকে, মিটিং-মিছিল করে, নির্বাচনে দাঁড়ায়, সংসদে গিয়ে বসে, কাগজে বিবৃতি দেয়, ছবি ছাপে। আরেক ভাগ নিজেদের একেবারে গোপন রাখে। যাদের সঙ্গে নিত্য চলাফেরা, ওঠাবসা তারাও জানে না ওদের আসল পরিচয়। দলের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ আর আনা-নেয়া করা, যাবতীয় গোপন ব্যবসা চালানো, গোপন কর্মীদের আধুনিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া, কোথাও বোমা মেরে বা প্রতিপক্ষের কাউকে হত্যা করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়া–এ সবই হচ্ছে দলের গোপন অংশের কাজ। দলের এই গোপন শাখার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হচ্ছে নাজমুল। প্রধান যে সে নামেই প্রধান, সত্তরের কাছে বয়স, মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবী হত্যা করার কারণে তাকে প্রধান করা হয়েছে। আজকাল চোখে ভালো দেখে না, বাত-ব্যামো লেগেই আছে, যে জন্য নাজমুল দুনম্বর হলেও সবাই জানে। শিগগিরই এক নম্বর হয়ে যাবে। ওর পছন্দ-অপছন্দের ওপর কর্মীদের অনেক কিছু নির্ভর করে।

তৃতীয়বার গ্লাস খালি করতে করতে নাজমুল ছক কেটে ফেলেছে টুপুল আর জয়ের অপারেশন কিভাবে সফল হবে। এ চালানে তিন কেজি হেরোইন যাবে ওপারে। নাজমুল নিজে পরখ করে দেখেছে–একেবারে খাঁটি মাল। ওদের নিজেদের কোম্পানির কাঁচামালের বাক্সে এসেছে ম্যাকাও থেকে। এ চালানে কম করে হলেও দুকোটি টাকা পাওয়া যাবে। টুপুলরা শুধু হেরোইনটুকু ঠিকানা মত পৌঁছে দেবে। দাম হুন্ডি করে পাঠানো হবে। ইন্ডিয়ান মাড়োয়ারিরা কারবারে লেনদেনের ব্যাপারে কখনও নয়–ছয় করে না। শুধু সময় মতো মালটা ওদের হাতে তুলে দিতে পারলে হয় ।

অনেকক্ষণ পর একটা সিগারেট ধরিয়ে নাজমুল বললো, ছেলে দুটো সাহসী, চেহারা সুন্দর, খুবই ইনোসেন্ট–যা আমাদের কাজের জন্য জরুরি। গতবারের ছেলেটার চেহারায় একটা পাকামো ভাব ছিলো। একটু নার্ভাস টাইপের সেজন্য বিডিআরের ইনফর্মার সন্দেহ করেছিল। এদের ব্যাপারে সে রকম কিছু হবে না। তবু সাবধানের মার নেই। কাসেদ আলী ওদের সঙ্গে যাবে, আক্কাস দূর থেকে নজর রাখবে, বর্ডারে ওদের নিবারণের হাওলা করে তবে ফিরবে। কাসেদ আলী ওদের কলকাতার ঠিকানায় তুলে দিয়ে আসবে। বার দুই-তিন যাওয়া-আসা করলে ওরা নিজেরাই যেতে পারবে।

সাজ্জাদ বললো, বস বলছিলেন ছেলে দুটো বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এর মধ্যে খবরের কাগজে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন বেরিয়ে যায় নি তো?

এত শিগগির কেউ কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় না। নিশ্চিন্ত গলায় জবাব দিলো নাজমুল –তাছাড়া ওরা কাল রাতেই বর্ডার পার হচ্ছে।

নাজমুল যখন টুপুলদের নিয়ে এসব ভয়ানক ষড়যন্ত্র করছিলো তখন ওরা সিনেমায় ছারপোকার কামড় ভুলে রুদ্ধশ্বাসে নাভারনের জার্মানদের কামান অকেজো করে দেয়ার দুঃসাহসিক অভিযান দেখছিলো। যদি জানতো ছবির গ্রেগরী পেকদের চেয়ে বড় বিপদে ওরা নিজেরা পড়তে যাচ্ছে তাহলে এই মুহূর্তেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতো।