পরিশিষ্ট

মণিমণ্ডন

মণিমণ্ডন

প্রসিদ্ধ মণিকার রসময় সরকারের বাড়ি হইতে একটি বহুমূল্য জড়োয়ার নেকলেস চুরি গিয়াছে। সকালবেলা খবরের কাগজ পড়িবার সময় বিলম্বিত সংবাদের স্তম্ভে খবরটা দেখিয়াছিলাম। বেলা আন্দাজ আটটার সময় টেলিফোন আসিল।

অপরিচিত ব্যগ্র কণ্ঠস্বর, ‘হ্যালো। ব্যোমকেশবাবু?’

বলিলাম, ‘না, আমি অজিত। আপনি কে?’

টেলিফোন বলিল, ‘আমার নাম রসময় সরকার। ব্যোমকেশবাবুকে একবার ডেকে দেবেন?’

নাম শুনিয়া বুঝিতে বাকি রহিল না যে, চোর ধরিবার জন্য ব্যোমকেশের ডাক আসিয়াছে। বলিলাম, ‘সে বাথরুমে গিয়েছে, বেরুতে দেরি হবে। কাগজে দেখলাম আপনার দোকান থেকে নেকলেস চুরি গেছে।’

উত্তর হইল, ‘দোকান থেকে নয়, বাড়ি থেকে। —আপনি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্যোমকেশবাবুর বন্ধু?’

বলিলাম, ‘হ্যাঁ। ব্যোমকেশকে যা বলতে চান, আমাকে বলতে পারেন।’

ক্ষণেক নীরব থাকিয়া রসময় বলিলেন, ‘দেখুন, যে নেকলেসটা চুরি গেছে, তার দাম সাতান্ন হাজার টাকা। সন্দেহ হচ্ছে বাড়ির একটা চাকর চুরি করেছে, কিন্তু কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিসে অবশ্য খবর দিয়েছি, কিন্তু আমি ব্যোমকেশবাবুকে চাই। তিনি ছাড়া নেকলেস কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।’

বলিলাম, ‘বেশ তো, আপনি আসুন না। আপনি আসতে আসতে ব্যোমকেশও বাথরুম থেকে বেরুবে।’

রসময় একটু কাতরভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, আমি বেতো রুগী, বেশি নড়াচড়া করতে পারি। তার চেয়ে যদি আপনারা আসেন তো বড় ভাল হয়।’

যাহারা বিপদে পড়ে তাহারাই ব্যোমকেশের কাছে আসে, সে আগে কাহারও কাছে যায় না। আমি বলিলাম, ‘বেশ, ব্যোমকেশকে বলব।’

রসময়ের মিনতি আরও নির্বন্ধপূর্ণ হইয়া উঠিল, ‘না না, বলাবলি নয়, নিশ্চয় আসবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না।’

‘বেশ।’

‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। এখনি গাড়ি পাঠাচ্ছি।’

মিনিট কয়েক পর একটি ক্যাডিলাক্‌ গাড়ি আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ বাথরুম হইতে বাহির হইলে সকল কথা বলিলাম এবং জানালা দিয়া গাড়ি দেখাইলাম। দেখিয়া শুনিয়া সে আপত্তি করিল না। আমরা ক্যাডিলাকে চড়িয়া যাত্রা করিলাম।

কলিকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে রসময় সরকারের গোটা পাঁচেক সোনাদানা হীরা-জহরতের দোকান আছে, কিন্তু তাঁর বসতবাড়ি বৌবাজারে। অল্পকাল মধ্যে গাড়ি তাঁহার দ্বারে গিয়া দাঁড়াইল।

রসময় সরকারের বাড়িটি সাবেক ধরনের, একেবারে ফুটপাথের কিনারা হইতে তিনতলা উঠিয়া গিয়াছে। মাঝখানে উপরতলায় উঠিবার দ্বারমুক্ত সিঁড়ি, দুই পাশে দোকানের সারি। গৃহস্বামী উপরের দুইতলা লইয়া থাকেন।

সিঁড়ির দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, গাড়ি গিয়া থামিতেই দ্বার খুলিয়া একটি যুবক বাহির হইয়া আসিল। শৌখিন সুদর্শন চেহারা, বয়স সাতাশ আটাশ। নমস্কার করিয়া বলিল, ‘আমার নাম মণিময় সরকার। বাবা ওপরে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আসুন।’

আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিলাম। দ্বিতলে আছে রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, চাকরদের থাকিবার স্থান এবং তক্তপোশপাতা একটি বসিবার ঘর। আমরা দ্বিতল ছাড়াইয়া ত্রিতলে উঠিয়া গেলাম। এই ত্রিতলে গৃহস্বামী সপরিবারে বাস করেন।

তৃতীয় তলে উঠিলে গৃহস্বামীর বিত্তবত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিলাতি তালা লাগানো ভারী দরজায় রেশমী পর্দা, মেঝেয় পুরু গালিচা; ড্রয়িংরুমটি দামী আসবাব দিয়া সাজানো, গদি-মোড়া সোফা সেটের মাঝখানে কাশ্মীরী কাঠের নিচু টেবিল, দুই জানালার মাঝখানে বইয়ের আলমারি, দেয়ালে পারসিক ছবি-আঁকা ট্যাপেস্ট্রি ইত্যাদি। উপস্থিত ঘরটি একটু অবিন্যস্ত। মণিময় আমাদের ঘরে লইয়া গিয়া বলিল, ‘বাবা, ব্যোমকেশবাবু এসেছেন।’

দেখিলাম রসময় সরকার একটি চেয়ারে বসিয়া ডান পা সম্মুখদিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছেন এবং একটি বিবাহিতা যুবতী তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার আঙ্গুলে সেঁক দিতেছে। রসময়বাবুর বয়স অনুমান পঞ্চাশ, ভারী গড়নের শরীর, মাংসল মুখ এখনও বেশ দৃঢ় আছে। আমাদের দেখিয়া তিনি তাড়াতাড়ি উঠিবার চেষ্টা করিয়া আবার বসিয়া পড়িলেন, আমার ও ব্যোমকেশের পানে পর্যায়ক্রমে চক্ষু ফিরাইয়া দুই করতল যুক্ত করিয়া ব্যোমকেশকে বলিলেন, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু। আমি সব দিক দিয়েই বড় কাবু হয়ে পড়েছি। আপনি—আপনারা এসেছেন, আমি বাঁচলাম। বসুন, বসুন অজিতবাবু।’

আমাদের মধ্যে কে ব্যোমকেশ তাহা প্রশ্ন না করিয়াও তিনি বুঝিয়াছেন। রসময় সরকার বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি তাহাতে সন্দেহ নাই।

আমরা সোফায় পাশাপাশি বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘পায়ে বাত ধরেছে দেখছি। বাত রোগটা মারাত্মক নয়, কিন্তু বড় কষ্টদায়ক।’

রসময় বলিলেন, ‘আর বলবেন না। আমার শরীর বেশ ভালই, কিন্তু এই বাতে আমাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। ছেলেবেলায় ফুটবল খেলতাম, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা ভেঙে গিয়েছিল। এখন এমন দাঁড়িয়েছে, আকাশের এক কোণে রুমালের মত একট টুকরো মেঘ উঠলে বুড়ো আঙুলে চিড়িক্‌ মারতে থাকে। —কিন্তু সে যাক, বৌমা এঁদের জন্যে চা নিয়ে এস।’

বধূটি এতক্ষণ হেঁটমুখে বসিয়া শ্বশুরের পায়ে সেঁক দিতেছিল। সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু তাঁহার মুখে পারিবারিক বিপদের ছায়া পড়িয়াছে। সে উঠিবার উপক্রম করিতেই ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না, চায়ের দরকার নেই, আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি। উনি শ্বশুরের পদসেবা করছেন করুন।’

রসময় একটু হাসিলেন, বধূ আবার বসিয়া পড়িল। রসময় বলিলেন, ‘আচ্ছা, তবে থাক। মণি, সিগারেট নিয়ে এস।’

মণিময় এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া ছিল, সে চলিয়া গেলে রসময় বধূর পানে সস্নেহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, ‘বড় লক্ষ্মী বৌমা আমার। গিন্নী ছোট ছেলেকে নিয়ে তীর্থদর্শনে বেরিয়েছেন, এখন ওর হাতেই সংসার। অবশ্য ওকে দিয়ে পদেসেবা আমি করাই না, কিন্তু চাকরটা—’

এই পর্যন্ত বলিয়া রসময় থামিয়া পেলেন, তারপর গলার স্বর পাল্টাইয়া বলিলেন, ‘বাজে কথা থাক, কাজের কথা বলি। আপনি অনুগ্রহ করে এসেছেন, আপনার অমূল্য সময় নষ্ট করব না। ব্যোমকেশবাবু, কাল রাত্রে আমার বাড়িতে অঘটন ঘটে গেছে, যা কখনও হয়নি তাই হয়েছে। একটা হীরের নেকলেস—’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘সব গোড়া থেকে বলুন। সংক্ষেপ করবেন না। মনে করুন আমি কিছু জানি না।’

মণিময় একটি ৫৫৫ মার্কা সিগারেটের টিন ঢাকনি ঘুরাইয়া খুলিতে খুলিতে ঘরে প্রবেশ করিল, টিন আমাদের সম্মুখে রাখিয়া জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। আমরা সিগারেট ধরাইলাম।

রসময় বলিতে আরম্ভ করিলেন—

‘কলকাতা শহরে আমার পাঁচটা জুয়েলারির দোকান আছে। বড় কারবার, বছরে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার কেনা-বেচা। অনেক বিশ্বাসী প্রবীণ কর্মচারী আছেন। আমার যখন শরীর ভাল থাকে আমি দেখাশোনা করি। দু’বছর থেকে মণিও যাতায়াত শুরু করেছে।

‘কলকাতার বাইরে, ভারতের সর্বত্র আমাদের কাজ কারবার আছে। বোম্বাই মাদ্রাজ নয়াদিল্লী, যেখানে যত বড় জহুরী, সকলের সঙ্গে আমাদের লেন-দেন। কখনও আমাদের কাছ থেকে তারা হীরে জহরত কেনে, কখনও আমরা তাদের কাছ থেকে কিনি। জহুরী ছাড়া সাধারণ খরিদ্দার তো আছেই। রাজারাজড়া থেকে ছাপোষা গৃহস্থ, সবই আমাদের খদ্দের।

‘মাসখানেক আগে দিল্লী থেকে রামদাস চোক্‌সী নামে একজন বড় জহুরী আমার কাছে এল। রাজস্থানের কোন্ রাজবাড়িতে মেয়ের বিয়ে, দশ লাখ টাকার গয়নার ফরমাশ পেয়েছে। কিন্তু সব গয়না সে নিজে গড়তে পারবে না, আমাকে দিয়ে একটা হীরের নেকলেস গড়িয়ে নিতে চায়। ডিজাইন দেখে, হীরে বাছাই করে দাম কষা হল। সাতান্ন হাজার টাকা। এক মাসের মধ্যে গয়না গড়ে দিল্লীতে রামদাসের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

‘গয়না তৈরি হল। আমার ইচ্ছে ছিল আমি নিজেই গিয়ে গয়নাটা দিল্লীতে পৌঁছে দিয়ে আসব, কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে আমার বাতের ব্যথা চাগাড় দিল। কী উপায়! অত দামী গয়না কর্মচারীদের হাতে পাঠাতে সাহস হয় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল মণিময় যাবে আমার বদলে। আজ ওর যাবার কথা।

‘আমি এ ক’দিন বাড়ি থেকে বেরুতে পারিনি, মণিই কাজকর্ম দেখছে। নেকলেসটা তৈরি হবার পর বড় দোকানের সিন্দুকে রাখা ছিল, কাল বিকেলবেলা মণি সেটা বাড়িতে নিয়ে এল।

‘এখন আমার বাড়ির কথা বলি। আমার স্ত্রী ছোট ছেলে হিরন্ময়কে নিয়ে তীর্থ করতে বেরিয়েছেন, অর্থাৎ দাক্ষিণাত্য বেড়াতে গেছেন। বাড়িতে আছি আমি, মণিময় আর বৌমা। দোতলায় থাকে দু’জন চাকর, বামুন, ড্রাইভার, আর আমার খাস চাকর ভোলা। এই ক’জন নিয়ে বর্তমানে আমার সংসার।

‘কাল বিকেলে মণি যখন নেকলেস নিয়ে বাড়ি এল, আমি তখন এই চেয়ারে বসে ছিলাম, আমার খাস চাকর ভোলা পায়ে মালিশ করে দিচ্ছিল। মণি নেকলেসের কেস্‌ আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও বাবা।’

‘আমি ভোলাকে ছুটি দিলাম, সে চলে গেল। তখন আমি কেস্‌ খুলে গয়নাটা পরীক্ষা করলাম। সব ঠিক আছে। তারপর বৌমাকে ডেকে বললাম, ‘বৌমা, কাপড় দিয়ে এটাকে বেশ ভাল করে সেলাই করে দাও।’ বৌমা এক টুকরো কাপড় এনে এখানে বসে বসে ছুঁচ-সুতো দিয়ে সেলাই করে দিলেন।’

ব্যোমকেশ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়া শুনিতেছিল, এখন মুখ তুলিয়া বলিল, ‘মাফ্‌ করবেন, গয়নার বাক্সটা আকারে আয়তনে কত বড়?’

রসময়বাবু দ্বিধাভরে এদিক ওদিক চাহিয়া বলিলেন, ‘কত বড়? মোটেই বড় নয়। এই ধরুন—’

পিতা ইতস্তত করিতেছেন দেখিয়া মণিময় বইয়ের শেল্‌ফ হইতে একটি বই আনিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিল, বলিল, ‘এই সাইজের বাক্স।’

রসময় বলিলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক ওই সাইজের। অবশ্য বাক্সটা কুমিরের চামড়ার, তার ভেতরে মখমলের খাঁজ-কাটা ঘর।

বইখানা ষোলপেজী ক্রাউন সাইজের, পৃষ্ঠা-সংখ্যা আন্দাজ তিনশত। ব্যোমকেশ বইখানা মণিময়কে ফিরাইয়া দিয়া বলিল, ‘বুঝেছি, তারপর বলুন।’

রসময় আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন—

‘তারপর মণি চা খেয়ে ক্লাবে চলে গেল। আমি গয়নার কেস্‌টা হাতে করে আবার অফিস-ঘরে গেলাম। পাশেই আমার অফিস-ঘর। বাড়িতে বসে কাজকর্ম করার দরকার হলে ওখানে বসেই করি। একটা সেক্রেটারিয়েট্‌ টেবিল আছে, তার দেরাজে দরকারী কাগজপত্র থাকে। আমি গয়নার কেস্‌ দেরাজে রেখে দিলাম। বাড়িতে একটা লোহার সিন্দুক আছে বটে, কিন্তু গিন্নী তার চাবি নিয়ে চলে গেছেন।

‘আমার অন্যায় হয়েছিল, অত বেশি দামী জিনিস খোলা-দেরাজে রাখা উচিত হয়নি। কিন্তু আমার বাড়ির যে-রকম ব্যবস্থা, তাতে আশঙ্কার কোনও কারণ ছিল না। চাকর-বাকর দোতলায় থাকে, ডেকে না পাঠালে ওপরে আসে না; অন্য লোকেরও যাতায়াত নেই। তাই এখান থেকে গয়না চুরি যেতে পারে এ-সম্ভাবনা মনেই আসেনি।

‘রাত্রি আন্দাজ ন’টার সময় আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য দোতলায়, কিন্তু এই বাতের ব্যথাটা হয়ে অবধি বৌমা ওপরেই আমার খাবার এনে দেন। খাওয়া সেরে আমি একটা বই নিয়ে বসলাম, বৌমাও খেয়ে নিলেন। মণির ক্লাব থেকে ফিরতে প্রায়ই দেরি হয়, তাই তার খাবার বৌমা শোবার ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখলেন।

‘দশটার সময় আমি ভোলাকে ডাকবার জন্যে ঘন্টি বাজালাম, তারপর শুতে গেলাম। আমার বেতো শরীর, শোবার পর হাত-পা টিপে না দিলে ঘুম আসে না। ভোলাই রোজ টিপে দেয়, তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লে চলে যায়।

‘ভোলা খুব কাজের চাকর। বছর দেড়েক আমার কাছে আছে; জুতো বুরুশ করা, কাপড়-জামা গিলে করা, ফাই-ফরমাশ খাটা, হাত-পা টেপা, সব কাজ ও করে। কাল বৌমা সদর দোর খুলে দিলেন, ভোলা এসে আমার হাত-পা টিপে দিতে লাগল। আমি ক্ৰমে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর সে কখন চলে গেছে জানতে পারিনি।

‘হঠাৎ ঘুম ভাঙল মণির ডাকে। ও আমার বিছানার ওপর ঝুঁকে ডাকছে, ‘বাবা! বাবা!’ আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বললাম, ‘কী রে? মণি বলল, ‘নেকলেসটা কোথায় রেখেছেন?’ আমি বললাম, ‘টেবিলের দেরাজে। কেন?’ ও বলল, ‘কই, সেখানে তো নেই!’

‘আমি ছুটে গিয়ে দেরাজ খুললাম। নেকলেসের বাক্স নেই। সব দেরাজ হাঁটকালাম। কোথাও নেই। মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। মণিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই এত রাত্রে কী করে জানলি?’ সে বলল—’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া রসময়কে নিবারণ করিল, মণিময়ের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, ‘রাত্রি তখন ক’টা?

মণিময় অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, ‘প্রায় বারটা। বারটা বাজতে পাঁচ মিনিট কি দশ মিনিট হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘রাত বারটার সময় কোনও কারণে আপনার সন্দেহ হয়েছিল যে, নেকলেস চুরি গেছে। কী করে সন্দেহ হল সব কথা খুলে বলুন।’

মণিময় যেন আরও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল, পিতার প্রতি একটি গুপ্ত কটাক্ষপাত করিয়া ঈষৎ স্খলিত স্বরে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘কাল আমার ক্লাব থেকে ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাবে ব্রিজ-ড্রাইভ্‌ চলছে, আমি—’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথায় ক্লাব? নাম কী?’

‘ক্লাবের নাম—খেলাধুলো। খুব কাছেই, আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সব রকম ঘরোয়া খেলার ব্যবস্থা আছে, তাস পাশা পি্ংপং বিলিয়ার্ড। কাল ব্রিজ-ড্রাইভ্‌ শেষ হতে রাত হয়ে গেল—’

‘আপনি হেঁটে ক্লাবে যান?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব কাছে, তাই হেঁটেই যাই। কাল যখন ক্লাব থেকে বেরুলাম তখন পৌনে বারটা। রাত নিষুতি। আমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক সামনে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। আমি যখন বাড়ির প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গজের মধ্যে এসেছি তখন দেখলাম, আশেপাশের দোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু একটা লোক ঠিক আমাদের দোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বোধ হয় আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, তারপর চট্‌ করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

‘দূর থেকে দেখে মনে হল, ভোলা চাকর। কাছে এসে দেখলাম দরজা ভেজানো রয়েছে। অন্যদিন আমি দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরি, কিন্তু সদর দরজা তার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। আজ খোলা রয়েছে। আমার খট্‌কা লাগল। সদর দরজায় হুড়কো লাগিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। দোতলায় চাকরেরা ঘুমোচ্ছে, কারুর সাড়া শব্দ নেই।

‘তেতলায় উঠতেই স্ত্রী এসে দরজা খুলে দিলেন। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেছেন, তেতলার দরজায় বিলাতি গা-তালা লাগানো; ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলে বিনা চাবিতে বাইরে থেকে খোলা যায় না। আমি স্ত্রীকে বললাম, বাড়ির সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। উনি বললেন, উনিও দেখেছেন—’

‘উনিও দেখেছেন?’ ব্যোমকেশ বধূর পানে চোখ ফিরাইল।

বধূ লজ্জা পাইল, তাহার মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। রসময় তাহাকে উৎসাহ দিয়া বলিলেন, ‘লজ্জা কী বৌমা? যা দেখেছ ব্যোমকেশকে বল।’

বধূ তখন লজ্জা-স্তিমিত কণ্ঠে থামিয়া থামিয়া বলিল, ‘কাল রাত্তিরে—আমি—ওঁর ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছিল—আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলুম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর—হঠাৎ দেখলুম, ঠিক আমাদের দরজার সামনে ফুটপাথের ওপর কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ঝুঁকে দেখবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু ভাল দেখতে পেলুম না। তারপরেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হল দরজায় ঢুকে পড়ল। সেই সময় দেখতে পেলুম উনি আসছেন, লোকটা যেন ওঁকে দেখেই ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর আমি গিয়ে তেতলার দরজা খুলে দিলুম। উনি এলেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘লোকটাকে চিনতে পেরেছিলেন?’

বধূ মাথা নাড়িল, ‘না, ওপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তবে মনে হয়েছিল, চাকরদের মধ্যেই কেউ হবে।’

হুঁ, ব্যোমকেশ মণিময়কে বলিল, ‘তারপর কী হল?’

মণিময় বলিল, ‘স্ত্রীর কথা শুনে সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। নেকলেসটা বিকেলবেলা এনেছি, সেটা বাবা নিশ্চয় টেবিলের দেরাজে রেখেছেন, কারণ সিন্দুকের চাবি নিয়ে মা চলে গেছেন। আমি চুপি চুপি বাবার অফিস-ঘরে গেলাম। আলো জ্বেলে দেরাজগুলো খুলে দেখলাম। নেকলেসের কেস্‌ নেই। আরও যেখানে যেখানে রাখা সম্ভব সব জায়গায় খুঁজলাম। কোথাও নেই। ভীষণ ভয় হল। তখন বাবাকে ডেকে তুললাম।’

মণিময় চুপ করিলে ব্যোমকেশ নিবিষ্ট মনে আর একটি সিগারেট ধরাইল, তারপর সপ্রশ্ন চক্ষে রসময়ের পানে চাহিল। রসময় আবার কাহিনীর সূত্র তুলিয়া লইলেন—

‘যখন নিঃসংশয়ে বুঝলাম নেকলেস চুরি গেছে তখন সব সন্দেহ পড়ল ভোলার ওপর। ভেবে দেখুন, আমার তেতলার সদর দরজায় ইয়েল লক লাগানো; ভেতর থেকে বাইরে যাওয়া সহজ, কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরে আসা সহজ নয়। রাত্রি দশটার পর চাকরদের মধ্যে একমাত্র ভোলাই ভেতরে ছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভোলা কখন উঠে গেছে জানি না। হয়তো সে পৌনে বারটার সময় উঠে গেছে, দেরাজ থেকে নেকলেস নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে হয়তো তার ষড়ের লোক ছিল—‘

ব্যোমকেশ মণিময়কে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি একটা লোকই দেখেছিলেন?’

মণিময় বলিল, ‘হ্যাঁ। দ্বিতীয় জনপ্রাণী সেখানে ছিল না।’

ব্যোমকেশ বধূর দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আপনি?’

বধূ বলিল, ‘আমিও একজনকেই দেখেছিলুম। আমি সারাক্ষণ নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলুম, আর কেউ থাকলে দেখতে পেতুম।’

ব্যোমকেশ কিয়ৎকাল সিগারেট টানিল, শেষে রসময়কে বলিল, ‘তারপর আপনি কী করলেন?’

রসময় বলিলেন, ‘তখন বারটা বেজে গেছে। বাপ-বেটায় পরামর্শ করে থানায় টেলিফোন করলাম। মণি নিচে নেমে গিয়ে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল, যাতে বাড়ি থেকে কেউ বেরুতে না পারে। থানার বড় দারোগা অমরেশবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ভাগ্যক্রমে তিনি থানায় উপস্থিত ছিলেন, ফোন পেয়ে তক্ষুনি তিন-চারজন লোক নিয়ে এসে পড়লেন।

‘প্রথমে দোতলার ঘরগুলো খানাতল্লাশ হল। চাকরেরা সকলেই ঘুমোচ্ছিল ভোলাও ছিল। পুলিস তন্নতন্ন করে তল্লাশ করল, কিন্তু নেকলেস পাওয়া গেল না।

‘অমরেশবাবু তখন তেতলা খানাতল্লাশ করলেন। বলা যায় না, চোর হয়তো নেকলেস চুরি করে এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। পরে তাক বুঝে সরাবে। কিন্তু এখানেও নেকলেস পাওয়া গেল না।

‘অমরেশবাবু তারপর ভোলাকে জেরা আরম্ভ করলেন। ভোলা স্বীকার করল, সে নিচে নেমে গিয়েছিল। সে বলল, আন্দাজ এগারটার সময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি দেখে সে দোতলায় নেমে যায়। অন্য চাকরেরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোলাও শুয়ে পড়ল, কিন্তু তার ঘুম এল না। তখন সে খোলা হাওয়ার খোঁজে নিচে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়াল। মণিময় যে ক্লাব থেকে ফেরেনি তা সে জানত না। সে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল মণি আসছে। তখন সে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল কারণ রাত্তিরে চাকর-বাকরের বাইরে যাওয়ার কড়া বারণ আছে। এই তার বয়ান। নেকলেসের কথা সে জানে না।

‘অমরেশবাবুর জেরায় আরও জানা গেল, ভোলার দুই ভাই কলকাতায় থাকে, মেছুয়াবাজারে তাদের বাসা। ভায়েদের সঙ্গে ভোলার বিশেষ দহরম-মহরম নেই, তবে হাতে কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে তাদের বাসায় দেখা করতে যায়।

‘অমরেশবাবু যতক্ষণ ভোলাকে সওয়াল জবাব করছিলেন ততক্ষণ তাঁর সঙ্গীরা রাস্তার দু’ পাশে তল্লাশ করছিল; আনাচ কানাচ ডাস্টবিন সব খুঁজে দেখছিল। মণিও তাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। এইসব ব্যাপারে ভোর হয়ে গেল, অমরেশবাবু দোতলায় একজন লোক রেখে চলে গেলেন। ভোলাকে বলে গেলেন, এ-বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা করলেই গ্রেপ্তার করা হবে।

‘তারপর—তারপর যত বেলা বাড়তে লাগল ততই আমার মন অস্থির হয়ে উঠল। অমরেশবাবু কাজের লোক, চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। কিন্তু আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না ব্যোমকেশবাবু। আপনাকে ফোন করলাম। আপনি আমার নেকলেস উদ্ধার করে দিন। আপনি ছাড়া এ-কাজ আর কেউ পারবে না।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল, ‘আমার ওপর আপনার এত বিশ্বাস, আশা করি বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারব। —ভোলা চাকর তো বাড়িতেই আছে?’

‘হ্যাঁ, দোতলার ঘরে আছে।’

‘তাকে একবার ডেকে পাঠালে দু-চারটে প্রশ্ন করে দেখতাম।’

‘বেশ তো।’ রসময় পুত্রের দিকে চাহিলেন।

মণিময় চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে ভোলাকে লইয়া ফিরিয়া আসিল।

ভোলা চাকরের চেহারা সাধারণ ভৃত্য শ্রেণীর লোকের চেহারা হইতে পৃথক নয়। একজাতীয় মুখ আছে যাহা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীর্ণ ও অস্থির হইয়া পড়ে, উঁচু নাক ও ছুঁচলো চিবুক প্রাধান্য লাভ করে। ভোলার মুখ সেই জাতীয়। দেহও বেউড় বাঁশের মত পাকানো; বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তাহার চোখের দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্ন নাই, কিন্তু সংযত সতর্কতা আছে।

ব্যোমকেশ তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘তোমাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

ভোলা সহজভাবে বলিল, ‘আজ্ঞে।’

‘নাম কী?’

‘ভোলানাথ দাস।’

‘দেশ কোথায়?’

‘মেদিনীপুর জেলায়।’

‘কলকাতায় কতদিন আছ?’

‘তা পনর বছর হবে।’

‘তোমার দুই ভাই কলকাতায় থাকে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মেছোবাজারে বাসা নিয়ে একসঙ্গে থাকে।’

‘তুমি ভায়েদের সঙ্গে থাক না?’

‘আজ্ঞে, আমি যেখানে চাকরি করি সেখানেই থাকি।’

‘ভায়েদের সঙ্গে বনিবনাও আছে?’

‘আজ্ঞে, বে-বনিবনাও নেই। তবে দাদারা লেখাপড়া জানা লোক। আমি মুখ্‌খু—’

‘তোমার দাদারা কী কাজ করে?’

‘বড়দা পোস্ট-অফিসে কাজ করে, মেজদা কর্পোরেশনের জমাদার।’

‘তুমি বিয়ে করনি?’

‘করেছিলাম, বৌ মরে গেছে।’

‘এ-বাড়িতে কতদিন কাজ করছ?’

‘দেড় বছর।’

‘তার আগে কোথায় কাজ করেছ?’

‘অনেক জায়গায় কাজ করেছি।’

‘কী কাজ?’

‘আজ্ঞে, পা-টেপা চাকরের কাজ। অন্য কাজ করবার বিদ্যে আমার নেই।’

বিদ্যা না থাক, বুদ্ধি যথেষ্ট আছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। যে-বুদ্ধি নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে, সেই বুদ্ধি। ব্যোমকেশ আবার আরম্ভ করিল, ‘সকলে সন্দেহ করেন তুমিই হীরের নেকলেস চুরি করেছ।’

ভোলা চেঁচামেচি করিল না, শান্তভাবে অস্বীকার করিল, ‘আজ্ঞে, হীরের নেকলেস আমি চোখে দেখিনি।’

‘কাল যখন মণিময়বাবু নেকলেসের বাক্স এনে রসময়বাবুকে দেন, তখন তুমি তাঁর পায়ে মালিশ করে দিচ্ছিলে।’

‘একটা বাক্স এনে দিয়েছিলেন। বাক্সে কী আছে আমি জানতাম না।’

‘কিছু আন্দাজ করতে পারনি? রসময়বাবু যখন বাক্স খোলবার আগে তোমাকে চলে যেতে বললেন তখনও কিছু আন্দাজ করনি?’

‘আজ্ঞে না।’

ব্যোমকেশ ক্ষণেক ভ্রূকুটি করিয়া নীরব রহিল, তারপর সহসা চক্ষু তুলিয়া বলিল, ‘কাল সন্ধ্যের পর তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?’

এতক্ষণে ভোলার চোখে একটু উদ্বেগের চিহ্ন দেখা দিল, কিন্তু সে সহজ সুরেই বলিল, ‘আজ্ঞে, বেরিয়েছিলাম। একটা গামছা কেনবার ছিল, তাই বৌদিদির কাছে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।’

ব্যোমকেশ বধূর দিকে চাহিল, বধূ ঘাড় হেলাইয়া সায় দিল। রসময়বাবুর মুখ দেখিয়া মনে হইল, তিনি এ-খবর জানিতেন না। মণিময়ও জানিত না, কারণ সে তৎপূর্বেই ক্লাবে চলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু ব্যোমকেশ জানিল কী করিয়া? অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়িয়াছে?

সে ভোলাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কতক্ষণ বাইরে ছিলে?’

‘ঘণ্টাখানেক।’

‘গামছা কিনতে এক ঘণ্টা লাগল?’

‘আজ্ঞে, গামছা কিনে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।’

‘কারুর সঙ্গে দেখা করনি?’

‘আজ্ঞে, না।’

‘তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ নেই?’

‘চেনাশোনা দু-চারজন আছে, বন্ধু নেই।’

‘যাক। —কাল রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তুমি রসময়বাবুর পা টিপে দিয়েছিলে?’

‘আজ্ঞে। রোজ টিপে দিই।’

‘কাল ক’টা অবধি পা টিপে দিয়েছিলে?’

‘ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজ এগারটা হবে।’

‘তুমি যখন দোতলায় নেমে গেলে, অন্য চাকরেরা জেগে ছিল?’

‘আজ্ঞে না, ঘুমিয়ে পড়েছিল।’

‘কেউ জেগে ছিল না?’

‘কেউ না।’

‘ভারী আশ্চর্য। যাহোক, তুমি তারপর কী করলে? শুয়ে পড়লে?

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তবে রাত বারটার সময় রাস্তায় বেরিয়েছিলে কেন?’

‘অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঘুম এল না, তখন নিচে নেমে গেলাম। ভেবেছিলাম, খোলা জায়গায় খানিক দাঁড়ালে ঘুম আসবে।’

‘কতক্ষণ ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিলে?’

‘দু-তিন মিনিটের বেশি নয়। দাদাবাবু যে কেলাব থেকে ফেরেননি তা জানতাম না। দেখলাম তিনি আসছেন, তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।’

‘সিঁড়ির দরজা বন্ধ করেছিলে?’

‘আজ্ঞে, দাদাবাবু আসছেন, তাই বন্ধ করিনি।’

ব্যোমকেশ আর একবার ভোলার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল, বোধ করি মনে মনে তাহার স্থিরবুদ্ধির প্রশংসা করিল, তারপর শুষ্কস্বরে বলিল, ‘আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পার।’

ভোলা চলিয়া গেল। সদর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ আসিলে রসময় জিজ্ঞাসুনেত্রে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, ‘কী মনে হল?’

ব্যোমকেশ বিমর্ষভাবে বলিল, ‘ভারী হুঁশিয়ার লোক। তবে কাল সন্ধ্যেবেলা যে বেরিয়েছিল, তা স্বীকার করেছে।’

‘তাতে কী প্রমাণ হয়?’

‘প্রমাণ কিছুই হয় না। তবে ওর যদি কেউ ষড়ের লোক থাকে, চুরির আগে তার সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করেছিলে। নইলে নেকলেসটা লোপাট হয়ে গেল কী করে?’

‘তা বটে।’

ভোলা সম্বন্ধে আর বেশি আলোচনা হইতে পাইল না, দ্বারে টোকা পড়ায় মণিময় চলিয়া গেল এবং অবিলম্বে পুলিস দারোগার পোশাক-পরা এক ভদ্রলোককে লইয়া উপস্থিত হইল। লম্বা চওড়া চেহারা, ব্যক্তিত্ববান পুরুষ। দারোগা অমরেশবাবু সন্দেহ নাই।

রসময় উঠিবার উপক্রম করিয়া সবিনয়ে বলিলেন, ‘এ কী অমরেশবাবু, কী খবর! আপনি আবার এলেন যে!’

অমরেশবাবু চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া সনিশ্বাসে বলিলেন, ‘মেছোবাজারে গিয়েছিলাম ভোলার ভায়েদের বাসা খানাতল্লাশ করতে। কিন্তু—’ এই সময় আমাদের উপর নজর পড়ায় তিনি থামিয়া গেলেন।

রসময়বাবু অপ্রতিভভাবে পরিচয় করাইয়া দিলেন, ‘ইন্সপেক্টর মণ্ডল, ইনি— ইয়ে— ব্যোমকেশ বক্সী। বোধ হয় নাম শুনেছেন।’

অমরেশবাবু খাড়া হইয়া বসিলেন, বিস্ময়োৎফুল্ল স্বরে বলিলেন, ‘বিলক্ষণ! ব্যোমকেশ বক্সীর নাম কে না শুনেছে? আপনিই! আপনার নাম প্রমোদ বরাটের কাছেও শুনেছি মশাই। প্রমোদকে মনে আছে? গোলাপ কলোনীর ব্যাপারে তদন্ত করেছিল। প্রমোদ আমার বন্ধু।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘প্রমোদবাবুকে খুব মনে আছে। ভারী বুদ্ধিমান লোক।’

অমরেশবাবু বলিলেন, ‘সে আপনার পরম ভক্ত। তার আছে আপনার অদ্ভুত ক্ষমতার গল্প শুনেছি। —তা আপনিও এই নেকলেস চুরির ব্যাপারে আছেন নাকি? বেশ বেশ, আপনাকে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা; প্রমোদের মুখে শুনেছি আপনার খ্যাতির লোভ নেই, কেবল সত্যান্বেষণ করেই আপনি সন্তুষ্ট। হা হা।’

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল, ‘ইন্সপেক্টর মণ্ডল, যার যা আছে সে তা চায় না, এই প্রকৃতির নিয়ম। এ-ব্যাপারে খ্যাতি যদি কিছু প্রাপ্য হয় আপনিই পাবেন। আমি মজুরি পেলেই সন্তুষ্ট হব।’

রসময়বাবু গাঢ়স্বরে বলিলেন, ‘মজুরি বলবেন না, ব্যোমকেশবাবু, সম্মান-দক্ষিণা। যদি আমার নেকলেস ফিরে পাই, আপনার সম্মান রাখতে আমি ত্রুটি করব না।’

‘সে যাক,’ ব্যোমকেশ অমরেশবাবুর দিকে ফিরিল, ‘আপনি ভোলার ভায়েদের বাসা সার্চ করেছেন, কিন্তু কিছু পেলেন না?’

অমরেশবাবু বলিলেন, ‘কিচ্ছু পেলাম না। ওর ভায়েরা কাজে বেরিয়েছিল। দুই বৌ ঘরে ছিল। কিন্তু আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কিছু পাওয়া পাওয়া গেল না।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাঁহার পানে চাহিয়া বলিল, ‘তাহলে আপনার সন্দেহ ভোলা তার ভায়েদের সঙ্গে ষড় করে একাজ করেছে।’

অমরেশবাবু বলিলেন, ‘ভায়েদের বদলে অন্য কেউ হতে পারে, কিন্তু ষড়ের লোক আছে। নইলে নেকলেসটা লোপাট হয়ে গেল কী করে?’

‘মণিময়বাবু এবং তাঁর স্ত্রী কিন্তু অন্য লোক দেখেননি।’

‘ওঁরা যখন ভোলাকে দেখেছেন, তার আগেই হয়তো ষড়ের লোক মাল নিয়ে সরে পড়েছে।’

‘মণিময়বাবুর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ষড়ের লোক এলে উনি তাকে দেখতে পেতেন না কি?’

দুইজনে কিছুক্ষণ পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর অমরেশবাবু দ্বিধাভরে প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনার কি মনে হয় ভোলার কাজ নয়?’

‘এখন কিছু মনে হচ্ছে না। তত্ত্বতল্লাশ যা করবার সবই আপনি করেছেন, কিছুই বাকী রাখেননি। এখন শুধু ভেবে দেখতে হবে।’ সে উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘এখন উঠি। যদি ভেবে কিছু পাওয়া যায় আপনাদের জানাব।’

বাসায় ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার সন্দেহটা কার ওপর?’

ব্যোমকেশ পাঞ্জাবি খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘তিনজনের ওপর।’

চমকিয়া বলিলাম, ‘তিনজন কারা?’

‘ভোলা, মণিময় এবং মণিময়ের স্ত্রী—’ বলিয়া ব্যোমকেশ স্নান করিতে চলিয়া গেল।

বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। সুযোগের দিক দিয়া তিনজনকেই সন্দেহ করা যায়। রসময়ের দেরাজ হইতে নেকলেস সরানো তিনজনের পক্ষেই সম্ভব। আর মোটিভ? বড়মানুষের ছেলেদের সর্বদাই টাকার দরকার। মণিময় ক্লাবে গিয়া তাস-পাশা খেলে, নিশ্চয় বাজি রাখিয়া খেলে। হয়তো অনেক টাকা দেনা হইয়াছে, ভয়ে বাপের কাছে বলিতে পারিতেছে না—’

আর মণিময়ের স্ত্রী? মেয়েটি দেখিতে শান্ত শিষ্ট, কিন্তু তাহার মুখের উদ্বেগের ব্যঞ্জনা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। গহনার প্রতি স্ত্রীজাতির লোভ অবস্থা বিশেষে দুর্নিবার হইয়া উঠিতে পারে।

কিন্তু যে-ই চুরি করুক, চোরাই মাল বেমালুম সরাইয়া ফেলিল কী করিয়া?

সেদিন দুপুরবেলা ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় লম্বা হইয়া সারাক্ষণ কড়িকাঠের শোভা নিরীক্ষণ করিল, কথাবার্তা বলিল না। আপরাহ্নিক চা পানের পর হঠাৎ বলিল, ‘চল, একবার ঘুরে আসা যাক।’

‘কোথায় ঘুরবে?’

‘রসময়বাবুর বাড়ির সামনে ফুটপাথে। জায়গাটা ভাল করে দেখা হয়নি।’

পদব্রজে আমাদের বাসা হইতে রসময়বাবুর বাড়ির সামনে ফুটপাথে পৌঁছিতে কুড়ি মিনিট লাগিল। কাছাকাছি গিয়া ব্যোমকেশ এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। বাড়ির দরজার দুই পাশে দোকানগুলি খোলা রহিয়াছে। একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান, একটি ঘড়ির দোকান, দুইটি বস্ত্রালয়। সব দোকানেই খরিদ্দারের যাতায়াত। ফুটপাথে পথচারীর ভিড়।

রসময়ের বাড়ির তেতলায় গোটা চারেক জানালা; উহাদেরই একটা হইতে মণিময়ের বৌ পথের পানে চাহিয়া ছিল। চোখ নামাইয়া দেখিলাম, ব্যোমকেশ হঠাৎ থামিয়া গিয়াছে এবং একদৃষ্টে রসময়ের সদর দরজার দিকে চাহিয়া আছে। তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলাম, দরজা খুলিয়া মণিময় বাহির হইয়া আসিল। তাহার পরিধানে ধুতি, গেঞ্জি, হাতে একখানা খামের চিঠি। সে দরজার বাহিরে আসিয়াই পাশে দেয়ালে-গাঁথা পোস্ট-বক্সে চিঠি ফেলিয়া দিয়া আবার ফিরিয়া যাইবার উপক্রম করিল।

‘এই যে মণিময়বাবু! কাকে চিঠি লিখলেন?’

ব্যোমকেশের কণ্ঠস্বরে মণিময় চমকিয়া চাহিল। আমাদের দেখিয়া সবিনয়ে বলিল, ‘এ কী, আপনারা! কিছু খবর আছে নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার খবর পরে দেব। আপনি কাকে চিঠি লিখলেন?’

মণিময় একটু বিষণ্ণ স্বরে বলিল, ‘মাকে খবরটা দিলাম। তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে লিখলাম। কিন্তু আজ আর চিঠিখানা যাবে না, ডাক বেরিয়ে গেছে। সেই কাল ভোরের ক্লিয়ারেন্সে যাবে। —কিন্তু আপনি নিশ্চয় কিছু ভাল খবর পেয়েছেন। সত্যি বলুন না।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখনও কিছু খবর পাইনি, কিন্তু এখন পেয়েছি।’

‘কী খবর? নেকলেসের সন্ধান পেয়েছেন?’

‘পেয়েছি। সব কথা পরে বলব, এখন আমাকে একটা জরুরী কাজে যেতে হবে।’

‘একবারটি ওপরে আসবেন না? বাবা আপনার কাছ থেকে খবর পাবার জন্যে অস্থির হয়ে রয়েছেন।’

ক্ষণেক চিন্তা করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, জরুরী কাজটা আগে সারতে হবে। অজিত, তুমি বরঞ্চ ওপরে যাও। রসময়বাবুকে আমার পক্ষ থেকে বলে দিও, কাল সকালে তিনি নেকলেস ফিরে পাবেন।’ বলিয়া সে হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

আমি মণিময়ের সঙ্গে উপরে গেলাম। রসময়বাবু বিলক্ষণ হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন, ব্যোমকেশের বার্তা শুনিয়া বার বার উদ্বেগভরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, ‘সত্যি পাব তো? ঠিক পাব তো?’

আমি বলিলাম, ‘ব্যোমকেশকে কখনও মিথ্যে আশ্বাস দিতে শুনিনি। সে যখন বলেছে পাবেন তখন নিশ্চয় পাবেন।’ অতঃপর চা, কেক ও ৫৫৫ নম্বর সিগারেট সেবন করিয়া ক্যাডিল্যাকে চড়িয়া গৃহে ফিরিলাম।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ব্যোমকেশ তখনও ফেরে নাই। আরও ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘গিয়েছিলে কোথায়?’

সে বলিল, ‘থানায়। দারোগা অমরেশবাবুর সঙ্গে দরকার ছিল।’

‘কী দরকার?’

‘ভীষণ দরকার। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়, কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’

আমার কৌতূহল চরিতার্থ করিবার ইচ্ছা তাহার নাই দেখিয়া আমি উঠিয়া পড়িলাম। আহারে বসিলে সত্যবতী আমার মুখ লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘মুখ গোমড়া কেন?’

বলিলাম, ‘তোমার পতিদেবতাটি একটি কচ্ছপ।’

সত্যবতী মুখ টিপিয়া হসিল, ‘এত জন্তু থাকতে কচ্ছপ কেন?’

‘কচ্ছপ কথা কয় না।’

ব্যাপার বুঝিয়া সত্যবতীর মুখ সহানুভূতিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল, সে বলিল, ‘সত্যি বাপু। কী রাগ যে হয়। আচ্ছা, আমাদের না হয় বুদ্ধি একটু কম। তাই বলে কৌতূহল তো কম নয়।’

তাড়াতাড়ি খাওয়া সারিয়া শুইয়া পড়িলাম।

ঘুম ভাঙিল রাত্রিশেষে, ব্যোমকেশ ঠেলা দিয়া ঘুম ভাঙাইয়া দিল, ‘অজিত, ওঠ ওঠ, এখনি বেরুতে হবে।’

চা প্রস্তুত ছিল, তাড়াতাড়ি গলাধঃকরণ করিয়া ব্যোমকেশের সহিত বাহির হইলাম। রাস্তার আলো তখনও নেভে নাই, ঘুমন্ত নগরকে সহস্রচক্ষু মেলিয়া পাহারা দিতেছে।

কোথায় চলিয়াছি তখনও জানি না; কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর বুঝিলাম, রসময়বাবুর বাড়ির দিকে যাইতেছি। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শেষরাত্রে রসময়বাবুর সঙ্গে কী দরকার?’

সে বলিল, ‘রসময়বাবুর সঙ্গে দরকার নেই।’

‘তবে? শেষরাত্রে বেরুবার দরকার ছিল কী?’

‘ছিল। জানই তো, ওস্তাদের মার শেষরাত্রে?’

‘সোজা কথা বলবে, না কেবল হেঁয়ালি করবে?’

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিয়া, ‘রসময়বাবুর বাড়ির দেয়ালে যে ডাক-বাক্স আছে, তার প্রথম ক্লিয়ারেন্সের সময় হচ্ছে পাঁচটা। আজ যখন ডাক-বাক্স খোলা হবে তখন সেখানে উপস্থিত থাকতে চাই।’

মাথার মধ্যে দপদপ করিয়া কয়েকটা বাতি জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু অন্ধকার সম্পূর্ণ দূর হইল না। বলিলাম, ‘তাহলে—?’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘ধৈর্য মানো, সখা, ধৈর্য মানো।’

কয়েকটা গলিঘুঁজির ভিতর দিয়া চলিবার পর রসময়বাবুর বাড়ির সম্মুখীন হইলাম। গলি যেখানে বড় রাস্তায় মিলিয়াছে সেখানে দুটা লোক প্রচ্ছন্নভাবে দাঁড়াইয়া আছে। ব্যোমকেশ তাহাদের সহিত ফিসফিস করিয়া কথা বলিল। তারপর আমরাও গলির মুখে প্রচ্ছন্ন হইয়া দাঁড়াইলাম।

হাতঘড়িতে দেখিলাম, পাঁচটা বাজিতে দশ মিনিট। এখনও রাস্তায় লোক চলাচল আরম্ভ হয় নাই, মাঝে মাঝে সব্জি-বোঝাই ট্রাক গুরুগম্ভীর শব্দে চলিয়া যাইতেছে। রসময়বাবুর বাড়ির অভ্যন্তর অন্ধকার, সম্মুখস্থ ল্যাম্পপোস্ট বন্ধ সদর-দরজার উপর আলো ফেলিয়াছে। দরজার পাশে দেয়ালে-গাঁথা ডাক-বাক্সর লাল রঙ অসংখ্য ইস্তাহারে চাপা পড়িয়া গিয়াছে। ওটা যে ডাক-বাক্স, তাহা সহজে নজরে পড়ে না।

একটি একটি করিয়া মিনিট কাটিতেছে। সঞ্চরমাণ মিনিটগুলির লঘু পদধ্বনি নিজের বক্ষ-স্পন্দনে শুনিতে পাইতেছি।…পাঁচটা বাজিল; শরীরের স্নায়ুপেশী শক্ত হইয়া উঠিল।

লোকটা কখন নিঃশব্দে ডাক-বাক্সের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। যেন ভৌতিক আবির্ভাব। গায়ে খাকি পোশাক, কাঁধে দুটা বড় বড় ঝোলা। ঝোলা দুটা ফুটপাথে নামাইয়া সে পকেট হইতে চাবির গোছা বাহির করিল, তারপর ডাক-বাক্সের তালা খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া ইশারা করিল, আমরা শিকারীর মত অগ্রসর হইলাম। গলির মুখ হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম, রাস্তার দুই দিক হইতে আরও দুই জোড়া লোক আমাদেরই মত ডাক-বাক্সের দিকে অগ্রসর হইতেছে। নিঃসন্দেহে পুলিসের লোক, কিন্তু গায়ে ইউনিফর্ম নাই।

লোকটা ডাক-বাক্সের কবাট খুলিয়াছে, আমরা গিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ধরিলাম। সে ভয়চকিতভাবে ঘাড় ফিরাইয়া আমাদের আটজনকে দেখিয়া ত্বরিতে ঘুরিয়া দাঁড়াইল, ডাক-বাক্সের খোলা কবাট পিঠ দিয়া আড়াল করিয়া স্খলিত স্বরে বলিল, ‘কে, কী চাই?’

ব্যোমকেশ কড়া সুরে বলিল, তোমার নাম ভূতনাথ দাস। তুমি ভোলার বড় ভাই!’

ভূতনাথ দাসের মুখখানা ভয়ে শীর্ণ-বিকৃত হইয়া গেল, চক্ষু দুটা ঠিকরাইয়া বাহির হইবার উপক্ৰম করিল। সে থরথর কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘কে—কে আপনারা?’

অমরেশবাবু হুঙ্কার দিয়া বলিলেন, ‘আমরা পুলিস।’

অমরেশবাবু যে দলের মধ্যে আছেন তাহা প্রথম লক্ষ্য করিলাম। তিনি সামনে আসিয়া দৃঢ়ভাবে ভূতনাথের কাঁধে হাত রাখিলেন। অনুভব করিলাম, একটু নাটকীয় ভঙ্গীতে ভূতনাথকে ভয় পাওয়াইবার চেষ্টা হইতেছে। চেষ্টা ফলপ্রসু হইল। ভূতনাথ একেবারে দিশাহারা হইয়া গেল, হঠাৎ উগ্র তারস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, ‘ওরে ভোলা, তুই আমার এ কী সর্বনাশ করলি রে! আমার চাকরি যাবে—আমি যে জেলে যাব রে!’

সে থামিতেই অমরেশবাবু তাহার কাঁধে একটা ঝাঁকানি দিয়া বলিলেন, ‘কোথায় রেখেছ চোরাই মাল, বের কর।’

ভূতনাথ অমরেশবাবুর পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িল, ‘হুজুর, ও পাপ জিনিস আমি ছুঁইনি। ডাক-বাক্সর মধ্যেই আছে।’

ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিলাম। পরশু মধ্যরাত্রি হইতে আজ সকাল পর্যন্ত নেকলেস রসময়বাবুর বাড়ির দেয়ালে-গাঁথা ডাক-বাক্সের মধ্যেই আছে।

অমরেশবাবু বলিলেন, ‘বের কর।’

ভূতনাথ উঠিয়া ডাক-বাক্সের দিকে ফিরিল। ডাক-বাক্সে অনেক চিঠি জমা হইয়াছিল, তাহার হাত ঢুকাইয়া বাক্সের পিছন দিকের কোণ হইতে একটি পার্সেল বাহির করিয়া আনিল। সাদা কাপড়ে সেলাই করা ব্রাউন ষোলপেজী বইয়ের মত আকার আয়তন। ভূতনাথ সেটি অমরেশবাবুর হাতে দিয়া কাতরস্বরে বলিল, ‘এই নিন বাবু। ধর্ম জানে এর ভেতর কী আছে, আমি চোখে দেখিনি।’

এই সময় রসময়ের সদর দরজা খুলিয়া গেল। লাঠিতে ভর দিয়া রসময় এবং তাঁহার পিছনে মণিময় ও বধূ। সকলের সদ্য-ঘুম-ভাঙা চোখে সবিস্ময় উদ্বেগ। রসময় বলিলেন, ‘অমরেশবাবু! ব্যোমকেশবাবু? কী হয়েছে? আমার নেকলেস—?’

ব্যোমকেশ অমরেশবাবুর হাত হইতে প্যাকেট লইয়া রসময়ের হাতে দিল, ‘এই নিন আপনার নেকলেস। খুলে দেখুন।’

বেলা আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময় আমরা দু’জনে আমাদের বসিবার ঘরে চৌকির উপর মুখোমুখি উপবিষ্ট ছিলাম। সত্যবতীকে আর এক প্রস্থ চায়ের ফরমাশ দেওয়া হইয়াছে। নেকলেস-পর্বের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলিতেছে।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনর্থক হয়রানি। ডাক-বাক্সটা দোরের পাশেই আছে এটা যদি প্রথমে নজরে পড়ত তাহলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব নিষ্পত্তি হয়ে যেত। কলকাতা শহরে দেয়ালে-গাঁথা অসংখ্য ডাক-বাক্স আছে, কিন্তু হঠাৎ চোখে পড়ে না। ডাক-বাক্সের রাঙা গায়ে ইস্তাহারের কাগজ জুড়ে তাকে প্রায় অদৃশ্য করে তুলেছে। যারা জানে তাদের কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা জানে না তাদের পক্ষে খুঁজে বার করা মুশকিল।

‘প্রথম যখন নেকলেস চুরির বয়ান শুনলাম, তখন তিনজনের ওপর সন্দেহ হল। ভোলা, মণিময় এবং মণিময়ের স্ত্রী, এদের মধ্যে একজন চোর। কিংবা এমনও হতে পারে যে, এই তিনজনের মধ্যে দু’জন ষড় করে চুরি করেছে। মণিময় এবং ভোলার মধ্যে ষড় থাকতে পারে, আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ষড় থাকতে পারে। ভোলা এবং মণিময়ের স্ত্রীর মধ্যে সাজশ থাকার সম্ভাবনাটা বাদ দেওয়া যায়।

‘কিন্তু চুরি যে-ই করুক, চোরাই মাল গেল কোথায়? চুরি জানাজানি হবার একঘণ্টার মধ্যে পুলিস এসে বাড়ির দোতলা তেতলা খানাতল্লাশ করেছিল, কিন্তু বাড়িতে মাল পাওয়া গেল না। একমাত্র ভোলাই দুপুর রাত্রে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু সে বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, দূরে যায়নি। অন্য কোনও লোকের সঙ্গে তার দেখাও হয়নি। ভোলা যদি চুরি করে থাকে, তবে সে নেকলেস নিয়ে করল কী? মণিময় এবং তার স্ত্রীর সম্বন্ধে ওই একই প্রশ্ন—তারা গয়নাটা কোথায় লুকিয়ে রাখল?

‘তিনজনের ওপর সন্দেহ হলেও প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি অবশ্য ভোলা। মণিময় যখন নেকলেস এনে বাবাকে দিল তখন সে উপস্থিত ছিল। কেসের মধ্যে দামী গয়না আছে তা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত নয়। সন্ধ্যের সময় সে গামছা কেনার ছুতো করে বাইরে গিয়েছিল; এইটেই তার সবচেয়ে সন্দেহজনক কাজ। সে যদি বাইরের লোকের সঙ্গে সাজশ করে চুরির মতলব করে থাকে তবে সহকারীকে খবর দিতে যাওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু সে গয়না চুরি করে সহকারীকে দিল কী করে?

‘তারপর ধর মণিময়ের কথা। মনে কর, মণিময় আর তার স্ত্রীর মধ্যে সাজশ ছিল। মনে কর, রাত্রি এগারটার সময় মণিময় ক্লাব থেকে বাড়ি এসেছিল, বাপের দেরাজ থেকে গয়না চুরি করে আবার বেরিয়ে গিয়েছিল; তারপর গয়নাটা কোথাও লুকিয়ে রেখে পৌনে বারটার সময় বাড়ি ফিরে এসেছিল। অসম্ভব নয়; কিন্তু তা যদি হয়, তাহলে ভোলা কি জানতে পারত না? জানতে পারলে সে কি চুপ করে থাকত?’

এই সময় সত্যবতী চা লইয়া প্রবেশ করিল এবং আমাদের সামনে পেয়ালা রাখিয়া হাসি-হাসি মুখে বলিল, ‘এই যে, কচ্ছপের মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি।’

ব্যোমকেশ কটমট করিয়া চাহিল। কিন্তু সত্যবতী তাহার রোষদৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া বলিল, ‘বলছ বল, এখন আমার হাত জোড়া। পরে কিন্তু আবার বলতে হবে।’ বলিয়া সে চলিয়া গেল।

আমরা কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া চা পান করিলাম। কচ্ছপের উপমাটা ব্যোমকেশের পছন্দ হয় নাই, তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না। মনে আমোদ অনুভব করিলাম। এবার সুবিধা পাইলেই তাহাকে কচ্ছপ বলিব।

যাহোক, কিছুক্ষণ পরে সে আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ‘মণিময় আর বৌয়ের ওপর যে সন্দেহ হয়েছিল, সেটা স্রেফ সুযোগের কথা ভেবে। মোটিভের কথা তখনও ভাবিনি। মণিময়ের মোটা টাকার দরকার হতে পারে, তার বৌয়ের গয়নার প্রতি লোভ থাকতে পারে; কিন্তু ওদের পারিবারিক জীবন যতটা দেখলাম তাতে চুরি করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। রসময়বাবু স্নেহময় পিতা, স্নেহময় শ্বশুর। ছেলে এবং পুত্রবধূকে তাঁর অদেয় কিছুই নেই। যা চাইলেই পাওয়া যায় তা কেউ চুরি করে না।

‘ভোলার কথা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। সুযোগ এবং মোটিভ, দুই-ই তার পুরোমাত্রায় আছে। লোকটা ভারী ধূর্ত আর স্থিরবুদ্ধি। হয়তো চাকরিতে ঢুকে অবধি সে চুরির মতলব আঁটছিল এবং মনে মনে প্ল্যান ঠিক করে রেখেছিল। কাল বিকালবেলা মস্ত দাঁও মারবার সুযোগ জুটে গেল। বাড়িতে দামী গয়না এসেছে, কিন্তু গিন্নী সিন্দুকের চাবি নিয়ে তীর্থ করতে চলে গেছেন।

‘ভোলার সাজশ ছিল তার বড় ভাই ভূতনাথের সঙ্গে। ভেবে দেখ, কেমন যোগাযোগ। ভূতনাথ পোস্ট-অফিসে কাজ করে; তার কাজ হচ্ছে রাস্তার ধারের ডাক-বাক্স থেকে চিঠি নিয়ে ঝোলায় ভরে পোস্ট-অফিসে পৌঁছে দেওয়া। হালফিল বৌবাজার এলাকায় তার কাজ; সকাল বিকেল দুপুরে তিনবার এসে সে ডাক-বাক্স পরিষ্কার করে নিয়ে যায়।

‘ভোলা গামছা কেনার ছুতো করে ভূতনাথের কাছে গেল। তাকে বলে এল, সকালবেলা ডাক পরিষ্কার করতে গিয়ে সে ওই ডাক-বাক্সটার মধ্যে একটা প্যাকেট পাবে, সেটা যেন সে নিয়ে না যায়, ডাক-বাক্সতেই রেখে দেয়। তারপর পুলিসের হাঙ্গামা কেটে যাবার পর সেটা বাড়ি নিয়ে যাবে। সাধারণ ডাক-বাক্সে প্যাকেট কেউ ফেলে না, তাই প্যাকেট চিনতে কোনও কষ্ট নেই। বিশেষত এই প্যাকেটে সম্ভবত ঠিকানা লেখা থাকবে না।

‘ভূতনাথ লোকটা ভালমানুষ গোছের। কিন্তু সে লোভে পড়ে গেল। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। চাকরি তো যাবেই, সম্ভবত শ্রীঘর বাসও হবে।

‘কাল বিকেল পর্যন্ত আমি অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম। তারপর যেই দেখলাম মণিময় ডাক-বাক্সে চিঠি ফেলছে অমনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল। ভোলা বলেছিল তার এক ভাই পোস্ট-অফিসে চাকরি করে। কে চোর, কী চুরি করেছে, চোরাই মাল কোথায় আছে, কিছু অজানা রইল না। ভোলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে টুক করে প্যাকেটটা ডাক-বাক্সে ফেলে আবার উপরে উঠে গিয়েছিল। হয়তো দরজার সামনে মিনিটখানেক দাঁড়িয়েছিল হাঁফ নেবার জন্যে। মণিময় যে ক্লাব থেকে ফেরেনি এবং মণিময়ের বৌ যে জানালায় দাঁড়িয়ে স্বামীর পথ চেয়ে আছে তা সে জানত না।

‘আমি যখন ব্যাপার বুঝতে পারলাম, তখন সটান অমরেশবাবুর কাছে গেলাম। ভোলার দাদা ভূতনাথ কী কাজ করে, পোস্ট-অফিসে খবর নিয়ে জানা গেল। তখন বাকী রইল শুধু আসামীদের ফাঁদ পেতে ধরা এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা।’

দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনিয়া দ্বার খুলিলাম। মণিময় দাঁড়াইয়া আছে। হাসিমুখে বলিল, ‘বাবা পাঠালেন।’

ব্যোমকেশ ভিতর হইতে বলিল, ‘আসুন মণিময়বাবু।’

মণিময় ভিতরে আসিয়া বসিল, পকেট হইতে একটি ছোট্ট নীল মখমলের কৌটা লইয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে রাখিল, ‘বাবা এটি আপনার জন্যে পাঠালেন। তিনি নিজেই আসতেন, কিন্তু তাঁর পা—’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না, উপযুক্ত ছেলে থাকতে তিনি বুড়োমানুষ আসবেন কেন? তা—নেকলেস পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন?’

মণিময় হাসিয়া ঘাড় নাড়িল, ‘সে আর বলতে! তিনি আমাকে বলতে বলেছেন, এই সামান্য জিনিসটা আপনার প্রতিভার উপযুক্ত নয়, তবু আপনাকে নিতে হবে।’

‘কী সামান্য জিনিস?’ ব্যোমকেশ কৌটা লইয়া খুলিল; একটা মটরের মত হীরা ঝক্‌ঝক্‌ করিয়া উঠিল। হীরার আংটি? ব্যোমকেশ আংটিটা সসম্ভ্রম চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘ধন্যবাদ। আপনার বাবাকে বলবেন আংটি আমি নিলাম। এটাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি এর উপযুক্ত নই। চললেন না কি? চা খেয়ে যাবেন না?’

মণিময় বলিল, ‘আজ একটু তাড়া আছে। দুপুরের প্লেনে দিল্লী যেতে হবে। ফিরে এসে আর একদিন আসব, তখন চা খাব।’

মণিময় চলিয়া গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভিতর দিক হইতে সত্যবতী প্রবেশ করিল। বোধ হয় পর্দার আড়ালে ছিল। ললিতকণ্ঠে বলিল, ‘দেখি দেখি, কী পেলে?’

ব্যোমকেশ আংটির কৌটা লুকাইয়া ফেলিবার তালে ছিল, আমি কাড়িয়া লইয়া সত্যবতীকে দিলাম। বলিলাম, ‘এই নাও। এটা ব্যোমকেশের প্রতিভার উপযুক্ত নয়, এবং ব্যোমকেশ এর উপযুক্ত নয়। সুতরাং এটা তোমার।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আরে আরে, এ কী!’

আংটি দেখিয়া সত্যবতীর চক্ষু আনন্দে বিস্ফারিত হইল, ‘ও মা, হীরের আংটি, ভীষণ দামী আংটি! হীরেটারই দাম হাজার খানেক।’ আংটি নিজের আঙুলে পরিয়া সত্যবতী ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল, ‘কেমন মানিয়েছে বল দেখি!—ঐ যাঃ, মাছের ঝোল চড়িয়ে এসেছি, এতক্ষণে বোধহয় পুড়েঝুড়ে শেষ হয়ে গেল।’ সত্যবতী আংটি পরিয়া চকিতে অন্তৰ্হিতা হইল।

ব্যোমকেশ তক্তপোশে এলাইয়া পড়িয়া গভীর নিশ্বাস মোচন করিল, বলিল, ‘গহনা কর্মণো গতিঃ।’

বলিলাম, ‘ঠিক কথা। এবং গহনার গতি গৃহিণীর দিকে।’

1 Comment
Collapse Comments

বেতাল পঁচিশি বইটি সংগ্রহ করে আপলোড দিলে ভালো হতো

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *